এমনই এক দিনে পর্ব-০৭

0
1

“এমনই এক দিনে” (পর্ব-৭)
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

১৩.
সকাল থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে, আজ আর বাইরে বের হতে ইচ্ছে করছে না। তাই সকালের নাশতা সেরে হুমায়ূন আহমেদের “এই মেঘ, রৌদ্রছায়া” বইটা নিয়ে শর্বরী বারান্দায় এসে বসে। একটু পরেই মাজেদের মা এসে চা দিয়ে গেল। যাওয়ার আগে বলল,

“বড় আফা, আইজকা কি সুন্দর বিষ্টি দ্যাখছেন! আপনের আম্মারে এট্টু কন খিচুড়ি রান্না করবার জন্য।”

শর্বরী বই থেকে মুখ না তুলেই বলল, “খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করছে না, মাজেদের মা।”

“তো কি খাইবেন?”

“ভাতই খাব।”

মাজেদের মা ভেংচি কেটে নিচে এসে শর্বরীর মাকে বলল, “বড় আফায় খিচুড়ি রান্না করবার জন্য কইছে। সঙ্গে বেগুনি ভাজতেও কইছে।”

বই পড়তে পড়তেই একটা সময় হুট করেই শর্বরীর নীরদের কথা মনে পড়ে গেল। সেদিনের পর লোকটার সাথে আর দেখা হয় নি। লজ্জা আর সংকোচে পরদিন ক্লিনিকে না গেলেও ফিরে আসার দিন ঠিকই যায়। গিয়ে জানতে পারে নীরদ নেই, চলে গেছে। তার কেন যেন খুব খারাপ লাগল। বাড়ি ফেরার পথে সবার সাথে হাসি তামাশায় আর যোগ দিতে পারল না। সেখান থেকে আসার দুই মাস হয়ে গেছে। এরমধ্যে অরিনের বিয়ে হয়েছে, সে দেশও ছেড়েছে। তবুও শর্বরী এখনও সেই দিনেই পড়ে আছে। সেদিন নীরদের দেওয়া প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সে মেডিসিন, ক্রিম এনে ব্যবহার করেছে। র ্যাশ দেখা গেল এক সপ্তাহের মধ্যেই গায়েব। মনে মনে নীরদকে সে এর জন্য যে কতবার ধন্যবাদ দিয়েছে! ওহ আরেকটা কাজও করেছে। নীরদের টাকা শোধ করার জন্য ও একটা চাকরি নিয়েছে। প্রথমে বিশ হাজার টাকা বেতন দেখে ও খুব খুশি হয়েছিল যদিও কিন্তু কাজের চাপে এখন ওর নাজেহাল অবস্থা। আগের কিছু টাকা আর এক মাসের বেতনের পুরোটা দিয়ে গত সপ্তাহে সে চল্লিশ হাজার টাকা নীরদের চেম্বারে রেখে এসেছে। তা করতেও অবশ্য বেশ কাঠখড় পো’ড়াতে হয়েছে। চেম্বার সহকারী টা কোনো ভাবেই তাকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছিল না। এভাবে এতগুলো টাকাও একজনের হাতে ফেলে আসা যায় না। তাই সে উপায় না পেয়ে টাকা গুলো একটা গিফট বক্সে করে নিয়ে পরদিন আবার যায়। নীরদ না থাকা অবস্থাতেই সে গিয়ে বক্সটা ওই লোকের কাছে দিয়ে বলে,

“এটা উনাকে দিবেন। সাবধানে রাখবেন কিন্তু। কাঁচের জিনিস ভেঙে গেলে আপনাকে জরিমানা দিতে হবে।”

লোকটা বক্স হাতে নিয়ে ভেতরে রেখে আসা পর্যন্ত ও দাঁড়িয়ে রইল। এতগুলো টাকা ওর। জীবনের প্রথম রোজগার। এভাবে কীভাবে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে আসতে পারে? সামনের মাসে আবারও টাকা পাঠাবে। সেটা ওঁ ওই বাক্সের মধ্যেই একটা চিরকুটে লিখে দিয়েছে।
_________________________________

ইমার্জেন্সি থেকে বের হয়ে নীরদ চেম্বারের দিকে যাচ্ছিল। সহকারী সেলিম এগিয়ে এসে বলল আজ আবারো একটা বাক্স দিয়ে গেছে মেয়েটা। নীরদ কিছু বলল না, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেতরে ঢুকল। প্রথমেই তার চোখ পড়ল গিফট বক্সটার উপর। আজকে আবারও! ওহ, আজ তো দশ তারিখ। চিরকুটে সেবার রাণী লিখে দিয়েছিলেন প্রতি মাসের দশ তারিখ অল্প অল্প টাকা শোধ করবেন। তিনি না কি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন এ বছরের মধ্যেই সবটা ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিতে। নীরদের হাসি পায়, তবে জোর করে আটকে রাখে‌। বোকা মেয়ে! অযথা কষ্ট করছে। নীরদ চিরকুট বাদে টাকাগুলো ছুঁয়েও দেখেনি। যেভাবে ছিল সেভাবেই ড্রয়ারে রেখে দিয়েছে। তবে এই বাক্সটাও খুলে দেখল চিরকুট আছে কি না। না, নেই। এবার আর কোনো চিরকুট না পেয়ে তাকে হতাশ হতে দেখা গেল। মেয়েটার হাতের লেখা চমৎকার। গুটি গুটি অক্ষরের লেখার দিকে সেদিন ও কতক্ষণ যে তাকিয়ে ছিল! সুযোগ পেলেই একটু পর পরই দেখছিল। এখনও দেখছে। ও ঠিক করল, মেয়েটার এমন কাজের জন্য ও এবার শা’স্তি দেবে। বড় ধরনের শা’স্তি দেবে। টাকার গরম দেখাচ্ছে, তাও আবার কাকে! নীরদকে?

১৪.
শর্বরী হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে। এই সময়ে নীরদ ডিউটিতে থাকে। আগে দু’বার এই সময়েই টাকাটা দিয়ে গেছে। কিন্তু আজ ওঁর কাছে কেমন যেন লাগছে। অন্যরকম একটা অনুভুতি হচ্ছে। সেই সাথে ভ’য় যে পাচ্ছে সেটাও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ধীর পায়ে নীরদের চেম্বারের সামনে এসে দাঁড়াতেই সেলিম দাঁত কেলিয়ে হেসে ফেলল। বলল,

“আজ আবারো উপহার নিয়ে আসছেন?”

শর্বরী মাথা নাড়ল। সেলিম দরজা থেকে সরে গিয়ে বলল,
“আজকে তাহলে আপনিই যান, ভেতরে গিয়ে রেখে আসেন।”

শর্বরী অবাক হলো। এই লোকটাকে ওর চিনতে অসুবিধা হচ্ছে। এই লোককে সেদিন এত মিনতি করেও ভেতরে ঢুকতে পারেনি আজ কি না স্বেচ্ছায় পথ করে দিচ্ছে ভেতরে যাওয়ার জন্য। ওঁর মন আনচান করতে লাগল। কিন্তু কী ভেবে ভেতরে ঢুকল। ও ভেতরে ঢুকতেই বাইরে থেকে খট করে দরজাটা বন্ধ করে দেয় লোকটা। শর্বরী আৎকে উঠে দরজার নব ধরে টানাহেঁচড়া করতে লাগল কাজ হলো না। ও কয়েকবার চেঁচিয়ে লোকটাকে ডাকল। না, সাড়া মেলেনি। ভ’য়ে, আ’ত’ঙ্কে ওর গলা শুকিয়ে আসে। তখনই ও লক্ষ্য করে ওর পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে নীরদ। এবার ওঁর অবস্থা একদম প্রথম দিনের মতো হয়। আজ থেকে আবারো নীরদকে সে ভ’য় পায়‌। এত ঘাবড়ে যায় যে ওর হাত পা অবশ হয়ে আসে। আরো দু চার বার ব্যর্থ চেষ্টা করল দরজা খোলার। নীরদ বলল,

“ভ’য় নেই, আটকে রাখব না সারাজীবনের জন্য।”

“সারাজীবন তো দূরের কথা এক মুহূর্তের জন্যও আটকে থাকতে চাই না। দরজা খুলতে বলুন! এক্ষুনি!”

নীরদ খেয়াল করল মেয়েটার গলা কাঁপছে অসম্ভব। সে একটু এগিয়ে যেতেই চোখ তুলে তাকালো শর্বরী। শক্ত গলায় বলল,

“একদম কাছে আসার চেষ্টা করবেন না।”

এতক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে থাকার কারণে শর্বরীর চোখ দুটো দেখতে পায়নি নীরদ। এবার মাথা তুলে তাকানোতে সে দেখল শর্বরীর চোখ দুটো লাল হয়ে উঠেছে, চোখ ছলছল করছে। যে কোনো মুহূর্তে কেঁদে দিতে পারে। সে অবাক হয়, মেয়েটা এত ভ’য় কেন পাচ্ছে? হঠাৎ করেই তার মাথায় এলো, মেয়েটা প্রথম থেকেই তাকে এত ভ’য় পায়। নীরদের রা’গ হলো। সে কি দেখতে ভ’য়া’নক, কুৎ’সিত কিছু? ও আরেকটু কাছে এসে দাঁড়ায় শর্বরীর। বলে,

“তুমি আমাকে এত ভ’য় কেন পাও? আমি কী তোমাকে বকেছি? মে’রেছি?”

শর্বরী কিছু বলল না। নীরদও আজ রা’গ সামলাতে পারছে না। ও ধ’ম’কে উঠল,

“বলো!”

শর্বরী দ্রুত মাথা নাড়তে লাগল। না, এমন কিছুই করেনি। তবে কেন? কেন সে নীরদকে ভ’য় পাচ্ছে?

“আমি তোমাকে বলেছি টাকা দিতে আমাকে? চেয়েছিলাম ক্ষতিপূরণ?”

শর্বরী আবারো মাথা নাড়তেই নীরদ ওর ডান হাতের কব্জি ধরে টেনে আনল আরেকটু কাছে, বলল,

“কথা বলো। মাথা নাড়ছ কেন? তুমি বোবা? কথা বলতে জানো না!”

“ওহ্ না!”

শর্বরী সর্বোচ্চ শক্তি খাটিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। তবে এবার ওর চোখ থেকে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছে। নীরদ একটু নরম হলো। একটু দূরে সরে দাঁড়ালো। বলল,

“টাকা গুলো নিয়ে যাও। আর কখনো টাকা নিয়ে আসবে না।”

“ওটা দিতে আমি বাধ্য। আপনি না বললেও।”

নীরদ খেয়াল করল ও নরম হওয়াতে শর্বরীও এবার গরম হলো। বাহ; বেশ ভালো। নীরদ এটাই চাইছিল। এই মেয়েটা এমন কান্না কাটি করবে ছিঁচকাদুনের মতো তা তো ও কখনো কল্পনাও করেনি।

“আমি নিতে চাইছি না।”

“তবুও আমি দেব। এবার আপনি নিবেন না কি ফেলে দিবেন সেটা আপনার হাতে।”

“জেদ করো না।”

“তুমি করে বলবেন না আমাকে। আমি পছন্দ করছি না ব্যাপারটা।”

“আমার ইচ্ছে আমি বলব। এবার তুমি পছন্দ করছ কি করছ না সেটা তোমার ব্যাপার।”

শর্বরী বুঝল ওঁর কথার জালে ওঁকেই ফেলছে। লোকটা আস্ত শ’য়’তান। যেমনটা দেখায় বাইরে তেমনটা না। শর্বরীর মনে হচ্ছে প্রত্যেক সাক্ষাতে ও লোকটাকে একটু একটু করে চিনতে পারছে, জানতে পারছে। শর্বরী টাকাটা বের করে ডেস্কের উপর রাখতেই নীরদ বলল,

“আমি বারণ করেছিলাম।”

“আমিও শুনতে বাধ্য নই।”

“বেশ। তবে তাই হোক। টাকা দিচ্ছো দাও, আমি নেব। কিন্তু সেই সাথে আরেকটা জিনিসও একেবারের জন্য নিয়ে নেব।”

শর্বরী বুঝতে পারল না নীরদের কথা। ও তাকিয়ে রইল নীরদের দিকে। নীরদ সামান্য হেসে পকেট থেকে পায়েলটা বের করল। বলল,

“ভেবেছিলাম ফিরিয়ে দেব। তবে আজ এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর দেব না।”

“ওটার আশা আমি ছেড়েও দিয়েছি।”

“আচ্ছা। তাহলে তো আর কোনো চিন্তা রইল না। এটা আমার।”

“পরবেন?”

“না, পরাবো।”

“কাকে?”

“সেটা ব্যক্তিগত ব্যাপার।”

শর্বরী তেড়ে এসে বলল, “ওটা আমার।”

“তুমিই তো বললে ওটার আশা আর করো না।”

“এটা আমার দাদু দিয়েছিলেন আমাকে। আমার অনুভূতি জড়িয়ে আছে।”

“তবে নাও। আমি দিতেই চাইছি। টাকা গুলোর সাথে এটাও ফিরিয়ে দিচ্ছি। নিয়ে যাও।”

শর্বরীর মনে হলো নীরদ ওকে করুনা করছে। কেন যেন ওঁর সেই মুহূর্তে এত খারাপ লাগছিল। নানান উদ্ভট কল্পনা করে ও সেদিন টাকার সাথে সাথে পায়েলটাও ছেড়ে এলো। আজীবনের জন্য।

#চলবে।