এমন একদিন সেদিন পর্ব-০১

0
1

#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১

১.
বাসরঘরে ঢুকে সদ্য বিবাহিত বরের প্রথম কথাটি’ই ছিলো ভীষণ তিক্ত, ‘বিয়ের রাতে পালিয়ে যাওয়া কি আপনাদের হাউজ ন্যাশন ট্রেন্ডেন্সি?’

গরম আবহাওয়ার আকাশ হঠাৎ হালকা হলো। বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো ঝিরিঝিরি বৃষ্টির গন্ধ, শুকনো পাতার উড়োউড়ির ছন্দ। সেই বৃষ্টির গন্ধ আর পাতার ছন্দের হাওয়ার সাথেই ভরপুর খুশবুতে মেতে উঠলো হক বাড়ির দোতলার ডান পাশের ঘর’টা। ফুলে ফুলে আমোদিত ঘরটায় বিছানার ঠিক মধ্যিখানে মধ্যমনি হয়ে বসেছিলো দুষ্টু। তার পালিয়ে যাওয়া হয়নি। এই দুঃখে সে জর্জরিত তার উপর আকস্মিক ভেসে আসা এহেন খোঁচা দেওয়া বাক্যে সে বড় বড় চোখে তাকালো। চোখ উঠিয়ে, ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই এক রাশ আলস্য তাকে ঝেঁকে ধরলো। দুষ্টু হাই তুলে বিছানায় শুয়ে পরলো। ভারী লেহেঙ্গা এবং সাজগোছ নিয়ে শুয়ে থাকা গেলো না। উশখুশ করতে করতে উঠে বসে একটা সুতি কামিজ নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরলো।

প্রচ্ছদ ভ্রু কুচকে, সচেতন দৃষ্টিতে দুষ্টুর প্রতিটা পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করলো। বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বিছানায় বসতেই তার ভেতরটা অপমানে কাটা দিয়ে উঠলো। তাকে যে খুব নিখুঁত ভাবে এড়িয়ে চলা হয়েছে এবং খুব সূক্ষ্ম ভাবে তাকে পাত্তা দেওয়া হয়নি, এমনকি তার কথা কানেই নেওয়া হয়নি, চিনেও না চেনার ভান করে জামা-কাপড়ের পুটলি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যাওয়া হয়েছে ভাবতেই কপালের রগ ফুলে উঠছে।

মিনিট কতকপরে’ই দুষ্টু বের হলো। প্রচ্ছদকে এড়িয়ে ডেসিন টেবিলের সামনে গিয়ে দাড়ালো। চুল খুলতে ব্যস্ত হয়ে পরতেই প্রচ্ছদ শান্ত ঠান্ডা স্বরে বলল,

‘বাসর রাতে স্বামীকে আগে সালাম করতে হয়।’

দুষ্টু ভ্রু কুচকে আয়না গলিয়ে চাইলো। ততক্ষণে হাওয়া থেমে গেছে। বৃষ্টির ঝিরিঝিরি ভাবটাও আর নেই। আবারো ভ্যাপসা গরমে প্রকৃতি ছেয়ে উঠেছে। দুষ্টুর চুল খোলা শেষ। ফ্যানের বাতাসে উড়ছে সেসময়। প্রচ্ছদের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে অবহেলার গলায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও বলল,

‘স্বামী? হাহ, স্বামী! ঠিক!’

দুষ্টুর এমন ছন্নছাড়া কথায় প্রচ্ছদ ভ্রু বাঁকালো। বক্র ভ্রু’যুগলে তাকাতেই দুষ্টু হাত দিয়ে ইশারা করে টেবিলের উপর রাখা দুধের গ্লাস দেখিয়ে বলল, ‘তো প্রাণপ্রিয় স্বামী, দয়া করে খেয়ে নিন।’

প্রচ্ছদ একবার অর্ধনির্মিলিত চোখে দুধের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আবারো পূর্ণ দৃষ্টি ফেলল দুষ্টুর উপর। বলল,

‘তোমরা সব বোনেরাই একরকম, না?’

দুষ্টুর কপালে ভাঁজ পরলো। বুকে আড়াআড়ি ভাবে হাত ভাঁজ করে দাড়ালো। প্রচ্ছদ আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে। একটু পর নিশ্চয়ই তুমি থেকে আপনিতে চলে যাবে! ও তো এরকমই। প্রচ্ছদ বলল,

‘তোমাদের লজ্জা হয় না? আর তোমাদের কি বলবো আমার ফ্যামিলির আসলে লজ্জা নেই। বড় বোন পালিয়ে যাওয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও ছোট বোনকে বউ বানিয়ে নিয়ে এলো।’

দুষ্টু অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ চাহনি মেললো। তাকে অপমান করা হচ্ছে? তাও এভাবে? সামনাসামনি? প্রকাশ্যে? তাকে অপমান করে প্রচ্ছদ পার পেয়ে যেতে পারবে? প্রচ্ছদ শেরওয়ানির বোতাম খুলতে খুলতে বলে,

‘কেনো শুধু শুধু বাবা-মার মুখ পোড়াও? বিয়ের রাতে পালিয়ে যাও? আমার মা তোমাকে না ধরতে পারলে তো মান-সম্মান সব জলে যেতো।’

দুষ্টু কটাক্ষ চাহনি মেলে চাপা শক্ত করে বলল, ‘দ্যাটস নান অফ ইউর বিসনেস।’

প্রচ্ছদ ঠান্ডা চোখে তাকালো। ধারালো মুখে স্থির স্বরে তাকে বলতে শোনা গেলো,

‘অফকোর্স দিস ইজ মাই বিসনেস। বিকজ ফ্রম নাও, ইউ আর মাই রেসপন্সিবিলিটি। মাই ওয়াইফ!’

সেই হিম শীতল ঠান্ডা গলায় তীক্ষ্ম ফলার মতো কণ্ঠধ্বনিতে যেনো অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। এই ফুলে ফুলে আমেজে পরিপূর্ণ ঘরটাকেও ভীষণ পাষণ্ড মনে হলো। কোমলতা ছড়িয়ে বিছিয়ে যেনো নিঃশেষ হয়েছে। আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এখন যা পরে আছে তা শুধুই কঠোরতা, নির্দয়তা, নির্মমতা। দুষ্টু উল্টোদিকে ঘুরে অসহায় যোগে নরম গলায় উত্তর দিলো,

‘আমি তো হতে চাইনি আপনার স্ত্রী কিংবা দায়িত্ব।’

‘তুমি না চাইলে নিশ্চয়ই বিয়ে’টা সম্ভব হতো না, রাইট?’

এই কথায় দুষ্টু কেমনতর চোখে যেনো চাইলো। প্রচ্ছদ একটু থেমে বলল,

‘তুমি যেহেতু বিয়েটা করতে চাওনি তবে ফ্যামিলিকে কেনো জানাওনি? ইভেন আমাকে তো একবার জানাতে পারতে?’

দুষ্টু বিদ্রুপ সুরে বলল,

‘সেই কপাল হলে তো আমার ভালোই হতো। আমার অসুস্থ বাবা যদি আমাকে কসম না দিতো তবে কেউ আমাকে দমিয়ে রাখতে পারতো না। আর আপনাকে আমি ফোন করবো কীভাবে? আপনার নাম্বার’ই তো আমার কাছে নেই। মায়ের কাছে চাইতেই মা চোখ পাঁকিয়ে তাকালো। শেষমেষ গায়ে হলুদের দিন থেকে আমার ফোনটাকেই কব্জা করে নিলো। আচ্ছা, আপনি কি করেছেন? যাকে বিয়ে করবেন তার মতামত টুকুও নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি?’

প্রচ্ছদ অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আশ্চর্য! তোমাকে বিয়ে করার জন্য কি আমি ধেই ধেই করে নাচছিলাম? আমি তো হ্যাঁ বলিনি বিয়েতে।’

একটু থেমে প্রচ্ছদ আবারো বলে,

‘আবার নাও বলিনি। তোমার বোন যে মান-সম্মান ডুবিয়েছে আমাদের, তারপর তো তোমাকে বিয়ে করিয়ে ঘরে আনার কথা কল্পনাও করা যায় না। নেহাৎ আমার মা এবং তোমার মা ছোটোবেলার বান্ধবী। তাদের এই এতো ক্লোজ বন্ডিং’টাই জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ালো।’

দুষ্টু বিস্ময় নিয়ে গরম তেলে পানি ফেলার মতো ছ্যাঁৎ করে উঠলো,

‘আপনার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে মানে? কাল তো আমার জীবনে এসেছে। আপনি…! এই আপনি হচ্ছেন আমার জীবনে সবচেয়ে খারাপ, বাজে আর ফালতু কাল।’

‘জাস্ট সাট আপ।’ প্রচ্ছদ দাঁত কিড়মিড়িয়ে উঠলো।

‘ইউ জাস্ট সাট আপ।’

প্রচ্ছদ চোখ পাঁকিয়ে চাইলো। দুষ্টু মুখ বাঁকিয়ে অন্যদিকে ঘুরলো। কিছুক্ষণ গম্ভীর নিশ্চুপতার পর প্রচ্ছদ ঠান্ডা মেজাজে প্রশ্ন ছুড়লো,

‘দ্যান হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?’

প্রচ্ছদের আচমকা এমন প্রশ্নে দুষ্টু উদাস চোখে ওর দ্বারপ্রান্তে চাইলো। চোখে মুখে ভেসে গেলো তীব্র না বলা কিছু আর্তনাদ। নিরাশ চোখ দুটো নিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চোখের কোল ঘেঁষে সাক্ষাৎ করে গেলো অশ্রুসৈন্যরা। চোখের কপাট বন্ধ করে খুব সাবধানে সে উত্তর দিলো,

‘আই লাভ সামওয়ান এলস্।’

‘আই ডিডেন্ট ওয়ান্ট টু হেয়ার ইট। আই সেইড, হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?’

প্রচ্ছদের ওই কাট কাট প্রশ্নে দুষ্টুর অন্তরাত্মা দিয়ে বরফ শীতল স্রোত বয়ে গেলো। প্রচ্ছদের এই ধারালো গম্ভীর মুখটার দিকে তাকিয়েই কেটে গেলো তার কয়েক ক্ষণ। বুকের মাঝে বলের মতো ঢপ খেতে লাগলো, ‘তোমার দু’বছরের ভালোবাসা অনন্ত জীবনের সমান।’ পরমুহূর্তেই মস্তিষ্কে দপ করে জ্বলে উঠলো, ‘তুমি বিবাহিত। পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করো।’ মস্তিষ্কের সাথে মনের এতোসব দ্বন্ধে দুষ্টু যখন পাগলপ্রায় তখন সেসব দ্বন্ধ একপাশে ছেড়ে ছুঁড়ে ফেলে দুষ্টু হালকা আওয়াজে বলে উঠলো,

‘আই ওয়ান্ট ডিভোর্স।’

প্রচ্ছদের শিরদাঁড়া বেয়ে যেনো গরম স্রোত বয়ে গেলো। এতোটাই গরম যেনো আগুনের ফুলকি! হঠাৎ’ই অনুভব করলো তার ভালো লাগছে না। এই হালকা হাওয়ার ভ্যাপসা গরমের মাঝে টিকে থাকা যাচ্ছে না। সামনের এই নারী’টিকে আর এক মুহুর্তের জন্যও সহ্য করা যাচ্ছে না। প্রচ্ছদ একটানে শেরওয়ানি খুলে ফেলল। কোথাও একটা ফারর…শব্দ হয়ে শেরওয়ানি ছিড়ে গেলো বোধহয়। সেই শব্দে দুষ্টু চোখ মুখ খিচে বন্ধ করলো। প্রচ্ছদ তড়িৎ বেগে দুষ্টুর কাছে এসে নির্মল কন্ঠে হুমকি দেওয়ার ন্যায় বললো,

‘আর যদি ডিভোর্স না দেই?’

দুষ্টু বন্ধ চোখের দ্বার উন্মোচিত করে পূর্ণ সতর্ক দৃষ্টিতে তাকালো। প্রচ্ছদের বুকে হালকা ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে গরম গলায় বলল,

‘কেনো দিবেন না? একটু আগেই বলেছেন আমাকে নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেননি তবে কেনো ডিভোর্স দিবেন না? সুন্দরী মেয়ে দেখেই মন ঘুরে গেলো তাই না?’

প্রচ্ছদ দাঁতে দাঁত চেপে বিছানার হেডবোর্ডে ঘুষি দিয়ে দুষ্টুর হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

‘তোমাকে আজ প্রথম দেখছি না, বেয়াদব মেয়ে। প্রচ্ছদের জন্য মেয়ের অভাব হবে না। ইউ ডোন্ট ডিজার্ভ মি। সুন্দরী তো বহু পরের কথা। নিশ্চয়ই দুষ্টু প্রচ্ছদের জন্য নয়।’

প্রচ্ছদ দুষ্টুর হাত ছেড়ে দিতেই দুষ্টু ব্যথায় হাত চেপে ধরে দ্বিগুণ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,

‘প্রচ্ছদ দুষ্টুর জন্য নয়। ইউ ডোন্ট ডিজার্ভ মি। গটেড? ইটস ইউ।’

‘গেট আউট ফ্রম মাই রুম। বের হও আমার ঘর থেকে। তোমাকে আমার দেখতে’ই ইচ্ছে করছে না।’

‘দেখতে ইচ্ছে না করলে চোখ বন্ধ করে রাখুন। এই ঘরে আমারও সমান অধিকার আছে ডিভোর্স দেওয়ার আগপর্যন্ত।’

‘তুমি যাবে? বের হও, মেয়ে।’

‘ইউ গেট আউট। আউট ফ্রম মাই রুম, মাই হোম এন্ড মাই লাইফ।’

প্রচ্ছদ তাজ্জব বনে গেলো। বিস্ময়ের সহিত বলল,

‘আমি তোমার জীবন থেকে বেরিয়ে যাবো?’

পরমুহূর্তেই দাঁত কিড়মিড় করে বললো,

‘হাউ ডেয়ার ইউ? তুমি আমার জীবন থেকে বেরিয়ে যাবে।’

‘নিশ্চয়ই আমি নিজ পায়ে হেটে হেটে আসিনি? আমার বাড়ি থেকে আমাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছেন, ঠিকাছে? আমি যেচে বিয়ে করতে আপনার বাড়ি যাইনি। আপনি গিয়েছেন আমার বাড়ি। সুতরাং, কথাবার্তাও সাবধানে বলবেন আপনি।’

প্রচ্ছদ আহাম্মক বনে গেলো। বিয়ের চব্বিশ ঘণ্টা পার না হতেই এই মেয়ের মুখে এতো বড় কথা! কীভাবে সম্ভব? প্রচ্ছদ রেগে হুড়মুড় করে ওয়াশরুমে ঢুকে শব্দ করে দরজা লাগালো। দুষ্টু কানে হাত দিলো। পরমুহূর্তেই প্রচ্ছদ আবার বেরিয়ে এলো। দুষ্টুর সামনে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক, নরম, খানিক অপ্রকাশিত সুরে তাকে বলতে শোনা গেলো,

‘সত্যি ডিভোর্স চাও?’

দুষ্টু অসহযোগে চাইলো। ডানে বামে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ নিচে নামালো। ছোট করে জবাব দিলো, ‘হু।’

প্রচ্ছদ কেমন ধারায় যেনো দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। চোখের দৃষ্টিতে ফুটে উঠলো টগবগে আগুন গরম লালাভ দৃষ্টি। ভালোভাবে তাকাতেই বোঝা যাবে, সেই চোখেই সূক্ষ্ম এক ব্যথার সৃষ্টি।

‘সময় দিন। মিউচুয়াল ডিভোর্সের তিনমাস সময় লাগবে।’

অতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রচ্ছদ বাক্য দুটি বলে আবারো ওয়াশরুমে ঢুকলো। এবারের দরজায় শব্দ হলো না। আস্তে করে লাগানো হলো। অতর্কিতভাবে রাগের চেয়ে ব্যথার মাত্রাটা হয়তো বাড়লো। তুমি থেকে আবারো আপনিতে নামা হলো। সিলিং পাখার বাতাস কমে এলো। গরমের দাপট বোঝা গেলো। গাছেরা আন্দোলনে নেমে পাতাদের দমিয়ে রাখলো। সাথে সাথে হাওয়ারাও তাল জুগিয়ে থেমে গেলো। দুষ্টু ঘামলো। প্রকৃতির উষ্ণতার সাথে ভীষণ ভারী অস্বস্থি মিলেমিশে একাকার হয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস রোধ করলো।

চলবে❤️