“এমনই এক দিনে” (পর্ব-১৭)
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৩৩.
একটা বড় খাট, খাটের অপর পাশেই বিশাল এক বুক শেল্ফ, একটা ড্রেসিং টেবিল, বই পড়ার টেবিল, বড় একটা আলমারি, আর কুশনযুক্ত একটা রকিং চেয়ার নিয়েই নীরদের ঘর। ছিমছাম সাদামাটা একটা ঘর, অতিরঞ্জিত কিছু নেই তবে প্রয়োজনীয় সবই আছে। ছোটবেলা থেকে বড়বেলা পর্যন্ত অর্জন করা সব ক্রেস্ট, ট্রফি নিয়ে একটা আলাদা কর্ণার আছে। সেখানে কিছু ছবি আছে, হাই স্কুলে পড়ুয়া হ্যাংলা পাতলা নীরদের দিকে তাকিয়ে শর্বরী ফিক করে হেসে ফেলল। অবশ্য যে কেউ দেখলেই হাসবে। অমন একটা শুকনা ছেলে কি না এখন মস্ত শরীরের এক মানুষ। তবে হ্যাঁ, বরাবরই দারুন হাইট ছিল তার। চেয়ে দেখার মতো।
শর্বরী বিছানায় বসে কিছুক্ষণ আরেকবার ঘরটায় চোখ বুলিয়ে নেয়। তার মনে হচ্ছে এখানে সবই আছে তবে প্রাণ নেই। নীরদ নীরদ গন্ধ নেই। কেমন যেন! নীরদ এখন আর এখানে থাকে না বলেই হয়তো। বালিশে মাথা রেখে শুতেই শর্বরীর রাগ হলো নীরদের উপর। লোকটা কোথায়? কাল রাতের পর আর দেখা হয়নি তাদের। দুপুরে নীরদ শর্বরীকে আনতে যেতে পারেনি। ইমার্জেন্সি পড়ে যায় হঠাৎ করেই। সবার সাথে সে না কি রওনা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু এখানে আসার আগ মুহূর্তে ওই খবর পেয়ে হসপিটালে চলে যায়। এখন রাত হয়ে এসেছে। এ বাড়িতে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। এসেই সবার মধ্যে বসে থাকতে হয়েছিল তাকে। নীরদের মা কয়েক দফা আহ্লাদ করলেন ওকে নিয়ে। শর্বরীর অস্বস্তি হচ্ছিল। সরোদ না থাকলে হয়তো আরো কিছু সময় সেখানেই বসে থাকতে হতো। এই ঘরে আসতেই সরোদের ছোট বোন সামিহা বলল,
“ভেবেছিলাম ফুল দিয়ে ঘরটা সাজাবো। কিন্তু ভাইয়া বারণ করেছে। ওঁ এসব একদমই পছন্দ করে না। ওঁকে আমরা খুব ভয় পাই তো, তাই আর ওঁর কথার অবাধ্য হইনি। তবে আমাদের তোমার জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে ভাবি। আমরা কত করে বলেছি ভাইয়াকে। মানলোই না।”
শর্বরীর চাপা রাগ হলো। লোকটা নিজের ইচ্ছেকেই গুরুত্ব দিল শুধু। শর্বরীর জন্য তো দিনটা স্পেশাল, এমন দিনে কী একটু কম্প্রোমাইজ করা যেত না? পরক্ষণেই তার মনে হলো, কেন? কেন করবে কম্প্রোমাইজ? শর্বরীর দিক থেকে হয়তো দুর্ভাগ্যক্রমে একটা অনুভূতি তৈরি হয়েছে, নীরদের প্রতি আগ্রহ জন্মেছে। নীরদের তো আর তেমন কিছু হয়নি। হবেই বা কেন? নীরদ নিশ্চয়ই তাকে পছন্দ করে না। কিন্তু অপছন্দ করে থাকলে বিয়ে করল কেন? নীরদ কী জানত না? ওটা শর্বরী ছিল!
নীরদের ফিরতে একটু বেশিই রাত হলো। এসে বিছানায় শুয়ে থাকা শর্বরীকে দেখে সে আনমনে হাসল। আশ্চর্য! মেয়েটা এখন এখানে, তার ঘরে, তারই বিছানায়। দুদিন আগেও এখানে তাকে কেবল কল্পনাতেই ভাবা যেত। বাস্তবেও যে এমনটা হবে সেটা মনেই হয়নি। নীরদ খুব সাবধানে শর্বরীর কাছে গিয়ে বসল। আলতো করে ছুঁয়ে দিল শর্বরীর নরম গাল। শর্বরী নড়ে উঠতেই তার হুঁশ ফিরে। এটুকুতেই সে দিকবিদিক শূন্য হয়ে পড়ে। হাত সরিয়ে নেয়, উঠে যেতে নিবে তখনই তার অন্য হাত শর্বরী আঁকড়ে ধরে। নীরদ তাকাতেই শর্বরী ঘুম জড়ানো গলায় বলল,
“কখন এসেছেন?”
নীরদ সাথে সাথেই উত্তর দিল না। এমন একটা প্রশ্নে ভেতরে ভেতরে যে সে পুলকিত হয়নি তা বলা যায় না। মেয়েটার সামনে এলে কেন যেন নরম হতে ইচ্ছে করে না। শর্বরী কোনো এক কারণে তাকে ভ’য় পায় তা সে জানে। এ নিয়ে তার এখন আর মাথা ব্যথা নেই। মেয়েটার ভ’য়ের উপর ভ’য় তৈরি করতে পারলেই এখন বোধহয় সে সার্থক হয়। শর্বরীর থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে পরনের হাতঘড়ি খুলতে খুলতে গম্ভীর গলায় সে বলল,
“এসেছি আগেই।”
“ডাকলেন না যে?”
নীরদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। শর্বরী লজ্জা পেয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল,
“এমনিতেই বললাম। ওভাবে তাকানোর কোনো প্রয়োজন নেই।”
নীরদ কিছু বলল না আর। খানিক মৃদু হেসে আলমারি খুলে নিজের টি শার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ে।
নীরদ রাতের খাবার খায়নি, সামিহা খেতে যাওয়ার জন্য ডাকতেই শর্বরী নড়েচড়ে বসল। একবার ভাবল বলবে, “তোমরা গিয়ে ঘুমাও, উনার জন্য আমি আছি তো। আমিই দেখব।”
সব কিছু কী এতই সোজা না কি? শর্বরী ওই কথা কখনো বলতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, কেউ বললে নীরদের জন্য খাবার পরিবেশন করতে তার আপত্তি নেই। ভাবনার বিষয় একটাই সেই সুযোগটা তো পেতে হবে।
“ভাবি নিচে আসবে? আমরা উনো খেলছি। আমাদের জয়েন করতে পারো।”
শর্বরী মাথা নেড়ে ওঁর সাথে সেখান থেকে চলে এলো। খেলতে খেলতে একসময় কিছু হাউজ রুলের কারণে কথা কাটাকাটি হতে থাকল। সবাই যখন তর্কবিতর্কের মধ্যে ব্যস্ত তখন সেখানে নীরদ এলো। এসব খেলা তার অপছন্দ। দেখলেই বিরক্ত হয়। তবে আজ ছোট ভাই বোনদের সাথে তার প্রিয় রমণীর এমন উচ্ছাসে মত্ত রূপে মুগ্ধ হয়ে সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তা উপভোগ করল।
“ভাইয়া খেলবে?”
রাতুল হুট করে ডেকে উঠল। সবার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল নীরদের উপর। এতে সে ভীষণ বিরক্ত হয়। কেমন একটা ধরা পড়া চো’রের মতো অনুভূতি হয়, তাই আর সেখানে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না। ওদের দিকে না তাকিয়েই থমথমে গলায় “না” বলে সেখান থেকে চলে এলো। তাকে ওভাবে চলে যেতে দেখে শর্বরীর একটু মন খারাপ হলো। লোকটা এমন অদ্ভুত আচরণ বরাবরই করে। তবে আজ এত বেশি খারাপ লাগছে কেন?
৩৪.
রিসেপশনের দিনও শর্বরীর ভালো কাটল না। এত কাছে নীরদ তবুও যেন কাছে নেই। আগের দিন রাতে শর্বরী রাগ করে সামিহার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে। নীরদ একটু খোঁজ ও নেয় না তার নতুন বউয়ের। অথচ সকাল হতেই নীরদের দাদী এ নিয়ে বেশ কথা শুনিয়ে দেয় তাকে। প্রথম রাতেই স্বামী স্ত্রী ঠিক কী কারণে আলাদা ঘুমিয়েছে তা নিয়েই তিনি একের পর এক প্রশ্ন বাণে জর্জরিত করছিলেন তাকে। শর্বরী কিছু বলতে পারেনি। তার কাছে কিছুই ভালো লাগছিল না। এই বিয়ে ব্যাপারটা কেমন যেন! একদমই ভালো অনুভূতি হচ্ছে না তার। বরং নীরদের প্রতি জন্মানো প্রিয় অনুভূতি গুলোও ধীরে ধীরে অপ্রিয় হয়ে উঠছে। না, এটা তার একার দায়িত্ব নয়। দুটো মানুষকে নিয়েই একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে, দুজনেরই সমান ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। নীরদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে না সে আগ্রহী। অতএব শর্বরীর ও দায়বদ্ধতা নেই। নীরদ দূরে সরে থাকতে পারলে সেও পারবে। অসম্ভব কিছু তো নয়!
সেদিন রাতেই নীরদের ফ্ল্যাটে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। সেখানে আসার পর শর্বরী আবারো কেমন দুর্বল হয়ে পড়ে। এই বাসায় এসে তার প্রথমেই যেটা মনে হলো, এখানে প্রাণ আছে। নীরদ নীরদ একটা গন্ধ আছে। বিশেষ করে গৃহপ্রেবেশের সময় নীরদ যখন বলল,
“ওটা ছিল তোমার শ্বশুর বাড়ি। আর এটা তোমার স্বামীর ঘর, তোমার নিজের ঘর। তোমার ঘরে তুমি যা ইচ্ছে হয় করবে, তাতে আমি অধম কিছু বলার সাহস রাখি না।”
তখনই সে বুঝতে পারল। সংসার জীবনের ভার নেওয়ার সময়ে এসে পড়েছে সে। এখন একজন মানুষের সাথে সাথে একটা গোটা সংসারও সামলাতে হবে তাকে। যদিও কীভাবে কী করবে তার ঠিক বুঝ নেই ওঁর কাছে। সুযোগ পেয়ে নীরদকে প্রথমেই ও যে প্রশ্ন করল তা ছিল,
“আপনি কাজের লোক বাদ দিয়ে দেবেন সত্যি?”
“হুঁ। মিথ্যে মিথ্যে বাদ দেওয়া যায় না কি?”
“আপনি আমাকে দিয়ে সব কাজ করাতে চান?”
“হ্যাঁ, চাইব না কেন?”
“আপনি সত্যিই চান আমি কাজ করি।”
“কাজ না করে বসে থাকলে কত অসুখ বিসুখে পড়বে। কাজ করলে শরীর মন দুটোই ভালো থাকে।”
“আমি যদি বলি করব না তবে কী করবেন?”
“অন্য সবাই যা করে তাই করব।”
শর্বরী কোমল চোখে তাকিয়ে বলল, “অন্য সবার মতো আপনিও বউ পে’টাবেন?”
নীরদ হাসল। শর্বরীকে টেনে এনে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে বলল,
“অন্যরা এমন করে?”
“হুঁ, এমনই করে।”
“তোমার মনে হয় আমি তেমন কিছু করব?”
শর্বরী নীরদের এত কাছে এসে ঘাবড়ে যায়। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “করতেও পারেন। আপনাকে বিশ্বাস নেই।”
নীরদ শর্বরীর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল, “বিশ্বাস নেই এই কথাটা বলার আগে দু বার কেন ভাবলে না সুরসুরি?”
শর্বরী চকিতে নীরদের দিকে তাকালো। লোকটা হাসছে, এই প্রথম এভাবে হাসছে। শর্বরী খেয়াল করল ওঁর ভ’য় লাগছে। এবার আর শুধু নীরদের চোখেই নয় হাসিতেও ভ’য় পাচ্ছে।
#চলবে।