“এমনই এক দিনে” (পর্ব-১৪)
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
২৭.
আজ ক’দিন তী’ব্র তা’পদা’হে শহর পু’ড়ছে। ঘর থেকে বের হতেই ইচ্ছে করে না। না বেরিয়েও উপায় নেই, তাই বের হতেই হয়। শর্বরীর ক্ষেত্রে অবশ্য সেটা বলা যায় না। সে বের হয় একদম স্ব ইচ্ছে থেকে। প্রতিদিন বেলা এগারোটার দিকে সে হসপিটালের উদ্দেশ্য বের হয়। এসময়ে যাওয়ার পেছনে একটা কারণ রয়েছে। ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ! এই এগারোটা থেকে সাড়ে বারোটা পর্যন্ত নীরদ ব্যস্ত থাকে রোগী দেখায়। বাইরে এদিকে ওদিকে তখন তার সাথে দেখা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এজন্য দিনের এই সময়টা শর্বরী বেছে নিয়েছে। কেন? ওই যে, শর্বরী দুর্বল হয়ে পড়ছে! অভদ্র ডাক্তারটা কেমন করে যেন তার মন মস্তিষ্কের রাজত্ব নিয়ে নিচ্ছে। সে তা হতে দিতে পারে না। মনও তার, মস্তিষ্কও তার। দুটো তারই কথায় চলবে। তারই আদেশ মানবে। একটা বাইরের লোক, যার সাথে কি না শর্বরীর কোনো সম্পর্ক নেই, একদম কিছু হয় না, অমন একটা লোক কীভাবে আসে তার সবটা দখল করতে? দেবে না, এটা হতে সে দেবে না। অদ্ভুত ব্যাপার, লোকটা এত গভীরে কখন চলে গেল? সে যে একদমই টের পেল না! পেলে তো অন্তত তখনই রুখতে পারত।
আজ জ্যামের কারণে আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে। বারোটা বেজে ছয় মিনিট তখন, শর্বরী ঘড়ি দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বেশিক্ষণ থাকা যাবে না, রুমকি নামের মেয়েটা তার অপেক্ষায় ছিল। দেখেই হেসে চেঁচিয়ে উঠল,
“এত দেরি করলে ভাবলাম আসবেই না।”
রুমকি মেয়েটার কথা সুন্দর। কোনো টান নেই তার কথায়। ওই যে বলে না বইয়ের ভাষায় কথা বলা, ও ঠিক সেভাবেই কথা বলে। একদম বইয়ের ভাষায়। শর্বরী প্রথমদিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি এত সুন্দর করে কথা বলা কার থেকে শিখলে?”
মেয়েটা এক গাল হেসে বলল, “আমার আম্মা এভাবেই কথা বলতেন।”
শর্বরীর এত ভালো লাগল রুমকিকে! কী সুন্দর করে আম্মা বলল। ইশ্, এত সুন্দর আম্মা ডাকটা শোনার জন্য তার আম্মা আর নেই। শর্বরীর মায়া হয়, নিজ কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত সে ওই মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে।
“আজকে চকোলেট খাব না।”
শর্বরী তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্রতিদিন যার চকোলেটের ডিমান্ড থাকে তোলা তোলা সে আজ বলছে চকোলেট খাবে না। হঠাৎ কী হলো? সে রুমকির পাশে গিয়ে বসল।
“কেন? খাবে না কেন?”
“ডাক্তার বলেছেন চকোলেট খেলে আমার অসুখ সারবে না সহজে।”
শর্বরীর মনটা কেন যেন খচখচ করতে লাগল। ডক্টর রোকসানা এই কেবিনের দায়িত্বে আছেন। তার কথা রুমকি খুব একটা পাত্তা দেয় না, এটা সে নিজেই দেখেছে। আজ হঠাৎ কীভাবে তার মাঝে ভালো চিন্তার উদয় হলো!
“ডক্টর রোকসানার কথা শুনছ তবে?”
“না, রোকসানা আপা না।”
“তবে কে?”
“একটা ভাইয়া ডাক্তার আছে। খুব সুন্দর, লম্বা করে, সে বলেছে।”
শর্বরীর কেন যেন তৎক্ষণাৎ নীরদের কথা মাথায় এলো। পরক্ষণেই ভাবল, ধুর, সবকিছুতেই ওই লোকের কথা কেন মাথায় আসে?
“সে কে? নাম বলো!”
“নাম তো জানি না।”
“তুমি তার কথা শুনলে যে হঠাৎ?”
“বলব না।”
শর্বরীর রাগ হলো, বলবে না মানে কী? লুকোচুরির কী আছে? আজব তো! মেয়েটার বেডের সামনে টুলে বসে বলল,
“না বললে আমি আর আসব না তোমাকে দেখতে।”
মেয়েটা কিছুক্ষণ আমতা আমতা করল,
“বলব?”
“বলো, বলতেই তো বলছি সেই কখন থেকে।”
রুমকি একটু এগিয়ে এসে শর্বরীর কানে ফিসফিস করে বলল,
“আমি ওকে বিয়ে করব। আমার পছন্দ হয়েছে। তাই ওর কথা শুনছি।”
শর্বরী কিংকর্তব্যবিমূঢ় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। আজকালকার পিচ্চি কাচ্চা এসব বলে কী? বাড়িতে আছে এক খোকন, কিছু হলেই বিয়ের কথা বলে। এরা বোধহয় বিয়ে ছাড়া কিছুই বোঝে না। ঢোকায় কে এসব ওদের মাথায়?
“বিয়ে করবে মানে? বিয়ে বোঝো তুমি?”
রুমকি মাথা নিচু করে এমন ভাবে হাসল! শর্বরীর অস্বস্তি হলো। সব রাগ গিয়ে পড়ল ওই ভাইয়ার উপর। সামনে পেলে একদম কথা শুনিয়ে দিত। আচ্ছা, বাচ্চা মেয়েটাকে লোকটা কিছু করেনি তো? আজকাল কেউ কোথাও নি’রা’পদ নয়। বাচ্চারা তো না-ই। পে’ডো’ফা’ই’ল কতগুলো জায়গায় জায়গায় ছড়িয়ে আছে। শর্বরীর চিন্তা বেড়ে গেল।
একটু পরেই ডক্টর রোকসানা এলেন। শর্বরী তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করল না। সাড়ে বারোটা সেই কখন বেজে গেছে। আজ আর বসা চলবে না। বেরোতে হবে। রুমকি জোর করল, তবে আজ সত্যিই আর সম্ভব নয়। শর্বরী তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বের হয়ে এলো। একটু সামনে এগোতেই ঠিক সেই অঘটন টাই ঘটল। যেটার ভ’য় পাচ্ছিল সে।
নীরদ দাঁড়িয়ে আছে পাঁচ ছয় হাত দূরত্বে। গায়ে আজ এপ্রোন টা নেই। পরনে তার ফর্মাল পোশাক, একটা সবুজ শার্ট আর কালো প্যান্ট। শার্টের হাতা গুটানো, বুকের দিকে দুটো বোতাম খোলা। তাকে দেখতে কেমন উদ্ভ্রান্তের মতোন লাগছে। এমন ছন্নছাড়া নীরদকে আগে কখনো দেখেছে বলে শর্বরীর মনে হয় নি। এই এত পরিবর্তনের মধ্যে একটা অপরিবর্তন ধরা পড়ল অবশ্য। নীরদের চোখের সেই ঈগল দৃষ্টি! শর্বরীকে যেটা সবসময় একদম ভেতর পর্যন্ত ধরাশায়ী করে। আজ একটু আগেও শর্বরী তার থেকে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। অথচ ঠিক এখন, এই মুহূর্তে এসে তার মনে হলো, তার অবাধ্য মনের কোথাও সুপ্ত এক বাসনা ছিল এই মানুষটার একটা ঝলক দর্শন করার। এজন্যই বোধহয় তার এমন এক অনুভূতি হচ্ছে যেন মরুভূমির বুকে হেঁটে বেড়ানো তৃষ্ণার্ত পথিক সে অবশেষে গলা ভেজানোর জন্য কাঙ্ক্ষিত সুপেয় পানির খোঁজ পেল।
অবাধ্য মন, অবিবেচক মস্তিষ্ককে শাসিয়ে শর্বরী যখন সেখান থেকে প্রস্থান নেওয়ার কথা ভাবছিল তখন তার দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো নীরদ। খুব কাছে, একদম ছুঁই ছুঁই দূরত্বে। শর্বরীর তখন দম বন্ধ হয়ে আসছিল, বাতাসে অক্সিজেনের শূন্যতা অনুভব করতে লাগল। সে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। নীরদ তখন আরেকটু এগিয়ে এলো। শর্বরীর চোখে চোখ রেখে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। যে চোখকে এত ভ’য় পায় শর্বরী আজ সেই চোখ দুটোকে এত কাছে দেখে তার আপাদমস্তক ঠাণ্ডায় জমে গেল। এরপর একদম হুট করেই যা হওয়ার হয়ে গেল। একটা, দুটো এরপর যেন অজস্র! নীরদ যখন সরে দাঁড়ালো শর্বরী তখন টলছে, একটু পরেই ধপ করে নীরদের বুকে লুটিয়ে পড়ল। এক মুহূর্তের জন্যও দেরি না করে নীরদ তাকে আগলে ধরে।
“বড় আফা? গাড়িতে ঘুমাই থাকবেন বাসায় আইবেন না?”
শর্বরী তড়াক করে উঠে বসল। ওহ্! স্বপ্ন! মন, মস্তিষ্কের সাথে স্বপ্নও এখন তার সাথে বে”ই’মা’নি করছে। শর্বরীর মাথা কাজ করছে না। করিডোরে নীরদকে দেখে সে তখনই ছুটে বেরিয়ে আসে, গাড়িতে উঠে ড্রাইভার চাচাকে তাড়াতাড়ি ড্রাইভ করতে বলে সিটে হেলান দিয়ে বসে। নিজেকে শান্ত করতে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে পানি খায়। তারপর তো রাস্তায় আবারো বিশাল এক জ্যাম বাঁধে! শর্বরী কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল! টেরই পেল না। আর ঘুমানোর পরেই এমন একটা স্বপ্ন। মনে হচ্ছে স্বপ্ন তো নয় এটা যেন তার মনেরই অব্যক্ত চাওয়া। ঘরে এসে বারবার সে ওই মুহুর্তটা অনুভব করতে লাগল। ভীষণ অবাকও হলো এই ভেবে, ওটা ছিল একটা স্বপ্ন অথচ এতটা জীবন্ত!
২৮.
রেবেকা সুলতানা ড্রয়িং রুমে বসে ছেলের বিয়ের জন্য আনা শেরওয়ানি দেখছেন। ওখানে তিনটা তিন রকমের শেরওয়ানি আছে, একটাও তাঁর পছন্দ হচ্ছে না। হবে কী করে? এই বিয়েটাই তো পছন্দ না তাঁর। নেহায়েৎ নিজের ছেলে! তার সুখের জন্য, খুশির জন্য তিনি সবই করতে পারেন। বেয়াদব ছেলেটা মা চিনল না, মায়ের কথা একটু শুনল না। কী হতো? কী হতো শর্বরীকে বিয়ে করলে? মেয়েটা খারাপ কোথায়! দো’ষ, ত্রুটি কিছু তো একটু বলবে! না, সেটাও বলছে না। ছেলেটা যেন তাঁর সাথে লুকোচুরি খেলায় নেমেছে। আর ওই আরেক জন আছে তাসরিফের মা, ভদ্রমহিলা বরাবরই দু লাইন বেশি বোঝেন। সবসময় সবকিছুতে নিজেকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। আশ্চর্যজনক ভাবে তার কথাই সবাই রাখে। যা বলে তাই করে। মহিলার ভাতিজির উপর তিনি এখনই বিরক্ত। ওই মেয়েকে ভবিষ্যতে কখনো মেনে নিতে পারবে কি না কে জানে! রেবেকা সুলতানার আফসোস হয়, সেবার জোর করে যদি ছেলেটার সাথে শর্বরীর বিয়ে দিয়ে দিতেন! রাগ করে চুপ করে থাকাটা যে তখন কত বড় একটা ভুল কাজ ছিল এখন সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে।
টেলিফোন বেজে উঠল অকস্মাৎ, ভাবনা চিন্তার মধ্যে ডুবে থাকা রেবেকা সুলতানার সম্বিৎ ফিরে। তাঁর পাশেই টেলিফোনটা ছিল, ফোনটা তুলবে না ভেবেও কেন যেন তুলল। কানে ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে একটা মোটা নারী কন্ঠ শোনা গেল। তাসরিফের মা মহিলাটাকে চিনতে অসুবিধা হলো না। রেবেকা সুলতানা কল কেটে দিতে গিয়েও দিলেন না। এখন ফোনে কথা না বললে ওই মহিলা বাড়ি পর্যন্ত যে চলে আসবে না সেই গ্যারান্টি নেই। থাকুক! কী বলে তা শুনে দেখলে ক্ষ’তি তো নেই।
“বিয়াইন সাহেবা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা ছিল যে!”
“জ্বি, আপনার তো সব কথাই গুরুত্বপূর্ণ। আচ্ছা বলেন।”
রামিশা চৌধুরী মনে মনে হাসলেন। মেয়ে পক্ষ হয়েও ছেলে পক্ষকে বারবার নাস্তানাবুদ করার মধ্যে আলাদাই একটা মজা আছে।
“মেয়ে আর ছেলে তো এখন পর্যন্ত দেখা সাক্ষাৎ করেনি। ভাবছি তাদের এবার দেখা করানো যাক।”
“এখনই কী দরকার? না দেখলেও চলে। আমার ছেলে ওই মেয়েকেই বিয়ে করবে বলে দিয়েছে। আপনারা ভ’য় পাবেন না শুধু শুধু। ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলে সেটা পরে না হয় দেখব।”
রামিশা চৌধুরী রেগে গেলেন। ত্রুটি বিচ্যুতি? তাদের মেয়ের! কী বলে! সেরার সেরা তাদের শর্বরী। এমন মেয়ে দুটো পাবে না ওঁরা। দু’টো কী একটাই পাবে না। নীরদ একটা ভদ্র সভ্য ভালো ছেলে তাই তিনি আগ্রহ দেখিয়েছেন। নয়তো এত শখ ছিল না তার এখানেই মেয়েকে দেওয়ার। তিনি এত কিছু ভাবেননি, মেয়ে কার সাথে থাকবে, জীবনসঙ্গী কেমন সেটাই বড় বিষয়। সেখানে এত দিক খোঁজাখুঁজি করে সময় নষ্ট করতে তিনি ইচ্ছুক নন।
“আমরাও আপনাদের ত্রুটি বিচ্যুতি এখন দেখতে যাচ্ছি না। আর বিয়েই তো সব না, দুজনের একে অপরকে বোঝা, জানা এসবও প্রয়োজন। তাই বলছিলাম!”
“কবে কোথায় দেখা করতে যেতে হবে?”
“আমাদের বাড়িতেই আসতে পারে। আমার ভাতিজি এখানে থাকবে তখন। ওদের দেখা সাক্ষাৎ হোক, দেখি কী কথা হয় দুজনের মধ্যে।”
“আপনি কেন দেখতে যাবেন?”
“আরে সেটা বলার জন্য বললাম। আমি দেখতে যাব কেন?”
এরপর একটা দিন নীরদ আর শর্বরীর দেখা করার জন্য ঠিক করা হলো। দুজনকে এই ব্যাপারে জানালেই দুজনের কারোরই তেমন আগ্রহ দেখা গেল না। প্রথমে যদিও বলা হলো রামিশা চৌধুরীর বাসায় দেখা করানো হবে। পরে আবার কী ভেবে তিনিই ঠিক করলেন, বাইরে কোথাও দেখা করতে দেওয়া হবে। একটা ফাইভ স্টারে তাদের এক সাথে ডিনারের জন্য টেবিল বুক করা হলো। সেই কাজটা করল সরোদ।
নির্দিষ্ট সেই দিনে শর্বরী আর নীরদ দুজনই সেখানে উপস্থিত হলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে সৃষ্টি হলো এক নতুন বিপত্তির।
#চলবে।