এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব-৩৩+৩৪

0
231

#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৩
দেখতে দেখতে আরো অনেকগুলো দিন কে’টে গেল। ইতোমধ্যে হিয়ার ওই ছেলে সংক্রান্ত সমস্যাটাও সমাধান হয়েছে। তবে এতে তার কম ভোগান্তি পোহাতে হয়নি! ছেলেটা ভীষণ একগুঁয়েমি করছিল। ছেলের মাকে আনতে বললেও আনছিল না কিন্তু হিয়ার পিছুও ছাড়ছিল না। অবশেষে হিয়া বাধ্য হয়ে প্রক্টরকে জানায়। অতঃপর সব সমস্যার সমাধান হয়েছে।

চৈত্রের প্রখর দা*বদাহে প্রকৃতিতে বসন্তের ইতি ঘটতে চলেছে। মার্চ থেকে এপ্রিলের প্রথমার্ধকে কিভাবে যে বসন্ত ঋতু বলা হয় তাই বুঝে আসে না তিতিরের। ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরল তিতির। বাসায় এসে মায়ের বানানো শরবতটা খেয়ে বিছানায় গা এলানো মাত্রই অক্ষিপল্লব ভারী হয়ে আসছে। কিন্তু আজ শারীরিক ক্লান্তি থেকে মানসিক ক্লান্তি কিছুটা বেশি। সকালেই রোকেয়া বেগমের নাম্বার থেকে কল এসেছিল। রাহানের ছোট ভাই মাহাদই মায়ের নাম্বার থেকে কল করে রোকেয়া বেগমের অসুস্থতার খবর জানিয়েছিল। তিনি নাকি বারবার তিতিরকে একনজর দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অস্থির হয়ে আছেন। ফোনের ওপার থেকে রোকেয়া বেগমের কান্নার শব্দও শোনা যাচ্ছিল। তিনি মাহাদের হাত থেকে ফোন নিয়ে কান্না করছিলেন আর বলছিলেন, তিতির যেন একবার তাকে দেখতে আসে। এমতাবস্থায় তিতিরের পক্ষে সম্ভব হয়নি মুখের উপর না করে দেওয়া। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে শুক্রবার গিয়ে দেখে আসবে।

এদিকে নাজমা বেগম যে কখন এসে তিতিরের পাশে বসেছেন, সেটা ও বুঝতে পারেনি। নাজমা বেগম মেয়ের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করেন,
“কীরে? কই হারালি? কী এতো ভাবছিস?”

মায়ের আচমকা ডাকে হকচকিয়ে উঠল তিতির। নিজেকে ধাতস্থ করে স্থীর হয়ে বসল। তারপর বলল,
“মা শোনো, সামনের শুক্রবার আমার একবার ফরিদপুর যেতে হবে। ”

মেয়ের এমন প্রস্তাবে নাজমা বেগম ভীষণ অবাক হন। তিনি অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন,
“হঠাৎ ফরিদপুরে যাওয়ার ইচ্ছা হলো কেন তোর? ওই শহরে আবার তোর কী?”

তিতির হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“এক সময় তো ওই শহরটাই আমার সবকিছু ছিল। আজ আমি এই শহরে এসেছি তার কারণও ওই শহরের কিছু মানুষজনের অবদান। একটা সময় পর তারা আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করলেও এক সময় কিন্তু আমি তাদের নয়নের মনি ছিলাম। আমার সুখ-দুঃখের সাথী ছিলেন তারা। আজ সেখানে এমন একজন মানুষের অসুস্থতার খবর শুনে যদি আমি না যাই আমি নিজের কাছে ছোট হয়ে যাব। তিনি তো তার ছেলে হারিয়েছেন। একজন মায়ের কাছে ছেলে হারানোর দুঃখটা কেমন তুমি তো জানোই। আমি ভুলে যেতে চাই তার করা খারাপ ব্যবহার গুলো। একজন মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের উপর নিজের আক্ষেপ ও দুঃখ এসব পুষে রেখে তার গুনাহ বাড়াতে চাই না।”

“তোর শাশুড়ি অসুস্থ?”

“হ্যাঁ। হুট করে শয্যাশায়ী! ডাক্তাররা কিছু বলতে পারছেন না। মাহাদ বলল, মা নাকি বারবার নিজের মৃত্যুর কথা বলতে থাকেন। আমাকে খুব করে দেখতে চাইছেন।”

রোকেয়া বেগমের খবরটা শুনে নাজমা বেগম ভীষণ ব্যথিত হলেন, সেই সাথে চিন্তায় পরে গেলেন। তিতির মাকে দেখে বলল,
“তুমি চিন্তা করো না। তুমি আর হিয়া এখানেই থাক। আমি গিয়ে দেখে আসব।”

তিতিরের কথা শুনে নাজমা বেগম আঁতকে ওঠলেন। দ্রুত হড়বড়িয়ে বললেন,
“কী বললি? কখোনোই না। তোকে আমি একা ছাড়ব তা তুই ভাবলি কী করে! ওইখানে সুজন ও পলাশরা আছে। যখন তখন অ্যা*টাক করে বসবে। ”

তিতির মাকে আশ্বাস দিতে চাইল। বলল,
“কিছু হবে না। আমি যে ফরিদপুরে যাব সেটা সুজন ও পলাশ কেউ জানতেই পারবে না। হাসিব ও সাইফ এসে আমাকে বাস স্টেশন থেকে সরাসরি রাহানের বাড়িতে নিয়ে যাবে। মৃদুলা, রিক্তারা আগে থেকেই ওখানে থাকবে।”

“বাহ! তুই তবে সব ভেবেই রেখেছিস।”

“মা, রাগ করো না। আমি একা গেলে কোনো সমস্যায় পরলেও ফাঁকফোকর দিয়ে ফিরতে পারব কিন্তু তোমরা সাথে গেলে তখন বিষয়টা চিন্তার হবে। তাছাড়া আমি জাস্ট দেখা করব আর চলে আসব। থাকব না তো।”

“যা ভালো বুঝিস কর।”

এই বলে নাজমা বেগম গোমড়া মুখে তিতিরের ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মায়ের প্রতিক্রিয়া দেখে তিতির ফুঁস করে দীর্ঘশ্বাস গুলো ঝেড়ে ফেলতে চাইল।

_________

দুই দিন পর ক্যাম্পাসের একটা ছায়ার মধ্যে তিতির, জারিন, নাদিয়া, লিরা ওরা বসে আছে। থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরছে। নাদিয়ার পকেট ফ্যানটা নিয়ে ইতিমধ্যে কাড়াকাড়ি লেগে গেছে। নাদিয়া ও জারিনের এই ফ্যান নিয়ে কাড়াকাড়ি দেখে তিতির হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে সম্মুখে তার দৃষ্টি গেল। দেখতে পেল শুভ একটা ছেলেকে হাসতে হাসতে ভাতৃত্বপূর্ণ আলিঙ্গন করল। অতঃপর ছেলেটার কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ক্যান্টিনের দিকে যাওয়া ধরল। তিতিরের কাছে মনে হল, ছেলেটাকে সে চেনে! অবশ্য না চেনার অবকাশ নাই। ক্যাম্পাসের যেকোনো ছাত্রের সাথেই শুভর ভালো সম্পর্ক। কিন্তু ছেলেটা ক্যাম্পাসের কেউ না। তিতির মস্তিষ্ক সিংগনাল দিচ্ছে ছেলেটা শুভ, মাশরিফদের বন্ধুমহলের কেউ! নামটা ঠিক মনে পরছে না ওর। কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে তিতির, নাদিয়া ও জারিনের ঝ*গড়া থামাতে ওদের হাত থেকে ফ্যানটা কেড়ে নিল। তারপর বলল,

“বাতাস পরে খা*স। এখন চল ক্যান্টিন থেকে ঠান্ডা কিছু খেয়ে আসি।”

লিরা ও জুলিয়ার কাছে প্রস্তাবটা ভালো লাগল। জুলিয়া উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,
“আইসক্রিম? আমি চকবার খাব। ইটস টু মাচ ইয়াম।”

লিরা বলে ওঠল,
“কোনো কাপ আইসক্রিম খাই? গরমে চকবার গলে গলে হাতে পরলে?”

“কিছু হবে না। খুব খুব জলদি খেয়ে ফেলব।”
“ওখেই। লেটস গো। গরমে আইসক্রিমে হেইড্যাক হয় বাট আজ মাস্ট খাব।”

তিতির বলে,
“আচ্ছা বাবা! তোরা যা খুশি খাস। এখন চল তো।”

ওরা পাঁচ জন চলতে থাকে ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে। ক্যান্টিনে ঢুকে কিছু কিনবে কী! তিতিরের নজর তো শুভ ও শুভর বন্ধুকে খুঁজছে। জারিন তিতিরকে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলে,

“কী হলো? দাঁড়িয়ে পরলি কেন? চল।”
তিতির নিজেকে সামলে বলে,
“হ্যাঁ হ্যাঁ চল।”

আইসক্রিম কিনে ওরা কোনার দিকে একটা টেবিলে বসল। তখনি একটু দূরে শুভদের দেখতে পেয়ে তিতির জারিনকে ডেকে দেখাল।
“এই! শুভ ভাইয়ার সাথের ছেলেটা তার বন্ধু না?”

জারিন দিক না বুঝে কা*নার মতো এদিক ওদিক তাকাতাকি করে কিছুটা জোড়েই বলে ফেলল,
“কই শুভ ভাইরে দেখিস তুই?”

জারিনের গলার স্বর শুনে তিতির চোখ-মুখ খিঁচে ওর হাত খা*মচে ধরে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আস্তে বল! এতো জোড়ে চিল্লানোর কী আছে?”

নাদিয়া পাশ থেকে বলে ওঠে,
“কী হইছে? শুভ ভাইরে খুঁজিস কেন? ওই তো শুভ ভাই বসা। দাঁড়া ডাক দেই।”

এই বলে নাদিয়ে তিতিরের মুখের ভাবের তোয়াক্কা না করেই শুভকে ডেকে ওঠল। নাদিয়ার ডাক শুনে শুভ ও শুভর বন্ধু তাকাল। নাদিয়া ইশারায় আসতে বললে ওরা সেই টেবিল ছেড়ে ওদের টেবিলে আসে।

লিরা হাসি মুখে বলে ওঠ,
“হাই! হাউ আর ইউ অভী ভাই?”

অভী হালকা হেসে বলে,
“খুব ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ্‌। তোমরা কেমন আছো?”

“আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভাইয়া।”

এবার জারিন জিজ্ঞেসা করে,
“এতোদিন পর আমাদের কথা মনে পরল?”

অভী জবাবে হাসে। নাদিয়া বলে,
“তাও তো উনার আমাদের কথা মনে পরেছে! কিন্তু অর্ক ও রাফি ভাইয়াকে দেখ, এই পর্যন্ত আর এলোই না। সেই যে গেল!”

শুভ হেসে বলে,
“বৃহস্পতিবারে আসবে। মানে পরশুদিন। তখন আমরা সাত বন্ধু আবার একত্রিত হব।”

তিতির মনে মনে ছটফট করছে কিছু জানার জন্য। তিতির জানে যে অভী ও মাশরিফের কর্মক্ষেত্র এক। এখন অভী আসল আর মাশরিফ এলো না!
তিতিরের মনের কথাটা জারিনই বলে দিল,

“অভী ভাই, আপনার বন্ধু মাশরিফ ভাই যে এলো না?”

“বৃহস্পতিবার আসবে। ওর মাও আসবে তো। আজকে আমি ওকে অনেকবার আসতে রিকোয়েস্ট করেছিলাম কিন্তু রাজী হয়নি।”

শেষোক্ত কথাটা বলতে বলতে অভী তিতিরের দিকে তাকাল। তিতির অভির তাকানো দেখে মাথা নিচু করে ফেলল। কথার বা*ণ যে তার দিকে তা তার বুঝতে বাকি নেই। এবার আসলে সে ব্যাপারটা মিটিয়ে নেওয়ার কথা ভাবল।

________

বৃহস্পতিবার, তিতির সকালে ক্লাসের জন্য বেরোনোর আগে নাজমা বেগম তিতিরকে বললেন,
“শোন, আজকে টিউশনিতে যাওয়ার আগে বিকেলে বাসায় আসিস। তোর মহিমা খালা ও মাশরিফ আসবে। ওরা তো সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকবে। রাতে থাকতে বলতাম কিন্তু থাকতে দিব কই বল? অন্তত একটা রুম তো লাগবেই। বোনকে রাতে রেখে দেওয়ার ইচ্ছে আছে।”

তিতির প্রথমে অবাক ও খুশি হলেও শেষে বিমর্ষ হয়ে যায়। বলে,
“কী করব এখন? তুমি থাকতে বলো, তাছাড়া মেজর মাশরিফের বন্ধুরা তো আছেই!”

“তাহলে বলে দেখব, কী বলিস?”
“বলো।”

চলবে ইনশাআল্লাহ,

#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৪
বিকেলে কিছু সময়ের জন্য বাড়িতে আসলো তিতির। বাড়িতে এসেই মহিমা বেগমকে সালাম দিয়ে মায়ের পাশে বসল। মহিমা বেগম সালামের জবাব দিয়ে হাস্যজ্জল কণ্ঠে তিতিরকে জিজ্ঞাসা করেন,

“কেমন আছো তিতির? দিনকাল কেমন কাটছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আন্টি। আপনারা কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ্‌। এখন ছেলের বউ দেখতে পারলে মনটা শান্ত হতো।”

মহিমা বেগম অবশ্য কথাটা তিতিরকে উদ্দেশ্য করেই বলেছেন। যদিও এখন তার ছেলের বিয়ে নিয়ে তেমন মা*থাব্যথা নেই।
মহিমা বেগমের কথা শুনে তিতির আড় নজরে মাশরিফের দিকে তাকায়। মাশরিফ এক ধ্যানে ফোন স্ক্রল করছে। তিতির না এই মাশরিফের সাথে আগের মাশরিফ যে তাকে ভালোবাসে বলে দাবি করে! তার মিল পাচ্ছে না। তিতির ভাবে, হয়তো তার কারণেই এমনটা পরিবর্তণ। নিজের মন-মস্তিষ্কে আর চাপ নিতে চাইল না সে। মাকে বলে টিউশনে যাবে।

“মা, আমি যাই তবে।”

নাজমা বেগম জিজ্ঞেসা করেন,
“খেয়ে যাবি না?”
“না। দুপুরে ক্যান্টিনে খেয়েছি। এখন যাই তবে।”
“আচ্ছা সাবধানে যাস।”

মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে তিতির বেরিয়ে আসছিলই তখন আরেকবার পাশ ফিরে মাশরিফের দিকে তাকায়। নাহ্! মাশরিফ একবারও নিজের নজর হটায়নি। দৃষ্টি এখনো তার ফোনের স্ক্রিনেই নিবদ্ধ! তিতির ঘন নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বেরিয়ে আসে।
তিতির যাওয়া মাত্রই মাশরিফ স্ক্রিন থেকে নিজের দৃষ্টি হটায়। অতঃপর চোখে হেসে মনে মনে স্বগতোক্তি করে,

“বলেছিলাম তো! তুমি না ডাকলে ভালোবাসব না! ভালোবাসি বলব না। নিজের অনুভূতি প্রকাশ করব না। আর এখন তোমারই কষ্ট হচ্ছে?”

মাশরিফ এরপর তার মাকে বলে,
“মা, আমি বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গেলাম। সন্ধ্যার দিকে এসে তোমাকে পিক করে নিব।”
মহিমা বেগম হাস্যজ্জল মুখে জবাব দেন,
“আচ্ছা যা। দ্রুত আসিস।”

বোনের কথা শুনে নাজমা বেগম ভ্রু কুঁচকালেন। তিনি বললেন,
“আপা, তোমরা কিন্তু আজকে কোথাও যেতে পারবে না। আজকে তোমাদের এখানেই থাকতে হবে। জানি রুমের একটু কষ্ট হবে কিন্তু তাও। একদিন এতটুকু সহ্য করাই যায়।”

চায়ের ট্রে হাতে হিয়া এসে বলে,
“জি আন্টি। আজকে কিন্তু আপনারা থেকে যাবেন। আমি আর তিতির ফ্লোরে মোটা তোষক বিছিয়ে সামলে নিতে পারব। আপনি আর মা বিছানায় ঘুমালেন আর মাশরিফ ভাইয়া পাশের রুমে।”

মহিমা বেগম চটজলদি বলে ওঠলেন,
“আরে না! কীসব বল? আমরা আজকে থাকব না।”
“উহুম আন্টি। আপনাদের তো আজকে থাকতেই হবে। আর মাশরিফ ভাইয়া, প্লিজ, আজকে থেকে যান। আমাদের ছোটো বাসা বলে আপনারা থাকবেন না?”

মহিমা বেগম এক পলক মাশরিফের দিকে তাকায়। মাশরিফ দ্বিধায় পড়ে যায় কী বলবে! সে হাসার চেষ্টা করে বলে,
“আসলে সেজন্য না। মানে… ”

“কোন মানে-টানে শুনব না ভাইয়া। আপনারা আজকে থাকছেন। আমি সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছি। ”

মহিমা বেগম বলতে চাইলেন,
“তোমাদের কষ্ট হয়ে যাবে মা! ”

“কোন কষ্ট হবেনা আন্টি। চাচারা যখন শহর থেকে বেড়াতে আসে তখন আমরা এই দুই রুমই এডজাস্ট হয়ে যাই। কোন সমস্যা হয় না। আর একসাথে বেশি মানুষ থাকলে বরং ভালোই লাগে। হায়াতও বেশি মানুষ দেখলে আমাকে জ্বালায় কম। ”

শেষোক্ত কথাটা হিয়া একটু মজার ছলে বলে। হিয়ার রমনাত্মক কথা শুনে ওরা হেসে ওঠে। নাজমা বেগম ও হিয়ার এতো অনুরোধে মহিমা বেগম আর আপত্তি করতে পারলেন না। মাশরিক চা পান করে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে বেরিয়ে যায়।

______
টিউশনি করিয়ে তিতির বাসায় ফিরে নিজের রুমে গিয়ে ব্যাগটা রেখে একটু বিছানায় গায়ে লাগানোর প্রস্তুতি নিতেই মনে হল সে ছাড়াও রুমে আর অন্য কারো উপস্থিতি বিদ্যমান। হকচকিয়ে উঠল তিতির। পাশ ফিরে দেখল মাশরিফ তার দিকে শান্ত, নিশ্চল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে। পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত না তিতির ঘাবড়ে যায়। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে আমতা আমতা করে বলে,

“সরি, একচুয়েলি অ্যাই ডিডিন্ট নোটিস ইউ। ইটস মাই রুম, দ্যাটস হোয়াই! আমি চলে যাচ্ছি।”

তিতিরের এই হুলস্থুল কাণ্ড দেখে মাশরিফ শান্ত কণ্ঠে বলে,
“রিল্যাক্স। পানি খাও (পাশের পড়ার টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে) তারপর শান্ত হয়ে বসো। এতো হা*ইপার হওয়ার কিছু হয়নি।”

মাশরিফের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে তিতির ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি সাবাড় করে ফেলল। অতঃপর বলল,
“আসলে আমার মা*থা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল যে, আপনার আজকে থাকবেন। আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আসলে সরি।”

“আপনি রেস্ট করুন। আমি বরং ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসি।”

তিতির নিষেধ করতে চাইলো কিন্তু মাশরিফ ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তিতির কয়েক সেকেন্ড সেদিকে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলে,

“এই লোকটা কি সব সময় এতো গম্ভীর? নাকি আমার সাথেই এতো গম্ভীর্যতা প্রদর্শন করছে? কই? আমাদের প্রথম সাক্ষাতের সময় তো উনি এত গম্ভীর্যতা আমার সাথে দেখায় নি! তখন তো খুব ক্যাজুয়াল ছিল। এমনকি নিজেই আমার সাথে কথা বলার বাহানা খুঁজত! এতো পরিবর্তণ?”

কথা গুলো বলতে বলতে তিতিরের মনে পরল তাকে তো ফ্রেশ হয়ে প্রয়োজনীয় সব নিয়ে মায়ের রুসে যেতে হবে।জলদি করে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে জামা-কাপড় ও এপ্রোনটা ভিজিয়ে বালতি নিয়ে বেরিয়ে আসে।

রাতের খাবার খেতে বসার পর খাওয়া চলাকালীন সময়ে মহিমা বেগম তিতিরকে জিজ্ঞেসা করেন,
“তিতির, তোমার প্রফ কবে?”

প্রশ্ন শুনে তিতির তাকায়। অতঃপর বলে,
“এই তো জুনে শুরু হবে।”

“সেকেন্ড প্রফ?”
“জি।”
“এমবিবিএস ও ইন্টার্নি শেষ হওয়ার পর কি ময়মনসিংহতেই থাকবে?”

প্রশ্নটা শুনে তিতির চুপসে যায়। তার ভবিষ্যৎ গন্তব্য তার জানা নেই। তাই জবাবে বলে,
“জানিনা আন্টি। ভাগ্য যেখানে আছে সেখানেই যাব।”

“এখন থেকে লক্ষ্য ঠিক করে রাখা ভালো। ফরিদপুরে তো আর ফিরবে না।”
“না আন্টি। ওখানে আর ফেরার ইচ্ছে নাই। ওই শহরটাকে একেবারে ছেড়ে চলে এসেছি। যেখানেই যাই না কেন, ওখানে আর ফিরতে চাই না। অনেক কিছু হারিয়েছি ওই শহরে।”

কথা গুলো বলতে বলতে তিতির ভাতের প্লেটে ভাত নাড়াচাড়া করছে। মহিমা বেগমও আর কিছু বললেন না। মাশরিফও মাথা নিচু করে প্লেটে ভাত নাড়াচাড়া করছে। তখন নাজমা বেগম বলে ওঠেন,

“কালকে তো তুই ফরিদপুরে একবার যাবি। ভোর সকালেই কি বের হবি? দেরি করে বের হলে ফিরতে ফিরতেও তো দেরি হয়ে যাবে। ”

তিতিরের ফরিদপুরে যাওয়ার কথা শুনে মহিমা বেগম সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন,
“হঠাৎ ফরিদপুরে কেন যাবে? ”

নাজমা বেগম মলিন কন্ঠে জবাব দিলেন,
“ওর শাশুড়ি মানে রাহানের মা রোকেয়া বেগম খুব অসুস্থ। শয্যাশায়ী। কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। তিনি একবার তিতিরকে দেখতে চেয়েছেন। রাহানের ছোট ভাই মাহাদ ফোন করেছিল। তাই কালকে তিতির দেখতে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ”

মহিমা বেগম অবাক কণ্ঠে বলেন,
“একা একা যাবে নাকি? ওখানে তো ওর শত্রুর অভাব নেই! এখন একা একা একটা মেয়ে গেলে কিনা কি হয়! তার চেয়ে ভালো কালকে তিতিরের সাথে মাশরিফও যাক। গেল আর নিয়ে আসল।”

মহিমা বেগমের প্রস্তাব শুনে তিতির হতচকিত হয়ে তাকায়। মাশরিফও চোখ তুলে তাকিয়েছে, যার দরুন তিতির ও মাশরিফের নেত্র যুগলের সাক্ষাৎ ঘটে। তিতির হড়বড়িয়ে বলে,

“না আন্টি। তার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি একা যেতে পারব। আর বাসস্ট্যান্ডে আমার দুই বন্ধু আমাকে এসে রিসিভ করবে। এরপর ওরাই আমাকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে যাবে। কোন সমস্যা হবে না এতে।”

“চুপ করো মেয়ে। আমি যা বলছি তাই হবে। তুমি একা তো ফরিদপুরে যাবেই না। মাশরিফ তোমাকে নিয়ে যাবে ও নিয়ে আসবে। তুমি একা গেলে তো তোমার মা চিন্তায় চিন্তায় স্ট্রো*ক করে ফেলবে! তাছাড়া আমরা সবাই টেনশনে থাকব। তার থেকে ভালো আমার ছেলে তোমাকে নিয়ে গেল। ও সাথে গেলে আমাদের টেনশন অনেকটাই কমে যাবে।

মহিমা বেগম ধমকে তিতির চুপ করে যায়। সে মাশরিফের প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় আছে। মহিমা বেগম এবার মাশরিফকে বলেন,

“তুই নিয়ে যেতে পারবি না তিতিরকে? তুই তো সবই জানিস। যদি কোনো বিপদ-আপদ হয়?”

মাশরিফ এক পলক তিতিরের দিকে তাকায়। তিতির মস্তক নত করে রেখেছে। অতঃপর মাশরিফ বলে,
“উনার যদি কোন প্রবলেম না থাকে তাহলে আমি নিয়ে যেতে পারি। আমার কোন প্রবলেম নেই।”

নাজমা বেগম ও মহিমা বেগম দুজনই খুব খুশি হন। মহিমা বেগম সহাস্যে বলেন,
“ওর আবার কী-সের প্রবলেম! তিতির? তোমার কোনো প্রবলেম আছে?”

তিতির থতমত খেয়ে যায়। আমতা আমতা করে কিছু বলার প্রস্তুতি নিতেই নাজমা বেগম বলে ওঠেন,
“ওর কোনো সমস্যা নাই। একা যাবে ভেবেই আমি ভীষণ ভয়ে ছিলাম। এখন সাথে যদি মাশরিফ বাবা যায় তবে ভয়টা কমবে।”

নাজমা বেগমের সাথে হিয়াও তাল মেলায়। অগ্যতা তিতির বাধ্য হয়ে যেতে রাজী হয়।

_____

পরেরদিন খুব সকালে তিতির ও মাশরিফ সবার থেকে বলে বাসে উঠে ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা করে। সকালে রওনা করায় তাড়াতাড়িই ফরিদপুরে পৌঁছে গেছে। ঘড়ির কাটায় এগারোটা ছুঁইছুঁই। রাহানদের বাড়িতে কলিংবেল চেপে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। প্রায় এক মিনিট হলো। এখনও দরজা না খোলাতে তিতিরের কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছে। হঠাৎ করে জার্নি করে এসে কোন জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে কিছুটা খারাপ লাগে। তিতির ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে আবার কলিংবেল চাপা মাত্রই দরজা খোলা হয়।

চলবে ইনশাআল্লাহ,