#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৩১
৬৫.
পুবাকাশে সূর্য এবং আকাশের চুম্বনের লাল রেখা ভাসছে। ভোর ফোটা আলোয় টিউ টিউ করে মিষ্টি শব্দে একটা পাখি উড়ে গেলো বাড়ির উপর দিয়ে। দূরের চাঁপা ফুলের মিষ্টি গন্ধে দুষ্টুর মন জুড়ালো। জোরে শ্বাস টেনে নিতে নিতে পেছন দিকে ঘুরতেই শক্ত, সুঠাম, চওড়া বুকের সাথে হালকা করে ধাক্কা লাগলো। দুষ্টু বিরক্তি নিয়ে মাথায় হাত ঘষে প্রচ্ছদের দিকে তাকাতেই মিষ্টি করে হাসলো।
প্রচ্ছদ সময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলো মরা হাসি’টার দিকে। আজ-কাল মেয়েটা আর জেদ করে না, বায়না ধরে না, তর্ক করে না। দুষ্টু, চঞ্চল, স্বভাবের বাচ্চামো মেয়েটা যেন চোখের পলকেই শান্ত, ধীর-স্থির সাথে বড় হয়ে গেলো। বয়সের সাথে আচরণের মিল পাওয়া যায় বরং। কিন্তু এহেন আচরণ তো দুষ্টুকে মানায় না। এই আচরণের সাথে তো প্রচ্ছদও অভ্যস্ত নয়। দিন-রাত তার ভীষণ অস্বস্থি হচ্ছে। কী একটা অপরাধ বোধের মতোন অনুভূতি বারবার মাথা চাড়া দিয়ে জাগতে গিয়েও পরক্ষণে নেতিয়ে পরে।
দুষ্টু তুড়ি বাজালো। ভ্রু উঁচু করে হাত নাড়িয়ে বলল,
‘কি? কি দেখেন?’
দুষ্টুর ওই ভ্রু উপরে তুলে নিচের ঠোঁট ভেতরে নিয়ে গিয়ে হাত নাড়িয়ে কথা বলার ভঙ্গিমাটা ভারি সুন্দর ছিলো। তাকে যেন আজ একটু বেশি দারুন লাগছে। সদ্য প্রস্ফুটিত কোমল ফুলের মতোন মিষ্টি হাসি ফুটে উঠেছে ওষ্ঠে। ফর্সা লম্বাটে মুখটা জুড়ে ভীষণ পবিত্রতার ছাপ। ভোর ভাঙা পেলব, নরম, লালচে প্রভা’র অভিমুখে মুখের একপাশ ক্ষণে ক্ষণে হয়ে উঠছে লাবণ্যময়ী। মাথায় লাল রঙের সুতি ওড়না প্যাচানোতে দুষ্টুকে এই প্রথম দেখলো প্রচ্ছদ। নামাজ পড়ে আর খোলা হয়নি। ওই অরুণ আলোয়, করুণ রাঙা মুখ’টার দিকে নিমিষে একচিত্তে তাকিয়ে থেকে প্রচ্ছদ অবচেতন মনেই বলে উঠলো,
‘আপনাকে।’
‘হুম?’
‘হুম। আরেকটু কম সুন্দর হলে কি হতো?’
দুষ্টু তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে প্রচ্ছদের বুকের বা’পাশে হালকা করে স্পর্শ করলো। সে চমকে তাকালো। দুষ্টু আগের মতোই হাত নেড়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কি?’
প্রচ্ছদ কাধ নাঁচায়, ‘কোথায় কি?’
‘কি বলছেন এসব?’
‘কই? ওহ… আমার কল্পনার গোপনীকে বলছিলাম।’
দুষ্টু ভ্রু কুচকে তাকায়। প্রচ্ছদ চোখ উল্টে ফু করে নিশ্বাস ছেড়ে গোপন ব্যর্থে মাথা নাড়ে। দুষ্টু বারান্দায় পায়চারি করতে করতে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,
‘আপনার প্রেমিকার নাম কি?’
প্রচ্ছদ আবার চোখ উল্টালো। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দুষ্টু প্রশ্নটা আবার করে। প্রচ্ছদ ভীষণ আবেগের ন্যায় ভঙ্গি করে জবাব দেয়, ‘সন্ধানী।’
‘কিহ? সন্ধানী?’
‘হুম।’
দুষ্টু জোরপূর্বক বলে, ‘ওহ, নাইছ। আনকমন নেইম।’
‘দেখতে হবে না কে রেখেছে?’
‘কে?’
‘আমি।’ প্রচ্ছদ কলার উচুঁ করে ভাব নিলো।
সে বিস্ময় নিয়ে তাকালো, ‘আপনি? আপনার প্রেমিকার নাম আপনি রাখছেন? তার মানে ওর আকিকা আপনি নিজে করছেন। তাহলে আপনি ওর প্রেমিক কীভাবে হন? বাপ, দাদা, চাচা, খালু, ঝালু কিছু একটা হবেন।’
প্রচ্ছদ থতমত খেয়ে কথা ঘুরালো, ‘নাহ। আর কি! কিছু না। বাদ দেও। তোমার মোটা মাথায় ডুকবে না।’
‘কি বললেন?’ দুষ্টু নাক ফোলায়।
‘বলেছি, আজ কিন্তু বাড়িতে মিলাদ পড়াবে।’
‘কেনো?’
‘আমার ফুফু-ফুফার মৃত্যুবার্ষিকী।’
‘ওহ। তারা মারা গিয়েছেন কীভাবে?’ দুষ্টুর স্বর নিচে নেমে এলো।
‘এক্সিডেন্ট করে।’
‘তাদের কোনো ছেলে-মেয়ে নেই?’
‘আছে।’
‘আসবে?’
‘হুম।’
‘আপনাদের কাছে থাকলেই তো পারে।’
‘সেটা তো আমরাও বলি।’
প্রচ্ছদ ঘরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। দুষ্টু বড়দের মতো ডাকলো, ‘এই যে! নামাজ পড়া হয়েছিল কি?’
প্রচ্ছদ হাসলো, ‘হুম।’
সে আবার যাওয়ার উদ্দেশ্যে কদম ফেললো। দুষ্টু আস্তে করে ডাকে। প্রচ্ছদ মাথা ঘুরাতেই বলল,
‘আজকে না আমাদের কোর্টে যাওয়ার ডেট ছিলো?’
ভালো একটা মূহুর্ত নষ্ট করতে যেন এ কথাটাই যথেষ্ট ছিলো। প্রচ্ছদের চোখ-মুখ শক্ত হয়ে এলো। অন্যদিকে ঘুরে বলল,
‘হুম। কিন্তু আজ তো সম্ভব নয়। কাল আমার সময় হবে না। পরশু যাবো। চিন্তা করো না।’
বলেই প্রচ্ছদ চপল পায়ে চলে গেলো। পূবাকাশে রক্তিম রেখা সরে গিয়েছে। চারিদিকে নরম রোদ ঝিমুচ্ছে। গায়ের শাল’টা আটসাট ভাবে জড়িয়ে দুষ্টু সেদিকে তাকিয়ে থেকে পরপর অনেকগুলো দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
৬৬.
বেলা দশ’টা। হক বাড়িতে মানুষের আনাগোনা। ব্যস্ত লোকের পদধ্বনি। উঁচুস্বর, হাক-ডাক, শব্দ একাকার। নীড় রিক্সা থেকে নামলো। বুক ফুলিয়ে নিঃশ্বাস টেনে নিলো। শেষ এসেছিল বোধহয় কুরবানীর ঈদে। আসবে না আসবে না করেও দুই মামা গিয়ে তাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে এসেছে শত ব্যস্ততার মাঝেও। বস্তুত, এই বাড়ির প্রতি তার অনেক ঋণ। এই জগৎ সংসারে এ বাড়ির মতো আপন তার আর কোথাও নেই। এ বাড়ির মানুষগুলোর মতো আদর-সোহাগ তাকে আর কেউ কখনো করেনি। ও বাড়িতে থাকে সে একমাত্র বাবা-মার বিস্তর স্মৃতি আছে বলেই। নীড় কদম ফেলল। তার বুকের ভেতর একপ্রকার অপ্রাকৃত আওয়াজ হচ্ছে। ভালো লাগছে না একদম।
—-
দুষ্টুর কপালে পরেছে বাটাবাটির কাজ। তার সাথে বসেছে আরো তিনজন মহিলা। তাদের দক্ষ, শক্তপোক্ত হাত অথচ তার হাতের তালু লাল হয়ে গিয়েছে। ব্যথায় হাতের জয়েন্ট খুলে পরার যোগাড়। দুষ্টু বাটতে বসেছে ডাইনিং রুমের মেঝেতে। রান্নাঘরে গিজগিজ করছে মানুষ। বসা তো দূরের কথা দু’পা নিয়ে মিনিট খানেক দাঁড়ানো দায়। পেঁয়াজ বাটতে বাটতে সে অসহায় চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে ইরা কিংবা নীরাকে খুঁজলো। রসুন বেটে হাত জ্বলছে। মাথার কাপড় পরে গেছে। নতুন বউ। বাড়ি ভর্তি মানুষ। কে কোনদিকে কোন কথা বলে! ব্যস্ত ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকাতেই তার সচল হাত দুটো অচল হয়ে এলো। স্তব্ধ হয়ে গেলো হৃৎপিণ্ড৷ অশান্ত, ব্যস্ত চোখের মনি দুটো হঠাৎই শান্ত, নরম, জ্বলজ্বল করে উঠলো। এক রাজ্য সমান অবাকতা, বিস্ময়তা নিয়ে সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সদর দরজার দিক।
প্রচ্ছদ এসে ঠোঁট প্রসারিত করে জড়িয়ে ধরলো আগমনীকে। সিড়িন হক, সবুজা হক গিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে শরীরের হাল-চাল নিয়ে স্নেহময় প্রশ্ন করলো। ইফতার হক, মারুফ হক জড়িয়ে ধরে উচ্চস্বরে হেসে কথা বলল। এতোটা খুশি হয়ে এভাবে কারোর সাথে কথা বলতে এই একমাসে এ বাড়ির মানুষগুলোকে দেখা যায়নি। রীতিমতো সেখানে ছোট খাটো জটলা পেকে গেছে। নীড় মৃদু হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে তাদের সাথে তাল দিলো। প্রচ্ছদ কথা বলছিলো উচ্চশব্দে। কি যেন বলে হাসছিলো নীড়ের বাহুতে মেরে। সবুজা হক নীড়ের হাত থেকে ফলমূল, মিষ্টির প্যাকেট গুলো নিয়ে গেলেন। প্রচ্ছদ ধমকে বলল, ‘এসব আনতে কে বলছে?’
‘তুই।’
‘আমি? মারবো এক থাপ্পড়।’
‘মার। আমারও হাত আছে।’
‘আমি তোর বড়।’
নীড় মুখ ত্যাড়া করে বলে, ‘দু’বছরের বড় কোনো বড় না। তুই আমার বন্ধু।’
‘মেয়েদের মতোন মুখ বাকাঁস কেন? চল বস।’
পা ফেলতে না ফেলতেই চোখ পড়লো ডাইনিং রুমে স্থির বসে থাকা পেঁয়াজে হাত মাখামাখি মেয়েটার দিকে। দৃষ্টি শুন্য, মুখ রক্তশূণ্য। তাকাতেই নীড়ের চোখের পলক পরলো না। শরীর অপ্রস্তুত কাঁপুনিতে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো। কম্পনরত হাত’টা অনেক কষ্টে উঠিয়ে দুষ্টুর দিকে তাক করে বলতে পারলো শুধু,
‘ও এখানে?’
প্রচ্ছদ হাসলো। ওর কাধ চাপড়ে বলল,
‘তোর ভাবী। বিয়েতে তো এলি না। চট্টগ্রাম চলে গেলি। তোর বিয়েতেও দেখিস আমি থাকবো না, শালা।’
চারিদিকে যেন বজ্রপাতে সব ধ্বংস হয়ে যেতে লাগলো। আশেপাশের কোনো ধ্বনি তার কর্ণপাত হলো না। কানে পুপু ধরনের একপ্রকার শব্দে তালা লেগে যাচ্ছিলো। মনের ভেতর গড়া অভিমান, রাগের দূর্গ গুলো আকস্মিক বিস্ময়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। তবুও স্বস্তি ছিলো। কিন্তু একি! বিশাল পাহাড় পরিমাণ অস্বস্থির বোঝা নিয়েই কি সারাটা জীবন পার করতে হবে তাকে? তার সবচেয়ে প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের বউ! ভাবলেই নীড়ের শরীর শিউরে উঠছে, কেঁপে উঠছে, অসাড়তায় ভুগছে। সে টলতে টলতে সোফায় বসলো।
দুষ্টু আবার কাজে মনোযোগ দিলো। নিষ্প্রাণ হাত দুটো চলছে শক্ত পাটায় অবিরাম যন্ত্রের ন্যায়। হঠাৎ কে যেনো মাথার কাপড়’টা তুলে দিলো। দুষ্টু চমকে ঘাড় ঘুরালো। প্রচ্ছদ ঈষৎ হেসে ফিসফিস করে বলল,
‘একটা বয়স্ক মহিলা বলছিলেন, নতুন বউয়ের তো আদব-কায়দা নেই। মাথায় কাপড় পর্যন্ত দেয় না। আমি চাই না আমার ক্ষণস্থায়ী হলেও একমাত্র অর্ধাঙ্গিনীকে কেউ কটু কথা বলুক।’
দুষ্টু একদৃষ্টিতে প্রচ্ছদের মুখের দিকে চেয়ে রইল। প্রচ্ছদ ব্যতিব্যস্ত গলায় বলে,
‘কি ব্যাপার? চোখ লাল কেনো? পেঁয়াজের ঝাঁঝে তাই না? চলো উঠো, বাটতে হবে না।’
প্রচ্ছদ হাত ধরলো। দুষ্টু নির্বাকে উঠে পরলো। নীড় পলকবিহীন চোখে সেদিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো, প্রচ্ছদ ইরাকে ডেকে নিয়ে দুষ্টুর চোখের দিক তাক করে হাত নেড়ে নেড়ে কি কি যেন বলছে! তার চোখ ক্রমশ ভিজে উঠলো। উল্টোদিক মুখ ঘুরিয়ে বাতাসে শ্বাস ছেড়ে পুনরায় অক্সিজেন টেনে নিয়ে বলল,
‘তবুও সে সুখে থাকুক।’
চলবে❤️
#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৩২
৬৭.
দুপুরে প্রযুক্ত এলো। দ্বিপ্রহরের সূর্যের কড়া উত্তাপে উদ্ভাসিত হক বাড়ির জানালা দরজা মাড়িয়ে সাদা ঝকঝকে মেঝে। উগ্র ঘোরের মাঝেই নীড় উঠে দাড়ালো। প্রযুক্ত জড়িয়ে ধরে পিঠ থাপড়ে বলল,
‘কি রে? খবর কি?’
নীড় হালকা করে মাথা নাড়ায়, ‘তোমার খবর কি? কেমন আছো?’
প্রযুক্ত ঈষৎ হাসে। প্রচ্ছদ তাদের সামনে এসে দাড়ালো। বলে,
‘কি ব্যাপার বল তো? তোদের দুজনের চেহারার এক্সপ্রেশন একইরকম? হতাশা নিয়ে ঘুরঘুর করছিস?’
প্রযুক্ত মৃদু হেসে প্রচ্ছদের পেটে গুতা দেয়। নীড় ঠোঁটে হাত রেখে আপাদমস্তক প্রযুক্তকে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
‘নতুন জামাই জামাই দেখতে লাগছে, না?’
প্রচ্ছদ ভ্রু বাকিয়ে প্রযুক্তকে দেখে। বলে, ‘সত্যি নাকি? বিয়ে-শাদি করে ফেলছোস?’
প্রযুক্ত সজোরে কিল দিলো দুজনের পিঠে। এ নতুন নয় একসাথে হলেই তাদের বিয়ে বিষয়ক কথাবার্তা চলে। হঠাৎ কে যেন ঝট করে নীড়ের হাত ধরে ঝুলে পরলো। নীড় ঘাড় বাঁকাতেই সে এক গাল হেসে উচ্ছ্বাসে জিজ্ঞেস করলো,
‘কেমন আছো নীড় ভাইয়া?’
নীড় টিয়ার গাল টিপে দিয়ে বলল, ‘ভালো। তুমি?’
‘বেশ ভালো। এবার থাকবে তো কিছুদিন?’
নীড় জোরপূর্বক হেসে মাথা নাড়ায়, ‘কাল সকালেই চলে যাবো। আজ রাতেও যেতে পারি। নট সিউর।’
টিয়া চোখ কুচকে বলে, ‘কেনো?’
‘কাজ আছে একটু, খুকি।’
‘কিসের খুকি? আমি বড় হয়ে গেছি।’
‘ওহ তাই নাকি?’
‘হুম। শুনুন স্যার। সরি প্রযুক্ত ভাইয়া…।’
প্রযুক্ত চমকে তাকালো। টিয়ার দিকে আতংক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রচ্ছদের কানে ফিসফিস করে বলল,
‘দেখ শুধু, এখন কি বলে?’
টিয়ার দিকে ফিরে প্রযুক্ত গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করে, ‘বলো।’
‘আমার না একটা চ্যাপ্টার সমস্যা। যাওয়ার আগে বুঝিয়ে দিয়ে যাবেন প্লি…।’
প্রযুক্ত প্রচ্ছদের দিকে তাকায়। প্রচ্ছদ খেঁক করে উঠে,
‘এই? প্রযুক্ত যেদিনই আসে সেদিনই তোর এতো চ্যাপ্টারে সমস্যা বের হয়? এটা প্রবলেম সলভ করার মতো সময়? বাড়িতে মিলাদ। সকলের মন ভালো নেই। আর আসছেন উনি বিদ্যার জাহাজ! কত সমস্যা তার! পড়াশোনা নিয়ে কত চিন্তিত সে!”
টিয়া চোখ ঘুরায়,
‘ওমা! প্রযুক্ত ভাইয়া হলো আমার স্যার তাকে দেখলে তো সমস্যারা পায়ে হেটে চলে আসবেই। এসব হলো ভালো ছাত্রীর লক্ষণ। বুঝছো ভাইয়া?’
‘কত ভালো দেখাই যায়! ক’টা সমস্যা আমার কাছে নিয়ে আসিস? থাপড়ায়ে মাথার ভূত নামায় দেবো।’
টিয়া থতমত খেয়ে বলল,
‘তুমি ভাবীকে নিয়ে বিজি থাকো তাই যাই না। একদম আমাকে অপমান করে কথা বলবা না ভাইয়া। আমি বড় হয়ে গেছি কিন্তু।’
নীড়ের মুখ’টা শুকনো হয়ে এলো। প্রচ্ছদ বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘অকালকুষ্মাণ্ড একটা!’
প্রযুক্ত হাসে। নীড়ের কনুই ধরে বলে,
‘আমি তো মিলাদ খেয়ে বিকেলেই চলে যাবো টিয়া। তুমি বরং নীড়ের কাছে থেকে বুঝিয়ে নিও। ও ব্রাইট স্টুডেন্ট। তোমার থেকেও ওর মধ্যে লক্ষণ ভালো।’
নীড় ঠোঁট চেপে হাসলো। টিয়া নাক ফুলিয়ে বলল,
‘নাহ, থাক নীড় ভাইয়া অনেকদিন পর এসেছে। ওকে কষ্ট দিবো না। আপনি পরে এসে বুঝিয়ে দিয়ে যাবেন।’
টিয়া চলে যেতেই প্রযুক্ত ফিসফিস করে বলে,
‘তোর বোনের মতো মাথামোটা ছাত্রী আমি আর একটাও পাইনি। সামান্য একটা ম্যাথ নিয়ে এসেও বলে বুঝিয়ে দেন। কদিন পর দেখা যাবে ‘অ আ’ নিয়ে এসে বলছে এই অক্ষরের নাম অ কেনো? আপনার নাম প্রযুক্ত কেনো? আমার নাম টিয়া কেনো? আচ্ছা, মানুষের নাম রাখতে হয় কেনো? এসব ইচ্ছে করে বলে জানিস? সব আমাকে শান্তিতে না থাকতে দেওয়ার ধান্দা।’
নীড় প্রযুক্তর কাধ ধরে চিন্তার ভান করে টিপ্পনী কেটে বলে,
‘একে বলে বিরাট ভালো ছাত্রীর লক্ষণ। যত সমস্যা তত আসান আর তত ভালো নাম্বার।’
৬৮.
মিলাদ শেষে খাওয়া দাওয়া সম্পূর্ণ হতে হতে প্রায় বিকেল পাঁচ’টা বাজলো। দুষ্টু হাতের কাজ-কর্ম শেষ করে উপরে চলল গোসল করতে। প্রচ্ছদ সোফা ছেড়ে উঠে এলো। সিড়ির কাছে গিয়ে খপ করে দুষ্টুর হাত’টা ধরলো। নীড় সোফা ছেড়ে তড়িৎ বেগে উঠে পরেও আবার সোফায় বসলো। প্রযুক্তর সাথে গল্পে ব্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করলেও নির্লজ্জ, অবাধ্য চোখ দুটো বারবার ঘুরে ঘুরে সামনে বরাবর সিড়ির দিকেই ভিড়ছিলো।
‘কি করছো? এক্ষুনি তো পরে যাচ্ছিলে।’
দুষ্টু প্রচ্ছদের হাতে ভর করে এক সিড়ির উপর দাড়ালো। পা দুটো টলছে। মাথা ঘুরাচ্ছে। এতো কাজ যেমন একসাথে কোনোদিন করা হয়নি তেমন এখন পর্যন্ত পেটে শরবত ছাড়া আর কিছুই পরেনি সাথে এতো বড় ধাক্কা পাওয়ার কল্পনাও কোনোদিন করা হয়নি। এতোটা অস্বস্থি! উফফ! প্রচ্ছদ দুষ্টুকে ধরে ধরে ঘর পর্যন্ত নিয়ে যেতেই দুষ্টু কাপড়-চোপড় নিয়ে অগোছালো পায়ে হেটে গেলো।
গোসল শেষে তোয়ালে পেঁচিয়ে বের হয়ে প্রচ্ছদকে তখনো বসে থাকতে দেখে সে ভ্রু কুচকালো। সাইড টেবিল’টার উপর খাবার থালা দিয়ে চাপানো দেখে কুচকানো ভ্রু দুটো আরো খানিকটা বেঁকে গেলো। থালা সরিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘খাবার নিয়ে এসেছেন আপনি?’
প্রচ্ছদ ফোনে চোখ বুলাতে বুলাতে উত্তর দেয়, ‘নাহ। বড় ভাবী দিয়ে গেছে।’
‘ওহ।’ বলেই দুষ্টু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা মুছলো। গায়ের উড়না, জামা টেনে ঠিক করে অনেকদিন বাদে নিজের চেহারার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলো। এরপর আয়না গলিয়ে প্রচ্ছদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো,
‘আপনি এখনো এখানে বসে আছেন কেনো? আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন?’
প্রচ্ছদ অপ্রস্তুত হলো। দুষ্টু মুখের উপর কথা বলে দেয়। মন আর মুখের মাঝে কোনো রাখঢাক নেই। ব্যাপারটা যেমন ভালো তেমন মানুষকে মুহুর্তেই বেকায়দায় ফেলে দেওয়ার দারুন একটা পন্থা। সে কথা এড়ালো,
‘সিড়ির কাছে তো প্রায় পরেই যেতে, আমি না ধরলে!’
‘গেলে যেতাম। তাতে আর কি এমন ক্ষতি হতো? একটু হাত-পায়ে নাহয় ব্যথাই পেতাম। দুদিন সবাই খুব আদর-যত্ন করে খাওয়াতো।’
প্রচ্ছদ সূক্ষ্ম চোখে তাকায়,
‘তোমার কথা-বার্তা এমন কাট কাট কেনো? নিজের দোষে শরীর কেনো খারাপ করবে? ভাবী বলে গেলো সকালেও খাওনি ঠিকমতো। কেনো? শরীর কি হেলা-ফেলা করার জিনিস? অন্যদের টেনশনে ফেলে, বসে বসে যত্ন-আত্তি নিতে খুব ভালো লাগবে, না?’
দুষ্টু প্রচ্ছদের দিকে এগিয়ে এলো। মাথাটা নিচু করে মুখোমুখি হলো। এরপর খানিকটা রাগী, খানিকটা শীতল আর খানিকটা তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠলো,
‘আপনার কি মনে হয় না, আমাকে নিয়ে আজ একটু বেশি মাতামাতি করছেন আপনি? এ বাড়িতে আছি তো প্রায় এক মাসের বেশি। কই এতো বাড়াবাড়ি করতে তো কখনো দেখিনি। লোক দেখাচ্ছেন? সবাইকে দেখাচ্ছেন তাই না যে, বউকে কতটা ভালোবাসেন, কতটা কেয়ার করেন?’
প্রচ্ছদ আগুন গরম চোখে তাকায়। চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘সাট আপ। ঠিকভাবে কথা বলো। সচরাচর যা করি আজ-ও তাই করছি। কেনো? তুমি যে সেদিন রাতে তোমার প্রেমিকের বাড়ি থেকে এসেই অজ্ঞান হয়ে গেলে সেদিন আমি তোমার সেবা করিনি? দেখ-ভাল করিনি সেই দু’দিন? তোমার মতো বেয়াদব মেয়ে এসব ডিজার্ভ-ই করে না। আমার পাপ হয়েছে তোমাকে মাথায় তুলে।’
দুষ্টু সোজা হয়ে দাড়ালো। হেটে বারান্দার দিকে গেলো ভেজা তোয়ালে নেড়ে দিতে। সেখান থেকেই খানিক উঁচু স্বরে বলল,
‘পরশুদিন কোর্টে যাবেন বলেছিলেন মনে আছে তো?’
‘না মনে থাকলেও, মনে তো করিয়েই দিলে।’
কথাটা বলেই প্রচ্ছদ সটান উঠে দাঁড়িয়ে বড় বড় পা ফেলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
চলবে❤️
#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৩৩
৬৯.
প্রযুক্ত সরে এলো। ফাঁকা জায়গা দেখে ফোন রিসিভ করতেই কেউ একজন ওইপাশ থেকে অনর্গল বলে গেলো,
‘কি ব্যাপার, মাস্টারমশাই? বিয়ে করলেন কাল, আর এর মাঝেই বউকে ভুলে বসে আছেন। একদিনেই যদি এই অবস্থা হয় তবে এক বছর গেলে তো আর আপনাকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না। আর আমি চিন্তা করছি জীবনের বাকি ষাট’টা বছর আপনার সাথে দোল-দুলানি করে পার করবো। হাইরে কপাল! মনে হচ্ছে, আরেকটা ভদ্র বর খুঁজতে হবে।’
এক নিদারুণ মাতাল আবেশে প্রযুক্ত চোখে মুখে অন্ধকার দেখছিলো। কানের মাঝে কে যেন বারবার সুরেলা সুরে ফিসফিস করে বলে যাচ্ছিলো, ‘মাস্টারমশাই!’ নিজেকে কেমন বয়স্ক বয়স্ক মনে হলো। প্রযুক্ত ঝকঝকে হেসে একটু গম্ভীর ভাব নিয়ে বলল,
‘কেনো এই বর ভালো লাগছে না? এই বর ভদ্র নয়? অভদ্র? বিয়ে করে বউ বানালাম যাতে সারাদিন আমার সাথেই লেপ্টে থাকে। তা দেখি, ওমা! লেপ্টানো তো দূর। বউ আমার, একটা ফোনও দেয় না। ভাবছি, আরেকটা ভালো বউ খুঁজতে হবে।’
‘খুন করে ফেলবো, মাস্টারমশাই।’
প্রযুক্ত শব্দ করে হাসে,
‘আমিও খুন করে ফেলবো। বর খুঁজা হচ্ছে? গলা কেটে বানের জলে ভাসিয়ে দেবো।’
‘আপনার নামে মার্ডার কেস করবো।’
‘মেরেই তো ফেলবো আপনাকে। মার্ডারের কেস কে করবে?’
‘উফফফ..মাস্টারমশাই তর্ক করবেন না তো। এতো তর্ক করতে পারেন আপনি!’
‘তাই না? আর নিজে?’
‘আমি তো ভালো।’
শ্রেয়সী হাসলো। তার মন’টা এখন অনেক ভালো। যতটা মনে হয়েছিলো বিষয়টা ঠিক হয়নি এখন ততটাই মনে হচ্ছে নাহ ভুল কিছুও হয়নি। বিয়ে’টা করা থাকলো নাহয়। পরে সবাইকে জানিয়ে, বাবা-মাকে নিয়ে আবার বিয়ে করা যাবে।
‘দেখা করুন না একটু।’
প্রযুক্ত অবাক হয়, ‘এখন?’
‘হুম। সমস্যা?’
‘নাহ, একমাত্র বউয়ের জন্য তো আমি অলওয়েজ সমস্যামুক্ত। আপনার কোনো সমস্যা হবে না তো?’
শ্রেয়সী হাসলো। অন্তরের গহীনে একটা মিষ্টি বাতাস সারা শরীর দুলিয়ে গেলো। বউ! সে এখন কারো বউ। প্রযুক্তর মুখে কি সুন্দর লাগে এই ডাকটা! ইশশ..ইচ্ছে করে ছুটে চলে যাই বরটার কাছে।
৭০.
প্রযুক্তকে এগিয়ে দিতে গিয়েছে প্রচ্ছদ। এখন প্রায় সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলো। মাগরিবের আযান পরেছে। টিয়া এতোক্ষণ নীড়ের কাধে মাথা রেখে গল্প করছিলো। টিয়ার নীড়কে ভালো লাগে। তাদের মতের মিল হয়। যা টিয়ার অন্যকারো সাথে মিলে না। ঝগড়া লেগে যায়। অন্যকারো মতো নীড় টিয়াকে বকা-ঝকা করে না। সবসময় হাসিখুশি ভাবে টিয়ার প্রতিটা কথায় মাথা নাড়িয়ে যায়। মাঝেমধ্যে টিয়া নীড়কে মিস করে। তখন ফোনে কথা বলে মনের সব কথা উগড়ে দিয়েই ক্ষান্ত থাকতে হয়। টিয়া চলে গেছে নিজের ঘরের দিকে মিনিট পাঁচেক হলো। নীড় একা একা কিছুক্ষণ বসে থেকে ছাদের দিকে পা বাড়ালো।
দুষ্টু ঘরের দিকে যাচ্ছিলো। সিড়িন হক ডেকে উঠলেন। তড়িঘড়ি করে বললেন,
‘সন্ধে নেমে এলো। জলদি গিয়ে ছাদ থেকে কাপড় গুলো তুলে আনো। বড় বউমা ওতো বারবার সিড়ি ওঠানামা করতে পারে না।’
দুষ্টু এক ছুটে গেল। প্রত্যেকের কাপড়চোপড় তুলে নিতেই দু’হাত বন্ধ হয়ে গেলো। ছাদের কর্ণারে যেতেই নজর পরলো নীড়ের দিকে। চোখাচোখি হলো। সারা শরীর কেমন ঝনঝনিয়ে উঠলো। দ্রুত পায়ে উল্টোদিকে ঘুরে এগিয়ে যেতেই দৈবাৎ নীড় ডেকে উঠলো। দুষ্টুর সারা শরীরে গরম রক্তের স্রোত বয়ে গেলো। পা দুটো স্থির হয়ে মেঝের সাথে আটকে গেলো।
নীড় এগিয়ে এলো। কাঁপছে তার পা দুটো। সংকোচ হচ্ছে। কুণ্ঠিত বোধ সারা বুকে চেপে ধরছে। কখনো ভাবা হয়নি ভালোবাসার মানুষ’টার সামনে দাঁড়াতেও এতোটা অস্বস্থি হবে। দুষ্টু ঘুরলো। শক্ত কণ্ঠে বলল,
‘বলো।’
নীড় সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
‘তুমি বলোনি কেনো তুমি আমার ভাইয়ের বউ?’
‘তুমি বলোনি কেনো আমার বর তোমার ভাই?’
নীড় অবাক হয়ে চাইলো। আমার বর! কতটা সহজে…কতটা অকপটে… কতটা অহংকার নিয়ে দুষ্টু বলে ফেলল। এই একটা বাক্যের কাছেই যেন তাদের ভালোবাসার রং ফিকে হয়ে গেলো, শক্তি কমে এলো, উজ্জ্বল প্রদীপের দাউদাউ অগ্নিশিখা গুলো আস্তে আস্তে নিভে যেতে লাগলো।
‘আমি তো জানতাম না তুমি আমাকে ঠকিয়ে আমার ভাইকেই বিয়ে করবে।’
‘আমি তোমাকে ঠকিয়েছি?’
দুষ্টু পলক ফেলতে পারলো না। নীড় বিদ্রুপ করে হাসলো, ‘ঠকাওনি?’
‘নাহ, ঠকাইনি।’
‘আমি কিন্তু তোমার বিয়ের আগের দিনই চট্টগ্রাম থেকে এসে পরেছিলাম, দুষ্টু। চাইলেই তুমি বিয়ে ভেঙে আমার সাথে পালিয়ে আসতে পারতে অথচ তুমি আমাকে কিছু জানাও-ই নি।’
‘কিন্তু আমি জানতাম না। তুমি কবে আসবে তা আমাকে বলোনি। তোমার সাথে আমি যোগাযোগ বন্ধ করেছিলাম যাতে তুমি সন্দেহ না করো। আমি বিয়েটা করতে চাইনি। জোর করে দেওয়া হয়েছে। পালিয়েও গিয়েছিলাম। স্টেশন থেকে ধরে নিয়ে এসেছে। এরপরও আমি তোমার কাছে গিয়েছিলাম, তোমার ভাইকে ডিভোর্স দেবো বলে।’
‘এখনো দেবে?’
দুষ্টু কথা বলল না। সন্ধে নামার ওই পশ্চিমাকাশের সূর্য ডোবার লাল-হলুদ আলোয় ওর মুখটা ভারি নমনীয়, কোমলপ্রাণ আর পবিত্র দেখালো। নীড়ের চিন্তাভাবনা, মনের সংযম, শপথ হঠাৎই যেন এলোমেলো হয়ে গেলো। সে দুষ্টুর হাত চেপে ধরে অস্থির কণ্ঠে বলল,
‘তুমি যখন ডিভোর্স নেবেই তখন তো আমার কাছে আসতে সমস্যা নেই। তুমি তো আমাকে ভালোবাসো। তোমাদের মধ্যে তো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও স্থাপন হয়নি।’
দুষ্টু হালকা হেসে শুধালো, ‘স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হলে মেনে নিতে না?’
নীড় মাথা ঝাকায়, ‘নিতাম। চলে এসো। কবে ডিভোর্স?’
দুষ্টু হাত ছাড়িয়ে নিলো। উল্টো পায়ে হালকা পিছিয়ে যেতে যেতে কঠিন সুরে বলল,
‘সম্ভব না, নীড়। যা ভাঙে, তা জোড়া লাগে না। তুমি বলছো, আমি তোমাকে ঠকিয়েছি। এই কথাটা আমার সারাজীবন শুনতে হবে। তুমি সারাজীবন খোটা দিয়ে যাবে আমার অন্য এক জায়গায় বিয়ে হয়েছিলো। পরে এটাও বলতে পারো আমাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও হয়েছিলো। মানুষের মন! গিরগিটির চেয়েও রং পাল্টায়।’
নীড় বিস্ময় নিয়ে তাকালো, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি, দুষ্টু। ‘
‘কিছু ভালোবাসার পূর্ণতা পেতে নেই। তারা পূর্ণতা পেলে প্রকৃতির ক্ষতি। প্রকৃতি মেনে নেয় না। তুমি আমার ভাগ্যে নেই। আমিও তোমার ভাগ্যে নেই। আমি চাই না তোমার কাছে যেতে, ঠিক তেমনি আমি চাই না তোমার ভাইকে ঠকাতে। তোমার ভাই খুব ভালো মানুষ। কি দরকার উনাকে ঠকানোর? আমার চেয়ে হাজার গুনে ভদ্র, লক্ষ্মী, সভ্য একটা মেয়ে উনি ডিজার্ভ করে। তাছাড়া, আমি তো উনাকে কখনো ভালোবাসতে পারবো না।’
নিবিড় আচ্ছন্নতা নিয়ে নীড় বলল, ‘আর আমি? আমাকে সারাজীবন ভালোবেসে যাবে তাই না?’
শেষের বাক্যটা উৎসাহ নিয়ে বলে সে। দুষ্টু হাসলো। কেমন যেনো মরা, করুণ, প্রাণহীন সেই হাসি। নীড়ের উচ্ছ্বাস দপ করে নিভে গেলো। দুষ্টু বলে গেলো,
‘হয়তো না। যা একবার মরে তা আর বর্তে না। তোমার ভাই একটা কথা বলেছিলো জানো?’
‘কি?’
‘মূল্যবান হও, অর্থহীন নয়।’
নীড় সতর্ক চোখে চাইলো, ‘তুমি বোধ হয় প্রচ্ছদকে ভালোবেসে ফেলছো।’
দুষ্টু হাসলো। জোরে জোরে। বলল,
‘বোকা! ভালোবাসা এতো সহজ হলে আমার মতো দুঃখী মানুষ থাকতো নাকি এই পৃথিবীতে?’
‘ডিভোর্স দেওয়ার পর কি করবে? তোমার বাবা তো অসুস্থ। মেনে নিতে পারবে তো? নাকি ওটাও মিথ্যে ছিলো?’
‘নাহ, মিথ্যে নয়। বাবাকে জানতেই দেবো না। আমি চলে যাবো আমার পথ ধরে। বিসিএস এর ভাইভা দেবো এরপর ইনশাআল্লাহ টিকে গেলে আর পেছন ফিরে তাকাবো না। অতীত ফেলে বর্তমান নিয়ে বাঁচবো। ভবিষ্যত’কেও ঠাই দেবো না। যেদিকে যায় জীবন, যাক। নিজের মতো চলুক। স্বাধীন হয়ে বাঁচুক। ডানা মেলে আকাশে উড়ুক। মুক্ত বিশাল দেহের বটগাছের মতো ডাল-পালা ছড়িয়ে দিক তোমাদের মতো পুরুষের দিকে।’
দুষ্টু চলে গেলো। বড় বড় পা ফেলে। মুচকি হাসি দিয়ে। অন্তরের বিষ ঝরিয়েও দুঃখ বয়ে নিয়ে। নীড় আকাশের দিকে তাকিয়ে শূন্যে হতাশমিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ছাড়তেই তা মিলিয়ে গেলো। দেখা পাওয়া গেলো না।
একজনের মনে জাগলো তেজ। নিজেকে একা বয়ে নিয়ে নতুন উদ্যমে বাঁচার তেজ। অন্যজনের মধ্যে জেদ। বঞ্চিত, পরাজয়, হেরে যাওয়ার জেদ। বিশাল সমুদ্র পরিমাণ ভালোবাসা বয়ে নিয়ে এসেও, এক মুঠো ভালোবাসা নিয়ে ফিরতে না পারার জেদ। দুটি মানুষ দু’রকমের সংকল্প নিয়ে অন্য এক মানুষে পরিণত হতে চলল। একজন চলল পরিপূর্ণ নারী হবার উদ্দেশ্যে অন্যজন চলল হেরে যাওয়ার আক্রোশে প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে।
এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না! মানুষ’টা তো এমন ছিলো না। নিমিষেই যেন পাল্টে গেলো। যেন…যেন খারাপ মানুষের খোলস ধরার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় নামলো।
চলবে❤️
#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৩৪.
৭১.
ছুটে এসে ঘরের দরজা ঝাপটে ধরে সামনের দিকে তাকাতেই দুষ্টু চমকে উঠলো। ভয়ার্ত, আতংকিত দৃষ্টিতে প্রচ্ছদের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলল। প্রচ্ছদ গম্ভীর মুখে তার মুখোমুখি দাঁড়ায়। কপাল কুচকে প্রশ্ন করে,
‘ছাদে গিয়েছিলে?’
দুষ্টু ভীত চোখে তাকিয়ে বারবার মাথা নাড়ে।
‘কেনো?’
প্রচ্ছদের প্রশ্নগুলো যেন কাটা হয়ে বিধলো গায়ে। দেখে ফেলেছে নাকি? কী ভয়ংকর পরিবেশ সাথে কী ভয়ংকর গলার স্বর! দুষ্টু মিনমিন করে বলল,
‘এমনি।’
‘একাই গিয়েছিলে?’
এই প্রশ্ন করা মাত্র দুষ্টু কেঁপে ঘাড় ফিরালো। প্রচ্ছদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলো তখনো। সে নিচু স্বরে জবাব দেয়,
‘কেনো একা ছাদে যাওয়া যাবে না? নিষেধ?’
প্রচ্ছদ হতাশ শ্বাস ফেলে ফিরে গিয়ে বিছানায় বসে। ঠান্ডা কণ্ঠে বলে,
‘নাহ। সন্ধ্যের সময় একা ছাদে গিয়েছো তার উপর এমন দৌড়ে আসলে তাই জিজ্ঞেস করলাম। ভয় পেয়েছিলে নাকি?’
দুষ্টু জবাব দিলো না। ঠোঁট কামড়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। প্রচ্ছদ বালিশে পিঠ ঠেকাতে ঠেকাতে ঠেস মেরে বলল,
‘ওহ! তোমাকে তো আবার এসব বলা যাবে না। বললেই তো বলবে, আমি তোমাকে নিয়ে বেশি মাতামাতি করছি আজ-কাল। লোক দেখাচ্ছি।’
দুষ্টু ভ্রু কুটি করে তাকায়,
‘এইখানে আপনি আমি ছাড়া অন্য কোনো লোক তো নেই। তাহলে এই কথা উঠছে কেনো?’
‘উঠছে কেনো মানে? তুমি নিজেই তো বলেছো আমি তোমাকে লোক দেখানো কেয়ার করি।’
দুষ্টু ভেংচি কেটে অজু করতে যায়। মাগরিবের নামাজ পড়ে শেষ করে ঘাড় ফিরিয়ে প্রচ্ছদকে জিজ্ঞেস করলো নরম গলায়,
‘নামাজ পড়বেন না?’
প্রচ্ছদ মিনিট দুয়েক মৌন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে জবাব দিলো,
‘তুমি আসার আগে পড়ে নিয়েছি।’
‘ওহ।’
জায়নামাজ ভাঁজ করে টেবিলের কর্ণারে রেখে দুষ্টু মাথা থেকে লাল উড়না’টা খুলে চুল আচড়ালো। প্রচ্ছদ আড়চোখে তাকিয়ে হঠাৎ বলল,
‘শুনুন।
দুষ্টু অবাক হয়ে চাইলো, ‘হু? বলুন।’
‘লাল উড়না পরবেন না।’
দুষ্টু চোখ ছোট করে, ‘কেনো?’
‘এমনি। আমি বলেছি তাই। অন্তত আমার সামনে পরবেন না।’
দুষ্টু ঠোঁট টিপে হাসে আর বলে, ‘কেনো লাল উড়না পরলে বুঝি আমায় বেশি সুন্দর দেখায়?’
প্রচ্ছদ মাথা নাড়ায়। বলে উঠলো দৈবাৎ,
‘নামাজ রত ওই পবিত্র সুন্দর সময়টায় এই পবিত্র, নির্মল, গৌরবর্ণ মুখটা থেকে যেনো এক ছটা আলোক রশ্নির জ্যোতিঃস্ফুরণ ঘটে। আমার চোখ ধাঁধিয়ে যায় সেই প্রকট আলোর ঝলকানিতে!’
দুষ্টু কিছুক্ষণ বিস্ময়তা নিয়ে তাকিয়ে রইলো। এরপর মুচকি হেসে চুল আচঁড়াতে আঁচড়াতে বলল,
‘ভাবছি চুলগুলো কেটে পিঠ সমান করবো।’
প্রচ্ছদ কঠিন চোখে তাকায়, ‘কেনো?’
‘সামলাতে পারি না। কষ্ট হয়। আগে আম্মুই সামলে দিতো।’
‘কোনো দরকার নেই। আমি সামলিয়ে দেবো। কাটবে না তবুও।’
দুষ্টু শব্দ করে হাসলো। ঘরের সামনে দিয়ে তখন নীড় নিচে যাচ্ছিলো। হাসির শব্দ শুনেই সেকেন্ড বিশেকের জন্য থমকে দাড়িয়েছিলো। এরপর চটপট পায়ে চলে গেলো। চিরুনি রেখে হাত খোপায় চুল পেঁচাতে পেঁচাতে প্রচ্ছদের সামনে দাঁড়িয়ে ভ্রু উঁচু করে দুষ্টু শুধালো,
‘সত্যি তো?’
প্রচ্ছদ চোখ ঘুরালো। এড়িয়ে যেতে বলল, ‘নীড়ের সাথে পরিচয় হয়েছে তোমার?’
দুষ্টু পুনরায় কেঁপে উঠলো। এদিক সেদিক অযথা ব্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করে প্রচ্ছদের প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে চাইলো। প্রচ্ছদ ঘুরে বসে হঠাৎ মনে পরেছে এমন ভঙ্গিতে বলল,
‘আচ্ছা, তুমিও তো ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়েছো?’
দুষ্টু দুরুদুরু বুকে মাথা নাড়ালো। প্রচ্ছদ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
‘তোমার আর ওর ডিপার্টমেন্ট তো সেম। ব্যাচও সেম। তোমরা আগে থেকে পরিচিত ছিলে না?’
দুষ্টু দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে। কি বলবে ভেবে পেলো না। প্রচ্ছদ ভ্রু কুচকে তাকালো। তৎক্ষণাৎ যেন দুষ্টুর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। আমতা আমতা করে সত্যি কথা বলল,
‘হুম চিনতাম। আমরা ভালো বন্ধু।’
প্রচ্ছদের ছোট্ট চোখ দুটো বিস্ফোরিত হয়ে গেলো। দুষ্টু আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে আবার বলে,
‘একটু ঝামেলা হয়েছে আমাদের মধ্যে তাই আরকি!’
প্রচ্ছদ জোরে শ্বাস ছেড়ে বলে,
‘ওহ, তাই বলো! বন্ধু, প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী এদের মধ্যে এমন টুকটাক ঝামেলা লেগেই থাকে। তাই বলে কথা না বলে থাকবে নাকি? মনোমালিন্য তো একটু-আধটু হবেই, বোকা।’
দুষ্টু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এক বিন্দু সমপরিমাণও নড়তে পারলো না। তটস্থ চোখে অনেকক্ষণ প্রচ্ছদের ওই প্রপঞ্চময় মুখ’টার দিকে তাকিয়ে থাকলো এক দৃষ্টিতে।
৭২.
রাত দশ’টা। হক বাড়িতে রাতের খাবারের পর্ব শেষ হয়েছে আরো বেশ কিছুক্ষণ আগে। এই সময়’টার সবাই না ঘুমালেও যে যার ঘরে চলে যায়। তবে আজ একটু ব্যতিক্রম দিন বৈ কিনা! তেমনি ব্যতিক্রম শব্দটা একদম পরিপূর্ণ সত্য প্রমাণিত করে সমস্ত নিয়ম লঙ্ঘন করে সিড়িন হক আর সবুজা হক এলেন টিয়ার ঘরে। টিয়া বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলো। কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলো না। এরপর টেনে টেনে বলল,
‘ওহ মাই গড, স্বপ্ন নাকি?’
সিড়িন হক হালকা করে চোখ বড় করলেন। টিয়া দমে গেলো। চিবুক’টা প্রায় বুকের সাথে মিশে গেলো। সবুজা হক বললেন,
‘এসব কি ধরণের কথা?’
‘থাক, বকা দিস না।’
সিড়িন হক এগিয়ে এলেন। টিয়ার পাশে বসে বললেন,
‘তোমাকে বসার ঘরে যেতে হবে একটু।’
টিয়া নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কেনো?’
সবুজা হক আবার ধমকালেন,
‘কেনো মানে? বলছি তাই। বাবা, জেঠু ডাকছে।’
সিড়িন হক বিরক্ত চোখে তাকালেন,
‘আহ! এতো ধমকিয়ে কথা বলিস কেনো, সবুজা? তোর ধৈর্য্য খুব কম।’
টিয়া নিচু মাথায় মুচকি হাসলো। কেউ আর কিছু বলার আগেই বলল, ‘আচ্ছা। চলো।’
দরজার কাছে যেতেই সিড়িন হক টিয়াকে ডেকে উঠলেন। সবুজা হকও দাঁড়ালেন।
‘সন্ধ্যের আগে তুমি নীড়ের কাধে মাথা রেখে বসেছিলে?’
টিয়া স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘হ্যাঁ ছিলাম তো, নীড় ভাইয়া মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। সবসময়ই তো দেয়। কেনো? কি হয়েছে?’
সবুজা হকের মুখ’টা আজ যেনো একটু বেশি উজ্জ্বল। তবুও তিনি গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করলেন,
‘তোর বাবা আর জেঠু যে তোদের পাশ দিয়েই কাজে বেরিয়ে গেছে দেখিসনি?’
‘হ্যাঁ, দেখলাম তো। জেঠু জিজ্ঞেস করলো, কিছু খাবো কিনা। বাবা কপালে চুমু দিয়ে গেলো। সবসময়ই তো এরকম’টা হয়। হঠাৎ এসব প্রশ্ন কেনো?’
‘নাহ, এমনি। তোদের দু’জনকে একসাথে দেখতে নাকি ভালো লাগে তোর জেঠু, বাবা বলছিলেন।’
টিয়া হাসলো। সিড়িন হকের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘দেখো তো বড়মা, ভাই-বোন কে একসাথে দেখলে তো ভালো লাগবেই! আর আমাদের মধ্যে স্ট্রং বন্ডিং না?’
সিড়িন হকের কপালে এতোক্ষণের কুঞ্চন রেখা দু’টো সরে গেলো। কাটা কাটা ধারালো চেহারা’টার উপর গম্ভীরতার, চিন্তার একটা কালো ছায়া ছিলো। টিয়ার কথা’টা শোনামাত্র নিমিষে তা উধাও হলো। নিশ্চিন্ত মনে বলল,
‘তাহলে তো ভালোই। কোনো সমস্যাই থাকলো না।’
——-
বসার ঘরে গিয়ে দেখা গেলো নীড়ের পাশে জায়গাটাই খালি পরে রয়েছে। টিয়া দ্বিধা-দ্বন্ধ হীন বসে পরলো। ইফতার হক এবং মারুফ হক নিজেদের মধ্যে চোখে চোখে কিছু বললেন। টিয়া নীড়ের দিকে তাকিয়ে বড় করে হাসি দিয়ে সামনে বরাবর সোফায় তাকিয়ে বলল,
‘বাবা, জেঠু ডাকছিলে?’
পরক্ষণেই দুষ্টু আর ইরার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আরে বড় ভাবী, নতুন ভাবী দাঁড়িয়ে আছো কেনো? চেয়ার টেনে বসো না!’
নীরা আগে থেকেই সাজিদের পাশে বসেছিলো। টিয়ার কথা শোনামাত্র মুখ বাঁকালো। ইফতার হক গলা পরিষ্কার করে বললেন,
‘তুই তো আমার সোনা মেয়ে।’
টিয়া গর্বের সহিত মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘অবশ্যই।’
ইফতার হক মাথা নাড়ায়, ‘নীড়ও আমাদের মানিক-রতন।’
‘হুম, কিন্তু আমার থেকেও নীড় ভাইয়াকে বেশি আদর করো তোমরা। আমি বুঝতে পারি। আমার হিংসে হয় তখন।’
টিয়া গাল ফুলিয়ে জবাব দিলো। নীড় টিয়ার মাথায় সজোড়ে গাট্টা মারলো। মারুফ হক হাসলেন। বললেন,
‘তো আমরা চাই, আমাদের অতি আদরের দু’জনকে একসাথে রাখতে। যাতে আদরের মাত্রা’টা বিশাল আকার ধারণ করে।’
টিয়া বিরক্ত চোখে তাকালো,
‘উফফ..বাবা। হেয়ালি কথা আমি বুঝি না। সহজ করে বলো।’
সিড়িন হক বললেন এবার গুমোট কণ্ঠে,
‘আমরা চাই তোমাদের চার হাত এক করে দিতে। তোমাদের বিয়ে দিতে চাই।’
পাশে দাঁড়ানো দুষ্টু শুধু অবাকই হলো না বরং তার ঠোঁট দুটোর মাঝে কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে গেলো। যা থেকে সে দূরে চলে যেতে চায়, তা যেনো আরও শক্ত-পোক্ত হয়ে ঘাড়ে চেপে বসছে। দুষ্টু সামলাবে কি করে এতো বড় বোঝা’টা? নিজের সংকল্প ভাঙতে…এই পরিবারের মানুষ’গুলোর মাঝে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে…প্রচ্ছদকে এতো বাজে পরিস্থিতিতে ফেলতে তো সে কখনোই পারবে না। সবথেকে বড় কথা প্রচ্ছদ পাগল হয়ে যাবে এ কথা শোনার পর। তার নিজের অতি প্রিয় ভাই’টার সাথেই তার স্ত্রীর….? ছি! ছি! কী দুর্দশী বিশ্রী ব্যাপার! দুষ্টুর ভাবনার মাঝেই প্রচ্ছদ ওর কানে কানে ফিসফিস করলো। তা এক ধরনের ফসফস ধ্বনি তুললো। সেই ধ্বনিতে যেন নিমিষেই সব ভাবনা উধাও হলো। চোখের কপাট বন্ধ হয়ে নিদারুণ এক কাঁপুনি সারা অঙ্গ জুড়ে বিচরণ করলো।
‘বলেছিলাম না, আমার প্রিয় মানুষের বিয়ে। দেখলে তো এবার? তুমি তো উল্টো’টা বুঝেছিলে।’
প্রচ্ছদ মৃদু হাসলো। দুষ্টু অপ্রস্তুত চোখে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসি দিলো।
সিড়িন হকের কথাটা কানে যাওয়া মাত্র নীড় উঠে দাড়ালো। মাথা নাড়িয়ে বিকট আওয়াজে যেই ‘না’ করতে যাবে ওমনি চোখ দুটো ভিড়লো গিয়ে দুষ্টু প্রচ্ছদের দিকে। চোখের পলকে যেন সব উলোটপালোট হয়ে গেলো। নীড় বসে পরলো। ইফতার হক অতি আদুরে স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
‘আপত্তি আছে, মানিক?’
নীড় ঘোরের মাঝেই মাথা নাড়িয়ে না করলো। অতঃপর ঝাপসা চোখ নিচু করে মেঝের দিকে তাক করলো। দৃষ্টি শক্ত করে বিরবির করলো,
‘কষ্ট দেবো তোমায়! আমার থেকে ঢের গুণ বেশি কষ্ট তুমি পাবেই। তোমার চোখের সামনে আমার বিয়ে হবে তোমারই ননদের সাথে। এর থেকেও কঠিন প্রতিশোধ হয় নাকি আবার?’
নীড় ক্রমাগত মাথা নাড়িয়ে নিজের প্রশ্নের জবাব নিজেই দেয়,
‘নাহ, হয় না। তাও ভালো, আমি সচক্ষে তোমার বিয়ে হতে দেখিনি। কিন্তু তুমি দেখবে। দেখতেই হবে! দ্বিগুণ জ্বালা ভোগ করো! দেখি কেমন পারো!’
টিয়ার মাথা ঘুরে উঠলো। চোখের সামনে যেন নিস্তব্ধ, ভরা শীতের গভীর রাতের কুয়াশার ন্যায় ঝাপসা দেখলো চারিপাশ। সারা শরীর অসার হয়ে এলো। মাথার ভেতর খেলে গেলো একটা নাম। প্রযুক্ত! প্রযুক্ত! প্রযুক্ত! কিন্তু কিছুতেই চেহারা ভাসে না। ও ভাসানোর চেষ্টাও করলো না। তার বুকে যন্ত্রণা হচ্ছে না, পুড়ছে না কিন্তু হালকা ব্যথা হচ্ছে। চিনচিনাত্মক ব্যাথা! এ কেমন কথা? তার রাগ হলো। প্রচন্ড রাগ।
আশ্চর্য তো! সবকিছু এতো সহজ নাকি? তার ভালোবাসা’টা হয়তো একটুখানি ভিন্ন কিন্তু বুকের মধ্যে পুষে রাখা সর্বদা ওই একটা পুরুষ মানুষের নাম তো আর কয়েকটা মিনিটের মাঝেই পাল্টে যেতে পারে না৷ কীভাবে পারে? পলকে সে দাঁড়িয়ে পরলো। সোফার গদি মৃদু নড়ে উঠলো। ড্রইংরুম কাঁপিয়ে সশব্দে বলে উঠলো,
‘অসম্ভব।’
চলবে❤️