#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-২০
খাবার ঘরে ঢুকতেই সাজিদ দেখলো টেবিল একদম ফাঁকা। শুধু এক কোণায় ফোনে চোখ রেখে পরপর খাবার মুখে ঢুকাচ্ছে টিয়া। কোনোদিকে হুশ নেই। সাজিদ টিয়ার পাশের চেয়ার টেনে বসলো। প্লেটে খাবার তুলতে তুলতে আড়চোখে একবার টিয়ার দিকে তাকালো।
‘ফোনে কি? খাওয়ার সময় ফোন টিপিস কেন?’
টিয়া চমকে উঠলো। সাজিদকে পাশে দেখে দ্বিতীয় দফায় ভড়কিয়ে চোখ বড় বড় করে চাইলো। বুকে থুতু দিয়ে পরমুহূর্তে আবার ফোনে ব্যস্ত হলো। অনেকক্ষণ পর সাজিদ খাবার মুখে নিয়ে অস্পষ্ট গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘প্রেম নাকি করছিস আজ-কাল?’
টিয়া ফোনে দৃষ্টি রেখেই ভ্রু কুচকে বিস্ময়তার গলায় বলল,
‘পাগল নাকি? হঠাৎ প্রেম করতে যাবো কেনো?’
টিয়ার নিজের উপর এহেন আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলার ধরণ দেখে সাজিদ পুরোদস্তুর স্বস্তির অনেক বড় নিঃশ্বাস ছাড়লো। ঝটপট খাওয়া শেষ করে টিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলো।
টিয়া তখনো খাচ্ছিলো। ফোন দেখে দেখে খেতে গিয়ে তার অনেক দেরি হয়। বদ অভ্যাস! সাজিদ মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে সে মুচকি হাসলো। একটুপর ভাই চলে যেতেই যেনো তার হুশ হলো। ভাইয়া কি বলে গেলো? ফোনে ডুবে গিয়ে সে বেমালুম ভুলে বসেছিলো কালকে তার আর নীরার ঘটনাগুলো। নীরা নিশ্চয়ই সাজিদকে কিছু বলেছে নাহলে হঠাৎ এসব জিজ্ঞালো কেনো? সাজিদের কথা গুলো ভাবতেই টিয়ার গায়ে কাটা দিলো। ভাগ্যিস সে অবচেতনে স্বাভাবিক ভাবে উত্তর করেছে। তা নাহলেই তো শরীর কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যেতো সাথে সাজিদও সব বুঝে ফেলতো! টিয়া কপালে হাত ঠেকিয়ে বিরবির করলো,
‘কিন্তু আমি তো প্রেম করছি না। এতো বানিয়ে কথা কীভাবে বলতে পারে একটা মানুষ?’
৪৩.
শেষ বিকেলের মরা আলোয় মেঘ কেটে আকাশের মাঝে রঙিন দাগ টেনেছে। প্রযুক্ত কালো রঙের ফুলহাতা পাতলা গেঞ্জি পরে দাঁড়িয়ে আছে লেকের পাশে। ওপাশে দু’চারটা হাঁস সাঁতার কাটছে স্বচ্ছ, নিবিড়, হালকা ঢেউ খেলানো জলে। প্রযুক্ত হাতঘড়ি’টা একবার দেখলো। এরপর ভ্রু কুচকে সামনের দিকে তাকাতেই থমকে গেলো বিরক্তির দৃষ্টি জোড়া। চোখের পর্দায় ধরা দিলো কালো শাড়িতে এক সুরম্য রমণী নাম তার শ্রেয়সী…. নাকি প্রেয়সী নাকি চোখের পলকে সে একটু’খানি উদাসী? প্রযুক্ত চোখ ঘুরালো। পরমুহূর্তেই আবার তাকালো। মোহিত, বিহ্বল, বশীভূত চোখে বিবশ গলায় নিজ মনে মনে বলল, ‘নাকি ভালোবাসি?’
পায়ে পায়ে শ্রেয়সী এগিয়ে এলো প্রযুক্তর মুখোমুখি। গোলাপি রাঙা ঠোঁটের এক কোণায় ভীষণ দারুণ অভিভূত মুচকি হাসি। উচ্ছ্বাসে, উল্লাসে প্রাণবন্ত নারী’টি বলল,
‘আপনি কালো পড়েছেন তবে!’
প্রযুক্ত অবাকতার সাথেই জোরপূর্বক হেসে বলে,
‘আপনি তো বলেছিলেন কালো পরতে কিন্তু আপনি যে শাড়ি পরবেন সেটা তো বলেননি।’
শ্রেয়সী লাজুক হাসলো। মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘চলুন হাটি।’
পায়ে পা এগোলো। দুর্দমনীয় অজানাতে। লেকটা বড়। রাস্তার বা’পাশে কিছুদূর অবধি এগিয়ে গেছে। মাথা উঁচু করে দণ্ডায়মান বিশাল বৃক্ষসাম্রাজ্য। শীতার্তর মৃদু ঠান্ডা হাওয়া। শ্রেয়সীর আচঁল উড়ছে। গোছানো খোলা চুলগুলো অগোছালো হয়ে মুখে পরছে অবিরাম। প্রযুক্ত তখনও দেখছিলো বিভোর আঁখি’তে। খানিক বাদে ধীর গলায় বলল,
‘সুন্দর লাগছে!’
শ্রেয়সী অগোছালো চুলগুলো সামলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে চাইলো। প্রযুক্ত মৃদু হাসলো। সারা শরীরে যেনো কম্পন খেলো গেলো সে নারীর। গোপনে হাসলো সেও। পলকবিহীন নয়নে দূর, বহুদূরে দৃষ্টি রেখে বলল,
‘সেদিন মূহুর্তের কথা বলেছিলাম। মনে আছে? নদীর পাড়, ভেজা বালি, গা শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া?’
‘মনে আছে।’
শ্রেয়সী মুচকি হাসলো। রাস্তার মাঝখানে দাড়াঁলো। দু’হাত তুলল। প্রযুক্ত বিস্ময় নিয়ে তার পাগলামি কর্ম দেখে গেলো। উঁচুস্বরে শ্রেয়সী বলে উঠলো,
‘আরো একটি মুহূর্ত! লেকের ঢেউয়ের ছলাৎ শব্দ, পিচ ঢালা রাস্তায় সবুজ পাতার ছায়ার দুলানো এলো নকশা, চুল উড়ানো বাতাস, এই প্রথম শাড়ির কুচি ধরে অবিন্যস্ত হাটা আর পাশে থাকা অবুঝ মানুষ’টা।’
কেনো হলো কে জানে পক্ষান্তরে প্রযুক্ত’র শরীর প্রাণ জুড়ে কেমন এক.. অপার্থিব, অতীন্দ্রিয় অনুভূতি বিচরণ করলো। হৃদয় স্তব্ধ হলো। থমকে দাঁড়ালো। শ্রেয়সী এগিয়ে গেলো অনেকটা। প্রযুক্ত দূর থেকে সম্পূর্ণ অন্য এক নিজস্ব দুহিতা আবিষ্কার করলো তার অজ্ঞাত অভিনিবেশপূর্ণ দর্শনেন্দ্রিয়তে।
৪৪.
তমসার নিঝুম, শ্রান্ত, শান্ত রজনী। আকাশের মাঝখানে রাজার বেশে মস্ত বড় এক চাঁদ। সৈন্য সেজে বসে আছে নক্ষত্রের দল। দুষ্টু বিকেলে ছাদ থেকে নিয়ে আসা এলোমেলো শুকনো কাপড়গুলো ভাঁজ করছিলো। প্রচ্ছদ বাইরে থেকে এলো। দুষ্টু চোখ তুলে একবার তাকিয়ে দেখলো। অতঃপর আবারো নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। প্রচ্ছদ ওয়াশরুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে বাইরের জামাকাপড় ছেড়ে দুষ্টুর খানিকটা পেছনে দাড়াঁলো। দুষ্টু একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে বলল,
‘কিছু বলবেন?’
অনেকটা সময় নিয়ে প্রচ্ছদ উত্তর দেয়,
‘কোর্টে আবেদন করা হয়েছে ডিভোর্সের জন্য। কাল বোধ হয় উকিলের চেম্বারে যেতে হবে।’
দুষ্টুর চোখে খুশির ঝিলিক। আকাশের সেই মস্ত বড় সুখী চাঁদটার ন্যায় তার ঠোঁটে ক্রমাগত সুখ ফুটে উঠলো। উচ্ছ্বাসে বলল, ‘সত্যি?’
প্রচ্ছদের চোখ মেঝের দিকে। কেনো কে জানে! তবে পরমুহূর্তেই কেনো যেনো দুষ্টুর হাসি ঠোঁটেই মিলিয়ে গেলো। মুখটা ভার হলো। এবার তার কণ্ঠ শুনালো গম্ভীর এবং অল্প একটু বিস্ময়, ‘সত্যি নাকি?’
প্রচ্ছদ উত্তর দিলো না। দুষ্টু আবার কাপড় ভাঁজ করায় মনোনিবেশ করলো ভারাক্রান্ত মনে। আবার কিছুক্ষণ পরেই প্রচন্ড খুশি সে। প্রচ্ছদ অনেকক্ষণ মৌন থেকে প্রশ্ন করলো,
‘তুমি কি এই সংবাদে খুশি নাকি দুঃখী?’
দুষ্টু প্রচ্ছদের কথা শুনলো। কিন্তু কেনো কারণে উত্তর দিতে ইচ্ছে হলো না। দুষ্টুর পাত্তাহীন ব্যবহারে প্রচ্ছদ বড় বড় কদমে এগিয়ে এসে খপ করে তার হাত থেকে কাপড় গুলো নিয়ে বিছানায় ছুড়ে মারলো। এরপর চোখে চোখে তাকালো। চার চোখ একত্রে পুলকিত হলো। প্রচ্ছদের বুক কাপঁলো। মিনিট কতক এক দৃষ্টিতে দুষ্টুর দিকে চেয়ে থেকে হালকা গলায় প্রশ্ন করলো,
‘খুশি নাকি দুঃখী?’
দুষ্টু শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে উদাস কণ্ঠে বলে, ‘বুঝতে পারছি না। নিজেকে নিজেই চিনতে পারছি না এই প্রথমবার! তবে মনে হচ্ছে আমি খুশি।’
প্রচ্ছদ মলিন যোগে চাইলো। অদ্ভুত এক অভিমান! ওর ভেতরের প্রচ্ছদ’টা প্রশ্ন করতে চায়, ‘কেনো আপনি খুশি, দুষ্টু? কেনো আপনার কষ্ট হয় না?’
কিন্তু বলতে পারে না। পলকবিহীন চেয়ে রয়। দুষ্টুর দৃষ্টিতে নিজেকে বুঝতে না পারার অসহায়ত্ব। প্রচ্ছদের চোখ অভিলাষপূর্ণ। তার বুকের কম্পন থেমে গেলো। রাত নামের অন্ধকার মৃতজালে তাকালে মনে হলো, ‘চারিদিক ঘন অন্ধকার!’ দুষ্টু জিজ্ঞেস করে,
‘কি দেখছেন ওভাবে?’
প্রচ্ছদ উত্তর করে না। শূন্য নয়নে তাকিয়ে থাকে। দুষ্টু ওর চোখের সামনে হাত নাড়িয়ে আবার প্রশ্ন করে, ‘শরীর খারাপ লাগছে আপনার?’
তবু প্রচ্ছদ উত্তর করে না। খানিক বাদে শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুষ্টুকে ছেড়ে চলে যায় বারান্দার দিকে। দুষ্টু মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন ফুটিয়ে চেয়ে রয় প্রচ্ছদের পদচ্ছাপের দিকে।
চলবে❤️
#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-২১
৪৫.
প্রত্যুষের ঝিরিঝিরি গা শিউরানো ঠান্ডা সমীর। দুষ্টুর গায়ে পাতলা খয়েরী শাল। চারিদিকে মৃদু শীতের আমেজ। খুব ভোরে উঠলে দেখা যায়, কুয়াশার ধূম্রজাল। তবে এখন প্রভাত নয় ঘড়ি জানান দিচ্ছে সকাল দশটা পেরিয়েছে।
গন্তব্যে পৌঁছে গাড়ি থেমে দাঁড়িয়ে আছে। প্রচ্ছদ মিনিট কতক নিরবে বসে থাকলো। সারা শরীরে চিনচিনে ব্যথা… মাথায় চিনচিনে ব্যথা.. বুকে চিনচিনে ব্যথা! কী আশ্চর্য! এতো ব্যথা নিয়ে প্রচ্ছদ গাড়ি থেকে নামবে কি করে? হাটতে পারবে তো? সে ঘাড় ঘুরিয়ে দুষ্টুর দিকে তাকালো। তাকাতেই দুষ্টু চোখ সরিয়ে অন্যদিকে চাইলো। কী নিদারুণ অপমান! বলি প্রচ্ছদের চেহারাটা দেখতে কি এতোটাই অসুন্দর রে?
এমন কাটা কাটা ধারালো চেহারা…তীক্ষ্ণ নাক…ওমন চঞ্চুর ন্যায় ঠোঁট.. অরঞ্জিত সফেদ রঙের অপূর্ব চমককৃত সুন্দর মুখ’খানা এই ধরণীতে ওই অহংকারী নারী আর একটাও খুঁজে পাবে? প্রচ্ছদ দাঁতে দাঁত চাপলো। তাকে পাত্তা দিলো না এই মেয়ে? সেও ডিভোর্স দেবে না। দেখি এই মেয়ে কি করে! বিরক্তিকর মেয়েমানুষ।
‘গাড়ি থেকে জলদি নামুন। আমাকে তাড়াতাড়ি ভার্সিটি যেতে হবে। এমনিতেই আপনার জন্য দু’দিন ছুটি নিতে হয়েছে আমার।’
দুষ্টু তাজ্জব বনে গেলো। কি হলো? হঠাৎ আপনি? নাক’টা ওমন ফুলিয়েই বা রেখেছে কেনো? সে অবাক কণ্ঠে শুধালো,
‘আমার জন্য ছুটি নিয়েছেন মানে? আমি তো আপনাকে ছুটি নিতে বলিনি। আপনার থেকে রেহাই পেতেই তো আমি আমার বাসায় গেলাম। সেখানেও আপনি পেছন পেছন হাজির হলেন।’
প্রচ্ছদ বিস্মিত। অবাক দৃষ্টিতে দুষ্টুর দিকে তাকালো প্রায় সাথে সাথেই ভেতরটা অপমানে জর্জরিত হয়ে উঠলো৷ সূক্ষ্ম কাটার মতো কি যেন বিধলো বুকে! এতো নির্লজ্জ হয়ে অপমানিত সে এর আগে আর কখনো হয়নি। ইশশ.. কেনো গিয়েছিলো সেদিন এই অহংকারীর কাছে? প্রচ্ছদের মুখের ভাষা হারিয়ে গেছে। কোনো মানুষ মুখের উপর এভাবে বলতে পারে? একটুও বাধলো না? এতোটা লজ্জা দিয়ে কেউ কাউকে অপমান করে? মনুষ্যত্ব বোধটুকুও বুঝি নেই এই রমণীর? প্রচ্ছদের নিজেকেই ছিঃ দিতে ইচ্ছে হলো। দোষ’টা তো তারই! সে চকিতেই চোখ সরিয়ে ফেলল।
উকিলের চেম্বারে বসতেই উকিল প্রচ্ছদের সাথে হাত মেলালো। পরিচিত বন্ধু হওয়ায় তাদের চা খেতে দেওয়া হলো। প্রচ্ছদের সাথে টুকটাক আলাপ সেরে, দুষ্টুর সাথে পরিচিত হয়ে, ওদের হাল-চাল জিজ্ঞেস করার পর্ব শেষ করে বলল,
‘শোন, কোর্টে আবেদন করা হয়েছে। কোর্ট এলাকার মেয়রের সাথে তোকে কথা বলতে হবে। তার চেম্বারে চল।’
প্রচ্ছদ পা বাড়ালো উকিলের সাথে। দুষ্টু হিজাব টেনেটুনে ঠিক করলো। চেম্বারের এক কোণায় বেসিং এর আয়নায় আরেকবার দেখে নিলো। তার মনে হচ্ছে, সিড়িন হক এই কোর্ট এলাকায়ও এসে পরেছে এবং দুষ্টুর হিজাব একটু নড়চড় হলেই গা কাঁপানো স্বরে বলছে, ‘হিজাব ঠিক করে পরো। এতো বড় মেয়ে হিজাবও পরতে জানো না নাকি?’
দুষ্টু বড় করে শ্বাস ফেলে পা বাড়ালো। প্রচ্ছদ তাকে ফেলেই চলে গেলো। পেছন ফিরে তাকালো না পর্যন্ত? ভেবেই ভীষণ রাগ হলো। ওমন দায়িত্ব জ্ঞানহীন পুরুষমানুষ সে আর দুটো দেখেনি। যতোই হোক দুষ্টু তো এখন তার দায়িত্বে নাকি? ইরেসপন্সিবল লোক একটা!
—
মেয়র গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো, ‘কি করেন আপনি?’
‘প্রফেসর।’
‘আপনি?’
প্রশ্নটা ছিলো দুষ্টুর জন্য। দুষ্টু ঠিকঠাক হয়ে বসে বলল,
‘এখনো কিছু করি না। তবে ইনশাআল্লাহ শীঘ্রই কিছু করবো। বিসিএস এর ভাইভা পরীক্ষা সামনে। টিকে গেলেই ল্যাঠা চুকে যাবে।’
প্রচ্ছদ বিরক্ত হলো। এই মেয়ে বেশি কথা বলে। দুষ্টুর কথাবার্তার এহেন চঞ্চলতা দেখে মেয়র গোপনে হালকা হাসলো। বলল, ‘কতদিন হলো বিয়ে হয়েছে আপনাদের?’
দুষ্টু আঙ্গুলে গুনে হিসেব করে বলল, ‘সাত-আট দিন। নট সিউর এট অল।’
মেয়র বিস্ময় নিয়ে চাইলো। বিয়ের দিন’টা পর্যন্ত ঠিকঠাক জানে না? গলা পরিষ্কার করে কাগজে কিছু লিখতে লিখতে তিনি বললেন,
‘ডিভোর্স কেনো চান?’
প্রচ্ছদ উত্তর দিলো আগে, ‘বনিবনা হচ্ছে না তাই। জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
‘দুজনের এক মত?’
‘হ্যাঁ।’
এবারও প্রচ্ছদ বলল। তার ওমন দৃঢ়তার সহিত শক্ত মুখে কাঠিন্যের ন্যায় কথাগুলো বলতে শুনে দুষ্টু তাকালো অবাক হয়ে। এভাবে তো ওর কথা বলার কথা ছিলো! মেয়র আরো দু’বার প্রশ্ন করলো। এরপর বলল,
‘এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হলো। এরমাঝে যদি আপনাদের মতের পরিবর্তন না ঘটে তবে পরবর্তীতে দু’পক্ষ থেকে সাক্ষী সহ আসবেন। ধন্যবাদ।’
মেয়রের চেম্বার থেকে বের হতেই প্রচ্ছদ গটগট করে বড় বড় পা ফেলে গাড়ির দিকে চলে গেলো। দুষ্টু তখনো বিস্মিত! বেয়াদব লোকটার হলো কি? এমন করছে কেনো? রেগে টেগে আছে নাকি! কিন্তু দুষ্টু তো রাগার মতো কোনো কাজ করেনি। তাহলে রাগবে কেনো? দুষ্টু পায়ে পায়ে গাড়ির সামনে গেলো। প্রচ্ছদ নির্বিকার ভঙ্গিতে একচিত্তে সামনের শূন্যে তাকিয়ে। সিটে বসতে বসতে দুষ্টু বিরবির করলো,
‘ঢং!’
প্রচ্ছদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। চাপা শক্ত করে জবাব দিলো,
‘তুমি আমার জন্য খুব বেশি বিরক্তিকর! কবে ঘাড় থেকে নামবে? সেইদিনের অপেক্ষায় আমি।’
দুষ্টু আশ্চর্য হয়ে চাইলো। চোখের কোণা হঠাৎই ছলছল করে উঠলো। একটা মানুষ কাউকে এতোটা অপছন্দ করতে পারে? অপমানে, লজ্জায়, সংকোচে ভেতরটা বুঁদ হয়ে রইল তার। গাড়ি চলতে শুরু করলো। কোর্ট ছাড়িয়ে, পথ পেরিয়ে, পিচঢালা রাস্তার দু’পাশের বিশাল দেহের গাছপালা ফেলে চলে এলো আবার হক বাড়িতে। দুষ্টু ঠিক করলো সে আর কক্ষনো এই খারাপ লোকটার সাথে কথা বলবে না।
৪৬.
শেষ বিকেলের ম্লান সোনালি রোদ্দুরের ছায়া যখন চারিদিক বিছিয়ে দিয়েছে প্রযুক্ত তখন সবেমাত্র ঘরে ফিরেছে। ভার্সিটি থেকে ফিরতে আজ ভীষণ দেরি হয়ে গেছে। মায়ের কাছ থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই চোখ বন্ধ হয়ে এলো। বিকট শব্দে ফোন বেজে উঠলে, নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকাতেই ভ্রু’ দুটো কুচকে এলো। ফোন কানে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘হ্যালো।’
মিনিট দুয়েক গড়ালো। ওপাশ থেকে উত্তর পাওয়া না গেলে বক্র ভ্রু জোড়া আরো খানিক বেঁকে এলো। পুনরায় শুধালো সে, ‘কে বলছেন?’
তবুও ওপাশ থেকে কথা ভেসে এলো না। প্রযুক্ত বিরক্ত গলায় ধমকে উঠলো, ‘তামাশা করার জন্য ফোন দিয়েছেন?’
ভেসে এলো এবার বড় একটা দীর্ঘশ্বাস। এরপর চুপচাপ কেটে দেওয়া হলো। প্রযুক্ত চোখের সামনে ফোন ধরে কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থেকে বলে উঠলো,
‘আজব তো!’
ফোন’টা চার্জে বসিয়ে টিয়া বিকেলের মরা আলো’টার দিকে উদাস চোখে তাকালো। বুকের ভেতর কু ডাকে। বারবার মনে হয়, একতরফা ভালোবাসা’টা বুঝি এবার হারিয়েই গেলো! ভাবলেই টিয়ার বুক কাঁপে। হৃদয়ে বিষন্নতার ঝড় বহে। একমাত্র প্রযুক্তকে দেখবে বলেই সে দৌড়ে প্রতিটা দিন ভার্সিটি যায়। অথচ আজ গোটা একটা দিন সে প্রযুক্তকে দেখলো না। কেনো যেন আজ ভার্সিটি যেতেই ইচ্ছে হলো না। একপ্রকার ঘর থেকে বের হলেই কেমন গা ছমছম করে উঠলো। কালকের দুপুরে ভাইয়ের বলা কথাগুলো মনে পরলো। তার মস্তিষ্কে বলের মতো বারবার ঢপ খাচ্ছে, আমি যদি বড় ভাবির সামনে পরে যাই আর বড় ভাবি যদি আমাকে দেখে ছি ছি করে বলে উঠে,
‘ছিহ টিয়া, তোকে আমি এতো আদর করি, আর তুই কিনা আমার ভাইয়ের দিকে কু’নজর দিস?’
সত্যি কি কু’নজর! টিয়ার নজর কু’নজর? টিয়ার বুক ফেটে কান্না বের হতে চায়। ঠোঁট টিপে ধরে সে। বুকের মাঝে কেমনতর শূন্যতা। হাহাকার! মনে হলো আজ সারাটাদিন তার বৃথা। কি যেন একটা করা হয়নি হয়নি বলে বোধ হচ্ছে! আচ্ছা, প্রযুক্তকে কি আজ কোনোভাবে বাড়িতে আনা যায়? পড়ার অছিলায়? টিয়া উচ্ছ্বসিত হলো।
পরক্ষণেই মনে হলো, না থাক, আজ ডাকলে যদি নীরা ভাবী কোনো সমস্যা করে। যদি বাড়ির বড়দের বলে দেয়? এমনিতেই প্রযুক্ত সামনে থাকলে বাস্তবিকই টিয়ার আচরণ অন্যরকম হয়ে যায়। সারাক্ষণ এক ধ্যানে প্রযুক্তর দিকে তাকিয়ে থাকা, ছলে বলে কৌশলে শুধু তার সামনে দিয়েই ঘোরাঘুরি করা, এটা ওটা সমস্যা বলে সবসময় প্রযুক্তকে নিজের সামনে পড়ার টেবিলে আটকে রাখা! বেচারা প্রযুক্তটাও তখন অসহায় হয়ে পরে। না পারে কিছু বলতে আর না পারে সইতে!
টিয়া ফিক করে হেসে উঠলো। চোখের উপর থেকে বিষন্নতার পর্দাটা উড়ে গেলো। ঝকঝক করে আনন্দ প্রকাশ পেলো। দূরের আকাশে এক ঝাঁক চিল উড়ে চললো। টিয়া রেলিং ধরে দুলতে দুলতে তা দেখলো। অদ্ভুত শোনা গেলেও সত্যি, সাধারণ প্রযুক্ত থেকে স্যার প্রযুক্তকে টিয়া বেশি ভালোবাসে। এর জন্য প্রযুক্ত বাসায় এলেই টিয়া তাকে পড়ানোতে ব্যস্ত রাখে। প্রযুক্তর পড়ানোর ওই এটিটিউড, অন্য সবার থেকে আলাদা একটা স্টাইল, গম্ভীরতা’টাই ভীষণ মুগ্ধ করে তাকে। সাধারণ প্রযুক্তকে সে ভালোবাসে না। ভাবনাটা দৈবাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে মনে আসতেই টিয়া চোখ কুচকে বিরবির করলো,
‘কিন্তু ভালোবাসার মানুষ’টাকে তো সবসময় সব নিয়মেই ভালোবাসা উচিত। উচিত বৈকি এটা তো আবশ্যক! হৃদয় থেকে আসে। কিন্তু টিয়ার এ কেমনতর প্রেম? হঠাৎ ভালোবাসা আসে, হঠাৎ আসে না।’
টিয়া আবার বৈরাগী দৃষ্টি ফেলল বিশাল আকাশে। স্থির নয়নে ভাবতে বসলো, আসল সমস্যা’টা কোথায়? সাথে এও ভাবতে লাগলো প্রযুক্ত যদি তাকে ভালো না বাসে, বিয়ে না করে তার ঠিক কতটা কষ্ট হবে? আচ্ছা, তখন কি কষ্ট পরিমাপ করা যাবে? আদেও কি যায়?
চলবে❤
#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-২২
৪৭.
মধ্যাহ্নের তেজস্বী অংশুমালী মাথায় নিয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে শ্রেয়া হাপ ছেড়ে বাচঁলো। ভ্যাপসা গরমে চুলের ভাঁজে ভাঁজে ঘামে ভিজে উঠেছে। হাতের মাঝে ধরে থাকা টিস্যু দিয়ে মুখ, কপাল, গলা মুছে এদিক ওদিক তাকিয়ে রিক্সা খুঁজলো। না পেয়ে ত্যক্তবিরক্ত মুখে ফুটপাতের রাস্তা ধরে এগিয়ে চললো। কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই সে সতর্ক দৃষ্টিতে ঘাড় ঘুরিয়ে কোণা চোখে পেছনে তাকালো। ভরদুপুরে আরো কিছুদূর যাওয়ার পরই দেখা গেলো রাস্তা ফাঁকা। গাড়িটা এখনো আসছে ধীর গতিতে। শ্রেয়া একদম ফাঁকা স্থান দেখে দাঁড়ালো। গাড়িটাও থেমে গেলো।
সাজিদ অস্বস্থি ভঙ্গিতে গাড়িতে বসে থাকতেই দেখলো মেয়েটা এগিয়ে আসছে। সাজিদ যেন একটু জড়সড় হয়ে বসলো। এরপর এলোমেলো ভঙ্গিতে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ঘুরাতে নিলেই মেয়েটা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলল,
‘স্টপ। এক পাও নড়বেন না।’
সাজিদের হাত ভীতিতে থেমে গেলো। শ্রেয়া চটপট পায়ে এগিয়ে আসছে। সাজিদের ভেতরটা অশান্তিতে কাটা হয়ে রইল। শ্রেয়া এগিয়ে এসে ঠিক সেদিনের মতোই গাড়ি থেকে নামতে বলল।
‘আপনার সমস্যা কি বলুন তো? বুড়ো বয়সে ভীমরতি?’
সাজিদ নিশ্চুপ। সে যে কেন এমন করছে তা সে নিজেও জানে না। তবে এটুকু জানে, এটা ঠিক না। তবুও কোনো এক অদৃশ্য টানে, অশরীর কবলে পরে সে এরকম করতে বাধ্য হচ্ছে। শ্রেয়া আবার বলল ধমক দিয়ে,
‘আপনার মান নেই? এতো অপমান করলাম সেদিন তারপরেও আমার পেছন পেছন ঘুরেন? চক্ষুলজ্জা বলেও তো একটা জিনিস আছে।’
সাজিদ একবার চোখ তুলে তাকালো৷ শ্রেয়া সাথে সাথেই চোখ রাঙায়।
‘নেক্সট টাইম আমার পেছন পেছন আসলে লোক ডেকে গণপিটুনি খাওয়াবো। আর লোক ডাকতে হবে না আপনার মতো মেন্দা মার্কা লোকের জন্য আমি একাই যথেষ্ট। যত্তসব!’
বাতাসে চুল উড়ানোর ভঙ্গি করে শ্রেয়া হনহন করে চলে গেলো। সাজিদ নির্বিকার চেয়ে থাকলো সেদিক। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়ালো বিষাক্ত অপমান, লজ্জা, খানিকটা আতংক আর চারিদিক ছড়ালো সেই মিষ্টি মেয়ের চুলের সুভাস, কথা বলার আলাদা এক ভঙ্গিমা, দাপট। সাজিদ বিরবির করলো,
‘আচ্ছা, মেয়েটার নাম কি?’
৪৮.
পার হয়েছে দিন পনেরো। এরমাঝে কোর্টে সাক্ষী সহ উপস্থিত হয়েছিলো দুষ্টু-প্রচ্ছদ। সাক্ষী হিসেবে গিয়েছে অর্জন এবং ইরা। দৃষ্টির কথা একবার বলেছিলো দুষ্টু কিন্তু প্রচ্ছদ সাফ না জানিয়েছে। দৃষ্টির নামও শুনতে চায় না সে। দুষ্টুর পরিবারের কেউ জানে না বিধায় তার পক্ষ থেকে সাক্ষী নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আর যদি দুষ্টুর অসুস্থ বাবা জানে তবে বলা যায় না তাকে বাঁচিয়ে রাখাও অসম্ভব হতে পারে। সব ভেবেই তার পক্ষ থেকে ইরা গিয়েছে।
অর্জন এবং ইরাকে নিয়ে যেতেও হয়েছে অনেক করসৎ করে। পরের মাসে এক তারিখে ডেট দেওয়া হয়েছে আবার। সাক্ষী সহ একই কারণে পুনরায় তাদের কোর্টে যেতে হবে।
—
দিগবিদিক শিউলি ফুলের কড়া গন্ধ। শেষ বিকালের স্বর্ণ-কালো রংটার সাথে মিলিয়ে মিশিয়ে গেছে আকাশের এক কোণার শুকতাঁরা। রংচটা বাড়িটার নিচ তলার বারান্দা থেকে তখনো আসছিলো বেলী ফুলের সুঘ্রাণ। মাগরিবের আযান দেওয়ার একটু পরেই পড়তে এলো নুসরাতের ভাই। নীড় তখন কাথা-মুড়ি দিয়ে শুয়ে। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। নুসরাতের ভাই ছুটে গেলো দু’তলায়। একটুপর হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখা গেলো নুসরাতকে।
নীড়ের পায়ের কাছে বসে উৎকণ্ঠিত সেই নারী অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘জ্বর আপনার? খেয়েছেন কিছু?’
নীড় কথা বলল না। হালকা গোঙানির আওয়াজ ভেসে এলো। নুসরাত উঠে দাঁড়িয়ে কপালে হাত দিয়ে দেখতে গেলেই জ্বরের ঘোরে অদ্ভুত এক কাজ করে বসলো নীড়। এমনভাবে নুসরাতের হাত ঝটকানা দিলো যেন সেই মেয়ে তার গায়ে হাত দিলে তার পাপ হবে। নুসরাতের চোখের কার্ণিশে জল এলো। এক ফোঁটা, দুই ফোঁটা এরপর চোখ টলমল করলো ভরপুর পানিতে। চোখ টপকে যখনি পানি পরতে যাবে তখনি নুসরাত প্রায় সাথে সাথে জায়গাটা থেকে সরে দাড়ালো। একটু পর জলপট্টি নিয়ে নীড়ের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আস্তে করে ডাকলো,
‘উঠুন একটু। জলপট্টি’টা লাগান।’
নীড় অস্পষ্ট স্বরে বলে, ‘লাগবে না। তুমি তোমার কাজে যাও।’
নুসরাত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো। নরম কণ্ঠে বলল, ‘আমি লাগিয়ে দেই?’
নীড় আস্তে আস্তে উঠে বসলো। নুসরাত ওকে বালিশ হেলান দিয়ে দিলো এরপর রুমাল চিপে পানি ঝড়িয়ে নীড়ের হাতে দিলো। নীড় বালিশের সাথে হেলান দিয়ে বসলো। জলপট্টি’টা নিজের কপালে রেখে বলল,
‘এবার যাও তুমি।’
নুসরাত উঠে গেলো। তবে রান্নাঘরের দিকে। মিনিট দুয়েক পর এসে জিজ্ঞাস করলো,
‘পাতিল হাড়ি তো সব একদম খালি। ধুয়ে মুছে তুলে রাখা। আপনি রান্না করেন নি? সারাদিন খাননি?’
নীড় জবাব দিলো না। চোখ বন্ধ করে মাথা ওপাশে হেলালো। নুসরাত বড় করে শ্বাস ফেলে দু’তলায় গেলো। খাবার নিয়ে এসে নীড়ের সামনে বসে বলল,
‘একা খেতে পারবেন?’
নীড় বিরক্ত হলো, ‘তোমাকে খাবার আনতে কে বলেছে? নিয়ে যাও।’
‘খাইয়ে দেবো?’
নীড় জলপট্টি সরিয়ে বিরক্ত মুখেই থালা’টা নুসরাতের হাত থেকে ছিনিয়ে নিলো। এরপর গাপুসগুপুস করে খেলো। নুসরাত ঠোঁট টিপে হাসলো। খাওয়ার পর পানি এগিয়ে দিলো। নীড় একবার চেয়ে দেখলো। নুসরাত মিষ্টি করে হেসে বলল,
‘দেখবেন এখন জ্বর কমে যাবে।’
নীড় গ্লাস রেখে একবার সচেতন দৃষ্টিতে নুসরাত কে দেখে নিলো। এরপর ইশারায় বিছানার এক কোণা দেখিয়ে বলল,
‘ওখানে বসো।’
নুসরাত অবাক হলো। দৌড়ে গিয়ে বসলো। পা নাচালো। এতোটা খুশি হলো যে সে জীবনে কখনো হয়নি। নীড় তাকে বিছানায় বসতে বলল? নিজ মুখে? সে উচ্ছ্বসিত। নীড় বড় করে শ্বাস টেনে নিলো নিজের মাঝে। এরপর খুব শান্ত স্বরে বলল,
‘দেখো নুসরাত, তুমি যা ভাবছো তা ঠিক নয়। সেটা ভুল।’
নুসরাতের পা নাচানো থেমে গেলো। অবুঝ গলায় শুধালো,
‘কোনটা ভুল?’
পরক্ষণেই আবারো পা নাচিঁয়ে পাত্তাহীন কণ্ঠে বলল,
‘যাক গে, কোনটা ভুল কোনটা ঠিক আমি জানতে চাই না। আমার কাছে আমি ঠিক।’
নীড় অস্বস্থি বোধ করলো। থেমে থেমে বলল,
‘তোমাকে জানতে হবে। তুমি পুরোটাই ভুল।’
‘কি ভুল?’
‘আমি… আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি।’
প্রায় সাথে সাথে বাতাস থমকে গেলো। নুসরাতের দৃষ্টি স্থির হলো। চঞ্চল পা দুটো নিশ্চল হয়ে এলো। অস্পষ্ট কণ্ঠে শুধালো,
‘কিহ?’
‘হুম। আমি আমার দুষ্টুকে ভালোবাসি।’
কথাটা যেন হাই ভোল্টেজে ঝটকা লাগলো নুসরাতের মনে, ‘আমার?’
পরক্ষণেই বলে, ‘মিথ্যে কথা। তাই না? আমি জানি। আপনার জ্বর বোধ হয় বেড়েছে। শুয়ে ঘুমান তো একটু।’
নুসরাত জোরপূর্বক হাসছে। নিজেকে নিজে বুঝ দিতে চাইছে। নীড় ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলল,
‘নাহ। কোনো জ্বর নেই। আমি সজ্ঞানে বলছি। আমি জানি, তোমার মনে আমার জন্য অন্যরকম কিছু তৈরি হয়েছে যা আরেকটু প্রশ্রয় দিলে আমার অন্যায় হয়ে যাবে।’
ঘন ঘন বজ্রাঘাতে ছিন্নভিন্ন হলো নুসরাতের হৃদয়কূল। চোখের একপাশ’টা ভিজে উঠতেই টিমটিমে হলুদ আলোর আড়ালে মুছে ফেলা হলো। পরমুহূর্তেই মেকি হাসি ঠোঁটের কোণায় জাগিয়ে তুলে প্রশ্ন করলো একের পর এক। যেন সে খুব খুশি। খুব! তার কষ্ট নেই। কোনো কষ্ট নেই।
‘কিভাবে পরিচয় আপনাদের?’
‘ইউনিভার্সিটিতে’ই।’
‘ওহ। সেও আপনাকে ভালোবাসে?’
‘দু’বছরের সম্পর্ক।’
নুসরাত ঠোঁট টিপে কান্না আটকালো, ‘খুব ভালোবাসেন?’
কেমন কেঁপে কেঁপে উঠলো তার সারা দেহ। নীড় উৎকণ্ঠা বোধ করলো। দুষ্টুর কথা বলতে তার সর্বদা ভালো লাগে। কিন্তু বলার মানুষ নেই। সে ভীষণ ভালো লাগা নিয়ে বলে গেলো। নুসরাত অনিচ্ছায় অন্যমনস্ক কৌতুহল নিয়ে শুনলো।
‘ওর খুশির জন্য নিজের জীবন উপেক্ষা করতে পারি। আমার জীবনের প্রথম প্রেম। প্রথম দেখায় প্রেম। Love at first side. জানো, প্রথম প্রথম তো দুষ্টু আমাকে সহ্যই করতে পারতো না। খুব ঝগড়া হতো। আমি ওর এক ইয়ার সিনিয়র ছিলাম। ওর জন্য আমি এক ইয়ার লস দিয়েছি। আমরা ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে ছিলাম। ও একটা সাবজেক্ট একটু কম বুঝতো। আমি ওকে নোট দিয়ে সাহায্য করতাম। ওর সমস্যা গুলো মাঝে মাঝে বুঝিয়ে দিতাম। আস্তে আস্তে আমাদের মাঝে ঝগড়া কমে এলো। ভাব হলো। জানো, আমি ওকে সাইকেল চালানোও শিখিয়েছি। যদিও ও এখনো ঠিক মতো চালাতে পারে না। কিন্তু তাতে কি? হাতে হাত রেখে শিখিয়েছি তো। এটাই অনেক! ওই যে বারান্দার এক কোণায় সাইকেল’টা। আমি যত্ন করে রেখেছি। ওর সাথে স্মৃতিময় কোনো জিনিস আমি কক্ষনো হেলাফেলা করি না।’
নীড় বলছে মুগ্ধ চোখে বিভোর কণ্ঠে। নুসরাত বারান্দা গলিয়ে চাইলো। সাইকেলের হ্যান্ডেল দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। নীল রঙা সাইকেলটা দেখে নুসরাতও একদিন বলেছিলো,
‘সাইকেল টা কি সুন্দর! আমাকে চালানো শিখাবেন? আমি চালাতে পারি না।’
নীড় খুব সুন্দর ভাবে অবজ্ঞা করেছিলো। হয়তো সেসব কথা নীড়ের মনেও নেই। মনে না থাকারই কথা। সে তো আর নুসরাত’কে পছন্দ করে না। ভালোবাসে না। ওর বুক ফেটে রক্তকান্না বয়ে আসতে চায়। নীড় আবার বলল,
‘ওর জন্য কয়েকটা কবিতা সাজিয়েছি আমি।’
নুসরাত চকিতেই তাকালো ছোট্ট বুকশেলফের এক কোণায় থাকা খয়েরী ডায়েরি’টার দিকে। এই ডায়েরি’টা লুকিয়ে একদিন পড়েছিলো। পাচঁ ছটা বেশ সুন্দর কবিতা লেখা। তখনের ওই সময়টাতে নুসরাতের মনে হয়েছিলো, এই কবিতা গুলো বুঝি তার সম্পত্তি। তার জন্য লেখা। কবিতার নায়িকা’টি বোধ হয় সে। একান্তই সে!
সেসব কথা ভাবলে নুসরাতের এই সময়’টায় এসে অনুশোচনা হচ্ছে। লজ্জায় কুকড়ে যাচ্ছে সে। অবহেলার অপমানে হৃদয় জর্জরিত হয়ে পরছে। কেনো এতো আগ বাড়িয়ে ভেবেছিলো? এতো বেশি ভেবেছিলো বলেই না আজ এতোটা কষ্ট পাচ্ছে। সবথেকে বেশি কষ্ট হচ্ছে এই ভেবে যে, এই মানুষ’টা জানে নুসরাত তাকে ভালোবাসে তবুও তার করার কিচ্ছু করার নেই। কি সুন্দর অবহেলা তাই না? কী করুণা! নুসরাত’টা ভীষণ মূল্যহীন হয়ে গেলো। ভীষণ! ইশশ.. কি অদ্ভুত ব্যথা হচ্ছে!
নুসরাত উঠে দাড়ালো। এরপর চোখের পলকে দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো৷ মাগরিবের আযান পরেছে তখন মাত্র সবে মিনিট বিশেক হয়েছে। এখনো সন্ধ্যের ভাবমূর্তি ফুরোয়নি। নীড় কাঁপা হাতে দুষ্টুকে ফোন করলো।
‘আসবে একটু?’
দুষ্টু অবাক হয়ে ডাকলো, ‘নীড়? এখন?’
‘হ্যাঁ, একটু আসো না। আমার ভালো লাগছে না। কতদিন তোমায় দেখি না।’
দুষ্টুর বুকে পাথর চাপা পরলো। ঠোঁট চেপে ধরলো,
‘কণ্ঠ এমন শোনা যায় কেনো? অসুস্থ হয়ে পরেছো আবার?’
নীড় ক্রমাগত মাথা নাড়িয়ে বাচ্চাদের মতো বলে, ‘নাহ। তুমি আসো।’
‘হঠাৎ এমন বাচ্চামো করছো কেনো?’
নীড় অসহায় গলায় বলে, ‘আসো না একটু। প্লিজ…। একটু এলে কি হবে?’
দুষ্টু হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। মৃদুস্বরে বলে, ‘আসছি। তবে কিছুক্ষণের জন্য।’
চলবে❤️