‘এখানে সুখ ছোঁয়া যায়’ পর্ব-৮
(ক’পি করা সম্পূর্ণ ভাবে নি’ষে’ধ।)
মৌনতা চৌধুরী বাড়িতে আসে একেবারে সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই এমন সময়। এসেই সে হন্তদন্ত হয়ে খুঁজতে থাকে তাহমীদকে। এমনিতেও বড় বাড়ি এবং বাড়ির সদস্য অত্যাধিক তার ওপর এখন আরো অতিথিতে ভরে আছে সারা বাড়ি। মৌনতার বাড়ির মূল সদস্যদের খুঁজে পেতেই বেশ বেগ পেতে হয়েছে। তাহমীদকে না পেলেও ঊষানকে দেখতে পেয়েই ডাক দেয়। তাহমীদ কোথায় আছে জানতে চাইলে ঊষান বলল,
-‘কল করে দ্যাখো।’
-‘সেটা কি তোমার আমাকে বলে দিতে হবে? তোমার কি মনে হয় আমি তাকে কল না করেই এত খুঁজে হয়রান হচ্ছি? এখানে এসেছি? গিয়ে জিজ্ঞেস করো তোমার ভাইকে, গতকাল রাত থেকে আটচল্লিশ বার আমি তাকে কল করেছি। এত বার কল দেওয়ার পরেও একবারের জন্যও সে আমার কলটা পিক করেনি। হাউ ডেয়ার হি? ওর সা’হ’স হয় কি করে আমাকে ডি’চ করার!’
ঊষান বুঝতে পারল না কল না ধরার সাথে ডিচ করার কি সম্পর্ক! সে এখন এখানে দাঁড়িয়ে এই চুলবুলি মেয়েটার সাথে কথা বলতে মোটেও আগ্রহী নয়। তাই দ্রুত বলে উঠল,
-‘আচ্ছা বেশ বেশ। ভাইয়ের সাথে দেখা হলে আমি বলব তুমি এসেছ। তুমি প্লিজ এখন রিল্যাক্স হও। রিনির কাছে যাও।’
ঊষান তাড়াতাড়ি পাশ কা’টিয়ে চলে গেল। এই মেয়েটাকে তার খুব একটা ভালো লাগে না। কেননা মেয়েটা খুবই উগ্র স্বভাবের। এমন স্বভাবের মেয়েদের তার মতো চুপচাপ শান্তশিষ্ট ছেলের অন্তত ভালো লাগে না।
তাহমীদ রুমঝুমকে রিনিঝিনির কাছে দিয়ে এসেছে একপ্রকার জোর করেই। রিনিঝিনি যখন শুনল রুমঝুম চলে যাওয়ার চেষ্টা করছিল তখন সে খুবই আ’হ’ত হয়। বলে,
-‘আমি তোমাকে কত বার বলেছি আমরা আগামীকাল খুব মজা করব। তুমি থেকো। তারপরও তুমি চলে যাচ্ছিলে? আমাকে না জানিয়েই? একটা মুহূর্তের জন্যও কি আপন ভাবতে পারছ না আমাদের! এত নি’ষ্ঠু’র মেয়ে তুমি?’
রুমঝুম কি বলবে বুঝতে পারল না। রিনিঝিনি অনবরত বলতেই লাগল,
-‘বাবাকে জানিয়েছিলে? আমার তো মনে হয় না। বাবা বারবার বলেছিলেন তোমাকে কালকের দিনটা অন্তত যেন থাকো। এমন করা ঠিক হয়েছে তোমার?’
রুমঝুম তাহমীদের তাকালো। তাহমীদ যেন চোখ দিয়েই তাকে বলছে;
-‘দেখছ তো? তুমি চলে যেতে নিয়ে কত বড় ভুল করছিলে!’
তাদের কথার মধ্যেই সেখানে অনিরুদ্ধ এলো। রিনিঝিনির পাশে দাঁড়ালো। বলল,
-‘আমি তাহলে আসছি। ধন্যবাদ, আপনি সাহায্য না করলে আমি মায়ের সাথে দেখা করতে পারতাম না।’
তাহমীদ অনিরুদ্ধকে এই প্রথম দেখল। ছেলেটা অপরিচিত। ছেলেটার কথা গুলোও কেমন যেন গোলমেলে। সে ভ্রু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো রিনিঝিনির দিকে। রিনিঝিনি বুঝতে পেরে ভাইকে বলল,
-‘ভাইয়া উনি অনিরুদ্ধ। বড় মায়ের ছেলে। অনিরুদ্ধ! উনি আমার বড় ভাই তাহমীদ।’
তাহমীদ আর অনিরুদ্ধ একে অপরের পরিচয় পেয়ে হাত মেলায়। তাহমীদ অনিরুদ্ধকে বলল,
-‘আপনি এখন কোথায় যাচ্ছেন?’
-‘বাড়িতে।’
-‘আপনি বাড়িতে যাচ্ছেন কেন? আজ তো এখানেই আপনি থাকবেন। প্লিজ! এটা আপনার বাড়িই ভাবুন। কাল একটা অনুষ্ঠান আছে আপনি প্লিজ আজ যাবেন না।’
রিনিঝিনিও দ্রুত সায় দিলো। বলল,
-‘হ্যাঁ, আপনি আজ কেন যাবেন? থাকুন না! আমাদের সাথে আনন্দ উৎসবে থাকুন!’
-‘আসলে আমি এভাবে থাকতে পারব না। অকোয়ার্ড ফিল করব খুব।’
-‘দাদীকে নিয়ে আপনি ভাবছেন কেন? দাদী তো জানেই না আপনি আসলে কে। আপনি ভাইয়ার বন্ধু হয়ে থাকুন না দুটো দিন। ভাইয়া এদিকে আয় তো একটু।’
রিনিঝিনির ডাকে একটু সরে গিয়ে তাহমীদ বলল,
-‘বল!’
-‘একটা ঝামেলা হয়েছে। দাদী কোনো ভাবেই বড় মায়ের ছেলের উপস্থিতি চাইছেন না। আমি তাই ছোট চাচার এক গেস্টকে বড় মায়ের ছেলে বলে চালিয়ে দিয়েছি। সবাই এখন ওনাকেই অনিরুদ্ধ ভাবছেন।’
-‘মানে?’
-‘ভাইয়া প্লিজ তুই সবাইকে বল যে অনিরুদ্ধ তোর ফ্রেন্ড। তাহলে দেখবি সবাই ইজি হচ্ছে ওনার সাথে। উনিও তখন কমফোর্ট ফিল করবে। বেচারার মায়ের এত বড় একটা দিন! সে থাকবে না পাশে? তুই বল এটা কি ঠিক? দাদী শর্ত দিয়েছেন সে এই বাড়িতে থাকলেও তার মায়ের সাথে দেখা করতে পারবে না। আর আগামীকাল অতিথি যাওয়ার সাথে সাথেই একটা ব্যবস্থা করবে। দাদীর ব্যবস্থা কেমন হতে পারে তা তো বুঝতেই পারছিস!’
-‘আর ছোট চাচার গেস্ট? সে কে?’
-‘সেসব পরে বলব। তুই এখন প্লিজ ওনাকে রাজি করা এখানে থাকার জন্যে।’
বোনকে পরখ করে নিয়ে গম্ভীর স্বরে তাহমীদ বলল,
-‘সেটা না হয় আমি বলব। কিন্তু আমার ভাবনার বিষয় তুই তাকে এখানে রাখার জন্য এত ডেস্পারেট কেন হচ্ছিস? তার নিজের মধ্যেই তো এত থাকার ইচ্ছা দেখা যাচ্ছে না।’
ইশ! রিনিঝিনি এখন কী বলবে? ধুর! ভাই তার এত চালাক কেন? রিনিঝিনি নিশ্চিত ভাই আন্দাজ করে ফেলেছে। তাহমীদ হঠাৎ করেই হাসল। হেসে বলল,
-‘আচ্ছা আমি দেখছি। তুই রুমঝুমকে নিয়ে যা। তোর কাছেই রাখবি ওকে। আবার যেন পালানোর চেষ্টা না করে খেয়াল রাখবি।’
রিনিঝিনি মাথা নেড়ে সায় জানায়। পরক্ষণেই কিছু বুঝতে পেরে চটজলদি বলে ওঠে,
-‘তুমি? তুই কখন আবার তুমি বলতে শুরু করেছিস ওকে? কী ব্যাপার!’
রিনিঝিনি কিছু ইশারা করে হাসল। তাহমীদ বিষম খায় তাতে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রুমঝুমকে এক পলক দেখে নিয়ে বলল,
-‘ও আমার পূর্ব পরিচিত। কলেজে আমরা এক সাথে আই মিন একই ক্লাসে ছিলাম।’
রিনিঝিনির মুখটা হা হয়ে গেল। চমকে উঠে বলল,
-‘আশ্চর্য আরো আগে বলবি না? আমি সেই কখন থেকে তাকে নাম ধরে ডাকছি তুমি করে বলছি। আমার সিনিয়র হয় সে! অথচ দেখে আমার থেকেও ছোট মনে হয়। হায়! আচ্ছা আমি নিয়ে যাচ্ছি ওকে আমার রুমে স্যরি ওনাকে। তুই প্লিজ একটু অনিরুদ্ধর ব্যাপারটা দ্যাখ!’
তাহমীদ মাথা নাড়ল সম্মতিতে। রিনিঝিনির সাথে যাওয়ার সময় রুমঝুম আরেকবার তাহমীদের দিকে তাকালো। ওর মনে নানান চিন্তা ভাবনা আসছে। তাহমীদের তখনকার কোনো কথাই হজম করার মতো ছিল না। ওভাবে কেন কথা বলছিল সে?
অনিরুদ্ধকে তাহমীদ থাকার জন্য জোর করল খুব। অনিরুদ্ধ ব্যাপারটা নিয়ে ভাবল। কিন্তু তার একবার বাড়ি যাওয়ার দরকার। তখন হুট করেই এসে পড়েছে কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই। এ ভাবে অফিসের পোশাকে এতক্ষণ থাকাটা তো আর সম্ভব নয়। তাই সে তাহমীদকে দ্রুত ফিরে আসবে বলে আশ্বস্ত করে নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।
তাহমীদ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে সন্ধ্যার চা আড্ডায় যোগ দিতে নিচে নামে। তখন তার সাথে ঊষানের দেখা হয়। তাকে দেখেই ঊষান বলে মৌনতা এসেছে। খুঁজছে অনেকক্ষণ যাবৎ। শুনে তাহমীদ বি’র’ক্ত হলো কিছুটা। মৌনতা আসলে চাইছে কী? কতবার সে এক কথা বলবে! জরিনাকে ডেকে তাহমীদ বলল তাদের ভাই বোনদের সবার জন্য তিন তলার লিভিং রুমে যেন চায়ের ব্যবস্থা করে। এত ভীড়ের মধ্যে সে বসবে না। ঊষানকেও বলল সাথে যেতে।
_______________________________
রিনিঝিনি আর রুমুঝম বসে গল্প করছিল। তখনই মৌনতা সেই রুমে ঢুকল। ঢুকেই সে রুমঝুমকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। সুন্দর চেহারার শাড়ি পরিহিতা একটি মেয়ে! চোখে মুখে একটা পবিত্র ভাব। মৌনতাকে দেখেই ঝট করে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ভ’য় নাকি ভদ্রতা কোনটা থেকে সে এমন করল তা বোঝা গেল না। মৌনতা ভাবুক হয়ে তাকিয়ে রইল মেয়েটা কে?
-‘মৌন কখন এসেছ?’
রিনিঝিনি এগিয়ে গেল। মৌনতা সে কথার জবাব না দিয়ে উলটো প্রশ্ন করল,
-‘উনি কে?’
রিনিঝিনি স্কুলের মিস বলতেই নিচ্ছিল কিন্তু এটা বললে রুমঝুম নিজেকে দূরের মানুষ মনে করবে এমনকি এটা সমীচীনও নয়, যখন সে জানতে পেরেছে মেয়েটি তার ভাইয়ের ক্লাসমেট তখন তো আরো এটা বলা উচিত হবে না। তাই সে বলল,
-‘স্পেশাল মানুষ। আমার ভাইয়ার …
মৌনতার বুক ধরফর করে উঠল। সে পুরো কথা না শুনেই রিনিঝিনির হাত চেপে ধরে বলল,
-‘তোমার ভাইয়া কোথায়?’
রিনিঝিনি এমন একটা রিয়েকশন হঠাৎ করেই আশা করেনি। সে বলল,
-‘ভাইয়া তো রুমে বোধ হয়।’
-‘আচ্ছা আমি আসছি। আমার উনার সাথে দরকারি কথা আছে।’
মৌনতা রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল। তার হাত পা রা’গে কাঁপছে। সে তাহমীদকে আগেও দুইবার রুমে গিয়ে খুঁজেছে পায়নি। দুর্ভাগ্যক্রমে সে যতবারই তাহমীদের রুমে গিয়েছে ততবারই সে ছিল না। এবারও তাই হলো!
জরিনা গুনগুন করতে করতে চায়ের ট্রে নিয়ে উপরে যাচ্ছিল। তাকে দেখে মৌনতা জিজ্ঞেস করল তাহমীদ কোথায় দেখেছে কিনা। জরিনা বলল,
-‘বড় ভাইয়ে তিন তালায় আছে। ডাইকা দিমু?’
-‘দরকার নেই আমিই যাচ্ছি।’
মৌনতা হুড়মুড় করে সিঁড়ি ডিঙিয়ে উপরে উঠল। তিন তলার লিভিং রুমে গিয়েই সে দেখতে পেল ঈশান, ঊষান, রিতি আর তাইফকে নিয়ে তাহমীদ বসে মনের আনন্দে গল্প করছে। তা দেখে তার গা জ্ব’লে গেল। সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল তার পর ঝুঁ’কে কলার চেপে ধরল তাহমীদের। আকস্মিক এমন কান্ডে সবাই চমকে উঠল,
-‘কি করছ মৌনতা! কলার ছাড়ো!’
তাহমীদ কড়া ভাষায় বলল। মৌনতা যেন শুনল না। আরো জোরে চেপে ধরল কলার। বলল,
-‘হাউ কুড ইউ? আপনি এটা আমার সাথে কীভাবে করতে পারলেন! কীভাবে? বিয়ে হওয়ার কথা ছিল আমাদের। আপনি কেন এমন করলেন?’
উপস্থিত সবাই কিছু বুঝল না। দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে শুধু দেখছিল সবটা। তবে জরিনা এসব দেখে দাঁড়িয়ে রইল না। সে ট্রে টেবিলে রেখেই দৌঁড়ে নিচে গেল। তার প্রিয় কাজ সাড়তে হবে। বরাবরই তার একটা প্রিয় কাজ রিনিঝিনির কানে ব্রেকিং নিউজ দেওয়া। যদিও কখনোই এই নিউজ শোনার জন্য রিনিঝিনি আগ্রহী থাকে না। তবুও শুনতে হয় তাকে।
মৌনতার হাবভাবে তাহমীদ ব্যাপারটা কিছুটা আন্দাজ করতে পারে। রুমঝুমের ভাষ্য মতে কাল অনেক মহিলা তাকে তাহমীদের স্ত্রী ভেবেছিল। যারা এসব ভাবা ভাবি করেছে তারা এসব ছড়াতেও দেরি করেনি নিশ্চয়ই। মৌমিতা আন্টি তো উপস্থিত ছিলেন গতকাল। নিশ্চয়ই এটা নিয়ে তিনিও ভুল কিছু ভেবে বসেছেন।
জরিনা হাঁ’পাতে হাঁ’পাতে রিনিঝিনির রুমের দরজায় দাঁড়ালো। চেঁচিয়ে বলতে লাগল,
-‘বড় আফা! জলদি চলেন! মোনোতা আফায় তো বড় ভাইয়েরে বে’জ্জ’ত কইরা দিতাসে। আসেন, জলদি আসেন!
#চলবে।
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।