“এমনই এক দিনে” (পর্ব-১১)
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
২১.
ড্রয়িং রুমে খোকনকে নিয়ে মাজেদের মা হাঁড়ি পাতিল খেলছেন। ব্যাটা ছেলে হাঁড়ি পাতিল খেলবে কেন এই নিয়ে মাজেদের মায়ের যত আপত্তি। তিনি খোকনের রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি গুলো এনে সামনে সাজিয়ে রেখেছেন। খোকন সেসব ছুঁয়েও দেখছে না। বারবার কী চা বানাচ্ছে আর মাজেদের মা কে খেতে দিচ্ছে। একই কাজের পুনরাবৃত্তিতে তিনি বিরক্ত হয়ে বিড়বিড়িয়ে বলতে লাগলেন,
“বজ্জাত পোলা! মাইয়াগো লাহান খেলাইবার চায়। তুই ব্যাডা একলা একলা গাড়ি চালাইবি, পেলেন উড়াইবি। তুই আমারে লইয়া এত কাহিনী করস ক্যান!”
আজ অনু আর রিমা দুজনেই বাড়িতে। কাল অনেক রাত পর্যন্ত জেগে মুভি দেখেছিল দুজন। সকালে রিমার ক্লাস মিস যাওয়ায় সে অনুকেও আর যেতে দিল না। বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠে এখন দুজনে নাশতা করতে বসেছে। রিমা পরোটা চায়ে চুবিয়ে এক কামড় দিয়ে মাজেদের মায়ের দিকে তাকালো। খোকনের দিকে কেমন মেজাজ গরম করে তাকিয়ে আছেন তিনি। রিমার তাকে নিয়ে সন্দেহ হয় কখন না জানি খোকনটাকে ধরে উদোম ক্যালানি দেয়! একটা মাত্র ছোট ভাই তাদের! কত আদরের। মাজেদের মায়ের হাবভাব ওঁর পছন্দ হয় না। খোকনের জন্য নতুন কাউকে রাখতে হবে কি না এ নিয়ে ছোট চাচীর সাথে কথা বলতে হবে। অনু মিক্সড সবজি দিয়ে পরোটা খেতে খেতে বলল,
“আজকে চল কোথাও পিকনিকে যাই। বড় আপা কই!”
“মা বলল দরকারি কাজে বের হয়েছে।”
“বড় আপার বিয়ে হয়ে গেলে আমরা দুজনে একা থাকব কী করে?”
“তুইও বিয়ে করে নিস এরপর। দুলাভাই কাছে থাকলে একা থাকার চিন্তা করতে হবে না আর।”
“সবকিছুতেই তোর মশকরা আমার ভালো লাগে না। তুই ভেবে দ্যাখ, ওঁর বিয়েটা একটু জলদি হচ্ছে না?”
“আমার দুইটা ক্লাসমেট বিয়ে শাদি করে বাচ্চা পালে তারা আপার থেকে চার বছরের ছোট হবে। আর তুই বলছিস আপার বিয়ে জলদি হচ্ছে!”
“তুই একটা স্বার্থপর। তুই চাইছিস আপা বিয়ে করে চলে যাক এরপর ওঁর রুম তুই দখলে নিবি। এটা তুই ছোট থেকেই বলতি।”
“ও ভালো কথা মনে করিয়েছিস। আমি তো এই পরিকল্পনার কথা ভুলেও গিয়েছিলাম। আর তুই এখন এমন করছিস কেন? তখন তো আমার সাথেই খুব নাচলি।”
অনু আর কথা বাড়ালো না। শর্বরীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে সে তা কিছুতেই মানতে পারছে না। শুরুতে লাফালাফি করলেও এখন খুব খারাপ লাগছে। তখন অমন খুশিতে নাচানাচি করার জন্য ওঁর এখন আফসোস হচ্ছে। শর্বরী হয়তো ভাবল তাকে বিদায় দিতে সবাই কতটা আগ্রহী! চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ও ভাবল শর্বরীর সাথে কথা বলে দেখবে। বিয়েটা আরো পরে করলে নিশ্চয়ই বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে না। ততদিনে অনু মন শক্ত করার চেষ্টা করবে না হয়।
বাড়ির কলিং বেলটা তখন বেজে উঠল। ওঁরা ভাবে শর্বরী এসেছে। মাজেদের মা উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখল রেবেকা সুলতানা দাঁড়িয়ে আছেন। এক ঝলকেই মাজেদের মা তাকে চিনতে পারল। ওই একদিন শর্বরীর জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল সেই মহিলা। রেবেকা সুলতানা বললেন,
“বাড়িতে কেউ নেই?”
“জ্বে আছে। আপনে ভিতরে আইসা বসেন। আমি ডাকবার জন্য যাইতেছি।”
রেবেকা সুলতানা ভেতরে এসে বসলেন। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে শর্বরীর খোঁজ করছিলেন বোধহয়। শর্বরীর মা এসে তাঁর সাথে সালাম বিনিময় করলেন। ভদ্রমহিলা প্রথমেই শর্বরীর খোঁজ করলেন। শর্বরী নেই শুনে একটু হতাশ হলেন। বেশ কিছুক্ষণ টুকটাক কথার পর বললেন সেদিনের পর কিছু সমস্যার জন্য আর যোগাযোগ করা হয়নি, উনি যেহেতু আগেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে এসেছেন তাই জানতে চাইলেন এই নিয়ে উনাদের কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মাজেদের মা পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। শুনে হেসে বললেন,
“আপনের টাইম শেষ।”
রেবেকা সুলতানা থতমত খেয়ে বললেন, “মানে?”
“মানে হইল গিয়া বড় আফার আরেক খানে বিয়া ঠিক।”
রেবেকা সুলতানা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে শর্বরীর মায়ের দিকে তাকাতেই তিনি মাথা নেড়ে সম্মতি জানান। সাথে সাথেই তিনি মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন। এই মুহূর্তে তাঁর ইচ্ছে করছে নীরদকে ধরে ইচ্ছেমতো চড়াতে। অবাধ্য ছেলে! মায়ের কথার কোনো দাম নেই তার কাছে। তাঁর ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল।
দোতলা থেকে তখন ছুটে নিচে এসে উপস্থিত হলেন খোকনের মা। তিনি এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,
“সর্ব’না’শ হয়ে গেছে!”
শর্বরীর মা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। চিন্তিত গলায় বললেন, “কি হয়েছে?”
“শর্বরী এ’ক্সি’ডেন্ট করেছে।”
শুনতেই তিনি আর্তনাদ করে উঠলেন,
“আল্লাহ্ আল্লাহ্, কী বলে! কখন? কীভাবে? আমার মেয়ে ঠিক আছে তো!”
“ওঁর কিছু হয় নি। ওঁ সুস্থ আছে। ওঁর গাড়ির সামনে একটা বাচ্চা মেয়ে এসে পড়েছিল। তাকে শুনলাম ওটিতে নেওয়া হয়েছে। আমাদের এখনই হসপিটালে যেতে হবে। কী একটা অঘটন ঘটে গেল! খোকনের বাবা তো বলছে এটার পু’লি’শ কে’ই’স হতে পারে।”
অনু আর রিমা চেঁচামেচি শুনে ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে আসে। খোকনের মায়ের শেষ কথাটা শুনতে পায় দুজনেই। রিমা বলল,
“কীসের কে’ই’স?”
__________________________________
শর্বরী কপালে হাত ঠেকিয়ে বসে আছে। পাশেই আরেফিন বসে আছে নীরব হয়ে। শর্বরীর দুশ্চিন্তা তড়তড় করে বাড়ছে। বাচ্চা মেয়েটার এখনও কোনো খবর পাওয়া যায়নি। নীরদ ওটিতে গেছে আধা ঘন্টা হয়ে গেছে। তার আপাদমস্তক কাঁপছে। মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে সে কী করবে! একটা খু’নে’র দ্বায় বহন করে সে বাঁচতে পারবে না। কাউকে এই মুখ আর দেখাতে পারবে না। একটু আগেই ছোট চাচাকে কল করে সবটা জানিয়েছে। বাবাকে কল করার সাহস পাচ্ছিল না কোনো ভাবেই। ছোট চাচা তাকে আশ্বস্ত করলেন সব ঠিক হয়ে যাবে। সে যেন কোনো ভাবেই ভেঙ্গে না পড়ে। শর্বরী খুব চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। অজানা আ’শ’ঙ্কায় তার চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে আসছে বারবার।
আরেফিনের প্রতি সে খুব কৃতজ্ঞ। লোকটা কিছু বলছে না অথচ কত কিছু করছে তার জন্য। এটা কেবলই সমাজ সেবা কি না সে বুঝতে পারল না। তবে তাকে নিতান্তই ভদ্র লোক মনে হলো। এমন উপকারী মনোভাব আজকাল কয়জনের থাকে! লোকটাকে বেশ কয়েকবার ও ধন্যবাদ জানিয়েছে এর মধ্যে। তবে সে বারবার বলছে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই, এটা তার দায়িত্ব ছিল। শর্বরীর অনুশোচনা হলো। এই লোকটাকে শুরুতে ও ভালো চোখে দেখেনি। আসলে বাইরেরটা দেখে কাউকে বিচার করা যে অন্যায় সেটা লোকটার কাজে কর্মে তা সে ভালো করেই বুঝতে পারল।
আরো বিশ মিনিট পর ওটি থেকে নীরদ আর ডক্টর রোকসানা বেরিয়ে এলো। শর্বরীকে ডক্টর রোকসানা এগিয়ে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“চিন্তা করো না। মেয়েটা আউট অব ডেঞ্জার। ওর কন্ডিশন অত সিরিয়াস ছিল না। সময় মতো নিয়ে এসে বেশ ভালো করেছ। এই সপ্তাহে চিকিৎসার ভেতর থাকলেই অনেকটা সুস্থ হয়ে যাবে সে।”
শুনে শর্বরী দুই হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে সে কখনোই নিজেকে ক্ষমা করতে পারত না, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রাখতে পারত না। এটুকু বাচ্চা একটা মেয়ে! তার জন্য ওঁকে কতটা কষ্টই না সহ্য করতে হচ্ছে!
নীরদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে শর্বরীকে দেখতে লাগল। বোকা মেয়ে, এত ভ’য় পেয়েছে! পেয়েছে তো পেয়েছে নীরদকেও সঙ্গে খুব ভ’য় পাইয়ে দিয়েছিল। তার তখনকার কান্নাকাটিতে নীরদও অনেক ঘাবড়ে গিয়েছিল না জানি কী করে ফেলেছে! গিয়ে দেখে মেয়েটার তেমন কিছুই হয়নি, যেসবের আশংকা সে প্রথমে করেছিল। গাড়িতে যথাসময়ে ব্রেক কষে বলে অতটা গুরুতর আঘাত পায়নি। ছিটকে পড়াতে মাথার পেছনটা ফেটে র”ক্ত বের হয়, ছোট মানুষ তাই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। তারপরও রিস্ক যে ছিল না তা না। তবে তারা খুব অভিজ্ঞতার সাথে সেটা সামলে নিয়েছে। নীরদ প্রথমে ভেবেছিল শর্বরী বোধহয় গাড়ি চা’পাই দিয়ে দিয়েছিল মেয়েটাকে।
আরেফিন শর্বরীর দিকে তাকিয়ে বলল, “এবার অন্তত রিল্যাক্স হোন। ক্যাফেটেরিয়াতে চলুন। এক কাপ চা খেলে দেখবেন ভালো লাগছে।”
নীরদ ততক্ষণাৎ বারণ করল, “এখন উনার বাড়িতেই ফিরে যাওয়া উচিত হবে। উনার রেস্টের প্রয়োজন। এখানে বাকি সব আমরা সামলে নেব।”
শর্বরী মাথা নেড়ে অসম্মতি প্রকাশ করে। মেয়েটা যতক্ষণ না পুরোপুরি সুস্থ হচ্ছে ততক্ষণ সে এখানেই বসে থাকবে। সে কারো বারণ শুনল না। সেখানেই বসে রইল। নীরদের রাগ হলো, সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই একটা লোক হন্তদন্ত হয়ে সেখানে ছুটে এলো। আর সমানে চেঁচামেচি করতে লাগল,
“আমার মাইয়া কই? আমার মাইয়া কই?”
শর্বরী ঘাবড়ে গেল। নিশ্চয়ই লোকটা ওই মেয়ের বাবা। নীরদ এগিয়ে গেল তার কাছে। লোকটাকে কোনো ভাবেই শান্ত করা যাচ্ছিল না। একটু পরেই শর্বরীর বাবা আর চাচারা এসে উপস্থিত হলো। তারা আসতেই লোকটাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে তাদের সাথে করে নিয়ে গেলেন। শর্বরী সেদিকে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তাকিয়ে রইল।
২২.
শর্বরীর বাবা সাবের রহমান মেয়েটির বাবাকে নিয়ে ক্যাফেটেরিয়াতে গিয়ে বসেছেন। লোকটাকে প্রথমেই ঠাণ্ডা পানি খেতে দিলেন তিনি। গড়গড় করে সবটুকু পানি খেয়ে লোকটা একটু শান্ত হয়। গরীব মানুষ সে, এতবড় হাসপাতালে কোনো দিন আসা হয় নি তার, এত বড় মানুষদের সাথে কোনোদিন কথা তো দূরের কথা পাশেও দাঁড়ানো হয় নি। স্যুট বুট পরা মানুষগুলোকে দেখে তাই সে একটু হকচকিয়ে গেল।
“আপনার নাম কী?”
“করিমউল্লাহ।”
“করিমউল্লাহ সাহেব, আপনার মেয়ের জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত। তার এই অসুস্থতা বা এই বিপদের জন্য আমার মেয়ের দ্বায় আছে যা আমি অস্বীকার করতে পারি না কোনো ভাবেই। তবে আপনাকে আমি শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি আমার মেয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে এটা করেনি। আমার মেয়ের এই কাজের জন্য আপনার কাছে আমি বিনীতভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি, আপনার মেয়ে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তার সবটুকু খরচ আমি বহন করব।”
লোকটা নীরবে চোখের জল ফেলছেন। কিছু বলছেন না। শর্বরীর বাবা তার কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন,
“আমার ছোট ভাই আজ থেকে বারো বছর আগে এমন এক সড়ক দু’র্ঘ’টনায় মা’রা গিয়েছিল। আমাদের এত অর্থ প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও সেদিন আমার ভাইকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। ওই যে, হায়াৎ মওত আল্লাহর হাতে! আপনার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি, এমন দিন আমাকেও পার করতে হয়েছে। তবে আপনাকে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন আরেকটা সুযোগ দিয়েছেন। আপনার মেয়েটা এখন বিপদমুক্ত। আপনি যা চাইবেন, যতটা ক্ষতিপূরণ চাইবেন আমি দিতে প্রস্তুত। আপনার কাছে শুধু আমার একটাই অনুরোধ আপনি আমার মেয়েটাকে মাফ করে দিয়েন। কারণ আমি জানি, আপনি মাফ না করলে আমার মেয়ে তার জীবনভর এই অ’প’রা’ধবোধ থেকে মুক্তি পাবে না। আমার মেয়েটা খুব সরল। আমি জানি, আপনার মেয়ের কিছু হলে আমি আমার মেয়েকেই হারিয়ে ফেলব। তাই আপনি নিশ্চিত থাকুন, আপনাদের সবটুকু প্রয়োজনে আপনারা আমাদের পরিবারকে পাশে পাবেন।”
করিমউল্লাহ অঝোরে কাঁদছে। এই একটা মেয়ে ছাড়া এই দুনিয়ায় তার আপন বলতে আর কেউ নেই। বছর ক’য়েক আগে তার স্ত্রী করোনায় মা’রা গিয়েছিল। এরপর থেকে মেয়েটাকে নিয়ে সে একাই চলছে। রিকশা চালিয়ে ছোট একটা বাচ্চা নিয়ে তার দিন গুলো সুন্দর মতোই কেটে যাচ্ছিল। হঠাৎ করে কী যে হয়ে গেল!
তার কাঁধে হাত রেখে বসা এই লোকটাকে তার অসাধু কেউ মনে হচ্ছে না। অন্য কেউ হলে বোধহয় তার মেয়েটা এখনও রাস্তায় পড়ে থাকত। চিকিৎসার অভাবে মা’রা যেত। হয়তো হাসপাতালে নিয়ে এলেও তাকে রেখে পালিয়ে যেত। হয়তো টাকাও দিতো, চিকিৎসার জন্য কিন্তু দো’ষ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে কাঁধে হাত রেখে এমন সান্ত্বনা কী দিতো? তার জানা নেই।
একটু পরেই করিমউল্লাহ তার মেয়ের সাথে দেখা করে এলো। মেয়েটার অবস্থা শঙ্কামুক্ত দেখে তার স্বস্তি হলো। দরজার সামনেই একটা মেয়ে ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ওই অনুকম্পাময় ভোলা চাহনির দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো এই মেয়ের দ্বারা আর যা-ই হোক না কেন, কারো ক্ষতি করা সম্ভব নয় অন্তত স্বেচ্ছায়। সে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“আপা, মানুষের জীবনে ভুলচুক হইতেই পারে। সবসময় যে কেউ সব কিছু ঠিকঠাকই করব তার কোনো গ্যারান্টি নাই। কথা হইল গিয়া তার মনে কী আছে। আপনার মনে কী আছে আপনার চেয়ে ভালো কেউ জানব না। আমার কোনো রাগ নাই। আপনি কষ্ট পাইয়েন না। আপনারে দেখে আমি যা বুঝলাম আপনি ইচ্ছা কইরা কিছু করেন নাই। আমার মেয়ে বাঁইচা আছে এটাই আমার জন্য অনেক। আপনারে ধন্যবাদ, সময়মতো ওঁর চিকিৎসা করাইছেন। এটাই আমার জন্য অনেক।”
লোকটা চলে যেতেই শর্বরী ভেজা চোখে আশেপাশে তাকাতে লাগল। নীরদ তখন তার দিকেই এগিয়ে আসছিল কোথা থেকে। তাকে দেখে শর্বরী চুখ মুছে নিল। নীরদ তার সামনে এসে কতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
“কিছুক্ষণ সময় দিতে পারবে?”
শর্বরী মুখে কিছু বলল না। শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। নীরদ উল্টো দিকে ফিরে বলল,
“আমার সাথে আসো।”
শর্বরী তার পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। দুজনেই কিছু বলছে না, একদম চুপচাপ। অথচ দু’জনেই ভেতরে ভেতরে কত কথা সাজিয়ে নিচ্ছে একে অপরকে বলার জন্য।
__________________________________
শর্বরীর মা চাচী সবাই এসেছেন। করিডোরে একাধারে সব চিন্তিত মুখে বসে আছেন। শর্বরীর বাবা তাদের আসতে বারণ করেছিলেন। এরপরেও বাড়ি শুদ্ধ চলে আসায় তিনি তার স্ত্রীর সাথে রাগারাগী করলেন। শর্বরীর মাও কম নন। স্বামীর মুখের উপর জবাব দিয়ে এখন উল্টো রাগ দেখিয়ে বসে আছেন। উনার মেয়ের এমন একটা বিপদের দিনে তিনি ঘরে বসে থাকবে? মেয়ে কী ওঁর বাপের একার! উনার কেউ না!
মাজেদের মা বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলেন। এরপর উঠে অনু আর রিমার কাছে গেলেন। তারা দুজন একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি তাদের কাছে গিয়ে বললেন,
“মেজো আফা, ছোডো আফা কিছু খাইবেন না?”
রিমা বিরক্ত চোখে তাকালো তার দিকে। মাজেদের মা কে ওঁরা বাড়িতেই রেখে আসবে ভেবেছিল। মহিলা আসার সময় যা ন্যাকা কান্নাকাটি করছিল যে আর না নিয়ে আসতে পারল না। ও জানত, মহিলা এসেছে তার মতো মজ মস্তি করতে।
“আপনাকে বলেছি তো বাড়িতেই থাকতে। এসেছেন কেন? বাড়িতে থাকলে তো কত কিছু খেতে পারতেন, টিভি দেখতে পারতেন।”
“তয় এইহানেও খানা আছে। আমারে বাগরার কিনা দ্যান।”
এত গুমোট পরিস্থিতির মধ্যেও মাজেদের মায়ের এমন কথা শুনে অনু খিলখিল করে হেসে ফেলল। বলল,
“ওটা বাগরার না, মাজেদের মা। বার্গার, বুঝেছেন।”
“ওই একই হইল। উন্নিশ বিশের পাইর্থক্য।”
“ঊনিশ বিশ না, পুরোটাই পার্থক্য।”
রিমা বলল,
“আমরা টাকা নিয়ে আসিনি। আপনি এক কাজ করেন, ড্রাইভার চাচাকে বলে দিচ্ছি উনার সাথে বাড়ি চলে যান।”
মাজেদের মা রিমাকে ভেংচি কেটে সেখান থেকে চলে এলো। হুহ! এতদিন পর হাসপাতালে আসছে, যে একটু ঘুরবে তা না সেখানেও তাকে বাঁধা দেয়। যাবে না। আজ এখানেই সে খাবে, ঘুরবে, ফিরবে। শর্বরীর ছোট চাচা বাইরে থেকে তখন আসছিলেন, মাজেদের মা তার সামনে গিয়ে বলল,
“ছোডো সাহেব, খোকন বাবায় বাগরার খাওনের লিগা কান্দে। কেউই কিচ্ছু খায় নাই। সবাইর কী ক্ষিধা! আমারও ক্ষিধা কিন্তু আমি কিছু খামু না। আপনে তাদের জন্য কিছু কিনা আনেন।”
“আশ্চর্য, এরা না খেয়ে আছে এতক্ষণ ধরে? আচ্ছা তুমি গিয়ে বসো। আমি কিছু নিয়ে আসছি।”
একটু পরেই ছোট চাচা গিয়ে এত এত খাবার কিনে আনলেন। বার্গার, রোল, চিকেন প্যাটিস, কোক, এমনকি চাও নিয়ে আনেন। শর্বরীর মা চাচীরা সবাই ভাবলেন, এনেছে যখন না খেয়ে ফেলে রাখার তো কিছু নেই। তারা সবাই খাওয়া শুরু করলেন।
রিমা আর অনু তখন সেখানে এসে দেখল সবাই এটা ওটা খাচ্ছে, একটু দূরেই মাজেদের মা ফ্লোরে হাত পা ছড়িয়ে বসে বার্গারে কামড় বসাচ্ছেন। ওদের দুজনকে দেখেই আবারো ভেংচি কেটে বার্গারে সস্ লাগিয়ে পুনরায় খেতে থাকেন। তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে হাসপাতালে মানুষ কেবল বার্গার খেতেই আসে।
রেবেকা সুলতানা নীরদের চেম্বারে এসে দেখে নীরদ নেই। সেলিমকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল কোথায় গেছে তাকে জানিয়ে যায়নি। রেবেকা সুলতানার মাথা কাজ করছে না, শর্বরীর চাচীর থেকে তিনি শুনেছেন এই হাসপাতালের কোনো এক ডাক্তারের সাথেই না কি শর্বরীর বিয়ে ঠিক হয়েছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
“এই হসপিটালের কোনো ডাক্তারের কী সামনে বিয়ে টিয়ে কিছু আছে?”
সেলিম ভাবত লাগল, এরপর কিছু একটা মনে পড়তেই বলল,
“হ্যাঁ, ডাক্তার ফারহানের কালকে শুনলাম বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
রেবেকা সুলতানা হাহাকার করে উঠলেন,
“হায় আল্লাহ্, শেষে কি না ফারহানের সাথে শর্বরীর বিয়ে হবে!”
ডক্টর রোকসানা তখন সেখান দিয়েই যাচ্ছিলেন, উনাদের কথপোকথন শুনতে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। ডক্টর ফারহানের কথা শুনে তিনি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। গতকাল ডক্টর ফারহান যখন তাকে এসে বলল খুব শীঘ্রই সে বিয়ে করছে তখন তার কথা রোকসানা বিশ্বাস করেনি। ভেবেছিল মজা করছে! এখন যা শুনছে তাতে তো মনে হচ্ছে সে সত্যিই বলেছিল। রোকসানা স্টেথোস্কোপটা ছুঁড়ে ফেলে ডক্টর ফারহানের চেম্বারের দিকে ছুটল। এত বড় বাটপার! এতদিন ভালোবাসার নাটক করে এখন অন্য কাউকে নাচতে নাচতে বিয়ে করে নিচ্ছে! ছাড়বে না, ডক্টর ফারহানকে ও ছাড়বে না। দরকার পড়লে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে। এত বড় প্র’তা’রণা কোনো ভাবেই মেনে নেওয়া যাবে না। সে বারবার বিড়বিড় করে বলতে লাগল,
“ট্রেইটার!”
#চলবে