এমনই এক দিনে পর্ব-১৩

0
297

“এমনই এক দিনে” (পর্ব-১৩)
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

২৫.
রামিশা চৌধুরী নীরদের চেম্বারে এসে তাকে কয়েকবার খুঁজে গেলেন। বারবারই এসে দেখেন যে সে নেই। সেলিমকে বার কয়েক জিজ্ঞেস করেও বিশেষ লাভ হয় না। তার ওই এক কথা, “স্যার নেই, কোথায় গেছে তা ঠিক বলতে পারি না।”

রামিশা চৌধুরীর এই রোবটের মতো বারবার এক কথা বলা ছেলেটাকে ধরে একটা আছাড় দিতে ইচ্ছে করল। আরে তুই খোঁজ নে, কোথায় আছে সেই খবর বের কর! না, সেটাও করবে না। ওটা করতে বললে তখনো যন্ত্রের মতো ওই এক কথাই বলে, “অফ টাইমে স্যার কল দিতে বারণ করেছেন।”

তিনি তাসরিফের থেকে নীরদের নাম্বারটা নিলেন। প্রথমে সেলিমের থেকেই নিতে চেয়েছিল কিন্তু পরে কী মনে করে আর চায়নি‌। নাম্বার নিয়ে তিনি কল করলেন, রিং হলো, রিসিভ করল না। রিং হতে হতেই একসময় কল কেটে গেল। পরপর চারবার কল দিলেন। প্রত্যেকবারই রিং হয় কিন্তু রিসিভ আর হয় না। তিনি বিরক্ত হয়ে গেলেন। আশ্চর্য! এত কীসের ব্যস্ততা তার? একটা কল ধরতে পারছেনা!
_________________________________

শর্বরী স্তম্ভিত হয়ে নীরদের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মাত্র লোকটা তাকে কী বলল! সুরসুরি? সত্যিই? ভুল কিছু শুনেছে বলে তো মনে হচ্ছে না। কিন্তু এটা কী নাম? নীরদ ওভাবে ডাকবেই বা কেন?

“সুরসুরি?”

“স্যরি, তোমার নামটা মাথায় আসছিল না।”

শর্বরী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। মানে কী? নাম মাথায় আসছিল না তাই বলে সুরসুরি ডাকবে? উঁহু, এমন নামে ইচ্ছে করেই ডেকেছে সে। এখন নাটক করছে। কী অভদ্র লোক! এটা কী নামে ডাকল! সুরসুরি? এটা আদৌ কোনো নাম হলো!

“তাই বলে এমন নাম মাথায় আসবে? অদ্ভুত!”

“এসে পড়েছে। কী করব?”

“আপনি একটা….

শর্বরী আটকে গেল। বলবেই বা কী? বলতে গেলে কত কিছুই বলা হয়ে যাবে। এর থেকে ভালো চুপ থাকুক। ছিঃ কী বাজে নাম! সুরসুরি!

“কী আমি?”

“কিছু না।”

“বলো, যা বলতে চাইছ বলো‌।”

“কিছুই বলতে চাই না। আপনার সাথে আমার কোনো কথাই নেই।”

“কিন্তু আমার তো আছে।”

শর্বরী সামনে অগ্রসর হচ্ছিল, তবে নীরদের কথা শুনে থমকে দাঁড়ায়। পেছন ফিরে মৃদু স্বরে বলল,

“কী কথা?”

নীরদ কিছুক্ষণ শর্বরীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার তো কত কথাই আছে। মাঝেমাঝে মনে হয় এই একটা মানুষের জন্যই তার সব কথা জমে আছে। এমন কেন মনে হয় সে বলতে পারবে না। এই যে এখন শর্বরী জানতে চাইল, সে কী বলতে পারবে কী কথা আছে? পারবে না। কিছু্ই বলতে পারবে না। তার শর্বরীকে বোধহয় আর কিছুই বলা হবে না। শর্বরীর ও আর তার কথা শোনার একটু সময় হবে না। নিজের অবাধ্য মনকে কোনো ভাবে শান্ত করে রূঢ় স্বরে শর্বরীকে বলল,

“কিছু না। যাও।”

শর্বরীকে এক ধরনের বিধুরতা ঘিরে ধরল। কেন যে লোকটার থেকে হুট করে এত কিছু আশা করছে! এই লোক কে হয় তার? কোনো সম্পর্কই তো নেই এর সাথে। এই মানুষটার থাকা না থাকা, বলা না বলা কোনো কিছুই তো তার কাছে ম্যাটার করার কথা নয়। এরপরেও লোকটার ছোট থেকে ছোট কথা, আচরণ এতটা গভীরে গিয়ে লাগছে কেন? কী জন্য! শর্বরীর বারবার কান্না পাচ্ছে, এত অসহায় কেন লাগে? কীসের কারণে এই লোকটার সামনে থাকলে এত দুর্বল লাগে? বুকে ব্যথা অনুভব করে কেন? তার চোখে তখন পানি টলটল করছে, সেটা লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে গেল সে। পারল না। চলে আসার আগে নীরদকে বলল,

“আমার সারাজীবনের জন্য একটা আক্ষেপ থেকে যাবে যে, কেন আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে।”

নীরদ শুনলো চুপ করে থেকে। কিছু বলল না। বলবেই বা কী? তার সাথে দেখা হওয়া নিয়ে শর্বরীর তো আনন্দে নাচার কথাও নয়।

আরেফিন বাইরে দাঁড়িয়ে শর্বরীর জন্য অপেক্ষা করছিল। তখন ভালো করে বিদায় নেওয়া হয়নি। ওই ডাক্তারটার খোঁজে তাড়াহুড়ো দেখিয়ে কোথায় যে চলে গেল! যাওয়ার আগে তাকে বলেছিল বাইরে দাঁড়াতে। তাই সে এখনও অবিচল দাঁড়িয়ে আছে। তবে অপেক্ষা করতে তার বিরক্ত লাগছে না। ভালোই লাগছে। শুনেছিল কিছু কিছু অপেক্ষা মধুর হয়। সেটা যে মিথ্যে নয়, তা এখন বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে সে।

শর্বরী এলো একদম এলোমেলো রূপে। তাকে দেখে এক মুহূর্তের মধ্যেই আরেফিন ধরে ফেলল কিছু একটা হয়েছে। এগিয়ে গিয়ে কোমল গলায় জানতে চাইল,

“কিছু হয়েছে?”

শর্বরী অপ্রস্তুত বোধ করল। মাথা নেড়ে বলল,

“না, কী হবে?”

“আপনাকে অন্যরকম লাগছে।”

“অন্যরকম মানে?”

“না বলছিলাম, যেতে দেখেছি হাসিখুশি এলেন একদম মলিন মুখ করে।”

“ওহ্, আসলে ক্লান্ত লাগছিল।”

আরেফিন শর্বরীর পেছনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বিল্ডিং টার দিকে তাকিয়ে রইল। সেখানকার থার্ড ফ্লোরে নীরদ পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তাদের দিকেই। আরেফিন হাসল মনে মনে। এই দুজনের মধ্যে বিশেষ কিছু একটা যে আছে বুঝতে অসুবিধা হলো না। শর্বরী বলল,

“আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ রইল।”

“কীসের?”

“আগামী মাসে আমার বিয়ে। আমি চাই আপনি আমার বিয়েতে আসুন।”

আরেফিনের মনে হলো, তার মনের মধ্যে সদ্য বেড়ে ওঠা ফুলের কুঁড়িটা ওখানেই ঝরে পড়ে গেল। এক রাশ হতাশা নিয়ে সে শর্বরীর দিকে তাকালো, শর্বরীর চোখে তার জন্য কোনো বিশেষ অনুভূতি তো দূরের কথা সহানুভূতিও নেই‌। একটা স্বাভাবিক কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতেই তাকিয়ে আছে সে।

“কী হলো? আসবেন না!”

আরেফিন মৃদু হেসে বলল,
“চেষ্টা করব যাওয়ার।”

“চেষ্টা নয় আসতেই হবে। আপনার ঠিকানা ফোন নাম্বার দিয়ে যাবেন প্লিজ! কার্ড পাঠাতে তো হবে?”

নিজের ঠিকানা, নাম্বার দেওয়ার সময় আরেফিনের মনে হলো, কাউকে পছন্দ করার আগে অন্তত আগে পিছে জেনেই পছন্দ করতে হবে। নয়তো এমন করুণ দশাই হবে। ধ্যাত, ব্যাপারটা কেমন যেন! শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে গেল। গাড়িতে ওঠার সময় সে আরেকবার নীরদের দিকে তাকালো। এখনও সে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে। আরেফিনের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল,

“ওরে, এত চোখে চোখে রাখার কিছু নেই। তোর বউ আমি নিয়ে যাচ্ছি না!”

২৬.
নীরদ দূর থেকে আরেফিন আর শর্বরীকে দেখে রীতিমতো রেগে গেল। তার ইচ্ছে করছিল তখনই নিচে গিয়ে মেয়েটাকে সেখান থেকে নিয়ে আসতে। দরকার পড়লে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আনত। কিন্তু, সেই সাধ্য কী তার আছে? লোকটা শর্বরীর প্রেমিক ও নয়‌, হবু বর। শর্বরী তার সাথে যত ইচ্ছে যতক্ষণ ইচ্ছে কথা বলতে পারবে। নীরদের সেখানে করার কিছু নেই‌। শর্বরীর জীবনে তার কোনো ভূমিকা নেই। শর্বরী তো বলেই গেল, ওর আফসোস হবে, অনুশোচনা হবে নীরদের সাথে দেখা হওয়ার জন্য।

যাক গে, সেসব ভেবে আর অযথা সময় নষ্ট করা চলবে না। এমনিতেও আজ তেমন একটা কাজ করতে পারছে না। করবে কীভাবে? মন বসছেনা কোনোভাবেই। কেমন ছন্নছাড়া লাগছে নিজেকে। আজ আর কিছু করতেও পারবে না হয়তো। চেয়ারম্যানকে কল করে আজকের জন্য ছুটি নিতে সে যখন ফোনটা পকেট থেকে বের করল তখন দেখল মায়ের এ নিয়ে এগারোটা কল, এছাড়া আরো চারবার একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এসেছিল। ফোন সাইলেন্ট ছিল, এছাড়া এতটাই শর্বরীতে মগ্ন ছিল যে অন্য কিছুর দিকে ধ্যান যায়নি।

মায়ের কল দেওয়ার কারণ ওর অজানা নয়। আজ মা তাকে যা নয় তা বলে অপমান করবে তা সে জানে। তবে অপরিচিত নাম্বারটা জরুরী কাজে এসেছিল কিনা অনুমান করতে পারল না। মায়ের সাথে সরাসরি কথা বলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই, তাই ওই অপরিচিত নাম্বারে আগে কল দিল। একবার রিং হতেই কলটা রিসিভ হলো, একটা কর্কশ গলার আওয়াজ পাওয়া গেল,

“হ্যালো কে? নীরদ!”

নীরদ একটু বিব্রত হলো। এভাবে কে কথা বলছে সে বুঝতে পারল না। অপরিচিত লাগছে আবার যেন কিছুটা পরিচিতও মনে হচ্ছে।

“কে বলছেন?”

“আমি তাসরিফের আম্মু। চিনতে পারলা?”

নীরদ চিনতে পারল, তড়িঘড়ি করে সালাম দিল। রামিশা চৌধুরী সালামের জবাব দিয়ে বললেন,

“বাবা তুমি কোথায় আছো?”

নীরদের এই মুহূর্তে তাসরিফের মায়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কারণটা সহজ, উনি হবু শ্বশুরবাড়ির মানুষ, এখন মন মেজাজ ভালো নেই তার। কী থেকে কী বলে ফেলে সেটাও একটা চিন্তার বিষয়।

“আন্টি হসপিটালেই আছি।”

“ওহ্, কোথায় আছো বাবা? একটু তোমার চেম্বারে আসো। একটা বিপদে পড়ে আসছি তোমার হাসপাতালে। আমার ভাতিজি তোমার হবু বউ একটা কান্ড ঘটায় ফেলছে।”

নীরদের বিরক্ত লাগছিল। ওই মেয়েটার ব্যাপারে কিছু জানতে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তাছাড়া এখন মা আছেন, তিনি যদি দেখেন তার কাছে না গিয়ে হবু শ্বশুরবাড়ির লোকজনের তোষামোদ করছে তবে ব্যাপারটা আরো খারাপের দিকে যাবে। এর থেকে ভালো হয়, হসপিটাল থেকেই বেরিয়ে যাওয়া। চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলে এরপর সত্যিই সে বাসায় চলে গেল। বাসায় ফিরে গোসল শেষে একটা লম্বা ঘুম দিল। সে মনঃস্থির করে ফেলেছে, যা কিছু হয়ে যাক না কেন আজ ঘুম থেকে সহজে‌ উঠবে না। পেট ভরে, মন ভরে শুধু ঘুমাবে। কেননা ঘুমই সব, ঘুমই সুখ।

এরপর দুই দিন কেটে যায়। শর্বরীর পরিবার বাচ্চা মেয়েটার ভালোই খোঁজখবর রাখছে। এমনকি তার বাবা করিমউল্লাহকে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন সাবের সাহেব। শর্বরী এর মধ্যে এক বার এসে দেখে যায় বাচ্চাটাকে। মেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে‌। হেসে খেলে কথা বলছে। শর্বরীর ওঁর জন্য আদর লাগে। ভেবে রেখেছে পরের বার খেলনা নিয়ে যাবে অনেক গুলো। সেদিন খোকনকে নিয়ে গিয়েছিল, মেয়েটা খোকনের সাথে অনেকক্ষণ গল্প করেছে। কী গল্প করেছে শর্বরী সেসবের আগা মাথা কিছুই বোঝেনি। বুঝবেও বা কী করে? তার মাথায় নীরদ ছাড়া আর কিছু বা কাউকে নেওয়ার সময় আছে কোথায়? সারাক্ষণ ওই এক জনের কথাই ভাবছে। যত ভাবে আর না, ভুলে যাবে। ততোই যেন মনে পড়ে। সেদিন হসপিটালে এলেও সে নীরদের সাথে দেখা করেনি। যথেষ্ট চেষ্টা করেছে নীরদের চোখে না পড়ার জন্য। তার মনে হয়েছিল নীরদ তাকে দেখেনি। অথচ ভুল, নীরদ তার আসা যাওয়া দুটোই যত্নের সাথে লক্ষ্য করে।

এর মধ্যে বিয়ের শপিং শুরু হলো। শর্বরীর কোনো আগ্রহ জন্মায় না তাতে। ফুফু এমন হাবভাব দেখে একদিন অনেক কথা শুনিয়ে দিয়ে যান। উনার ধারণা শর্বরী প্রেম করছে। প্রেমিকের জন্যই এমন উদাসীন হয়ে বসে আছে। শর্বরী যত বলল ফুফু তার কথা শুনতেই চাইলেন না। যাওয়ার আগে বললেন,

“এমন সস্তা প্রেম আসবে আর যাবে। এত মাথায় তুলে রাখার তো কিছু নেই। তাছাড়া যার তার প্রেমে পড়া ভদ্র মেয়েদের শোভা পায় না।”

ফুফুর মনে হয় শর্বরী চাল চুলোহীন কারো প্রেমে পড়েছে। যাকে এখন চাইলেও বিয়ে করা সম্ভব নয়। তাই হয়তো সারাক্ষণ অমন বিষণ্ণ হয়ে এক কোণায় বসে থাকে। ফুফুর ধারণাকে সত্য ভেবে নিয়ে মা, চাচীরাও প্রতিনিয়ত তাকে এটা ওটা বলছেন। এমনকি মাজেদের মাও আজ এসে বলে গেলেন,

“বড় আফা? বিয়া করতে মনে কয় না?”

শর্বরী কিছু বলল না। চুপচাপ বইপত্র গোছানোর কাজে মনোনিবেশ করল। তুলে না রাখলে কয়দিন পর সব গুলোয় ধুলো বালি পড়বে। তখন তো আর কেউ এসে একটু পরিষ্কার করে দেবে না।

“তয় যেই ব্যাডার কাম ধান্দা নাই তার সঙ্গে পেরেম করতে গেছেন ক্যান? তাইনে মানে আপনের ফুপ্পু ঠিকই কয়। ভুইলা যান, হে আপনেরে খাওয়াইবো কী? যাইয়া দেখেন নিজে আইজ কতদিন খাইতে পারেনা, থাকোনের জায়গা নাই দেইখা ঘুমাইতেও পারে না।”

মাজেদের মা যদিও অন্যভাবে কথাটা বলেছেন তবে ভুল বলেননি। অন্য প্রান্তে থাকা নীরদ সত্যিই আজ কতদিন খেতে পারে না, ঘুমাতে পারে না। তবে তার ফ্রিজ ভর্তি খাবার আছে, থাকার জন্য আলিশান ঘর আছে।

#চলবে।