এমনই এক দিনে পর্ব-০৩

0
1

“এমনই এক দিনে” (পর্ব-৩)
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৫.
আজ সকালটা একেবারে এলোমেলোভাবে শুরু হলো শর্বরীর। ঘুম ভাঙতেই দেখে ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁইছুঁ অথচ তার ক্লাস শুরুই হয় আটটায়! তাড়াহুড়ো করে সে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বেশি দেরি হওয়ায় সকালের নাশতা পর্যন্ত করা হয়নি।

সারাদিন ভার্সিটিতে একের পর এক ক্লাস, গুরুত্বপূর্ণ লেকচারে শর্বরীর মাথা যেন একটু ভার ভার লাগছিল। তবে ক্লাস শেষে বন্ধুদের সাথে একটু নিশ্চিন্তে সময় কাটানোর জন্য গেল বারিধারার এক চমৎকার কফি শপে। খাওয়াদাওয়া আর আড্ডায় জমে উঠেছিল সময়টা। কিন্তু ফিরতি পথে ঘটল বিপত্তি। সবাইকে বিদায় দিয়ে যখন একা সে হেঁটে আসছিল তখনই একটা উঠতি বয়সী ছেলেকে দেখা গেল দ্রুত সাইকেল চালিয়ে তার দিকেই আসছে। শর্বরী সরে যাওয়ার আগেই ছেলেটির সাইকেলের চাকা গিয়ে উঠে শর্বরীর বাঁ পায়ের উপর। ব্যথায় মুখ বেঁকিয়ে ওঠে ওর। সাথে সাথেই ও পায়ে হাত দিয়ে বসে পড়ে। মাঝের দুটো আঙুলের নখ ফেটে র”ক্ত বের হচ্ছে। আশপাশে দাঁড়ানো কয়েকজন সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। ছেলেটি ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে বারবার ‘স্যরি’ বলছিল, কিন্তু ব্যথা তখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, দাঁড়িয়ে থাকাও কষ্টকর।

উপায় না দেখে শর্বরী নিজেই একটা রিকশা ধরে কাছের এক হাসপাতালে চলে গেল। আর মনে মনে ভাবছিল—”এই একটা দিন আর কতভাবে খারাপ কাটবে?”

টানা দুই ঘন্টার একটা জটিল অপারেশন শেষে ওটি থেকে বের হয়ে নীরদ দ্রুত কদম ফেলে এগিয়ে যাচ্ছিল তার চেম্বারের দিকে। পেছন পেছন ডক্টর ফারহান ও আসছিল। তিনি একটু দৌড়ে এসেই নীরদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে শুরু করলেন।

“সত্যি বলতে আমি আশা করাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। তবে আপনার মনোবল দেখে আবার সাহস ফিরে পেয়েছি। এই রকম জটিল কেস হলে আমি আসলে কখনোই হ্যান্ডেল করতে চাই না। কিন্তু আপনি যদি থাকেন তখন আসলে একটা ভরসা পাই।”

নীরদ মৃদু হাসে। ডক্টর ফারহান আবারো বললেন,

“ডক্টর রোকসানা থাকলে আবার আমার সাহস সব তলানিতে চলে যায়। বুঝতেই তো পারছেন কেন?” কথাটা বলে নিজেই হো হো করে হাসতে লাগলেন।

নীরদের প্রচণ্ড ঘাড় ব্যথা করছে। একটানা অনেকক্ষণ ধরে ঝুঁকে থাকার ফলে এমন হচ্ছে। সে বাম হাতে ঘাড় মালিশ করতে করতে নিজের চেম্বারের সামনে এসে দাঁড়ায়। ডক্টর ফারহান ও তখন তার পাশে। দূর থেকে ডক্টর রোকসানাকে আসতে দেখেই তিনি হেসে ফেললেন। নীরদ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,

“ডক্টর রোকসানা বোধহয় আপনার জন্যই আসছেন। অল দ্য বেস্ট!”

ভেতরে ঢুকতেই নীরদ চমকে উঠল। তার মা আর সাথে একটা মেয়ে বসে আছে। তাকে দেখেই তার মা রেবেকা সুলতানা উঠে এলেন। উনার চোখে মুখে চমৎকার হাসি লেপ্টে আছে। মাকে এত খুশি দেখে সে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সামনেই কপালে হাত ঠেকিয়ে রাখা মেয়েটিকে একবার দেখে চোখের ইশারায় জানতে চাইল সে কে। রেবেকা সুলতানা ফিসফিস করে বললেন,

“ওই মেয়েটা!”

নীরদ বুঝতে পারল না কোন মেয়েটা। মা কার কথা বলছে! সে এক পা এগিয়ে যেতেই মেয়েটা পেছনে ফিরে তাকায়। সাথে সাথেই লাফ দিয়ে উঠে ছোট্ট একটা আর্তনাদ করে আবার বসে পড়ে। সাথে সাথেই নীরদের মুখ থেকে সারল্য সরে গিয়ে তা কাঠিন্যে পরিণত হয়। এই তো সেই মেয়েটা! সেদিনের পালিয়ে যাওয়া মেয়েটা! এখানে, মায়ের সাথে কী করছে সে?

শর্বরীর গা কাঁপছে। ভীষণ রকমের গা কাঁপছে। এই লোকটাকে দেখলেই ওর ভয় লাগে। এত ভয় কেন পায় কে জানে! একটা হেডলাইট ভাঙলে কাউকে এত ভয় পেতে হয়? একদম ভয়ের চোটে থরথরিয়ে কাঁপতে হয়? ওর জানা নেই! রেবেকা সুলতানা এগিয়ে এলেন ওর দিকে। চিন্তিত গলায় বললেন,

“আরে তুমি উঠতে গেলে কেন? ইশ, আরো চাপ পড়ল পায়ে! বেশি ব্যথা করছে?”

নীরদ মায়ের কথা শুনে শর্বরীর পায়ের দিকে তাকালো। শর্বরী পা আড়াল করার চেষ্টা করল ওকে তাকাতে দেখে। রেবেকা সুলতানা বলল,

“মেয়েটার পায়ে একটা দুষ্টু ছেলে সাইকেলের চাকা উঠিয়ে দিয়েছে বুঝলি। মাঝের দুটো আঙুল একেবারে থেঁতলে গেছে।”

মায়ের মেয়েটার প্রতি এত দরদ দেখে নীরদ বিরক্ত হলো। নিজের চেয়ারে বসে বলল,

“দেখে তো মনে হচ্ছে ট্রিটমেন্ট নিয়েছে। তাহলে এখানে কী কাজ?”

‘এখানে কী কাজ’ কথাটা শোনার সাথে সাথেই শর্বরী ভীষণ ল”জ্জা পেল। এরপর তার রাগও হলো। মা ছেলে দুজনের ওপরই। মা টা হুট করে করিডোরে তাকে দেখে পূর্ব পরিচিত মানুষের মতো যেচে পড়ে এসে তাকে নিয়ে আদিখ্যেতা করল আবার ওর বারণ সত্তেও এখানে জোর করে নিয়ে এলো। কীসব হাবিজাবি বলছিল সে নিজেও বুঝতে পারেনি। মহিলা এক প্রকার জোর করেই নিয়ে এসেছে। পা ঠিক থাকলে শর্বরী দৌড়ে বেরিয়ে পড়ত এখান থেকে। আজকের দিন টা না তার কপালটাই খারাপ নইলে বারবার এই লোকের সাথে এমন অপ্রীতিকর অবস্থায় দেখা হয় কেন? তাছাড়া লোকটার হাবভাব দেখে সে অনুমান করল ভীষণ রকমের অহংকারী একটা মানুষ সে। ন্যূনতম সৌজন্যবোধ পর্যন্ত নেই তার মধ্যে। পরক্ষণেই আবার মনে পড়ল সেদিনের শোধ নিচ্ছে নিশ্চিত। ও মনে মনে নীরদকে বকতে লাগল,
“আরে ব্যাটা অভদ্র, তুই কী ভেবেছিস? শর্বরী আবেদিন তোর ক্ষতিপূরণ না দিয়েই কেটে পড়ার ধান্দা করছে? না! সে তোর ক্ষতিপূরণ ঠিকই দেবে। আজ না হয় কাল। সে জাত বংশের মেয়ে। কথা হচ্ছে সেদিন একটু ঘাবড়ে গেছে। না হয় কখনই সে এমন পালিয়ে যাওয়ার মতো মেয়ে না!”

ছেলের এমন রুক্ষ ব্যবহারে রেবেকা সুলতানা অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গেলেন। বাপের মতোই হাদাটা মেয়েদের সাথে ঠিক মতো কথা বলতে জানে না। ঠিক এই কারণেই তার এখনো কোনো গতি হয় নি। এদিকে ত্রিশ পার করে গেছে।

“ওর নাম শর্বরী। সেদিন সামিহার বিয়েতে তোকে বলেছিলাম না একটা মেয়ের কথা! ভুলে গেছিস?”

নীরদের মনে পড়ল। মায়ের পছন্দ করা মেয়ে মানে এই মেয়েটা? নো ওয়ে! মা একে এখানে কেন নিয়ে এসেছে? তার রাগ হচ্ছে, এভাবে হুট করে মেয়েটাকে এখানে নিয়ে আসার আগে তার সাথে একবার যোগাযোগ করা উচিত ছিল।

শর্বরীর অস্বস্তি হচ্ছে। আর পারছে না সে এখানে এভাবে বসে থাকতে। টেবিলের উপর থেকে ব্যাগটা হাতে নিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো খুব সাবধানে। রেবেকা সুলতানা ও তড়িঘড়ি করে উঠে বললেন,

“একি মা, তুমি চলেছ কোথায়? বসো না, একটু কথা বলি!’

শর্বরী হাতঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে বলল, “আমার খুব তাড়া আছে আন্টি। বাসায় সবাই চিন্তা করবে। আপনি আমাকে কিছুক্ষণ বসে রেস্ট নিতে দিয়েছেন তার জন্য অনেক ধন্যবাদ।”

জবাবে তিনি কিছু বলবেন তার আগেই শর্বরী আড় চোখে নীরদের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল,

“আমি আমার ঋণ শোধ করতে জানি। সময় মতো ঠিকই করে দিব।” এই বলে আর মুহূর্তের জন্যও সে অপেক্ষা করল না। বেশ কষ্ট হলেও এক প্রকার জোর করেই দ্রুত হেঁটে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। অন্যদিকে নীরদ শুধু তাকিয়ে থেকে তার চলে যাওয়া দেখল।

৬.
ড্রয়িংরুমে ফ্লোরে বসে খোকনকে গল্প শোনাচ্ছিল মাজেদের মা। পাশেই সোফায় বসে বই পড়ছিল অনু আর তার পাশেই রিমা ল্যাপটপে প্রেজেন্টেশন তৈরি করছিল। মাজেদের মা এত জোরে জোরে কথা বলছিল যে না চাইতেও সবটা তাদের শুনতে হচ্ছিল। এক সময় বিরক্ত হয়ে রিমা বলে উঠল,

“মাজেদের মা, আপনার গল্পে মেলা থেকে হারিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু নাই? সবসময় গল্পের মূল চরিত্র শুধু মেলা থেকে হারায়?”

“আছে তো। আরেকটা আছে, ওইটাতে টেরেন থেইকা হারায় যায়।”

“ওহ, হে আল্লাহ, এই মহিলাকে আমি আর সহ্য করতে পারছি না!”

অনু হাসতে হাসতে বলল, “আপনার জন্য ফুফুই ঠিক আছে বুঝলেন? ফুফু আসছেন তো পরশু।”

মাজেদের মা তব্দা খেয়ে বললেন, “আবার! তাইনে আবার আইব?”

রিমা বলল, “আপনার কোনো সমস্যা?”

“জ্বে। হে আমার সমইস্যা করে। আইলেই খালি আমার পিছনে লাগে। মাজেদের মা এই কাম করো, মাজেদের মা ওই কাম করো। ভালা কতা কইলে আবার রাগ করেন। তাই তেনারে ভালা কতাও কইতে নাই।”

“আপনি কি ভালো কথা বলেন তা আমাদের জানা আছে। গতবার জেঠী না থাকলে আপনার আর রক্ষা ছিল না। সেদিনই ফুফু আপনার চাকরি নট করতেন।”

অনু বলল, “সেদিন আপনি কী ভয়টাই না পেলেন মাজেদের!”

“আমি? আমি ডরাই? আমি কাউরে ডরাই না। আমি তাইনের খাই না তাইনের পরি? আমি তো আপনেগো খাই।”

খোকন ফ্লোরে বসে খেলছিল। একটু আগেই তাকে যে বাটিতে করে মাজেদের মা খাওয়াচ্ছিল সেটা হাতে নিয়েই ফ্লোরে আছাড় মা”রল সাথেই সাথেই বাটিটা দুই টুকরো হয়ে গেল। শব্দ শুনতে পেয়ে রান্নাঘর থেকে খোকনের মা ছুটে এলেন। কাঁচের টুকরোর পাশে ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেখান থেকে সরিয়ে আনলেন। একটু চওড়া গলায় মাজেদের মা কে বললেন,

“মাজেদের মা, ওর হাতে বাটি দিলেন কেন?”

“আমি কি দিসি নাকি খোকন তো নিজেই লইয়া ভাঙছে। নিজের পোলার দুষ কেউই দেখে না। যত দুষ খালি মাজেদের মার।”

“আপনি এত রাগ করছেন কেন? আমি তো সেভাবে বলিনি আপনাকে।”

“তো আমি রাগ করুম না? কিছু হইলেই আমারে কয়। আমি কি আপনেগো খাই? আমি আল্লাহর খাই। আল্লাহ আমারে খাওয়ায়।”

রিমা ল্যাপটপ নিয়ে উঠে যেতে যেতে বলল, “পল্টিবাজ মহিলা একটা।”

তখনই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়িতে ঢুকল শর্বরী। তাকে এভাবে আসতে দেখে অনু দৌড়ে গিয়ে ধরল। সবাই বেশ হট্টগোল শুরু করে দিল এ অবস্থা হলো কী করে জানার জন্য! মাজেদের মা ফট করে বলে উঠলেন,

“বয়স কালে বিয়া দিলে আর এমুন হইত না। একে তো সুন্দর মাইয়া মানুষ, আরো সাঁঝের সময় একলা বাইরে যায় তেনারা পিছে লাগসে। এবার ছুডাও তেনাগোর থাইকা। সহজে পাইরবা না। অহন বিয়া দিলে সব ঠিক হইব।”

রিমা চেঁচিয়ে উঠল, “এই আপনি যান তো এখান থেকে! আপনার কাছে যতসব আজগুবি কথা!”

রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে শর্বরী ঘুমাতে এলে তার সারাদিনের ঘটনা সব মনে পড়ে গেল। মনে পড়ল কীভাবে অভদ্র ভ’য়া’নক লোকটার কথা। আজকে এক দিক দিয়ে ভালো হলো সে লোকটার ঠিকানা পেয়ে গেছে। এবার সে তার ক্ষতিপূরণ দিতে পারবে। যাক, অন্তত একটা বড় চাপ তো কমবে ওর ওপর থেকে। এতদিন যা মানসিক অশান্তিতে ভুগতে হয়েছে! লোকটার ক্ষতিপূরণ দিয়েই সে আজীবনের জন্য তার চ্যাপ্টার ক্লোজ করে দিবে। বালিশে মাথা দিয়ে সে কয়েকবার বিড়বিড় করল, “অভদ্র একটা!”

হসপিটাল থেকে ফিরতে প্রতিদিন বেশ রাত হয় নীরদের। আজও ডিউটি শেষে বাসায় ফেরার সময় সে সব চেক করে বের হওয়ার সময় খেয়াল করল একটা হেয়ার ব্যান্ড পড়ে আছে তার ডেস্কের ওপর। এতক্ষণ সে এটা খেয়াল করেনি। কার হতে পারে চিন্তা করতে করতেই মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেল। নামটা কি যেন? সরণি? না, এটা না। অন্য কিছু। ও বারবার চেষ্টা করেও মনে করতে পারল না। মনে করতে না পেরে ও খুব উত্তেজিত হয়ে উঠল। আর তখনই সবচেয়ে বড় হঠকারিতা করে ফেলল, এই মাঝ রাতে মাকে কল করে বলল,

“মেয়েটার নাম যেন কী?”

#চলবে।