এবং তুমি পর্ব-১৭

0
727

গল্পের নাম— #এবং_তুমি❤️
লেখিকা— #সোনালী_আহমেদ
পর্ব– ১৭

” রিয়াজ রাজ চৌধুরী এবং রিপন রাজ চৌধুরীর গোপন কুকীর্তি ফাঁস। তথ্যসূত্রে জানা গিয়েছে, জনাব রিয়াজ নিজের মামাতো বোন মাধবি নামের মেয়েকে জোরপূ্র্বক ধর্ষণ করেছেন। এ ঘটনায় তার বাবাও শামিল ছিলেন। বিস্তারিত, ৪ পৃষ্টা কলাম ৫।”

পৃষ্ঠা-৪

|কলাম ৫|

মিস মাধবি, একজন সাধারণ নারী। ছোট বয়সে উনার মা চলে যান। এরপর থেকে ছোট বোনকে নিয়ে বাবার সাথেই তার বসবাস। স্কুল-কলেজের ছুটির দিনে তিনি প্রায়ই ফুফুর বাড়ীতে যেতেন। এমনই এক ছুটির দিনে তিনি যখন গেলেন, তখন তার ফুফা-ফুফু বাড়ীতে ছিলেন না। ছিলো শুধু বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রিপন রাজ চৌধুরীর ছেলে রিয়াজ রাজ চৌধুরী। অর্থাৎ উনার ফুফাতো ভাই। এ বিষয়ের পুরো ফায়দা লুটে নেন মিস্টার রিয়াজ। তিনি জঘন্য ফন্দি এঁটে মিস মাধবির বস্ত্রবিহীন ভিডিও ধারন করেন। এবং এ ভিডিও’র হুমকি দিয়ে তার সাথে শারিরীক সম্পর্কে পর্যন্ত লিপ্ত হোন। মিস মাধবি এ বিষয়ে কাউকে জানাতে পারেন নি ভিডিও ফাঁশ হবার ভয়ে। সেই ঘটনার পর টানা কয়েক বছর তাকে এভাবেই শাসিয়ে রাখা হয়েছিলো। একদিন রিয়াজের মা অর্থাৎ মিস মাধবির ফুফুকে এ বিষয়ে মিস মাধবি জানিয়েয়ে দিয়েছিলেন। অতি মাত্রায় ডিপ্রেশনে এসে তিনি হাল ছেড়েই কথাটি জানাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তখন এ বিষয়টি রিপন রাজ চৌধুরীর কর্ণগোচর হয়। তিনি এ বিষয় শোনার পর-মুহূর্তেই মিস মাধবিকে হুমকি-ধমকি দিয়ে চুপ করিয়ে রাখেন। এমনকি তার ফুফুকে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি পর্যন্ত দেন। ফলে আবারো চুপ হয়ে যান মিস মাধবি।
মিস মাধবির সাথে সেই সময় চুক্তি হয় যে, তিনি এ বিষয়ে যাতে কাউকে না জানান।তাহলে তার ভিডিও ডিলেট করা হবে এবং ফুফুর সংসার বেঁচে যাবে। কিন্তু এমন টা হয় নি। মিস মাধবির বিয়ের দিন পুনরায় মিস্টার রিয়াজ তাকে ব্ল্যাকমেইল করলেন। এবং ভিডিওর কথা বলে তাকে আবারো তাদের কাছে নিয়ে যান। বাধ্য হয়েই বিয়ের আসর ছেড়ে পালাতে হয় তাকে। এমন কয়েকদিন কেটে যাবার পরপরই মিস মাধবি তার না হওয়া স্বামী অর্থাৎ ছোট বোনের স্বামীর সাহায্য নিয়ে আজ ২৬ শে এপ্রিল তিনি মুক্ত হোন। এবং পর্যাপ্ত প্রমানের মাধ্যমে রিয়াজ রাজ চৌধুরী এবং রিপন রাজ চৌধুরীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছেন। এ ঘটনার ম……

আর পড়তে পারলাম না। হাত থেকে পত্রিকা টা পড়ে গেলো। আপার সাথে এতকিছু হয়ে গিয়েছে আর আমি এসবের কিছুই জানি না। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে আপার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ততক্ষণে আপার চোখ দিয়ে তুমুল বর্ষণ হচ্ছে। আওয়াজ তুলে কাঁদছেন। জীর্ণ, রোগা পাতলা শরীর। যেনো আপার সাথে ঘটিত তুমুল অত্যাচারের জলজ্যান্ত প্রতিচ্ছবি। আমার শরীর কাঁপতে লাগলো। ঠিকঠাক দাড়াতে পারছিলাম না। কান্নাভেজা কন্ঠে বললাম,

—এসব সত্যি আপা?

আপা মাথা নাড়লেন। সাথে সাথেই কেঁদে দিলাম। একদম বাচ্চাদের মতো। আপাকে জড়িয়ে ধরতেই যেনো কান্নার গতি হুরহুর করে তীব্র হয়ে উঠলো। হৃদপিন্ড বিষাক্ত সাপের ছোবলের ন্যায় ব্যাথা হচ্ছিলো। কাঁদতে কাঁদতে আমার হেচকি উঠে গেলো। নাক টেনে বললাম,

—-তুমি আমাকে বলো নি কেনো আপা? ওই কুকুর টা তোমার সাথে এত দিন থেকে এত কিছু করে আসছে আর তুমি আমাকে একটা কথাও বলো নি। তুমি খুব খারাপ,আপা! খুব খারাপ। আই হেইট ইউ।

আপা কাঁদছেন। আমি আবারো বললাম,

—এমন তো কথা ছিলো না আপা। মা চলে যাবার পর থেকে কিন্তু আমরা সব শেয়ার করতাম। তুমি হুট করে বদলে যাবার পরেও আমি তোমাকে সব বলতাম। অথচ তুমি আমাকে বলতে পারলে না। আমি কত কাঁদতাম যে আপা তুমি কেনো বদলে গেছো? কেনো একা একা থাকো, তুমি কিছুই বলতে না। উল্টো আমাকে বকা দিয়ে বের করে দিতে। তুমি তো জানতে আমি একা ঘুমুতে পারতাম না। তোমাকে জড়িয়ে না ধরলে আমার ঘুম হতো না। অথচ তুমি কি করলে, আমাকে আলাদা বিছানা দিয়ে দিলে। সারা রাত জেগে কেঁদেও তোমার মন গলাতে পারি নি। জানো,আমি সারাক্ষণ ভাবতাম, কি এমন ভুল করেছি যে আপা এমন বদলে গেছে,কেনো আমার থেকে দূরে থাকছে। সবসময় নিজেকে দোষারোপ করে কষ্ট পেতাম। অথচ আমি জানতাম ই না তখন আমার থেকে দ্বিগুন কষ্ট তোমার হচ্ছিলো। আমাকে কেনো বললে না আপা।

আপা কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

—কীভাবে বলতাম? আমার নিজের ই যে ঘেন্না হতো আমার শরীরের প্রতি। তুই যে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতি। আমি কীভাবে পারতাম তোকে আমার এই নষ্ট শরীর স্পর্শ করতে দিতে। আমি কখনো চাইতাম না তোর আশেপাশেও আমার নষ্ট শরীরের ছায়া পড়ুক। তাই সবসময় তোকে দূরে দূরে রেখে আগলে ছিলাম। আমিই কোনোদিন তোকে ফুফুর বাড়ীতে যেতে দেই নি। সবার কান ভরিয়ে দিতাম তোর নামে উল্টাপাল্টা কথা বলে। যাতে কেউ তোকে কোথাও না নিয়ে যেতে পারে। জানি তুই সেজন্য কাঁদতি। তবুও আমি শক্ত ছিলাম। কারণ ওই নরক যন্ত্রণা থেকে এই সামান্য কষ্ট ঢের ভালো ছিলো। তোর আমার উপর খুব অভিমান জমে গেছে না রে? আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি খুব খারাপ বোন। খুব খারাপ। আমার মতো কোনো বোন যাতে কোনোদিন কারো না হয়।

আপা কান্নার জন্য কথা বলতে পারছিলেন না।বারবার তার গলায় আটকে যাচ্ছিলো। আমি তখন শব্দ করে কাঁদছি। আমার মনের দীর্ঘ অভিমান আর রাগ যেনো ধুয়ে মুছে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। কথা তো বলছিলাম কিন্তু শব্দ হচ্ছিলো না। গলা বোধ হয় ভেঙ্গে গিয়েছে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে আপাকে বললাম,

—খবরদার এমন কথা আরেকবার বলো তো। তুমি সবচেয়ে ভালো বোন। সবচেয়ে ভালো। বেস্ট,বেস্ট,বেস্ট! তোমার মতো বোন যেনো ঘরে ঘরে থাকে। আমার মতো ভাগ্যবতী বোধহয় দ্বিতীয় টি নেই।কারণ আমি তোমার মতো বোন পেয়েছি। তোমার বোন হতে পেরেছি। তুমি হচ্ছো পৃথিবীর বেস্ট বোন।

আপা ততক্ষণে কেঁদে টেদে অস্থির। আমি আপার শরীরের সাথে একদম মিশে বললাম,

—এ শরীরের উপর যদি পৃথিবীর সব নিকৃষ্ট বস্তু আর জীবজন্তু রাখা হয় তবুও আমি নির্দ্বিধায় জড়িয়ে ধরবো। এ শরীর যদি আগুণে ধ্বংস ও হয়ে যায় তবুও আমি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখবো। এ শরীর যদি পৃথিবীর সবচেয়ে বিচ্ছিরি জিনিসের থেকেও বিচ্ছিরি হয়ে থাকে তবুও আমি জড়িয়ে ধরে থাকবো। খবরদার তুমি আরেকবার নিজেকে নিকৃষ্ট বলে থাকো তো!
নিকৃষ্ট ওই কুকুর রিয়াজের শরীর। নিকৃষ্ট ওই কুকুরের মন, নিকৃষ্ট ওই কুকুর।

রাগে আমার শরীর জ্বলছিলো। রিয়াজ ভাইকে নিশ্চই পুড়িয়ে ভষ্ম করে ফেললে রাগ টা একটু কমে টমে যেতো। লোকটার উপর ভীষণ রাগ উঠছে। যাকে বলে ভয়ংকর রাগ! আমার শরীরের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে যদি হালকা পাতলা একটা চড়ও দিতে পারতাম তাহলে একটু শান্তি মিলতো। বেয়াদপ টা ব্যাথা না পেলেও কিন্ত আমি আরাম পেতাম। স্বস্তি বোধ করতাম। আচ্ছা আমার কি এখন মারা উচিত? হু,একদম। আরেকবার যদি তাকে দেখি তাহলে ঠাডায় চড় দিবো। দরকার পড়লে স্যান্ডেল দিয়েও মারবো। আমার বাদামি রঙের জুতো জোড়া দিয়ে। ওটা পরলে ঠকঠক আওয়াজ হয়। এটা দিয়ে মারলে নিশ্চই জোরে লাগবে, আর বেশি ব্যাথাও পাবে।

কান্নাকাটির এক পর্যায়ে আপা বললেন,

—তুই তখন কি বলেছিলি? কিসের সম্পর্ক? তোর বোধহয় কোথায় ভুল হয়েছে, আ….

আপা বলতে চাইলো ইশান স্যারকে কীভাবে চিঠির মাধ্যম দিয়ে যোগাযোগ করে নিস্তার পেয়েছিলেন। কিন্তু আমি শুনতে চাইলাম না। মনে মনে তখন বিশাল অপরাধবোধ হচ্ছিলো। ছিঃ,আমার মেন্টালিটি এত খারাপ? সত্যিই খুব খারাপ। যা নয় তা বলে ফেলেছিলাম। কত আজেবাজে চিন্তা করে ফেলেছিলাম। এর জন্য নিশ্চই আমার শাস্তি পাওয়া উচিত! কঠিন শাস্তি। ইশান স্যার তো খুব ভালো একজন মানুষ। তার সম্পর্কে এত নিচু মানসিকতা রাখা রীতিমত শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তিনি না জানি আমার সম্পর্কে কী ভাবছেন? উনার কথা মনে পড়তেই তাকে খুঁজতে লাগলাম। তিনি তখন জানালার পাশে দাড়িয়ে আছেন। তার মুখের উপর ধূসর রঙের ধোঁয়া উড়ছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম সিগারেটের ধোয়া। ইশান স্যার সিগারেট খান? কিন্তু কবে থেকে? আমি তো তাকে খেতে দেখি নি। নাকি আমার সামনে খান ই নি। উদ্ভট চিন্তার মাঝেই ইশান এসে বললেন,

—আপু, আপনার বাবাকে ফোন দেওয়া হয়েছে। তিনি হয়তো ঘন্টাখানেকের মধ্যেই চলে আসবেন।

আপু মাথা নাড়ালেন। আমি তখন ইশানকে সরি বলতে চাইলাম, কিন্তু বলা হলো না। ইশান আমাকে কথা বলতে না দিয়ে পুনরায় আপাকে বললেন,

—আপু, আপনার বোনের সাথে আমার খুব জরুরী কাজ আছে। তাই আমি তাকে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি প্লিজ এদিক টা একটু সামলে নিন। সাংবাদিকদের বলবেন, আমি কাল বাকি ইন্টারভিউ দিবো। আজ যেনো আমাকে খোঁজ না করা হয়, প্লিজ। আমি জানি এই মুহূর্তে আপনার বোনকে আপনার দরকার। কিন্তু তার থেকেও বেশি আমার প্রয়োজন। আপনি চিন্তা করবেন না, আমার কাজ হয়ে গেলে সরাসরি তাকে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিবো। প্লিজ একটু হ্যান্ডেল করে নিন।

আপা মাথা নাড়তে দেরী হলো ইশান স্যার আমাকে টেনে নিয়ে যেতে দেরী হলো না। আমি বললাম,
-‘কই নিয়ে যাচ্ছেন? আমি এখন কোথাও যাবো না। দেখুন আমার মন-মানসিকতা এখন ঠিক নেই। আমি আপার কাছে যাবো।’

ইশান স্যার কঠিন ধমক দিয়ে বললেন,-‘মন-মানসিকতা আমার ঠিক নেই। তুমি যদি এই মুহূর্তে চুপ না থাকো তাহলে আই সোয়ার আমি তোমার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করে বসবো। ‘
কথাটা শেষ করেই তিনি তার ফোন আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। একটু বেসামাল হলে এতক্ষণে এটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতো। আমি রাগ দেখিয়ে স্মার্ট ফোনটার দিকে তাকালাম। যখন তাকালাম তখন ই বোধহয় আমার হুশ চলে গেলো। শরীরের সব শক্তি উড়ে গিয়েছিলো। বিষ্ময়ে আমার চোখদুটো বড় হয়ে গেলো। হাত-পা অটোমেটিক থেমে এলো। আমি মুখে হাত দিয়ে উনার দিকে একপলক তাকিয়ে পুনরায় স্ক্রিনের দিকে তাকালাম। ততক্ষণে আমার বাক-শক্তি হারিয়ে গিয়েছিলো। মুখ দিয়ে শব্দ ই বের হচ্ছিলো না।

#চলবে…..

®সোনালী আহমেদ