এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব-২৩+২৪

0
245

#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৩
পরেরদিন সকালে ক্লাস শেষে তিতির যখন একা করিডোরে হাঁটছিল তখন শুভর সাথে দেখা হয়। হাঁটছিল বললে ভুল হবে, সে রাফি, শুভদেরই খুঁজছিল। তিতির শুভকে ডাক দেয়,

“ভাইয়া একটু শুনবেন?”

শুভ এসেছিল এক স্যারের সাথে কথা বলতে। তিতিরের ডাকে দাঁড়ায়। এগিয়ে এসে বলে,
“আরে তিতির, কী অবস্থা?”

“জি ভাইয়া ভালো। আপনাকে কিছু দেওয়ার আছে?”

শুভ অবাক হয়ে শুধায়,
“আমাকে? কী?”

তিতির এবার ব্যাগ থেকে হিজাব ও চুড়ির বক্সটা বের করে শুভর হাতে দিয়ে বলে,
“এসব দয়া করে আপনার বন্ধুকে দিয়ে দিবেন আর তাকে বলে দিবেন, পরের স্ত্রীকে নিয়ে অনাধিকারচর্চার না করতে।”

শুভর কাছে কথাটা রূঢ় শোনাল। সে কিয়ৎ মৌন রইল। তারপর বলল,
“তুমি সময় নাও। ভাবো। তাড়া কিসের!”

“ভাবাভাবি শেষ। আমি শান্তি চাই প্লিজ। আপনার বন্ধু নিজের যেমন অশান্তি বাড়াচ্ছে তেমনি আমারও।”

শুভ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এগুলো আমি নিতে পারলাম না। দুঃখিত। তবে যার উপহার তাকেই ফিরিয়ে দিয়ো। যদিও সে আজ আসত না তবুও তাকে আসতে বলছি।”

এই বলে শুভ চলে গেল। শুভর খারাপ লাগছে তার বন্ধুর জন্য। কিন্তু এখানে তার তো কিছু করার নেই। যা বোঝার ও বলার তার বন্ধু নিজেই নাহয় বলুক! চলতে চলতে শুভ ব্যাপারটা মাশরিফকে মেসেজে বলে দিল।

_________

মেসেজটা পাওয়া মাত্রই মাশরিফ বাড়ি থেকে রওনা দিয়েছে। দুপুর বারোটা নাগাদ এসে ক্যাম্পাসে পৌঁছাল। ময়মনসিং মেডিকেল কলেজের লেক পাড়ে অপেক্ষা করছে মাশরিফ। তিতিরকে ইতিমধ্যে খবর পাঠানো হয়েছে। তিতির এই এলো বলে। মধ্যাহ্নের তপ্ত রোদে ঘেমে একাকার অবস্থা হলেও মৃদু সুনীলে শরীরে শিথিলতা আসছে কিন্তু মন! সে তো বড্ড বিষণ্ণতায় কাতর! জ্বলজ্বলে সূর্য রশ্নির দিকে গুটি কয়েক মিনিট তাকিয়ে থেকে কারও ডাকে দৃষ্টি হটালো। চোখে হাসল মাশরিফ। সেই হাসির খবর বিপরীত ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছাল না।

তিতির এসে মাশরিফের পাশে ওর দিকে ঘুরে দাঁড়াল। অতঃপর ভণিতা ছাড়াই বলল,
“আপনার উপহার সামগ্রী আপনি নিজের কাছেই রাখুন। কারো অনুমতি ব্যতীত তাকে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। ”

তিতির দিকে বক্সখানা মাশরিফের দিকে এগিয়ে দিল। সেটা দেখে মাশরিফ মুচকি হাসল। তারপর চোখ নামিয়েই বলল,
“উপহার বুঝি অনুমতি নিয়ে দিতে হয়? জানা ছিল না।”

“হ্যাঁ অনুমতি নিয়ে দিতে হয়। অনুমতি ছাড়া উপহার শুধু পরিচিত ও প্রিয়জনদের থেকে গ্রাহ্য করা হয়। আপনার জ্ঞাতার্থে বলি, আপনি আমার প্রিয়জন বা প্রয়োজন কোনোটাই না। সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন।”

মাশরিফ এবার চোখে হেসে তিতিরের নয়নজোড়ায় দৃষ্টিপাত করল। অতঃপর বলল,
“যদি বলি আপনি ভুল!”

তিতিরের ভ্রুঁ প্রশ্নাত্মক সংকুচিত হলো। সে শুধাল,
“তাই? কী করে?”

“আপনার জানার বাহিরেও এমন কিছু আছে যা আপনি আজ জানবেন। তবে আমার ইচ্ছে ছিল না আজ জানানোর। কিন্তু আপনি যেহেতু আমার ব্যাপারে জেনেই গেলেন তাহলে এইটুকুও জেনে রাখুন।”

এই বলে মাশরিফ তার পকেট থেকে একটা খাম বের করল। সেটা তিতিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

” নিন। এটা পড়ুন।”

তিতির এক পলক মাশরিফের দিকে ভ্রুঁকুঞ্চন করে তাকিয়ে খামটা হাতে নিল। খামটার দিকে তাকিয়ে দেখল তাতে ঢাকা সিএমএইচ এর নাম লেখা আছে। কিছুটা সন্দিহান দৃষ্টি নিক্ষেপ করে খামটির দিকে। তিতিরকে এভাবে দেখতে দেখে মাশরিফ বলল,

“এটা আপনার শ্রদ্ধেয় পরলোকগত শ্বশুরবাবা মোঃ ওসমান আলী এক নার্স বা ওয়ার্ড বয়ের হাতে লিখিয়ে পাঠিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর দুই-তিন দিন আগে আমি এটা পেয়েছিলাম। সম্ভবতো তখন তিনি প্রায় সুস্থ ছিলেন।”

তিতির অবাক হয়ে বলল,
“হ্যাঁ বাবা প্রায় অনেকটাই সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। শুধু এক পাশ প্যারালাইজড ছিল। শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়াতে তিনি বাসায় আসার জেদ করলে আমার দেবর তাকে নিয়ে এসেছিলেন। বাসায় আসার দুই দিনের দিন হুট করে আরও অসুস্থ হয়ে যায়। এরপর ফরিদপুর মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।”

“তাই হবে হয়তো। উনি আমাকে চিঠিটা পাঠিয়েছিলেন। আর উনি যখন অসুস্থ হয়েছিলেন মানে তার মৃত্যুর প্রায় ছয় মাস আগে উনাকে আমি বাড়িতেই দেখতে গিয়েছিলাম। তখনি আপনাকে..!”

মাশরিফ হঠাৎ থেমে যাওয়াতে তিতির বলল,
“কী? আমাকে প্রথম দেখেছিলেন?”

“হ্যাঁ।”

“তবে সেটা আপনি ছিলেন? আমি সহসা কারও সামনে যাই না। মেডিকেলে ছাড়া বাড়িতে পুরুষ কেউ আসলে দরকার ছাড়া সামনে যাই না।”

তিতিরের প্রত্যুত্তরে মাশরিফ হালকা হেসে বলে,
“চিঠিটা পড়ুন।”

তিতির এবার চিঠিটা খুলে পড়া ধরল,
“মেজর মাশরিফ ইকবাল,
চিঠিটা আমি কাউকে দিয়ে লিখাচ্ছি। তুমি আমার ছেলের মতোই। আমার মন বারবার বলছে আমার ছেলে, আমার রাহান আর জীবিত নাই। যেদিন থেকে এটা মনে হচ্ছে সেদিন থেকে আমার বাঁচার প্রতি অনীহা তৈরি হয়েছে। আমার স্ত্রী, ছোটো ছেলে ও মেয়ের জন্য কোনো চিন্তা নাই। কারণ আমার ছোটো ছেলে তার মাকে ফেলবে না। আর মেয়ে তো বিয়ে দিয়েই দিয়েছি। চিন্তা কেবল তিতিরের জন্য। মেয়েটা আমার পুত্রবধূ হলেও তাকে আমি মেয়ের নজরেই দেখি। ওর বাবা-ভাইও জীবিত নাই। আমার মৃত্যুর পর যে ও আমাদের বাসায় থাকবে না তাও বুঝি। ওর জন্য চিন্তায় আমার মাঝেমাঝে নিজের উপর রাগ হয়। বিয়েটা যদি আর কিছুদিন পর হতো তবে হয়তো মেয়েটার ভাগ্যে অন্যকিছু থাকত। সেদিন তোমার দৃষ্টিতে আমি ওর প্রতি মুগ্ধতা দেখেছি। লালসা দেখিনি। বাবার চোখ কিছুটা তো আন্দাজ হয়। তুমি ওকে দেখার পরপরই যখন জানতে পারলে ও রাহানের স্ত্রী তখন সাথে সাথেই দৃষ্টি সংযত করে নিয়েছিলে। তোমাকে আমি চিনি। রাহানের সুবাদে দুই-তিন বার সেনানিবাসেও গিয়েছিলাম। তুমি একজন ভালো ছেলে। আমার মেয়েটা খুব চাপা স্বভাবের। যদি আমার এই মেয়েটা বিধবা হয়ে থাকে তাহলে তুমি যদি মেয়েটাকে আপন করতে পারো তবে এই বাবা তোমার উপর ঋণী হয়ে থাকব।
ইতি এক সন্তানহারা বাবা।”

লেখাটা পড়তে পড়তে তিতির দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। জলের ধারা গড়িয়ে পরলো। চিঠিটার উপরেও দুয়েক ফোঁটা অশ্রুবিন্দু নিজেদের স্থান দখন করে নিয়েছে। মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের হচ্ছে না। আশেপাশের সবকিছু কেমন ভারী ভারী লাগছে। তিতির বড়ো একটা ঢোক গিলে আকাশপানে তাকলো। লম্বা শ্বাস নিয়ে চিঠিটা ভাঁজ করে রাখল। তারপর সেটাকে বুকে চেপে রাখল কয়েক মূহুর্ত।
মাশরিফ মলিন হেসে বলল,

“এটা ঠিক আপনার প্রতি আমার ফিলিংস প্রথমদিন থেকেই কিন্তু অনেস্টলি, আপনাদের বাড়িতে যেদিন আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম সেদিনের পর আপনার শ্বশুরবাবার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আপনার কোনো খোঁজ আমি নেইনি। ফরিদপুরেও আসিনি। অন্যের স্ত্রী মনে করে একপ্রকার নিজের অনুভূতি দাবিয়ে রেখেছিলাম। তারপর চিঠিটা পড়ার পরই আমি ফরিদপুরে আসার সিদ্ধান্ত নেই। কিছু কাজ পরাতে দেরি হচ্ছিল কিন্তু তখনি ওসমান আঙ্কেলের মৃত্যুর খবর আসে। আমি হয়তো একটু বেশিই আবেগী হয়ে গিয়েছিলাম যা আমার পেশার সাথে যায় না। আপনার চোখে হয়তো এখন আমি এক ছ্যাঁ*চড়া লোক! হয়তো কেনো বলছি! সত্যিই তাই। তার জন্য দুঃখীত। আপনি না চাইলে আমি আপনার সামনে আমার অনুভূতি ব্যাক্ত করব না।”

তিতির চুপ করে আছে। তার আঁখিদ্বয় দ্বারা অশ্রুধারা এখনও ধীর গতিতে গড়াচ্ছে। মাশরিফ এবার নিজের পকেট থেকে আরেকটা খাম বের করে। সেটা তিতিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“এটা আপনার মাকে দিবেন। আপনি খুলবেন না। আর ভয় পাওয়ার কারণ নাই। আপনার মায়ের সামনে আমার নিচ মা*নসিকতা প্রকাশ করার ভুল করিনি। খামে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে যা আপনিও জানতে পারবেন তবে আপনার মা আগে জানুক আমি চাই। এই রিকুয়েস্টটা রাখবেন। আমি আজ এসেছিই এই দুটো জিনিস দিতে। চিঠিটাও আপনি আপনার কাছে রাখুন। সকল আমানত ফেরত শেষ। এবার তো এই উপহার সামগ্রীও আমায় ফেরত নিয়ে যেতে হবে!”

তিতির মাশরিফের দিকে তাকাল। নিষ্প্রাণ চাহনি তার। মাশরিফ হতাশ হলো। বলল,
“এই মেজর আপনার সামনে আপনার অনুমতি ছাড়া আসবে না।”

এই বলে মাশরিফ বক্সটা নিয়ে চলে যেতে উদ্ধত হয়। তিতির মাশরিফকে ডাক দেয়। তিতিরের ভাঙা কন্ঠস্বরে মাশরিফ থমকে দাঁড়ায়। তিতির এগিয়ে গিয়ে বলে,

“ধন্যবাদ আমাকে ফরিদপুর ছাড়ার জন্য প্ররোচিত করার জন্য। আপনি আমাদের অনেক হেল্প করেছেন। কৃতজ্ঞতার শেষ নাই।”

“আপনার গন্তব্য এখানেই ছিল। যদি কোনো সময় দেখা হয় সেই অপেক্ষায় রইলাম। তবে আমার মন বলছে সময়টা বেশি দীর্ঘ হবে না। ভালো থাকবেন।”

মাশরিফ চলে গেল। তিতির চিঠিটা ও খামটা নিয়ে ধীর পায়ে ক্যাম্পাসের দিকে যায়। বিকেলে নাজমা বেগম ও হিয়া, হায়াতকে নিয়ে আসবে। তখনই খামটা দেখা হবে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৪
মাশরিফ বিষণ্ণ মনে বাসায় ফিরল। চুপচাপ সোফায় বসে আছে। মহিমা বেগম বহুদিন পর নিজেদের বাড়িতে যাবে বলে ছেলের কাছে উচ্ছাস নিয়ে আসলেও ছেলের বিমর্ষ মুখশ্রী দেখে তার খুশি মিইয়ে গেল। তিনি মাশরিফের পাশে বসে কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করেন,

“কি হয়েছে তোর? মুখটা এমন ভার করে রেখেছিস কেন?”

ফুঁস করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মাশরিফ জবাব দিল,
“কিছু না মা। তুমি কিছু বলবে?”

“ওই যে কখন বের হবি? আজ তো বাড়িতে যাব। অভি, রণিত, রাতুলরাতো দুপুরের খাবার খেয়েই মাঠে খেলতে চলে গেছে। ওদেরকে ফোন করে আসতে বল। ওরাও তো সাথে যাবে।”

” হ্যাঁ বলছি। তুমি ব্যাগ-পত্র গোছাও।”

মাশরিফ কিছু হয়নি বললেও মহিমা বেগমের মন মানতে চাইলো না। তিনি ছেলের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে আদুরে কন্ঠে শুধালেন,
“কী হয়েছে রে বাবু? মাকে বল।”

মায়ের উৎকণ্ঠা দেখে মাশরিফ মিষ্টি হাসল। তারপর ঘাড় নাড়িয়ে বলল,
“কিছুনা। একটুখানি মাথার ডান পাশে চিনচিনে ব্যথা করছে। রোদের মধ্যে গাড়ি ড্রাইভ করে গিয়েছি আবার এসেছি তো। তাই হয়তো একটুও মাথা ধরেছে।”

” ও মা! সে কী বলিস! তুই ঘরে যা। ঘরে গিয়ে গোসল করে একটু রেস্ট নে। আমি তোর জন্য এখনই কড়া করে লেবু-আদা চা বানিয়ে আনছি।”

এই বলে মহিমা বেগম উঠে যেতে নিলেই তখন তার মনে পড়ে তার ছেলে তো দুপুরের খাবার খায়নি! নিজের ভুলোমনা মনকে তার ঠা*টি*য়ে চ*ড় মারতে মন চাইলো!

“দেখেছিস? আমি ভুলেই গিয়েছি, তুই যে দুপুরে খাবার খাসনি। এখনই তো চা বানাতে যাচ্ছিলাম। গোসল করে ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি তোকে নিজ হাতে খাইয়ে দিব। তারপর কিছুক্ষণ পর চা বানিয়ে দিব। তারপর আধা ঘন্টার মতো রেস্ট নিয়ে তারপর আমরা রওনা হবো।”

মাশরিফ আর মায়ের কথার বিরোধিতা করলো না। চুপচাপ মায়ের কথা মতো চলে গেল।

___________

নাজমা বেগম ও হিয়া বাস থেকে নেমেছে। তিতির অনেকদিন পর ওদেরকে দেখে দ্রুত গিয়ে জড়িয়ে ধরে। কিছু সময় নিরব থেকে বলে,

“আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো?”

নাজমা বেগম মেয়ের গালে হাত দিয়ে প্রত্যুত্তর করেন,
“না। সব ঠিক আছে। তুই কেমন আছিস?”

“আলহামদুলিল্লাহ্‌। আর হায়াত বাচ্চাটা দেখি বড়ো হয়ে গেছেরে।”
এই বলে হিয়ার কোল থেকে হায়াতকে নিয়ে একটু আদর করে হিয়াকে বলে,
“ওর তো খাওয়া হয়নি। তাই না? সেই বাসে উঠার পরে ওকে আর খাওয়ানো হয়েছিল?

“ফিটারে একটু দুধ এনেছিলাম। একটু খেয়ে আর খায় না।”

হিয়ার প্রত্যুত্তরে তিতির তাড়া দিয়ে বলল,
“জলদি চল তবে। বাচ্চাটার মুখটা শুকিয়ে গেছে একদম।”

তিতির ইমরানকে ডাকল,
“দোস্ত ব্যাগগুলা গাড়িতে তোল না।”

ইমরান এসে ব্যাগগুলা গাড়িতে উঠায় তারপর ওরা গাড়িতে উঠলে রওনা করে।

________

মির্জাপুর থেকে মাশরিফ ওর মা ও বন্ধুদের নিয়ে টাঙাইলে নিজেদের বাড়িতে যাচ্ছে। গাড়ি অভী ড্রাইভ করছে। বেশি পথ না কিন্তু মাশরিফকে মহিমা বেগম গাড়ি ড্রাইভ করতে মানা করেছেন। অভী, রাতুলরা সবই জানে। এখন তারাও বা কী করবে বুঝতে পারছে না। এক ঘণ্টার মধ্যে ওরা টাঙাইলের বাড়িতে পৌঁছে গেল। গাড়ি গেইটের কাছে আসতেই করিম চাচা মেইন গেইট খুলে দেন। গাড়ি ভেতরে প্রবেশ করিয়ে বাগানের কর্নারে পার্ক করে রাখে। করিম চাচা এসে হাসিমুখে সালাম দেন।

“আসসালামু আলাইকুম ভাবী। আপনেরা আসবেন শুইনা আমি সব ব্যাবস্থা কইরা রাখছি। বাজার সদাই কইরা আনছি এখন কামালের আম্মায় রান্না করতাছে।”

মহিমা বেগম হালকা হাসেন তারপর বলেন,
” এত কষ্ট করতে গেলেন কেন করিম ভাই? আমরা মা-ছেলেরা মিলে রান্না করে নিতাম।”

” কি যে কন ভাবি! এতদিন পরে আইলেন। কামালের আম্মায় তো শখ কইরা রান্না করতাছে। আপনারা জার্নি কইরা আইছেন এখন গিয়া রেস্ট নেন। মাগরিবের আজান পরব এখনই।”

করিম চাচার কথায় মহিমা বেগম মৌন সম্মতি দেন। মাশরিফ ও তার বন্ধুদের ডেকে বলেন,
“তোরা ব্যাগ পত্র নিয়ে ভিতরে যা। আর মাশরিফ তোর না শরীর খারাপ রেস্ট কর গিয়ে।”

পুরোটা রাস্তা যেমন মাশরিফ চুপচাপ ছিল এখনো তেমনটাই চুপচাপ। বিষন্নতা যেন তাকে আঁকড়ে ধরেছে। আজ তো বৃহস্পতিবার। শুক্রবার, শনিবার এখানে থেকে রবিবার মাকে নিয়ে কোয়াটারে ফিরে সোমবার বা মঙ্গলবারে সে সেনানিবাসে ফিরে যাবে। এর মধ্যে ময়মনসিংহতে আর যাওয়ার ইচ্ছে নেই। তার প্রেয়সী তার থেকে দূরত্বের আবদার করেছে। প্রেয়সীর এই কাঠিন্যতম আবদার পূরণ করতে সে সবকিছু করতে পারে। নিজেরই সামান্য সুখটা নাহয় বিসর্জন দিল!

নিজের জন্য বরাদ্দ করে রাখা ঘরটার মধ্যে গিয়ে বসলো মাশরিফ। মাথা নিচু করে হাত দুটি মুষ্টিময় করে বসে আছে। রনিত গিয়ে মাশরিফের কাঁধে হাত রেখে ওর পাশে বসলো। অভি ও রাতুলো ঘরের দরজা বন্ধ করে সামনে এসে দাঁড়ালো। রনিত জিজ্ঞাসা করে,

” দেখ ভাই, মেয়েটা তোকে ভালোবাসে না বাদ দে! তুই একটা ভালো মেয়ে পাবি দেখিস। তাও এমন চুপচাপ বসে থাকিস না। তোকে এতো বিমর্ষ অবস্থায় মানতে পারছি না।”

রণিতের কথায় মাশরিফ বড্ড বেশি অসন্তুষ্ট হলো। কন্ঠে অসন্তোষ নিয়ে বলল,
“ও আমার সাথে যেমনটাই ব্যবহার করুক না কেন আমি ওকেই ভালোবাসি।”

রাতুল বলল,
“আচ্ছা বুঝেছি। এখন কতোক্ষণ এভাবে গোমড়া মুখে ঘাপটি মে*রে বসে থাকবি? চল মসজিদে যাই। সেখানেই কিছুটা সময় বসে থাকলে মন ভালো হয়ে যাবে।”

“চল। আজান তো পরবে এখনি।”

ওরা চারজন হাত-মুখ ধুঁয়ে ওজু করে মহিমা বেগমকে বলে মসজিদে যায়।

নামাজ শেষে মাশরিফরা অনেকটা সময় মসজিদে বসে থেকে এলাকার টং এর দোকানে যায়। চার জনে খেতে খেতে গল্প করছিল তখন দোকানী মাশরিফকে বলে ওঠে,

“বাজান, তোমরা তো অনেকদিন পরে আইলা।”

মাশরিফ হালকা হেসে বলে,
“হ্যাঁ চাচা। প্রায় আড়াই-তিন মাস। আমি ছুটিতে না আসলে তো মা এখানে আসতে পারেনা। একা একা মাকে বাড়িতে রাখতে আমার মন সায় দেয় না। তাছাড়া মা চাকরিও করেন। তাই দুটো মিলেই আসা হয় না। এই যে আমি ছুটিতে আসলাম, কাল-পরশু মায়েরও ছুটি বলে এখানে আসলাম। আমি আসার পরপরই মা এখানে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মায়ের জন্য কলেজটা প্রতিদিন জার্নি করে যাওয়া-আসাটা কিছুটা কষ্টকর হয়ে যায়। তাই আমিই বলেছিলাম, বৃহস্পতিবার বিকালে যাব। শুক্র-শনি থাকব। রবিবার দিন সকালে আবার ব্যাক করব।”

দোকানী চাচা বলেন,
“ঠিকই কইছো বাবা। তোমার মায়ের বয়স হইছে। একা একা থাকাটা কেমন জানি ভয় ভয় লাগে। এখন যেখানে থাকে সেখানেও কি একা একাই থাকে?”

মাশরিফ হ্যাঁ বোধক বুঝলে দোকানী চাচা আবার বলেন,
“তুমি একখান বিয়া করলা ফেলাও বাবা। বুড়া মানুষ আর একা একা কতদিন থাকব? কখন কি হইয়া যায়! এক মুহূর্তেরও কোন বিশ্বাস নাই। হায়াত-মওতের কি বিশ্বাস আছে? তাছাড়া তোমার বাবা ও জীবিত নাই। তোমার মায় একলা থাকে। এখন যদি পোলার বউ-বাচ্চা না দেইখা যায়, তয় কেমন লাগে কও?”

দোকানীর কথা শুনে মাশরিফের মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। তুমি নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। চায়ের কাপে আর চুমুক দিচ্ছে না। অর্ধ খাওয়া চায়ের কাপটা বেঞ্চে রেখে দিয়েই দাম মিটিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করে। রাতুল, অভী ও রণিত হা করে তাকিয়ে থেকে তারাও চায়ের কাপটা রেখে মাশরিফের দিকে ছুটল। অভী দ্রুতপদে হেঁটে মাশরিফের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল,

“কী হলো? চলে আসলি কেনো?”

“ভালো লাগছে না।”

রাতুলও পাশাপাশি এসে বলে,
“দোকানদার কিন্তু মিথ্যে কিছু বলেনি। আন্টি আর কতকাল একা একা থাকবেন বল? শেষ বয়সে তিনি একা একাই থাকছেন। মেয়ে থাকে শ্বশুর বাড়ি আর ছেলে থাকে সেনানিবাসে। দোকানদার তো এটাই বললেন। তুই শুধু শুধু রাগ করছিস।”

মাশরিফ চোখ বন্ধ করে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি রাগ করছি না। কিন্তু আমার এখন এগুলো শুনতে ভালো লাগছে না। আমার মন মেজাজ এমনিতেই ভালো নেই। ”

রণিত কিছু একটা ভেবে বলল,
“চল নেটফ্লিক্সে থ্রিলার মুভি দেখি। সারারাত ধরে দুই-তিনটা মুভি দেখে কাটাব!”

“তুই দেখ। সাথে তোর সাথের দুইটারে নিয়ে দেখ। আমি দেখব না। আমি তো ঘুমাব। মাথায় যন্ত্রণা করছে।”

মাশরিফের কথায় রণিত মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“ভালো বুদ্ধি দিলাম ভালো লাগলো না। যা তোর দেখতে হবে না। দেখবনে, রাত বারোটার পরে এসে দরজা খট খট করছিস।”

“দেখা যাবে।”

হাঁটতে হাঁটতে ওরা বাড়ির কাছে চলে এসেছে। বাড়ির ভেতরে ঢোকা মাত্রই মহিমা বেগম জোড়ালো কন্ঠে বললেন,
“এই তোরা বস কামালের মা কতো পদের পিঠে দিয়ে গেল। চা বানিয়ে নিয়ে আসছি। সোফায় বস।”

অভী, রাতুল, রণিতরাতো মহা খুশি! তিনজনে সমস্বরে চিল্লিয়ে বলে,
“জলদি আনেন আন্টি। পেটে ইঁ*দু*র দৌঁড়াচ্ছে।”

এদের আহ্লাদীপনা দেখে মাশরিফ হেসে নিজের ঘরের দিকে অগ্রসর হয় কিন্তু নিজের ঘরে দোরগরায় দাঁড়িয়ে তার মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হয়ে যায়। প্রচণ্ড রেগে মাকে চিৎকার করে ডাকে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,