“এমনই এক দিনে” (পর্ব-১৬)
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
(প্রতিটা লাইন একটু মন দিয়ে পড়বেন যেন কোনো কনফিউশন না থাকে।)
৩১.
বাইরে পাতা একটা বেঞ্চে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে সরোদ। সেই কখন থেকেই এখানে বসে ফুরফুরে মেজাজে একের পর এক চা খাচ্ছে, এ নিয়ে তিন কাপ চা খাওয়া হয়েছে তার। মাজেদের মা চতুর্থ বারের মতো চা নিয়ে এসে কটমট করে তাকালো তার দিকে। সরোদ হেসে উনার হাত থেকে চার নাম্বার কাপটা নেওয়ার সময় কিঞ্চিৎ হাসে। থমথমে মুখে চায়ের কাপ গুলো ট্রে তে নিয়ে মাজেদের মা চলে আসার সময় দরজার কাছে অনুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গজগজ করতে করতে বললেন,
“আমার এত কালের জীবনে আমি এমুন চা খাওইন্না দেখি নাই। চল্লিশ মিনিডে চাইরবার হেয় চা খুঁজছে। কাপ আনতে গেলেই কয় আরেক কাপ পিলিজ। হের পিলিজের গু’ষ্টি মা’রি। আমি এই আমার রুমে গিয়া শুইলাম। আর আসমু না। আপনে থাকেন, আপনেগো মেহমান, আমার কী! আপনেরাই হেরে যতন করেন।”
অনুর রাগ হলো, এভাবে বলার কী আছে? একটু চা-ই তো চেয়েছে! থাক, এরপর আবার চাইলে সে নিজেই বানিয়ে দিবে। মাজেদের মা চলে যেতেই সেখানেই বসে পড়ল ওঁ। বলা তো যায় না, কখন না আবার লোকটা চা চেয়ে বসে!
চায়ের কাপে চুমুক দিতেই সরোদের ফোনটা বেজে উঠল। রেবেকা সুলতানা কল করেছেন। রিসিভ করতেই বাজখাঁই গলায় বললেন,
“এই এই তোরা সব থাকিস কোথায় বল তো?”
“ভাইয়ার শ্বশুর বাড়িতে।”
“একদম মশকরা করবি না, সঠিক কথার সঠিক জবাব দে!”
“ঠিকই তো বলেছি।”
“নীরদের বউয়ের খবর কী?”
“ভালোই তো।”
“ভালো কীভাবে! তোর মা তখন বাড়ি এসে বলল, স্যালাইন দেওয়া হয়েছে।”
“ওহ্, সেটা তোমার ডাক্তার ছেলে বেশি বেশি করেছে। তার বউ দুর্বল এজন্য।”
“তোরা আজ সেখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিস নাকি?”
“না, শুনলাম ভাবির জ্ঞান ফিরেছে। আমি আর ভাইয়া চলে আসব একটু পর।”
রেবেকা সুলতানা কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে বললেন, “বউ কেমন হয়েছে দেখেছিস?”
“ভাবি? ভাবি তো খুব সুন্দর। আফটার অল তোমার পছন্দ।”
“আমার পছন্দ মানে? মজা নিচ্ছিস ভাইয়ের সাথে মিলে? তুই বুঝি জানিস না এই বিয়েতে আমার মত ছিল না!”
“জানি, জানি। ভাইয়া আমাদের ঘোল খাইয়েছে বুঝলে। নাটক করেছে, ছোটটাকে না বড়টাকেই বিয়ে করেছে।”
“মানে?”
“আরে, তুমিও বোধহয় আমার মতো ভুল করেছ। আমিও প্রথমে ভুল ভেবেছিলাম। অনু না ভাইয়া শর্বরী ভাবিকে বিয়ে করেছে।”
“ওমা! কীভাবে? শর্বরীর তো অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক। আর নীরদের বউয়ের নাম তো, সেহেনাত।”
“ভাবির নামই, আজমেরী সেহেনাত। বাড়িতে শর্বরী ডাকে আর কী।”
রেবেকা সুলতানার মাথা ঘোরাতে লাগল। একটু আগেই সরোদের মা এসেছিল বিয়ের গল্প করতে। তিনি শুনতে চাননি। ছবিও দেখেননি। সরোদের সাথে কথা শেষ করেই তিনি ছুটলেন ছোট জা এর ঘরে। নতুন বউয়ের ছবি দেখতে হবে তো! সরোদ মজা করছে কি না সেটাও তো দেখতে হবে!
নীরদের বিয়ে নিয়ে বরাবরই তার শখ আহ্লাদ কম ছিল না। বরং সবকিছু নিয়েই বেশি বেশি করতেন। খুব আশা করেছিলেন তার পছন্দ করা মেয়েটিকেই ঘরের বউ করে আনবেন। নীরদ যখন না বলল, তখন তিনি কিছু দিন ভেবে ঠিক করলেন সরোদের জন্যই না হয় আনবেন। সে পরিকল্পনা মতো শর্বরীদের বাড়িতেও গিয়েছিলেন। আর তখনই জানতে পারেন শর্বরীর বিয়ে ঠিক অন্যত্র। এরমধ্যে ছেলেও অন্য জায়গায় বিয়ে করতে হ্যাঁ করে দিয়েছে। অহেতুক কারণে পছন্দের পাত্রী হাতছাড়া হওয়া, নীরদের ব্যবহার সবকিছুতে রেগে গিয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ছেলের যা খুশি তা-ই করুক। তিনি তার ব্যাপারে আর নাক গলাতে যাবেন না। দিনের পর দিন মা ছেলের মধ্যকার স্নায়ু যু’দ্ধ চলতে লাগল। দেখা গেল, যে বিয়ে নিয়ে এত এত আয়োজন করার শখ ছিল সেই বিয়েতে তার সরব অংশগ্রহণই ছিল না। রাগ পড়ে যেত আরো আগেই, ছেলেটা একটু এসে যদি ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে মাকে মানিয়ে নিতো। তিনি শুধু ছেলেকেই দেখেছেন, যার কি না কোনো হেলদোল ছিল না। মা যে রাগ করে আছে সেটাও ভাঙাতে আসেনি। অপদার্থ একটা ছেলে! তার এতটুকু বোধ বুদ্ধি কী হয়নি? তার মা কী একটা মেয়ের জন্য নিজের ছেলেকে ফেলে দিতেন?
বিয়ে উপলক্ষে দুই পরিবারের মধ্যে বেশ কয়েকবার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। এরমধ্যে যার অধিকাংশই হয় শর্বরীদের বাড়িতে নয় বাইরে কোথাও। বিয়ের কেনাকাটা করতে সরোদের মা আর বোন যায় তাদের বাড়ি থেকে। রেবেকা সুলতানা দূরেই থেকেছেন, ছেলেটাও একবারও এসে বলেনি, “মা যাও না! এত রাগ করে কী হবে?” তবে তিনি তো মা, ছেলের মনের অবস্থা একেবারে ধরতে না পারলেও কিছুটা ধরতে পেরেছিলেন। পারিপার্শ্বিক সব কিছুতে এত অমনোযোগী, উদাসীন হতে ছেলেকে আর কখনো দেখেননি তিনি। হ্যাঁ, নীরদ যদিও বরাবরই একটু গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করে নিজেকে কিন্তু এতটা অপ্রকৃতিস্থ আচরণ, খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম, ঘুমের অনিয়ম, ওঁর চোখের নিচে কালো দাগ এসব কেমন নতুন ঠেকল উনার কাছে। প্রচণ্ড রকমের স্বাস্থ্য সচেতন ছেলেকে এমন অবস্থায় দেখে তিনি নিজেও বুঝতে পারছিলেন না ঠিক কী করবেন। বারবার বলেও বিশেষ লাভ হতো না, ছেলেটা নিজের দিকে একটু খেয়ালই করেনি। এই যে আজ বিয়ে করতে গেল, তখন কেমন যেন লাগছিল তাকে। মনে হচ্ছিল সে খুশি ছিল না একদমই, আনন্দে তো নয়ই, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল সব কিছুতেই ভীষণ অনীহা তার। তিনি অবশ্য তখন এত গুরুত্ব দেননি। নিজ মনকে অনবরত বোঝাতে থাকেন খুশি থাকবে না কেন? সে তো নিজের পছন্দে বিয়ে করছে।
৩২.
শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কামরায় শর্বরী ঘামছে। পিঠ একদম ভিজে গেছে। চিটচিটে শরীরে ভারি লেহেঙ্গা পরে থাকতে আর পারছে না সে। উঠে গিয়ে যে সব বদলে নিবে তাও সম্ভব হচ্ছে না। নীরদ সামনেই বসা। এক মনে শর্বরীর টেবিলের উপর থাকা একটা বই পড়ছে। আদৌ পড়ছে কি না তা ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। শর্বরীর কেন যেন মনে হচ্ছে চশমার আড়ালে চোখ দুটো তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নীরদকে সচরাচর চশমা পরতে সে দেখেনি। এ নিয়ে বোধহয় দুইবার দেখা হয়েছে। চশমাতে তাকে ভিন্ন একজন মনে হয়। একদম অচেনা কেউ! অথচ লোকটা মোটেও অচেনা নয়। বহুদিনের পরিচয়, তার চেয়ে বড় কথা এখনকার পরিচয়, লোকটা ওঁর স্বামী। বিবাহিত ওঁরা দুজন। অদ্ভুত না? শর্বরীর কাছে এখনও বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না।
বিয়ের আগে, তাকে ঠিক কতবার বলা হয়েছিল হবু বরের ছবি দেখতে। রিমা আর অনু তো ফেসবুকেও অ্যাড হয়ে কথা বলতে বলেছিল। ওঁ শোনেনি। ইচ্ছেই করেনি কখনো। কোনো আগ্রহ জন্মায়নি। একদিন অনেক খুঁজে রিমা লোকটার ফেসবুক আইডি বের করল। তবে কোনো প্রোফাইল পিকচার না থাকায় আ্যাড হয়নি। এমনিতে ওঁর ধারণা ওটাই তাদের হবু দুলাভাইয়ের আইডি ছিল। শর্বরী সেদিন একটু ঢু মেরে দেখেওনি। দেখলে হয়তো তখনই বুঝতে পারত, কারণ নিক নেম নীরদ দেওয়াই ছিল। অনু আর রিমা নীরদকে চেনে না, নাম জানা তো দূরের কথা। কখনো তো মুখোমুখি হয়নি, ওই একদম প্রথম সাক্ষাতে শর্বরী দেখলেও তাদের দুজনেরই তেমন সুযোগ হয়ে ওঠেনি দেখার। দৌড়ের উপর ছিল সবাই। তাছাড়া শর্বরী কখনো নীরদের ব্যাপারে কিছু বলেনি তাদের। তাই জানবেই বা কী করে? তবে এরপর ছবিতে দেখেছে। তাসরিফ দেখিয়েছে। তাসরিফ আবার কখনো নীরদের নাম নিতো না, ঠাট্টা করে নিজেও বলত দুলাভাই। আর বাড়িতে সবাই আশরাফ বলত। আজ অবশ্য এটা নিয়ে এক দফা হাসাহাসি হয়েছে। ছোট চাচা প্রথমদিন আশহাব শুনতে ভুল করেছিলেন। তাই আশরাফ বলতেন। বাড়ির সবাইও সেই থেকে তার কথা উঠলেই আশরাফ বলে সম্বোধন করত। শর্বরী তো এটাই জানত কোনো এক আশরাফের সাথেই তার বিয়ে হতে যাচ্ছে।
শর্বরীকে বারণ করার পরও নড়চড় করতে দেখে নীরদের রাগ হলো। টেবিলে বইটা রেখে, চোখ থেকে চশমাটা খুলে উঠে গিয়ে ওঁর সামনে দাঁড়ালো। এবার নীরদকে এভাবে শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শর্বরী সত্যিই ভ’য় পেল।
“বারণ করেছিলাম তোমায়!”
শর্বরী অসহায় চোখে তাকালো, “এভাবে বসে থাকতে সত্যিই খারাপ লাগছে। খুব অস্বস্তি হচ্ছে, চেঞ্জ করতে হবে।”
নীরদ দেখল স্যালাইন শেষ হয়ে এসেছে। শর্বরীর অবস্থাও এখন স্থিতিশীল পর্যায়ে, এবার ক্যানোলা খুলে দেওয়াই যায়। সে এতক্ষণ এজন্যই অপেক্ষা করছিল। অভিজ্ঞ কারো হাতেই এই কাজ করতে হতো। এখানে সে ছাড়া আর তেমন কেউই নেই। তাছাড়া থাকলেও বা কী? করতে দিলেই তো! ভুলেও দিত না। নীরদ হাসল। তাকে হাসতে দেখে শর্বরী ঘাবড়ে গেল। এই প্রথম ক্যানোলা লাগানো হয়েছে তার, এর আগে রিমাকে দেখেছে, এটাতে খুব ব্যথা হয় একদম ছটফট করে। শর্বরী দূরে সরে বসল। নীরদ যদি ইচ্ছে করে আরো ব্যথা দেয়?
“দরকার নেই, খোলার দরকার নেই।”
নীরদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। শর্বরী একটা ঢোক গিলে বলল, “ব্যথা দিবেন আমি জানি।”
“আমি কেন ব্যথা দেব? এটা তো নরমাল, একটু লাগবেই।”
“আপনাকে আমার ভরসা নেই। আপনি ইচ্ছে করে বেশি ব্যথা দিতে পারেন।”
“একদম ফালতু কথা বলবে না। বে’য়া’দব মেয়ে। যেখানে আমি চেষ্টা করছি রা’গ সামলে ঠাণ্ডা হয়ে কথা বলার জন্য সেখানে তিনি কি না বারবার আমার রা’গ বাড়িয়ে দিচ্ছেন।”
নীরদ ওঁর হাতটা ধরে পাশে বসল। শর্বরী হাত সরিয়ে নিয়ে আরেকটু সিঁটিয়ে বসল। নীরদ এবার আর কিছু বলল না। শুধু ওঁর চোখের দিকে তাকালো। এতেই কাজ হলো। সে নিজে থেকেই আবার কাছে এসে বসে হাতটা বাড়িয়ে দেয় নীরদের দিকে।
নীরদের খুব সাবধানে কাজ করার পরেও অনেকটাই ব্যথা পেল শর্বরী। এতে নীরদ কিংবা ক্যানোলা কারোরই দো’ষ নেই। দুই তিন দিন থাকলে নাহয় ব্যথা হতো খুব কিন্তু এটা বেশিক্ষণ হয়নি লাগিয়েছে এরমধ্যে এত ব্যথা হওয়ার কথা নয়। শর্বরীর অতিরিক্ত নড়াচড়া করার কারণেই সে ব্যথাটা বেশি পেয়েছে। সব কিছু ঠিকঠাক করে, নীরদ বলল,
“এবার তোমার যা ইচ্ছে হয় করো। আমি যাচ্ছি।”
শর্বরী উতলা হয়ে বলল, “কোথায় যাবেন আপনি?”
আকস্মিক এমন আচরণে নীরদ একটু চমকে গেল। ধরেই কিছু বলতে পারল না। একটু সময় নিয়ে বলল,
“বাড়িতে যাব।”
শর্বরী কিছু বলল না। কিন্তু তার মনটা খচখচ করতে লাগল। একাই যাবে? তাকে নেবে না? নীরদ বোধহয় বুঝল ব্যাপারটা। নিজের ফোনটা টেবিল থেকে নিয়ে পকেটে ঢোকানোর সময় বলল,
“তুমি চিন্তা করো না, কালই তোমায় নিয়ে যাব। অসুস্থতার ছলে ভালোই ফাঁকি দিয়েছ। ডিউটি মিস করেছ। আমি অবশ্য ছাড় দেব না। সময় মতো সবটা উসুল করে নিব।”
“মানে? কী করবেন আপনি?”
“তেমন কিছুই না। বাসায় ফিরে গিয়ে প্রথমে তো ছুটা বুয়া বাদ দিয়ে দেব, ওয়াশিং মেশিনটাও বুয়াকে গিফট করে দিব, ডিশ ওয়াশার এর ও প্রয়োজন নেই। সব মিলিয়ে দুজন মানুষেরই তো কাজ। কী আর বেশি বলো! এই তো শুধু ঘর মোছা, কাপড় ধোয়া, আর ক’টা থালা বাসন মাজতে হবে। ওহ্, আরো কিছু আছে। সেটা নিয়ে পরে আলোচনা হবে।”
শর্বরীর রাগে চোখ ভিজে এলো, রাগ বেশি উঠলে কান্না এসে যায় কেন যেন বারবার। নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
“আপনি বিয়ে করতে চেয়েছেন কী কাজ করানোর জন্য না কি আমাকে বিয়ে করেছেন বলেই অমন খাটিয়ে মা’র’তে চাইছেন।”
“দুটোর জন্যই।”
“আমি যাব না।”
“বেশ তো, আমিও জোর করব না।”
শর্বরী অবাক চোখে নীরদের দিকে তাকিয়ে রইল। যাওয়ার আগে নীরদ কী মনে করে আবার সামনে এসে দাঁড়ায়। পকেট থেকে একটা ভাজ করে কাগজ বের করে সামনে ধরতেই শর্বরীর আপাদমস্তক কেঁপে উঠল। নীরদ ভাবুক মুখ করে বলল,
“এটা আমার চোখ না? তুমি এঁকেছ? যাক, অন্তত একটা গুণ তো তোমার মধ্যে আছে।”
#চলবে।