#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৫
দরজা খুলে রাহানের বোন রুমি। রুমি দরজা খুলে তিতিরকে দেখে ভারি অবাক হলো। রুমি অবাক কণ্ঠে শুধায়,
“তুমি? তুমি এখানে?”
রুমি এহেনো প্রতিক্রিয়ায় তিতির অস্বস্থিতে পরে যায়। সে এক পলক মাশরিফের দিকে তাকায়। তারপর বলে,
“মাকে দেখতে এসেছি আপু। মা আমাকে দেখতে চেয়েছেন। ”
কথাটা শুনে রুমি মুখ বাঁকালো। কেমন তাচ্ছিল্য ভাব এনে বলল,
“বাহ! মায়ের খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে! তা উদ্দেশ্যটা কি?”
রুমির কথার ধরনে তিতির বেশ বিরক্ত হয়। সে রুক্ষ কণ্ঠে বলে,
“আমি কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে আসিনি কিছুদিন আগে মাহাদ আমাকে মায়ের অসুস্থতার খবর জানিয়েছিল এবং মাও আমাকে খুব করে অনুরোধ করেছিল একবার এসে তাকে দেখে যেতে। মায়ের অনুরোধ ফেলতে পারিনি বলেই আজকে এসেছি। ”
রুমি তিক্ত কিছু বলতে নিবে তার আগেই একটা মেয়ে এসে তিতিরের হাত ধরে বেশ উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলে,
” ভাবি আপনি এসেছেন? আসেন ভাবি আপনাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাই।”
মেয়েটাকে তিতির চিনতে পারে। জিজ্ঞাসা করে,
” আরে তিহু, কেমন আছ?”
” আলহামদুলিল্লাহ ভাবী। আপনি কেমন আছেন?”
” এইতো আলহামদুলিল্লাহ। মাহাদের মুখে তোমার কথা শুনে খুব ভালো লেগছিল। যে তোমরা বিয়েতে দেরি করোনি।”
” মা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পরেন। তাই মাহাদ বলল বিয়েটা দ্রুত করে ফেলতে। এইতো দুই মাস হলো বিয়েটা হয়েছে।”
তিতির এবার খুশি হয়ে বলে,
” মায়ের দেখভালের জন্য কেউ তো আছে! শুনে মনে শান্তি পেলাম।”
তিতিরের এই সাধারণ কথাটা রুমির কাছে যেন তীরের মতো বিঁধল! সে ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
” তুমি কি বলতে চাইছ? আমি মায়ের খেয়াল রাখি না?”
রুমির এহেনও প্রশ্নের তিতির হতবাক হয়ে গেল! সে তো এরকম কিছু বলেনি।
“আপু, আপনি ভুল ভাবছেন। আমি আপনাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলিনি। আপনি তো শ্বশুর বাড়িতে থাকেন। এখানে মায়ের খেয়াল রাখার জন্য কেউ তো থাকা উচিত। তাই জন্য বলেছি।”
রুমি এর কোন প্রত্যুত্তর না করে ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগল। তিহু রুমির কথা পাত্তা না দিয়ে বলে,
” বাদ দিন ভাবী! রুমি আপুর কথায় কিছু মনে করবেন না। আসেন ভিতরে আসেন। আর ভাইয়া, আপনিও ভিতরে আসেন।”
মাশরিফ এতটা সময় গম্ভীর মুখ করে সবার ব্যবহার দেখছিল। তিহুর আতিথ্যতায় সে হালকা হেসে ভিতরে গেল। তিহু তিতির ও মাশরিফকে নিয়ে রোকেয়া বেগমের ঘরের দিকে গেল। রোকেয়া বেগমের ঘরে তার পাশে মাহাদ বসে আছে। মাহাদ তার মায়ের পায়ে তেল মালিশ করছে। রোকেয়া বেগমের মুখশ্রী এতটা শুকনো ও রুগ্ন দেখাচ্ছে যে তিতির প্রথম দেখায় চিনতে পারেনি। হতবাক হয়ে যায় সে। মাহাদকে তিতির ইশারায় জিজ্ঞাসা করল, রোকেয়া বেগম জেগে আছেন না ঘুমিয়ে আছেন? মাহাদ যখন ইশারায় বুঝালো রোকেয়া বেগম জেগে আছেন তখন তিতির দৃঢ় পায়ে রোকেয়া বেগমের পাশে গিয়ে বসে। অতঃপর তার হাতটা নিজের কোলে তুলে নিয়ে বলে,
“আসসালামু আলাইকুম মা। এখন কেমন আছেন?”
তিতিরের কণ্ঠস্বর শুনে রোকেয়া বেগম চোখ খুলে তাকালেন। চোখ ভর্তি জল আর মুখে লেগে আছে তৃপ্তির হাসি। তিনি জড়ানো কণ্ঠস্বরে বললেন,
“তুই আসছিস মা? কতদিন পর তোরে দেখলাম। আমি না হয় তোর উপর একটু বেশি রাগ করে ফেলছি, তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করছি। তাই জন্য তুই আমারে ভুলে যাবি? শুধু এই মায়ের খারাপ দিকগুলাই দেখলি? ”
বলতে বলতে রোকেয়া বেগম হু হু করে কেঁদে ওঠেন। তিতিরও চোখের জল ধরে রাখতে পারেনা। আবেগময় মূহুর্তে উপস্থিত সকলের নেত্রকোণে নোনাজল ভীড় করেছে। মাশরিফের হঠাৎ ফোন আসাতে মাশরিফ একটু ঘর থেকে বের হয়ে কথা বলতে যায়। তখনি রুমি রোকেয়া বেগমের রুমে প্রবেশ করে আচমকা বলে,
“নতুন আশিক পেয়েছ নাকি তিতির? সাথের লোকটা কে?”
কথাটা যেন বজ্রপাতের মতো পতিত হলো। তিতির হতচকিত হয়ে তাকায়। অবাকের রেশে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেছে। মাহাদ বিস্মিত কণ্ঠে বলে,
“এসব কী বলছ আপু?”
রুমি আরও তেজী কণ্ঠে বলে,
“ভুল কী বললাম? ঠিকই তো বললাম। ময়মনসিংহতে গিয়েছে কেন তবে? আবার আজকে আসল তো সাথে করে এক অচেনা ছেলেকে নিয়ে! ওর ভাই তো বেঁচে নাই। তাহলে আর কে? নতুন আশিকই তো হবে!”
মাহাদ জোরালো কণ্ঠে বলে,
“থাম আপু। যা মুখে আসছে বলে চলেছ। একটু বুঝে তো বলো।”
“এই তুই চুপ কর। যা বুঝিস না বলবি না। তোরা সব দেখেও চুপ করে থাকলে কী আমিও চুপ করে থাকব? সত্য দেখেও চুপ থাকব নাকি?”
তিতির চোখ বন্ধ করে একটা হতাশার ঢোক গিলে। অতঃপর বলে,
“সব না জেনে একটা মন্তব্য করে ফেললেই বোধহয় নিজেকে মহাজ্ঞানী ভাবা যায়! কিন্তু ভুলে যাবেন না, এসব হীন মানসিকতার মহাজ্ঞানী সম্মানের যোগ্য না।”
তিতিরের কথায় ফুঁসে উঠল রুমি। রুমির স্বামি সাদিক ইশারায় বারবার রুমিকে থামতে বলছে কিন্তু রুমি তো নাছোড়বান্দা! তেজী কণ্ঠে বলে,
“কী জানব হ্যাঁ? তোমার পরিবারে পুরুষ মানুষ আর আছেই বা কে? তোমার চাচাতো ভাই তো ছোটো। তাহলে আর কী বুঝব? আমি নাহয় বেশি বুঝি, তবে তুমিই বলো লোকটা কে?”
তিতির লম্বাশ্বাস নিয়ে অকপটে হড়হড়িয়ে বলতে থাকে,
“উনি আমার কাজিন। খালাতো ভাই। উনি আমাদের পাশে ছিলেন বলেই এখনও সমাজের চি*ল-শ*কু*নেরা আমাদের তিন জন মেয়ে লোককে ছিঁড়ে খেতে পারেনি। বিপদের বন্ধু চিনেন? মেজর মাশরিফ ইকবাল আমাদের মা-মেয়েদের বিপদের বন্ধু। উনি সুসময়ের মাছি না। তাই আপনি বাহিরের লোক হয়ে না জেনেই উলটা-পাল্টা মন্তব্য করে ফেলবেন না।”
রুমির শেষের কথা গুলো মাশরিফ ঘরের দরজার কাছে এসে শুনেছে। তখন তার যতোটা রাগ হচ্ছিল, এখন তার থেকে বেশি প্রশান্তি কাজ করছে। এবার মাশরিফ দরজার কাছ থেকে বলে ওঠে,
“আপনার বুঝি পরচর্চার খুব শখ মিসেস রুমি? আসার পর থেকে দেখছি আপনি তিতিরের পেছনেই পরে আছেন? তিতিরকে নিয়ে তো এখানের আর কারোর কোনো সমস্যা আমার নজরে আসছে না, কিন্তু আপনার একার দিক থেকেই দশ জনের সমান সমস্যা নজরে আসছে। আপনি আপনার বাবার বাড়িতে এসেছেন ভালো কথা, সবার সাথে হাসি-খুশি থাকবেন। কিন্তু আপনি দেখছি বাড়ির পরিবেশ খারাপ করার জন্য উঠে পরে লেগেছেন। তাছাড়া তিতির তো বলেছে সে শুধু মেজর রাহানের মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছে তাও উনার রিকুয়েস্টে। তবে কী জানেন মিসেস রুমি, আমি শুনেছি, আপনি নাকি বছরের ৮-৯ মাসই এই বাড়িতে পরে থাকেন! তাতেই বোঝা যায় আপনার আগ্রহ! বিয়ের পর এতো সময় বাপের বাড়ি পরে থাকলে আপনার সংসারের হাল কী?”
রুমি ক্ষেপে ওঠল। রুক্ষ কণ্ঠে শা*সা*ল,
“আপনি কিন্তু বেশি কথা বলছেন। আমার বাবার বাড়ি, আমি যখন খুশি আসব।”
“তাহলে তিতিরের শ্বশুর বাড়ি! ওর স্বামী জীবিত না থাকলেও স্বামীর পক্ষের হকের অধিকারে ও যখন খুশি এই বাড়িতে আসতে পারবে। এখন আপনার কাছে কোনটা বেশি এপ্রোপ্রিয়েট মনে হয়? আপনি সারা বছর এই বাড়িতে পরে থাকেন, তাতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ বা সমস্যা নাই। কিন্তু অন্যের ব্যাপারের নিজের খাঁড়া নাকটাকে ঢোকানোর চেষ্টা করবেন না।”
কথাগুলো বলে মাশরিফ এবার রুমির স্বামীর দিকে তাকায়। রুমির স্বামী সাদিক মাথা নিচু করে রেখেছে। মাশরিফ তাকে জিজ্ঞেসা করে,
“ভাই, আপনি যদি এভাবে মাথা নিচু করে রাখেন, তাহলে কীভাবে হবে? আপনার স্ত্রীকে আপনি নরম ভাবে ইশারা করে যে থামাতে পারবেন না, তা আপনিও জানেন। অন্যায় কথা শুনলে রুখে দাঁড়াতে হয়।”
রুমির স্বামী সাদিক বলে,
“ভাই, ওরে আমি অনেক বুঝাইছি কিন্তু সে বুঝে তো নাই, উলটো রাগ করে এখানে এসে মাসের পর মাস থাকে। ওর জন্য আমাকেও এখানে থাকতে হয়। আমার মাকে তো ওর জন্য আমার ভাইয়ের কাছে রাখি, এখন ও নিজেও বাসায় থাকে না। তখন আমি তো একা হয়ে যাই।”
রুমি রেগে বো*ম হয়ে কিছু বলতে নিবে তখন রোকেয়া বেগম রুগ্ন কণ্ঠে বলে ওঠেন,
“তুই আজকে এখনি চলে যা রুমি। আমার সংসারে আর ঝামেলা বাঁধাস না। নিজের সংসারটা মন দিয়ে কর।”
চলবে ইনশাআল্লাহ,
#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৬
সন্ধ্যার পর তিতির ও মাশরিফ ময়মনসিংহতে ফিরল। সারাদিন জার্নি শেষে অবসন্ন শরীর এখন বিশ্রাম চাইছে। তিতির নিজের ঘরে গিয়ে জামা-কাপড় নিয়ে মায়ের ঘরে চলে গেল। মাশরিফ কিছু সময় সোফার ঘরে বসে থেকে শরবত খেয়ে একটু রেস্ট করতে গেল। মহিমা বেগমও ছেলের সাথে কথা বলতে ছেলের পিছু গেলেন। মাশরিফ বিছানার উপর বসা মাত্রই মহিমা বেগম ছেলের পাশে এসে বসলেন তারপর জিজ্ঞাসা করলেন,
“হ্যাঁ রে, ওখানে কোনো ঝামেলা হয়নি তো? সব ঠিক ছিল?”
মাশরিফ ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“হয়েছিল। মিটেও গেছে।”
“কী হয়েছিল?”
“মেজর রাহানের বোন উলটা-পালটা কথা বলছিল। বাদ দাও সেসব। ওসব মনে করলেই মেজাজ খারাপ হচ্ছে।”
মহিমা বেগম আর ঘাটালেন না। তিনি এবার উৎসাহী কণ্ঠে বললেন,
“আমি নাজমার সাথে কথা বলেছি।”
মাশরিফ ফোন স্ক্রল করতে করতে বলল,
“কী ব্যাপারে?”
“তোর ও তিতিরের বিয়ের ব্যাপারে।”
প্রথম দফায় পাত্তা না দিলেও দ্বিতীয় দফায় আচমকা ঘুরে তাকায়। অতঃপর বিস্মিত কণ্ঠে বলে,
“কী বললে?”
ছেলের প্রতিক্রিয়াতে মহিমা বেগম হাসলেন। তিনি বললেন,
“তোর খালা তো রাজি। এখন তিতির রাজি হলেই হলো। তারপর ঘরোয়া ভাবে বিয়ে পড়িয়ে রাখব। তোদের যখন সময় হবে তখন তোদের মতো ভাববি।”
মাশরিফ তাচ্ছিল্য করে বলল,
“আগে থেকেই এতোকিছু ভেবে রাখছ যে! মেইন মানুষটাই তো রাজি হবে না। তুমি দেখো, তিতির রাজি হবে না। বাদ দাও ওসব।”
“আগে থেকে নেগেটিভ ভাবিস কেন? রাজিও তো হতে পারে।”
“দেখা যাক। কাল সকালে কিন্তু জলদি বের হতে হবে। খুব সকালে বের হবো।”
মহিমা বেগম বললেন,
“সব গুছিয়ে রাখ তবে। আমার তো ক্লাসও আছে।”
“এই গোঁছানোর ঝামেলাই হতো না যদি গতকালকেই চলে যেতাম। আজ নাহয় ওখান থেকে এসে তিতিরকে নিয়ে বেরোতাম। থাকার জন্যই শপিং করতে হলো, এখন সেগুলোও টানতে হবে।”
“থাক। দুইটা দিনই তো। কাছাকাছি থাকলে সম্পর্ক গভীর হয়।”
_________
এদিকে নাজমা বেগম ও হিয়া তিতিরের দুইপাশে বসে ওই বাড়িতে কিছু হয়েছে কীনা জানতে চাইছে। তিতির অনেকটাই ক্লান্ত। তাও মা ও ভাবির আগ্রহে বলতে শুরু করে,
ফ্ল্যাশব্যাক,,
রোকেয়া বেগম যখন রুমিকে চলে যেতে বলেন তখন রুমি রেগে কান্নারত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“ওহ! এখন বড়ো ছেলের বউকে দেখে দরদ উতলে ওঠছে? এখন আর আমাকে লাগে না তাই না? তোমার বড়ো ছেলের বউ! তোমার লক্ষী বউ! কত লক্ষী দেখো, এখনই পরপুরুষ সাথে নিয়ে করে ঘুরছে! নির্লজ্জ মেয়ে। সে যে বিধবা সেটা মনে হয় ভুলেই গেছে। এভাবে চলাফেরা করলে কে বলবে সে বিধবা? চরিত্রহীনা একটা।”
রুমি কথাগুলো বলে ফোঁস ফোঁস করতে থাকে। রোকেয়া বেগমেরও চোখ দিয়ে পানি পরছে। মাশরিফ প্রতিবাদ করে বলে,
“আমি বুঝতে পারছি না, আপনার কী সমস্যা হচ্ছে? তিতির কীভাবে চলবে না চলবে এটা সম্পূর্ণ ওর ব্যাপার। আপনি ওর চরিত্রে আঙুল তুলতে পারেন না। রাহান স্যারের মৃত্যুর অনেকটা সময় হয়ে গিয়েছে। টে*রো*রিস্টদের বলা সময় অনুযায়ী প্রায় দেড় বছর! আর স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীর ইদ্দতকাল ৪ মাসের মতো। বহু আগেই তিতিরের ইদ্দতকালও শেষ। রাহান স্যারের মৃত্যুর খবর জেনেছে সেটাও ছয় মাসের মতো হয়েছে। তাহলে কেন সে নিজের মতো থাকতে পারবে না? আপনাদের বাসায়ও তো থাকার মতো পরিবেশ রাখেননি। এখন আপনি কী চান? ও ম*রে যাক?”
রুমি চোখ মুখে ফুঁসতে ফুঁসতে চিৎকার করে বলে,
“ও আমাদের বাড়িতে আসবে কেন? ওর জন্য আমার ভাই আজকে আমাদের সাথে নাই। অ*পয়া, অ*লক্ষী একটা! আমাদের পরিবারটা তছনছ করে দিয়েছে।”
রুমির অযৌক্তিক অভিযোগে মাশরিফ প্রচণ্ড বিরক্ত হয়। এদিকে তিতিরের দিকে নজর গেলে দেখে তিতির চোখ বন্ধ করে দাঁত দাঁত চেপে কান্না আটকে রাখার চেষ্টায় আছে কিন্তু বে*ই*মান লোচন বিরোধিতা শুরু করছে। কপোল বেয়ে দুঃখের দরিয়া বইয়েই চলেছে।
মাশরিফ তিতিরের এই অশ্রসিক্ত নেত্রপল্লব দেখে নিজের রাগ সংবরণ করতে পারল না। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলতে শুরু করে,
“আপনাদের পরিবার তছনছ হয়েছে? কিন্তু, আমার তো মনে হয়, এই মেয়েটার (তিতিরকে দেখিয়ে) জীবন তছনছ হয়েছে! একবার নিজেকে ওর জায়গায় কল্পনা করে দেখুন তো! দম আটকে ম*রে না যান! প্রথমেই বলা হয়েছে, তিতির আজকে এখানে এসেছে আপনার মায়ের বিশেষ অনুরোধে। তিতিরকে যা তা বলে আপনি যে বিবেক বুদ্ধিহীন সেটাই বারবার প্রমাণ করছেন। আর সাদিক সাহেব, আপনার স্ত্রীকে এখান থেকে দয়া করে নিয়ে যান। যতক্ষণ আমরা এখানে আছি ততক্ষণ দয়া করে আপনার স্ত্রীকে আমাদের থেকে দূরে রাখুন। এবার অন্তত তার বেপরোয়া জবানে লাগাম টানুন!”
রুমির স্বামী সাদিক আর একটুও অপেক্ষা করলেন না। রুমিকে জোর করে টেনে নিয়ে যান। রুমি চলে যাওয়ার পর রোকেয়া বেগম চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তিতিরের হাত নিজের মুঠোবন্ধি করে অনুনয়ের স্বরে বলেন,
“আমাকে মাফ করে দিস রে। আমি তোকে আসতে বলেছি বলে তোকে আজ এত কথা শুনতে হয়েছে। আমার মেয়েটা যে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে, আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু দোষ তো আমারই। আমিই প্রথমে ওর লাগাম টানিনি। ওর কোন কথা মনে নিস না।”
কথাগুলো বলতে বলতে রোকেয়া বেগমের চোখ আবারও ভিজে ওঠে। তিতির নিজের এক হাত ছাড়িয়ে রোকেয়া বেগমের চোখের জল মুছে দিয়ে বলে,
“আমার সব সয়ে গেছে মা। রুমি আপুর ব্যবহার যে এরকম আমি জানি। কমতো আমার সাথে এরকম ব্যবহার করেনি! দোয়া করি, আল্লাহ উনাকে হেদায়েত দিক। ”
রোকেয়া বেগম জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বলেন,
“তুই তোর জীবনটা নতুন করে শুরু কর। সুন্দর করে শুরু কর। কোন কালো ছায়া যেন তোর জীবনে না আসে। জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। একজনের জন্য জীবনকে থামিয়ে রাখা মানে বোকামি। জীবন তার নিজ গতিতে চলে। সময়, প্রয়োজন ও মনের তাগিদে জীবনে কিছু মানুষের আনাগোনা ঘটে। তোর বাবা (শ্বশুর) আমাকে বলে গিয়েছিলেন, আমি যেন তোর জীবনটা গুঁছিয়ে দেই। তিনি হয়তো আগেই সবটা বুঝে গিয়েছিলেন। তুই তো জানিস, মানুষটা তোকে কখোনো পুত্রবধূর দৃষ্টিতে দেখেননি। নিজের মেয়ের মতো আগলে রেখেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন তার এই মেয়ের জীবনটা সুন্দর হোক। আমিও হয়তো খুব বেশিদিন বাঁচব না। তোর জীবনটা সুন্দর হয়েছে দেখে ম*র*তে পারলেও শান্তি।”
তিতির চোখ মুছে ভাঙা কণ্ঠে অভিযোগ করে ওঠে,
“এসব অশুভ কথা বলবেন না। আপনি অনেক বছর বাঁচবেন। আপনার এই মেয়ের সুন্দর জীবন মন ভরে দেখবেন। কিচ্ছু হবে না আপনার।”
রোকেয়া বেগম অশ্রুস্নাত চোখেই হালকা হাসেন। অতঃপর বলেন,
“নারে, মন থেকে সাড়া পাই না। তোর সুন্দর, সুখী জীবন দেখার তৃষ্ণা নিয়ে দুনিয়া ছাড়তে চাই না।”
তিতিরের কাছে চোখের জল ছাড়া আর কোনো জবাব দেওয়ার মতো নেই। যতোটা সময় এখানে থাকবে ততো তার হাঁসফাস লাগবে তাই জলদি বিদায় নিয়ে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে।
ফ্ল্যাশব্যাক শেষ,,
সব শুনে নাজমা বেগম ও হিয়ার চোখেও পানি জমে ওঠেছে। তিতির মুখ ঢেকে কান্না লুকানোর চেষ্টা করছে। হারাতে হারাতে সে খুব ক্লান্ত। রোকেয়া বেগম তাকে কষ্ট দিয়ে অনেক কথা বললেও তার ভালোবাসার পরিমানও তিতির ঠাওর করতে পারে না। তিনি যখনই কষ্ট দিয়ে কথা বলেছেন, তা যে এক সন্তানহারা মায়ের ক্ষোভ ছিল, তিতির ওটাই মানে।
নাজমা বেগম বলেন,
“আমারও মনে হয় এবার তোর নিজের জীবনটাও গোঁছানো দরকার। হায়াত-মউতের কোনো বিশ্বাস নাই। আমিও তো ম*রে যেতে পারি!”
কথাটা শোনামাত্রই তিতির উচ্চরব করে ওঠল,
“তুমিও! তোমরা শুরুটা করেছ কী হ্যাঁ! এরকম অশুভ কথা বলেই যাচ্ছ।”
“মিথ্যা বলতেছি নাকি? সত্যিই তো। আজ আছি, কাল থাকব কীনা কে জানে? আমারও তো তোকে, হিয়াকে, হায়াতকে নিয়ে চিন্তা হয়।”
“তাহলে ইনডাইরেক্টলি শুধু আমাকে বোঝাচ্ছ কেন? হিয়াকেও বলো।”
হিয়া তীক্ষ্ম কণ্ঠে বলে ওঠে,
“আমাকে বলে না তোকে কে বলল? আমার একটা বাচ্চা আছে। মা যেমন আমাদের কথা ভাবেন তেমনি নিজের আগে আমারও ওর কথা ভাবতে হয়। আমার তো তাও একটা বাচ্চা আছে যাকে ঘিরে আমার চলে যাবে। কিন্তু তোর? কিসের টান তোর? বিনা সংসারে বিধবা তুই। অতীতকে ভুলে সামনে আগা। তোর পীড়াদায়ক অতীত ভুলতে হবে। আমাকে দেখ! অতীতটাই সুখময়। আমার অতীতটাই আমার বাকি জীবন বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়। নিজের জন্য আমি কিছু করছি না, আমি নিজেকে নিজের মেয়ের জন্য গোঁছাচ্ছি। মেয়ের আইডল হতে চাই। আমার মেয়ের বিয়ের আগে ওর একটাই বাবা হবে। সেটা তিয়াস। আর কেউ না।”
তিতির হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। নাজমা বেগম হুট করে বলেন,
“শোন না, তোর মহিমা খালা বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। আমি তো রাজি। তুইও রাজি হয়ে যা না। মাশরিফ কিন্তু ছেলে হিসেবে খুব ভালো। আর তোর মুখে আজকের ঘটনা শুনে বুঝলাম, তোর জন্য ওই সেরা। উন্নতমনা ও অন্যায়ের প্রতিবাদকারী। তোকে সবসময় আগলে রাখবে। তাছাড়া চেনা-জানার মধ্যে। রাজি হয়ে যা না মা!”
তিতির হতচকিত হয়ে মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকায়। উপস্থিত শব্দবাণে সে বাকরুদ্ধ।
________
সুজন ও পলাশের সহচরদের একজন সন্ধ্যার পর যখন সুজনের ফোন খোলা পায় তখন ফোন করে বলে,
“ওস্তাদ, একটা খাসা খবর আছে। আপনে হুনলে আপনার পরান ঠান্ডা হই যাইব।”
সুজন গ্লাসে নে*শাপানি ঢালতে ঢালতে বলে,
“তো কার লাইগ্যা বইয়া রইছস ******! ক তাড়াতাড়ি।”
“আপনের ময়নাপাখি তো আজকা ফরিদপুরে আইছিল!”
কথাটা শুনে সুজন সোজা হয়ে বসে। প্রবল উৎসাহ নিয়ে বলে,
“কস কী? কখন?”
“আমি তো দুপুর দেখছি মেডিকেল কলেজের গেইটে। তয় লগে একটা বেডাও আছিল। আমি আবার ছবি তুইল্লা রাখছি। ”
“দে জলদি ছবি দে। আবার কোন ভা*তার জুটাইছে এই ছেঁ*ড়ি!(অনেক অশ্রাব্য শব্দ আমি এড়িয়ে গেলাম)”
সুজনের সেই সহচর ইমোতে ছবি পাঠালে সুজন ছবি জুম করে তিতিরের সাথের ব্যাক্তিটির চেহারা বুঝার চেষ্টা করছে। সে মোটামুটি বুঝতে পারছে তাও এর সত্যতা বিচার করতে পলাশকেও দেখায় তারপর দলের এমন কেউ যে নে*শা করেনি তাকেও দেখায়। তারা বুঝতে পারে সাথের ব্যাক্তিটি কে!
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।