‘এখানে সুখ ছোঁয়া যায়’ (পর্ব-৫)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
রুমঝুম স্তব্ধ হয়ে এখনও একই জায়গায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। বেশ বিচলিতও দেখা যাচ্ছে তাকে। ল্যাপটপ বিছানায় রেখে তাহমীদ উঠে এগিয়ে এলো তার দিকে। তাহমীদকে এগিয়ে আসতে দেখে তার বুকের ভেতরে যেন কা’ম’ড় পড়ল। হাত পা তার অস্বাভাবিক ভাবে ঠান্ডা হয়ে পড়ল। দ্রুত মাথা নিচু করে ফেলল। তাহমীদ যদিও অবাক হয়ে এসে জানতে চাইছিল কি হলো? কিন্তু রুমঝুমের মুখের দিকে তাকিয়ে তার হাসি পায়। মেয়েটা তাকে ভ’য় পাচ্ছে? আশ্চর্য! সে কী খেয়ে ফেলবে তাকে!
-‘কী ব্যাপার?’
একটা রাশ ভারী গলার স্বর কানে আসতেই মাথা তুলে তাকালো রুমঝুম। তাহমীদ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার গলা শুকিয়ে আসে তাতে। বেশ নার্ভাস হয়ে পড়ছে সে। তাহমীদ আরেকবার তাকে পরখ করে বেডের দিকে এগিয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মাথায় এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে বলল,
-‘নাও।’
ইতস্তত ভঙ্গিতে গ্লাসটা হাতে নিল সে। এক টানে গ্লাসের সবটুকু পানি পান করে গ্লাস খালি করে দিল। তা তাহমীদ মৃদু হাসে। তাহমীদকে হাসতে দেখে আরো ল’জ্জা পায় রুমঝুম। ইশ! এমন ভাবে পানি খেয়েছে যেন সে কত কালের তৃষ্ণার্ত।
তাহমীদ গ্লাসটা রুমঝুমের হাত থেকে নিয়ে সাইড টেবিলে রাখল। পুনরায় জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে। এবার রুমঝুম নিজেকে সামলে নিয়ে বলতে লাগল,
-‘কিছু মহিলা আমাকে ভেবেছিল আমি আপনার….
থেমে গেল সে। বলতে দ্বিধা হচ্ছে। তাহমীদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
-‘তুমি আমার?’
প্রচন্ড ল’জ্জা লাগছে রুমঝুমের। তবুও, উপায় যেহেতু আর নেই, বলতেই হবে। তাই ল’জ্জা কোনো ভাবে চেপে রেখে বলল,
-‘ওনারা ভাবছেন আমি আপনার ওয়াইফ।’
-‘তো?’
নির্লিপ্ত শোনালো তাহমীদের গলা। এমনটা রুমঝুম আশা করেনি। চমকে উঠে বলল,
-‘তো মানে? কেউ আপনাকে আর আমাকে জড়িয়ে ফেলছে। আজেবাজে ভাবছে।’
-‘জড়িয়ে ফেলুক। তাদের জড়িয়ে ফেলাতে আমরা একে অপরের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছি না। যাচ্ছি কি?’
রুমঝুম মাথা নাড়ল। না, জড়িয়ে যাচ্ছে না।
-‘তারপর?’
রুমঝুম বুঝল তারপর বলতে তাহমীদ জানতে চাইছে সে এখানে কেন। সে মাথা নিচু করে বলল,
-‘ওই মহিলাদের মধ্যে একজন হুট করেই আমার হাত ধরে টে’নে নিয়ে এনে এই রুমে বন্ধী করে দিলেন। তাঁর ধারণা…
আবারও কথা বলতে গিয়ে আ’ট’কে গেছে সে। তাহমীদ দেয়ালে হেলান দিয়ে দু হাত বুকের মধ্যে ভাজ করে বলল,
-‘তাঁর ধারণা?’
-‘তাঁর ধারণা আমাদের মান অভিমান হয়েছে। অর্থাৎ তাঁরা ভাবছেন স্বামী স্ত্রীর মধ্যে একটু কথা কা’টা’কা’টি হয়েছে তাই দুজন দূরে দূরে থাকছে। এজন্যে উনি আমাকে এভাবে এই ঘরে নিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে বাহির থেকে। আপনি দেখুন! দরজাটা বাহির থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’
তাহমীদ এগিয়ে গিয়ে দেখল। দরজা বন্ধ। রুমঝুম বলল,
-‘প্লিজ কিছু করুন। আমি বের হবো।’
-‘কি করব?’
-‘দরজাটা প্লিজ কাউকে খুলে দিতে বলুন না!’
এক পলক রুমঝুমের আতঙ্কিত মুখটা দেখে নিয়ে ঊষানকে কল করল। ঊষান জানালো সে বড় ঘাটে। ঈশানকে কল করতেই সে জানালো আসছে। কিন্তু আসছে বলেও পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হয়ে যায় সে আসে না। রুমঝুম দরজায় বারি দিয়ে কাউকে ডাকতে নিতে গেলে তাহমীদ বারণ করে। বাইরের কেউ এভাবে বন্ধী ঘরে তাদের দেখতে পেলে নিশ্চয়ই ভালো চোখে দেখবে না। সবাই তো আর স্বামী-স্ত্রী ভাববে না। তাছাড়া তারা তো স্বামী-স্ত্রীও নয়। ঈশানকে আবারও কল করতেই সে জানালো বড় চাচা তাকে নিয়ে গার্ডেনের খাবার দাবারের তদারকি করছেন। এই মুহূর্তে আসতে পারবে না। তাহমীদ রিনিঝিনিকে কল করল। কিন্তু কল রিসিভ করল না রিনিঝিনি। করবে কী করে? সে তো বিছানায় ফোন ফেলে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। আর এমন কেউ নেই যাকে কল দেওয়া যায়। উৎসুক দৃষ্টিতে রুমঝুম তাহমীদের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাহমীদ মাথা নাড়তেই খুব অসহায় বোধ করতে লাগল সে। আর কতক্ষণ এভাবে তাহমীদের সাথে থাকতে হবে এই ভেবেই সে ঘামছে।
তাহমীদকে চিন্তিত লাগছে না। সে তার কফি কর্ণারের দিকে এগিয়ে গেল। রাত জেগে কাজ করার অভ্যাস তার। সেজন্যে কফিও খুব খাওয়া হয়। বারবার নিচে গিয়ে কফি আনতে অসুবিধা লাগে দেখে রুমেই ছোট একটা কফি মেশিন এনে রেখেছে সে। আর সাথে কয়েকটা মগ, হরেক ব্রান্ডের কফি পাউডার, দুধ, চিনি সবই আছে। সব কিছুই সুন্দর, সুসজ্জিত ভাবে রাখা। ঝটফট কফি তৈরি করে নিয়ে এসে এক মগ বাড়িয়ে দিল সে রুমঝুমের দিকে। রুমঝুম নিতে না চাইলে এক প্রকার জোর করেই হাতে তুলে দিল। চিন্তিত মুখ করেই রুমঝুম কফিতে চুমু দিয়ে দেখল কফিটা ভালো লাগছে। তাহমীদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
-‘থ্যাঙ্ক ইউ।’
তাহমীদ কিছু বলল না। তার দৃষ্টি বারান্দার কাঁচের দরজাটা ভেদ করে আকাশে ঝলমল করা পূর্নিমার চাঁদটার উপর গিয়ে পড়েছে। সেখানেই যেন তার মন পড়ে আছে। রুমঝুম চায়ে পুনরায় চুমুক দিতেই শুনতে পেল,
-‘রুমঝুম!’
কেঁপে উঠল রুমঝুম। গুরু গম্ভীর গলাটা কিছুটা মদির শোনালো। আকস্মিক তাহমীদের মুখে নিজের নাম শুনে তার হৃদয়ের মধ্যে কিছু একটা ঘটে গেল।
-‘আমাদের অনেক বছর পর দেখা হলো তাই না?’
রুমঝুম মৃদু হেসে মাথা নিচু করে ফেলল। তাহমীদও হাসল।
রুমঝুমের তখনকার অনুভূতিটা ব্যক্ত করা যায় না। হৃদয়ের গহীনে কোনো সময় এমন সব কিছু অনুভূতির সৃষ্টি হয় যেগুলো কেন, কি জন্যে, কীভাবে সৃষ্টি হচ্ছে তা কেউই উপলদ্ধি করতে পারে না। শুধু অনুভব করে যায়। রুমঝুমও তাই করল। কিছুক্ষণ আগেও তাহমীদ তাকে চিনে গেছে বলে সে কেমন হা হুতাশ করছিল। অথচ এখন তার ভালো লাগছে তাহমীদ তাকে স্মরণে রেখেছে এই ভেবে। তার মনে পড়ল, কোনো দিন এই মেধাবী, ফার্স্ট বেঞ্চে বসা, শিক্ষকদের প্রিয় স্টুডেন্টটার সাথে তার কথা হয়নি। এই ছেলেটাকে সে অন্য ভাবেই দেখত। সবার থেকে আলাদা, ভদ্র, নম্র ছেলেটাকে তার মনে হতো অ’হং’কারী। অথচ আজ মনে হচ্ছে সে গম্ভীর কিন্তু অ’হং’কারের ছিঁটেফোঁটাও তার মধ্যে নেই।
-‘কলেজের পর তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে? রিইউনিয়ন প্রোগ্রামে তুমি ছিলে না, কার মুখ থেকে যেন শুনেছিলাম ঢাকা থেকে চলে গিয়েছিলে তোমরা।’
-‘এইচএসসির পর হুট করেই বাবার ট্রান্সফার হয়ে যায়। আমরা সপরিবারে চট্টগ্রামে চলে যাই তখন। তারপর সেখানেই তিন বছর ছিলাম। তিন বছর পর বাবার প্রোমোশন হয়ে পুনরায় ঢাকা ট্রান্সফার হয় ঠিকই কিন্তু আমি তাদের সাথে তখন মাঝপথে ভার্সিটি ছেড়ে আসতে পারিনি।’
-‘চিটাগং ইউনিভার্সিটিতে পড়েছিলে তুমি?’
চমকে উঠে রুমঝুম জবাব দেয়,
-‘হ্যাঁ। আপনি জানলেন কীভাবে?’
-‘স্কুলে তোমার জমা দেওয়া সিভিতে দেখেছিলাম।’
-‘ওহ্।’
-‘আঙ্কেল আন্টি কেমন আছেন?’
-‘বাবা অসুস্থ। মাও নানান রোগে ভূগছেন। বয়স হয়েছে তো।’
-‘আর?’
-‘আর কে? আমার কোনো ভাই বোন নেই তো।’
-‘ইন ল’জ?’
গাল লা’ল হয়ে গেল রুমঝুমের। তাহমীদ সিভিতে এটা কি দেখেনি সে বিবাহিত কিনা! ওহ! সেটা কেন দেখবে? তার দরকার শিক্ষাগত যোগ্যতা। তাই সেটাই দেখেছিল।
-‘আমি এখনও বিয়ে করিনি।’
তাহমীদ জানত। তারপরেও জিজ্ঞেস করেছে। বিয়ে করিনি কথাটা শুনতে পেরে তার ভালো লাগছে।
-‘কবে করছ?’
ধুর! তাহমীদ এসব কি জিজ্ঞেস করছে? তার ল’জ্জা লাগছে এই ব্যাপারে কথা বলতে। সেটা বুঝতে পেরেও কেন তাহমীদ তাকে বারবার এই ব্যাপারে বলছে! তাছাড়া তাদের সম্পর্ক এতটাও ভালো নয় যে এমন আলাপ করবে। কিছু কিছু সময় না চাইলেও অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের ভদ্রতা করে উত্তর দিতে হয়। এখন রুমঝুমের তেমনই সময়। সে এখানেই কথা শেষ করতে বলল,
-‘জানি না।’
-‘কেউ নেই? আই মিন! কারো সাথে কমিটেড আছো?’
-‘না।’
তাহমীদ স্বস্তি পেল। রুমের দরজাটা তখনই খট করে খোলার শব্দ হলো। ঈশান হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকে বলল,
-‘কি হয়েছে ভাইয়া? তোমাকে এভাবে লক করে রেখেছে কে?’
কথা শেষ করে সামনের দিকে খেয়াল করতেই সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। তার ভাই রুমে একা নেই। স্কুলের নতুন মিসও সাথে আছেন। ওই তো! দুজনে কি সুন্দর কফি মগ হাতে বসে আছে। যেন বহু বছরের বিবাহিত যুগল হাসিমুখে, তৃপ্তি নিয়ে তাদের পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ করছে।
#চলবে।