এখানে সুখ ছোঁয়া যায় পর্ব-১৫ এবং শেষ পর্ব

0
286

‘এখানে সুখ ছোঁয়া যায়’ অন্তিম পর্ব
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

ইখতিয়ার নিচে এসে দেখল চারদিকে মানুষ গিজগিজ করছে। বহু বছর পর এমন কোনো অনুষ্ঠানে এসে তার আনন্দ হচ্ছে। অবাক করা ব্যাপার, অচেনা অজানা কতগুলো মানুষের সাথে অল্প সময়ের মধ্যেই তার ভাব হয়ে গেছে। সবার সাথে মিশছে, কথা বলছে, গল্প করছে। রিনিঝিনিকে আজ অন্য দিনের তুলনায় কম ব্যস্ত মনে হলো। সে সমবয়সীদের সাথে গল্প করছে। এদিক ওদিক গিয়ে ছবি তুলছে। এক ফাঁকে আবার ইখতিয়ারকে এসে জিজ্ঞেস করে গেল, ‘অসুবিধা হচ্ছে না তো?’ এক সময় ইখতিয়ারের মনে হলো এসেছে থেকে বাড়ির সবচেয়ে গুরুজনের সাথে তার আলাপ হয়নি। তাই সে আশুরা খাতুনের কাছে গেল। তিনি তখন অতিথিদের সাথে বসে গল্প করছেন। নতুন বউ অর্থাৎ সালমা কায়সার তাঁর এক পাশে বসে আছেন। ইখতিয়ার সকলের উদ্দেশ্যে সালাম দিতেই আশুরা খাতুন চেঁচিয়ে উঠলেন,

-‘এই তুমি এইহানে কি করো?’

ইখতিয়ার একটু ভড়কে গেল। কি বলবে বুঝতে পারল না। আশুরা খাতুন সালমা কায়সারকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-‘তোমার পুতে কি ছুডু বাইচ্চা? কইলাম না হেরে দূরে থাকতে!’

ইখতিয়ার তব্দা খেয়ে গেল। সালমা কায়সার ও ইতস্তত দৃষ্টিতে তাকালেন ইখতিয়ার এর দিকে। পাশ থেকে ছোট ফুফু বললেন,

-‘আম্মা, চুপ যান এখন। বাড়িতে মেহমান আছে পরে এসব নিয়ে কথা বলবেন।’

-‘ক্যা? আমি চুপ যামু ক্যা? ওই পোলা তোমারে মানা করসি না এহানে আইতে?’

ইখতিয়ার এবার মুখ খুলল,

-‘আপনি কি বলছেন আমি বুঝতে পারছি না।’

-‘ওমা কি কয়! ও বড় বউ, তোমার পুতে নাকি বোঝে না।’

ইখতিয়ার এবার একটু জোর গলায় বলল,

-‘আশ্চর্য! আপনি আমাকে উনার ছেলে বলছেন কেন বারবার? উনি তো আমার মা নন।’

ছোট ফুফু লাফ দিয়ে উঠে বললেন,

-‘কি বলো? তুমি ভাবীর ছেলে না?’

ইখতিয়ার দু পাশে মাথা নেড়ে বলল,

-‘না। ইভেন আমি উনাকে চিনিও না।’

-‘তাহলে তুমি কে?’

-‘আমি ইখতিয়ার। সারোয়ার খানের ছেলে।’

ছোট ফুফু মনে করার চেষ্টা করতে থাকেন। হঠাৎ করেই চেঁচিয়ে বলে,

-‘সারোয়ার ভাই? গার্মেন্টসের ব্যবসা ছিল যার উনি?’

-‘জ্বি।’

-‘ভাই তো মনে হয় মা’রা গেছেন আরো কয়েক বছর আগে।’

ইখতিয়ার মাথা নাড়ল। কিছু বলতে পারল না। ফুফু এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এরপর বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগিয়ে তারা আশুরা খাতুনকে মনে করালেন সারোয়ার খানের কথা। বয়স হওয়ায় তাঁর তেমন মনে ছিল না। কিন্তু এখন মনে করিয়ে দেওয়াতে চিনতে পারলেন। এক সময় এই ছেলেটা যখন কোলের ছিল তখন তাকে নিয়ে তার মা এই বাড়িতে এসেছিল। তিনি ইখতিয়ারকে পাশে বসিয়ে নানান গল্প করতে লাগলেন। পুরোনো স্মৃতিচারণের পাশাপাশি নিজের ব্যবহারে ক্ষমাও চাইলেন। একটু পর রিনিঝিনি এলো। ইখতিয়ারকে নিজ দাদীর পাশে মধ্যমণি হয়ে বসে থাকতে দেখে তার যা বোঝার বোঝা হয়ে যায়।

তাহমীদ আজ কয়েকবার রিনিঝিনির ঘরের সামনে দিয়ে আসা যাওয়া করেছে। অথচ একবারও রুমঝুমের দেখা পায়নি। তার ইচ্ছে করে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়তে। কিন্তু অতটা অসভ্যতা আবার করা চলে না। একটু সভ্যতা তার মধ্যে এখনও আছে। সে ঘরে এসে দুই লাইনের একটা চিঠি লিখল। চিঠি হাতে নিয়ে সে এদিক ওদিক ঘুরতে লাগল। অদ্ভুত ভাবে আজ কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বড় চাচা তাকে এমন ঘুরঘুর করতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,

-‘কি ব্যপার তাহমীদ? এমন অদ্ভুত আচরণ করছ কেন?’

-‘কি করলাম চাচা?’

-‘কি করলে মানে? সেই কখন থেকে দেখছি তুমি একবার এই পাশ থেকে ওপাশ যাচ্ছো আবার ওপাশ থেকে এপাশে আসছো। সেটাও তুমি একবার নয় কয়েকবার করেছ।’

-‘আসলে তেমন কিছু না চাচা। আমার খাওয়া বেশি হয়ে গেছে তো তাই একটু পায়চারি করছি।’

-‘পায়চারি করার জন্য গার্ডেন আছে। সেখানে যাও। বেশি সমস্যা হলে তোমার জিমে যাও। এমন করলে লোকে কি ভাববে?’

-‘কি ভাববে?’

চাচা বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন। একটু সামনে যেতেই তিনি আবার পেছনে ফিরলেন। তাহমীদকে ডেকে বললেন,

-‘রিনির ঘরে একটা মেয়ে আছে। সম্ভবত আমাদের স্কুলের নতুন টিচার। আমি খেয়াল করেছি মেয়েটা একটু পর পর দরজা খুলে উঁকি দিচ্ছে বাইরে। যখনই তোমাকে দেখছে তখনই আবার দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। বোধ করি তুমি অন্য কোনো মতলব নিয়ে এখানে হাঁটছ না।’

তাহমীদ ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল। আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ালো না। একেবারে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেল। পথে তার রিতির সাথে দেখা হলো। তার হাতে চিঠিটা দিয়ে তাহমীদ বলল, ‘স্কুলের মিস কে দিবি।’

রিতি উপরে আসতে তার দেখা হলো ঈশানের সাথে। ঈশান তার হাতে কাগজ দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,

-‘এটা কি?’

রিতি দুষ্টুমি করে হেসে বলল,

-‘প্রেমপত্র।’

ঈশান চোখ রাঙানি দিতেই বলল,

-‘আরে আমার না।’

-‘কার তবে?’

-‘বড় ভাইয়ার।’

-‘মানে?’

-‘মানে হলো, ভাইয়া এই চিরকুট স্কুলের নতুন টিচারকে দিতে বলল।’

ঈশানের মনটা ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে গেল। সে বলল,

-‘মিথ্যে বলছিস।’

-‘আরে সত্যি। ভাইকে জিজ্ঞেস করো। চাইলে চিঠি দেখতে পারো।’

-‘না। আমি অন্যের জিনিস দেখি না। আর কোনো দিন দেখবও না।’

ঈশান মন খারাপ করে চলে গেল। ধুর; সন্দেহ ঠিক ছিল। ভাইয়ের প্রেমিকার দিকে চোখ পড়েছে ভাবতেই তার এখন লজ্জা লাগছে। ধুর! ধুর!

ঊষান আর তাইফ বাইরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিল। মৌনতা তখন খুব সেজেগুজে এলো কোথা থেকে যেন। এসেই বলল,

-‘আমাকে কেমন লাগছে?’

তাইফ কিছু বলল না। ইশারায় আঙুল তুলে দেখালো সুন্দর লাগছে। মৌনতা ঊষানের দিকে তাকালো। বলল,

-‘তুমি কিছু বলো?’

-‘কি বলব?’

-‘আমাকে কেমন লাগছে এই লেহেঙ্গায়? জানো এটা কার ডিজাইন করা? মনীষ মালহোত্রার!’

-‘ও… না লেহেঙ্গাটা আসলেই সুন্দর। কিন্তু তোমাকে মানাচ্ছে না। এই যেমন ধরো, বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা।’

-‘ঊষান! আমি তোমাকে কা’ম’ড়ে দিব।’

মৌনতা তেড়ে আসছে দেখতে পেয়েই ঊষান ক্যামেরা ফেলে দৌঁড় দিল। এই জংলি মেয়ের ঠিক নেই। সত্যিই দেখা গেল কা’ম’ড়ে দিয়েছে।

অনিরুদ্ধ ছাদে এসে বসে আছে। তার মন ভালো নেই। কোনো ভাবেই সে আনন্দ করতে পারছে না। অথচ সে প্রথমে ভেবেছিল তেমন কিছুই হবে না। অনিরুদ্ধ ছাদে এসেছে জানতে পেরে একটু পর রিনিঝিনি ও এলো। এসে দেখল অনিরুদ্ধ আকাশের দিকে চুপ করে তাকিয়ে আছে।

-‘মন খারাপ?’

অনিরুদ্ধ মাথা নাড়ল। যার অর্থ না। রিনিঝিনি একটু দূরত্ব রেখে পাশে দাঁড়ালো। বলল,

-‘খুব বেশিই মন খারাপ?’

অনিরুদ্ধ আবার মাথা নাড়ে। তবে এবার সে হ্যাঁ বোঝায়।

-‘আপনি মন থেকে মানতে পারেন নি তাই না?’

অনিরুদ্ধ রিনিঝিনির চোখে চোখ রেখে বলল,

-‘আসলে তেমনটা নয়। এই বিয়েটা আমিই জোর করে দিয়েছি। মা কখনো নিজ থেকে কিছু করেন নি। বলা চলে মা রাজিই হন নি। আমার বাবা যখন এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যান তখন আমার বয়স মাত্র তিন। আমার মা তখনও যুবতী। ওই বয়সে একা একটা ছেলেকে মানুষ করাটা সহজ কাজ ছিল না। সবাই চেয়েছিলেন মা বিয়ে করুক আবার। তবে মা রাজি হননি। বাবার টাকা পয়সা কম ছিল না। আমরা বেশ আয়েশেই ছিলাম। খাওয়া পরার কোনো অভাব ছিল না ঠিক তবে একটা শক্ত ছায়ার অভাব ছিল। মা যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন সেই অভাব কাটানোর। তবে মাঝে মাঝে মা কাঁদতেন। আমার যখন বয়স পনেরো তখন একদিন শুনলাম নানু মাকে কিছু বলছেন। যা বুঝলাম, আমার বাবা মাকে মা’রা যাওয়ার আগে বলে গেছেন তিনি যেন নতুন জীবন শুরু করেন। নানুর কথা তাহলে মা কেন সেটা করছেন না। মা শুধু চুপ করে শুনতেন। এরপর নানুও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমরা আরো একা। বলে রাখি, আমার দাদা দাদুও আমার জন্মের আগেই মা’রা যান। বাবার আর কোনো ভাই বোন ছিল না। আমার মায়ের ও যে বোন উনি বিদেশে থাকতেন। তাই আমরা খুব একা ছিলাম। মা বাবার অফিসে বসতেন নিয়মিত। নানান কাজে নিজেকে খুব ব্যস্ত রাখতেন। আমি যখন ভার্সিটিতে পড়ি, থার্ড ইয়ারে তখন একটা জিনিস নোটিস করতে থাকি। প্রতিদিন এক মধ্য বয়স্ক লোক আমাদের বাড়ির মোড়ের চায়ের দোকানে বসে পেপার পড়তেন আর একটু পর পরই আমাদের বাড়ির দিকে তাকাতেন। মা ও দেখতাম তাকে দেখলে কেমন মিইয়ে যান। আমি একদিন কিছুটা আন্দাজ করতে পারি। মা কে জিজ্ঞেস করি। আমার মা তখন কিছু গোপন করলেন না। বললেন কলেজ লাইফে তার একজন প্রেমিক ছিলেন। মাকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু বিয়েটা কিছু কারণে তাদের হয় না। ওই লোক কিছু মাস আগে জানতে পারলেন মায়ের জীবনের বয়ে যাওয়া ঝড়ের কথা। এরপর তিনি এখানে আসেন। আমার প্রথমে ভীষণ রা’গ হয়েছিল। আমি পারি না তখনই গিয়ে লোকটার মা’থা ফা’টিয়ে দেই। মা বলেন তিনি বারণ করেছেন লোকটাকে। তারপরও তিনি আসেন রোজ। একারণে মা আমাকে অফিসের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। আমিই এরপর থেকে সবটা সামলাতে থাকি। মা বাড়িতে থেকেও সব কিছুর দেখভাল করেন। আমরা ভেবেছিলাম লোকটা একটা সময় ঠিকই চলে যাবেন। অথচ বছর পার হলো। নিয়মিত এক বেলা উনি আসতেন। একদিন আমি না সহ্য করতে পেরে নিচে গেলাম। তিনি আমাকে দেখে হেসে বললেন, ‘মা’রতে এসেছ?’ আমি সেদিন সত্যিই তাকে আর কিছু করতে পারলাম না। বরং নিস্তেজ হয়ে বাড়ি ফিরলাম। লোকটার থেকে জানতে পারি তিনি তখনও বিয়ে করেননি। তার সেই প্রেমিকাকে না পাওয়ায় আর বিয়ে করবে না বলে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হয়েছেন। তিনি আগে কোনো দিন আসেনি। কারণ কখনো চায়নি তার জন্য মায়ের কোনো অসম্মান হোক। তবে বাবার চলে যাওয়ার কথা শুনে, মায়ের একা জীবন চলার ঘটনা শুনে তিনি কৌতুহল বশত একদিন এসেছেন। এরপর রোজই আসতে লাগলেন। একসময় লোকটা ক্ষমা চায় আমার কাছে। আমি তার চোখে সেদিন কোনো নোং রা মি দেখিনি। দেখেছি বহু বছরের জমিয়ে রাখা প্রেমিকের চোখের প্রেম। লোকটা কথা দিয়েছেন আর আসবেন না। যতোই হোক তিনি অ’প’রা’ধ করছেন। কাজটা কোনো ভাবেই গ্রহণ যোগ্য নয়। এরপর সত্যিই তিনি আর কোনো দিন আসেন নি। মাঝে কয়েক বছর পার হয়। আমি মা কে দেখে অ”প’রা’ধবোধে ভুগি। আমার বারবার মনে হয় আমার জন্য মা একটা জীবন একাকী পার করে দিয়েছেন কোনো অভিযোগ ছাড়া। একদিন মাকে জিজ্ঞেস করি। মা বলেন আমার বাবাকে তিনি অত্যন্ত সম্মান করেন। কেবল আমার জন্য নয় বরং সেই সম্মান থেকেও মা কোনো দিন এগিয়ে যান নি। আমি আর কিছু বলিনি। বলার মতো তো কিছু ছিল না।’

রিনিঝিনি অবাক হয়ে সবটা শুনছিল। অনিরুদ্ধ থেমে যেতেই বলল,

-‘তারপর? তারপর কীভাবে হলো এই সবটা!’

-‘মায়ের মনে বাবার প্রতি যেমন সম্মান ছিল তেমনি ওই লোকটার জন্য ভালোবাসা ছিল। সেটা কখনোই বিলীন হয়নি। আমি যখন বুঝতে পারলাম আমি চাইলে এই দুটি মানুষকে মেলাতে পারি। তখন আর দেরি করিনি। আমি আঙ্কেলের অফিসে গেলাম। এবং নিজে থেকে প্রস্তাব দিলাম। উনি একসময় রাজি হলেও মা রাজি হননি। মাকে রাজি করাতে আমার সময় লেগেছে। আসলে মা খুব ভয় পেতেন। সমাজের কথা ভাবতেন। এক সময় আমি মাকে বুঝিয়ে বলি, এই সমাজ কখনোই আমাদের জন্য ভাবেনি। আমরা তবে কেন ভাববো? এটা তো কোনো অপরাধ নয়। শেষ দিনও মা ভীষণ কেঁদেছেন। আমাকে ছেড়ে আসতে তাঁর যে খুব কষ্ট হচ্ছিল আমি তা জানি। তবে সেদিন আমার সবচেয়ে আনন্দ হচ্ছিল। আমি যেন সেদিন মা নয় নিজের মেয়ের বিয়ে দিচ্ছিলাম দাঁড়িয়ে থেকে। ওই অনুভূতি ছিল অন্যরকম। প্রশান্তির।’

-‘আমার বড় চাচা যে এমন পাগল প্রেমিক সেটা তো আমরা জানতামই না। বড় চাচা বরাবরই গম্ভীর ছিলেন। আমরা উনাকে ভয় পেতাম ছোট থেকেই।’

অনিরুদ্ধ মৃদু হাসে। রিনিঝিনি কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল,

-‘আপনি প্রেম ভালোবাসা এত ভালো বোঝেন?’

-‘তা একটু বুঝি।’

-‘প্রেমে পড়েছেন কখনো।’

-‘বহুবার।’

রিনিঝিনির গলা কেঁপে উঠল,

-‘সত্যি?’

অনিরুদ্ধ হাসল,

-‘প্রকৃতির প্রেমে পড়েছি।’

-‘আমি মানুষের কথা বলছি।’

-‘হ্যাঁ, পড়েছি। মানুষ ও প্রকৃতির অংশ।’

রিনিঝিনির এবার রাগ হলো। সে চলে আসতে নিলেই অনিরুদ্ধ বলে,

-‘আপনি যে প্রেমের দিকে ইঙ্গিত করেছেন সেই প্রেমে বোধহয় খুব শীঘ্রই পড়ব। একেবারে পা পিছলে। কিন্তু আমাকে ধরে তোলার কেউ নেই। আপনি কি সেই দায়িত্ব নিবেন?’

রিনিঝিনি কিছু বলতে পারল না। তার বুকে আবারো ঘন্টি বাজছে। ডং ডং ডং। সে এক ছুটে সেখান থেকে চলে গেল।

_________________________________

রুমঝুম সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে যখন বের হচ্ছিল তখনি তার তাহমীদের উপর চোখ পড়ল। অন্য দিনের মতো আজ তেমন ফিটফাট হয়ে নেই সে। কেমন যেন ছন্নছাড়া লাগছে। রুমঝুম বাইরে বেরিয়ে এসে ব্যাগ থেকে চিঠিটা বের করল। কাল রিতি যখন চিঠিটা তাকে দিয়েছিল সে ভয়ে বের করে দেখতে পারেনি। এখন ইচ্ছে করছে একটু দেখতে কি লেখা আছে তাতে। ভাজ খুলতেই দেখল গুটিগুটি অক্ষরে লেখা, ‘সেদিন অডিটোরিয়ামে কেন এলে না রুমঝুম? তুমি কি জানো আমি সেদিন রাত পর্যন্ত সেই অডিটোরিয়ামে বসে ছিলাম! শুধু তোমার অপেক্ষায়।’

রুমঝুমের হাত ফসকে চিঠিটা পড়ে গেল নিচে। বাতাসের কারণে একটু দূরে উড়ে গিয়েই পড়ল। সে চিঠিটা তুলে নেওয়ার আগেই তাহমীদ এসে চিঠিটা তার হাতে তুলে নিল। রুমঝুম স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইল তাহমীদের চোখের দিকে। তার মনে পড়ে গেল কলেজের বিদায়ের দিনের কথা। তার ব্যাগের উপর সেদিন কেউ একজন একটা চিরকুট রেখে গিয়েছিল। সেখানে লেখা ছিল, ‘তিনটায় একটু অডিটোরিয়ামে এসো তো!’ সে যখন চিরকুট হাতে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তখন খেয়াল করেছে জানালার পাশে তাহমীদ দাঁড়িয়ে ছিল। তার ঠোঁটে সেদিন আসলেই মুঁচকি হাসি ছিল। যেটা তার সেদিন চোখের ভ্রম মনে হয়েছিল।

ইখতিয়ার এর দরকারি জিনিস গুছিয়ে দিয়ে জরিনা যখন চলে আসছিল ইখতিয়ার তখন তাকে পেছন থেকে ডাকে। ইখতিয়ারকে মানি ব্যাগ বের করতে দেখে জরিনার মন খুশিতে ভরে উঠল। সে এতক্ষন এটাই চাইছিল। এই লোক এসেছে থেকে সে তার জন্য কম খাটেনি। একটু বকশিশ তো আশা করতেই পারে! কিন্তু এরপর যা হলো তার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না।

রিনিঝিনি নিজের ঘরে বসে জামা কাপড় ভাজ করছিল। জরিনাকে কাউকে গা’লি দিতে দিতে আসতে দেখে সে ভ্রু কুঁচকে বলল,

-‘কি হয়েছে রে?’

-‘কি হইত না? আমি গরীব হইতে পারি ফকিন্নি তো না। হেয় আমারে এত বড় অকমান করব কিল্লি গা!’

-‘অকমান না অপমান হবে কথাটা।’

-‘হ আপনেও এহন করেন অকমান।’

-‘ধ্যাত! কি হয়েছে বলবি তো?’

জরিনা ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,

-‘ওই বিদেশি ব্যাডায় আমারে পঞ্চাশ ট্যাহা দিসে বকশিশ। কয় এই ট্যাহা দিয়া ভালা কাপড় চোপড় কিনতাম, কিছু খাইতাম। আপনে কন পঞ্চাশ ট্যাহা দিয়া কেমতে জামা কাপড় কিনে আবার খানাও কিনে।’

রিনিঝিনি অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে বলল,

-‘আসলেই?’

-‘তয় আপনে কি ভাবসেন আমি মিছা কতা কই? এই যে নিজ চোউক্ষে দেইখ্খা লন।’

জরিনা নোটটা সামনে ধরল। রিনিঝিনি দেখল এটা টাকা নয় পাউন্ড। গুগল করে দেখল এটা বর্তমানে বাংলাদেশে ৭ হাজার টাকার বেশি। সে হাসতে হাসতে বলল,

-‘আরে বোকা মেয়ে। এটা তো টাকা না।’

-‘ট্যাহা না মানে? ও… তাই তো আমি কই এইহানো এডা কার ফডো। ব্যাডা আমার লগে মশকরা করসে ফডো ওয়ালা কাগজ ধরাইয়া।’

-‘আহ! বাজে বকিস না আগে বোঝ। এটা হলো পাউন্ড। মানে বিদেশি টাকা। আর এই বিদেশি টাকা আমাদের দেশে কত হবে জানিস?’

-‘কত?’

-‘সাত হাজার পাঁচশ বায়ান্ন টাকা।’

জরিনা চিৎকার করে উঠল,

-‘ও আল্লাহ গো; কি কন! সইত্য কইতাছেন?’

-‘হ্যাঁ। তুই ব্যাঙ্কে যা দেখবি তারা এটা নিয়ে তোকে টাকা দিয়ে দিবে।’

-‘ও মা গো! আমার তো বিশ্বাস হয় না। হায় হায়! কেউ জানত পারলে তো আমার লগে ডা’কা’তি করব। আপনে কাউরে কইয়েন না বড় আফা। পিলিজ লাগে!’

রিনিঝিনি হাসতে থাকে অবিরত। একটু পর ইখতিয়ার ও যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। সবার থেকে বিদায় নিয়ে শেষে রিনিঝিনির কাছে আসে। রিনিঝিনি বলল,

-‘আবার আসবেন ইখতিয়ার সাহেব।’

ইখতিয়ার হেসে বলল,

-‘অবশ্যই আসব। কেননা এখানে সুখ ছোঁয়া যায়।’

রিনিঝিনি চমকে উঠল ইখতিয়ার হাসল আবার। বলল,

-‘বাড়ির এই নামটা নিশ্চয়ই আপনার দেওয়া?’

চূড়ান্ত রকমের অবাক হয়ে রিনিঝিনি বলল,

-‘হ্যাঁ, আপনি জানলেন কীভাবে! কেউ বলেছে?’

-‘না, আর কাউকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করিনি। আমার মন বলছিল এটা আপনার মাথা থেকে এসেছে।’

রিনিঝিনি চুপ করে রইল কিছু বলল না। জরিনা দৌড়ে এসে বলল,

-‘ভাইজান ধইন্যবাদ। আমার জীবনে কেউ কোনো দিন এত ট্যাহা বকশিশ দেয় নাই। আপনেরে দোয়া করি। আপনেরে যেন আল্লাহ বাংলা বউ মিলায় দেয়। একেবারে আমগো বড় আফার মতো।’

শেষ কথাটা শোনার সাথে সাথেই রিনিঝিনি কেঁপে উঠল। একবার জরিনার দিকে তাকিয়ে আরেকবার ইখতিয়ারের দিকে তাকাতেই খেয়াল করল ইখতিয়ারের ঠোঁটে হাসি। গাড়িতে ওঠার আগেও ইখতিয়ার আরেকবার পেছনে তাকাতে ভুলল না।

(সমাপ্ত)