এখানে সুখ ছোঁয়া যায় পর্ব-১৪

0
113

‘এখানে সুখ ছোঁয়া যায়’ পর্ব-১৪
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

একটু পর পরই বিলাপ করে কেঁদে উঠছেন আশুরা খাতুন। পাশেই তার দুই মেয়ে বসে তাকে সামলাচ্ছেন। ছেলের বউরা কাছে আসতে ভয় পাচ্ছেন। সকালে কয়েক দফা শাশুড়ি তাদের কথা শুনিয়েছেন। এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে তাদের সামনে দিয়ে তারা কেউই খেয়াল করেনি। রিনিঝিনির মা চাচীরা শাশুড়িকে বুঝিয়ে উঠতে পারছেন না যে তারা সারাদিন বাড়ির কাজে ব্যস্ত ছিলেন, বাড়ি ভরা এত লোকজন এত সবের মধ্যে তারা কীভাবে খেয়াল করবে। রিনিঝিনি ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল। তখনই ছোট ফুফুর মেয়ে চৈতী এসে বলল,

-‘আমাকে কেমন লাগছে আপু?’

রিনিঝিনি একবার চোখ বুলিয়ে বলল,

-‘সুন্দর।’

-‘কম সুন্দর না বেশি সুন্দর?’

রিনিঝিনি বুঝল কিছু একটা হয়েছে। সে হেসে বলল,

-‘খুব সুন্দর।’

-‘তাহলে কেন সে আমায় ফিরেও দেখল না?’

চৈতী ভীষণ রেগে আছে। রাগলে তার নাক লাল হয়। ফর্সা মুখে লাল নাকটা চোখে লাগে। রিনিঝিনি তার নাক টিপে দিয়ে বলল,

-‘কি ব্যাপার?’

-‘বড় মামানির ওই ছেলেটা আছে না? তিন তলায় থাকছে যে!’

-‘হ্যাঁ, ইখতিয়ার সাহেব। কি করেছে উনি?’

-‘আমাকে অপমান করেছে।’

-‘কি বলছিস! উনি অমন মানুষ না।’

-‘তুমি এমন ভাবে বলছ যেন জনমের পর জনম ধরে সংসার করছ ওঁর সঙ্গে।’

-‘ধুর! চেনার জন্য সংসার করতে হবে কেন?’

-‘সংসার করলেই মানুষ চেনা যায়।’

-‘তোর খুব অভিজ্ঞতা আছে মনে হচ্ছে!’

-‘আমি জানি।’

-‘বেশ। জানিস তো তাহলে এখন তুই যেটা ভাবছিস সেটাও ভুল হতে পারে। তুইও তো সংসার করিস নি।’

চৈতী চুপ করে রইল। দেখে মনে হলো কিছু ভাবছে। রিনিঝিনি তাকে পাশ কাটিয়ে দাদীর কাছে গেল। বলল,

-‘এমন ভান করছ যেন কেউ ম’রে গেছে!’

-‘তুই চুপ কর!’

-‘তুমি চুপ করো। অনেক হয়েছে তোমার এসব ঢং এর।’

-‘ঢং লাগে তোর? হ্যাঁ! তোর কাছে রং ঢং মনে ওয়?

-‘রং এর কথা আমি বলিনি। বড় ফুফু তুমি চলো! অনেকক্ষণ বসে আছো এখানে। গেস্ট আসছে অথচ তাদের দেখা সাক্ষাৎ করার জন্য কেউই নেই দেখছি।’

বড় ফুফুর ও বিরক্ত লাগছিল। অযথাই মা ব্যাপারটা বড় করছে। নিশ্চয়ই কোথাও মনের ভুলে রেখেছে এখন খেয়াল নেই। একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে। বাড়ি ভরা মানুষ কমলেই আবার খোঁজার কাজ শুরু করতে হবে। পানের বাটা যে স্বর্ণের এটা কি সবাই জানে নাকি? তাছাড়া এত সিকিউরিটির মধ্যে কীভাবে কেউ এত বড় জিনিস নিয়ে যায়! ওটা তো ছোট খাটো পানের বাটা না, খানদানি পানের বাটা।

চায়ের কাপ হাতে তিন তলার টানা খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ইখতিয়ার। এখান থেকে বাড়ির সামনের অংশটা দেখা যায়। সে গেইটের দিকে তাকিয়ে আছে, একের পর এক লোকজন গেইট দিয়ে আসছে, যাচ্ছে। চা শেষ করে সেখান থেকে ফিরে আসতে নিলেই তার চোখ যায় গার্ডেনের গোল চত্বরের পানির ফোয়ারার এক পাশে থাকা বিরাট বড় এক নামফলকের দিকে। সেখানে নকশা করে লেখা ‘এখানে সুখ ছোঁয়া যায়’। ইখতিয়ার হাসল, গতকাল আসার সময় তো এটা খেয়াল করেনি! গেইট দিয়ে ভেতরে আসতেই তো এটা চোখে পড়ার কথা ছিল।

-‘রিনিঝিনিকে দেখেছেন?’

হুট করে কোমল এক নারী কন্ঠ শুনতে পেয়ে ইখতিয়ার পেছনে ঘুরে তাকালো। রুমঝুম দাঁড়িয়ে আছে ইতস্তত ভঙ্গিতে।

-‘সকালে একবার দেখা হয়েছিল। দেড় ঘন্টা আগে বলা চলে।’

-‘ওহ আচ্ছা।’

রুমঝুম চলে যেতেই নেয়, ইখতিয়ার ডাকে তাকে। রুমঝুম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ইখতিয়ার একটু এগিয়ে এসে বলে,

-‘আপনি কি রিনিঝিনির ভাবি? আই মিন মি. তাহমীদের ওয়াইফ?’

-‘না না। আমি ওনাদের স্কুলের নতুন টিচার। দু’দিন হলো জয়েন করেছি।’

-‘ওহ, আই আম এক্সট্রিমলি স্যরি! আমি ভেবেছিলাম আপনারা স্বামী স্ত্রী। মাই মিস্টেক!’

-‘ইটস্ ওকে।’

রুমঝুম দ্রুত পা চালিয়ে সিঁড়ির কাছে আসতেই তাহমীদকে দেখল। সে উপরে আসছিল রুমঝুমকে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়ল। রুমঝুম ও দাঁড়িয়ে আছে এই ভেবে তাহমীদ উঠে এলেই সে নামবে। কিন্তু তার তো কোনো হেলদোল নেই দেখা যাচ্ছে। তাহমীদের দৃষ্টি বরাবরই ঠান্ডা। এমন ভাবে তাকায়! রুমঝুমের মেরুদন্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও যখন সে নড়ে না তখন রুমঝুমকেই পা বাড়াতে হয়। সে যখন তাহমীদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন তার মনে হচ্ছিল কিছু একটা তার দম খিচে টেনে ধরেছিল।

অনিরুদ্ধ পাঞ্জাবি পরে তৈরি হয়ে সবেমাত্র ঘর থেকে বের হতে নিল, অমনি কোথা থেকে রিনিঝিনি এসে হাজির। তার হাতে কিছু একটা আছে যা সে কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছে। সে এসেই জিনিসটা অনিরুদ্ধের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

-‘আপনাকেই খুঁজছিলাম এতক্ষণ। চলুন!’

চমকে উঠে অনিরুদ্ধ বলল,

-‘কোথায়? আর এটা কী?’

-‘দাদুর ঘরে চলুন। আর এটা পানের বাটা আমি চু’রি করেছি।’

অনিরুদ্ধ হেসে ফেলল,

-‘চু’রি করলে স্বীকার যায় কে?’

আহা! এত সুন্দর হাসি! এই হাসির উপরেই তো রিনিঝিনি বারবার ফেঁ’সে যেতে পারে। লোকটা এত বেশি কেন আকৃষ্ট করে তাকে? রিনিঝিনির ইচ্ছে করে সুর তুলে গাইতে,

‘বন্দে মায়া লাগাইছে
পিরিতি শিখাইছে
দেওয়ানা বানাইছে রে
কী যাদু করিয়া গো বন্দে মায়া লাগাইছে’

অনিরুদ্ধ পানের বাটা নেড়ে চেড়ে দেখে রিনিঝিনিকে বলল,

-‘এটা গোল্ডের?’

-‘হুম।’

-‘দাদুর জিনিস চু’রি করতে গেলেন কেন হঠাৎ?’

-‘রাগ হয়েছে তাই।’

-‘আপনার রাগ হয়?’

-‘হবে না কেন? আমি কি অনুভূতিহীন?’

-‘না তেমনটা না। আপনাকে আমি আসলে অন্যভাবে দেখেছি।’

-‘কীভাবে?’

অনিরুদ্ধ ভাবনায় পড়ে গেল। কীভাবে বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না।

-‘আপনাকে আমার শান্ত ব্যক্তিত্বের অধিকারী মনে হয়েছে।’

-‘শান্ত ব্যক্তিত্বের মানুষের রাগ হয় না? শুনুন! যে উপরে যত শান্ত ভেতরে ঠিক ততোটাই অশান্ত।’

অনিরুদ্ধ কৌতুক করে হাসল,
-‘তাই নাকি?’

-‘হ্যাঁ তাই। আমার রাগ হয়, অভিমান হয় আবার…’

-‘আবার?’

-‘আবার অনেক কিছুও হয়। এত কিছু বলতে পারব না। আপনি চলুন আমার সাথে। এই পানের বাটা দাদুর হাতে তুলে দিয়ে বলবেন আপনি উদ্ধার করেছেন।’

-‘মানে?’

-‘উফ! সব কিছুর এত মানে মানে করতে হয় না তো।’

আশুরা খাতুন গম্ভীর মুখে পানের বাটাটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছেন। একসময় তার গম্ভীর মুখে হাসি ফোটে। অনিরুদ্ধের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন,

-‘তোমার নাম কী ভাই!’

-‘অনিরুদ্ধ হাসান।’

আশুরা খাতুনের কাছে নামটা কঠিন লাগল। তিনি আমতা আমতা করে বললেন,

-‘ছোড নাম নাই?’

-‘আমার মা অনি বলে ডাকেন।’

-‘অনি? সুন্দর নাম। বাড়ি কোই তোমার?’

-‘বনানীতে।’

-‘ওহ। তোমার আব্বা কি করে?’

-‘বাবা বিজনেস করতেন।’

-‘এহন?’

-‘বাবা বেঁ’চে নেই।’

আশুরা খাতুনের মন নরম হলো। অনিরুদ্ধের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

-‘আহারে! থাক দুঃখ পাইও না। আমাগো বাপও আমরা অল্প বয়সে থাকতেই দুনিয়া ছাড়ছে। তা তোমার মা আছেন?’

-‘জ্বি মা আছেন।’

-‘তুমি কী কাম করো?’

-‘আমি আর্কিটেক্ট।’

-‘কি টেক!’

রিনিঝিনি পাশ থেকে বিরক্ত মুখে বলল,

-‘ইঞ্জিনিয়ার।’

আশুরা খাতুন খুশি হয়ে গেলেন। ইঞ্জিনিয়ার মানে বিরাট বড় কিছু। আর্কিটেক্ট তো তিনি বোঝেন না। দুইটা শব্দ তিনি ভালো চেনেন এক ডাক্তার, দুই ইঞ্জিনিয়ার।

-‘বিয়া করছ?’

অনিরুদ্ধ এবার একটু লজ্জা পেল। রুম ভর্তি এত সব মহিলার মধ্যে একে তো অস্বস্তি হচ্ছে তারওপর এমন সব প্রশ্ন! রিনিঝিনি ও তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার এবার বেশ লজ্জাও লাগছে।

-‘না।’

আশুরা খাতুনের মন খুশিতে ভরে উঠল। রিনিঝিনি অনিরুদ্ধের পাশেই দাঁড়িয়ে। দু’টোকে যা ভালো মানিয়েছে! এই নাতিনের বিয়ে নিয়ে তার অনেক শখ আহ্লাদ আছে। অনিরুদ্ধকে মনে ধরেছে উনার। রিনিঝিনির জন্য এমন সুন্দর পাত্রই চাইছিলেন তিনি।

-‘তুমি তাহমীদের বন্ধু?’

মিথ্যে বলতে ইচ্ছে করছে না অনিরুদ্ধর। তারপরও বলতে হলো,

-‘জ্বি।’

-‘আসবা তো সবসময়? বন্ধুর বাড়িতে আসিও। ঘুরবা, খাইবা, আড্ডা দিবা।’

-‘জ্বি সুযোগ পেলে চেষ্টা করব আসার।’

-‘আমার নাতিনরে তোমার কেমন লাগে?’

এমন প্রশ্নে অনিরুদ্ধ একা নয় রিনিঝিনিও হকচকিয়ে গেল। দাদীর পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,

-‘এসব কি বলছ?’

আশুরা খাতুন পাত্তা দিলেন না। জবাবের আশায় তাকিয়ে রইলেন। অনিরুদ্ধ এবার রিনিঝিনির দিকে তাকালো। লম্বা, ছিপছিপে গড়নের মেয়েটা আহামরি রূপবতী না কিন্তু আকর্ষণীয়। যে কাউকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা তার আছে। আশুরা খাতুন অনিরুদ্ধর দৃষ্টি খেয়াল করে মুচকি হাসেন। রিনিঝিনির তখন যাই যাই অবস্থা। এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়েছে না পারছে বলতে আর নাই বা পারছে সইতে।

অনিরুদ্ধ রিনিঝিনির অস্বস্তি বুঝতে পেরে চোখ সরায়। আশুরা খাতুনকে ছোট করে বলে,

-‘ভালো লাগে।’

রিনিঝিনি কেঁপে উঠল। অনিরুদ্ধর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। সে ভেবেছিল এটার কোনো জবাব অনিরুদ্ধ দিবে না। দেওয়ার আছেই বা কী? না! সে বেশি ভাবছে। অনিরুদ্ধ নিশ্চয়ই এখন পরিস্থিতির চাপে এমন কথা বলেছে। ঠিকই তো! এমন প্রশ্নে কেউ কি বলবে খারাপ লাগে? না না এখানে অন্য কিছু নেই। অত খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই।

আশুরা খাতুনের ঘর থেকে বের হয়ে আসার সময় জরিনা রিনিঝিনিকে বলল,

-‘দেখছেন দাদীর কামডা! পানের বাটা কইরা কইরা অস্থির অথচ এহন খুঁইজা পাইয়া জিগাইলো ও না কই থেইকা বাইর করছে। হেয় আমারেই যত ইনবিজিগেশন করে। আর কাউরে করে না।’

-‘শব্দটা ইনভেস্টিগেশন হবে।’

-‘হ হইছে। আপনে আজীবন আমার ভুলই ধরেন!’

#চলবে।