#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ২১
-‘তো তোমায় কেমন পানিশমেন্ট দেওয়া যায় আহি? অনন্ত জলিলের মতো ডেন্জেরাস টাইপ নাকি ইমরান হাশমির মতো একটু হটি-নটি টাইপ?’
এমন গম্ভীর ফিসফিসালো কন্ঠ রীতিমতো আমার সারা দেহে এক শীতল হাওয়া ছাড়িয়ে দিলো। আনভীর তীক্ষ্ণ চাহিনী নিবদ্ধ করে ঝুঁকে রইলেন আমার দিকে, এমন ভাব করছেন যেন উনার বলা কথাটা একেবারেই স্বাভাবিক। কিন্ত উনার এসব ভয়ঙ্কর কথা শুনে অস্থির লাগছে আমার , শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য বুক উঠানামা করছে ক্রমাগত। আমি আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করলাম,
-‘দ-দেখুন আ-আনভীর,এবারের মতো ছেড়ে দিন আমায় প্লিজ!’
আনভীর হেসে দিলেন আমার কথায়। বলে ওঠলেন,
-‘আমার জন্য আর পাঁচ মিনিট ওয়েট করলে তোমার এমন অবস্থা হতো না আহি। তার ওপর আমার বারবার বারণ করা সত্বেও ধ্রুবের সাথে কথা বলার স্পর্ধা দেখালে… এখন তো এই সুইট হ্যান্ডসাম হাজবেন্ট থেকে শাস্তি পেতেই হবে।’
এই লোক সুইট এন্ড হ্যান্ডসাম কম মেন্টাল বেশি। তবে কথাটি আমি পেটের ভেতরেই ঢুকিয়ে রাখলাম। উনার লাল মুখশ্রী দেখে কথাটি বলার আর সাহস রইলো না। এদিকে উনি যেভাবে আমার শরীরে ভর দিয়ে আছেন আমার তো মনে হয় আজ চ্যাপ্টা হয়ে শেষপর্যন্ত মরেই যাবো। কিন্ত আমি শান্ত রাখলাম নিজেকে। বললাম,
-‘ওয়ান্স এগেইন আনভীর, আপনি বিয়ের রাতেই আমায় বলে দিয়েছেন যে এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী আপনি আমায় কোনোরূপ কোনো জোর করবেন না। আর যেদিকে আপনার ইগো হার্টের জন্য পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি আমায় ঘৃণা করেন তাহলে ধ্রুব ভাইয়ার সাথে দেখলে এত পজেসিভ হয়ে যান কেনো? এট এনি চান্স আপনি জেলাস না তো?’
আমি ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলাম উনাকে। আমি নিশ্চিত এবার উনি বিভ্রান্ত হবেই হবে। তারপর সেই সুযোগেই আমি দূরে সরে যাবো । কিন্ত আমায় চরম মাত্রার অবাক করে দিয়ে উনি শান্ত চাহিনী নিয়েই তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। অতঃপর আড়ষ্ট গলায় বললেন,
-‘আমি জেলাস নাকি ওভার পজেসিভ সেটা তো তোমার দেখার বিষয় না আহি ! আমি কি করবো না করবো তার কৈফিয়ত কি তোমায় দিতে হবে?’
-‘এক্সাকলি আমিও সেম প্রশ্নটা করতে চাচ্ছিলাম। আপনি আমায় কৈফিয়ত দিতে বাধ্য না তবে আমি কেনো আপনাকে কৈফিয়ত দিবো? লিসেন, ধ্রুব ভাইয়া জাস্ট আমার একজন টিউটর। উনি আমায় পড়াবেন, আমার সাথে হেসে হেসে কথা বলবেন , দরকার পড়লে হাতে হাত ধরে ঘুরবেন, আপনার কি? তাছাড়া উনি তো আপনারাই বন্ধু।’
-‘ধ্রুব আমার জাস্ট ক্লাসমেট। এছাড়া কিছু না।’
উনার থমথমে কন্ঠ। আমি শক্ত গলায় বললাম,
-‘আপনার ক্লাসমেট হোক বা সোলমেট হোক আমি কেয়ার করি না। এখন দূরে সরুন আমার কাছ থেকে। আপনার ঘেষাঘেষি রীতিমতো বিরক্ত করছে আমায়।’
আমি উনার বুকে ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করলেও একবিন্দু সরাতে পারলাম না। উনি বাকা হেসে বলে ওঠলেন,
-‘পানিশমেন্ট না দিয়ে তোমায় ছাড়ছিনা আমি। তো বলো , কেমন টাইপ পানিশমেন্ট দেবো? ডেন্জেরাস বলো কিংবা হটি-নটি টাইপ , দুটোর জন্যই আমি কিন্ত রেডি আছি।’
-‘কিন্ত আমি রেডি নাই।’
দম ফেলে বললাম আমি।উনি ঠোঁটে ডেভিল স্মাইল ঝুলিয়ে বলে ওঠলেন,
-‘পানিশমেন্ট ইজ পানিশমেন্ট আহি। তুমি রেডি থাকো বা না থাকো, তা তো ভোগ করতেই হবে।’
বলেই উনি আচমকা আমার পাশে শুয়ে পড়ে নিজের কাছে টেনে নিলেন একেবারে। আমি হঠাৎ হকচকিয়ে গেলাম। কেননা এতদিন আমাদের দুজনের মাঝখানেই একটা বিরাট কোলবালিশ ছিলো। এককথায় বাংলাদেশ ভারত বর্ডার বললেও চলবে। আমি তটস্থ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-‘ক-ক-কি করছেন আ-আপনি?’
-তোমার খুব শখ না আমার কাছ থেকে দূরে থাকার?তাই আজকে আমার একেবারে কাছাকাছি ঘুমাতে হবে তোমায়। নো কোলবালিশ , নো বর্ডার।
উনি একথা বলেই আমার দিতে কাত হয়ে চোখ বুজে ফেললেন। নিজের হাত রেখে দিলেন আমার পেটের ওপর। আমার হার্টবিট ক্রমান্বয়ে যেন মিস হয়ে গেলো উনার এমন স্পর্শে। আল্লাহ ! এই শাস্তি তো বোধহয় আমার প্রাণ কেড়ে নিবে। উনি ঘুমুঘুমু গলায় বললেন,
-‘পানিশমেন্ট শেষ হয়নি মিসেস ওয়াইফ! কালকে ভোর পাঁচটায় উঠে আমার লাইব্রেরি সাফ করবে। ঘুম থেকে উঠে সেখানে গিয়েই আমি যেন দেখি সব পরিষ্কার।’
আমি মনে মনে এই অসভ্য, ইতর, ফাজিল লোকটাকে সহস্র গালাগাল দিলাম। মনে মনে বললাম,
-‘আল্লাহ ! এই লোক যেমনে আমারে ধরসে চোখ বন্ধ করলেই তো খালি ইমরান হাশমির নাউযুবিল্লাহ মার্কা সিন গুলো মনে পড়বে। কি যে এক জ্বালায় পড়লাম।’
.
.
______________________________
পরশুদিন মেডিক্যাল পরীক্ষা আমার। সেই সুবাদে পড়াশোনার প্রচন্ড চাপ। কোচিং যেহেতু অফ তাই নাকে মুখে পড়ছি আমি। বইয়ের পাতাগুলো দেখে মাথা ঘুরাচ্ছে আমার। সকালে আনভীর ভার্সিটি যাওয়ার আগে আমার পড়ার একটা রুটিন করে দিয়ে গিয়েছেন। বললেন বাসায় ফিরে সব উনি রিচেইক করবেন। আমি এখন উনার রুটিম মাফিক সব কাজ করে যাচ্ছি। সারাদিন পড়াশোনা আর ব্যস্ততার পর একটা লম্বা ব্রেক নিলাম সন্ধ্যার সময়।
মাথাটা যন্ত্রনায় ভোঁ ভোঁ করছিলো। তাই ফ্রিজ থেকে এক গ্লাস ঠান্ডা অ্যাপেল জুস নিয়ে বারান্দার ডিভানে বসে পড়ি। ফুরফুরে হাওয়ার সাথে অ্যাপেল জুস নিমিষেই আমার মানসিক চাপটা দূর করে দিলো। আনভীর বাসায় ফিরেন নি এখনও। রিসার্চের কাজগুলোর জন্য ইদানীং বাসায় কমই থাকেন উনি। হঠাৎ ডিভানের পাশে ফোনটা বেজে উঠতেই আমি স্ক্রিনে তাকালাম। প্রথমে ভেবেছিলাম আনভীর কল করেছেন। কিন্ত চাচীর নম্বর দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছি অনেকটা। আনভীর বাসায় নেই। তাই কিছু না ভেবেই ফোন রিসিভ করে বললাম,
-‘হ্যালো চাচি?’
-‘কেমন আছিস রে আহি?’
উনার ব্যবহারের বিরাট পরিবর্তন দেখে আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম। রূঢ়স্বরে বললাম,
-‘যেমনটা রেখেছিলে, ঠিক তেমনটাই।’
ওপাশে মলিন শ্বাস ফেললেন উনি। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-‘কল দেওয়ার প্রয়োজনটা কি জানতে পারি?’
-‘অপূর্বর জন্য।’
অপূর্ব ভাইয়ার নাম শুনে আরও একদফা স্থির হয়ে গেলাম।যদিও আমি জানতাম যে ভাইয়া দেশে ফিরেছে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে আমার সাথে কিন্ত চাচিও যে এভাবে তৎপর হয়ে পড়বে তা আমি ভাবতে পারিনি। চাচি কাদো কাদো গলায় বললো,
-‘ছেলেটা আমার পাগল হয়ে যাচ্ছে রে মা। সারাদিন শুধু তোর নাম মুখে জব্দ করে রাখে। তোর রুমে ২৪ ঘন্টা দরজা লাগিয়ে বসে থাকে। একদিন তোর নম্বর নেওয়ার জন্য তো দোলার গায়ে হাত তুলতে গিয়েছিলো।’
-‘তো কি চাও আমায় কাছ থেকে?’
-‘তুই একবার শুধু দেখে যাস না ছেলেটাকে?ওর অবস্থা আমি মেনে নিতে পারছিনা।’
আমি রূঢ়স্বরে বললাম,
-‘অসম্ভব। ভাইয়ার সামনে একবার গেলে আমায় মেরে ফেলবে সে। আগে তো কম যন্ত্রণা দেয়নি। এখন এত পাগল হয়ে যাচ্ছে কেনো?’
-‘এই অভাগা মায়ের কথা রাখ না আহি?’
চাচি অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলে ওঠলো এবার। আমি যেন গোলকধাধায় পড়ে গিয়েছি এতে। অপূর্ব ভাইয়া সত্যিই এমন করছে আমার জন্য? কিন্ত আমি উনার মুখোমুখি হলে সে তো আমায় মেরে ফেলতেও দু’বার ভাববে না। এমন চাচাতো ভাই থাকার থেকে না থাকাটাও যে ভালো? আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই পেছন থেকে কেউ শীতল কন্ঠে বলে ওঠলো,
-‘কার সাথে কথা বলছো আহি?’
আমার শিরদাড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো এবার।উনার উত্যপ্ত শ্বাস আছড়ে পড়ছে আমার ঘাড়ে। অজানা আতঙ্ক আমায় ঘিরে ধরলো এতে।মানুষটা আনভীর ছাড়া আর কেউই না। এর আগে বাবার সাথে কথা বলেছি বিধায় আমার সাথে কি জঘণ্য আচরণটাই না করেছিলো। এবার যদি জানে যে চাচি ফোন দিয়েছে, তাহলে কি করবেন উনি?
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ
ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।