এখানে সুখ ছোঁয়া যায় পর্ব-০৬

0
105

‘এখানে সুখ ছোঁয়া যায়’ পর্ব-৬

ঈশান খুবই অশান্তির মধ্যে আছে, তার একটুও ঘুম আসছে না। বিছানায় শুয়ে নানান চিন্তা ভাবনা করে অস্থির হয়ে উঠছে। স্কুলের মিস নাকি ভাইয়ের ক্লাসমেট। সেটা নিয়ে ঈশানের সমস্যা নেই। বরং চেনা পরিচিত হলে তো ভালোই। সমস্যাটা অন্য জায়গায়। তার ভাই মেয়েদের সাথে খুব কম মেশে। তেমন একটা মেয়েদের দিকে তাকায়ও না। অথচ আজ সে নিজ চোখে দেখেছে ভাই রুমঝুমের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে কথা বলছিল বারবার। এবং খুব বেশিই কথা বলছিল। সচরাচর সে এত কথা বলেই না! একটা ছেলে হয়ে আরেকটা ছেলের অনুভূতি কিছুটা হলেও বোঝার ক্ষমতা তার তো আছে নাকি! সে মনে মনে বারবার প্রার্থনা করছে ভাই যেন রুমঝুমকে নিয়ে তেমন কিছু না ভাবে। এত বছর পর ঈশান কারো দিকে ঝুঁকতে চাইছে। হোক সে বয়সে বড়! ইট ডাজেন্ট ইভেন ম্যাটার! কিন্তু মনের মধ্যে একটা কথা বারবার খচখচ করছে। হুট করে নিশ্চয়ই ভাইয়ের তার ক্লাসমেটের প্রতি অনুভূতি আসবে না। যদি তেমন কিছু হয়েই থাকে তবে অবশ্যই সেটা আরো আগে থেকেই। রিলেশনে ছিল কখনো? নিশ্চয়ই রিলেশনে ছিল। কলেজ জীবনের পর থেকেই ভাই অন্যরকম হয়ে পড়েছিল। সব কিছু থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। সবাই ভাবত বড় হচ্ছে, কাজ করছে, ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবছে তাই এমন আলাদা হয়ে যাচ্ছে সে সকলের থেকে। কিন্তু এমনও তো হতে পারে কোনো রকম আ’ঘা’ত থেকে বা কোনো সম্পর্কের ভা’ঙ’ন থেকে সে আলাদা হয়ে পড়েছিল! তার ব্রেনে ঢং করে একটা আ’র্ত’নাদের মতো বেজে উঠল! “ওহ্ নো!” রুমঝুম কি তবে তার ভাইয়ের এক্স ছিল? হুট করে এত বছর পর দেখা হয়ে কি তাদের পুরোনো অনুভূতি নতুন করে জেগে উঠেছে? যদি এমনটা হয়েই থাকে সে খুবই দুঃখ পাবে। তবে এত আগেই দুঃখ পেয়ে বসে থাকলে তো হবে না। লাস্ট ট্রাই করে দেখতে হবে। সুযোগ আছে কিনা! সে যা ভাবছে তা যদি ভুল হয় তবে সে সামনে এগোবে। নয়তো ভাইয়ের ভালোবাসায় সে ভুলেও নজর দিবে না। যা ভাইয়ের তা ভাইয়েরই থাকুক।

সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠতে রিনিঝিনির দেরি হয়ে যায়। রাতে কাজের ব্যস্ততা আর তারওপর নতুন করে লাল নীল অনুভূতিতে মত্ত থাকতে থাকতে সে ঘুমায়নি। আযান দিলে নামায পড়ে এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করে কিছুক্ষণ। তবে ক্লান্তও লাগছিল খুব তাই বিছানায় গিয়ে আবার শুয়ে পড়ে। তখনই একটু ঘুম হয়। সে ঘুম যে এত গাঢ় হবে, একেবারে বারোটায় ভা’ঙবে তা সে ভাবতেও পারেনি। অবশ্য ঘুমটা আরো দেরিতেই ভা’ঙত বোধহয়। এখন তো জোর করে ভা’ঙানো হয়েছে। জরিনা ডাকছে বারবার, রিনিঝিনি শোয়া থেকে উঠে বি’র’ক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে বলল,

-‘কি হয়েছে? এমন চেঁচাচ্ছিস কেন?’

-‘আরে উঠেন বড় আফা। আর কত ঘুমাইবেন? নিচে যাইয়া দেখেন কি গমডোগোলডাই না ঘটসে!’

-‘আহহা! বললাম না শব্দটা গ’ণ্ড’গোল হবে?’

-‘ধুরো! আপনেরে আমি ডাকতেসি জরুলী কামে আপনে এহানে আমার ভুল ধরতে বইসা আছেন!’

চুল বাঁধতে বাঁধতে রিনিঝিনি বলল,

-‘কি হয়েছে খুলে বল!’

-‘নিচে এক বেডায় আসছে। বড় খালাম্মার পোলা নাকি। হেয় রে নিয়াই তো লাগসে গমডোগোল ডা। দাদী কইতেছে হে রে বাড়িত যাতে ঢুকতে না দেওন হয়। বড় খালাম্মা খুব কানতাছে। তার সাথে এখনও পোলার দেহা করাইতে দেয় নাই। আপনে চলেন! আহারে! কেমুন কানতাছে।’

রিনিঝিনির বুক ধরাম করে উঠল। একি! দাদী এত বড়ো পা’ষা’ণের মতো আচরণ করছে অনিরুদ্ধের সাথে! সে দৌঁড়ে নিচে নামল। পেছন পেছন জরিনাও এলো। হল রুমে এসে দেখল সবাই গোল বৈঠকে বসে আছে। দাদী চোখ মুখ শক্ত করে রেখেছেন। বড় মা মাথা নিচু করে কাঁদছেন। অন্যান্য সদস্যরা সবাই অসহায় চোখে তাকিয়ে আছেন। বাবা-চাচাদের দেখা যাচ্ছে না। যাবেই বা কীভাবে? সবাই তো অফিসে। নিজ নিজ কর্মসংস্থানে। তাই তো দাদীর জোর এখন আরো বেড়েছে।

-‘কি শুনছি আমি? তুমি নাকি বড় মাকে উনার ছেলের সাথে দেখা করতে দিচ্ছ না? এটা কেমন ব্যবহার দাদী?’

-‘তুই চুপ থাক। তোর কথা শুইনা হের মারে নয় ঘরে তুলছি। তাই বইলা ছ্যাড়ারেও তুলব? শুনসি ছ্যাড়ার বাপে বিরাট বড়লোক ছিল, টাকা পয়সা তো কম নাই। নিজের চলার মতো যোগ্যতা আছে। তয় সে এখানে কেন আসব?’

-‘আশ্চর্য! তো সে আসবে না? মায়ের কাছে আসবে না?’

-‘ক্যান আইবো? মায়েরে বিয়া দিবার পারছে তো এহন আর কি? এত দরদ থাকলে মায়েরে ঘর থাইকা বাইর করসে ক্যান? আমি বইলা রাখি, বড় বউ তার আগের সংসার, বাচ্চা কাচ্চা সব ছাইড়া একবার যেহেতু এইহানে আসছে আর তাগো সাথে যোগাযোগ রাখবার পারব না।’

রিনিঝিনি কি বলবে বুঝতে পারল না। সবার দিকে অ’গ্নি’দৃ’ষ্টি নি’ক্ষে’প করে বাইরে বের হয়ে গেল। ইশ! বেচারা অনিরুদ্ধ! সে কী সারাজীবনের জন্য মায়ের ভালোবাসা, সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হয়ে গেল!

গেটের কাছে এসে রিনিঝিনি এসে অনিরুদ্ধকে কোথাও দেখতে পেল না। অনিরুদ্ধর জায়গায় একটা কোর্ট প্যান্ট পরিহিত লোক অসহায় মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স বেশি নয়। অনিরুদ্ধর মতোই হবে হয়তো। সে রিন্টুকে জিজ্ঞেস করল,

-‘বড় মায়ের ছেলে কোথায় রিন্টু মিয়া?’

-‘এই যে, এই লোক! দাঁড়ায় আছে যে। দ্যাখছেন আফা? এহনো যায় না। কইতেছি আফনার জায়গা নাই এই বাড়িতে তাও নড়ে না। থ্যাতা আছে বহুত।’

রিনিঝিনি বুঝল কোথাও একটা কনফিউশন হয়েছে। সে রিন্টুকে গেট খুলে দিতে বললে অনিচ্ছাসত্ত্বেও গেট খুলে দেয় রিন্টু। লোকটার দিকে এগিয়ে গিয়ে রিনিঝিনি বলে,

-‘আপনি?’

চশমা ঠিক করে লোকটি ভালো করে রিনিঝিনিকে দেখল। তারপর বলতে লাগল,

-‘জ্বি আমি ইখতিয়ার। বদরুল চৌধুরীর কাছে এসেছি।’

-‘ছোট চাচার কাছে?’

রিনিঝিনির প্রশ্নে লোকটা থতমত খেয়ে গেল বোধহয়। রিনিঝিনির ছোট চাচা কে সেটা তো তার জানার কথা নয়। রিনিঝিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলল,

-‘ওহ সরি। মাই মিস্টেক। আসলে আপনি যার নাম নিলেন তিনি আমার ছোট চাচা।’

লোকটা চুপ করে রইল। কতক্ষণ রিনিঝিনির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। যেন কোনো কিছু, কোনো কনফিউশন ক্লিয়ার করতে চাইছে। হুট করেই সে প্রশ্ন করে বসল,

-‘আর ইউ রিনিঝিনি?’

চমকে উঠল রিনিঝিনি। লোকটা চেনে তাকে? কীভাবে? সে তো চেনে না তাকে। তার জানামতে এই লোকের সাথে আজ, এখনই প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছে। কন্ঠে বিস্ময় রেখেই সে জবাব দিল,

-‘হ্যাঁ!’

-‘থ্যাঙ্ক গড! ফাইনালি পেলাম আপনাকে। আপনার কথাই আমাকে বদরুল আঙ্কেল বলেছিলেন। আপনি বোধ হয় আমাকে চিনতে পারেন নি। অবশ্য চেনার কথাও না। আমি সারোয়ার খানের ছেলে।’

রিনিঝিনির মনে পড়ল সারোয়ার আঙ্কেলের কথা। উনার ছেলেকে সে কখনো দেখেনি। তবে সে তার কথা শুনেছে অনেক। ছেলেটা অনেক বছর আগে লন্ডন পড়তে গিয়েছিল এরপর নাকি আর দেশে ফেরেনি কি একটা ব্যাপারে রা’গ করে। আঙ্কেলও বছর দুয়েক আগে গত হয়েছেন। এখন এতবছর হঠাৎ এই ছেলে কোথা থেকে এলো? তাও আবার তাদের বাড়িতে? আর চাচার সাথেই বা কি দরকার তার?

রিনিঝিনি খেয়াল করল ইখতিয়ারের সাথে দুটো লাগেজ। আশ্চর্য! সে এখানে থাকবে নাকি?

-‘আপনাকে চাচা আসতে বলেছেন?’

মাথা নাড়ে ইখতিয়ার। রিনিঝিনির হুট করেই মাথায় অন্য একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সবাই যখন একে অনিরুদ্ধ ভাবছে অর্থাৎ বড় মায়ের ছেলে ভাবছে তো ভাবুক না! সে জানে, দাদী ছ’ল করে হলেও মা ছেলেকে দূরে রাখতে চাইবে। তাই এখন সেও দাদীর সাথে ছ’ল করবে। তার এই ছ’লে যদি কারো উপকার হয় তবে হোক না!

#চলবে।

ইনশিয়াহ্ ইসলাম।