গল্পের নাম— #এবং_তুমি❤️
লেখিকা— #সোনালী_আহমেদ
পর্ব– ১৯
হাটু বের করা জামা পরে ইশান স্যারের সামনে যেতে পারবো না। কিন্তু আমি যেতে না চাইলে কী হবে? যেতে হবেই। শরীরের অংশগুলো অতিরিক্ত দৃশ্যমান দেখে রাগ রাগলো। ভীষণ রাগ। কিন্তু উপায় নেই। এগুলা পরতেই হবে নাহলে বস্ত্রবিহীন থাকতে হবে। এই মুহূর্তে আমাী আবার মেঘ-বৃষ্টির উপর রাগ হলো। মনে মনে দুটো গালাগাল করে শান্ত হলাম। বিশ্রি নয় সুশ্রী গালাগাল। কেউ শুনলে নিশ্চই বলবে,গালি আবার সুশ্রী হয় নাকি? হোক না তাতে কি?
ইশান স্যার কই নিয়ে আসলেন সেটাই বুঝতে পারছি না। পথিমধ্যে ঝড়-বৃষ্টি হওয়ায় গাড়ীর সামনের দিকে মাঝারি আকারের গাছ ভেঙ্গে পড়েছিলো। অবশ্য ইশান ওখানেই গাড়ী টা থামিয়েছিলো। এ জায়গা টা আমার জন্য অচেনা। সম্পূ্র্ণ অচেনা। জায়গাটার বর্ণনা না দিলেই নয়। এত সুন্দর যে দেখামাত্রই আমার চোখ জুড়িয়ে গেলো। এক তলা বাড়ী। সম্পূর্ণ অফ-হোয়াইট রঙে ঘেরা। সরু পথে খানিকটা হাটলেই ঘরটির মেইন ফটক। কি সুন্দর,পরিষ্কার ঝকঝকে পথ। দুইদিকের লম্বা লম্বা সবুজ গাছগুলো যেনো সৌন্দর্য দ্বিগুণ ফুটিয়ে তুলেছে। গাছগুলোর নিশ্চই সুন্দর নাম হবে? অদ্ভুতভাবে আমার সে নাম টি জানার ইচ্ছা হলো না। মনে হলো, নাম টা জানলেই বোধহয় সৌন্দর্য টা গায়েব হয়ে যাবে।তাই জানার চেষ্টাও করলাম না। বাড়ীটির সামনে কোনো ইয়া বড় দেওয়াল আর গেইট ছিলো না। ছিলো তারকাঁটা দিয়ে ঘেরাও। খুব সাদামাটার মাঝেও আমার কাছে খুব অসাধারণ কিছু লাগলো। কিছু একটা যা আমায় খুব আবির্ভূত করেছে। কিন্তু কি সেটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ঝড়-বৃষ্টির মাঝে প্রায় দৌড়েই ঘরে ডুকেছিলাম। অবাক করার বিষয় ছিলো, ঘরে তালা লাগানো ছিলো না। এত এক্সক্লুসিভ বাড়ীতে কেউ আবার তালা না দিয়ে রাখে কীভাবে?হাউ? ইশানের সেদিকে কোনোরকম মাথাব্যাথা দেখলাম না। একচুয়েলী তিনি আমার দিকে ফিরে পর্যন্ত তাকান নি।তার না তাকানোর ও যথেষ্ট কারণ রয়েছে। গাড়ীতে তার প্রশ্নের জবাব দেই নি আমি। তখন থেকে একঁঘুয়েমি ধরেই আছেন। আমার একটা সমস্যা আছে। খুব বড় সমস্যা। হুটহাট কোনোরকম সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। আচমকা কেউ কোনো প্রশ্ন করলে সরাসরি উত্তর দিতে পারি না। এ জড়তা কবে থেকে যে হলো তা আমার জানা নেই। বৃষ্টিতে ভেজার ফলস্বরুপ ক্রমাগত চারবার কি পাঁচবার হাঁচি দিয়েছি। ইশান অবশ্য তা দেখেও না দেখার ভান করলেন। আমার মনে তখন হাজারো প্রশ্ন। এ বাড়ী কার? ইশানের কেনো কোনো কৌতুহল নেই। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর্যায়ে বেড রুম পর্যন্ত চলে এসেছিলাম। পরনের জামার খুবই বিশ্রি দশা। ইশান কোথা থেকে হাটু বের করা কটা জামা এনে দিয়ে চলে গেলেন। আমি কতগুলো প্রশ্ন করলাম, তিনি জবাব ই দিলেন না।
জামা টা উহু, স্লিভলেস টপস টা। যাই হোক, এসবের নাম-ধাম জানা নেই। শেষমেশ পরেই নিয়েছিলাম। সুরসুর করে ড্রয়িংরুমে চলে আসলাম। অবশ্য এভাবে আসি নি, গায়ে একটি পাতলা চাদর জড়িয়ে এসেছি। পেছন থেকে যে কেউ দেখলে নিশ্চই ভূত-টূত বলে চেঁচিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবে। আমার অস্থিরতা ক্ষণে ক্ষণে বেড়ে যাচ্ছে। মূল অস্বস্তির কারণ টের পাচ্ছি না। ইশানের চলাফেরা বলে দিচ্ছে এটা উনার বাড়ী। কিন্তু এমন বাড়ী আছে বলে তো আমার জানা নেই। খানিকটা বিচলিত হয়েই আরেকটু এগোলাম।
—এটা কি পরেছো?
ইশানের স্যারের আওয়াজ পেয়ে নড়ে উঠলাম। তিনি কখন এখানে আসলেন আমার জানা নেই। আমার মনে হলো পূর্ব থেকেই ছিলেন। কেননা উনি খাবার সামনে বসে আছেন। আমি একরাশ বিষ্ময় নিয়ে তার দিকে তাকালাম। তার কোনো ভাবান্তর নেই। সে আমার জামার দিকেই তাকিয়ে আছে।
—আপনি এতগুলো খাবার কই পেলেন?
—তোমার জানা জরুরী নয়।
—অবশ্যই,জরুরী। কার না কার বাড়ীতে এসে কার খাবার খেয়ে নিচ্ছি। আপনি বলছেন সেটা জানা জরুরী নয়। অনেক হয়েছে,আপনি বলবেন, এটা কার বাড়ী? আর আমরা এখানে কেনো এসেছি?
— (……)
— আমার রাগ উঠে যাচ্ছে। উত্তর দিন নাহলে….
—নাহলে কি? কি করবে তুমি?
ইশানের রাগে থমথমে মুখ দেখে আমার মুখ দিয়ে কথা বের হলো না। এ লোকটা হঠাৎ এত রেগে গেলো কেনো? হোয়াই? তার চোখ-মুখ কেমন শক্ত হয়ে যাচ্ছে।
— ইউ নো, এতক্ষণ তুমি আমার ভালো রুপ দেখেছো। কত রিকুয়েস্ট আর কত হাতজোড় করেছি,কিন্তু তোমার মন গলে নি। শুকনো কাঠের মতো ছিলে। এবার তুমি দেখবে, আমি কি কি করি তোমার সাথে… তুমি না জানতে চেয়েছো,তোমাকে এখানে কেনো নিয়ে এসেছি? বলছি,উত্তরটা হলো যতক্ষণ তোমাকে ঠিক করতে পারবো না ততক্ষণ তুমি এখানেই থাকবে বন্দি।
আমি স্বশব্দে আওয়াজ করে বললাম,
—অসম্ভব, আমি এখানে থাকতে পারবো না। এক্ষুণি বেরিয়ে যাবো।
ইশান হাসলেন। তার হাসরির প্রতিশব্দ কানে বাজতে লাগলো। হেসেই বললো,
—প্রথমত তুমি এখান থেকে বের হতে পারবে না। এমনভাবেই ঘরটা বানানো হয়েছে।দ্বিতীয়ত সামহাউ যদি বেরোতে পারো,তাহলেও যেতে পারবে না। কারণ তোমার পরনে যে পোশাক রয়েছে তা পরে রাস্তায় কেনো ঘরের কারো সামনেও উপস্থিত হওয়া যাবে না। তৃতীয়ত বাহিরে রীতিমত ঝড় হচ্ছে।
ইশান বাম চোখ টিপলেন। আমি রেগে বললাম,
—তার মানে, আপনি ইচ্ছে করেই আমাকে এমন পোশাক দিয়েছেন।
—খেতে আসো,আমার সময় চলে যাচ্ছে।
—খাবো না,আমি। এক্ষুণি আমি আমার জামা পরে আসছি। আমি থাকবো না,চলে যাবো।
—শুধু শুধু টাইম নষ্ট করছো। তোমার জামা ওখানে নেই। সেটা তুমি বদলানোর সাথে সাথেই সরিয়ে ফেলেছি। লিসেন, তুমি যদি খাবার না খাও,আমার কোনো সমস্যা নেই। মনে রেখো তোমাকে দ্বিতীয়বার আর দেওয়া হবে না।
আমার শরীর শীতল হয়ে আসলো। ইশান স্যার এমন পাগলামি কেনো করছেন? তিনি কি জানেন না এসব তাকে একদম মানায় না। একদম না। যখন জানবে, যাকে পাওয়ার জন্য এতকিছু করছি সে কোনোদিন তার হতেই পারবে না। তখন কি হবে? আমি খুব শান্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে বসলাম। হালকা খাবার মুখে দিয়ে নিজেকে শান্ত করলাম। ইশান তখন নিজের খাওয়ায় মত্ত। সে ফিরেও তাকাচ্ছে না। আমি শান্ত কন্ঠে বললাম,
—স্যার…
ইশান বোধহয় শুনলেন না। সে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে খেয়ে যাচ্ছে। আমি ধীর কন্ঠে বললাম,
—আমি অসুস্থ। আমার অসুখ কোনো স্বাভাবিক রোগ নয়! খুবই কঠিন অসুখ। আমার জরায়ুতে টিউমার হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন,আমি বেশিদিন বাঁচবো না।
আমি চুপ করে গেলাম। গলায় কথা আটকে আছে। কথা বলতে পারছি না। এই মুহূর্তে আমার খুব কান্না পাচ্ছে। আমার লাইফের সবচেয়ে নিরুপায় অবস্থা বোধহয় এটাই। ইশান স্যারের দিকে লক্ষ্য করলাম। তার রিয়েকশন দেখতে। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি তার অবস্থার কোনোরকম পরিবর্তন ঘটালেন না। নিজের মতো খেয়ে যাচ্ছেন। আমি ভাবলাম তিনি বোধহয় আমার কথা শুনতে পান নি। তাই আবারো বললাম,
— আপনি শুনছেন আমি কি বলছি? আমার টিউমার হয়েছে। টিউমার!
ইশান শান্ত ভঙ্গিতে গ্লাসে পানি ঢাললেন। গটগট করে পানি খেতে লাগলেন। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখছি। আজব, তো তিনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন না? নাকি গায়ে মাখছেন না? কিন্তু কেনো?
ইশান হাত মুখ ধুয়ে বললেন,
—চলো,রুমে চলো।
আমি অতি আশ্চর্য হয়ে বললাম,
—রুমে চলো মানে? আমি কি বলছি আপনি শুনতে পাচ্ছেন না?
— না,পাচ্ছি না।
ইশান গম্ভীর কন্ঠে কথাটা বললেন। আমার অবাকের ধাপ যেনো আরেকটু বেড়ে গেলো। ইশান বললেন,
–দেখো, এই মুহূর্তে আমার পেটে ১ সুতো জাগা নেই। ফুল পেট ভর্তি। তোমাকে কোলে নেওয়া আমার জন্য অসম্ভব। তাই প্লিজ নিজ থেকে রুমে আসো।
—আশ্চর্য! আপনি আমার কথা বুঝতে পারছেন না? আমি কি বলছি শুনেন নি?
— না,শুনে নি।তুমি রুমে আসো, তাহলে শুনবো।
ইশান আমাকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন। আমাকে বিছানায় বসিয়ে দরজা টা লাগিয়ে দিলেন। বাহিরে তখনো অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামছে,চারদিকে ঘন কালো মেঘ। দেখে মনে হচ্ছে বোধহয় সন্ধ্যা নেমেছে। একটু পর হয়তোবা রাত হয়ে যাবে। অথচ এখন ভর-দুপুর!ইশান জানালার পর্দা টা হালকা মেলে দিলেন। অন্ধকার দৃশ্য চোখ এড়ালো না। আমার মষ্তিষ্কের নিউরনগুলো তখন কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছিলো। ইশান স্যার আমার কথায় কোনো ভাবান্তর দেখালেন না কোনো?
—আপনি চাদর টানাটানি কেনো করছেন? আগে আমার কথাটা শুনে নিন। আমি কিন্তু সিরিয়াস।
ইশান আমার শরীরের চাদরটা সরানোর চেষ্টা করছেন। আমাকে শক্ত করে ধরে রাখতে দেখে রূঢ় কন্ঠে বললেন,
— দেখো, আমার এ মুহূর্তে খুব শীত করছে, সাথে ঘুমও পাচ্ছে। চাদরটা ছাড়ো তো। তোমার সাথে লেগে ঘুমাবো,বুঝেছো। তাহলে শীত টা কম লাগবে।
আমি অধৈর্য্য গলায় বললাম,
—স্যাররর..
—-হোয়াট? চেঁচাচ্ছো কেনো? তোমার কি ধারনা আমি বলদ?মূর্খ? যে তুমি যা তা বানিয়ে বলবে আমি বিশ্বাস করে নিবো। আই নো দ্যাট,আমি এখন তোমার কথা টা বিশ্বাস করা মাত্রই তুমি বলবে, এজন্য আমি আপনাকে ডিবোর্স দিতে চাই। আপনি প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন। রাইট? বাট ফর ইউর ইনফরমেশন, আমি এতটা গাঁধা নই।
#চলবে….
®সোনালী আহমেদ