#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-২৭
৫৫.
সেই বিকেল না গড়াতেই প্রচ্ছদের ঘরের সামনে দিয়ে যেতেই চাপা কন্নার আওয়াজ শুনে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে এলো ইরা। দুষ্টুর চোখ-মুখ ঢাকা গায়ের উড়নায়। শরীরজুড়ে ভয়ানক কাপুঁনি। কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠছে দেহ। ইরা কাছে বসে মাথায় হাত বুলালো। মমতাময়ীর সুরে হালকা গলায় শুধালো,
‘কাল রাত থেকে এরকম করছিস কেনো, বোন?’
দুষ্টু মাথা উঠালো। উঠানো মাত্র ঝাপটে ধরলো। ইরা চমকে উঠে খানিকটা পিছন দিকে হেলে গেলো। ঠিকমতো বসে দুষ্টুর মাথায় আবারো হাত বুলিয়ে দিতেই সে কম্পনজাত গলায় থেমে থেমে বলল,
‘কেনো সব এলোমেলো হচ্ছে? আমি যার জন্যই ভালো করতে যাচ্ছি তার-ই খারাপ করে ফেলছি। আমি কি খুব খারাপ?’
‘কে বলেছে তুই খারাপ? তোর মতো ভালো মেয়ে আর একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না, দুষ্টু। সবাই সবার জায়গা থেকে ঠিক, ভালো, সরল। শান্ত হ।’
দুষ্টু প্রত্যুক্তি করলো না। চাপা আওয়াজে দুলে দুলে উঠলো তার দেহ। ইরা চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে আরো অনেকরকম কথা বললো। কিন্তু তাতে দুষ্টুর কান্নার জোর বাড়লো বৈ কমলো না। ইরা দুষ্টুর মাথায় নিশ্চুপে হাত বুলালো অনেকক্ষণ যাবত। চারিপাশ থমথমে নিরবে ছেয়ে যেতেই নিরবিচ্ছিন্ন শব্দহীন পরিবেশ ঠেলে ইরার গলা কেমন অন্যরকম সুন্দর শুনালো,
‘তোর ভুল’টা কোথায় জানিস? তুই সবাইকে নিয়ে চিন্তা করতে চাস। সবাইকে নিয়ে চিন্তা করে তুই তাল পাবি না। তোর উচিত নিজেকে নিয়ে চিন্তা করা। যখন দেখবি তুই নিজেকে নিয়ে ভাবছিস তখন আশেপাশের মানুষগুলোর চিন্তা একা একাই মস্তিষ্কে হানা দিবে। সমস্যাগুলোর সুন্দর সমাধান হবে। তুই তো জানিস না কার মনে কি চলছে! কে কি চায়! সবার মনের ধারণা পাওয়া কি তোর একার পক্ষে সম্ভব? যখনি এই.. কারো মনের সাথে তোর মতামত মিলছে না তখনি দ্বন্ধ বেজে যাচ্ছে। পরিস্থিতি এলোমেলো হচ্ছে। কি দরকার তোর সবাইকে নিয়ে এতো ভাবার? এতে হয় কি জানিস, একজনের জন্য ভাবতে গিয়ে তুই আরেকজনের ক্ষতি করে ফেলিস। কারো মন নষ্ট করিস, সম্পর্কে দ্বন্ধ সৃষ্টি করিস।’
শেষের বাক্য ইরা থেমে থেমে গলার স্বর ফসফস আওয়াজে পৌঁছে দিয়ে বললো। দুষ্টু চোখ তুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ইরার কোলে মাথা রাখলো। কান্নার জোর কমেছে। সে মনোযোগ দিয়ে সব শুনছে। মৃদুস্বরে দীর্ঘশ্বাস গলায় তাকে বলতে শোনা গেলো,
‘কি জানি! আমার চারিপাশ থেকে না কষ্টের স্তূপ বন্যা আকারে প্রবাহিত হচ্ছে! পাহাড় ডিঙিয়ে, ঢালু জমি পেরিয়ে, সমতল ভূমিতে…সর্বত্র!’
‘বন্যার পর পলিমাটি জমা হয়। অতঃপর ফসল ফলে ভালো। তোর জীবনের কষ্টগুলোও হয়তো সেই শপথ নিয়েই এসেছে। হতেই পারে।’
দুষ্টু পলকে উঠে বসলো। বিস্ময়, ভীতি, অবাকতা নিয়ে তাকিয়ে থাকলো ইরার গোলগাল মুখপানে। কথাটা শোনামাত্র যেনো বুকের ভেতর কোনো বিশাল আকৃতির ধনুকের বিষাক্ত, জ্বলন্ত আগুনের তীর ছুটে এসে বিধলো। মূহুর্তেই হৃদয় খণ্ডবিখণ্ড করে লাল রঞ্জক পদার্থে রঞ্জিত হয়ে আংশিক বের হয়ে এলো বুক-পিঠ এফোড়-ওফোড় করে। সে তখনও দুরুদুরু বক্ষে মর্মার্থ খুঁজছে এই অতলান্ত, গভীর, কম শব্দে গোটা গল্প উপস্থাপন করা বাক্যের।
৫৬.
বিকেল গড়িয়েছে। শেষ আকাশের মাথায় দুটো লাল দাগ দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যের আবির্ভাব হচ্ছে। ক্লান্ত পক্ষীকূল নীড়ে ফিরছে ব্যস্ত ভঙ্গিতে। দূরালয় থেকে ভেসে আসছে চাঁপা ফুলের সুগন্ধ। কানে লাগছে বাশিঁর করুণ সুর। সাথে বাড়ছে শ্রেয়সীর হৃদয়ের গহীন সমুদ্রের অন্ধকার জালের বিস্তার। কে বাজায় এতো করুণ সুরের বাঁশি? নাকি তার অন্তঃকরণে বাজে? অকরুণ, অশিষ্ট ধরণী’কে কষ্ট জানান দিতে?শ্রেয়সী খাটের এক কোণায় বসে আছে চুপচাপ। কানে এসে বারংবার ধাক্কা খেয়ে যাচ্ছে শ্রেয়ার বলা তখনকার কথাগুলো,
‘আই উইশ তুমি একটা এরকম যাতাকলে পরো। একটা প্রেমে পরে তোমার জীবন উষ্ঠাগত হোক। তখন-ই আমার সাথে তোমার এসব বিহেভিয়ারের শোধ উঠবে।’
শ্রেয়সী অস্থিরচিত্তে উঠে দাড়ালো। হৃদপিণ্ডে বিরতিহীন চলতে থাকা ধুকপুক শব্দগুলো কানে এসে লাগছে ভীষণ করে। হাত পা কাপঁছে অস্বাভাবিক ভাবে। ক্রমাগত ঘরের এমাথা থেকে ওমাথা পায়চারি করে সে বিছানার হেডবোর্ডে মাথা এলিয়ে দিয়ে বসলো। এরপর নিজের ব্যবহৃত দ্বিতীয় ফোন’টা হাতে তুলে নিলো নির্বিঘ্নে।
অনেকক্ষণ পর বলল, ‘হ্যালো।’
প্রযুক্ত মৃদু হেসে হালকা অভিমানী সুরে বলে, ‘এতো ব্যস্ত? আজ সারাদিন একটা ফোন পেলাম না!’
শ্রেয়সী হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। গলা কাঁপছে। নিচু গলায় বলে,
‘তেমন কিছু না।’
প্রযুক্ত ভ্রু কুচকায়। জোরপূর্বক হাসে, ‘বাব্বাহ! দি গ্রেট শ্রেয়সীও কাদঁতে পারে বুঝি?’
কথাটা শোনা মাত্র শ্রেয়সী ঠোঁট ভেঙে শব্দহীন কেঁদে উঠলো। প্রযুক্ত নিশ্চুপে শুনলো দীর্ঘ শ্বাসের শব্দ, নাক টানার আওয়াজ, গোঙানির ধ্বনি। সবশেষে ঠান্ডা গলায় স্নেহের সুরে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি হয়েছে আপনার? আমাকে বলুন।’
শ্রেয়সী এবার শব্দ করে কাদঁলো। অস্ফুটস্বরে ঘটনাটা বলল সংক্ষেপে,
‘আমার দুই বন্ধু। দুজন দুজনকে ভীষণ ভালোবাসে। বান্ধুবীর বিয়ে হয়ে গেছে। বন্ধুকে জানায়নি। কাল সে সব জেনেছে। ওদের মাঝে ছাড়াছাড়ি হয়েছে। আমার বন্ধু অনেক ভেঙে পড়েছে। ওর বাবা-মা নেই। এখন বান্ধবী আমাকে বলছে, আমার বন্ধুকে সারাজীবন আগলে রাখতে।’
এতোটুকু বলতেই শ্রেয়সী হেচকি তুলে কাদঁলো। শেষ কবে এভাবে কেদেঁছে তা বোধহয় সে নিজেও জানে না। কি আশ্চর্য! অর্ধ পরিচিত একটা মানুষের কাছে কি বেহায়া ভাবেই না নির্দ্বিধায় চোখ জল ফেলছে? কেনো ফেলে? এতো নির্লজ্জ মানুষের এই চোখ দুটো, এই বুক…এই বুকের মধ্যিখানের মন’টা…বামপাশের হৃদপিণ্ড’টা। প্রযুক্ত নিশ্চুপ। শ্রেয়সী কান্নার দমক কমিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘এখন আমার করণীয় কি?’
প্রযুক্ত চোখ বন্ধ করে। নয়নের কার্ণিশে জল এসে ভিজলো। গড়িয়ে পরলো না। চোখের কোণাতেই নিজেদের জায়গা করে নিলো। নিরব, অবশ কণ্ঠে শুধু বলল,
‘আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি বলবো আপনি আপনার বন্ধুর কাছে যান। তার হয়তো এখন আপনাকেই বেশি দরকার।’
শ্রেয়সীর চোখের জল থেমে গেলো। স্থির হয়ে এলো হাত-পা। অবাক কণ্ঠে দৈবাৎ শুধিয়ে ফেলল, ‘আর আপনি?’
প্রযুক্ত হাসলো। মাথা দুলিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে বলল,
‘আমি? আমার চলে যাবে কিছু একটা করে।’
শ্রেয়সী তার বিস্ময়তার গলা দিয়ে শুধু বের করতে পারলো, ‘প্রযুক্ত…..!’
প্রযুক্ত নিঃশব্দে ফোন রেখে দিলো। প্রায় সাথে সাথে শ্রেয়সীর কান থেকেও ফোন’টা পরে গেলো। এরপর একচিত্তে নির্বিকার তাকিয়ে রইলো সামনের কোনো শূন্যে। ক্রমে ক্রমে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো বড় বড় শ্বাস। বাতাসে অক্সিজেনের বড়ো অভাব। ভেতরটা জ্বলছে দাউদাউ করে।
শ্রেয়সী এদিক সেদিক চাইলো অপ্রকৃতস্থের ন্যায়। এরপর ছুট লাগালো নীড়ের কাছে। তার অসার দেহ! ফাঁকা মস্তিষ্ক! শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এ কোন বিষাক্ত ব্যথা ছেয়ে যাচ্ছে! বিষে নীল হয়ে উঠলো অন্তরিন্দ্রিয়র অন্তরিক্ষ। গোপনে পরলো চোখের জল, বাড়লো বুকের ঝড়, জেগে উঠলো ঘুমন্ত স্মৃতির বোধ। হারলো ভালোবাসা, জিতলো বন্ধুত্বের জোর কিংবা জিতবে ভালোবাসা, হারবে বন্ধুত্বের জোর।
চলবে❤️
#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-২৮
৫৭.
সন্ধ্যে নেমেছে। মাথার উপর মৃদু আওয়াজে বিরামহীন ফ্যান ঘুরছে। প্রচ্ছদ চপল পায়ে ঘরে এলো। ইরা উঠে চলে যেতে যেতে বলল, ‘বকাঝকা করো না। খেয়াল রেখো।’
প্রচ্ছদ মাথা দুলালো। দুষ্টু বিছানায় হেলান দিয়ে বসেছিলো। প্রচ্ছদ গিয়ে ওর মুখোমুখি বসে রাশভারী স্বরে প্রশ্ন করল, ‘কেমন লাগছে এখন?’
‘বেটার।’
বলেই জানালা গলিয়ে বাইরে চাইলো। সন্ধ্যে-রাত্রির হাওয়ারা এসে চুল উড়ালো নাক মুখ জুড়ে। বিশাল দেহের গাছগুলো পাতা দুলাচ্ছে। বাড়ির সামনের রাস্তায় সারি বেধে থাকা লম্বা সুপারি গাছগুলো একে অপরের উপর হেলে পরেছে। প্রচ্ছদ হাত উঠালো। চুলগুলো সরিয়ে দিতে গিয়েও হাত গুটিয়ে নিলো। গম্ভীর গলায় বলল,
‘আমি এদিকে। এদিকে তাকালে ভালো হয়।’
দুষ্টু আস্তে করে ঘাড় কাত করে। উড়না ঠিকমতো গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
‘কিছু বলবেন?’
প্রচ্ছদ ভ্রু কুচকে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘হঠাৎ কেনো আমাদের বিয়ের কথা’টা বলে দিলে? আর বলেই যখন দিয়েছো তখন এতো মন খারাপের মানে কি?’
দুষ্টু আবারো ঘাড় ঘুরিয়ে জানালার দিক তাকালো। চোখের পাতা বন্ধ করলো। নিচুস্বরে জবাব দিলো,
‘এসব থাক।’
প্রচ্ছদ মাথা দুলায়, ‘নাহ। থাকবে না। আমাকে জানতে হবে।’
‘কেনো জানতে হবে?’ দুষ্টুর নির্লিপ্ত স্বর।
প্রচ্ছদ কি যেনো বলতে নিয়েও থেমে গেলো। পূর্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো দুষ্টু শুষ্ক মুখে,
‘কজ আই হেভ রাইটস।’
দুষ্টু দমে গেলো। এই একটা বিষয়… আবদ্ধতা! অধিকার! জীবন’টাই তছনছ করে দিয়ে গেলো। ভেঙে টুকরো টুকরো হলো সকল কল্পনা-জল্পনা, সাজানো স্বপ্ন।
প্রচ্ছদ ভ্রু কুচকায়, ‘উত্তর দিচ্ছো না যে?’
দুষ্টু ঠোঁট কামড়ে ধরে,
‘আমাদের দু’বছরের সম্পর্ক। কিন্তু এই দুটো বছর আমাদের প্রেমটা সীমাবদ্ধ ছিলো হাত ধরে ঘুরা, সময় পেলে ফুচকা খাওয়া, আড্ডা বাজি করা, নদীর পাড়ের হাওয়া নেওয়া… ব্যস এতোটুকুই। কিন্তু হঠাৎ কাল…
প্রচ্ছদ অস্থির গলায় প্রশ্ন করলো, ‘কাল? কাল কি হয়েছিলো?’
দুষ্টু ঢোক গিলে। গলার স্বর ঈষৎ কাঁপে,
‘ও আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। অস্বস্তি হচ্ছিলো আমার। তারপর ও কিস করতে চায় আর তখনি সব..
প্রচ্ছদ চোখের পলকে বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো। এরপর চকিতেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। বিছানা নড়ে উঠলো। দুষ্টুর কথা মাঝপথেই থেমে যায়। সে অবাক হয়ে প্রচ্ছদের চলে যাওয়া দেখে। খানিক বাদে তাজ্জব কণ্ঠে বলে উঠলো,
‘আশ্চর্য মানুষ তো! হুটহাট শুনতে এসে থমথমে ভঙ্গিতে চলে গেলো কেনো?’
৫৮.
অগ্রহায়ণ মাস। ঘড়িতে সাত’টা বাজে। জানালার কাছে মৃদুমন্দ নিবিড় ধোঁয়াময় জটলা। রাস্তার ধারে কুকুরের হাঁক। ফাঁকা রাস্তায় দু-একটা রিক্সার টুংটাং।খানিকক্ষণ বাদে বাদে সো করে বড় গাড়ি গুলোর কাঁদাপানি ছিটিয়ে চলে যাওয়া। গায়ে পাতলা কালো রঙের চাদর জড়িয়ে নীড় হেলেদুলে হেটে গেলো দরজার দিকে। ঘর ফাটানো শব্দে বিরতিহীন অসভ্যের মতো দরজা ধাক্কানো হচ্ছে। নীড় বিরক্ত হলো। দরজা খুলতেই দেখা গেলো, শ্রেয়সী হাঁপাচ্ছে। নীড় অদ্ভুত ভাবে কিছুক্ষণ দেখে সরে দাড়ালো। হৃদপিণ্ড চিরে বেরিয়ে এলো এক পশলা ক্লেশ। কাল ঠিক এই সময়’টার দিকে দুষ্টু এসেছিলো। ভাবতেই বুকটা শব্দহীন, বর্ণহীন, জ্যোতিহীন ব্যথায় ছেয়ে গেলো। নীড় বিছানার কোণায় বসলো। গা থেকে চাদর সরিয়ে বলে উঠলো,
‘এতো অস্থির দেখাচ্ছে কেনো তোকে? বস না!’
শ্রেয়সী বসলো না। পলক না ফেলে নীড়ের দিকে চেয়ে রইল। একদিনে কতটা শুকিয়ে গেছে! না খাওয়ায় পেট’টা যেন ভেতরের দিকে ডুকে গেছে। হাটলে তাকে কুঁজো দেখা যাচ্ছে। কপালে পরে থাকা অগোছালো উষ্কখুষ্ক চুল, জীর্ণশীর্ণ দেহ, খরখরে ঠোঁট। নীড় নিষ্প্রাণ কণ্ঠে শুধালো,
‘কিছু বলবি? চোখ, মুখ ফোলা কেনো?’
শ্রেয়সী সে কথার উত্তর দিলো না। দম না ফেলে বলল,
‘দুষ্টুর বিয়ে হয়েছে নীড়।’
নীড়ের থেকে উত্তর পাওয়া গেলো না। শ্রেয়সী আবার বলল, ‘ও ডিভোর্স নিয়ে নিবে তোকে বলেছে?’
নীড়ের চোখ মুখ শক্ত হলো,
‘তো? আমি কি করবো? আর কেনো ডিভোর্স নিবে ও? আমার জীবনে ওই মেয়ের আর কোনো জায়গা নেই। তুই কি ওর হয়ে সাফাই গাইতে এসেছিস? তাহলে আগেই চলে যা।’
‘নাহ, তুই আমার কথাটা শোন। দুষ্টু নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করতে চায়নি। ওকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
‘শ্রেয়সী, এই ব্যাপারে আর একটা কথাও না। ওকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হোক বা না হোক। ওর একবার অন্তত আমাকে বলার প্রয়োজন ছিলো। ওর বিয়ের এক মাস অথচ ও আমার থেকে ব্যাপার টা একদম লুকিয়ে রেখেছে। কি দারুণ ভাবে ঠকিয়েছে আমায়! প্রতারক।’
‘এভাবে বলিস না। ও তোকে খুব ভালোবাসে।’
নীড় নিভন্ত চোখে চাইলো। হালকা আওয়াজে বলল,
‘সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না। কিছু ভালোবাসা ভালোবেসেও নিদারুণ ভাবে হেরে যায়। মরে যায়। পায়ের তলায় পিষে যায়।’
শ্রেয়সী স্থির কণ্ঠে শুধায়, ‘আর তোর ভালোবাসা?’
‘ওই যে, প্রতিক্ষণে পায়ের তলায় পিষে ফেলছি।’
‘এই মুহূর্তে দুষ্টুকে তোর সামনে উপস্থিত করালেও তুই তোর জায়গা থেকে নড়বি না?’
তার দৃঢ়তার সাথে উত্তর, ‘কক্ষনো না। নড়লে কাল-ই নড়তাম। তোর এখানে আসার প্রয়োজন পরতো না। ‘
শ্রেয়সী অসহায় গলায় বলল,
‘কিন্তু কেনো? তুই তো বলতিস, ওকে দেখলে তোর ক্লান্তি দূর হয়, তোর সব রাগ পড়ে যায়, তোর জীবনে যা কিছু বর্ণহীন ওকে দেখামাত্র সাত রঙে সজ্জিত হয়।’
বারান্দা থেকে হু হু করে ঠান্ডা সমীর বয়ে এলো। পুরাতন, কমদামী, ময়লা পর্দা গুলো উড়লো। নীড় উদাস চোখে তাকালো,
‘বলেছিলাম? হয়তো বলেছি। সবসময় কি সবার জীবন একরকম থাকে? আমি পারবো না কারোর সংসার ভাঙতে। আমার দ্বারা সম্ভব হবে না। সারাজীবন এই অপরাধবোধ মাথায় নিয়ে বয়ে বেড়াতে পারবো না। নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারবো না। অন্যের সুখের জন্য নাহয় নিজের সুখ বিলি করলাম। তাতে ক্ষতি কি! এতে অপরাধবোধ কমে আর তাতেই সুখবোধ হয়।’
নীড়ের কথা শেষ হতেই ঘর পিনপিনে নিরবতায় ছেয়ে উঠলো। সময় গড়ালো। মিনিট থেকে মিনিট। শ্রেয়সী তখনও নিশ্চুপ। নীড় জোরপূর্বক হাসে,
‘তুই কি আর কিছু বলবি?’
শ্রেয়সী মাথা নাড়ায়।
‘বল তাহলে।’
সে ঠোঁট চেপে ধরে। চোখের কপাট খিচে বন্ধ করে। এরপর একদমে বলে,
‘দুষ্টু চায়, আমি তোকে বিয়ে করি। ও বলে, ওর পর আমি নাকি তোকে সবচেয়ে ভালো বুঝবো। তোর খেয়াল রাখতে পারবো। কিন্তু এটাতো কখনো সম্ভব নয়। নীড়…নীড় আমি কীভাবে তোকে? আমি সে নজরে কখনো এক মূহুর্তের জন্যও তোকে ভাবিনি। কীভাবে সম্ভব? তাছাড়া আমি…
শ্রেয়সী থামলো। বার কয়েক জোরে শ্বাস টানলো। কথাগুলো জড়িয়ে আসছে। গলায় পাক খাচ্ছে। সে রুদ্ধশ্বাসে বলল,
‘নীড় আমি অন্যকাউকে ভালোবাসি। আমার পক্ষে সম্ভব না তোকে হাসবেন্ডের নজরে দেখা। আমি তোকে সেইভাবে কল্পনা করা তো দূর কখনো মজা করে ভুলক্রমেও ভাবিনি।’
নীড় শ্রেয়সীকে থামালো। কপালে ভাঁজ ফেলে বিস্মিত কন্ঠে তেজ নিয়ে বলে উঠলো,
‘কিসের হাসবেন্ড? কিসের বিয়ে? কে কাকে বিয়ে করবে এখন সেটাও ওই মেয়ে ঠিক করে দিবে? শোন, তোর বান্ধবীকে বলবি এবার থেকে নিজের’টা ভাবতে। অনেক তো আমার কথা ভাবলো। ভেবেই তো জল এতোদূর পর্যন্ত গড়ালো। আমার সাজানো জীবন’টা পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে গেলো। এবার থেকে নিজের রাস্তা’টা দেখতে বল। আমারটা আমাকেই বুঝতে দিক। ও এটা ভাবতে পারলো কি করে? তুই আর আমি? আমরা ভাই-বোন, শ্রেয়সী। এটা কখনো সম্ভব? মুখে আনা তো দূরে থাক এটা ভাবাও কি কখনো সম্ভব? ওর মেন্টালিটি ঠিক কতটা নিচে নেমে এসেছে। ছি!’
শ্রেয়সী আহত চোখে তাকালো, ‘এভাবে বলিস না প্লিজ। ও তোকে এখন অবধি প্রচন্ড ভালোবাসে।’
নীড় হাত মুষ্টিবদ্ধ করলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ওর ভালোবাসা আমার জন্য অভিশাপ। চোখের সামনে থেকে যা। বন্ধু হয়ে থাকতে হলে থাকবি কিন্তু ওই মেয়ের নাম উচ্চারণ করবি না।’
শ্রেয়সী আশ্চর্যান্বিত দর্শনেন্দ্রিয় দিয়ে চেয়ে রইল কতকক্ষণ। এ কোন নীড়! দুষ্টুর পাগল নীড় তো নয়। সে কখনো এতো কঠিন ভাষায় কথা বলতে পারে না। এতো ঘৃণা নিয়ে নীড় কথা বলছে? নীড়? ভালোবাসা না পেলে কি ভালোবাসার মানুষের প্রতি এতোটা ঘৃণা জন্মাতে পারে? প্রযুক্তকে যদি শ্রেয়সী কখনো না পায় তাকে কি এতোটা ঘৃণা করতে পারবে? কখনো পারবে? আদেও কি সম্ভব! শ্রেয়সী আর ভাবতে পারলো না দৌড়ে বেরিয়ে এলো শ্যাওলা ধরা দু’তলার রংচটা বাড়ি’টা থেকে। দিগবিদিক না তাকিয়ে, বাতাস কেটে, পায়ের জুতো খুইয়ে সে চলল… অজানা গন্তব্যে।
দু’তলার বারান্দার গ্রিল ধরে পলকবিহীন চোখে দৃশ্যটা অবলোকন করে গেলো নুসরাত। বিষন্ন নয়নে তাকিয়ে নরম মনে ভাবলো, ‘এ মেয়েটা কে?’
অন্যদিকে, বারান্দায় সাইকেল জড়িয়ে জবান শক্তকারী ব্যর্থ প্রেমিক বসে পরলো হাটু ভেঙে। কতকগুলো বেলি ফুল নীল রঙা সাইকেল’টার গায়ে ছুইয়ে দিতে দিতে তার মাথা নিচু হলো। নিভৃতে, গোপনে, আড়ালে পড়লো একের পর এক নোনতা জলের সূক্ষ্মাংশু। সাইকেলের বেলের টুংটাং শব্দ করে সে ভাঙা আওয়াজে থেমে থেমে বলল শুধু,
“তুমি সাইকেল চালানো শিখবে তাই
আমি আজো সাইকেলে ঘুরে বেড়াই
শুধু ছলনায় তোমার ছোঁয়া মেলে না…..”
৫৯.
ঘরের সবক’টা জানালা দরজার কপাট খোলা। আশেপাশে অগোছালো ভাবে পরে থাকা খাতা, পেন্সিল, কলম, রাবার, রংপেন্সিল। বিছানার মধ্যিখানে বসে সাদা খাতার জমিন জুড়ে অবিরাম ছুটে চলছে পেন্সিল। বাতাসের দমকে উড়ে চলছে কাটা খোলা চুল। শ্যামলা আননে চিন্তার ছাপ, ঠোঁটে মাঝেমাঝেই জায়গায় করে নিচ্ছে পেন্সিলের মধ্যাংশ। কপালে পড়ছে কুঞ্চন। চেষ্টায় রত হাত প্রিয় মানুষ’টার স্কেচ তৈরিতে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। প্রিয় মানুষ’টার ছবি আকাঁর জন্য কি আগে নিজের মনে সেই ছবি’টা পার্মানেন্টলি থাকা প্রয়োজন নয়? টিয়া বিরক্ত হয়ে ফোন হাতে নিলো। প্রযুক্তর ছবি’টা আরেকবার দেখে নিয়ে চোখ আকঁতে বসলো। কিন্তু কিছুতেই হয়ে উঠলো না। রাগে দুঃখে সটান পাতা ছিড়ে ফেলে দিলো। সব রংপেন্সিল একে একে বিছানা থেকে ফেলে দিয়ে সে উঠে বসলো। মন খারাপ নিয়ে তাকিয়ে থাকলো প্রযুক্তর ছবির দিকে। ঠোঁট উল্টে আহ্লাদী হয়ে বলল,
‘আপনার চোখ জোড়া কেনো আঁকতে পারি না? আপনার চোখে কি আমি নেই? আচ্ছা! আমার অন্তরে আপনার ছবি নেই কেনো? হাজার ভেবেও আমার অন্তর থেকে আপনাকে টেনে নিয়ে আকঁতে পারলাম না! আপনার চোখে আমি নেই। আমার অন্তরে আপনি নেই। এ কেমন ভালোবাসা! আমি কিন্তু আপনাকে ভালোবাসি। কেমন ভালোবাসা ভালোবাসি?’
টিয়ার চোখ জোড়া দৈবাৎ ভিজলো। পৃথিবীতে কত রকমের ভালোবাসা বিদ্যমান? বলা যায়? গোনা যায়? দেখা যায়? নাকি শুধুই তা অনুভবের আবেগ মাত্র!
চলবে❤️
#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-২৯
৬০.
তমসার নিবিড় গহব্বরে, কুয়াশার ধূম্রজাল ভেদ করে বিষন্ন ভগ্নহৃদয়ে এলোমেলো পা ফেলে চলে যাচ্ছে সে একা রাস্তার কিনার ধরে। ধোয়াশার এই নিগূঢ় জাল ভেদ করে চারিদিকে ঠিকরে পড়ছে রাত্রি স্তব্ধতার রূপোলী চন্দ্র-শোভা। ডান পাশের ছোট্ট পুকুর থেকে উঠা ধোয়াময় কুয়াশার নিদারুণ দৃশ্য নজরকরণ করতে করতে দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রযুক্ত। জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে জ্যোৎস্নার প্রতিফলনের মাঝে গাছেদের ছায়া মাড়িয়ে ছোট ছোট কদম ফেলে এগিয়ে চলল।
আচমকা কে যেন ডাকলো! ফাঁকা, নিস্তব্ধ রোডে প্রযুক্ত চমকে ঘাড় ঘুরালো। কাউকে দেখতে না পেয়ে সামনের দিকে ঘুরিয়ে আনমনে আবারো কদম ফেলতে গেলেই পেছন থেকে কেউ যেন জোরে পিঠের উপর আছড়ে পরলো। প্রযুক্ত সেকেন্ড কয়েক জড়ীভূত হয়ে থেকে দম ফেলল। আর একটু হলেই পিচঢালা রাস্তায় মুখ থুবড়ে পরে যেতো। এভাবে কে জড়িয়ে ধরে? সে ভ্রু কুচকায়। বুকের মাঝে আড়াআড়ি ভাবে জড়িয়ে ধরা ফর্সা হাতগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে ক্ষণ। এরপর এক টানে মানুষ’টার হাত দুটো ধরে সামনে আনে।
প্রযুক্তর আত্মা ধক করে উঠলো। শ্রেয়সী নিভু নিভু চোখে তাকায়। তাকানো মাত্র মাথা’টা আবার এলিয়ে দেয় শক্তপোক্ত, চওড়া বুকে। প্রযুক্ত নড়ে উঠে এক হাত শ্রেয়সীর চুলের ভাঁজে দিয়ে ক্ষীণ আওয়াজে প্রশ্ন করলো,
‘আপনি?’
সে উত্তর দেয় না। হাত মুঠো করে ঝাপটে ধরে বুকের কাছে জ্যাকেটের অংশটুকু। প্রযুক্ত ওর থুতনিতে হাত রেখে মাথা উঠালো। শ্রেয়সী আধখোলা চোখে চাইলো। প্রযুক্ত ভ্রু উপরে তুলতেই সে বলল নিবেশে,
‘আমি সারা পৃথিবী রটিয়ে দেবো, ভালোবাসি। সেই পুরুষের একচ্ছত্র অধিপতি শ্রেয়সী। আমি সারা পৃথিবী’কে দেখিয়ে দেবো, যদি আপনি আমার না হন! জ্বালিয়ে দেবো, পুড়িয়ে দেবো, আপনাকে মেরে ফেলবো তারপর আমি’টা নিঃশেষ হয়ে যাবো। এই নশ্বর পৃথিবী’কে দেখিয়েই ছাড়বো।’
প্রযুক্ত ঝাপটে ধরলো। এতোটা শক্ত করে ধরলো যে বুকের মাঝেই পিষে যাবে নরম হাত-পা। চারিদিকে প্রণয়ের ভূকম্পন। প্রযুক্ত ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো বারংবার থেমে থেমে পাগলের ন্যায়! ধীর স্বরে বলল,
‘আর চাইলেও কিন্তু যেতে পারবেন না। বন্দি হয়ে সারাজীবন থাকতে পারবেন যেমন করে আছেন এখন? কষ্ট হবে না তো? বিরক্ত লেগে যাবে কি?’
শ্রেয়সী মুখ উঠালো। মাথা নাড়িয়ে ঈষৎ হেসে বলল,
‘কক্ষনো না। এভাবে গোটা জীবন বুকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে থাকতেও রাজি।’
‘সত্যি তো?’
শ্রেয়সী বিরক্ত নিয়ে তাকালো। এরপর আবার মুখ গুঁজলো। প্রযুক্ত শব্দ করে হেসে ঘাড় কাত করে মাথায় হাত বুলালো। স্তব্ধ গভীর ফাঁকা রাতে তাকে কোলে তুলে নিয়ে গাইলো কয়েক লাইন। শ্রেয়সী তাতেই মুগ্ধ হলো। বিমোহিত হেসে প্রযুক্তর গলা জড়িয়ে ধরে মুখ লুকালো ঘাড়ে। পাড়ি জমানো হলো ভালোবাসার রাজ্যে কিংবা বিশাল সমুদ্রে নাকি উচুঁ কোনো পাহাড়ে!
“শোনো না রূপসী, তুমি যে শ্রেয়সী
কী ভীষণ উদাসী, প্রেয়সী।
জীবনের গলিতে, এ গানের কলিতে,
চাইছি বলিতে, ভালোবাসি।”
৬১.
রাতে যখন প্রচ্ছদ ঘরে এলো দুষ্টু তখন বিছানা গোছাচ্ছিলো। চোখ তুলে প্রচ্ছদকে একবার দেখে নিয়ে বিছানা ঝাড় দিতে দিতে সে প্রশ্ন ছুড়লো,
‘তখন ওভাবে চলে গেলেন যে?’
প্রচ্ছদ ছোট করে উত্তর দেয়, ‘এমনি।’
দুষ্টু বিছানা ঝাড় দিয়ে প্রচ্ছদের সামনে এসে দাড়ালো। চোখা গলায় প্রশ্ন করলো, ‘আপনার কি বিষয়টা খারাপ লেগেছে? ভীষণ খারাপ?’
প্রযুক্ত ভ্রু কুচকে চাইলো। মিনিট দুয়েক পর হাতের কিছু কাপড় ভাঁজ করতে করতে দুষ্টু আবার বলল,
‘অবশ্য খারাপ লাগারও কোনো কারণ নেই। আমাদের মধ্যে তো আর ভালো-খারাপ লাগার মতো সম্পর্ক তৈরি হয়নি। আর তো মাত্র দু’মাস। তারপর যে যার রাস্তায়।’
কথাটা বলেই দুষ্টু যেনো স্বস্তির শ্বাস ফেলল। প্রচ্ছদ নিঃশব্দে ওয়াশরুমে ঢুকলো। খানিকবাদে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দুষ্টু তোয়ালে এগিয়ে দিয়ে আবার তার দিকে প্রশ্নবাণ তাক করলো,
‘আপনি কি আমায় ভালোবাসেন?’
তার নির্বিঘ্ন গলার স্বর অথচ দৈবাৎ এহেন প্রশ্নে প্রচ্ছদ পিলে চমকে তাকালো। হাতের তোয়ালে টা পরে যেতে যেতে পরলো না। সে বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে অন্যদিকে দৃষ্টি ঘুরালো। গলা খাঁকারি দিলো। দুষ্টু জানালা বন্ধ করে দিতে দিতে বলল,
‘বেসেছিলেন এক মূহুর্তের জন্যও কিংবা কখনো বাসার সম্ভাবনা আছে?’
প্রচ্ছদ আড়চোখে তাকায়। কেশে গলা পরিষ্কার করে জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে বলে,
‘এসব প্রশ্নের কারন?’
দুষ্টু গুরুত্বহীন গলায় চিন্তিত ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
‘নাহ মানে, অনেকদিন আগে আরকি! আপু বলেছিলো হয়তো আপনিও আমাকে ভালোবেসে ফেলতে পারেন। তাই জিজ্ঞেস করলাম। ক্লিয়ার থাকা ভালো না?’
‘তো কি ক্লিয়ার হলে?’ প্রচ্ছদ ভ্রু উঁচু করে।
‘এই যে, আপনি আমায় ভালোবাসেন না। হয়তো সম্ভাবনাও নেই। না বাসাই ভালো। কখনো মনের ভুলেও ভালোবেসে ফেলবেন না যেন! ভালোবাসার বিনিময়ে কিছু দিতে হয়। আমার কাছে দেওয়ার মতো কিছু নেই। আমাকে ভালোবাসলে কষ্ট বৈ আর কিছুই পাওয়া যায় না।’
শেষের বাক্য বলার ক্ষনে দুষ্টুর গলার স্বর’টা কেমন অন্যমনস্ক হয়ে কেঁপে উঠলো। প্রচ্ছদ অপ্রস্তুত, বিদীর্ণ চোখে চাইলো। উদাস কণ্ঠে শুধু বলল,
‘আচ্ছা।’
দুষ্টু আনমনা হয়ে বলে,
‘আমার কেনো যেনো মনে হয় আপনি আমাকে এক মূহুর্তের জন্যে হলেও কখনো ভালোবেসেছেন। কেনো মনে হয়? আচ্ছা, আপনি কি সত্যি কখনো এক সেকেন্ডের জন্যেও আমাকে ভালোবেসেছেন?’
প্রচ্ছদ দুষ্টুর থেকে দৃষ্টি সরালো। অকপটে জবাব দিলো,
‘নাহ।’
দুষ্টু হাফ ছাড়া গলায় বলে উঠলো,
‘বেঁচে গেলাম। এই আপনি যদি আবার আমাকে ভালোবাসতেন তাহলে সারাজীবন আমাকে একটা বোঝা বয়ে নিয়ে বেড়াতে হতো। কাছের মানুষের ভালোবাসা গ্রহণ না করার মাঝে খুব অস্বস্থি!’
প্রচ্ছদ কেমন করে যেন চাইলো,
‘আমি তোমার কাছের মানুষ?’
‘অবশ্যই, পার্মানেন্ট স্বামী না হলেও তো টেম্পোরারি স্বামী। সেই হিসেবে এই মুহুর্ত’টার জন্য আপনি আমার ভীষণ কাছের মানুষ না?’
প্রচ্ছদ অপ্রতিভ চোখে তাকালো। খানিক বাদে জিজ্ঞেস করলো,
‘তুমি তো তাকে ভালোবাসতে তাহলে কেনো কিস করতে দিলে না?’
হঠাৎ এমন প্রশ্নে দুষ্টু আস্তে-ধীরে তাকালো প্রচ্ছদের দিকে। অনেকক্ষণ চেয়ে রইলো। ভাবলো। চিন্তা করলো। বুঝার চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছুতেই কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। সত্যি তো, কেনো নীড়কে কিস করতে দেয়নি? তার বিয়ে হয়ে গেছে বলেই কি? বিয়ের আগে এমন পরিস্থিতি ঘটলে সে কি করতো? দিতো নাকি দিতো না?
দুষ্টু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কোনো উত্তর দিলো না। বাতি নিভিয়ে আসতেই অন্ধকার ঘরে প্রচ্ছদ ওর সামনাসামনি দাঁড়িয়ে হালকা হাতে কানের পেছনে চুল গুঁজে দিতে দিতে বলল,
“মূল্যবান হন, অর্থহীন নয়।”
বলেই প্রচ্ছদ বারান্দার দিকে পা বাড়ালো। কথা’টা বোঝামাত্র দুষ্টুর সবার্ঙ্গ কেঁপে উঠলো। আঁধার ডিঙিয়ে মানুষ’টার দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক। লোকটা কি বলে গেলো? কোন ইঙ্গিত? দুষ্টু কি অর্থহীন হয়ে গেছে নাকি অর্থহীন হয়নি বলেই ব্যাপারটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেলো? একবার কি জিজ্ঞেস করবে? না থাক।
তবে যাই হোক, এই প্রথমবার… প্রথমবার প্রচ্ছদের কথায় সে মুগ্ধ হলো। বক্ষের তরে স্থাপন করলো। মন ভালো করা এই শক্তিশালী বাক্যটা সে সবসময় মনে রাখবে। সবসময়…। মস্তিষ্কের এতো এতো জড়োপল্টো চিন্তার সাথে এও ভাবলো, এই লোকের মুখে হঠাৎ হঠাৎ আপনি ডাক’টা শুনতে মন্দ লাগে না বরং অজ্ঞাত তৃপ্তি বোধ হয়!
চলবে❤️
#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৩০
৬২.
পড়ন্ত বিকেলের শেষ মিঠে রৌদ্রস্নাতে মাখামাখি হাওয়াদের ঝাপটা। শুষ্ক পবন গায়ে মেখে অস্থির ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে প্রযুক্ত। শ্রেয়সী তড়িঘড়ি করে এলো। খানিকটা উচ্চস্বরে তাকে বলতে শোনা গেলো,
‘আপনি আমার বাসার সামনে কেনো এসেছেন?’
প্রযুক্ত ভ্রু কুচকে তাকালো। শ্রেয়সী আশেপাশে দেখে নিয়ে নিচু গলায় বলে,
‘চলুন এখান থেকে। কেউ দেখে নিলে বাবা বাসা থেকে বের করে দিবে।’
‘বের করে দিলে বের হয়ে এসে পরবেন। আমি আমার সঙ্গে করে নিয়ে যাবো। চলুন।’
শ্রেয়সী অবাক হলো, ‘মানে?’
‘রিক্সায় উঠুন বলছি।’
রিক্সায় উঠে বসতেই শ্রেয়সী হুট উঠিয়ে দিলো। প্রযুক্ত বিরক্ত মুখে হুট নামিয়ে দিয়ে বলল,
‘অন্ধকার অন্ধকার লাগে।’
শ্রেয়সী ভ্রু উঁচু করে বলে, ‘সমস্যা কি আপনার?’
‘কোনো সমস্যা নেই।’
‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’
‘কাজী অফিসে।’
‘কিহহহ?’
প্রযুক্ত আতংকিত চোখে তাকালো। শ্রেয়সীর মৃদুমন্দ চিৎকারে রিক্সাওয়ালা মামাও ঘাড় ঘুরালো বিরক্ত মুখে। প্রযুক্ত হীম শীতল কণ্ঠে শুধালো,
‘আপনি আমাকে ভালোবাসেন না? কাল রাতে মিথ্যে বলেছিলেন?’
শ্রেয়সী তাজ্জব বনে গেলো,
‘কি আজব! মিথ্যে বলতে যাবো কোন দুঃখে?’
‘তবে চিৎকার দিয়ে উঠলেন কেনো?’
শ্রেয়সী মিনমিন করে,
‘আমরা কাজী অফিসে কেনো যাবো?’
‘নিশ্চয়ই আপনাকে খুন করতে নিয়ে যাবো না। কাজী অফিসে মানুষ যা করতে যায় আমরাও তাই করতে যাবো।’
প্রযুক্তকে এমন ধারায় কথা বলতে এই এক মাসে দেখেনি শ্রেয়সী। সে বিস্ময় নিয়ে ফাঁকা মস্তিষ্কে তাকিয়ে রইল প্রযুক্তর অচেনা রাশভারী মুখ’টার দিকে। চোখের তাঁরা শূন্য। বুঝে আসছে না এখনো ঘটনাটির পটভূমি। দেখতে দেখতে রিক্ত দৃষ্টিতে ভাসলো দেয়াল থেকে রং সিমেন্ট খসে পড়া পুরাতন বিল্ডিং। শ্রেয়সীকে হাত ধরে প্রযুক্ত নামালো। শক্ত মুখে হেটে গেলো ভেতরে। রেজিষ্ট্রেশন পেপারে সই করতে বলা হলো। শ্রেয়সী তখনো বিস্মিত। তাক লাগা চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘স্বপ্ন নাকি বাস্তব? এসব কি হচ্ছে?’
‘বাস্তব। আপনি কি সই করবেন?’
শ্রেয়সী ডানে-বামে মাথা নাড়ালো। প্রযুক্তর শক্ত চোখ-মুখে একটা ঠান্ডা মেজাজের গম্ভীর শঙ্কার রেখা ভাসলো। নিবিড় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
‘ভালোবাসেন না আমাকে তাই না?’
শ্রেয়সী আবার মাথা নাড়ালো। উপর-নীচ! প্রযুক্ত অস্থির কণ্ঠে বলে,
‘সই করুন। জাস্ট নাও। ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা ভীষণ প্রকট। একবার আঘাত সইতে সইতে বেঁচে গেছি। আমার আত্মা আর ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত নয়, শ্রেয়সী।’
নির্মল আচ্ছন্নতা থেকে বেরিয়ে এসে অসহায় কণ্ঠে শ্রেয়সী বলে উঠলো,
‘আমি তো হারাচ্ছি না।’
প্রযুক্ত মাথা নাড়ালো, ‘হারাতে কতক্ষণ?’
শ্রেয়সী চোখ কুচকায়, ‘আমাকে বিশ্বাস হয় না?’
‘আপনাকে ছাড়া আমার বাঁচা হবে না।’
শ্রেয়সীর চোখের পর্দায় ঘন আবেশের ছায়া পরলো। প্রযুক্ত তাড়া দিলো,
‘সই’টা করুন না! ভালোবাসেন তো আমাকে নাকি? ভালোবাসলে তো একসময় বিয়ে করবেনি। তবে এখনি করে ফেলি। ক্ষতি কি!’
শ্রেয়সী সই করে দিলো। উগ্র, ভয়ংকর মোহের কবলে দৃষ্টিজোড়া আটকে কবুলও বলে দিলো দৈবাৎ। বলার পর সারা শরীর কেমন ঝনঝন করে উঠলো। দেহের বল হারিয়ে যেতে লাগলো ক্রমশ। দৌর্বল্য নয়নে তাকিয়ে ক্ষীয়মান কণ্ঠে বলল,
‘ভুল করলাম কি? আমার মন’টা এতো অস্থিরতায় ভুগছে কেনো?’
প্রযুক্ত ফিসফিস করে বলে,
‘চরম ভুল করে ফেললেন৷ ফ্রম নাও, আপনার নাম থেকে চুলের সুবাস পর্যন্ত আমার নাম জপবে। আমার ভীষণ সুখ অনুভূত হচ্ছে, শ্রেয়সী। আমি আপনার একচ্ছত্র অধিপতি এবং আমি আপনাকে পিপাসার ন্যায় ভালোবাসি।’
৬৩.
জানালায় পর্দা ফেলানো। ভারী পর্দা উড়িয়ে হুহু করে বাতাস ঘরের আনাচে-কানাচেতে জায়গা করে নিচ্ছে। সাজিদ শুয়ে ছিলো পিঠ দিয়ে ছেলের দিকে ঘুরে। ছেলের বুকের উপর তার একটা হাত। আরেকটা হাত মাথার নিচে। চোখের দৃষ্টি শূন্যে। মিষ্টি আকাশ হাসছিলো। নরম তুলতুলে ছোট্ট হাত দিয়ে বাবার শরীর ছুয়ে দিচ্ছিলো। ডেসিনটেবিলের সামনে নীল রঙের নাইটি পরা নীরা হাত-পায়ে তখন নাইট ক্রিম মাখছিলো যত্নসহকারে। বাম হাতে ক্রিম ঘষতে ঘষতে আড়চোখে একবার সাজিদের দিকে তাকালো। বলল,
‘এই ব্লু নাইটি পরে আমাকে সুন্দর লাগছে না?’
সাজিদ না তাকিয়েই বলে, ‘হুম।’
নীরা ভ্রু কুচকালো, ‘কেমন সুন্দর?’
‘অনেক সুন্দর। এতোটা সুন্দর যে পৃথিবীর সব মেয়ে এ সুন্দরের কাছে নগন্য। ওই লম্বা দুটো বিনুনি, গোলগাল ফর্সা মুখ, নীল-সাদা ড্রেসে অপূর্ব লাগে তোমায়। আমার তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে হয়।’
সাজিদ বলছিলো নির্বিঘ্নে এক সমুদ্র আবেগের ঘোরে। হঠাৎ গায়ে কে যেনো ধাক্কা দিলো। চোখ তুলে নীরাকে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। নীরা ক্রুর দৃষ্টিতে তাকালো,
‘কি বলছিলে তুমি?’
‘কই?’
‘এইমাত্র। লম্বা দুই বিনুনি, গোলগাল মুখ, নীল-সাদা ড্রেস?’
‘তোমার কথাই বলছিলাম।’
নীরা সন্দেহ নিয়ে নিজের দিকে আঙ্গুল তাক করে,
‘আমার কথা?’
‘হুম। তোমার চুলগুলো আগে অনেক লম্বা ছিলো না? দুই বেনী’তে কী অপরূপ লাগতো! এখন তো কেটে ফেলেছো। আমার ইচ্ছের তো আর কোনো দাম নেই। এইসব কি নাইটি পরে ঘুরছো? না করেছিলাম না? সাধারণ ভাবে তোমায় বেশি সুন্দর লাগে, নীরা।’
‘তাই?’
সাজিদ চোরা গলায় বলে, ‘হুম।’
‘আজকাল খুব বেশি কল্পনার জগতে থাকো বোধ হয়। সবসময় অন্যমনস্ক। ব্যাপার কি?’
সাজিদ বিরক্ত নিয়ে চাইলো। ছেলের দিকে ঘুরে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।
‘তুমি কি প্রেম করছো?’
সাজিদ একটু উঁচু কণ্ঠে বলে,
‘ভেবেচিন্তে কথা বলো। কি যা তা বলছো হ্যাঁ? ছেলে আছে আমার।’
‘ওহ, মনে আছে তাহলে?’
‘মনে আছে মানে? মনে থাকবে না কেনো? একটা মাত্র বাচ্চা আমার।’
‘সাট আপ। বাবা হওয়ার কোন দায়িত্ব’টা পালন করো তুমি?’ নীরা দাঁতে দাঁত চেপে বলে।
‘মা হওয়ার কোন দায়িত্ব’টা তুমি-ই পালন করো? সবসময় তো আম্মাই দেখে এলো। তুমি তো সারাদিন সাজগোছ নিয়েই থাকলে। আমার দিকে তাকানোর পর্যন্ত সময় ছিলো না কখনো তোমার বাচ্চা তো দূরে থাক।’
‘তাকাবো কি করে? স্বামী হওয়ার যোগ্যতা আছে নাকি তোমার?’
সাজিদ কড়া চোখে তাকালো। শক্ত গলায় বলে উঠলো,
‘স্ত্রী হওয়ার মতো এক ফোঁটা যোগ্যতাও কি কখনো তোমার ছিলো? কোন দায়িত্বটা পালন করেছো? আমি তবুও তোমাকে ভালোবাসতে চেয়েছি। অসুস্থ হলে সেবা করেছি। রাগ করলে রাগ ভাঙিয়েছি। খাইয়ে দিয়েছি। পরিশ্রম করে সব আবদার মেটাচ্ছি। কিন্তু তুমি? তুমি বলতে পারবে কখনো আমায় একটুখানি ভালোবেসেছো? অসুস্থ হলে ফিরে তাকিয়েছো? আহ্লাদ করে খাইয়ে দিয়েছো? নাকি রাগ করলে কখনো এসে জড়িয়ে ধরে রাগ ভাঙিয়েছো? উল্টে সবসময় নিজের আমোদ ফূর্তিতে ব্যস্ত থেকেছো। আমাকে তুমি থোরাই কেয়ার করো! আমাদের সম্পর্ক’টা শুধুই শারীরিক, এর বেশি আর কিচ্ছু নেই।’
সাজিদ আকাশ কে কোলে নিয়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ালো। নীরা স্থির দাঁড়িয়ে রইল। কথাগুলো খুব একটা ভুল নয় তবে সাজিদ কি কখনো মন থেকে চেষ্টা করেছে? চেষ্টা করলে হয় না এমন কিছু আছে নাকি পৃথিবীতে? তাদের সম্পর্ক’টা কি সত্যি শুধু শারীরিকে আবদ্ধ? শারীরিক সম্পর্কে তবুও আচ্ছন্নতা থাকে, সুখ থাকে, আবেগ থাকে। কিন্তু তাদেরটা তো যান্ত্রিক।
সাজিদ বারান্দার দরজার সামনে গিয়ে ঘুরে দাড়ালো। হালকা হেসে ফিচেল গলায় বলল,
‘বিয়ের পরেও তোমার প্রেমিকের সাথে অনেকদিন যোগাযোগ ছিলো তাই না? আচ্ছা, কতদিন ছিলো?’
নীরা চকিতেই তাকালো। মুখভর্তি আতংক। অস্পষ্ট স্বরে বলল, ‘হঠাৎ আজ এসব প্রশ্ন?’
‘এমনি, শুনি।’
নীরা চোখ বন্ধ করে মাথা নেড়ে ক্রমাগত বলল,
‘ছিলো না। কক্ষনো ছিলো না। কক্ষনো না।’
সাজিদ তবুও বলল স্মিত হেসে,
‘তোমার স্বামী হওয়ার পরিপূর্ণ যোগ্যতা তার ছিলো বোধ হয়। ইশশ… আমাকে বিয়ে করে জীবনে কী বড় ভুল’টাই না করলে!’
সাজিদ চলে গেলো আকাশকে বুকে ধরে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে। নীরা স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলো সাজিদের পিঠের দিকে। মাকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে আকাশ মুখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে মাড়ি বের করে হেসে উঠলো। এই বাচ্চা’টার জীবন বাবা-মায়ের যাতাকলে কখনো পিষে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে? আছে কি? আদুরে মুখের নিষ্পাপ হাসিটার দিকে নীরা তাকিয়ে থাকলো। বেশ অনেকক্ষণ!
৬৪.
জানালার খোলা পাট্টার ধারে দুষ্টু দাঁড়িয়ে ছিলো হেলান দিয়ে। প্রচ্ছদ তার পেছনে এসে দাঁড়ায়। দাড়াঁতেই শীতল বাতাসে ঠান্ডা চুল গুলো উড়ে এসে খেলে গেলো তার চোখে মুখে। কালো রেশমের ন্যায় চুলগুলো থেকে তখন ভেসে আসছিলো মিষ্টি সৌরভ। আলতো হাতে সে চুল সরালো। চুলে টান লাগতেই দুষ্টু পেছন ঘুরে তাকালো। সরি বলে চুলগুলো টেনে হাত খোপা করলো। প্রচ্ছদ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখলো সে দৃশ্যটুকু। জানালা গলিয়ে অন্ধকারের রাজ্যে দৃষ্টিপাত করে দুষ্টু জিজ্ঞেস করলো মৃদুস্বরে,
‘কিছু বলবেন?’
‘নাহ।’
‘তাহলে?’
‘তোমার সাথে অন্ধকার দেখি?’
প্রচ্ছদের নিকচ আবেদন। দুষ্টু ঈষৎ হাসলো,
‘অন্ধকার দেখবেন?’
‘তাই তো দেখছো।’
‘হুম..।’ সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
‘মন ভালো না খারাপ?’
‘মাঝামাঝি।’
প্রচ্ছদ জোরে শ্বাস নিয়ে ভঙ্গি করে বলল, ‘তাও ভালো। মহারানীর মন বলে কথা!’
প্রচ্ছদের কথা বলার ধরণে দুষ্টু হেসে দিলো। প্রচ্ছদের দিকে ঘুরে বুকে হাত ভাঁজ করে দাড়ালো। প্রচ্ছদ দুষ্টুর পাশ ঘেঁষে হাত’টা রাখলো জানালার পাট্টায়। বেখেয়ালি দুষ্টু মৃদু হেসে বলল,
‘বাব্বাহ! আপনার মুড মনে হয় আজ ভীষণ ভালো?’
‘হুম। ভালো তো। খুব ভালো।’
‘এতো ভালো? কারণ?’
‘অনেক বড় কারণ।’
‘তাই নাকি?’
‘হুম।’
‘শুনি একটু।’
প্রচ্ছদ ফিসফিস করে বলল, ‘বাড়িতে বিয়ে লাগবে খুব শীঘ্রই। আমার প্রিয় মানুষের বিয়ে।’
দুষ্টুও ফিসফিস করে বলে, ‘প্রিয় মানুষ’টা কে? প্রেমিকা?’
প্রচ্ছদ শব্দ করে হাসলো। চুল ঝাঁকিয়ে বলল, ‘কাল দেখতে-ই পাবে।’
চলবে❤️