#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফিরন
#পর্ব – ৪৩
খাগড়াছড়ি শহরটা দারুন। এককথায় মনোমুগ্ধকর যাকে বলে। কিন্ত যতদিন আমার সাথে আনভীর আছেন ততদিন কি উনারে ছাড়া আর কারও প্রতি আদৌ আমার মুগ্ধ হওয়া সম্ভব? জেলাসি কি,কাহাকে বলে এর সংজ্ঞা যদি আমি কাউকে দিতে পারতাম সবার আগে আমি ‘আনভীর রেজওয়ান খান’ নামটি বলে উঠতাম গলা হাকিয়ে। উনার রন্ধ্রে রন্ধে আমায় নিয়ে এত পরিমাণ হিংসা যে পারলে গিনেজ বুকেও নাম লেখানো যাবে এই পাগলটার। এখন পুরো পুরিবারের সাথে আমরা এসেছি খাগড়াছড়ি শহরে। মূলত রাফিদ ভাইয়ার গায়ে হলুদের জন্য কিছু কাঁচা মালসামাল কেনার প্রয়োজন ছিলো সেটার উদ্দেশ্যেই এখানে আসা। পরিবারের বয়োজোষ্ঠ্যরা কেউই আসেননি আমাদের সাথে। এখানে মূলত আনভীরের চাচাতো ফুফাতো ভাইবোনদের সমন্বয়েই রমরমা হয়ে উঠেছে। আমি ভেবেছিলাম আনভীর হয়তো যাবেন না আমাদের সাথে। কেননা এখানে অলরেডি মামুন ভাইয়া আছে আমাদের সামাল দেওয়ার জন্য। সেই সুবাদে উনার থাকার কথা ছিলো রাফিদ ভাইয়ার সাথে। কিন্ত আমায় চরম অবাক করে দিয়ে উনি নিজেই মামুন ভাইয়াকে বাড়িতে রেখে এসে পড়লেন আমাদের সাথে। সবাই এ ব্যাপারে মিটমিটিয়ে হেসে ওঠেছে , কেউ কেউ তো সিটি বাজিয়ে উঠতেই আনভীরের চোখ রাঙানীতে আর কিছু বলার সাহস পেলো না।
আমি একগাদা বিরক্তি নিয়ে তাকালাম আমার বরাবরে বসে থাকা আনভীরের দিকে। এই লোকটা যাবে মানেই চুইংগামের মতো চিপকে রাখবে আমায় নিজের সাথে। আনভীর নিজের কলার ঠিক করতে করতে একটা বিরাট ভাব নিয়ে বলে ওঠলেন,
-‘আই নো আমি সুন্দর। সো এভাবে না তাকালেও চলবে। তোমারই বর। কেউ ছিনিয়ে নিয়ে যাবে না।’
পরক্ষণেই চোখের পলক পড়লো আমার। অটোতে থাকা উনার ভাইবোনগুলা এবার যেন আর হাসি চেপে রাখতে পারলোনা। হঠাৎই নিজেদের সংকোচতা ছাড়িয়ে হেসে উঠলো পুরো পথ মুখোরিত করে। আমার কানজোড়া কেমন যেন গরম হয়ে গেলো লজ্জায় আবিষ্ট হয়ে। ইসসস! এই লোকটার মাথা আসলেই খারাপ। এভাবে বাহিরে সবার সামনে এগুলো না বলে পারতো না?আমার পাশে বসা উনার এক বোন অগোচরে আমার কানের কাছে এসে বলে ওঠলো,
-‘ভাবি গো , কি জাদু করেছো এই পাগলটার ওপর? এ দেখি আজরান ভাইয়েরেও ডাবল ক্রস করে ফেলেছে। ‘
আমি একটা মেকি হাসি দিলাম বিনিময়ে। তবে এটা বলতে বাধ্য যে আসলেই আজ উনাকে সুন্দর লাগছে খুব। সচরাচর ফর্মাল গেটআপ ছাড়া উনি বাহিরে বের হন না। তবে আজ উনি ফর্মাল লুকে নেই। একটা সাদা শার্ট এর সাথে ব্লু জিন্স পড়েছেন। হাতাগুলো সুন্দর করে ভাজ করা। অন্যান্য সময়ের মতো চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করেননি বিধায় বাতাসের তালে চুলগুলো বারবার আছড়ে পড়ছে কপালের কাছে। চোখে-মুখে একধরনের চাপা একটা হাসি। নিঃসন্দেহে মানুষটার ব্যাক্তিত্বে যে কেউ আকর্ষিত হতে বাধ্য। তবে কথায় আছেনা , যে মানুষ মাত্রই ইমপার্ফেক্ট ! উনার ক্ষেত্রেও বিসয়টাও আসলে তাই। উনি রূপেগুণে অনন্য হলেও উনার একমাত্র ক্রুটি হলো উনি প্রচন্ড ঠোঁটকাটা ধরনের মানুষ। কখন কার সামনে কি বলতে হয় সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র ধারনা নেই উনার, হয়তোবা পরোয়া করতে চান না ব্যাপারটি। উনি হয়তো ভালোবাসি কথাটি না বলেই অনেক ভালোবাসেন আমায়, এককথায় চোখে হারান। তাইতো বিয়ে বাড়ির এত ব্যস্ততা পাড়ি দিয়েও ছুটে চলে এসেছেন আমার সাথে। আমি অগোচরে একটা মুচকি হাসি দিলাম।
মার্কেটে তুমুল মানুষের ভীড়। বৃহস্পতিবার হওয়াতে মানুষের সমাগম অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেকটাই বেশি। তবে আমার কেন যেন এই সমাগম ভালো লাগলো। এখানকার মানুষগুলো খুবই আন্তরিক।হয়তো ট্যুরিস্টের প্রচুর আসা যাওয়া থাকায় সবার মধ্যেই আপ্যায়নের একটা চরম গুণ উপস্থিত আছে। শোনা গেলো খাগড়াছড়ি শহর থেকে দীঘিনালা আর্মি ক্যাম্পে যেতে লাগে ২৮ মিনিট। তারপর সেখান থেকে নাকি সাজেকে যাওয়া যায়। আমার প্রথমে শুনে খুবই উত্তেজনা কাজ করছিলো পরক্ষণেই মনে পড়লো আমরা এখানে থাকবো মাত্র তিনদিন। বিয়ের দাওয়াত শেষ করেই হয়তো ঢাকায় ফিরে যেতে হবে।তাই একটুমন খারাপও হলো বটে। আমি আর আনভীরের এক ফুফাতো বোন ভীড় ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছিলাম সামনের দিকে। পাশেই আমার সাথে আছেন আনভীর। হঠাৎ একজন লোকের সাথে ধাক্কা লাগাতে আমি খানিকটা সরে যেতেই আনভীর নিজের হাত দিয়ে আগলে ধরেন আমার বাহু। আড়নজরে সরু দৃষ্টি দিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখেও নিলেন ওই লোকটিকে। আমি শুকনো ঢোক গিললাম। উনি খানিকটা রেগে আছেন। হয়তো এত ভিড়ভাট্টা না হলে সত্যি সত্যিই ওই লোকটিকে ধরে জেরা করতো। তবে বাকিটুকু পথ পুরোটা সময়েই উনি আগলে রেখেছিলেন আমার হাত। এমনভাবে এ দোকান ও দোকান ঘুরছেন যাতে অন্য কারও সঙ্গেই আমার বা উনার স্পর্শ না লাগে। আমি ধীরভাবে উনার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই উনি শীতল কন্ঠে বলে ওঠলেন,
-‘এখানে ভীড় অনেক। আমি জানি তুমি বাচ্চা নও যে হারিয়ে যাবে তবুও ইনসিকিউর হচ্ছি আমি। হাতটা ধরো আমার!’
আমি পরক্ষণেই শক্তভাবে আগলে ধরলাম উনার হাত। এমন নিঃসংকোচ আবেদন কখনোই এড়ানো সম্ভব না আমার পক্ষে। এতটা বছর আমি এমনি একজন মানুষের অপেক্ষায় ছিলাম যে প্রতিটা পদে পদে খেয়াল রাখবে আমার। সন্তান হিসেবে বড্ডই একা একা বড়ো হয়েছি আমি।কারও ভালোবাসা তো দূরের কথা সমবেদনাও পাইনি। তাহলে ক্ষতি কি এমন একটা মানুষের অতিরিক্ত কেয়ারিং উপভোগ করার?
____________________
মুখ গোমড়া করে বসে আছি খাটে। আনভীর তড়িঘড়ি করে রেডি হতে ব্যস্ত। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান কিছুক্ষণ পরই শুরু হবে আর উনি কাজে এতটাই মগ্ন ছিলেন যে সময়ের আর হুশঁ জ্ঞান ছিলো না। চাচী পরে ঠেলেঠুলে উনায় রুমে পাঠিয়েছেন। কথা এটা না, কথা হলো উনি বাহিরে যেতে দিচ্ছেন না আমায়। বলছেন উনার সাথে বের হতে। আমায় একা পেলেই নাকি পাড়ার মহিলারা আমায় কুমারী মনে করে বউ বানানোর পরিকল্পনা করবেন। উনি যে মহিলাদের এসব কথায় এত ভয় পান আমি সেটা জানতাম না। তার জন্য কত কি প্রচেষ্টা ! আমার কানে দুল, গলায় খানদানী হার , এমনকি নাকে নোসপিন পড়াতেও ভুলেননি। নোসপিন পড়লে নাকি আমায় আর পিচ্চি পিচ্চি লাগবে না। আমি তাই বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলাম,
-‘ব্যাটা চশমিশ কোথাকার! এসেই স্লোগানের মতো জনে জনে আমারে যে নিজের বউ বলে বেড়িয়েছেন এলাকার বিড়ালও জানে যে আমি আপনার বউ।’
অবশেষে রেডি হয়ে উঠোনে গেলাম আমরা। উনি কোনো কথা না বলেই আমায় এককোণে উনার বোনদের সাথে বসিয়ে দিয়েছেন। কড়া গলায় বলেছেন এদিক ওদিক না যেতে। মুহুর্তেই মুডটা খারাপ হয়ে গেলো। কই ভেবেছিলাম একটু সবার সাথে কথাবার্তা বলবোতা কি আর এ পাগলটা থাকতে সম্ভব? আনভীরের এক বোন মিহি হেসে বলে ওঠলো,
-‘ভাইয়ের কথা বাদ দাও তো! ও আগে থেকেই এমন। পাত্তা দিও না। ইন্জয় করো ভাবি বেইব। আজ শিউলি ভাবি থাকলে আজরান ভাইয়াকে নাকের ডগায় ঘুরাতো।’
কথাটা মিথ্যে না। উনিতো জাস্ট বলেছেন এদিক ঐদিক না যেতে। মজা করতে তো আর না বলেননি। আমরা সবাই তাই এবার চাচীর কাছে গিয়ে বসলাম। মাতিয়ে দিলাম খোশ আড্ডায়। আরও অনেক অতিথিরাই এসেছেন। একপর্যায়ে খুব পিপাসা পেয়ে গেলো আমার। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি একপাশে কয়েকটি ঠান্ডা কোকের বোতল রাখা আছে। মামুন ভাইয়া আর আনভীর সেখানে ডেকোরেটরদের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। আমি টুপ করে বোতল নিয়ে কেটে পড়ার চেষ্টা করতেই আনভীর শীতল কন্ঠে ডাক দিলেন,
-‘আহি!’
আমি পা থামালাম। পেছনে ঘুরে দেখলাম আনভীর দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ভ্রু কুচকে। পলকেই মামুন ভাইয়া আর ওই লোকটি যেন গায়েব হয়ে গেলো। আনভীরের বাকা হাসি দেখেই আন্দাজ করে নিলাম উনারা গায়েব হননি বরং গায়েব করা হয়েছে। উনি সন্দেহজনিত কন্ঠে বলে ওঠলেন,
-আমায় ছাড়া খুব ইন্জয় করা হচ্ছে মিসেস ওয়াইফি? তোমায় কতবার আমি ডাকলাম তুমি কিভাবে পারলে আমায় এড়িয়ে চলতে?এভাবে যে হাসছিলে, আমায় পাগল না করলে তোমার ভাল্লাগেনা?
বলেই উনি খপ করে আমার হাত থেকে কোকের বোতলটা নিয়ে সেটা খুলে এক ঢোক খেয়ে নিলেন। আমি ভ্রু কুচকে টেবিলের দিকে তাকাতেই দেখলাম বাকি কোকগুলোর ট্রে আর নেই। অর্থাৎ মামুন ভাইয়া ওগুলো নিয়ে গিয়েছে। এখন আমি অন্যটাও নিতে পারবো না। এদিকে পিপাসা পেয়েছে অনেক। বলে ওঠলাম,
-‘আমারটা আমায় ফেরত দিন।’
-‘দিবো না। কি করবে তুমি? ভয় দেখাবে ‘হাউ’ করে। নাকি সেদিনের মতো ইঁদুরের ভয়ে গলায় ঝুলে পড়বে?’
বলেই উনি হেসে উঠলেন। আমার এই হাসি দেখে রীতিমতো গা জ্বলে গেলো।একে তো এদিকে মানুষ নেই। আর মহাশয় এটারই সুযোগ নিচ্ছে। আমি এগিয়ে উনার হাত থেকে নেওয়ার চেষ্টা করতেই উনি হাত উঠিয়ে ফেললেন যাতে আমি নাগাল না পাই। শয়তানি হাসি দিয়ে বললেন,
-‘নাগাল পেলে নিয়ে নাও।’
আমি থামলাম। বুঝেছি এভাবে কাজ হবেনা। অন্য কোনো উপায় বের করতে হবে। হঠাৎ আমার মাথায় একটা শয়তানি বুদ্ধি খেলে গেলো। বুঝলাম এটাই একমাত্র উপায়। আমি এবার উনার কাছে ঠোঁট কামড়ে খানিকটা এগিয়ে এসেই টুপ করে চুমু দিয়ে দিলাম উনার রক্তিম ঠোঁটজোড়ায়। হতভম্ব হয়ে গেলেন উনি। এতক্ষণ আনভীরের মুখে হাসির চরম রেশ থাকলেও সেটা পাল্টি খেয়ে এসে পড়েছে আমার চেহারায়। উনি আমার আচমকা আক্রমনে এতটাই অবাক হয়ে যান যে হাত ফসকে কোকের বোতলটা ফেলে দিতেই উনি সেটা নিয়ে চলে গেলাম। আনভীর তখনও বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছেন ঠোঁটে হাত দিয়ে।
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ
ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।