এমন একদিন সেদিন পর্ব-২৩+২৪+২৫+২৬

0
2

#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-২৩
৪৯.
সন্ধ্যের কালচে হলুদাভ ভাব ঘুচে ধীরে ধীরে সাক্ষাৎ দিচ্ছে ঘন, প্রকট, জমাট বাধা শর্বরের দল। গাছে গাছে পাতাদের মড়মড় শব্দ। বাদুড়ের পাখা ঝাপটানোর ধ্বনি। সাইকেল, রিক্সার টুংটাং বেল। রিক্সা থামলো এঁদো গলি’টার সামনে।

দুষ্টু যখন রংচটা বাড়ি’টার সামনে পৌছালো তখন ঘড়িতে বাজে সাড়ে ছ’টা। সন্ধ্যে পেরিয়েছে আরো ঘণ্টা খানেক আগে। বাড়িটার আশেপাশে আগাছায় ভরপুর। ট্যাংকির পানি পরে যাওয়ার টুপটুপ শব্দের প্রতিধ্বনি। বাড়ি ঘেঁষে বাড়ি থাকায় জায়গাটায় অন্ধকার ঘন জাল বুনেছে নিবিড় সাচ্ছন্দ্যে। গেটের সামনে আসতেই দুষ্টুর চোখ পড়লো তমসার বেড়ি ভেদ করে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা শিউলি ফুল গাছ’টার দিকে। সে বড় বড় শ্বাস ফেলে একবার আশেপাশে তাকালো। চারিদিক কেমন গা ছমছমে পরিবেশ। শরীর’টা আবার ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো তখন, যখন ভাবনা এলো, সে হক বাড়িতে কাউকে কিছু না জানিয়েই এসে পড়েছে। ভাবনা’টা আসতেই বুকের মাঝে তপ্ত নিঃশ্বাস ছড়িয়ে পরলো দামাল বেশে।

নীড় বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় শুয়েছিলো। চোখের কপাট বন্ধ। হঠাৎ শব্দ হলো। সে ভ্রু কুচকে চোখ খুলতেই দেখলো প্লাস্টিকের চেয়ারটার উপর মেয়েদের ব্যাগ রাখা। নীড় অবাক হয়ে তাকালো। দুষ্টু বিছানার কোণায় বসে পা দুলিয়ে বলল,

‘দরজা খোলা কেনো?’

নুসরাত যাওয়ার সময় বোধ হয় লাগিয়ে দিয়ে যায়নি। নীড় কথা’টা বলল না। নিজে নিজেই ভাবলো। তবে তার চোখে তখনও বিস্ময়তার ঢেউ। দুষ্টু উঠে এসে নীড়ের কপালে হাত রেখে চিন্তিত ভঙ্গিতে শুধালো,

‘আবার জ্বর বাধালে কি করে? ওষুধ খেয়েছো?’

নীড় মাথা নাড়িয়ে না করে। দুষ্টু ব্যাগ থেকে নাপা বের করে খাইয়ে দিতেই প্রশ্নটা করলো নীড়,

‘তুমি এখানে কেনো?’

দুষ্টু বোকা বনে গেলো। নীড়ের বাহুতে জোরেসোরে থাপ্পড় মেরে দিয়ে বলল, ‘নিজেই তো ফোন দিয়ে আসতে বললে।’

নীড় দ্বিগুণ বিস্ময়তা নিয়ে বলে, ‘আসতে বললেই আসতে হবে? জ্বরের ঘোরে কি নাকি বলেছি! এই রাতে তুমি এসেছো কেনো?’

দুষ্টু আকাশ সমপরিমাণ বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘এসেই তো পরেছি। এখন এসব বলছো কেনো?’

ক্রমাগত অদ্ভুত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো নীড়। আস্তে করে বলে, ‘তাও ঠিক।’

দুষ্টু উঠে দাড়াতে দাড়াতে ঘড়িতে চোখ বুলালো। রাত আট’টা বাজে। বলল, ‘পেটে কিছু পরেছে?’

‘হুম।’

দুষ্টু রান্নাঘর থেকে একবার ঘুরে এলো। এরপর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি খেয়েছো তুমি?’

‘দু’তলা থেকে খাবার পাঠিয়েছিলো।’

নীড় একটু নিচু গলায় বলে। দুষ্টু ভ্রু কুচকায়। বলে,

‘নুসরাত নিয়ে এসেছিলো?’

নীড় আবার মাথা ঝাঁকালো। দুষ্টু কয়েক পলক নিরবে তাকিয়ে থাকলো। এরপর বারান্দার দিকে পা বাড়ালো।মিনিট পাচেঁক কাটলো। ঘরের মাঝে পিনপিনে নিরবতা। শীতের মৌসুম না আসতেই জবরদস্ত ঠান্ডা পরে গেছে এবার। মাথার উপরে ফ্যান বন্ধ। ফিসফিসে আওয়াজ’টাও তুমুল বেগে মস্তিষ্কে লাগছে। বারান্দার বেলি ফুলের গাছ’টায় হাত ছুইঁয়ে দিতে দিতে বলে উঠলো দুষ্টু,

‘আজকাল তোমার একটু বেশি খেয়াল নেয় তাই না? মেয়েটা কিন্তু সুন্দর আছে!’

নিরবিচ্ছিন্ন নিরবতা ভেদ করে দুষ্টুর কথাগুলো প্রতিধ্বনি হয়ে এলো। নীড়ের বোধ হলো, সে গুহায় বাস করছে এই মূহুর্তে। শীতের সময় এই একটা ঝামেলা। ফ্যান বন্ধ করলেই কেমন দমবন্ধকর পরিস্থিতি। নীড় আড়চোখে দৃষ্টি লুকিয়ে তাকালো। দুষ্টু ঘরময় ঘুরে ঘুরে দেখছে। হাত দিয়ে প্রতিটা জিনিস স্পর্শ করছে। উল্টেপাল্টে দেখছে। নীড় বিরবির করলো, ‘নিজের খাল নিজে কাটো! কেমন বোকা পুরুষ তুমি!’

বস্তুত, নুসরাত দুষ্টুর সম্বন্ধে কিছু না জানলেও, নুসরাতের ব্যাপারে সম্পূর্ণটাই জানে দুষ্টু। মাস ছয়েক আগেই দেখা হয়েছিলো। ভার্সিটির সামনে। কারোর জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে নুসরাত’কে। কিন্তু সেটা নিছকই বাহানা। নীড়কে এক ঝলক দেখার পায়তারা। নুসরাত যখন দাঁড়িয়ে ছিলো তখন সন্তপর্ণে গাছের আড়ালে নিয়ে গিয়ে নীড় দুষ্টুকে দেখিয়েছে। তবে নুসরাতের তরফ থেকে এখনো দেখা হওয়া হয়নি।

নীড় গলা পরিষ্কার করলো। চোর চোর কণ্ঠে বলল,

‘আসতে সমস্যা হয়নি?’

দুষ্টু আবার বারান্দার দিকে গিয়েছে। সেখান থেকেই উত্তর’টা ভেসে এলো, ‘আজ তো প্রথম আসছি না।’

‘তা ঠিক। তবে কখনো তো রাতে আসোনি।’

‘আজ এলাম।’

দুষ্টু তখন সাইকেলের প্যাডেল ঘুরিয়ে, বেল বাজিয়ে, একটু হেলিয়ে দুলিয়ে দেখছিলো। এবার সে থেমে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ছুড়লো, ‘কি ব্যপার বলো তো? এসে কি ভুল করলাম?’

নীড় বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। অস্থির কণ্ঠে বলল,

‘এটা আবার কখন বললাম?’

দুষ্টু একটু অন্যরকম চোখে তাকালো। ঘর থেকেই নীড় তা দেখতে পেলো।

‘কি জানি! কখন কি বলছো তাও ভুলে যাচ্ছো। স্মৃতিশক্তি লোপ পাচ্ছে বোধ হয়।’

নীড় চোখ উল্টিয়ে ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেলল। সাইকেলের প্যাডেল’টা ঘুরাতে ঘুরাতে দুষ্টু বাঁকা গলায় আবার বলে,

‘হয় হয়। সুন্দরী মেয়ে আশেপাশে সারাক্ষণ ঘুরঘুর করলে এরকম একটু আধটু হয়।’

নীড় লুকিয়ে হাসলো। দুষ্টু ঘরে এসে দাড়ালো। ব্যাগ থেকে বিরিয়ানির ছোট্ট প্যাকেট বের করে পড়ার টেবিলের পাশে রেখে বলল,

‘রাতে যাতে খেয়ে নেওয়া হয়। নাকি আমার নিয়ে আসা খাবার মুখে রুচবে না?’

নীড় আবার ঠোঁট টিপে হাসলো। বলল,

‘লাগবে কি করে বলো তো? তুমি তো দোকান থেকে কিনে নিয়ে এসেছো আর ওই মেয়েটা কত কষ্ট করে রান্না করে নিয়ে এসেছে।’

দুষ্টু চোখ পাকিয়ে তাকালো। ব্যাগ হাতে নিয়ে বিরিয়ানির প্যাকেট তাতে ঢুকাতে ঢুকাতে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘বেশ, খেতে হবে না। ওর টাই খাও। আসছি আমি।’

কদম বাড়াতে গেলেই দুষ্টুর হাত টান পরলো। নীড়ের ঠোঁটে প্রচ্ছল হাসি। হাসতে হাসতেই ব্যাগ টেনে ধরে বলল,

‘ধুর পাগলি। রাগ করে কেনো? আমি তো জানি আমার পাগলি’টা রান্না পারে না। বিয়ের পর আমি শিখিয়ে দেবো তো!’

দুষ্টু বিপন্ন চোখে চাইলো। এলোমেলো দৃষ্টি। চোখের কার্ণিশে বিন্দু বিন্দু সলিলের দলের ভিড়। নীড় দুষ্টুর ব্যাগ হাতে নিয়ে বিরিয়ানির প্যাকেট’টা বের করে আবার টেবিলের এক পাশে রাখলো। এরপর সেই সলিলময় সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আশ্চর্য সুন্দরী চোখ জোড়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে সে অবাক হয়ে গেলো। প্রশ্ন করলো,

‘কি হয়েছে দুষ্টু?’

‘তুমি আমাকে কেনো এতো ভালোবাসো, নীড়?’

দুষ্টুর গলার স্বর কেমন ভাঙা ভাঙা শোনালো। শ্বাসনালীর মাঝে কি যেনো আটকে আছে। কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছে। ঘরের এক কোণার টিমটিমে হলুদ বাতি’টার আলো তার আননের একপাশে পরতেই কপোল গুলো দেখালো স্বর্ণের মতো উজ্জ্বল। চিকচিক করে উঠলো। সেই স্বর্ণখোচিত গালে পুরুষ, শক্ত, মাংশল হাত’টা পরতেই দুষ্টুর চোখের পাতা কেঁপে উঠলো। সারা শরীর অস্বস্থিতে ঝাকুঁনি দিয়ে উঠলো। সে হালকা সরে দাড়ালো। অতঃপর দৈবাৎ নীড় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। দুষ্টুর কম্পমান লোচন থেকে খুব সন্তপর্ণে জল গড়িয়ে পরলো। নীড় গালের সাথে গাল লাগাতেই দুষ্টু হালকা হেসে সরে দাড়ালো। তার মুখে ফুটে উঠেছে স্পষ্ট অসহায়ত্ব। কি আশ্চর্য! নীড় তো কখনো, কোনোদিনও এমন করেনি। দুষ্টু তো এসবে অভ্যস্ত নয়। সে তো জানে। বুঝে সব। তবুও….?

বিষয়টা পুরোপুরি এড়াতে দেয়ালে বাধাইকৃত এক মহিলা এবং পুরুষের ছবির দিকে ইশারা করে দুষ্টু জিজ্ঞেস করলো,

‘তোমার মা-বাবা তাই না?’

‘তুমি তো জানো।’

দুষ্টু মাথা ঝাঁকালো। এমন অস্বস্থিকর পরিবেশে কি করবে কি করবে ভেবে ভেবে…. পড়ার টেবিলের সামনে দাঁড়ালো। এরপর বই-খাতা উল্টাতে পাল্টাতে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করলো। নীড় দ্বিতীয় বারের ন্যায় আস্তে করে দুষ্টুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। দুষ্টু ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই নীড় বিরক্ত কণ্ঠে বলে উঠে,

‘এরকম করছো কেনো?’

দুষ্টু জোরপূর্বক হাসে, ‘আজ হঠাৎ এতো প্রেম?’

‘প্রেম তো সবসময়-ই থাকে। কিন্তু তুমি তো থাকো না।’

দুষ্টু নিজেকে আবার ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। নীড় পলকে দুষ্টুকে সামনের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। এরপর কিছুক্ষণ একচিত্তে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ধীর গতিতে তার মাথা এগিয়ে দিলো। দুষ্টু টেবিলের সাথে ঘেঁষে দাঁড়ালো। নীড়ের লালচে ঠোঁট জোড়া ক্রমশ এগোচ্ছে সেই অস্বস্থিতে কুকরে যাওয়া, সংকিত মনে, ভয়ার্ত হৃদয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে। দুষ্টু ইতস্ততভাবে হাসলো। টেবিলের দিকে ঝুঁকে গেলো। জড়তা নিয়ে বলল,

‘কি করছো নীড়?’

নীড় উত্তর দিলো না। বিবশ, বিভোর, কোনো এক মন্ত্রবলে বশীভূত হয়ে এগিয়ে গেলো। দুষ্টু ঠোঁটের উপর হাত রাখলো। নীড় হাত সরিয়ে দিলো। দুষ্টু সেকেন্ড কয়েক তাকিয়ে থাকলো হাতের দিকে। নীড়ের ঠোঁট ক্রমশ এগিয়ে আসছে। দুষ্টু এক ঝটকায় নীড়ের মুখ সরিয়ে দেয়। পরক্ষণেই এক অদ্ভুত কাজ করে বসে।

চেঁচিয়ে উঠে বলে,

‘নীড়, আমি বিবাহিত।’

তিন’টে শব্দ আলোড়ন তুলল। ঘরের মাঝে বিস্ফোরণ ঘটালো। নীড়ের মাথার উপর বজ্রপাত ঘটলো। দুষ্টু রুদ্ধশ্বাসে বললো,

‘সরে যাও প্লিজ!’

নীড় বিস্মিত চোখে দুষ্টুর দিকে এমন ভাবে তাকালো যেন দুষ্টু কোনো আজব মানুষ অধিকন্তু এই আজব নারী’টি আজব সব মিথ্যে কথা বলে তার সাথে মশকরা করার চেষ্টা চালাচ্ছে এবং তার চেষ্টায় সে পুরোদস্তুর সফল। নীড় জোরপূর্বক হাসে। অপ্রাকৃত স্বরে শ্বাস আটকে বলে,

‘মজা করো না দুষ্টু। ঠিকাছে আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি আর কিস করতে চাইবো না। অন্যায় হয়েছে আমার। মাফ করো, পাখি।’

দুষ্টুর চোখে স্রোতের ধারা। বক্ষস্থল কেঁপে উঠলো নীড়ের আদুরে বানী’তে। দুষ্টু উন্মাদের ন্যায় ক্রমাগত মাথা দুলিয়ে অসহায় চোখে অপারগ গলায় আর্তনাদ করে,

‘নীড়, তুমি যখন চট্টগ্রাম ছিলে তখন আমার….আমার বিয়ে হয়ে গেছে।’

এহেন দুর্বোধ্য কথায় নীড় পাগলপ্রায় হয়ে গেলো। সে বিশ্বাস করতে চায় না। দুষ্টুর হাত ধরে আকুতি করে এমন মজা না করার জন্য। মাথার চুল দু’হাত দিয়ে খামচে ধরে। দুষ্টু ভরা নেত্রে নিস্তব্ধে চেয়ে দেখে নীড়ের উন্মত্ততা। সে দুষ্টুকে শক্ত হাতে চেপে ধরে ক্রমাগত ঝাকিয়ে চিতকার করে বলে যায়,

‘আমি বিশ্বাস করি না। তুমি এটা করতে পারো না। মজা করছো না? প্লিজ দুষ্টু আমার এসব মজা ভালো লাগে না। তুমি তো জানো আমি এসব মজা নিতে পারি না। আমার ভালো লাগছে না। তুমি বলো এসব মিথ্যে। প্র‍্যাংক করছো। বলো না?’

দুষ্টু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে নিষ্প্রভ গলায় উত্তর দিলো, ‘মিথ্যে না।’

নীড়ের চোখ পাথর হয়ে এলো। তীক্ষ্ণ চোখে বিষন্ন স্বরে ক্ষীণ আওয়াজে শুধু বলতে পারলো, ‘সত্যি?’

দুষ্টু মাথা ঝাঁকায়। সাথে সাথে ঘর কাঁপানো চিৎকার ভেসে এলো।

‘চলে যাও। এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও। আর কক্ষনো আসবে না। প্রতারক!’

দুষ্টুর ফোলা চোখের পানি গড়িয়েছে তখন গলা অবধি। গলা থেকে বুক অবধি। এবার কোনো এক অদৃশ্য বোবা কান্নায়…. কিংবা রক্তের ধারা তার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গড়ালো। সে অবাক প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকালো। তার চোখের অশ্রুর ধারা’টা থেমে গেছে তৎক্ষণাৎ। থমকে গেছে। বুক ভরা আশা’টুকু যেন পলক ফেলতে না ফেলতেই মিশে গেলো, মিলিয়ে গেলো, নিরাশায় পরিণত হলো। তবুও বললো,

‘একবার আমার কথা’টা শুনো।’

নীড় ঘৃণ্য চাহনিতে পুনরায় গর্জন করে উঠে, ‘এই মুহূর্তে বেরিয়ে যাও।’

দুষ্টু মিনিট পাঁচেক নির্বাক নিষ্প্রাণ নেত্রে চেয়ে থাকলো। এরপর মুখে হাত চেপে ডুকরে কেঁদে ওঠে ব্যাগ হাতে তুলে চলে গেলো দৌড়ে।

নীড় পাথরের ন্যায় চেয়ে রইল টেবিলের উপর রাখা বিরিয়ানির প্যাকেট’টার দিকে।

দু’তলায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে নুসরাত দেখতে পেলো একটা মেয়ে আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে যাচ্ছে। ঠিক এই মেয়েটাই মিনিট ত্রিশ আগে জড়সড় হয়ে ঢুকেছিলো এই বাড়িতে। নুসরাত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই ভাবলো,

‘নীড় কি সব মেয়েকে এভাবেই কষ্ট দেয়? কাদিঁয়ে’ই ছাড়ে? আচ্ছা, এই মেয়ে কি সেই মেয়ে?’

চলবে❤️

#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-২৪
৫০.
এলোমেলো চিত্তে অগোছালো পা ফেলে ঘরে ঢুকতেই মেঘস্বরে শব্দটা কানে এলো, ‘কোথায় গিয়েছিলে?’

কি বিভৎস স্বর! যেন অতি কষ্টে কদর্যরূপে গলা থেকে শব্দগুলো বের করা হলো। বারে বারে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ছোট্ট ঘরটার মাঝে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এলো। দুষ্টুর সারা শরীর কেঁপে উঠলো।

‘ক’টা বাজে? এ বাড়ির বউ রাতে একা বাইরে যায় না।’

দুষ্টু নিষ্প্রভ চোখ দুটো তুলে তাকালো। প্রচ্ছদের কথাবার্তার ধরনে সিড়িন হকের ছাপ স্পষ্ট। দুষ্টু তাকানোর প্রায় সাথে সাথে প্রচ্ছদের বুক ধক করে উঠলো। কী ভীষণ লাল চোখ! দেখলে অন্তরাত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠে। এলোমেলো কিছু চুল অবিন্যস্ত হিজাবের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। মুখে অনিষ্টের ছায়া। চোখের কার্ণিশে জলের স্তূপ। এমন দুর্বোধ্য অবস্থায় প্রচ্ছদ এরআগে আর কখনো ওকে আবিষ্কার করেনি। সে বিস্ময় নিয়ে অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

‘কি হয়েছে?’

দুষ্টু নির্লিপ্ত দৃষ্টি ফেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নির্বাকে চলে গেলো। প্রচ্ছদ তাকিয়ে দেখলো তার বিশৃঙ্খল কলের পুতুলের ন্যায় পদক্ষেপ। এক পা ফেলতে গিয়ে আরেক পা ফেলছে। যেন এই ইহজগতে সে নেই। প্রচ্ছদ বুঝতে পারলো, খুব বড়সড় প্রভঞ্জন তার উপর দিয়ে বয়ে গেছে। এতোটা শান্ত, ভদ্র মেয়ে তো সে কোনোকালেই ছিলো না। প্রচ্ছদ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে ইরাকে খবর দিয়ে এলো। দুষ্টু বাড়িতে নেই বুঝতেই ইরা তড়িঘড়ি করে প্রচ্ছদকে ফোন করে ডেকে এনেছিলো। বাড়ির অন্যকেউ এ কথা জানতে পারলে এতোক্ষণে কুরুক্ষেত্র হয়ে যেতো।

আধ ঘন্টা হতে চললো। ওয়াশরুম থেকে এখনো ভেসে আসছে পানি পড়ার শব্দ। প্রচ্ছদ কপালে কুঞ্চন ফেলে কলম মুখে বসেছিলো। ঘড়ির কাটার দিকে আরেকবার তাকিয়ে শব্দ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে সে ওয়াশরুমের দরজায় গিয়ে শব্দ করলো। ডাকলো,

‘দুষ্টু, দরজা খোলো। শীতের রাতে এতো সময় নিয়ে গোসল করছো কেনো, অসভ্য মেয়ে? বের হও।’

ওপাশ থেকে কোনো প্রতিউত্তর ভেসে এলো না। প্রচ্ছদ বিরক্ত নিয়ে বলল, ‘কি ব্যাপার? বের হচ্ছো না কেনো? সর্দি লাগবে তো।’

আরো দু’তিনবার ডাকের পরেও সাড়া পাওয়া না গেলে প্রচ্ছদ ভ্রু কুচকে চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকলো। কপাল কুচকে ভাবলো, ‘অজ্ঞান টজ্ঞান হয়ে গেলো নাকি?’

প্রচ্ছদ জোরে শব্দ করে ধাক্কালো। একটুপর খট করে দরজা খুলে গেলো। প্রচ্ছদ সেদিকে তাকিয়েই স্তব্ধ হলো। সারাশরীরে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় ঢেউ বয়ে যেতে লাগলো। তার সম্মুখে এই ক্ষণে যে নারী দণ্ডায়মান তার সমস্ত গা ভেজা। চুলের একাংশ মুখে ছড়ানো। টপটপ করে পানি পরছে ঈষৎ লাল পাতলা অধরের উপর। গলার উদ্ধত কণ্ঠহাড় গুলো যেন কয়েক ঘণ্টার মাঝে আরো বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। হঠাৎ তাকালেই চোখ পড়ছে কণ্ঠহাড়ের ভেতরের লাল তিলে।

মিনিট দুয়েক না গড়াতেই এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো। যে ঘটনাটি ঘটবে বলে ধারণা কিংবা ঘটার মতো সেরকম সম্পর্ক, সেসব কোনোকিছুই ছিলো না ওদের মাঝে। ঘটনাটি ঘটার সেকেন্ড কয়েক প্রচ্ছদ নিশ্চল হয়ে রইল। পায়ের তলা আটকে গেলো মেঝের সাথে। দেহ বেয়ে তীব্র শীতল স্রোতের একটা ধারা নেমে গেলো… ততটা তীব্র যতটা তীব্রতায় মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘনিয়ে এসে দরজায় কড়া নাড়ে।

দুষ্টু ভেজা শরীর’টা সম্পূর্ণ হেলে আছে প্রচ্ছদের সাথে। মাথাটা বুকের কাছে পরে আছে অযত্নে। ভীষণ অবহেলার গোছে তার মাথাটা প্রচ্ছদের বুকের এক দিকে কপাল ঠেস দিয়ে পরে আছে। প্রচ্ছদ অনেক কষ্টে জড়ীভূত হাত দুটো উঠিয়ে আনলো। ঢোক গিলে এক হাত দুষ্টুর পিঠে রেখে অন্য হাত ওর গালে রাখলো। বার কয়েক হালকা থাপড়ে ডাকলো,

‘দুষ্টু, দুষ্টু।’

দুষ্টুর হেরফের নেই। কারোর অধীনে সে ঘুমন্তে আচ্ছন্ন। প্রচ্ছদ ওকে ধরে একবার বিছানায় বসাতে চাইলো। পরক্ষণেই আবার কি মনে করে চেয়ার টেনে বসিয়ে দুষ্টুকে এক হাত দিয়ে ধরে রেখে ইরাকে ফোন করলো।

ইরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো। মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে?’

‘অজ্ঞান হয়ে গেছে।’

ইরা কড়া চোখে তাকালো, ‘কীভাবে?’

‘আমি কীভাবে জানবো? আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছো কেনো?’

‘মারধর করেছো? আসার পরেই অজ্ঞান হয়ে গেলো যে?’

প্রচ্ছদ জোরেশোরে বলে, ‘হোয়াট? আমি জানি-ই না ও অজ্ঞান কেনো হলো। আসার পর মিনিট চল্লিশের মতো ওয়াশরুমেই ছিলো।’

‘জামা-কাপড়ও তো ভেজা।’

‘হুম। সেইজন্যই ডাকলাম। চেঞ্জ করে দাও।’

‘হায় আল্লাহ! অজ্ঞান মানুষকে চেয়ারে বসিয়ে রেখেছো?’

‘তো আর কোথায় বসাবো? বিছানায় শুয়ালে বিছানা ভিজে যাবে না? এমনিতেই সারা ঘর পানি দিয়ে কি একটা অবস্থা!’

ইরা বিস্ময়ের চরম শিখরে পৌঁছে গেলো। মাথা দুলিয়ে বলল,

‘আমার সামনে থেকে যা তুই। মাইর একটাও মাটিতে পরবে না তাহলে।’

‘রেগে যাচ্ছো কেনো? যাচ্ছি। ড্রেস চেঞ্জ করিয়ে একটু গরম দুধ খাইয়ে দিও।’

‘তোর বলতে হবে না।’

প্রচ্ছদ পা বাড়ালো। যেতে যেতেই গম্ভীর মুখে বলল,

‘বিছানা ভেজালে এই বেয়াদব মেয়ে’টা রাতে ঘুমাতো কোথায়? জ্ঞান ফিরলে দ্রুত আমার রুম ক্লিন করতে বলবে।’

ইরা ধমকে বলে, ‘প্রচ্ছদ, মাইর খাবি কিন্তু। এই মূহুর্তে চোখের সামনে থেকে যা। তোর রুম বড়? আমি পরিষ্কার করে দিবো। বিদায় হ।’

দুষ্টুর দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে প্রচ্ছদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। দরজায় উঁকি দিতে থাকা নীরা সাথে সাথে আড়াল হলো। ইরা এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে গেলো। নীরা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নাক ফুলিয়ে বললো,

‘সবার শুধু ইরা ইরা ইরা। উফফ… মাথা’টা ছিড়ে যায়।’

পরমুহূর্তেই মুখে হাত রেখে কৌতুহলী হয়ে কিছু ভেবে নীরা বাঁকা হাসলো। আচমকা কাধে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে তাকালো। সাজিদ নীরাকে দেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,

‘বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একা একা বিরবির করছো কেনো?’

নীরা আমতা আমতা করে বলে, ‘কই না তো? তুমি এখানে এসেছো কেনো? তোমাকে না ছেলের কাছে থাকতে বললাম?’

সাজিদ জহুরি নজরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। এরপর চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে বলল,

‘ভালো হয়ে যাও। ভালো হতে টাকা লাগে না। আর যদি লাগে তাও দেবো। তবুও ভালো হয়ে যাও।’

নীরা মুখ বাকিয়ে বলল, ‘Oil your own machine, please.’

৫১.
নিশীথে শেয়ালের হাঁক। খোলা বাতাস! তবুও কী নিদারুণ দমবন্ধকর পরিস্থিতি! বেহায়া বুক ভয়ংকর ভাবে দগ্ধ হচ্ছে! পুড়ছে! ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে। অন্তরিন্দ্রিয়র সেই পোড়া দহন এসে ঠেকেছে গলা অবধি। কণ্ঠস্বর রোধ করে আসছে। কী নিরব জ্বালা! নীড় টিকতে পারছে না। তবুও চোখে তার জলের রেশটুকু নেই। একটু পানি পরুক না! বুকের আগুনটুকু একটু নিভুক। এতো কষ্ট হচ্ছে কেনো? ভেতরটা মনে হয় ফেঁটে চৌচির হয়ে গেলো।

নীড় টেবিলে দু’হাতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ঠোঁট গোল করে ফু করে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলল। পা দুটো কাঁপছে। টেবিলের এক কোণায় বিরিয়ানির প্যাকেট’টার দিকে চোখ যেতেই একচোটে হাতের থাবার তা ফেলে দিলো। ছিটকে গিয়ে পরলো বারান্দার কার্ণিশে। প্যাকেট খুলে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো খাবার। বুকের চারিদিকে দগ্ধ পোড়া গন্ধের সাথে মিলেমিশে গেলো ঠকবাজ নারীর বিরিয়ানির বিদঘুটে গন্ধ। নীড়ের বমি পেলো। টেবিলে শব্দ করে দু’তিনবার আঘাত করলো।

অতঃপর দেয়ালে টাঙানো মায়ের ছবি’টার দিকে তাকিয়ে করুণ ভাঙা স্বরে তাকে বলতে শোনা গেলো,

‘আমি কি এতোটাই খারাপ, নিকৃষ্ট, জঘন্য ছিলাম, মা? ও আমাকে ছেড়ে চলে গেলো কেনো?’

উত্তর আসে না। নীড় উত্তরের অপেক্ষাও করে না।হাসফাস করে অস্থির নয়নে এদিক সেদিক তাকায়। তার নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। অসহ্য লাগছে এই ধরণীর প্রতিটা বিন্দু থেকে বিন্দুতর কণা পর্যন্ত। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়ার বাসনা জাগছে। বড্ড স্বার্থপর হতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে অভিশাপ দিতে,

‘নিঃস্ব যখন আমি হয়েছি, তখন নিঃস্ব হও সবাই। জ্বলে পুড়ে ছাই হও। অতঃপর আমার অপ্রাজ্ঞ দীর্ঘশ্বাসের কবলে পরে জরাগ্রস্ত সেই ছাই বিলীন হয়ে যাক।’

কিন্তু বলতে পারে না। শব্দগুলো সশব্দে গলা দিয়ে বের হয়ে আসতে চায় না। ভেতরে দলা পেঁকে আটকে নীড়ের গলা অবরুদ্ধ করে। মা’র ছবির পাশে দেয়ালে ঝুলানো অনেক পুরোনো একটা গিটার। খুব কষ্ট করে বাজাতে হয়। মাঝে মাঝে হাত কেটে রক্তাক্তও হয়।

নীড় অনেকদিন বাদে গিটার হাতে নিলো। এরপর ধপ করে বসে পরলো বারান্দার দরজায় হেলান দিয়ে। দৃষ্টি ফেললো টেবিলে রাখা দুষ্টুর দু’চোখের বিষ ফিজিক্স বইয়ে, বুকশেলফের এক পাশের ডায়েরিতে, বারান্দার সাইকেলে, বেলি ফুলের গাছে। ঠিক কিছু ঘণ্টা মাত্র আগে এসবকিছু ছুয়ে গেছে তার হৃদয়চিত্তের প্রেয়সী। এখন অবধি লেগে আছে তার অতলস্পর্শী স্পর্শ। নাহ, প্রতারক, বিশ্বাসঘাতকের স্পর্শ! একজন ঠকবাজ, ঘৃণ্য ছললনাময়ী মেয়ে মানুষের স্পর্শ!

গিটারের টুংটাং শব্দ ভেসে এলো স্থিরচিত্রে, করুণ, অসহায় হয়ে।

“তুমি সাইকেল চালানো শিখবে তাই,
আমি আজো সাইকেলে ঘুরে বেড়াই
শুধু ছলনায় তোমার ছোঁয়া মেলেনা
তুমি কবিতাগুলো পড়বে তাই আমি
আজো রাত জেগে ছন্দ সাজাই
রাত শেষে শুধু ভোর ফিরে আসে না
আমি তোমাকে বুঝিয়ে দেবোই তাই
ব্যাগে আজো রাখি ফিজিক্স বই
শুধু তুমি নেই তাই বইটা খুলি না
তুমি ছুঁড়ে ফেলে দিবে এই ভয়ে
আমি সিগারেট আজো রাখি লুকিয়ে শুধু
এখনতো কেউ বারণ আর করে না
তুমি এতো সহজে ভুলতে পারো
অন্য কাউকে জড়িয়ে ধরো
আমি কেনো শুধু ভুলে যেতে পারিনা
আজ অবাক লাগে তোমায় দেখে
আমায় আজ তোমার অচেনা লাগে
এতো ভালো অভিনয় কেনো জানিনা?”

আঙ্গুল চুইয়ে দু’ফোঁটা রক্ত পরলো। দু’তলার বারান্দার কর্ণারে দাঁড়িয়ে একচিত্ত মনে, প্রকট বন্ধ দৃষ্টিতে, কর্ণধার করছিলো বিষাদ, ব্যর্থ, যন্ত্রণাধারী নীড়ের গলার গান। নুসরাতের চোখে জল উপচে এলো। গান শেষ হলো। গলা’টা যেন কেউ চেপে ধরেছে। কেঁপে কেঁপে ভাসছে ছন্দ গানের পাটাতনে। আর গাওয়া গেলো না। সুর বন্ধ হতেই নীড় হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। তার কান্নার দমকে কয়েকটা রাত জাগা পাখি একসাথে উড়ে গেলো। রাত জাগা কালো প্রকৃতি অবাক হয়ে দেখলো, একজন মানব পুরুষ কাদঁছে!একজন দুষ্টু যাদুকরীর জন্য কাদঁছে। ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণায় চিৎকার করে কাদঁছে। সেই ভাগ্যবতী নারীর স্মৃতি মনে করে গলা ছেড়ে আর্তনাদ করছে। সত্যি তো ভাগ্যবতী সে! যে নারীর জন্য এক পুরুষ নয় বরংচ একাধিক পুরুষ কাঁদে সে ভাগ্যবতী বৈ কি!

রাত বাড়লো। কমলো কান্নার দমক। বাড়লো জ্বর। কমলো বিশ্বাস। বাড়লো বুকের ভেতরে এক প্রকারের চিনচিনাত্মিক ব্যথার প্রয়াস!
আহ! কি যন্ত্রণা!

চলবে❤️

#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-২৫
৫২.
তখন দুপুর দু’টো বেজে প্রায় পঁচিশ মিনিট। চারিপাশে নিরিবিলির বিস্তার। টুংটাং কাচের প্লেট, বাটি, গ্লাসের শব্দ নিস্তব্ধতার বেড়াজাল ভেঙে দিচ্ছে। বিশাল দৈর্ঘ্যের জনে জনে পূর্ণ টেবিল’টার এক কোণায় একটা মাত্র চেয়ার ফাঁকা। শুক্রবারের দৌলতে আজ বাড়িতে প্রতিটি মানুষ উপস্থিত। অথচ বাড়িতে সর্বদা উপস্থিত থেকেও অনুপস্থিত ফাঁকা চেয়ারের মালিক’টি। ইফতার হক লোকমা তুলতে তুলতে প্রচ্ছদের দিকে তাকিয়ে প্রথম প্রশ্ন করলেন,

‘ কি হয়েছে প্রচ্ছদ? সকালেও নেই। দুপুরেও খেতে এলো না?’

প্রচ্ছদ ভাতের থালা থেকে চোখ সরিয়ে বাবার দিকে তাকালো। এরপর নিচু গলায় বলল, ‘কার কথা বলছো?’

তিনি বোধ হয় বিরক্ত হলেন। কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,

‘বিয়ের পর তুমি বোকা হয়ে যাচ্ছো। তোমাদের মতো পুরুষের বিয়ের পর বোকা হওয়া মানায় না। ধূর্ত হতে শেখো। বিয়ের পর তো বোকা হয়েছে আমাদের জেনারেশন। বউয়ের আঁচল ধরে চলতে চলতে বোকা হয়ে যেয়ো না।’

অর্জন যারপরনাই বিরক্ত হলো অযথা বাড়তি আলাপে। সাজিদ মাথা নাড়িয়ে চোখ উল্টিয়ে গোপনে বুক ফুলিয়ে বড় করে শ্বাস ফেলল। ইফতার হকের কথা মানেই খোঁচা দিয়ে কথা। আর এমন সব কথা যার আগামাথা কোনোকিছুরই সেই সময়ের জন্য প্রযোজ্য নয়। সিড়িন হক খাওয়া থামিয়ে দিয়ে বললেন,

‘আমাকে খোঁচা মেরে কথা বলছো? তুমি কবে আমার আঁচল ধরে ছিলে?’

‘থাকিনি?’

‘অবশ্যই না। আঁচল ধরে থাকলে কি এই মূহুর্তে আমার সামনে বসে আমাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলতে?’

ইফতার হক মাথা নাড়িয়ে বললেন, ‘তাও ঠিক।’

‘ছেলে প্রশ্ন করেছে উত্তরে বললেই হতো তোমার বউয়ের কথা বলেছি তা না যত্তসব আলতু ফালতু কথা।’

‘এসব আলতু ফালতু কথা?’

‘অবশ্যই। মোটিভেশনাল বক্তা এসেছে রে আমার! আগে নিজেকে মোটিভেট করো।’

সিড়িন হক আবার বললেন স্বামীকে নকল করে, ‘ধূর্ত হতে শেখো! ধূর্ত হয়ে করবে’টা কি শুনি? বউয়ের সাথে ধূর্তামি করলে সে মহাপুরুষ হয়ে গেলো নাকি?’

ইফতার হক আর একটা কথাও বললেন না। চুপচাপ খেয়ে গেলেন। তাকে শুধু একবার বিরবির করতে শোনা গেলো,

‘মেয়ে মানুষের জাত। চাপার উপর দিয়ে রেইল গাড়ি গেলেও চাপা ভাঙবে না। কেনো যে বলতে গেলাম? বলতে গিয়ে নিজেই বোকা হয়ে এলাম।’

শ্বশুড়ের পাশে বসে থাকা ইরার প্রতিটি কথাই কর্ণগোচর হলো। সে মুখ চেপে হাসলো। প্রচ্ছদের যারপরনাই বিরক্ত লাগলো। গম্ভীর মুখে নিস্তব্ধে লোকমা তুললো পরপর। এর অনেকক্ষণ বাদে সিড়িন হক নিজে থেকেই বললেন,

‘ তা তিনি কোথায়? সকালেও দেখলাম না। দুপুরেও নেই। শুক্রবার বলে বড় বউ তিনমাসের পেট নিয়ে নিচে নেমে এসে খেয়ে যেতে পারছে আর তার নামতে কষ্ট হয়? সে বোধ হয় এগারো মাসের অন্তঃসত্ত্বা, নাকি?’

সিড়িন হকের কথায় নীরা এবার শব্দ করে হাসলো।

‘টিয়া, যাও ঢেকে নিয়ে এসো তোমার ছোট ভাবীকে।’

প্রচ্ছদ মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘ঘুমোচ্ছে মা।’

সিড়িন হকের কপালে কুঞ্চন পড়লো। গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

‘অবেলায় ঘুমোচ্ছে? কি হয়েছে?

‘ কি হয়েছে বুঝতে পারছি না। কাল সারারাত ঘুমোয়নি। দুপুরে নামাজ পড়েই শুয়ে পরলো। জিজ্ঞেস করতেই কোনোরকমে বলল, পেট ব্যথা।’

ইফতার হক ছেলের আচরণে অসন্তুষ্ট গলায় বলেন,

‘কি হয়েছে বুঝতে পারছো না মানে কি? তুমি ওর স্বামী না? ও এখন তোমার রেসপন্সিবিলিটি। ইউ হেভ টু রিমেম্বার দ্যাট।’

সিড়িন হক আবার বললেন,

‘পৃথিবী ধূলিসাৎ হয়ে গেলেও নিজের দায়িত্ব থেকে কখনো পিছপা হবে না। তোমার সকল আবেগ, উদ্বেগ, ব্যাকুলতা সবকিছুর উর্ধ্বে তা! দায়িত্ব কাধে নিতে কক্ষনো পিছুপা হবে না। তোমার মধ্যে যখন দায়িত্ব বোধ জাগ্রত থাকবে তখন মনে পাপ আসবে না। তুমি অসৎ পথে যাবে না। কারণ দায়িত্ব কখনো পাপের হয় না। দায়িত্ব সৎ! সুতরাং তুমি সৎ।’

সিড়িন হকের কথাগুলো যেনো ডঙ্কার বেশে কানে লাগলো সাজিদের। সে চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। অতঃপর তাকালো নীরার দিকে। মায়ের কোলে থাকা ছোট্ট নিষ্পাপ বাচ্চা’টার দিকে। তার মনে হলো, সে দায়িত্ব থেকে ধীরে ধীরে পিছুপা হয়ে যাচ্ছে। কিংবা হতে চাচ্ছে। সে কী অসৎ হয়ে গেলো? তার মনেও তো পাপ জাগ্রত হয়েছে। দায়িত্ব থেকে পিছপা হয়েছে বলেই কি?

খাওয়া শেষ হলো সবার। আস্তে আস্তে উঠে গেলো প্রতিটি মানুষ। নীরা সিড়িন হকের কাছে এসে নিচুস্বরে বললো,

‘বড় মা।’
‘হুম, কিছু বলবে।’
‘হুম। খুব ইম্পোর্টেন্ড কথা।’
‘বলো। শুনছি।’
‘বলছি যে! কাল সন্ধ্যার পর দুষ্টু বোধহয় বাড়ির বাইরে বের হয়েছিলো। অনেকক্ষণ ছিলো। আসার পর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। এরপর থেকেই তো অসুস্থ।’

নীরা বাড়িয়ে বাড়িয়ে আরো অনেক কিছুই বলল।সিড়িন হক অবাক হয়ে চাইলেন, ‘কি বলছো তুমি?’

‘হুম, আমি নিজে দেখেছি।’

সিড়িন হক দু’তলার ডান পাশের ঘর’টার দিকে তাকালেন। শক্ত মুখে বললেন,

‘রাতে আমাদের বাড়ির বউ’রা একা বাইরে বের হয়না। সে কি জানে না?’

নীরা মাসুম বাচ্চার ভঙ্গি করে ঠোঁট উল্টালো। তিনি কঠিন মুখে বললেন, ‘উপরে চলো।’

৫৩.
ঘরের ফ্যান বন্ধ। লাল পর্দার ফাঁক গলিয়ে লুকিয়ে-চুরিয়ে প্রবেশ করছে নরম মিঠা সূর্যের তেজ। ঘরময় অন্ধকার। প্রচ্ছদ ঘরে পা রেখে জানালা, বারান্দার দরজা থেকে পর্দা সরিয়ে দিলো। সাথে সাথে আলোড়ন তুলে আলোকিত হলো ঘরের আনাচে-কানাচ। প্রচ্ছদ পাঞ্জাবি খুলল। পাতলা সবুজ রঙের গেঞ্জি পরে এসে বার কয়েক দুষ্টুকে ডাকলো। সাড়াশব্দ না পাওয়া গেলে সে হালকা করে দুষ্টুর কপালে গলায় হাত রাখলো। ঘামে ভিজে উঠেছে বুঝতেই ফ্যান ছেড়ে দিয়ে এলো। এরপর আরো কয়েকবার ডাকলো।

বিবর্ণ মুখে ক্লান্ত চোখের পাটাতন বহুকষ্টে খুলে দুষ্টু নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

‘কয়’টা বাজে?’
‘তিন’টার কাছাকাছি।’
‘ওহ।’
‘যাও ফ্রেশ হয়ে এসো।’

দুষ্টু নিঃশব্দে উঠে চলে যেতেই প্রচ্ছদ বিছানার কোণায় বসলো। চিন্তিত ভঙ্গিতে গালে হাত বুলালো। এই বেয়াদব মেয়ে’টার চিন্তায় কাল রাতে তার ঠিকমতো ঘুম হয়নি। কিন্তু দুষ্টুকে জিজ্ঞেস করারও কোনো সুযোগ পায়’নি। কীভাবে ওর ব্যক্তিগত বিষয়ে কি জিজ্ঞেস করবে তা বুঝে উঠতে পারছে না।

ভাবতে ভাবতেই ওয়াশরুম থেকে বমির শব্দ ভেসে এলো। প্রচ্ছদ দৌড়ে গেলো। দুষ্টুর মাথা চেপে ধরে চিল্লিয়ে ডাকলো ইরাকে।

সিড়িন হক নীরাকে সাথে নিয়ে এদিকেই আসছিলেন। প্রচ্ছদের চেঁচানো শুনে তিনি তড়িঘড়ি করে ছুটে এলেন। এসেই দুষ্টুর মাথা নিচু করে চেপে ধরলেন। দুষ্টু তার শ্রান্ত, বলহীন শরীর’টা সিড়িন হকের উপর এলিয়ে দিলো। তিনি ওর মুখ ধুইয়ে মুছিয়ে দিলেন। ব্যতিব্যস্ত গলায় বললেন,

‘প্রচ্ছদ ওকে ধর।’

প্রচ্ছদ দুষ্টুর মাথা বুকের সাথে চেপে ধরে ঘরে নিয়ে এলো। সিড়িন হক বেসিন পরিষ্কার করে এলেন। নীরাকে বললেন,

‘খাবার নিয়ে এসো তো।’

নীরা খাবার নিয়ে আসতেই তিনি নিজে মেখে খাইয়ে দিলেন। নীরা প্রচ্ছদের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকালো। বলল,

‘এই তোমরা না ডিভোর্স নেবে? তাহলে ও বমি করলো কেনো? কাল রাতে অজ্ঞানও হয়ে গেলো।’

প্রচ্ছদ ইতস্তত বোধ করে অন্যদিকে তাকায়। সিড়িন হক বিরবির করে ‘মাথামোটা’ সম্বোধন করলেন। খাইয়ে দিতে দিতে দুষ্টুকে এবার ধমক দিলেন,

‘সারাদিন না খেলে তোমার বমি হবে না তো কি আমার বমি হবে? কাল রাতেও তো খাওনি।’

দুষ্টু ক্লান্ত চোখে শুনলো। প্রচ্ছদ একবার চোখ তুলে তাকালো। অস্পষ্ট স্বরে বলল,

‘কেউ তো খেয়াল করলো না। এমনকি বড় ভাবীও না। মা এতো খেয়াল করে?’

দুষ্টু আর খাবে না বলে চোখমুখ কুচকে গাইগুই করলো। সিড়িন হক চোখ রাঙালেন, ‘চুপচাপ খাও, মেয়ে।’

খাওয়া শেষ করে সিড়িন হক ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলেন, ‘কাল রাতে কোথায় গিয়েছিলে?’

প্রচ্ছদ তড়িৎ বেগে উত্তর দেয়, ‘মা আমার সাথে গিয়েছিলো। একটু উকিলের কাছে গিয়েছিলাম। এসেই ওয়াশরুমে ঢুকে অনেক সময় নিয়ে গোসল করার পর অজ্ঞান হয়ে গেছে।’

সিড়িন হক কথা বাড়ালেন না। প্রচ্ছদ আড়চোখে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ইরার দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে আশ্বস্ত করলো।

ইরা একবার শ্বাশুড়িকে দেখে নিয়ে বড় করে শ্বাস ফেলে মিষ্টি হেসে চলে এলো। কাল রাতে সে শিখিয়ে দিয়েছিলো প্রচ্ছদকে। দরজা বন্ধ করতে গিয়ে নীরার আঁচল তার চোখে পরেছিলো। ভাগ্যিস!

ঘরের সবাই চলে যেতেই প্রচ্ছদ দরজা বন্ধ করে এলো। দুষ্টুর মুখোমুখি বসে জহুরি নজরে তাকিয়ে বলল,

‘এবার সত্যি কথা’টা বলো।’
দুষ্টু মুখ ঘুরালো, ‘কি বলবো?’
‘কি হয়েছে তোমার?’
‘কিছু না।’
‘কাল রাতে কোথায় গিয়েছিলে?’
সে জবাব দেয় না। প্রচ্ছদ সতর্ক কণ্ঠে প্রশ্ন করে, ‘তোমার বয়ফ্রেন্ডের কাছে?’

দুষ্টু চকিতেই চোখ ঘুরিয়ে তাকালো। বিষণ্ণ, বিদীর্ণ, ম্লান চোখ জোড়ার ফাঁকে ফাঁকে বিন্দু বিন্দু নীর। নীড়ের জন্য নীর। প্রচ্ছদ তেরছাভাবে বলে,

‘ওহ, বয়ফ্রেন্ড বলা তো আবার বারণ। তা তোমার প্রেমিকের কাছে গিয়েছিলে?’

দুষ্টু দূর্বল, প্রাণদপূর্ণ অসহায় যোগে চাইলো। হতবল, অপারগ গলায় বলল, ‘আমি ওকে বলে দিয়েছি।’

প্রচ্ছদ ভ্রু উপরে তুলে, ‘কি বলেছো?’

দুষ্টু ঠোঁট চেপে ধরলো। নিজের মাঝে বড় করে একটা নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে শব্দ করে শূন্যে ছেড়ে দিলো।

‘বিয়ের কথা।’
প্রচ্ছদ অসহযোগ, অপ্রতিভ চোখে চাইলো, ‘তারপর?’
‘তারপর আর কি!’
‘কি বলল সে?’
‘চলে যেতে বলেছে।’
‘হুম?’
‘হুম, ওর চোখের সামনে থেকে চলে যেতে বলেছে।’

দুষ্টুর গলার স্বর কেঁপে উঠলো। মুখ ওদিকে ঘুরে গেলো। প্রচ্ছদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো বিস্ময় নিয়ে। এই পর্যায়ে কি বলা যায় তা তার মস্তিষ্ক জানান দিলো না। সে আরো কিছুক্ষণ নিস্তব্ধে চেয়ে রইল। দুষ্টুর মুখ দেখা যায় না। উল্টোদিকে ঘুরানো৷ তবুও সে বুঝতে পারলো, মেয়েটা ঠোঁট কামড়ে কাদঁছে। নিরবে ফেলা চোখের জলে কষ্ট বেশি। একটু জোরে কাদুঁক। মন’টা হালকা হবে। প্রচ্ছদ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। আসার সময় দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে এলো।

প্রচ্ছদ যাওয়ার পর সত্যি সত্যি দুষ্টু শব্দ করে কেঁদে উঠলো। বালিশে মুখ চেপে ধরলো। মনে পরলো, এইতো কিছুদিন আগে… দিন বিশেক আগে ও যখন বাপের বাড়ি গিয়েছিলো। নীড় ফুলের গাজরা নিয়ে এসেছিলো। কত যত্ন করে দুষ্টু তুলে রেখেছে। নীড় বলেছিলো, ওর যখন অনেক টাকা হবে ও সোনার গাজরা বানিয়ে দেবে। দুষ্টুর কান্নার বেগ বাড়লো। কেঁপে কেঁপে উঠলো শরীর। গলা ভেঙে এলো। চোখ জ্বললো। তবুও কান্নার জোর কমলো না। বরং থেকে থেকে বাড়লো।
ঘণ্টাখানেক বাদে কান্নার শব্দ যখন খানিকটা কমে এলে সে হেচকি তুলে ফোন লাগালো শ্রেয়সীকে। ফোন দিতেই মুখ চেপে ধরে আবার কেঁদে উঠলো।

চলবে❤️

#এমন একদিন সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-২৬
৫৪.
শ্রেয়া ফিনফিনে গলায় অনেক আগ্রহ নিয়ে শ্রেয়সীকে বলছিলো, ‘জানো আপু, একটা লোক আমার পেছনে ঘুরে। গাড়ি নিয়ে।’

শ্রেয়সী কিছু হিসেব মেলাচ্ছিলো। শ্রেয়ার কথা শুনে চকিতেই ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। ভ্রু উঁচু করে বলল, ‘তাই?’

‘হুম। আমি তো ইচ্ছেমতোন ঝেড়েছি।’

‘ভালো করেছিস। চিনিস ছেলেটা’কে?’

শ্রেয়া বিরক্ত নিয়ে বলল, ‘আরে ছেলে না লোক। চিনি না। আমাদের এলাকায় আগে কখনো দেখিনি। আমার থেকে অনেক বড়।’

শ্রেয়সী কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করে, ‘অনেক বড়? কত বড়?’

শ্রেয়া ভাবুক গলায় বলল, ‘আমার মনে হয় লোকটার বয়স ত্রিশ, চল্লিশ হবে।’

শ্রেয়সী বিস্ময় নিয়ে তাকায়। শ্রেয়া মিষ্টি করে হেসে বলল,

‘আমার থেকে একটু বেশি ডিফারেন্সে বয়স হলেও কিউট আছে।’

‘সুন্দর?’
‘বলা চলে।’
‘লোকটার সাথে কথা হয়েছে তোর?’
‘হুম। বললাম না ইচ্ছেমতোন ঝেড়েছি।’
‘কি ঝেড়েছিস?’

‘বুড়ো ধাম হয়ে বাচ্চা একটা মেয়ের পেছনে ঘুরতে লজ্জা করে না। আরেকদিন দেখলে লোক ডেকে গণপিটুনি খাওয়াবো। হেনতেন। এই তো এসবই বলেছিলাম।’

শ্রেয়া ঠোঁট উল্টে বলে। শ্রেয়সী টেবিল ছেড়ে বিছানায় শ্রেয়ার মুখোমুখি বসলো। কৌতুহল নিয়ে বলল,

‘আহারে! দুধ খাওয়া বাচ্চা’টা রেহ! তারপর?’

বলেই শ্রেয়ার গাল টিপে দিলো। শ্রেয়া বিরক্তি নিয়ে তাকালো। এরপর একটু চিন্তা করে বলল,

‘প্রেম করা যেতো শুধু বয়স বেশি বলে তোমরা মানবে না। তাই এই হ্যান্ডসাম লোক’টাকে হাত ফসকে যেতে দিচ্ছি।’

শ্রেয়ার দুঃখী দুঃখী স্বর। শ্রেয়সী আকাশ সমান তাচ্ছিল্য আর বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘বউ বাচ্চা আছে দেখ গিয়ে।’

শ্রেয়া মুখ ফুলিয়ে চোখ পিটপিট করে বলে, ‘তোমাকে বলছে? বউ থাকলে আমার পেছনে ঘুরবে কেনো?’

শ্রেয়সী ভ্রু নাঁচিয়ে উত্তর দেয়, ‘কারণ লোক’টা ক্যারেক্টারলেস।সিম্পল!’

শ্রেয়া দরজার বাইরে একটু উঁকিঝুঁকি মেরে অধিক আগ্রহের সহিত ফিসফিস করে বলল,

‘লোক’টাকে দেখে তো মনে হয় না বউ আছে। এত্তো সুন্দর বডি ফিটনেস। চোখ দিয়েই গিলে ফেলতে ইচ্ছে করে।’

শ্রেয়ার কথায় যেন শ্রেয়সী আকাশ থেকে পড়লো। বিস্ময় নিয়ে টেনে টেনে রঙ্গ করে বলল,

‘বাব্বাহ! তুমি তো বেত্তমিজ ধরণের পাকনা দুধু খাওয়া বাবু।’

শ্রেয়ার মুখ’টা থমথমে হয়ে গেলো। ঠোঁট উল্টালো বোনের কথায়। শ্রেয়সীর সামনে এভাবে বলতে চায়নি কিন্তু জাতশত্রু মুখ থেকে ফসকে বের হয়ে গেছে। স্লিপ অব টাং।

শ্রেয়সী আবার বলল হাতের আঙ্গুলে পাশের বাড়ি ইশারা করে ভীষণ আক্রোশে,

‘আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে যে ভাইয়া’টা থাকে তাকে দেখে বোঝা যায় তার একটা চার বছরের বাচ্চা আছে?’

‘না।’

‘তাহলে? তুই কীভাবে বুঝলি তোর বুড়ো ক্রাশের বউ নেই?’

বলেই শ্রেয়সী চোখ মুখ শক্ত করে শ্রেয়ার মাথায় ঘাট্টা মারলো। শ্রেয়া চোখ মুখ ফুলিয়ে থমথমে মুখে অন্যদিকে ফিরে তাকালো। মিনিট দুয়েক পর বই নিয়ে বসলো। গম্ভীর মুখে পড়তে পড়তে সে মনস্থির করলো, পরের তিন ঘণ্টা সে শ্রেয়সীর সাথে কোনোরকম কথা বলবে না। সে গুনগুন শব্দ করে পড়তে থাকলো।

মিনিট তিনেকও গড়ালো না। যেখানে সে সংকল্পবদ্ধ ছিল তিন ঘণ্টার। শ্রেয়সী কিছু মনে পড়ার মতো জিজ্ঞেস করছিলো ভ্রু উঁচিয়ে,

‘তুই কি লোকটা’কে পছন্দ করে ফেলেছিস? প্রেম করবি?’

শ্রেয়া বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘বিরক্ত করো না তো। প্রেম করার সময় আর ইচ্ছা হলে করবো। তাতে তোমার কি?’

‘এক থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে দেবো। ভুলেও যাতে এসব না শুনি। কয়েক মাস পর বোর্ড এক্সাম। আর এখন তুমি প্রেম করার চিন্তা করো? আব্বু-আম্মু শুনলে উষ্ঠা মেরে বাসা থেকে বের করে দেবে, দুধু খাওয়া বাবু।’

‘তুমি কি আমাকে একটু পড়তে দিবে? আমি কখন বলেছি প্রেম করবো? আই উইশ তুমি একটা এরকম যাতাকলে পড়ো। একটা প্রেমে পরে তোমার জীবন উষ্ঠাগত হোক। তখন-ই আমার সাথে তোমার এসব বিহেভিয়ারের শোধ উঠবে।’

শ্রেয়সী চোখ তুলে তাকালো। চোখে বিস্ময়, আতংক, ভীতি। আশ্চর্যান্বিত দর্শনেন্দ্রিয় দিয়ে সে শ্রেয়া’কে কয়েক পলক আলোকপাত করে থম ধরে বসে থাকলো। সত্যি কি কখনো…এরকম হতে পারে? শ্রেয়সী কি প্রেমে পড়বে? সেই বৃষ্টি ভেজা পুরুষের সাথে কি তার প্রেম হওয়ার কোনো আশংকা বা কোনো সম্ভাবনা আছে? ও বিষয়টা পাত্তা দিলো না কিন্তু তবুও ভীষণ সিরিয়াস হয়ে গুরুগম্ভীরের ভান ধরে শুধালো, ‘অভিশাপ দিলি?’

শ্রেয়া হতবাক হয়ে পরলো। ক্ষীণ গলায় বলে উঠলো, ‘ওমা! এসব কি বলছো? তোমার কি হয়েছে বলো তো?’

শ্রেয়সী নরম গলায় কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফোনের শব্দ কানে এলো। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে স্থিত গলায় বলল,

‘তুই পড়। ডিস্টার্ব করার জন্য সরি। আর কখনো এসব উল্টাপাল্টা বিষয় মাথায় আনবি না। বুঝেশুনে কদম ফেলবি। বয়স’টা খারাপ। আমার কথায় মন খারাপ করিস না।’

মুহূর্তেই ঝকঝকে হয়ে উঠলো উঠতি বয়সের কিশোরীর মন। বোনের গলা জড়িয়ে ধরে ঝুললো কিছুক্ষণ। শ্রেয়সী তখন রিংরিং করা ফোন’টা রিসিভ করলো,

‘কি খবর তোর? আজকাল ফোনও করিস না।’

অন্য সময় হলে দুষ্টুর জবাব হতো, ‘তুইও তো করিস না। সবসময় আমি কেনো? তোর ইগো তোর কাছে দামী আর অন্যদের’টা ফেলনা বুঝি? যেচে কখনো ফোন দিবি না! বলি বন্ধুদের মধ্যে এতো ইগো থাকতে আছে? থাকলে সেটা বন্ধুত্ব হয়? তুই আসলে কোনোদিনও আমাদের বন্ধু ভেবে উঠতে পারিসনি। মুখেই যত কথা।’

কিন্তু সেসব কিছুই বেরুলো না তার মুখ থেকে। মাথা’টা যেনো ক্রমশ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। অন্য সময় হলে অভিমান নিয়ে এতো এতো অভিযোগ করা হতো। যদিও তারা জানে, শ্রেয়সী এরকমই। শুধু শুধু ফোন দিয়ে কাউকে বিরক্ত করার মতো কিংবা অযথা বকবক করার মতো মেয়ে সে নয়। তার দিক থেকে বন্ধুত্ব’টা অপ্রকাশিত, অটল, অতল। তবুও এসব বলে ক্ষেপানোর মাঝে যেন অন্যরকম আনন্দ, সুখ লুকায়িত থাকে। আচ্ছা, দুষ্টু সব বলার পরও কি বন্ধুত্ব’টা ঠিক এরকম ভাবেই টিকে থাকবে? হয়তো না। আবার ভাগ্যের জোরে কখনো, ‘হয়তো।’

‘কিরে কথা বলছিস না কেনো? মন খারাপ?’

দুষ্টু চমকালো। বস্তুত, সকল অভিমান, অভিযোগ ছাপিয়ে বিশাল বেপরোয়া ধরণীতলে এই মেয়ে এবং আপুই তাকে সবচেয়ে বেশি ভালো বুঝে। আর কেউ বুঝে না। দুষ্টুর মন’টা উথলে উঠলো বোনের জন্য। এক ছুটে দৃষ্টির কাছে গিয়ে ঝাপটে ধরে বলতে ইচ্ছে করলো, ‘আমি ভালো নেই আপু। আমার মনে পাহাড়সমান দুঃখ। আমাকে একটু আদর করে দাও।’ আপু যতটা তাকে বুঝে মাও তাকে ততটা বুঝে না। আপু পালিয়ে যাওয়ার পর সে যেন দুষ্টুর প্রতিও অনেক উদাসীন। তারউপর বিয়ে ঠিক হওয়ার পর নীড়ের কথা শোনার সাথে সাথে মা বলেই ফেলেছিলো,

‘কোন পাপে তোদের দু’জনকে পেটে ধরেছিলাম? নাহ, আমারই গর্ভের দোষ। তোদের কোনো দোষ নেই। তোরা নির্দোষ। আসল দোষী আমি। আমার গলায় কলসি ডুবিয়ে মরে যাওয়া উচিত। মেরে ফেল তোরা আমাকে, বেহায়ার বাচ্চা।’

দুষ্টুর গলা থেকে একটা চাপা কান্না ছিটকে বেরিয়ে এলো। চারিদিক থেকে যেন বাধ ভেঙে বন্যায় ন্যায় কষ্টগুলো হুড়োহুড়ি করে এসে সব সুখ ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। শ্রেয়সী বিহ্বল হলো,

‘কিরে তুই কি কান্না করতাছিস?’

দুষ্টু মুখ চেপে ধরলো। শ্রেয়সী অস্থির কণ্ঠে বলল,

‘কি হইছে? কাঁদছিস কেন? চোখের পানি বেশি হয়েছে? আমি আসবো?’

দুষ্টু রুদ্ধ শ্বাসে বলে, ‘ওই বাড়িতে গেলে আমাকে আর পাবি না।’

‘পাবো না মানে? তোর ক’টা বাড়ি? রাগ করে কোথাও লুকিয়ে আছিস? আচ্ছা দাড়া, ঠিকানা দে। আমি আসতাছি। চোখ মুছ।’

‘শ্রেয়, আমার বিয়ে হয়ে গেছে।’

দুষ্টু অস্পষ্ট স্বরে বলে। শ্রেয়সী তখনও কথা বলছিলো নিজের মতোন,

‘এই যে আমি রেডি হচ্ছি। আধ ঘন্টার মধ্যে তোর ওখানে পৌঁছে যাবো। চিন্তা করিস না। ঠিকানা দিচ্ছিস না কেনো এখনো বাল?’

‘শ্রেয়সী, আমার বিয়ে হয়ে গেছে।’

এবার খানিকটা জোর গলায় শোনা গেল। কথাটা কানে যাওয়া মাত্র শ্রেয়সী কেঁপে উঠলো। মনে হলো, এই ইট-পাথরের শক্ত-পোক্ত ছাদ’টা তার মাথায় হুড়মুড় করে ভেঙে পরছে। পায়ের তলার মাটি ক্রমশ নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। সে মাটির গহীনে হারিয়ে যাচ্ছে হঠাৎ। মস্তিষ্কের সব ক্ষমতা শূন্য কৌটায় পৌঁছিয়ে সে হতবিহ্বল কন্ঠে প্রশ্ন করতে পারলো শুধু,

‘মিথ্যা বলছিস?’

দুষ্টু ঠোঁট কামড়ে ধরে, ‘না।’

‘তুই কি বুঝতে পারছিস তুই কি বলছিস? তোর বিয়ে হয়েছে মানে? কবে?’

দুষ্টুকে বলার সুযোগ না দিয়েই শ্রেয়সী আবার বলল প্রাঞ্জল স্বরে,

‘ওহ বুঝেছি। লুকিয় বিয়ে করছিস, নীড়কে? আরে আগে বলবি না, শালী? যেভাবে কান্না করতাছিলি! ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কাঁদিস না। আন্টিকে পরে বুঝিয়ে বলা যাবে। ওই হাদারাম টা কোথায়?’

শ্রেয়সীর কথার মাঝে দুষ্টু বারংবার নিচু স্বরে ডেকেছে। এবার সে গলা উচুঁ করে চিৎকার করলো,

‘শ্রেয়সী। আমার বিয়ে নীড়ের সাথে হয়নি।’

শ্রেয়সী দ্বিতীয় দফায় অবাকের চরম সীমানায় পৌঁছালো,

‘নীড়ের সাথে হয়নি মানে? কার সাথে হয়েছে?’

‘আম্মুর বান্ধবীর ছেলে।’

শ্রেয়সী যেন বিশ্বাস করতে পারলো না। অবিশ্বাস্য গলায় বলল, ‘কি বলছিস? কবে?’

‘মাসেক হয়েছে।’

‘বলিসনি কেনো তুই আমাদের?’ শ্রেয়সীর কণ্ঠে অবাকতা ঝরে ঝরে পরলো। খানিকবাদে উৎকণ্ঠিত স্বরে আবার প্রশ্ন করল,

‘নীড়? নীড় জানে? ও জানলে তো মরে যাবে, দোস্ত। তুই ওকে এভাবে ঠকাতে পারলি?’

দুষ্টু আবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো, ‘আমাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বাস কর বিয়ের রাতে আমি পালিয়ে স্টেশন অবধি গিয়েছিলাম কিন্তু আমাকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। আমি ডিভোর্স নেবো আর দু’মাস পর। কিন্তু কাল সন্ধ্যায় আমি নীড়ের কাছে গিয়েছিলাম। আমি নীড়কে সব বলে দিয়েছি। ও আমাকে চলে যেতে বলেছে। এরপর অসংখ্য বার ফোন দিয়েছি। রিসিভ করেনি। কিছুক্ষণ আগে একটা টেক্সট পাঠিয়েছে।’

‘কি পাঠিয়েছে?’

‘জীবনে তোমার মুখ আমাকে দেখাবে না। এরপর থেকে ওর নাম্বারে আর আমার কল ঢুকেনি।’

শ্রেয়সী বুঝতে পারলো না ও কি বলবে। শূন্যে তাকিয়ে বলল, ‘তুই ওকে বলে দে, তুই ডিভোর্স নিবি।’

শ্রেয়সী কথা’টা বলল ঠিকই কিন্তু আদতে সে জানে নীড় এই কথা জানা মাত্র দুষ্টুর সব চিহ্ন নিশ্চিহ্ন করে দিবে। ওর জন্য কারো সংসার ভাঙবে, সেটা কল্পনাতেও আনতে পারবে না।

‘বলেছি। টেক্সট করেছিলাম। তারপরই নীড় এই মেসেজ পাঠিয়েছে।’

‘আনবিলিভেবল। এসব কি? আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না।’

দুষ্টু চোখ ঘোরালো। খুব সন্তর্পণে পরলো জল। নিরুদ্দেশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো বারান্দা ঘেঁষে বেড়ে উঠা কাঠগোলাপ গাছ’টার দিকে। আচ্ছা, এই কাঠগোলাপের মতো স্বচ্ছ, শুভ্র, নির্মল একটা জীবন কেনো হলো না, ওর? কেনো!

দুষ্টু নিষ্প্রভ নিচু স্বরে বহুদূরান্তে চেয়ে বলল,

‘তুই ওকে দেখে রাখিস। আমি বুঝতে পারছি, সম্পর্কটা আর কখনো জোড়া লাগবে না। আর লাগলেও কেউ আর সহজ হতে পারবো না। ভালোবাসার লাল রং’টা যেন একদিনেই ভীষণ ফিকে হয়ে গেলো রে! এতো ঠুনকো ছিলো সবকিছু, আমি কিছু বুঝেই উঠতে পারলাম না।’

দুষ্টু থামলো। সময় নিলো। শ্রেয়সী’র চোখ দুটো থেকে ভীষণ নিরুপায় কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো। দুষ্টু পুনরায় নিষ্ক্রিয় কণ্ঠে বললো,

‘ও অত্যন্ত ভালো একটা ছেলে। এই এতো ভালো হওয়া’টাই বোধহয় সইলো না। ওকে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমার ভাগ্য বরাবরই আমার চাওয়ার বিপরীতে। নীড়….নীড় এসব ডিজার্ভ করে না। আমার মতো বাজে মেয়ে ওর লাইফ পার্টনার হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। আমি প্রতারক, ঠকবাজ।’

দুষ্টুর দীর্ঘশ্বাস মিশ্রিত আর্তনাদে গলার স্বর’টা কেঁপে কেঁপে উঠলো। এরপর বারকয়েক শুধু বলে চললো, ‘দেখে রাখিস। যত্নে রাখিস।’

শ্রেয়সী এ পর্যায়ে প্রশ্ন ছুড়লো, ‘আমি ওকে দেখে রাখবো মানে?’

দুষ্টুর গলা উদাস শোনা যায়। নমনীয়, নিচু, হালকা গলায় শ্বাস রোধ করে চোখের দ্বার বন্ধ করে সে বলে উঠে,

‘আমার পর তুই ওকে সবচেয়ে ভালো বুঝিস। ওর এখন বিশ্বস্ত, ওকে বোঝার মতো কাউকে দরকার। ওর তো কেউ থাকলো না। তুই তো আমাদের দেখে আসছিস বল। তুই পারবি না নীড়ের জন্য একটু কম্প্রোমাইজ করতে? আমি জীবন দিয়ে দেবো। তোদের থেকে অনেক দূরে চলে যাবো। আর কক্ষনো ফিরবো না। তবুও…

শ্রেয়সী মাঝপথে ওকে থামিয়ে দিলো। আশ্চর্য হয়ে হালকা আওয়াজে ডাকলো, ‘দুষ্টু…’

শ্রেয়সীর ডাকে দুষ্টু কথা ফেললো না। নিষ্প্রাণ চোখে বললো,

‘তবুও বলছি ওকে দেখে রাখ। আমাদের বন্ধুত্বটা তো মিথ্যে নয়। এই অটুট বন্ধনের জন্য হলেও তুই…

আর বলতে পারে না। গলা থেকে ছিটকে আসে কান্নার দল। শ্রেয়সী তৎক্ষণাৎ চিৎকার করে বলে,

‘তুই নিজে জানিস তুই কি বলছিস? পাগল হয়ে গিয়েছিস?’

‘শ্রেয়… ‘

‘একটা কথাও আর বলবি না। নীড়ের জীবন’টা তো নষ্ট করেছিস আমার জীবন’টাও নষ্ট করার জন্য উঠে পরে লেগেছিস? বিশ্বাসঘাতক ,স্বার্থপর।’

দুষ্টুর আর কথা বলতে পারলো না। আহত নির্বাক চোখ থেকে সন্তপর্ণে গড়িয়ে গেলো অশ্রু। হাতের উল্টোপাশ দিয়ে মুখ চেপে ধরলো।

শ্রেয়সী সজোরে কান থেকে ফোন সরিয়ে ছুড়ে মারে। এরপর আতংকিত চোখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে ভাঙাচোরা ফোনটার দিকে। ভেতরটা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে উঠছে। এই মুহুর্তে তার দুষ্টুকে মনে হচ্ছে রাক্ষসী এবং এই ফোন সেই রাক্ষসীর দূতি বার্তা। তার হাত-পা অনবরত কাঁপছে। শরীর অসার হয়ে যাচ্ছে। মুখ জুড়ে তিক্ত এক বিষাদ।
শ্রেয়সী ভাবতে পারছে না। কি করে পারবে ও যাকে সারাজীবন বন্ধু ভেবে এসেছে তাকে জীবনসঙ্গি ভাবতে? নিজের প্রাণপ্রিয় বন্ধুর সাথে কি কখনো দাম্পত্য জীবন পার করা যায়? ও তো কোনোদিন এসব কল্পনাও করে দেখেনি। মস্তিষ্কে মজার ছলে কিংবা অনর্থক ভাবেও কখনো এই কথাটা উঁকি দেয়নি। নীড়ের সাথে? কীভাবে সম্ভব?

আর প্রযুক্ত! এই বৃষ্টি ভেজা পুরুষ’টিকে ভুলবে কি করে সে? শ্রেয়সী তো বুঝে, যতই মুখে অস্বীকার করুক বাস্তবিক অর্থে সে ওই পুরুষ’টিকে মনের আনাচে-কানাচেতে ধারণ করছে। হৃদয়ের অতলান্তে এমন কোনো স্থান অবশিষ্ট নেই যেখানে তার ছবি আকাঁ হয়নি, তার নামে নিজের নাম জড়ানো হয়নি। মনের মধ্যিখানি’তে যে সবার একটা করে ভালোবাসার প্রেমপাখি থাকে, সেই প্রেমপাখি’টা বহু বছর সুপ্ত ছিলো। এই ছাব্বিশ বছর বয়সে এসে দৈবক্রমে যখন আস্তে আস্তে পিটপিট করে চোখ খুলে জাগ্রত হতে চাইলো তখনই সব চূর্ণবিচূর্ণ হতে লাগলো। মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে এক একটি স্বপ্ন, বিশ্বাস, সম্পর্ক, সময়।

শ্রেয়সী হঠাৎ মাথা নাড়িয়ে এলোমেলো স্বরে বলে,

‘নাহ, সম্ভব নয়। দুষ্টু কি করে এ কথাটা বলতে পারলো? আসলে…আসলে, ও কখনো কাউকে মন থেকে ভালোই বাসেনি। সব ছিলো ওর ছলনা। ওই মেয়ে একটা মানুষরূপী বিশ্বাসঘাতক ডাইনি। ভালোবাসলে কক্ষনো নীড়কে মাঝপথে ছেড়ে দিতো না। ও আকস্মিক বিপর্যয়ে উন্মাদ হয়ে গেছে। তা নাহলে এসব কেউ বলে? আমি সবাইকে জানিয়ে দেবো। সারা পৃথিবী রটিয়ে দেবো। আমি ভালোবাসি। ভালোবাসি এক দুপুরে দেখা হওয়া অপ্রত্যাশিত বৃষ্টিতে ভেজা চুল ঝাড় দেওয়া মুগ্ধতায় ঘেরা যুবক’টিকে।’

চলবে❤️