“এমনই এক দিনে” (পর্ব-১৫)
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
২৯.
গাড়ির বনেটের উপর বসে থাকতে থাকতে সরোদের বিরক্তি এসে গেছে। নীরদ যে কেন তাকেই সব জায়গায় টানে সে বোঝে না। গাড়ি কিনতে গেলেও সরোদকে ডাকো, ইভেন বউ দেখতে গেলেও সরোদকে চাই! মানে কী? আজ ছুটির দিন ছিল, সারাদিন বাড়িতে এই কাজে ওই কাজে কেটে গেছে, সন্ধ্যায় একটু রিল্যাক্স করে যে চা নাশতা করবে সেটাও হয়নি। নীরদকে নিয়ে ছুটতে হচ্ছে এদিক ওদিক। তবে আজ কেন যেন মনে হচ্ছে নীরদ অযথা তাকে ঘোরাচ্ছে। নানান দরকারের অযুহাতে যেখানে সেখানে গাড়ি থামিয়ে সময় নষ্ট করছে। সরোদের বুঝে আসছে না এত চিন্তার কী আছে? সোজা গিয়ে মেয়ে দেখবে, কথা বলবে, একটু খাওয়া দাওয়া করবে, এরপর ফেরার আগে নাম্বার নিবে, বাড়ি এসে কল করবে। দুদিন কথা বলবে আর তিন দিনের দিন তো বিয়েই। চাপ নেওয়ার কিছু তো দেখছে না সে। তার বিয়ে হলেও এমনই হবে নিশ্চয়ই। মনে মনে হাসল সে। অনুর কথা মনে পড়তেই তার মন ভালো হয়ে গেল। সরোদের এই বিয়ে নিয়ে একটা আফসোস আছেই, তার ইচ্ছে ছিল ভাইয়ের বিয়ে অনুর সেই বোনের সাথেই হওয়ার। অন্তত সেই সুবাদে অনুর সাথে তার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারত। মেয়েটাকে তার বড্ড পছন্দ হয়েছে। সমস্যা একটাই, কথায় কথায় কাঁদে বোধহয়। যাক গে, নরম মনের মানুষ তো! একটু কাঁদলে ক্ষ’তি নেই। বরং ভালো, এমন কারো সাথে সংসার করতে অন্যরকম আনন্দ পাওয়া যাবে।
“এই হাসছিস কেন?”
নীরদের আকস্মিক কথা বলায় সরোদ একটু বিব্রতবোধ করল। ভেবে লজ্জা পেল, এতক্ষণ কী যে ভাবছিল সে!
“তুমি না একটু আগেই ভেতরে গেলে? আবার এলে কেন?”
নীরদের ইচ্ছে করছে না কারো সাথে দেখা করতে। বিশেষ করে ওই মেয়েটির সাথে তো না। এতদিন সে ভাবত হয়তো বিয়ের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। তবে আজ এখানে এসে মনে হচ্ছে হয়তো টয়তো না, আসলেই ভুল ছিল। একদমই ভুল একটা সিদ্ধান্ত ছিল। এখন কীভাবে এর থেকে নিস্তার মেলে সেটাই সে ভাবছে। আরেকটা ব্যাপার হলো, এই বিয়ে না করতে চাওয়ার কারণটা সে স্বীকার করতে চাইছে না। তার মাথা থেকে কেউ একজন যাচ্ছেই না। নিজেকে আপ্রাণ বোঝানোর চেষ্টা করছে সে, একটা মানুষের কথা ভাবলেই কী সে ওই মানুষটাকে ভালোবাসবে নাকি? কিন্তু একটা মানুষকে এত বেশি ভাবে কে? দিন রাত, বলতে গেলে চেতনা থাকতে সবসময় ওই মেয়েটার কথাই তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। চিন্তায় চিন্তায় তার শরীরের কী হাল হয়েছে! বাড়িতে সবাই বকাবকি করছে কাজের চাপ কমানোর জন্য। আসলে এখানে যে কাজের চাপটা বড় চাপ নয় তা কাউকে বোঝানো তো দূরের কথা বলাও যাবে না। আজ সকালে সে ঘুম থেকে উঠেই কিছুক্ষণ ভাবে, মায়ের কথা শুনে সুরসুরিকেই বিয়ে করে নেওয়া উচিত ছিল তখন। ঠিক আছে, জেদি, ঘাড় ত্যাড়া মেয়ে! তবুও সে তো পারত বিয়ে করে এনে ত্যাড়ামো ছোটাতে। বরং তখন মেয়েটাকে কিছু দুষ্ট মিষ্টি সাজা দেওয়া যেত। সাজা গুলো ঠিক কেমন দেওয়া যেত সেটা ভাবতে গিয়ে নীরদ একটু হাসল। তাকে এমন হাসতে দেখে সরোদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কী ব্যাপার? মিটিমিটি হাসছ যে? ওহ্, ভাবির কথা ভাবছ!”
নীরদের হাসি গায়েব হয়ে গেল। না, অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে। এমন নোংরা মানসিকতার মানুষ তো সে নয়। একটা মেয়ের জীবন জড়িয়ে এর সাথে। সবকিছু নিয়ে ছেলেখেলা করা যায় না। তাছাড়া কীসের আশায়, কার আশায় সে অমন একটা সিদ্ধান্ত নিবে? ওই মেয়েটার তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক ছিল না। কমিটমেন্ট নামক ওই ব্যাপারটা ছিল না। তাহলে ঠিক কী কারণে এমন হঠকারিতা করবে সে? না, একটা মোহ সৃষ্টি হতেই পারে। সেটা সাময়িক। দ্রুতই কেটে যাবে। ভালোবাসা তো নয়, যে দিনের পর দিন বেড়েই যাবে!
“তুই চল আমার সাথে।”
“আমি? আমি কেন?”
“চল, তুই অন্য একটা টেবিলে বসে থাকবি। কিছু করা লাগবে না। চুপচাপ খাওয়া দাওয়া করবি শুধু।”
“আর তোমাদের দেখব?”
“অবশ্যই না। তাকাবি না একদম।”
“আচ্ছা। ঠিক আছে তাকাবো না।”
ভেতরে এসে নীরদ আবারো কেমন অসহায় বোধ করতে লাগল। অগত্যা সরোদকে বলল সে যেন গিয়ে আগে মেয়ের সাথে কথা বলে। নীরদের কথা শুনে অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে সরোদ বলল,
“আমি? তুমি আমাকে এজন্য এনেছ? মাথা খারাপ! পাত্রী তোমার তুমি যাও।”
“যেটা বলছি সেটা কর।”
“পারব না।”
“সত্যিই পারবি না?”
“না।”
“বেশ, কারো দেখা করতে হবে না আমিও চলে যাচ্ছি।”
“এটা ঠিক না। তোমাকে দেখা করতে হবে।”
“আমি তো বলিনি দেখা করব না। তুই আগে গিয়ে দেখ মেয়েটাকে। কথা বলতে হবে না শুধু দেখবি দূর থেকে।”
“একটু আগেই যে কথা বলতে বললে!”
“এখন বলছি তো, কথা বলা লাগবে না। দূর থেকে দেখবি শুধু।”
“সেটা তো তুমি নিজেই করতে পারো।”
“সরোদ প্লিজ!”
“ছেলে মানুষের এত শরম থাকলে হয়?”
নীরদ কীভাবে বোঝায় ব্যাপারটা ল’জ্জা নয় সংকোচ। তার মধ্যে একটা অ’প’রাধবোধে কাজ করছে। আচ্ছা? মেয়েটির কেমন লাগবে যখন সে জানতে পারবে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে নীরদ একবারও তার কথা ভাবেনি। তার নামটা পর্যন্ত জানতে চায়নি। নিশ্চয়ই তার খুব দুঃখ হবে যখন সে জানতে পারবে নীরদ তার ব্যাপারে এতটাই উদাসীন।
সরোদ হাসি মুখ করে সামনে এগিয়ে গেল। নির্ধারিত টেবিলের সামনে গিয়ে তার পায়ের নিচের মাটি সরে গেল। অনু? হ্যাঁ, সাদা সালোয়ার কামিজে বসে থাকা মেয়েটা অনুই তো! ভাই তবে অনুকে বিয়ে করছে? আশ্চর্য সেটা কীভাবে সম্ভব? না না, অসম্ভব বলেও তো কিছু মনে হচ্ছে না। সরোদকে দেখে অনুও দাঁড়িয়ে পড়ল। তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আপার হবু বরের জায়গায় সরোদকে দেখে তার কেমন যেন লাগল। কষ্ট কষ্ট একটা অনুভূতি। লোকটা আপাকে বিয়ে করছে তবে ওই সব কী ছিল! অনুর দিকে কেন অমন করে তাকাতো? কেন মুঁচকি হাসত। প্রতি সাক্ষাতে লোকটার মুখে সে একটা হাসি দেখেছে, আজই এমন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে কী অনুকে দেখে সে বিরক্ত? হবেই তো স্বাভাবিক! অনু কত বোকা! লোকটা তাকে নয় আপাকে পছন্দ করেছে। বুঝতে এত দেরি কেন হলো? চোখ নাকি মনের কথা বলে, লোকটার চোখ দেখে তো কোনোদিন মনে হয়নি সেখানে আপার কোনো অস্তিত্ব আছে!
“তুমি? এখানে?”
“কোনো সমস্যা?”
সরোদ মাথা নাড়ে। তার মেজাজ বিগড়ে গেছে। অনুর সাহস কী করে হয় তাকে উপেক্ষা করে তার ভাইয়ের কাছে যাওয়ার!
“আমাকে দেখে বিরক্ত হয়েছ মনে হচ্ছে।”
“বিরক্ত হওয়ার কথা নয় কী! আপনাকে সবসময় দেখলেই আমার বিরক্ত লাগে।”
“সেটা এখন আমি ভালোই বুঝতে পারছি। তা, তোমার মত ছিল?”
“কীসের মত!”
“এই যে এই বিয়েটার!”
“আশ্চর্য, আমার মত থাকবে না কেন? তাছাড়া আমার মতের কথা আসছে কেন?”
“না, এমনিতেই।”
“আপনি সবকিছু এমনিতেই করেন বোধহয়।”
অনুর চোখে কিছু একটা ছিল। সরোদের ভালো লাগছিল না সেখানে দাঁড়াতে। নীরদকে কিছু না বলেই সেখান থেকে চলে গেল।
অন্যদিকে অনুরও আর সেখানে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছিল না। কাঁপা কাঁপা হাতে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ওঁ শর্বরীকে কল করল। বলল,
“তোর বর খুব আয়োজন করে এসেছিল রে। আমায় দেখে বোধহয় রাগ করেছে। তাই চলে গেছে।”
“চলে গেছে?”
“হুঁ।”
“যাক, ভালোই হলো। আমার না একদমই দেখা করতে ইচ্ছে করছিল না। তুই ওখানে বসে থাক, আমি আসছি।”
লেডিস ওয়াশ রুম থেকে বের হতেই শর্বরীর দেখা হলো নীরদের সাথে। সেও জেন্টস ওয়াশ রুমের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। দুজনেই একে অপরকে দেখে স্থির দাঁড়িয়ে পড়ল। শর্বরী একটা ম্যাজেন্টা রঙের শাড়ি পরে আছে। তাকে দেখতে চমৎকার লাগছে, নীরদ তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তাতেই শর্বরীর হাত পা অসাড় হয়ে এলো। মনে মনে ভাবতে লাগল, এই লোকটা কেন তার পিছু ছাড়ছে না? তাদের কেন এতবার অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দেখা হয়ে যাচ্ছে। তাও বারবার ভুল সময়ে? কী হতো একটু সঠিক সময়ে দেখা হলে? সেদিন দেখাটা হেডলাইট না ভেঙে অন্যভাবে হলে হতো না! শুরুটা একটু সুন্দর হতে কী পারত না! শর্বরীর চোখ ভিজে আসছে। নীরদের সাথে দেখা হওয়ার না বরং নীরদের সাথে ভুল সময়ে দেখা হওয়ার আফসোস বোধহয় তার আজন্ম থেকে যাবে।
৩০.
নীরদ আর শর্বরীর বিয়ের আয়োজনে কোনো ত্রুটি হয়নি। প্রত্যেকটা প্রোগ্রাম ভালোই কাটে। বিশেষ করে শর্বরীদের বাড়িতে। তাদের বাড়ির সবাই ছিল আনন্দে, শোরগোলের মধ্যে। নীরদদের বাড়ির পরিবেশ তুলনামূলক ঠাণ্ডা ছিল। নীরদের মা তো শুরু থেকেই নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন, নীরদও তেমন আগ্রহ দেখায় নি কখনো কোনো কিছুতে, সেই সঙ্গে সরোদও যোগ দেয়। বিয়ে নিয়ে প্রথমে তার ব্যাপক প্রস্তুতি ছিল, কিন্তু যত দিন ঘনিয়ে আসে ততোই সে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। বিয়ের দিনও এদিক ওদিক ঘুরঘুর করেছে, এক জায়গায় স্থির হয়ে বসেনি। তার একদমই ইচ্ছে করছিল না।
বর কনের ফটোসেশন আছে, তাদের বাইরে যেতে হবে। সেখানে ছবি তোলার জন্য বিশেষ ভাবে সাজানো হয়েছে। আজকালকার বিয়েতে ধরাধরি করে ছবি তোলার পক্ষে নেই রামিশা চৌধুরী। তিনি বললেন সম্ভব না। এরপর সবার অনুরোধে বললেন, আগে বিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে তারপর তাদের যা ইচ্ছে হয় তারা যেন করে। সে কথা মতো, বিয়ে পড়ানো হয়।
কবুল বলার আগে শর্বরীর সব ছেড়েছুড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। এরপর তো বরের নাম শুনে তার হু হু করে কান্নাই চলে এলো। আশহাব শারাফাত! নীরদের নামও আশহাব ছিল। ডক্টর রোকসানা সবসময় তাকে ডক্টর আশহাব বলে ডাকতেন।
নীরদেরও তেমন অবস্থা হলো, সবার মুখে শর্বরী শর্বরী শুনে তার মনে পড়ল ওই মেয়েটার নাম শর্বরী ছিল, যেটা সে বারবার ভুলে যেত। যদিও সাইন করার সময় স্পষ্ট দেখেছে আজমেরী সেহেনাত।
বাইরে গিয়ে ফটোসেশন করা শেষে আর হয়নি। নীরদ শর্বরী কেউই রাজি হলো না। তাতে অবশ্য রামিশা চৌধুরী বেশি খুশি হলেন। তবে রিমা বেশ জোর করল তাদের একসাথে অন্তত দুটো ছবি তোলার। তার এক কথা, আজ না হলেও কয়েক বছর পরে আফসোস হবেই।
শর্বরীকে যখন ভেতর থেকে নিয়ে আনা হলো নীরদ তখন বন্ধুদের সাথেই বসে ছিল। শোরগোল পড়ে যাওয়ায় পেছন ফিরে তাকাতেই নিজ বিবাহিতা স্ত্রীকে দেখে সে কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সরোদও। শর্বরীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অনুকে দেখে মুহূর্তের মধ্যেই সে বুঝে ফেলে সেদিন কী বড় ভুলটাই না করেছে সে! অনুরও একই অবস্থা। সরোদের পাশে নতুন বরের পোশাকে দাঁড়িয়ে থাকা নীরদকে দেখে সেও তব্দা খেয়ে গেল।
শর্বরীর মাথা ঘুরছে। একটু পরেই তাকে একটা অচেনা অজানা লোকের সাথে চলে যেতে হবে। সারাজীবনের জন্য! সে যেতে চায় না। কখনোই চায় না। তার ইচ্ছে করছে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে এই বিয়ে সে চায় না। একদম স্টেজে ওঠার সময় সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতে নিলেই সবাই ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে গেল। এরপর শর্বরীর আর দেখা করা হয়নি তার নতুন বরের সাথে। যখন দেখা হলো তখন সে বিছানায় শুয়ে আছে। তার নিজের ঘরের। পাশেই একটা চেয়ার টেনে নীরদ বসে ছিল। শর্বরী তাকে দেখে নড়েচড়ে উঠতেই নীরদ ধ”ম”কে উঠল,
“বেশি নড়াচড়া করলে ঠা’স করে একটা থা’প্প’র মা’র’ব। বে’য়া’দব মেয়ে, স্যালাইন দেওয়া হয়েছে দেখছ না?”
#চলবে।