এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান পর্ব-১৫+১৬

0
193

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৫.

রইস দিলদার ধরা পড়েছে বেশ কিছুদিন হলো। অথচ তার মুখ দিয়ে একটা কোনো তথ্য বের করতে সক্ষম হলো না সামরিক বাহিনী। এমন কোনো টর্চার বাকি নেই যা করা হয় নি তার উপর। তবুও শয়তানটা মুখ ফসকে একটা শব্দও উচ্চারণ করে নি। উল্টো প্রতিবারই শয়তানদের মতো বিশ্রী ভঙ্গিতে হেসে বলে উঠে,

“ আবার শুরু হবে ধ্বংসলীলা। “

সামরিক বাহিনীর তখন দিশেহারা অবস্থা। তাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে। আরেকটা ধ্বংসযজ্ঞ যে অতি সন্নিকটে তা সকলেই আঁচ করতে পারছে। কিন্তু তারা চাইলেই এই বিষয়টা এলান করে সাধারণ মানুষদের জানাতে পারছে না। উপর মহল হতে সেই অনুমতি তাদের মিলে নি। মিলবেই বা কি করে? পুরো ঘটনা না জেনে এমন তথ্য ঘোষণা করলে সাধারণ জনগণ আতংকিত হয়ে পড়বে। শয়তানের দল সতর্ক হয়ে পড়বে। আরো বহু অনিশ্চিত আশংকা রয়েছে।

এক লক্ষ আটচল্লিশ হাজার চারশো ছেষট্টি কিলোমিটার আয়তনের এই দেশে রয়েছে মোট চৌষট্টিটি জেলা। যেকোনো জেলায়ই ঘটতে পারে সেই ধ্বংসযজ্ঞ। সম্পূর্ণ সামরিক বাহিনী নিজ নিজ অবস্থানে প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত। নিজেদের জীবন দিবে তবুও সিভিলিয়ানদের নিরাপত্তাই তাদের সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি।

__________

সারারাত জ্বরে তড়পানো বাণীর পুরোপুরি সম্বিত ফিরে পরদিন বিকাল বেলা। কেবিনের জানালা ভেদ করে প্রবেশ করা বিকেলের নরম আলোয় সে দেখতে পায় একজন নার্স অদূরে দাঁড়িয়ে একটা টেবিলের উপর ফাইলে কিছু একটা লিখছে। বাণীকে নড়েচড়ে উঠতে দেখেই সে দ্রুত বাহিরে চলে যায়।

বাণী অদ্ভুৎ দৃষ্টি মেলে চারিদিকটা একবার দেখে বোঝার চেষ্টা করে সে এখানে কি করছে। মুহুর্তেই তার মনে পরে যায় গত পরশু রাতের সেই বিভৎসকর ঘটনা। মনে মনে ছক কষে সবটা মেলাতেই বাণী বুঝতে পারে তার এই হসপিটালে আসার কারণ কি।

ডক্টর হুমায়রা তড়িঘড়ি করে কেবিনে প্রবেশ করেই বাণীকে দেখে হাস্যজ্বল মুখে বলে উঠে,

“ বাণী! আমাকে চিনতে পারছো? কেমন আছো এখন? “

ডক্টর হুমায়রার মুখপানে তাকাতেই বাণীর মনে পড়ে যায় ২০১৮ সালের ২০ই মে মাসের ঘটনা। বহ্নি যেদিন পৃথিবীতে এসেছিলো। বাণী তখন হাড়ভাঙা মরণ যন্ত্রণায় তড়পাচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরটা তখন কালবৈশাখীর প্রভাবে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অন্ধকারে তলিয়ে। বজ্রপাতের তুলনায়ও অধিক উচ্চস্বরে বাণী চিৎকার করছিলো। তার প্রতিটা চিৎকারে হয়তো হিরণের বাড়ির প্রতিটা ইট নিজেদের কান চেপে ধরেছিলো।

জীবন মৃত্যুর সেই রাতে এই মহিলাটা নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায় মা ও সন্তানকে বাঁচানোর। যেখানে বাণী নিজেই গর্ভের শিশু সহ নিজের মৃত্যু কামনা করছিলো সেখানে এই মহিলা যেন কোনো দেবদূতের ন্যায় সেদিন বাঁচিয়ে নেয় দুটো প্রাণ।

বাণী অতীত হতে ফিরে এসে মলিন মুখে মৃদু মাথা নেড়ে বুঝায় যে সে হুমায়রাকে চিনতে পেরেছে। হুমায়রা এগিয়ে এসে বাণীর কপালে হাত রেখে নিজের পিছু পিছু আসা নার্সকে প্রশ্ন করে,

“ লাস্ট কখন টেম্পারেচার চেক করেছো? “

“ পনেরো মিনিট আগে ম্যাডাম। “

“ কত ডিগ্রী? “

“ ১০২° এখন। “

হুমায়রা বাণীর দিকে তাকিয়ে হেসে শুধায়,

“ তোমার যেই অবস্থা ছিলো আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। লক্ষ্মণ গুলো নিউমোনিয়ার সাথে মিলে যাওয়ায় সেই অনুযায়ী টেস্ট করানো হয়। আল্লাহর শুকরিয়া যে রিপোর্টে সেরকম কিছু আসে নি। কি একটা কাণ্ড ঘটিয়েছো বলো তো! এই সিজনে এতক্ষণ বৃষ্টিতে কেউ ভিজে নাকি? “

কথাটুকু শেষ করেই হুমায়রা স্যালাইনের ড্রিপটা চেক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাণী নীরবে হুমায়রার দিকে তাকিয়ে রয়। কি অদ্ভুত! মহিলা নিজের কথা দ্বারা কি বুঝাতে চাইছেন? বাণীর এই অবস্থার জন্য সম্পূর্ণভাবে বাণী নিজেই দায়ী? দোষটা সম্পূর্ণ বাণীর?

বাণীর তরফ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে হুমায়রা বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,

“ হিরণ সাহেব বাহিরেই আছেন। ডেকে দিবো? “

হিরণের নামটা শুনতেই বাণীর মরে যেতে ইচ্ছে হলো। এই লোকের মুখোমুখি সে হতে চায় না। সে মোটেও প্রস্তুত নয়। হিরণের মুখোমুখি হলে বাণী নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে হিমশিম খাবে। উন্মাদের ন্যায় আচরণ শুরু করবে। অত:পর হয়তো হিরণ রেগে গিয়ে আরো একবার, এই হসপিটালেই…

না। আর কিছু ভাবতে পারে না বাণী। সে ভাঙা গলায় শুধায়,

“ বহ্নি কোথায়? “

ডক্টর হুমায়রা মিষ্টি হেসে বলে,

“ ও বাসায় আছে। “

“ আমি আমার মেয়ের সাথে কথা বলতে চাই। “

বাণীর এক বাক্যের আবদার শুনতেই হুমায়রা নার্স সহ বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর হিরণের ফোন হাতে একা ভিতরে প্রবেশ করে। ফোনটা বাণীর দিকে এগিয়ে দিয়ে ইশারা করে। অর্থাৎ বহ্নি লাইনেই আছে। বাণী নিজের দূর্বল হাতে ফোনটা নিয়ে কানে চেপে ধরে নরম স্বরে শুধায়,

“ মা। “

বহ্নি অপর পাশ হতে প্রফুল্ল গলায় চিৎকার করে উঠে,

“ মাম্মা! “

“ বহ্নি, মা আমার। তুমি খেয়েছো? “

“ হ্যাঁ মাম্মা। ইবাত চাচ্চু আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে। আমার সাথে মুভিও দেখেছে। আমরা অনেকক্ষণ প্লে করেছি। “

বাণী চোখ বুজে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। অবশ্য এটা হওয়ারই ছিলো। তার অনুপস্থিতিতেও ওই বাড়িতে তার মেয়ের কোনো অযত্ন হওয়ার সুযোগ নেই। কারো সেই সাহস নেইও। বহ্নি প্রশ্ন করে,

“ তুমি এখন ঠিক আছো মাম্মা? “

“ হ্যাঁ মা। আমি তাড়াতাড়ি চলে আসবো তোমার কাছে। তুমি ইবাত চাচ্চুকে বিরক্ত করো না। গুড গার্ল হয়ে থেকো। “

বহ্নির সঙ্গে কথা শেষ হতেই বাণী হুমায়রাকে প্রশ্ন করে,

“ কখন ডিসচার্জ করা হবে আমাকে? “

“ আগামীকাল সকালেই ডিসচার্জ করে দিবো। “

বাণী ফোনটা হুমায়রার হাতে দিয়ে শান্ত স্বরে বলে,

“ আমি যত দ্রুত সম্ভব নিজের মেয়ের কাছে ফিরতে চাই। “

হুমায়রা আর কোনো টু শব্দ করে না। সে নীরবে কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে হিরণের মুখোমুখি দাঁড়ায়। হিরণ নিজের ফোনটা পকেটে ভরে নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ কি বললো? “

“ যত দ্রুত সম্ভব বহ্নির কাছে যেতে চায় ও। “

হিরণ ম্লান হাসে। সে ইচ্ছে করেই বাণীর জ্ঞান ফেরা সত্ত্বেও তার সামনে যায় নি। অবশ্য যাওয়ার মুখও নেই তার। পাছে আবার বাণী রেগে কিছু একটা করে বসে! বাণীর আপাতত সবথেকে বড় মেডিসিনই হচ্ছে বহ্নি। মেয়েকে বুকে নিলেই কেবল সে শান্ত হবে।

হিরণের ভাবনার মধ্যেই তার ফোনের নোটিফিকেশন টুংটাং শব্দ করে বেজে উঠে। হিরণ ফোন বের করে ম্যাসেজটা ওপেন করতেই দেখে গোটা ইংরেজি শব্দে লেখা একটি বাক্য।

“ Meet me at 8 pm in my house. “

ম্যাসেজের উপর শমসের মজুমদারের নামটা দেখে কিছুক্ষণ সেই পানে তাকিয়ে রয় হিরণ। গতকাল তার শমসের মজুমদারের সাথে দেখা করার কথা ছিলো। কিন্তু আচানক বাণীর শারীরিক অবস্থার অবনতির ফলে সে যাওয়ার সুযোগ পায় নি। কিন্তু আজ অবশ্যই যেতে হবে।

হিরণ ফোনটা পকেটে চালান করে দিয়ে হুমায়রার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

“ আমার লোকরা এখানে আছে। কোনো প্রয়োজন পড়লে জাস্ট গিভ মি এ কল। এন্ড টেক এ গুড কেয়ার অফ বাণী। “

__________

নরম বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে আছে বাণী। শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে তার রুমে অবস্থানরত নার্সের দিকে। মেয়েটাকে যে তার পাহারা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এখানে রাখা হয়েছে তা নিয়ে বাণীর কোনো সন্দেহ নেই। তবে তার মাথায় চলছে অন্য পরিকল্পনা। এটাই এক মোক্ষম সুযোগ। হসপিটালের মতো একটা জনমানব পূর্ণ জায়গা, তার উপর আবার হিরণ নাকি বাসায় গিয়েছে। রাতে ফিরবে বলে জানিয়েছে। সব মিলিয়ে উপরওয়ালা যেনো স্বয়ং বাণীর জন্য পথ খুলে দিলেন।

ভাগ্যিস বাণী তখন বলেছিলো যে সে দ্রুত বহ্নির কাছে ফিরতে চায়। হিরণের কান পর্যন্ত নিশ্চয়ই এই কথা পৌঁছেছে? হিরণ তারমানে এখন এই ব্যাপারে আশ্বস্ত যে বাণীর ইচ্ছা হলো ঘরে ফিরে যাওয়া। তা ভেবে হিরণ এখন এইদিকে তেমন একটা মাথা ঘামাবে না। আর সেই সুযোগটাই বাণীর কাজে লাগাতে হবে। তবে তার পূর্বে বাণীর এই কেবিনের বাহিরের পরিস্থিতি পরখ করতে হবে। কিন্তু তা কিভাবে করবে সে?

_________

শমসের মজুমদারের আলিসান বাড়ির লিভিং রুমের বিশাল ঝাড়বাতির নিচে পায়ের উপর পা তুলে বসে রয়েছে হিরণ। তার পড়নে এখন ফর্মাল প্যান্ট, শার্ট ও কোট। তার মুখোমুখিই ঠিক অপর পাশের সোফাটায় বসে রয়েছে শমসের মজুমদার। যিনি আপাতত বেশ আয়েশ করে নিজের হাতের কাপে থাকা মালাই চায়ে চুমুক বসাতে ব্যস্ত।

হিরণ স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করে,

“ আব্রাহামের সাথে কথা হয়েছিলো? “

শমসের মজুমদার হাতের চায়ের কাপটা কাচের টি টেবিলের উপর রেখে বলে,

“ কথা হয়েছে। কালকের মিটিংয়ে তোমারও উপস্থিত থাকার কথা ছিলো প্রয়োজনীয় অস্ত্রসহ। সেই অস্ত্রগুলো ওদের বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটা তোমার ছিলো। যা পালন করতে তুমি ব্যর্থ হয়েছো। “

হিরণ নিজেকে স্বাভাবিক রাখে। বোঝার চেষ্টা করে শমসের মজুমদারের কথার দিক। অত:পর শান্ত গলায় বলে,

“ আমি অস্ত্র সাথে করে নিয়ে এসেছি। আপনি এগুলো আব্রাহামদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করুন। বাকিটা আমি ওকে ফোনে বুঝিয়ে দিবো। “

কথাটা বলে হিরণ চোখের ইশারা দিতেই তার অধিনভূত একজন একটা বিশাল সুটক্যাস এনে টি টেবিলের উপর রাখে। ব্যাগের চেইন খুলতেই দেখা যায় ব্যাগ ভর্তি অসংখ্য বিদেশি অস্ত্র। এই অস্ত্রগুলো হিরণের কোম্পানির তৈরী নয়। সে খাসভাবে বিদেশ হতে আনিয়েছে এগুলো। এগুলো আনাতে তার কম কাঠখড় পোহাতে হয় নি!

অস্ত্রগুলো দেখতেই শমসের মজুমদারের চোখ চিকচিক করে উঠে। সেই দৃশ্য দেখে হিরণ বাকা হাসে। তার আর এখানে কোনো কাজ নেই আপাতত। তাই সে নীরবে উঠে আসছি বলে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। ঠিক সেই মুহুর্তে শমসের মজুমদার বলে উঠে,

“ শুনলাম বৌ মা নাকি অসুস্থ। গুরুতর কিছু না আশা করি। “

হিরণের পা থেমে যায়। শয়তানটা তবে তার উপর নজর রাখিয়েছে। মনের রাগটা চেপে গিয়ে হিরণ পিছনে ফিরে স্বাভাবিক গলায় বলে,

“ সামান্য জ্বর শুধু। “

শমসের হেসে চায়ের কাপে ফের চুমুক দেওয়ার আগে বলে উঠে,

“ দেখে রেখো বৌ মা’কে। কারণ যেই হসপিটালে বৌ মা’কে এডমিট করিয়েছো সেই হসপিটালেরই অষ্টম তলায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবার মেয়েও রয়েছে। “

অপ্রত্যাশিত খবরটা শুনতে পেয়ে হিরণ অবাক হয়। জুলফিকার মুজতবার মেয়ে মানে? হসপিটালটায় সামরিক বাহিনীর আনাগোনা রয়েছে তাহলে? এতো বড় তথ্যটা শমসের মজুমদার জেনেও চুপ করে ছিলো? আর হিরণের লোকেরা? তারা কি অন্ধ নাকি? একজনেরও চোখে পড়ে নি বিষয়টা। প্রশ্নগুলো ভাবতে ভাবতেই হিরণ দ্রুত পা চালায়। তার এই মুহুর্তে হসপিটালে পৌঁছাতে হবে। ভেবেছিলো আজকের রাতটা বাণীকে হসপিটালে রাখবে। কিন্তু না। আর সম্ভব নয়।

হিরণ বেরিয়ে যেতেই শমসের মজুমদার একা একাই কুটিল হাসে। বেশ মজার খেলা তো! পোষ্য কুকুরের সাথে খেলারও অন্য এক মজা আছে।

__________

তীব্র উৎকন্ঠায় ঢোক গিললো বাণী। অন্ধকার কেবিন রুমে দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকা দেহটা যেনো নড়তেও ভুলে গেছে। দরজার বাহিরে এক ঝাঁক পায়ের দৌড়ের শব্দ কানে পৌঁছাতেই সে নিজের নিঃশ্বাসটুকুও আটকে ফেললো। যদি তার নিঃশ্বাসের শব্দ কেউ টের পেয়ে যায়?

পদধ্বনি ক্ষীণ হয়ে আসতে আসতে একটা সময় দরজার বাহিরে জায়গাটা সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ শোনা যায়। বাণী তখন পরিকল্পনা অনুযায়ী ধীরে ধীরে দরজার নব ঘুরিয়ে কেবিনের বাহিরে উঁকি মারে। সম্পূর্ণ করিডর শূন্য। কিছুক্ষণ আগের শক্ত নিরাপত্তার টিকিটুকুও এখন নেই। কি করতে চলেছে ভেবেই ভয়ে বাণীর শিরদাঁড়া বেয়ে ঘাম চুইয়ে পড়ে। আকাশটাও কেমন গুমোট স্বরে ডাকছে। বাণী আর অপেক্ষা করে না। দ্রুত পা চালিয়ে সে চলে যায় ইমারজেন্সি ফায়ার এক্সিট ওয়েরের দিকে। ইচ্ছে করেই নিজের গায়ের জামা বদলে সে একটা হসপিটাল গাউন পড়ে নিয়েছে। যেনো সহজে কারো নজরে না পরে। শুকনো চুলগুলো দিয়ে যথাসম্ভব নিজের মুখ আড়াল করে রাখার চেষ্টা করছে সে। ইমারজেন্সি ফায়ার এক্সিট ওয়ের দরজা পেরিয়ে সিড়ির কাছাকাছি গিয়েই সে যতদ্রুত সম্ভব পা চালায়।

তেরো তলা হতে নামাটা যদিও বাণীর মতো হালকা দেহের মানুষের জন্য তেমন একটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার না। কিন্তু বাঁধ সেধে দাঁড়িয়েছে তার শরীরের দূর্বলতা। এই শরীর নিয়ে নয় তলায় নামতেই সে হাঁপিয়ে উঠে। কিন্তু থামলে চলবে না। তার দ্রুত নামতে হবে। হিরণের লোকেরা প্রধান স্টেরওয়ে এবং লিফট গুলো খুঁজে বাণীকে না পেলে নিশ্চয়ই এই সিঁড়ি পথ এসে খুঁজবে? ভাবনাটা মনে উঁকি দিতেই বাণী একটা বড় নিঃশ্বাস টেনে ফের সিঁড়ি ভেঙে নামা শুরু করে।

প্রায় পনেরো মিনিটের মাথায় বাণী গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসে নামে। কিন্তু বের হয়ে মেইন এন্টারেন্সের দিকে যেতে নিয়েই বাণী দ্রুত ফিরে আসে। হিরণের লোকেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সাধারণ মানুষের ভীড়ে। এদের টেক্কা দিয়ে এখান থেকে পালানো মোটেও সম্ভব নয়।

বাণী মুহুর্তেই অস্থির হয়ে পড়ে। এবারও কি ব্যর্থ হবে সে? হিরণ? তার কাছে কি খবর পৌঁছে গিয়েছে? ধরা পড়লে হিরণ আবারও কি তার সাথে একই কাজ করবে? সম্ভাবনা গুলো মস্তিষ্কে উঁকি দিতেই বাণী দূর্বল হয়ে পড়ে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। তখনই আচমকা তার দৃষ্টি পড়ে নিচের দিকে চলে যাওয়া সিঁড়ির দিকে। নিচে বেসমেন্টে আবার কি আছে? বের হওয়ার কি কোনো রাস্তা রয়েছে?

প্রশ্নটা মনে উঁকি দিতেই বাণী দ্রুত সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সিঁড়ি ভেঙে বেসমেন্টে নামতেই সে দেখে নীরব বিশাল এরিয়া জুড়ে রয়েছে গাড়ি পার্কিং এর ব্যবস্থা। বাণী চারিদিকটা একবার পরখ করে। সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় রয়েছে এই বেসমেন্টটা। বাণী আরো একবার চারিদিকে তাকায়। অদূরে সে একটি কালো রঙের জিপ গাড়ি দেখতে পাচ্ছে। গাড়িটা যেই পজিশনে রাখা সেই পজিশনে সিসিটিভিতে কেবল গাড়ির সামনের অংশ দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ গাড়ির পেছনের নাম্বার প্লেট দেখার কোনো সুযোগ নেই।

বাণী আর অপেক্ষা করে না। সে আরো একবার ভালো করে নিজের চুলগুলো যত সম্ভব মুখের সামনে ফেলে চেহারাটা আড়াল করে ফেলে নিজের অত:পর খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে এগিয়ে যায় সেই গাড়ির পিছনের দিকে। দ্রুততার সহিত সবার আগে সে টেনে হিচড়ে গাড়ির নাম্বার প্লেটটা খুলে নিজের হাতে নিয়ে নেয়। অত:পর গাড়ির রেয়ার বোনাট খোলার চেষ্টা করে সে। কিন্তু আফসোস! গাড়ি লকড থাকায় বোনাট খোলার চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

বাণী আরো কয়েকবার চেষ্টা করতে নিলেই তখনই কারো পদধ্বনির শব্দ ভেসে আসে। বাণী ভয়ে সঙ্গে সঙ্গে মাথা নত করে গাড়ির পিছনে লুকিয়ে পড়ে। পদধ্বনি ধীরে ধীরে এদিকেই এগিয়ে আসছে। বাণীর বুক তখন ঢিপঢিপ করে লাফাচ্ছে। হিরণের লোকেরা না তো?

গভীর করে নিঃশ্বাস নিয়ে বাণী যখন আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত ঠিক সেই মুহুর্তেই সামনে থেকে গাড়ির দরজা খোলার শব্দ হয়। বাণী চকিতে উঁকি মারে আড়াল হতে। কিন্তু গাড়ির মালিক ততক্ষণে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসেছে। বাণীর চোখ জোড়া চিকচিক করে উঠে। সে মনে মনে আল্লাহর দরবারে লাখ কোটি শুকরিয়া জানিয়ে অতি সাবধানে এবং নিঃশব্দে গাড়ির রেয়ার বোনাট খুলে ভেতরে উঠে বসে। সঙ্গে করে সেই নাম্বার প্লেট নিতেও ভুলে না সে। বোনাটের দরজাটা লাগিয়েই বাণী মনে মনে গাড়ির মালিককে অসংখ্য ধন্যবাদ জানায়। নিশ্চিত আল্লাহই এই মানুষকে পাঠিয়েছে তার সাহায্যের জন্য। মুক্ত পাখির চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে আনন্দ অশ্রু।

__________

পথিমধ্যে অবাধ্য আকাশ হতে টুপটুপ করে বৃষ্টির বর্ষণ শুরু হয়। কালো শার্ট পরিহিত পুরুষ গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাতটা নিবদ্ধ রেখে একবার জানালা ভেদ করে আকাশ পানে তাকায়। চট্টগ্রামের বৃষ্টি এরকমই হয়। কোনো আগাম বার্তা ছাড়া অসময়ের মেহমানের ন্যায় হুটহাট হাজির হয়।

আকাশ পান হতে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ফের পথে দৃষ্টি স্থির করে সেই চোখ জোড়া। আচমকা নিস্তব্ধ গাড়ির ভেতর শোনা যায় অদ্ভুত এক শব্দ। মুহুর্তেই প্রশস্ত হাইওয়ের মাঝে থেমে যায় কালো জিপটি। গাড়ির মালিক বিস্ময় ভরা দৃষ্টি মেলে লুকিং মিরর দিয়ে গাড়ির পেছনের দিকে তাকায়। না। কেউ নেই। তবে কি সে ভুল শুনলো? উঁহু। কোনো সম্ভাবনাই নেই।

গাড়ির মালিক বেশ সচেতন। সে অতি সাবধানে তার পাশের ফ্রন্ট সিটে থাকা কালো রঙা রেইনকোটটা গায়ে জড়িয়ে নেয়। অত:পর সামান্য ঝুঁকে প্যান্ট সামান্য উঁচু করে পায়ের মোজার কাছের জায়গাটা হতে একটা কালো রঙা রিভলবার বের করে সে। বিনা শব্দ ব্যয়ে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই গাড়ি হতে নেমে ধীরে ধীরে গাড়ির পেছনের দিকে এগিয়ে যায় সে। গাড়ির পিছন দিকটায় এসে দাঁড়াতেই তার ভ্রু যুগল কুচকে আসে। তার গাড়ির পরিচয়পত্র অর্থাৎ তথাকথিত আইডি কার্ড কোথায়?

প্রশ্নটা মনে উঁকি দিতেই সে এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে গাড়ির রেয়ার বোনাটটা তুলে। সঙ্গে সঙ্গে সে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। রেয়ার বোনাটের ভেতর আশ্রয় নেওয়া এক জোড়া চোখও তাকে দেখে চমকে উঠে। কিন্তু সেই চমকানো বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়না। তার পূর্বেই সে মাথা নত করে চিকন স্বরে ফের উচ্চারণ করে,

“ হাচ্চি! “

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৬.

চল্লিশ মিনিটের পথ আধ ঘন্টায় পাড়ি দিয়ে হসপিটালে এসে পৌঁছায় হিরণ। ভীষণ অস্থিরতা কাজ করছে তার ভেতর। গাড়ি হতে নামার পূর্বে মুখে সতর্কতার সহিত মাস্কটা পড়ে নেয় সে। অত:পর বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে এগিয়ে যায় হসপিটালের ভিতরের দিকে। কিন্তু হসপিটালের ভেতর প্রবেশ করতেই সে অবাক হয়। ইবাত? ও এই মুহুর্তে হসপিটালে কি করছে? ওর তো বাসায় থাকার কথা। মনের প্রশ্ন চেপে গিয়ে নীরবে ইবাতের দিকে এগোয় সে।

হিরণকে এগোতে দেখে ইবাত ভীত হয়ে পড়ে। স্যার নিশ্চয়ই সবার আগে প্রশ্ন করবে যে ইবাত এখানে কি করছে? তখন ইবাত কি জবাব দিবে? যে এই আহাম্মকের দলের নাকের নিচ দিয়ে ম্যাডাম পালিয়ে গিয়েছে? আর আহাম্মকের দল সেই খবর জানিয়ে ইবাতকে এখানে ডেকে এনেছে?

ইবাতের ভাবনার ভীড়ের মধ্যেই হিরণ তার সামনে এসে দাঁড়ায়। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নিচু গলায় প্রশ্ন করে,

“ তুমি এখানে কি করছো? বহ্নিকে রেখে কোথাও যেতে নিষেধ করি নি তোমায়? “

ইবাত কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই হিরণ লিফটের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে উঠে,

“ এখানে আর কথা বলতে হবে না। উপরে চলো। সেখানে গিয়ে কথা হবে। “

ইবাত নীরবে হিরণের পিছু পিছু পা চালায়। উপরে গিয়ে স্যারকে বিষয়টা জানানোই উত্তম মনে করে সে। এখানে জানালে যদি কোনোরকম রিয়েক্ট করে বসে উনি?

__________

থমথমে একটা মুখ অতি শান্ত ভঙ্গিতে গাড়ি চালাতে ব্যস্ত। তার ঠিক পাশের সিটেই বসে থাকা মানবী ভীত দৃষ্টি নত করে বসে রয়েছে। পড়নের হসপিটাল গাউনটা এখন হাঁটুর নিচ সমান রেইনকোটের আবরণে আর দেখা যাচ্ছে না। মনে তার অসংখ্য সংশয়। এ কেমন অদ্ভুত কাকতালীয় ঘটনা? পুরো চট্টগ্রাম শহরে কি গাড়ির অভাব, যে প্রতিবারই তার ঘুরেফিরে দূর্জয়ের গাড়িতেই উঠতে হয়? এই কালো জিপের সাথে কি অদ্ভুৎ এক ম্যাগনেটিক সম্পর্কে বাঁধা পড়লো সে!

হঠাৎ কানে ব্রেক কষার তীব্র শব্দ হলো। সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়েও সিট বেল্টের কারণে ফের সোজা হয়ে যায় বাণী। ভীত দৃষ্টি তুলে গাড়ির কাঁচ ভেদ করে সামনে তাকাতেই সে একটা ঢোক গিলে। সেই হাইওয়ের তুলনায়ও সুনসান জায়গায় এনে গাড়িটা থামিয়েছে দূর্জয়। কারণ কি? উদ্দেশ্য কি?

প্রশ্নগুলো মনে উঁকি দিতেই নীরব গাড়ির ভেতর গম্ভীর স্বরটা প্রশ্ন ছুড়ে,

“ হোয়াট ইজ রং উইথ ইউ? “

বাণীর মাথাটা মৌমাছির মতো ভোঁ ভোঁ করছে। আপাতত বুঝ দেওয়ার জন্য মনে মনে একটা উত্তর সাজায় সে। অত:পর তা বলার জন্য মুখ খুলতে নিলেই দূর্জয় তাকে সতর্ক করে,

“ আমি কোনো ধরনের মিথ্যা শোনার জন্য প্রস্তুত নই। ডোন্ট প্লে উইথ মাই পেসেন্স। স্পষ্ট ভাষায় শুধু সত্যিটুকু বলো। “

বাণীর কণ্ঠরোধ হয়ে আসে। এ কি বিপদে পড়লো সে! কি করবে সে? সেনা সদস্য এই দূরদর্শী পুরুষ হলফ করে তার মিথ্যা ধরতে সক্ষম। কোনো কূল কিনারা না পেয়ে বাণী একহাত বাড়িয়ে নিজের পাশে গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করে। কিন্তু দরজাটা খুলে না। উল্টো দূর্জয় বিরক্ত মিশ্রিত গলায় শুধায়,

“ দরজাটা লকড। অযথা চেষ্টা চালানো বন্ধ করো৷ “

বাণী দূর্জয়ের কথাটা শুনে। নীরবে নিজের হাতটা সরিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসে সে। সিটের গায়ে পিঠ এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে নেয়। শরীরটা দূর্বল লাগছে বেশ। জ্বরটা আবার বাড়ছে নাকি? বাড়তেও পারে। গাড়ির বোনাট হতে সামনের সিটে এসে বসার সময় গায়ে রেইনকোটটা জড়ানো থাকলেও বাতাসের দাপটে বৃষ্টির পানির সংস্পর্শ হতে বাঁচতে পারে নি সে।

দূর্জয় এক পলক বাণীকে পরখ করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। অসুস্থ মনে হচ্ছে মেয়েটাকে। কে জানে তার বিহাইন্ড দ্যা স্টোরি কি? দূর্জয় বাণীকে সময় দেয়, অপেক্ষা করে।

আচমকা বাণী অদ্ভুৎ ভঙ্গিতে দৃষ্টি মেলে তাকায়। ভীত সেই দৃষ্টি। অস্থির গলায় দূর্জয়কে শুধায়,

“ আপনি একজন সোলজার তাই না? কোন পদে আছেন আপনি? আপনার ক্ষমতা কতদূর? “

বাণীর অদ্ভুত তিনটা প্রশ্ন শুনে দূর্জয়ের ভ্রু কুচকে আসে। তবুও সে স্বাভাবিক গলায় পাল্টা প্রশ্ন করে,

“ সেই ব্যাপারে তোমার কৌতূহলের কারণ জানতে পারি? “

বাণী অস্থির গলায় জবাব দেয়,

“ ইট ইজ এ সিরিয়াস ম্যাটার। দয়া করে আমাকে বলুন। “

দূর্জয় বাণীর চোখের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটার গুরুত্ব উপলব্ধি করে। অত:পর বেশ ছোট এক শব্দে নিজের পরিচয়, পদ এবং ক্ষমতা সম্পর্কে জানায়,

“ মেজর। “

বাণী আন্দাজ করে একজন সৈন্য সদস্য হিসেবে এই পদটা খুব সাধারণ কিংবা ছোট কোনো পদ নয়। এর গুরুত্ব এবং গাম্ভীর্য রয়েছে। তাই সে সাহস সঞ্চয় করে আবদার সুরে বলে,

“ একটা সাহায্য করুন। “

দূর্জয় সরু চোখ মেলে প্রশ্ন করে,

“ কি ধরনের সাহায্য? “

দূর্জয়ের প্রশ্নের পিঠে বাণী রুদ্ধস্বরে অনেকগুলো কথা বলে চুপ হয়। সবটা শুনে দূর্জয় বেশ অবাক হয়। এতক্ষণ সে বাণীর কেসটা যতটা জটিল ভাবছিলো এই মুহুর্তে বাণীর কথা শুনে সে আরো জটিল কিছু আন্দাজ করছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছে বাণী তালুকদারের বর্তমানটা রহস্যে ঘেরা অমীমাংসিত একটা কেসের মতো। যেই কেসটা মীমাংসা করার প্রবল আগ্রহ দূর্জয় নিজের মধ্যে টের পাচ্ছে।

দূর্জয় শান্ত গলায় প্রশ্ন করে,

“ আমি তোমাকে এই সাহায্যটা ঠিক কি কারণে করবো বলতে পারো? “

বাণী চোখ বুজে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। অত:পর উত্তর দেয়,

“ আপনার মধ্যে এই মুহুর্তে আগ্রহ কাজ করছে। যেই আগ্রহ দমনের একমাত্র উপায় আমার মুখে উচ্চারিত সত্য। আপনি আমাকে এই সাহায্যটা করুন, বিনিময়ে আমি আপনাকে সত্যটা জানাবো। “

__________

দমবন্ধ পাখির ন্যায় ছটফট করছে ডক্টর হুমায়রা। পা জোড়া সমতল ভূমির স্পর্শ পেতে ব্যকুল হয়ে রয়েছে। গলা দিয়ে চাইলেও কোনো শব্দ বের করতে পারছে না সে। কানের কাছে ভেসে আসে পুরুষালী গলায় হিসহিসিয়ে বলা কিছু কথা,

“ কিভাবে পালালো? এতগুলো মানুষ নিযুক্ত থাকতে কি করে পালালো? “

ডক্টর হুমায়রার অবস্থা দেখে সকলে ভয়ে তটস্থ হয়ে রয়৷ সবথেকে বেশী ভীত দেখাচ্ছে বাণীকে পাহারা দেওয়ার দায়িত্বে নিযুক্ত নার্সকে। তার খুব বলতে ইচ্ছে হয়,

“ আপনার স্ত্রী একজন ধূর্ত মহিলা। তিনি আমার চোখে ধূলো ছুড়ে পালিয়েছে। “

কিন্তু সে আর কথাটা বলার সাহস পায় না। ইবাত ইতিমধ্যে এগিয়ে এসে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য শুধায়,

“ স্যার, প্লিজ কাম ডাউন। ম্যাডামকে খুঁজতে হবে আগে। “

হিরণের কানে যেনো ইবাতের বলা কথাগুলো পৌঁছালো না। সে আরো দৃঢ়ভাবে হুমায়রার গলা চেপে ধরে। ইবাত গলার স্বর নিচু করে ফের বলে,

“ স্যার এটা হসপিটাল। নিজেকে সামলান। পরিস্থিতি বিগড়ে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। “

হিরণ ফোস ফোস করতে করতে হুমায়রার গলাটা ছেড়ে দেয়। মুহুর্তেই তিনি টাইলস বসানো ফ্লোরে বসে পড়েন। দু হাতে গলা ধরে কাশতে শুরু করেন। খানিকটা অক্সিজেনের অভাবে যেনো মরতে বসেছিলো।

হিরণ চেঁচিয়ে উঠে,

“ বাণী কিভাবে পালালো? “

হিরণের বাজখাঁই গলার দাপটে ভীত নার্স এইবার মুখ খুললো,

“ উনি ওয়াশরুমে যেতে চেয়েছিলেন। আমি উনাকে সাথে করে নিয়ে ওয়াশরুমে যেতেই উনি আচমকা শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যান। আমি দ্রুত ডক্টরকে ডাকতে কাউন্টার এরিয়ার ওদিকে ছুটি। ডক্টর হুমায়রা সহ ফিরে এসে দেখি ওয়াশরুমের দরজার সামনে আপনার একজন লোক পড়ে আছেন আর ম্যাম কোথাও নেই। “

নার্সের কথা শেষ হতে না হতেই হিরণের সেই গার্ড বলে উঠে,

“ স্যার আমি নার্সকে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে দেখে কেবিনে প্রবেশ করি ম্যাম ঠিক আছে কি-না দেখার জন্য। কিন্তু হঠাৎ মাথায় ভারী কিছুর আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যখন জ্ঞান ফিরে তখন শুনি ম্যামকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। “

হিরণ রেগে কিছু একটা বলতে নিবে তার পূর্বেই ইবাত উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে বলে,

“ স্যার এই মুহুর্তে রেগে কোনো লাভ নেই। আমাদের আগে সিসিটিভি ফুটেজ চেক করতে হবে। তাহলে আমরা জানতে পারবো ম্যাডাম কোথায় গিয়েছে। “

অতি রাগে হিরণ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো। তবে ইবাতের কথাটা তার মস্তিষ্কে পৌঁছে। মুহুর্তেই সে হুকুম জারি করে গত এক ঘন্টায় ধারণকৃত সিসিটিভি ফুটেজ ম্যানেজ করে দ্রুত নিয়ে আসতে। ইবাত এক মুহুর্ত দেরি না করে হসপিটালের কন্ট্রোল প্যানেল এরিয়ায় দৌড়ে চলে যায় সিসিটিভি ফুটেজের ক্লিপ ম্যানেজ করে নিয়ে আসার জন্য।

হিরণ অস্থির পায়ে পায়চারি করতে থাকে কাউন্টার এরিয়া জুড়ে। ডক্টর হুমায়রা তখনও ফ্লোরে বসে অক্সিজেনের ঘাটতি অনুভব করছে। চোখমুখ তার সম্পূর্ণ কালো হয়ে গিয়েছে। মনে মনে সে-ও অনুভব করে তীব্র ক্ষোভ। সেই ক্ষোভের জোরেই হুমায়রা হিরণের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে,

“ মানুষের উপর রাগ ঝাড়ার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন, যে আপনি কি এমন করেছেন যে আপনার স্ত্রী আপনার থেকে পালাতে চায়? নিজের মস্তিষ্ক দিয়ে বিবেককে প্রশ্ন করুন দোষটা কার? “

হিরণ ক্ষিপ্র দৃষ্টি মেলে হুমায়রার পানে তাকায়। তার বিগড়ে যাওয়া মেজাজে ডক্টর হুমায়রার প্রশ্নটা আরো বিরূপ প্রভাব ফেলে। হিরণ রাগী সুরে আদেশ করে,

“ আমার চোখের সামনে থেকে এই মহিলাকে নিয়ে যাও। আমি আর এর চেহারা দেখতে চাই না। “

বিশ মিনিটের ভেতরই ইবাতের কল আসে হিরণের কাছে। হিরণ কিছু বলবে তার পূর্বেই ইবাত বলে উঠে,

“ স্যার, ম্যাডাম ফায়ার এক্সিট ওয়ে দিয়ে পালিয়েছে। উনাকে বেসমেন্টের দিকে যেতে দেখা গিয়েছে সর্বশেষ। কিন্তু বেসমেন্টে যাওয়ার পর আর কি হয়েছে তা জানা যায়নি। পার্কিং এরিয়ার সিসিটিভি ফুটেজ ডিলিট করে ফেলেছে কেউ। “

ইবাতের বলা কথাগুলো শুনতেই হিরণ অবাক হয়। ডিলিট করে ফেলেছে মানে? কে করেছে? প্রশ্নটা মাথায় উঁকি দিতেই হিরণ গরম গলায় শুধায়,

“ বাণীকে কেউ সাহায্য করছে ইবাত। খুঁজে বের করো। বাণী আর ওই সাহায্যকারী দু’জনকে খুঁজে বের করো যেকোনো মূল্যে। “

__________

নীরব রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে সাদাত। রাস্তার মাথায় থাকা একটা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় রাস্তাটা মৃদু আলোকিত হয়ে রয়েছে। ফুটপাতের একপাশে শুয়ে রয়েছে দুটি অলস কুকুর। সাদাতের হাঁটার ভঙ্গি আপাতত খুবই সাধারণ। টানটান সোজা হয়ে বুক চওড়া করে দাঁড়ানোর কোনো লক্ষণ নেই তার মাঝে। থাকবেই বা কেনো? এটা তার খুব একান্ত সময়। যেখানে পেশাগত বাধ্যবাধকতার কোনো বালাই নেই। কেবল রয়েছে সে, এই নিস্তব্ধ রাত এবং তার কানে চেপে ধরা মুঠোফোনটি। যেই মুঠোফোনের অপরপ্রান্তে অন্য এক শহরে রয়ে যাওয়া তার আপনজনেরা রয়েছে। সাদাত মিষ্টি হেসে শুধায়,

“ সাওদার রেজাল্ট শুনলাম আম্মু। অনেক খুশি হয়েছি। দেখে নিও তোমার এই মেয়ে ঠিকই একদিন বিসিএস ক্যাডার হতে পারবে। “

ফোনের অপর পাশ হতে মধ্যবয়স্কা একজন পৌঢ় নারী চিন্তার আঁচ সহ বলে উঠে,

“ তুই কবে আসবি বাবা? এই মিশন আর কতদিন চলবে? “

“ নিশ্চিত না আম্মু। তুমি দোয়া রেখো যেনো নিরাপদে ফিরতে পারি। “

“ আমার সব দোয়া তো তোদের জন্যই। “

“ আচ্ছা আম্মু, আমি কালকে সুযোগ বুঝে কিছু টাকা পাঠাবো। সাওদাকে ওর পছন্দ মতো জামা কিনে দিও। সায়রা আর তোমার জন্যও কিছু কিনে নিও। সামনে কোরবানির ঈদ আসছে। “

“ এসবের কি দরকার? ওদের কি জামাই নেই নাকি? আর ঈদ তো এখনও অনেক দূরে। “

“ দরকার কি দরকার না এতো কিছু ভাবতে হবে না তো। তুমি শুধু যা বলছি তা করো। আর… “

মাঝপথেই সাদাতের কথা থেমে যায়। তবে তার পা জোড়া থামে না। বরং পায়ের গতি মৃদু ধীর হয়ে আসে। দৃষ্টি হয় সতর্কপূর্ণ। আপনজনের সাথে ফোনালাপের ইতি টেনে বলে,

“ আচ্ছা আম্মু, পরে কথা হবে। এখন রাখি। “

কথাটুকু বলেই ফোনটা পকেটে ভরে সে আচমকা পিছনে ফিরে তাকায়। শূন্য জনমানবহীন রাস্তায় কারো অস্তিত্ব নেই। সাদাত নীরবে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে।

লম্বা বিল্ডিংটার আড়ালে একটা ছায়া সটান ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেকেন্ড ত্রিশ পাড় হতেই সে অতি সাবধানে মাথাটা বের করে রাস্তায় উঁকি মারে। রাস্তাটা শূন্য দেখতেই সে বেশ অবাক হয়। সতর্ক দৃষ্টি মেলে ভালোভাবে চারিদিকটা পরখ করে। না। একটু আগে রাস্তায় ফোনালাপে ব্যস্ত পুরুষের কোনো চিহ্ন এই মুহুর্তে দেখা যাচ্ছে না। চোখের পলকে কোথায় চলে গেলো?

ছায়াটা এবার সোজা হয়ে সম্পূর্ণ বেরিয়ে এলো বিল্ডিংয়ের আড়াল হতে। ধীর পায়ে সতর্ক দৃষ্টি মেলে এগোতে এগোতে পৌঁছে যায় সামনের দিকে। ফুটপাত ধরে রাস্তার মাঝামাঝি এসে দাঁড়ায় সে। ফোনালাপে ব্যস্ত সেই পুরুষের খোঁজে বিশেষ দৃষ্টিটা বর্তায় চারিদিক জুড়ে।

ঠিক সেই মুহুর্তে ফুটপাতের পাশে দুই বিল্ডিংয়ের মধ্যকার অতি সরু গলি হতে এক জোড়া হাত তার মুখ চেপে ধরে এবং হাত টেনে গলির ভেতর তাকে নিয়ে যায়।

সেই ছায়া মানবীকে দেয়ালের সঙ্গে এমনভাবে চেপে ধরেছে সাদাত যেনো সামান্য নড়ার সুযোগটুকুও নেই। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মানবীর দিকে স্থির করতেই মৃদু আলোয় দেখতে পায় গায়ে লম্বা রেইনকোট, জিন্স এবং বুট শু পরিহিত নারী অনেকটা অপ্রস্তুত দৃষ্টি মেলে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। অপ্রস্তুত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকা সেই নারীকে চিনতে এক মুহুর্ত দেরি হয় না সাদাতের। সে জ্বলজ্বল করা রাগী দৃষ্টি মেলে হিসহিসিয়ে বলে উঠে,

“ উদ্দেশ্য কি তোমার মেয়ে? আমাকে ফোলো করছো কেনো? কে পাঠিয়েছে তোমাকে? “

সেই নারী চোখের ইশারায় বলে তার মুখ থেকে হাত সরাতে। সাদাত এক মুহুর্ত মেয়েটার হাবভাব পর্যবেক্ষণ করে মেয়েটার মুখ থেকে নিজের হাত সরায়। তবে অন্য হাতে শক্ত করে তার বাহু ধরে রাখে এ বুঝিয়ে দিতে যে পালানোর কোনো উপায় নেই।

সাদাত আশা করছিলো মেয়েটা হয়তো আমতা আমতা করবে কিংবা কোনো সাফাই গাইবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটা হেসে রহস্যময় গলায় বলে উঠে,

“ কি বস? কেসটা কি বলো তো? তুমি কি খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ যাকে রাতের আঁধারে মানুষের ফোলো করার সম্ভাবনা রয়েছে? “

প্রশ্নের প্রেক্ষিতে পাল্টা প্রশ্ন সাদাতের ভারী অপছন্দ। সে গরম চোখ জোড়া পাকিয়ে বলে,

“ সেদিন ক্যাফেতে লুকিয়ে আমার স্কেচ বানাচ্ছিলে, আজ আবার আমাকে ফোলো করছো। তোমার উদ্দেশ্য কি তা স্পষ্ট গলায় বলো। “

মেয়েটা এবার সামান্য গা ছাড়া ভঙ্গিতে বলে উঠে,

“ আমি কেনো ফলো করতে যাবো তোমাকে? চট্টগ্রাম শহরটা তোমার নিজের সম্পত্তি নাকি? আমি নিজের মতো হাঁটছিলাম শুধু। “

মেয়েটার বলা কথাটা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না সাদাতের। তবুও সে অতি অপ্রয়োজনীয় বস্তুর ন্যায় মেয়েটাকে শক্ত হাতের বাঁধন হতে মুক্তি দেয়। আঙুল দিয়ে শাসিয়ে শুধায়,

“ আর কখনো আমার ত্রি সীমানার মধ্যে দেখলে কিন্তু মোটেও ছেড়ে দিবো না। “

কথাটা বলেই সাদাত হনহনিয়ে সেই গলি হতে বেরিয়ে যায়। অগ্যাত নারীর মুখে ফুটে উঠে প্রফুল্ল হাসি। নাইন্টিসের আর্জুন রামপালের গোমড়া এডিশন পুরুষ তাকে না ছাড়লেও বিষয়টা তেমন একটা মন্দ হয়না। ভাবনাটা মনে উঁকি দিতেই উক্ত নারী দ্রুত পা চালিয়ে গলি হতে বেরিয়ে এসে রাস্তার দিকে তাকায়। পিছন হতে সেই পুরুষকে রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে দেখে সে মৃদু গলা উঁচু করে পিছু ডাকে,

“ এক্সকিউজ মি! “

সাদাত চলন্ত পা জোড়া থামিয়ে ফিরে তাকায়। ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ হোয়াট? “

“ আমি স্নিগ্ধা। নামটা মনে রেখো। “

সাদাতের চোখে মুখে ফুটে উঠে দ্বিরুক্তিভাব। স্নিগ্ধা! এর থেকে অপ্রয়োজনীয় নাম সে জীবনেও শুনে নি।

__________

মফস্বল এরিয়ার ভেতর বাইকটা প্রবেশ করতেই রাফি চরমভাবে চমকালো। সাইফ এদিকে বাইকটা নিচ্ছে কেনো? প্রশ্নটা মনে চেপে না রেখে সে মুখে উচ্চারণ করে,

“ এদিকে কোথায় যাচ্ছিস? “

প্রফুল্ল মনে বাইক চালাতে ব্যস্ত সাইফ রাফির প্রশ্নে বিরক্ত হয়। সেই বিরক্তি তার গলায় স্পষ্ট ফুটে উঠে,

“ বালামার। এতো প্রশ্ন করস কেন? “

বাইকের একদম পিছনে বসে থাকা প্রত্যয় সাইফের মুখে গালিটা শুনে নাক সিটকে বলে,

“ এগুলো কি ভাষা সাইফ? “

সাইফ দ্বিতীয় দফা বিরক্তি নিয়ে উত্তর দেয়,

“ বাংলা ভাষা বুঝোস না? “

কেউ আর কোনো কথা বলার সুযোগ পেলো না। তার পূর্বেই বাইকটা এসে থামলো মরিচ বাতি দ্বারা সজ্জিত একটা বাড়ির সামনে। বাড়ির পানে তাকাতেই রাফি আর প্রত্যয় অবাক হয়। তবে তাদের কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সাইফ বাইক থেকে নেমে চাবিটা রাফির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,

“ সামনে আগায় বস। আমি বলার সাথে সাথে বাইক স্টার্ট দিবি। একদম মেইন রোডে গিয়ে বাইক থামাবি। “

প্রত্যয় কিছুই বুঝতে পারছে না। সে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ তুই কি করতে চাচ্ছিস? “

সাইফ নিজের হাতে কিছুক্ষণ আগের কেনা কালো মিষ্টির প্যাকেটটা নিয়ে প্রত্যয়কে বলে উঠে,

“ তুইও কোনো প্রশ্ন না করে চুপচাপ নিচে নাম। “

প্রত্যয় সরু ভ্রু জোড়া মেলে তাকানোর পূর্বেই সাইফ অতি যত্নে র‍্যাপিং করা মিষ্টির প্যাকেট হাতে বাড়ির ভেতর চলে যায়। রাফির খুব ভয় করছে। সাইফ কি করতে চাইছে তা ঝাপসা আন্দাজ করতে পারছে সে।

একতলা বাড়িটার উঠোন ডিঙিয়ে প্রধান দরজার সামনে গিয়ে দু বার কলিংবেল বাজাতেই একজন ভদ্রলোক দরজাটা খুলে। আগ্রহী গলায় প্রশ্ন করে,

“ কে আপনি? “

সাইফ মুখে প্রাণখোলা হাসি মেখে বলে উঠে,

“ আসসালামু আলাইকুম আংকেল। অন্যা বাসায় আছে? ওর বন্ধু আমি। বিয়ে উপলক্ষে একটা গিফট দেওয়ার ছিলো। “

“ ওয়ালাইকুম আস সালাম। অন্যা তো বাসায় আছে। কিন্তু তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না বাবা। “

“ সমস্যা নেই আংকেল। আপনি অন্যার থেকে জেনে নিয়েন। একটু কষ্ট করে যদি ওকে ডেকে দিতেন। আসলে আমার খুব তাড়া আছে তো। ফ্লাইট আছে আমার। দেশের বাহিরে চলে যাবো দেখে ওর বিয়েটা এটেন্ড করতে পারবো না বিদায় গিফট নিয়ে এসেছি। “

ঘরের কর্তা ভদ্রলোককে খানিকটা দ্বন্দ্বে ভুগতে দেখা গেলো। তবুও তিনি গলা উঁচু করে ডাকেন,

“ অন্যা। অন্যা। দেখো তো তোমার কোন বন্ধু এসেছে। “

কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে শাড়ি পরিহিত গায়ে হলুদের সাজে সজ্জিত এক রমণী। দরজার কাছে আসতেই তার ভ্রু কুচকে যায়। অবাক সুরে প্রশ্ন করে,

“ আপনি কে? “

সাইফ আর এক মুহুর্ত দেরি না করে র‍্যাপিং প্যাকেটটা ভদ্রলোকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে অন্যার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে,

“ রাফিকে ভালোবাসো? “

প্রশ্নটা শুনতেই অন্যার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। সে ভীত দৃষ্টি মেলে নিজের বাবার দিকে তাকায় যিনি আপাতত রেগেমেগে আগুন গলায় প্রশ্ন করে যাচ্ছেন,

“ এই ছেলে? কে তুমি? “

সাইফ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ফের প্রশ্ন করে,

“ চুপ থেকো না অন্যা। এন্সার মি। এটাই তোমার শেষ সুযোগ। রাফিকে ভালোবাসো? “

অন্যা ভীত ও কাপা গলায় উত্তর দেয়,

“ বাসি। “

সাইফ আর দেরি না করে খপ করে অন্যার একহাত ধরে বাহিরের দিকে ছুটে। পিছনে অন্যার বাবা চেঁচিয়ে উঠে। উনার চেচামেচিতে ঘরের ভেতর হতে অন্যার মা আর বোনও বেরিয়ে আসে। আকস্মিক পরিস্থিতির ধাক্কা সামলাতে না পেরে অন্যা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু গেট পেরিয়ে বাহিরে আসতেই তার সেই চেষ্টা থেমে যায়। অস্ফুটে উচ্চারণ করে,

“ রাফি। “

রাফি অবাক ও বিমূঢ়। সাইফ দেরি করে না। অন্যাকে বাইকের সামন এনে দাঁড় করিয়ে বলে,

“ বাইকে উঠো। দেরি করো না। ফাস্ট। “

অন্যা অপ্রস্তুত দৃষ্টি মেলে সবার পানে তাকায়। তার মস্তিষ্কে এখানো ঠিকঠাক কিছু ধরছে না। সাইফ এবার রাগী সুরে ধমকে উঠে,

“ এই রাফি বাইক স্টার্ট দে। “

রাফি সঙ্গে সঙ্গে বাইক স্টার্ট দেয়। সাইফ ততক্ষণে ধাক্কিয়ে অন্যাকে বাইকে তুলে দিয়েছে। চোখের পলকে বাইকটা রাস্তা ধরে বেরিয়ে যেতেই সাইফ লক্ষ্য করে প্রত্যয় অবাক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে তার দিকে। যেনো এইমাত্র কি হলো তার কিছুই সে বুঝতে পারে নি। সাইফ আর দেরি না করে প্রত্যয়কে ধাক্কা মেরে চেঁচিয়ে উঠে,

“ শালা মারা খাওয়ার জন্য দাঁড়ায় আছোস? “

প্রত্যয় কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই দেখে বাড়ির ভেতর হতে একজন ভদ্রলোক লুঙি একহাতে ধরে চেঁচামেচি করতে করতে বেরিয়ে আসছে। তাকে দেখে প্রত্যয়ও সাইফের পিছু পিছু ছুটে বলে উঠে,

“ তুই একদিন আমাদের আধ-পাগল বানিয়ে ছাড়বি সাইফ। “

সাইফ ছুটতে ছুটতে জবাব দেয়,

“ পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না রে পাগলা। “

চলবে…