এমনই এক দিনে পর্ব-১৮ এবং শেষ পর্ব

0
2

“এমনই এক দিনে” (পর্ব-১৮)
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৩৫.
একটা সংসার সামলানো চারটি খানি কথা নয়, মা সবসময় বলতেন। শর্বরী তখন তেমন একটা গায়ে মাখতো না এই কথাটা। মা বরাবরই বেশি বেশি বলেন বলে তার মনে হতো। মা যখন তর্কে হেরে যেতেন তখন বলতেন,

“যেদিন তোর নিজের সংসার হবে সেদিন বুঝবি, মা কথা গুলো শুধু বলার জন্য বলতো না।”

শর্বরী হাসতো। খিলখিল করে হাসতো। অথচ আজ কান্না পাচ্ছে তার। নীরদ যদিও কথা মতো বুয়াকে বাদ দেয়নি। বুয়াও আছে, ওয়াশিং মেশিন, ডিশ ওয়াশার সবই আছে। তার করার মতো কাজও নেই তেমন। তবুও একটা চাপ থাকে সবসময়। বুয়া তার পরামর্শ ছাড়া নিজে থেকে কিছু করে না। বুয়াকে গাইড করতে সেও তেমন একটা পারে না। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়, বুয়া এতদিন কীভাবে কী করত? এতদিন শর্বরী ছিল না তিনি কাজ তো করে গেছেন। যে কোনো কিছু করতে নিলে অনুমতি চায়, যদিও শর্বরী সন্তুষ্ট বুয়ার উপর। তিনি মাজেদের মায়ের মতো না। মাজেদের মা থাকলে এই সুযোগে শর্বরীকে দিয়েই কাজ করিয়ে নিতেন। শর্বরীর কাজ করতে আপত্তি নেই। তবে কী থেকে কী করবে এটা ভেবেই সময় পার করে ফেলে। ঘর সাজাতে গেলেও ভ’য় হয় এই না নীরদের দরকারি কিছু সরিয়ে ফেলে। রান্না করতে গেলে আ’তঙ্কে থাকে এই না আবার ঝাল বেশি দিয়ে ফেলে, লবণ বেশি দিয়ে ফেলে। একদিন তো বেশি বেশি চিন্তা করতে গিয়ে রান্নাই করেনি। নীরদ এলো যখন তখনও সে বসে বসে ভাবছে কী রান্না করবে‌। সেদিন কী ল’জ্জাটাই না সে পেল! ল’জ্জায় বারবার চোখটা ভিজে আসছিল, তার থেকে বড় কথা নীরদ না খেয়ে থাকবে এটা ভেবেই তার খা’রাপ লাগছিল। নীরদের হাসি পেল এটুকু ব্যাপারে শর্বরীকে কাঁদতে দেখে। একটু পরেই ফ্রেশ হয়ে এসে সে নিজেই রান্না বসিয়ে দিল। তখন পুরোটা সময় শর্বরী তার পাশে দাঁড়িয়ে হেঁচকি তুলে কাঁদলো। খাবার পরিবেশন করে এসে নীরদ বলল,

“খেতে এসো। এত ঢং করার কী আছে? বললেই হতো আমার হাতের রান্না করা খাবার খেতে চাও। তুমি জানো না আমার মন বড়? একদিন তোমাকে রেঁধে খাওয়াতেই পারি। কেঁদো না, কাঁদলে সবাইকে যে ভালো লাগে তা কিন্তু না।”

শর্বরী খেতে বসেনি। নীরদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল চুপচাপ। কান্না থামলেও থমথমে মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। নীরদের খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত সেখান থেকে একদম নড়ল না। হাত মুখ ধুয়ে এসে তার শাড়ির আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে নীরদ বলল,

“তবে কাঁদলে তোমাকে আবার খুব বেশিই ভালো লাগে।”

শর্বরীর গাল লা’ল হয়ে এলো কথাটা শুনে। বিয়ের আগে তো এমন করতই, বিয়ের পর থেকে যেন আরো বেশিই জ্বা’লাতন করছে তাকে লোকটা। দুষ্টু মিষ্টি কিছু কথা তাদের মাঝে প্রতিদিন হয়। ঝগড়া হয় না। যেদিন নীরদ বলে সেদিন শর্বরী চুপ থাকে, যেদিন শর্বরী বলে সেদিন নীরদ চুপ থাকে। যেহেতু দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধা’ওয়া হয় না সেহেতু ঝগড়া শব্দটা এখানে নীরব।

তাদের বৈবাহিক জীবন আর পাঁচটা অ্যারেঞ্জ ম্যারেজের মতোই কাটছে। তবে এর বাইরেও কিছু একটা আছে। নীরদ আর শর্বরী দুজনই দুজনকে অনুভব করতে পারে। মুখে না বলা অনেক কথা এখন তারা একে অপরের চোখে তাকালেই বুঝতে পারে। নীরদের সামনে যেতে শর্বরী নিজেকে যথেষ্ট পরিপাটি রাখার চেষ্টা করে, যেটা করার কথা একসময় সে চিন্তাও করতে পারত না। আগের শর্বরী নীরদকে চোখের সামনে সহ্য করতে পারত না অথচ এখনকার শর্বরী দু দণ্ড ওকে না দেখলে উতলা হয়ে ওঠে। নীরদ ফিরতে দেরি করে সেদিন চাতকের মতো তার অপেক্ষায় বসে থাকে।

নীরদও কেমন বদলে গেছে। একসময় যে মেয়েটাকে দেখলেই রা’গ হতো, কথায় কথায় বে’য়া’দব বলতো সেই মেয়ের জন্যই এখন সে ফুল নিয়ে আসে। সে বই পড়তে ভালোবাসে তাই কখনো কখনো বই নিয়ে আসে। সে চকোলেট পছন্দ করে না তাই সেটা আনে না। তবে তার প্রিয় কফি নিয়ে আসে, নানান ব্র্যান্ডের। একদিন রাতে শর্বরীর ভালো লাগছিল না তাই নীরদ ওকে নিয়ে লং ড্রাইভে গেল। শর্বরী সেদিন আবদার করে বসল এখন থেকে এমনই হুটহাট তারা লং ড্রাইভে বের হবে। নীরদ রাজি হলো। সে খেয়াল করে দেখল বিরাট পরিবর্তন এসেছে তার মধ্যে। এরমধ্যে একটা হলো, শর্বরীর কোনো আবদার সে ফেলতে পারে না। কোনো ভাবেই পারে না। বরং তার ইচ্ছে হয় শর্বরী যেন আরো অনেক আবদার করে তার কাছে। একমাত্র তারই কাছে।

নীরদ যখন শুনেছিল শর্বরীর বিয়ে ঠিক হয়েছে। তখন থেকেই কেমন ছন্নছাড়া দিন কাটতে লাগল তার। কাজে মন দিতে পারত না। পরপর কয়েকবার বোর্ড ম্যানেজার তাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দায়িত্বের অবহেলা করার কারণে। নীরদ সেখানে এত বছর কাজ করছে, কখনো এমন দেখেনি তাঁরা তাকে। বরাবরই দায়িত্বের বেশি করে এসেছে ছেলেটা। নীরদকে বিশেষ স্নেহ করতেন বলে তিনি সরাসরি তাকে দুই সপ্তাহের ছুটি অফার করলেন। নীরদ রাজি হয়নি, তখন শর্বরী নিয়মিত হাসপাতালে আসছে। বোকা মেয়ে জানতো নীরদ তাকে দেখছে না, অথচ এমন কোনো দিন নেই যে নীরদ তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে তাকে দেখেনি। শর্বরীর লুকোচুরি খেলাটা তার একদম ভালো লাগত না। একদিন আর পারল না, সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কত কিছু বলবে ভেবে গিয়েছিল বলা আর হলো কই? শর্বরী যেন পালিয়ে গেলেই বাঁচে। নীরদ একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ল। দিনের পর দিন তার অনুভূতিগুলো অবাধ্য হয়ে উঠতে লাগল। তবে কখন থামতে হবে এটুকু তার জানা ছিল। শেষ মুহূর্তে বিয়ে করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে চরম হতাশা বোধ করে। তখন করারও আর কিছু ছিল না। শর্বরীকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করল যদিও সফল আর হতে পারেনি। শর্বরী উল্টো গভীর ভাবে জড়িয়ে গেল তার সাথে। জীবন বোধহয় কখনো কখনো জটিল হয়-ই সহজ হওয়ার জন্য।

৩৬.
দেখতে দেখতে তিন মাস কেটে গেছে। শর্বরী সহজ হয়েছে নীরদের সাথে। নীরদ যদিও আগের মতোই মেয়েটাকে খোঁ’চাতে থাকে প্রতিনিয়ত। শর্বরী এখন আর তেমন রা’গ করে না। জানে, নীরদ তাকে রা’গাতেই ওসব বলে। তবে আজ না চাইতেও রা’গারা’গী হয়েছে তাদের মধ্যে। এই যেমন আজ সকাল থেকে দুজনের মধ্যে বেশ কথা কা’টা’কা’টি হয়েছে। শর্বরী একটা কারণে বেশ জেদ ধরেছে। নীরদ আনমনেই বলে ফেলেছিল,

“বরাবরই তোমার জেদটা বেশি। জেদ করো না সবকিছুতে।”

শর্বরী জবাব দিল, “আমার জেদ বেশি?”

“হ্যাঁ।”

“কখন জেদ করলাম আমি?”

“কখন করোনি? সেই প্রথম থেকেই তোমার জেদ দেখে এসেছি। হেডলাইট ভেঙেছ বলে ক্ষতিপূরণ দিতে এসেছ, আমি বারণ করলাম। তুমি আমার বারণ শুনলে?”

“ওটা আমাকে করতেই হতো। বরং আপনি আমার সাথে অসভ্যতা করেছেন। আমাকে আপনার চেম্বারে আটকে রেখেছেন।”

“অসভ্যতা করেছি?”

“হ্যাঁ, করেছেন।”

নীরদ রেগে গেল। এগিয়ে এসে শর্বরীর সামনে দাঁড়ালো। শর্বরীর দিকে কিছুক্ষণ শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করল,

“সেদিন আমি কী তোমায় ছুঁয়েছি?”

শর্বরী হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল, মাথা নেড়ে না জানালো। নীরদ আবারো জিজ্ঞেস করল,

“কোনো অশোভন আচরণ করেছি?”

শর্বরী এবারও মাথা নাড়ে। নীরদ তার কাছ থেকে সরে এসে বলল,

“তাহলে অসভ্যতা কখন হলো? তুমি কথা শুনতে চাইতে না। আমার কাছে আর পথ ছিল না কোনো।”

শর্বরী লজ্জা পেয়ে গেল। ওভাবে বলা ঠিক হয়নি। মানুষটা মনে আ’ঘা’ত পেল হয়তো। সেদিন রাতে নীরদের সাথে আর কথা হলো না। শর্বরী কাছে গেলেও নীরদ দূরে সরে থাকল। পরদিন সকালে শর্বরীর উঠতে দেরি হলো, উঠে দেখে নীরদ চলে গেছে। ওঁর ভীষণ মন খারাপ হলো। লোকটাকে বারবার কথা দিয়েই সে আ’ঘা’ত করতে যায় কেন? নিজের উপর খুব রাগ হলো। অন্যদিন নীরদ দুপুরে খেয়ে আসে। এই অভ্যাসটা যদিও বিয়ের পর হয়েছে, আগে হসপিটালে বা আশেপাশের কোনো রেস্তোরাঁয় খাওয়া হতো। বেশিরভাগ সময় বাড়ি থেকে মা খাবার পাঠাতেন। বিয়ের পর থেকে সে কিছু সময় বের করে বাসায় এসে খেয়ে যেত। শর্বরীও রান্না শেষে টেবিল সাজিয়ে স্বামীর অপেক্ষায় বসে থাকত। আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অপেক্ষা করতে করতে রাত হলো। নীরদ ফিরল একদম বারোটার আগ মুহূর্তে। শর্বরী ততক্ষণে কয়েক দফা কান্নাকাটি করে বাড়িতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। না হয় সে ভুল করে একটা কিছু বলে ফেলেছে! লোকটা এত কেন উষ্মা প্রকাশ করছে! সে কী জানে না এত রাত পর্যন্ত একা থাকতে শর্বরীর ভ’য় হয়‌।

নীরদ না খেয়েই শুয়ে পড়ে, সারাদিনের অভুক্ত শর্বরী রাগে অভিমানে সব খাবার ফেলে দিল। বেশ অনেকটা সময় পার হলে নীরদ উঠে এলো। শর্বরী লিভিং রুমের সোফায় বসে ছিল। টিভি চলছে, শর্বরী সেদিকে তাকিয়ে আছে। টিভির সাউন্ড কমাতে কমাতে এতই কমিয়েছে যে কাছে গিয়ে দাঁড়ালেও কিছুই শোনা যাচ্ছে না। নীরদ পাশে বসে বলল,

“তোমার তো দেখছি সাউন্ড ছাড়া টিভি দেখার বিশেষ ট্যালেন্ট আছে মনে হচ্ছে।”

শর্বরী ওভাবেই স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

“আমার জন্য কারো সমস্যা হোক চাইনি। কারো ঘুম ভাঙানোর ইচ্ছে আমার নেই।”

“তারপরও ভাঙিয়ে দিলে।”

“একদম মি’থ্যে অ’পবাদ দিবেন না। আমি কিছু্ই করিনি।”

নীরদ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। শর্বরী এবার সাউন্ড বাড়িয়ে টিভি দেখতে লাগল। হঠাৎ নীরদ বলল,

“স্যরি, আমি অযথাই রাগ দেখিয়েছি।”

শর্বরী টিভির সাউন্ড আরো বাড়িয়ে দেয়। নীরদ দ্বিতীয়বার একই কথা বলল। শর্বরী রিমোট হাতে নিতেই এবার নীরদ ওটা নিয়ে নেয়‌। শর্বরী ছলছল চোখে তাকাতেই নীরদ জড়িয়ে ধরল তাকে। শর্বরী বলল,

“আপনার সাথে আমি আর থাকব না।”

“কেন?”

“থাকব না বলেছি ব্যাস।”

“থাকতে হবে। আমার সাথেই থাকতে হবে।”

“জোর করে ভালো কিছু হয় না।”

“ঠিক বলেছ। জোর করে আমি তোমাকে কখনো ভুলতে পারব না।”

শর্বরী নীরদের টি শার্ট চেপে ধরে বলল, “আমাকে ভুলতে পারা আপনার জন্য ভালো কাজ?”

“অবশ্যই।”

শর্বরী হুঁ হুঁ করে কাঁদতে লাগল, নীরদ ওঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ পর শর্বরী শান্ত হলে নীরদ ডাকল,

“শর্বরী?”

“হু?”

“ভালো কাজ আমার এখন আর ভালো লাগে না।”

শর্বরী আরেকটু সিঁটিয়ে বসল নীরদের পাশে। নীরদ জিজ্ঞেস করল,

“সারাদিন কিছু খাওনি কেন? খাবারের সাথে রাগ কীসের!”

“এই প্রশ্নটা আমি আপনাকেও করতে পারি।”

“আমি খাইনি কে বলেছে?”

“আমি জানি।”

“কীভাবে?”

“বুঝতে পারি”

“কীভাবে?”

“জানি না।”

নীরদ হাসল, শর্বরীকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বলল,

“খাবার ফেললে কেন?”

“এমনিতেই।”

“এমনি এমনি খাবার ফেলে কেউ?”

“ওটা খেতেও পারতেন না।”

“কেন?”

শর্বরী মিনমিন করে বলল, “আজ ইচ্ছে করে সব আইটেমের মধ্যে ঝাল দিয়েছিলাম বেশি করে। ইচ্ছে মতো লবণও দিয়েছি।”

নীরদ হতাশ গলায় বলল, “সত্যিই?”

“সত্যি?”

নীরদ আর কিছু বলল না। শর্বরী উঠে এলো, দুজনে একসাথে রান্নাঘরে ঢুকলো। বাইরে তখন ঝড় উঠেছে। শর্বরী বলল,

“খিচুড়ি করি?”

“করো।”

নীরদ সরে দাঁড়ালো। এক পাশে দাঁড়িয়ে থেকে একটু আগেই বেশ মান অভিমান করা মেয়েটাকে দেখতে লাগল। বৃষ্টি দেখতে দেখতে রান্না করবে বলে শর্বরী জানালা খুলে দিল। চুলগুলো বিরক্ত করছিল তাই এলোমেলো একটা খোঁপা বেঁধে আবার গভীর মনোযোগ দিয়ে সে রান্না করতে লাগল। নীরদ সেদিকে তাকিয়ে থাকতেই থাকতেই ভাবল, এমন একটা দিনের অপেক্ষাতেই ছিল সে। আজ, এখন সে শর্বরী না বললেও বুঝতে পারছে সে তার হৃদয়ে ঠিক কতটা জুড়ে আছে! তার মনে প্রশ্ন জাগে শর্বরীও কী বুঝতে পারছে সেটা?

(সমাপ্ত।)