এখানে সুখ ছোঁয়া যায় পর্ব-০৯

0
110

‘এখানে সুখ ছোঁয়া যায়’ (পর্ব-৯)
(ক’পি করা সম্পূর্ণ ভাবে নি’ষি’দ্ধ।)

রিনিঝিনি আর রুমঝুম তিন তলার বসার ঘরে এসে দেখল তাহমীদ কিংবা মৌনতা কেউই নেই। কেবল ঈশান, ঊষান, তাইফ, রিতি সোফায় বসে আছে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে। সবাইকে কিছুটা চিন্তিত লাগছে। রিনিঝিনি তাদের এমন রূপ দেখে জানতে চাইল,

-‘কি হয়েছে তোদের? ভাইয়া কোথায়?’

রিতি ইশারায় সামনে তাকাতে বলল। রিনিঝিনি আর রুমঝুম দুজনেই তাকালো সেদিকে। তাদের সামনেই বসার ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দা আছে, সেদিকে তাকাতেই তারা দেখল তাহমীদ আর মৌনতাকে। কাঁচের দরজা হওয়ায় তাদের দেখতে পেলেও তাদের মধ্যে কি কথা হচ্ছে তা শোনা গেল না। তবে কিছু একটা নিয়ে যে বেশ বা’কবি’ত’ণ্ডা হচ্ছে দুজনের মধ্যে তা বোঝা গেল ঠিকই।

রিনিঝিনি আড় চোখে রুমঝুমের দিকে তাকালো। দুজনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত বোধ করল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে রিনিঝিনি রুমঝুমকে বসতে বলল। রুমঝুম বসতেই সে বারান্দার পর্দা টেনে দিয়ে এলো। থমথমে এই পরিবেশটা কাটাতে তাইফ বলল,

-‘এত দেরি করলে কেন রিনি আপা? চা ঠান্ডা হয়ে এসেছে প্রায়। গরম করে আনতে বলব?’

রিনিঝিনি মাথা নাড়ল। চেক করে দেখল যথেষ্ট গরম আছে চা। সে দুই কাপ চা নিয়ে এক কাপ রুমঝুমের দিকে বাড়িয়ে দিলো। রুমঝুম চায়ের কাপ হাতে নিতেই সে ভাজা পোড়ার সব আইটেম থেকে কিছুটা তুলে নিয়ে প্লেট সাজিয়ে রুমঝুমের সামনেই রাখল।

রিতি মুগ্ধ চোখে রুমঝুমকে দেখছে। রুমঝুমের মধ্যে আলাদা একটা ব্যাপার আছে। দেখতে যেমন সুন্দর, চাল চলনও তেমনই পরিপাটি। কি চমৎকার করে শাড়ি পরে, মনে হয় একটুও ভাজ ন’ষ্ট হয় না। কথাও বোধ হয় খুব মেপে মেপে বলে। রিতি ফিসফিস করে রিনিঝিনির কানে কানে বলে,

-‘রিনি আপা? এই মিস টাকে বড় ভাইয়ার সাথে খুব মানাবে তাই না?’

রিনিঝিনি চমকে উঠল। আসলেই তো! ভাইয়ার সাথে দারুন মানায় রুমঝুমকে। কিন্তু তাদের দৃষ্টিতে মানালে কি কিছু করার আছে? তাহমীদ আর রুমঝুমের মধ্যে কিছু না থাকলে তাদের তো ভেবে লাভ নেই। সে হতাশ হয়ে পড়ল এক মুহূর্তের জন্য। মৌনতার কথাও মনে হলো। এই মেয়েটা তাহমীদকে ভীষণ ভালোবাসে। তাদের মা আর মৌনতার মা নিজেদের মধ্যে ঠিক করেও ফেলেছেন দুজনের বিয়ে দিবেন। যদিও তাহমীদ কখনোই এতে রাজি হয়নি। তবে মৌনতা চাইছে, সে এখনও চেষ্টায় আছে। রিনিঝিনির হুট করেই চিন্তা হতে লাগল খুব। ভাইয়া আর মৌনতার মধ্যে কি নিয়ে কথা হচ্ছে?

মৌনতার রা’গে সারা শরীর কাঁ’পছে। সে তাহমীদকে আরো একবার জিজ্ঞেস করল,

-‘আপনি সত্যিই বিয়েটা করেছেন? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’

তাহমীদ যথেষ্ট চেষ্টা করছে মাথা ঠান্ডা রাখার। সে চাইছে না মৌনতার সাথে কঠোর আচরণ করতে। কিন্তু মেয়েটা আজ সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে যেন। অযথা চেঁচিয়ে একটা অস্ব’স্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করছে। ছোট ভাই-বোন গুলোর সামনে তাকে হেন’স্তা করছে।

-‘কি হলো আপনি কথা কেন বলছেন না?’

-‘আমাকে কথা বলতে দিচ্ছো তুমি?’

তাহমীদ বি’র’ক্ত হয়েই বলল কথাটা। মৌনতার সহ্য হলো না কথাটা।

-‘আপনি কি বলতে চাইছেন? আমি আপনাকে কথা বলতে দিচ্ছি না? আসলে আপনিই কথা বলতে পারছেন না। কোন মুখে বলবেন কথা? কথা বলার মুখই তো নেই আপনার! আমাকে ঠ’কি’য়েছেন আপনি। অন্য একজনকে বিয়ে করে আপনি আমায় ঠ’কি’য়েছেন।’

-‘মৌনতা তোমার কি মনে হচ্ছে না তুমি আজেবাজে বকে চলেছ? আমি অন্য কাউকে বিয়ে যদি করেও থাকি তবে তোমাকে কীভাবে ঠ’কা’নো হয় বলো?’

-‘আমাকে ঠ’কা’নো হয় না?’

-‘অবশ্যই না। আমাদের মধ্যে কখনোই এমন সম্পর্ক ছিল না। আমাদের মায়েরা চাইছেন আমাদের বিয়ে হোক তাই বলে আমিও যে চেয়েছি কিংবা চাইছি তা নয়। আমি বরাবরই আমার সাইডটা ক্লিয়ার করেছি!’

-‘হ্যাঁ, আপনি বলেছেন আপনি একজনকে ভালোবাসেন। অথচ আজ আপনিই অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলেছেন।’

তাহমীদ হাসল। মৌনতা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আটকে রাখল। তাহমীদের হাসি তার সহ্য হচ্ছে না। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। ভীষণ!

-‘একজনকে ভালোবেসে আরেকজনকে বিয়ে করব এমন চিন্তা ভাবনা আমার নেই মৌনতা। আমি যাকে ভালোবেসেছি তাকেই জীবনের সাথে বাঁধতে চেয়েছি।’

-‘সে আমার থেকে বেশি সুন্দর এটাই আসল কারণ তা কেন বলছেন না?’

কথাটা বলতে বলতেই কেঁদে ফেলল মৌনতা। তাহমীদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মৌনতার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

-‘তোমাকে আমি শেষ বারের মতো বলছি, এভাবে আমার পেছনে ছুটো না। তোমাকে এমন পা’গ’লা’মি করায় মানায় না। তুমি খুব ভালো একটা মেয়ে। কোনো দিক দিয়ে তুমি কারো থেকে কম নও। তুমি তোমার মতো সুন্দর। তুমি তোমার মতো ভালো। কেউ কারো সমান হয় না। সবাই নিজ নিজ অবস্থানে, সৌন্দর্যে, জ্ঞানে, গুণে শ্রেষ্ঠ। আরেকজনের সাথে তুলনা করাটা আসলে বোকামি ছাড়া আর কিছুই না।’

-‘আপনি এতই যখন বোঝেন আমায় তবে কেন ফিরিয়ে দিচ্ছেন? আমি ভালোবাসি আপনাকে।’

-‘অবশ্যই ভালোবাসতে পারো। তবে এখানে একটা ব্যাপার আছে। তুমি আমাকে ভালোবাসছ বলে আমারও তোমাকে ভালোবাসতে হবে এমন নয়!’

-‘আপনি এত ক’ঠো’র হবেন না, এভাবে ক’ষ্ট দিবেন না প্লিজ!’

-‘তোমাকে ক’ষ্ট দেওয়ার ইনটেনশন আমার নেই। কিন্তু আমি আগেই তোমাকে সা’ব’ধা’ন করেছিলাম। তুমি শোনোনি। আমি তোমাকে বরাবরই স্নেহের চোখে দেখে এসেছি। সেখানে অন্য কোনো ভাবনা ছিল না। তুমি দয়া করে এভাবে ভে’ঙে পড়ো না। তোমার জন্য শুভকামনা রইল মৌনতা। তুমি একজন দুর্দান্ত, ভালো মনের জীবন সঙ্গী পাও এই কামনা করি।’

তাহমীদ ভেতরে এসে রুমঝুমকে দেখে একটু বিব্রত বোধ করল। ততক্ষণে চোখ মুখ মুছে মৌনতাও তার পেছনে এসে দাঁড়ালো। তাহমীদের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেও তাকালো রুমঝুমের দিকে। তার বুকটা আবারও কান্নায় ভেঙে পড়তে নিলেই সে নিজেকে সামলে নেয়। রিনিঝিনি মৌনতার হাত ধরে টেনে নিয়ে তাকে পাশে বসায়। কি হয়েছে জানতে চাইলে মৌনতা কিংবা তাহমীদ কেউই কিছু বলে না। রিনিঝিনিও আর তেমন ঘাটল না ব্যাপারটা নিয়ে। তাহমীদ রুমঝুমের পাশে গিয়ে বসতেই রুমঝুম একটু সরে গেল। তাহমীদ নিজের চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে মুঁচকি হাসল। তাইফ ততক্ষণে আসর জমিয়ে ফেলেছে। রুমঝুমও একটু স্বাভাবিক হয়েছে সবার সাথে।

ইখতিয়ার বসার ঘরের পাশের রুমটায় ছিল। এত বড় একটা জার্নির পর তার লম্বা ঘুমের প্রয়োজন ছিল। তাই দুপুরে খাওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়েছিল। এখন ঘুম ভেঙেছে তার। ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হতেই চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেয়ে সে বসার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। কত গুলো ছেলে মেয়ে নিজেদের মধ্যে কি নিয়ে কথা বলছে আর হাসছে। সবার মাঝে রিনিঝিনিকেও দেখতে পায় সে। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-‘চা হবে? আসলে আমার এই সময়ে একটা কড়া লিকারের চা না খেলে চলে না।’

আকস্মিক ইখতিয়ারের উপস্থিতি সবাইকে চুপ করিয়ে দিল। রিনিঝিনি ভুলেই বসেছিল ইখতিয়ারের কথা। তার লজ্জা লাগল। ইশ! বেচারা ছোট চাচার অতিথি। অথচ তার ঠিক মতো যত্ন নেওয়া হচ্ছে না। চাচা জানতে পারলে কী ক’ষ্টটাই না পাবেন! জরিনাকে ডাক দিয়ে সে কড়া লিকারের চা করে আনতে বলল। ইখতিয়ারকে সবার সাথে বসে গল্প করতে বলল। ইখতিয়ার প্রথমবার না করল। পরে সবাই বলাতে আর না করল না। বসল ঊষানের পাশে। এবার কিন্তু রিনিঝিনি তাকে সারোয়ার আঙ্কেলের ছেলে এবং ছোট চাচার অতিথি বলেই পরিচয় করিয়ে দিল। অনিরুদ্ধ আর ইখতিয়ারকে গুলিয়ে ফেলার সময়ে এরা কেউই তখন উপস্থিত ছিল না। তাই এখন আর নতুন করে কোনো গণ্ডগোল হলো না। ভাগ্যিস জরিনাও চা নিয়ে আসেনি তখনও। সে থাকলে হয়তো সৃষ্টি হতো নতুন এক হা’ঙ্গা’মা’র।

রুমঝুমের কেন যেন মনে হচ্ছে তাহমীদ একটু পর পরই তার দিকে তাকাচ্ছে। সে তাই দুইবার পরীক্ষা করে দেখেছে। তাহমীদ সত্যিই তাকাচ্ছে নাকি তার মনের ভুল। দুইবারই তার স’ন্দে’হ সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। তাহমীদ তার দিকে তাকাচ্ছে এমনকি সে যখন ধরে ফেলছে, চোখে চোখ পড়ছে তখনও সে চোখ সরাচ্ছে না। বরং তাকিয়েই থাকছে। এক পর্যায়ে রুমঝুম উঠে পড়ল। রিনিঝিনিকে বলল তার ক্লান্ত লাগছে। রিনিঝিনি বলল সে যেন তার রুমে গিয়ে রেস্ট নেয়। আর কিছুর দরকার পড়লে জরিনাকে যেন ডাকে। সেও কিছুক্ষণ পরেই আসছে। রুমঝুম মাথা নেড়ে সায় জানালো। সে চলে যেতেই তাহমীদও উঠে দাঁড়ায়। দরকারি কাজ আছে বলে সেখান থেকে চলে আসে। দ্রুত সিঁড়ি ডিঙিয়ে নিচে নামতেই দেখে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে রুমঝুম রিনিঝিনির রুমের দিকে যাচ্ছে।

-‘পালিয়ে যাচ্ছো?’

রুমঝুম পেছনে তাকালো। তাহমীদকে এক পলক দেখে নিয়ে বলল,

-‘পালাবো কেন?’

-‘তুমিই জানো।’

রুমঝুম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

-‘আপনি অদ্ভুত আচরণ করছেন। আমার ভালো লাগছে না।’

-‘কোনটা অদ্ভুত মনে হচ্ছে তোমার?’

তাহমীদ ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। কাছাকাছি এসে দাঁড়াতেই রুমঝুম বিচলিত হয়ে পড়ল। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল। কেউ তাদের একসাথে দেখে ফেললে আবার না কিছু ভেবে বসে!

-‘আপনি প্লিজ দূরত্ব বজায় রাখুন। আমার সত্যিই ভালো লাগছে না।’

-‘কেন?’

-‘আপনি বোঝেন না কেন? আপনি ছোট বাচ্চা তো না। যা করছেন তা অবশ্যই অ’ভ’দ্র আচরণ।’

-‘তুমি অযথা হাইপার হচ্ছো রুমঝুম।’

-‘অযথা না! আপনি প্লিজ দূরে থাকুন। আপনি তখন নিচে যা করেছিলেন আমি এখনও মাথা থেকে সরাতে পারিনি সেসব। আমার কাছে ব্যাপারটা ভালো লাগেনি।’

-‘আমার বউ হলে তোমার ক্ষ’তিটা কোথায়?’

রুমঝুম অবাক চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ তাহমীদের দিকে। তার কলেজের দিন গুলোর কথা মনে পড়ল। তখনকার তাহমীদের সাথে মিলিয়ে দেখল এই ছেলেটাকে সে চেনে না। তার মনে প্রশ্ন জাগে, এমন অদ্ভুত আচরণ করা ছেলেটা সত্যিই তাহমীদ? ভাবতেই তার মাথা ধরে যাচ্ছে! সে কোনো কথা না বলেই চলে এলো সেখান থেকে।

আশুরা খাতুনের মাথা আউলিয়ে গেছে। দুপুরের পর থেকেই তিনি তার খানদানি পানের বাটাটা খুঁজে পাচ্ছেন না। বিকেল পর্যন্ত এটা নিরব ত’ল্লা’শি চালিয়ে খোঁজা হলেও এখন আর ব্যাপারটা নিরব রাখা গেল না। সারা বাড়িতে ধুম পড়ে গেছে এখন। ঠিক করা হয়েছে সব কয়টা ঘরে ত’ল্লা’শি চালানো হবে। তবে তার আগে প্রাথমিক জি’জ্ঞা’সা’বা’দ করা হবে জরিনাকে দিয়ে। জরিনাকে যখন এটা শুনল তখন সে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলল। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-‘এত বছর এই হানে আমি কাম করি, আমারে দেখসেন চু’রি করতে?’

সবাই ব্যাপারটা ভেবে দেখল। আসলে জরিনা চু’রি করে না। যা করে সেটা রীতিমতো ডা’কা’তি। চোখের সামনেই সব নিয়ে যায়। তাই জরিনাকে দো’ষা’রো’প করার মতো কিছুও পাওয়া গেল না। বরং জরিনা আশুরা খাতুনের কানে কানে গিয়ে বলল,

-‘দাদী? আসল চুর কে আমি জানি।’

আশুরা খাতুন কথাটা শুনে বিস্মিত হয়ে যায়। জানতে চায়,

-‘কে!’

-‘ওই ব্যাডায় চু’রি করত পারে। আপনে যারে হের মায়ের লগে দেহা করতে দেন নাই লাগে এই কাম হেয় করসে। আপনের উপর বদলা তুলবার লাইগা করসে।’

#চলবে।

ইনশিয়াহ্ ইসলাম।