#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-২
(১৮+ এলার্ট)
২.
সিএনজির পেছনের সিটে বসা ছেলেমেয়ে দুটো তখন ঘনিষ্ঠ অবস্থায় বিদ্যমান। হালকা পাতলা ফিসফিসানি আওয়াজ রাত প্রহরের নিস্তব্ধতা ভেঙে হঠাৎ হঠাৎ কানে উঁকি দিচ্ছে জোরালো ডঙ্কারে। দুষ্টু বসেছে মেয়েটার পাশে। মাঝখানে বসা মেয়েটা মুচড়া-মুচড়ি করে মাঝেমাঝেই সতর্ক দৃষ্টিতে দুষ্টুর দিকে তাকিয়ে আবারো ছেলেটার কাধে মাথা এলিয়ে দিচ্ছে ভীষণ শ্রান্ত মুখে। দুষ্টু আড়চোখে ড্রাইভারের সামনে আয়নার দিকে তাকালো। ফেলে আসা কোনো এক ফ্লুরোসেন্ট এর আলোয় দেখতে পেলো ড্রাইভারের ঠোঁটে মিটমিটে হাসি। তার কাছে বেশ উপভোগ যোগ্য পরিবেশ। সিএনজির পেছনের সিটগুলোতে শুধু তারা তিনজন, সামনের সিটে কোনো যাত্রী নেই।
দুষ্টু কানে হেডফোনে লাগালো। ক্লান্ত দৃষ্টিতে রাত আট’টার ঝুম ঝুম তিমিরের গহ্বরে তাকিয়ে রইল ক্ষণকাল। তখন মনে হলো, হাওয়ায় দুলানো গাছেরা তাকে সানন্দে সংবর্ধনা জানাচ্ছে নতুন পরিবেশের নতুন জীবনে। গাছের কালো জটলার ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ বাদুরের ঝাপটানো শুনে চমকে উঠে পরক্ষণেই আবার মনে হলো, তাকে এই মাত্র বিশ্রীভাবে ভৎসর্না জানানো হলো। আধাঁরের হাওয়ায় দোল দিলো কালো বোরকার পাট্টা। অযত্নের সহিত বাধা বুকের ডান পাশে পরে থাকা নেকাপের একাংশও হাওয়ায় বিলীন হতে হতেই উড়ে চলে এলো বারংবার চোখে-মুখে। পাশ থেকে ভেসে আসা অস্বস্থিকর শব্দ… হাওয়ায় চোখে মুখে উড়তে থাকা এই নেকাপের অংশ… বাদুরের ঝাপটানো… অমাবস্যার এই কালো রাত্রি সবই যেনো বিরক্তির প্রতীক। ভয়ানক কিছু ঘটে যাওয়ার আসন্নবার্তা। বিরক্তের চরম পর্যায়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই সিএনজি এসে থামলো কমলাপুর রেইলস্টেশনে। দুষ্টু সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নিচু গলায় হঠাৎ’ই বলে ফেলল,
‘এমন বিচ্ছিরি ভাবে হাসবেন না। মুখ বন্ধ করুন।’
আকস্মিক এহেন কথায় আর ধমকে সিএনজি ওয়ালার চোয়াল খসে পরার জোগাড়। দুষ্টু বিরবির করতে করতেই পেছন থেকে ব্যাগ নামাতে গেলো। ছেলে-মেয়ে দুটো এখন স্থির হয়ে বসে স্বাভাবিক গল্প করছে। ছেলেটার হাত খুব যত্নসহকারে মেয়েটার হাত ধরা। স্টেশন থেকে আসা ক্ষীণ আলোয় দুষ্টু দেখতে পেলো মেয়েটা দেখতে ভারি সুন্দর!
৩.
২নং প্লাটফর্মে এসে দাড়াতেই পেছন থেকে কাধের নেকাপ সহ বোরকায় টান পরলো। দুষ্টু ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে সিড়িন হক’কে দেখেই চমকে উঠলো। বিস্ফোরিত অস্থির দৃষ্টিগুলো নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে ফের চাইলো মহিলা’টির দিকে। গলার স্বর পাল্টানোর চেষ্টায় যতটা সম্ভব কিন্নর করে বলল,
‘জি বলুন।’
সিড়িন হক একবার দুষ্টুর লাগেজের দিকে তাকালেন। লাগেজ’টা তিনি সম্ভবত চেনেন। সিড়িন হকের দৃষ্টি অনুসরণ করতেই দুষ্টু সাথে সাথে পা দিয়ে ধাক্কা মেরে লাগেজ’টা নিজের পেছনে পাঠিয়ে দিলো। প্লাটফর্মের মেঝের সাথে চাকার ঘর্ষণের শব্দেও দুষ্টুর পিলে চমকে উঠলো। পরপর কয়েকবার ঢোক গিলতেই দেখা গেলো, সিড়িন হক এই ভরা প্লাটফর্মে আশ্চর্য কাজ করে বসলেন। দুষ্টুর নেকাপ ধরে নিচে নামিয়ে দিলেন। সাথে সাথেই দৃশ্যমান হলো তার জমকালো চকচকে চাপা গাল, টানা গোল সাজানো চোখ, নিখুঁত সুন্দর আকাঁনো ঠোঁটে গাঢ় গোলাপি রং, চোখা নাকের উপরিংশে চকচকে ভাব, ছোট্ট কপালের নেকাপের নিচ অংশ থেকে উঁকি দিচ্ছে টিকলির কিয়দংশ। দুষ্টু আচম্বিতে থমকে গেলো। এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে তার মন বলল,
‘আল্লাহ! এই মহিলা এত্তো ডেঞ্জারাস!’
দুষ্ট এদিক ওদিক তাকিয়ে ঠোঁট আলগা করে অপ্রস্তুত হাসি দিলো। সিড়িন হকের দিকে তাকিয়ে হাতের আঙ্গুল গুলো ঢেউয়ের মতো দু’বার নাড়িয়ে বেক্কলের মতো বলল,
‘হাই আন্টি। হোয়াট’স আপ?’
সিড়িনা হকের নাকের পাটাতন ফুলে গেলো। দুষ্টুর নেকাপ আবারো সজোরে একটানে তুলে দিয়ে মুখ ঢেকে দিলেন। শক্ত করে ওর হাত ধরে যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই কঠিন মুখে এগিয়ে চললেন। গাড়ির কাছাকাছি গিয়ে ড্রাইভারকে বললেন, প্লাটফর্ম থেকে লাগেজ’টা আনতে। ড্রাইভার ছুটে লাগেজ’টা এনে গাড়ি স্টার্ট দিলো। সিড়িন হক সিটে মাথা এলিয়ে দিলেন। দুষ্টু যখন বাড়ির পেছন দিয়ে বেরিয়ে সিএনজিতে উঠলো সিড়িন হকও তখন গাড়ি নিয়ে দুষ্টুর পেছন পেছন ধাওয়া করলো।
সিড়িন হোক তার বন্ধ চোখ দুটো একটানে খুলতেই দেখলেন দুষ্টু তার মুখের ওপর এসে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। যেনো বিশাল গবেষণা চলছে। তিনি চোখ গরম করে তাকিয়ে সোজা হয়ে বসে গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন,
‘সিড়িন হক একই ভুল দু’বার করে না, মনে রাখবে।’
দুষ্টু গোপনে মুখ টানা মেরে অন্যদিকে ঘুরে বসলো। একটুপর আবারো সিড়িন হকের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো তিনি সিটে মাথা এলিয়ে ভ্রু কুচকে ওর দিকেই তাকিয়ে আছেন। দুষ্টু কাঁদো কাঁদো মুখে বলল,
‘বিয়ে’টা তবে করতেই হবে আন্টি?’
‘আম্মু ডাকো।’
বলেই সিড়িন হোক চোখ বন্ধ করে অন্যদিকে ঘুরলেন। দুষ্টু ভ্রু কুটি করে তাকালো। সিড়িন হক চোখের কপাট বন্ধ রেখেই বললেন,
‘পঁচিশে এসে ঠেকেছো সে খেয়াল আছে? বুড়ি হওয়ার আর কিছু বাকি নেই। তাও বিয়ে করার নাম-ধাম নেই। ঘরের খুটি হওয়ার চিন্তাভাবনায় নেমেছো নাকি?’
বুড়ি? দুষ্টু ঠোঁট ফুলিয়ে তাকালো। বিস্মিত প্রসারিত চোখ দুটো ঘুরে বেড়ালো সিড়িন হকের ধারালো মুখপানে। কিছুক্ষণ অবাকতায় চেয়ে থেকেই নির্লিপ্ততা ঘিরে ধরলো তাকে।
৪.
বাইরে তখন ঠান্ডা হাওয়া। ভ্যাপসা গরমে ভিজে চুপচুপে শরীরটায় হাওয়া লেগে ঘাম শুকিয়ে শরীরে বসে যাচ্ছে। দুষ্টু ঘরের এমাথা থেকে ওমাথা পায়চারি করে ভীষণ অসহায় মুখে বিছানায় বসলো। পানি খেলো। কেমন মিষ্টি মিষ্টি ভাব পানিতে। বোধহয় সর্দি লাগবে। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসে দৃষ্টিকে ফোন লাগালো। ফোন ধরা মাত্র দৃষ্টি নিজস্ব ভাষায় বলে চললো,
‘শোন, কি হইছে! ভার্চুয়ালগত পরিচিত একটা ছেলে আমার ন্যুড পিক চেয়েছে। পরে তোর দুলাভাইরে দেখাতেই, সে হেসে কুটিকুটি। তোর দুলাভাই বলছে…
দৃষ্টিকে মাঝপথে থামিয়ে দুষ্টু ভীষণ বিরক্তিতে রাগী স্বরে বলে উঠলো,
‘তুমি একটা ফাজিল। আর তোমার জামাই একজন অসুস্থ মানুষ। বউ অন্য লোকের সাথে ফ্লার্ট করে। সেই লোক আবার ন্যুড পিক চায়। সেসব দেখে তোমার বর হাসে? সিরিয়াসলি? মস্তিষ্ক নাই তোমার জামাইয়ের? আর তোমার কি লজ্জা সরম বলতে কিচ্ছু নেই? পানি দিয়ে গিলে খেয়ে ফেলেছো সব? আমার বোন হওয়ার ন্যুনতম যোগ্যতা কিভাবে অর্জন করলে সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার। তার সাথে আফসোস থেকে যাবে নিজ হাতে একজন কুলাঙ্গারের সাথে তোমার বিয়ের বন্দোবস্ত করেছি আমি।’
‘হইছে থাম! আর অপমান করিস না। তা এতো হাইপার কেন? কি হয়েছে?’
‘কি হয়েছে মানে, আর half an hour পর আমার বিয়ে। আর তুমি আমাকে তোমার ন্যুড পিকের গল্প শুনাইতেছো?’
‘আচ্ছা আচ্ছা চিল্লাইস না। কুল কুল! কি করবি আর? বিয়ে করতে না চাইলে পালিয়ে যা। আমি তো এই বুদ্ধি তোকে আগেই দিয়েছি।’
‘তোমার বুদ্ধি নিয়ে তুমি মরো, আমি পালিয়েছিলাম। আমার হবু শ্বাশুড়ি আমাকে স্টেশন থেকে বেঁধে নিয়ে এসেছে।’
দৃষ্টি হতবাক গলায় বলল, ‘কিহ?আসলেই?’
‘হুম।’
‘আল্লাহ বাচাঁয়ছে। এই বিপজ্জনক শ্বাশুড়ির বাড়িতে আমি বউ হয়ে যাইনি। তুই তো শ্যাষ দুষ্টু! তোর তো কপাল পুড়লো রে।’
দুষ্টু তীর্যক কন্ঠে বলল, ‘ঘা এর উপর নুন ছিটায়ো না। তার থেকে সাহায্য করো। এবার আমি কি করবো? বলো?’
‘নীড়কে ফোন লাগা।’
‘লাভ নেই।’
‘কেনো?’
‘নীড় সেই চট্টগ্রাম ওর গ্রামের বাড়িতে গিয়েছে। ওর তো বাবা-মা বেঁচে নেই। গ্রামের বাড়িতে ওর বাবার শেষ স্মৃতি দুই তলা বাড়িটা ওর দুই চাচা দখল করতে চাইছে। গত পনেরো দিন যাবত থেকে ও চট্টগ্রাম। যাওয়ার আগে ও কি বলেছিলো জানো? ‘আমাকে ছেড়ে নাকি এইবার ওর একদম যেতে ইচ্ছে করছে না।’ তুমি তো জানো ও কি পরিমাণ ইমোশনাল আর আমাকে নিয়ে পসেসিভ! ও গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কিছুদিন পর’ই এসব বিয়ে নিয়ে কাহিনি। বাবা আমাকে কসম দিলো, তোমার মতো কোনো ঘটনা যাতে আমি না ঘটাই। কিন্তু আমি তো আর কসম কাটিনি। মানে, এমন অবস্থা হয়েছে যে গত পনেরো দিন যাবত আমি ঠিক মতো নীড়ের সাথে কথাও বলতে পারিনি আর বিয়ের কথা কি বলবো? আর আমি তো ভেবেছিলাম বিয়ের আগমুহূর্তে হলেও ভাঙতে পারবো। কিন্তু এখন? এখন তো নীড়কে ফোন করেও কোনো লাভ নেই। ও আসতে আসতে আমার বিয়ে শেষ হয়ে বউভাত পর্যন্ত শেষ হয়ে যাবে। এক যে পালিয়েছিলাম এটা যদি এখন সিড়িন আন্টি আম্মুকে বলে দেয় তবে আরেক কাহিনি। সব মিলিয়ে হুলস্থুল কাণ্ড। আমি অনেক বড় ব্লান্ডার করে ফেললাম আপু।’
দৃষ্টি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘শ্রেয়সী? হ্যাঁ। ওকে বল।’
‘পাগল নাকি তুমি? আমি ওকে বলি আর ও আরেক কাণ্ড ঘটাক। নীড়কে ফোন করে বলে দেবে। বিয়ে বাড়ি এসে এমন হযবরল কাহিনী শুরু করবে যে শেষ পর্যন্ত বাবা হার্ট অ্যাটাক করে বসবেন। আর ওইদিকে নীড়ের অবস্থাও খারাপ হয়ে যাবে। না পারবে এই মুহুর্তে আসতে আর না পারবে সহ্য করতে। তারপর দেখা যাবে, দুই কূল’ই হারাচ্ছি।’
‘তবে কি বিয়েটা করছিস?’
‘উপায় নেই। দেখি কিছু করা যায় কিনা। দরকার পরলে বিয়ে করেই পালিয়ে যাবো।’
ক্ষণমাত্র আগের স্মৃতি হাতড়িয়ে দুষ্টু বড় করে শ্বাস ফেললো। এদিকে পালিয়ে যাওয়া হলো না, নীড়’কে জানানো হলো না, শ্রেয়সীর সাথে কথা বলা হলো না। উল্টে বাসর ঘর এসে জুটলো তার কপালে আর ওদিকে প্রচ্ছদের কপালে জুটলো ডিভোর্সের আমন্ত্রণপত্র।
চলবে❤️
#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৩
৫.
সেদিন ভোরের পবিত্র সোনালতা আলোয় ইরার চোখ জোড়া ভিজে উঠলো। হাতে তখনো প্রেগন্যান্সি কিট ধরে রাখা। ছোট্ট যন্ত্রটিতে ভেসে উঠলো দুটো লাল দাগ। সে তৃতীয় বারের মতো প্রেগন্যান্ট। মৃদু ঠান্ডা হাওয়ার অন্তর্বেদনায় তার শিথিল নয়নকূল স্রোতের গা ঘেঁষে হারিয়ে গেলো। ডান হাত’টা আস্তে করে পেটের উপর রাখতেই ঠোঁট ভেঙে নিঃশব্দে কেঁদে দিলো সে। এবারেও নিশ্চয়ই বাচ্চা’টা বাঁচবে না। মা ডাক শোনা হবে না। ছোট্ট আদুরে তুলতুলে শরীরের অধিকারী কেউ তার কোল জুড়ে বিরাজ করবে না।
প্রেগন্যান্সি কিট’টা হাতে নিয়ে ইরা অর্জনের সামনে দাঁড়ালো। কপালে এক হাত রেখে বিষন্ন মুখে রকিং চেয়ারে দুলছিলো অর্জন। ফজর নামাজ পড়ে সে আর ঘুমায় না। ইরার উপস্থিতি বুঝতে পেরে চোখ খুলে প্রিয় সহধর্মিণীর দিকে নরম চোখে তাকালো। প্রায় সাথে সাথেই যন্ত্রমানবের ন্যায় তার হাতে প্রেগন্যান্সির কিট ধরিয়ে দেওয়া হলো। অর্জন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। বহুদূরের শুন্য কোনো কোটায় চোখ নিবদ্ধ করলো। ইরা চলে যেতে নিলেই আকস্মিক ঝাপটে ধরে ওর পেটে মাথা গুঁজে দিলো। ইরা কেঁপে উঠলো। অর্জনের মাথার সাথে মাথা ঠেকাতেই ভেজা ভেজা গলায় তাকে বলতে শোনা গেলো,
‘ইরাবতী, আমরা এবার অনেক সাবধানে থাকবো। তুমি পুরোপুরি আমার সেফ জোনে থাকবে। বুঝলে?’
অর্জনের এই ভালোবাসাময় স্নেহের ডাক শুনে ইরার বুক কাঁপলো। স্থির নয়নে অস্থির মনি নিয়ে তাকিয়ে থাকলো স্বামীর মুখের দিকে ক্ষণকাল। অর্জনের মাথায় চুমু দিয়ে হালকা হাসলো। বললো,
‘এবারও যদি বাচ্চা’টা না হয় তবে তুমি আরেকটা বিয়ে করো।’
বলতে বলতেই ইরা আবারো ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলো। অর্জন উঠে দাঁড়িয়ে ইরাকে ঝাপটে ধরে বললো,
‘কেনো এসব বলো ইরা? আমার এসব ভালো লাগে না। আমার কাছে তুমিই সব। তুমি মানে অন্যরকম। তুমি মানে আমার ইরাবতী। তুমি মানে আমি যাকে ভালোবাসি।’
হাওয়ায় ভাসলো পাতার দল। বালুর ঝড় বইলো। নরম সূর্যের তেজ তপ্ত হতেই ইরা অর্জনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আরো শক্ত… আরো। ঠিক তার চেয়েও, যতটা শক্ত করে অর্জন ধরেছে। ছেড়ে দিলেই যেনো কোনো কালো যাদু জানা ডাইনি নিয়ে চলে যাবে তাদের যাদুর দেশে। অর্জনের বুকে মাথা পেতে ভাঙা গলায় ইরা বলে,
‘এতোটা ভালোবেসো না। অতি ভালোবাসায় আমি বিলীন হয়ে যাবো। চিরকাল নয় আজীবন থেকে যেতে চাই আমি।’
৬.
সিড়িন হক দুষ্টুর ব্যাপারে গম্ভীর, চিন্তিত এবং ভারি বিরক্ত! কিন্তু বড় বউয়ের সংবাদে তিনি তথাপি ঢের খুশি। তবে অপ্রকাশিত। প্রকাশ করতে তিনি নারাজ। সে স্বল্পভাষী, গুরুগম্ভীর। তার পক্ষে হঠাৎ করে চাঞ্চল্যতা দেখানো সম্ভব নয়। উৎফুল্লতা প্রমাণ করতে গিয়ে বউমাকে নিয়ে অযথা তোষামোদি করাও তার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পরবে না। বড় বউ যখন একটু আগে এসে তাকে খবর’টা দিলো তার মুখ চকমকে হয়ে উঠেছিল কিন্তু পরমুহূর্তেই কোনো কারণে কালো ছায়া নেমে এলো। ভারিক্কী স্বরে তিনি বলেছিলেন,
‘সাবধানে চলাফেরা করো।’
এদিকে দুষ্টুর গলা বসে গেছে। তাকে ঘর থেকে নিয়ে এসেছে তার একমাত্র ননদ টিয়া। আপন ননদ নয় চাচাতো ননদ। টেবিলে বসতেই দেখা গেলো বিশাল বড় টেবিলের বেশিরভাগই অপরিচিত মুখ। দুষ্টুর অবাধ্য কাশি’টা সবার সামনেই তেড়ে এলো। খাবার সামনে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতেই দু’তিনবার কাশি উঠে গেলো। সিড়িন হক ভ্রু বাকিয়ে তাকালেন,
‘এক রাতে ঠান্ডা ধরালে কীভাবে?’
দুষ্টুর শরীর কেঁপে উঠলো। মহিলার কন্ঠ শুনলেই শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেনো তাদের জোড়া ছেড়ে দেয়। খুকখুক করে আরো দু’একবার কেশে নিয়ে বলল,
‘পানি চেঞ্জ হয়েছে তো, তারউপর অতিরিক্ত গরম তাই বোধহয়।’
সিড়িন হকের একটি মাত্র দেবর। সেই দেবরের একমাত্র পুত্রবধূ কোণা চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো,
‘কেনো? আর কোথাও গরম নেই? তোমার বাবার বাড়িতে গরম নেই? গরম বুঝি শুধু আমাদের বাড়িতেই পরেছে?’
নীরার বিদ্রুপাত্মক কথা টের পেয়ে দুষ্টু খাওয়া থামিয়ে দাঁত বের করে হেসে উত্তর দিলো ,
‘আমার রুমে দক্ষিণ দিকে একটা এসি আর পশ্চিম দিকে আরেকটা এসি। অনেক আদরে মানুষ হয়েছি তো। আমার বাড়িতে গরম কি জিনিস সত্যি বুঝিনি গো। এই তোমাদের বাড়িতে এসেই বুঝলাম।’
প্রচ্ছদ এক ধ্যানে খেয়ে চললো। দিন দুনিয়ার কোনো হুশ তার নেই। খাওয়াই এই মূহুর্তে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কাজ। টিয়া মুখ চেপে হাসলো। নিজের আপন ভাবী হওয়া সত্ত্বেও নীরার খানিকটা অহংকার আর মানুষকে ছোট করে কথা বলার জন্য টিয়া ওকে তেমন একটা পছন্দ করে না। নীরা মুখ বাঁকালো। বিস্ময়ের ভান করে বলল,
‘তোমাদের বাড়ি বলছো কেনো? এটা কি এখন তোমার বাড়ি নয়? আমিও বউ তুমিও বউ।’
দুষ্টু মিষ্টি করে হেসে হেসেই বলল, ‘বলেছি তাতে কি হয়েছে? এটা কি তোমাদের বাড়ি নয়? আমি কি ভুল বলেছি? তুমি আমি তো জা। একই বাড়ির বউ। ওতো কথা ধরতে আছে নাকি?’
নীরার দৃষ্টিতে চমক খেলে গেলো। এই মেয়ের এতো চ্যাটাং চ্যাটাং কথার সাথে টক্করে না পেরে তার ভেতরটা পরাজয়ের আগুনে টগবগিয়ে ফুটলো কিছুক্ষণ। যথারীতি খেতে খেতে নীরা আবারো ঠেস মেরে বলল,
‘তুমি তো বেশ ভালোই তর্ক করতে পারো। বিতর্ক প্রতিযোগিতা করতে নাকি?’
দুষ্টু খোঁচা বুঝে উত্তরে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই পাশ থেকে প্রচ্ছদ টেবিলের নিচে ওর হাত চেপে ধরলো। দুষ্টু সাথে সাথে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
‘বউয়ের হয়ে প্রতিবাদ করতে পারবেন না তো আমাকেও দমিয়ে রাখবেন না। আমার’টা আমাকেই বুঝে নিতে দিন। এতোক্ষণ যেভাবে চুপচাপ গিলছিলেন তেমন ভাবেই গিলুন।’
প্রচ্ছদ উপহাসের সুরে দুষ্টর ন্যায় নিচু কণ্ঠে বলে, ‘তিন মাসের বউ।’
দুষ্টুর ভীষণ রাগ হলো। রাগের চোটে টেবিল উল্টে ফেলে চলে যেতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু করা হলো না৷ সিড়িন হক মোটা স্বরে বললেন,
‘নতুন বউদের এতো কথা বলতে নেই। আগে একটু পুরোনো হও।’
টেবিলে খাবারের তদারকি করছিলো ইরা। শ্বশুড়-শাশুড়ীর দেখভাল’ই বেশি করছিলো। ইফতার হক নরম সুরে বললেন,
‘বসো মা। এতো কাজ করতে হবে না। খেয়ে নাও।’
ইরা কিন্নর সুরে বলল, ‘না বাবা। সমস্যা নেই। আপনারা খেয়ে নিন তারপরে আমার খাওয়ার চিন্তা করা যাবে।’
সিড়িন হক কপাল কুচকে বললেন,
‘কাজ ছেড়ে খেতে বসো। বাচ্চা কাচ্চা এবার অন্তত হয়ে যেতে দাও। আর কত গাফিলতি করবে? মা হতে ইচ্ছে করে না তোমার?’
ইরা করুণ চোখে তাকালো। মার কথা শুনলে মনে হয় সে ইচ্ছে করে প্রতিবার বাচ্চা নষ্ট করে। অর্জনের পাশের চেয়ারটায় বসতেই ইরার টলমলে চোখ দুটো অর্জনের চোখে সূচালো ভাবে ধরা পরলো। রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ হলো। ইরা টেবিলের নিচে এক হাত দিয়ে অর্জনের হাত চেপে ধরলো আরেক হাত দিয়ে ইশারায় চুপ থাকতে বোঝালো। তবুও অর্জন চামচের টুংটাং শব্দ তুলে মাথা নিচু করে খেতে খেতে উত্তর করলো,
‘এতোই যেহেতু ভাবছো, তবে ওর খাবারটা উপরে পাঠিয়ে দিলেই তো হয়। কষ্ট করে নিচেও নামতে হয় না আর কাজও করতে হয় না।’
সিড়িন হক ছেলের দিকে ভয়ানক দৃষ্টি মেলে বললেন,
‘তুমি জানো না আমাদের বাড়িতে তিনবেলা একসাথে বসে খাওয়ার নিয়ম?’
‘আট-দশ মাস একসাথে বসে না খেলে নিশ্চয়ই নিয়ম পাল্টে যাবে না, মা।’
ইফতার হক মাথা উঁচু করে বললেন,
‘তর্ক করো না, অর্জন। বউমার খাবার ঘরেই পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এতে এতো কথা কাটাকাটির কি প্রয়োজন?’
সিড়িন হক খাওয়া থামিয়ে দিলেন। বললেন,
‘কেনো? সাজিদের বউয়েরও তো বাচ্চা হয়েছে। কই ওকে তো ঘরে খাবার পাঠাতে হয়নি।’
নীরা এক পলক পাশে বসা স্বামীর দিকে তাকালো। সাজিদ নির্বিকার। লোকমা তুলছে। কোনো হেলদোল নেই। সবুজা হক নিজের বউমার প্রশংসা শুনে ভীষণ খুশি হলেন। প্রশংসা পেলেই তাকে আর পায় কে! কোলে তার দু’বছরের নাতি ‘আকাশ’। তাকে খাওয়াতে খাওয়াতে তিনি মুচকি মুচকি হাসলেন। অর্জন খাওয়া থামিয়ে দিয়েছে। কঠিন মুখে বলছে,
‘নীরার তো আর ইরার মতো দু’বার মিসক্যারেজ হয়নি তাই না, মা?’
ইরা অর্জনের হাত চেপে ধরে আস্তে করে বললো, ‘আহা! চুপ করো না। খাওয়া শেষ করো।’
অর্জন রক্তলাল চোখে তাকিয়ে বললো,
‘তুমি চুপ করো। সমস্যাগুলো তোমার মাঝেই। তোমার কি দরকার আগ বাড়িয়ে কাজ করতে যাওয়ার? বাড়িতে তিন তিনটে বউ আছে। কেউ কাজ করে? দুষ্টু নাহয় সবে এসেছে কিন্তু…? তোমার এতো কাজ করতে হবে কেনো?’
নীরা মুখের সামনে লোকমা ধরেও আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে ঝরঝর করে ভাত পরে গেলো। বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো,
‘কথাটা কি আমাকে বললেন ভাইয়া?’
অর্জন আগুন গরম চোখেই নীরার দিকে তাকালো। দুষ্টু হা করে এতোক্ষণ একান্নবর্তী পরিবারের ছোট খাটো কথা থেকে বিশাল বড় এক ঝামেলার লাইভ টেলিকাস্ট দেখছিলো যেনো। তার মৃদু আফসোস হলো অর্জনের মতো এতো ভালো একটা ছেলে রেখে সে নিজ হাতে একজন বর্বর এবং বেত্তমিজের সাথে নিজের বোনকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলো। নীরার দিকে এক পলক চেয়ে সে বিরবির করে বলল,
‘পরলো কথা সবার মাঝে, যার কথা তার গায়ে বাজে।’
দুষ্টুর কথা কেউ না শুনলেও প্রচ্ছদ গোপনে ঠোঁট চেপে হেসে দিলো। এরপর আস্তে করে দুষ্টর হাতে দু’আঙ্গুল দিয়ে সতর্কতার বার্তা হিসেবে টুকা দিলো। দুষ্টু টেবিলের নিচেই প্রচ্ছদের হাতে জোরে একটা চিমটি কেটে আগুন গরম চোখে তাকিয়ে রইলো যেনো চোখ দিয়েই আজ ওকে ভস্ম করে ছাড়বে।
চলবে❤️