এমন একদিন সেদিন পর্ব-৩৬+৩৭+৩৮+৩৯

0
2

#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৩৬
৭৪.
কোর্টের মেয়র খুব-ই হতাশ গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

‘আপনারা সত্যি চান না আর একসাথে থাকতে?’

তাদের দায়িত্ব মিলিয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করা। কিন্তু ক্রমাগত বোঝানোর পরও এ দম্পতি তাদের সিদ্ধান্তে অনড়।

মেয়র অর্জন, ইরার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,

‘সাক্ষীর কি মতামত? দেখুন, উনাদের দেখে তো মনে হয় না উনাদের মধ্যে কোনো ঝগড়া-ঝামেলা বা অশান্তি হয়। এখানে যখন ডিভোর্সি কেস আসে তখন তাদের একে অপরের মুখ দর্শন করতেও দেখা যায় না। পরস্পরের প্রতি এতোটা ঘেন্না প্রকাশ করে যে তা এই মূহুর্তে এক্সপ্লেইন করতে পারছি না আমি। কিন্তু এদের ক্ষেত্রে তো সম্পূর্ণ’টাই উল্টো। দে আর ভেরি গুড কাপল। সেদিন দেখলাম একজন আরেকজনের হাত ধরে গাড়িতে উঠালো।’

ইরা-অর্জন একে অপরের দিকে তাকালো। দুষ্টু শক্ত গলায় বলে,

‘নাহ, আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তালাকনামা কার্যকর করুন।’

‘ওয়েল। আমি তবে তালাকের জন্য কোর্টে আবেদন করবো।’

‘ধন্যবাদ।’

‘তবে আমি আরেকবার ভেবে দেখতে বলবো আপনাদের, কোর্টে আবেদন করার সাথে সাথে কিন্তু আপনাদের তালাক কার্যকর হবে।’

‘আসি তবে।’

‘হুম আসুন এবং আরেকটা কথা, আপনি গর্ভবতী কি না তার রিপোর্ট দেখাতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রিপোর্ট নিয়ে আসবেন। যে কেউ এলেই হবে। তারপরই আবেদন করা হবে।’

দুষ্টু চমকে প্রচ্ছদের দিকে তাকায়। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঝিমানি বয়ে যায়। ধমনিতে যেনো অজস্র সূচ ফুটলো। প্রচ্ছদ উঠে চলে গেলো। দুষ্টু ঘাড় ঘুরিয়ে চেয়ে দেখলো তা।

পার্কিং লটে এসে দাড়াতেই কে যেন হাত আঁকড়ে ধরলো ইরার। ঘাড় ঘুরিয়ে প্রযুক্তকে দেখে ইরা এক গাল হাসি দিলো। প্রযুক্তর গালে হাত রেখে সহাস্যে বলল,

‘কি রে তুই এখানে?’

প্রযুক্ত মাথা নাড়িয়ে নিচু স্বরে বলে, ‘হুম, আপু শোনো। তোমার সাথে আমার কথা আছে।’

‘কথা বলতে তুই এই কোর্ট পাড়ায় এসেছিস?’

‘নাহ। তোমাদের বাড়িতে এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম।’

‘ওহ আচ্ছা, বল।’

‘এখানে না। চলো।’

প্রযুক্ত ইরার হাত ধরে টানতেই অর্জন এসে সামনে দাড়াঁলো, ‘এই, তুই আমার বউকে কই নিয়ে যাস?’

‘যেখানেই যাই। তুমি সরো। আমার আপুর সাথে প্রাইভেট কথা আছে। তোমরা বাড়িতে যাও। আমি আপুকে নিয়ে রেসটুরেন্টে বসি। পরে বাড়ি দিয়ে আসবো।’

‘আমার বউকে আমি বাইরের জিনিস খাওয়াই না।’

প্রযুক্ত চিৎকার দিয়ে উঠলো, ‘এই আপু, তোমার জামাইকে যেতে বলবা নাকি?’

৭৫.
অতঃপর রাত্রি নিরব। নির্জন, নিস্তব্ধ অন্ধকার গহ্বর থেকে ভেসে আসছে বিষন্নতার ডাক। আনুমানিক সাড়ে এগারোটা বাজে। দুষ্টু তবুও বসেছিলো চুপচাপ। ঘর-দোর এলোমেলো। ছোটখাটো কাপড়ের স্তূপ গুলো গুছিয়ে আজ আলমারিতে রাখা হয়নি। জানালার কপাটগুলো এখনো বন্ধ করা হয়নি। বিছানা গুছানো হয়নি। প্রচ্ছদ এতো রাতে কোথা থেকে যেনো এলো। শুকনো মুখটার দিকে এক পলক তাকিয়ে ফ্রেশ হতে চললো।

মিনিট কতক পরেও যখন দেখা গেলো দুষ্টু ঠিক একইভাবে থম মেরে বসে আছে প্রচ্ছদ তখন সাদা তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে গুমট স্বরে বলল,

‘কি ব্যাপার ঘর-দোর এতো অগোছালো কেনো? বিছানা ঠিক করোনি কেনো? ঘুমাবো না?’

দুষ্টু কথা বলে না। প্রচ্ছদের গলা থেকে যেন এবার বিদ্রুপের একটা ঝটকা ছিটকে বেরুলো,

‘আর তো মাত্র কিছুদিন। এরপর আমাদের ডিভোর্স হবে। তারপর তুমি নতুন জীবন উন্মোচন করবে। নিজের সাজানো প্রচ্ছদ বিহীন পথে চলবে। আজ তো তোমার জন্য খুশির দিন। থম মেরে বসে আছো কেনো?’

শূন্যে সোজা তাক করা চোখ দুটোর ফাঁকে ফাঁকে খেলে গেলো উদাসীনতা। নিস্তেজ গলা, অন্যমনস্ক স্বর একদম অন্যরকম কণ্ঠে দুষ্টু হঠাৎ বলল,

‘কেনো জানি আজ বড্ড মা হতে ইচ্ছে করছে!’

প্রচ্ছদের হাত দুটো থমকে গেলো। তোয়ালে’টা ঝকঝকে সাদা মেঝের উপর পরে গেলো। চোখ দুটো বিস্ফোরিত। যেনো এমন আজব বাণী কখনো কোনো মুখ বলেনি…কখনো কোনো কান শোনেনি। দুষ্টু আরও বললো মন্ত্রবশের ন্যায়। প্রচ্ছদের পা দুটো মেঝের সাথে চুম্বকের ন্যায় আটকে রইল।

‘আপনি জানেন, বড় ভাবী আমার থেকে দু বছরের বড়। অথচ এর মধ্যে তার দু’বার মিসক্যারেজ হয়েছে। আরেকটা বাচ্চা তার পেটে। নীরা ভাবী আমার থেকে দু’মাসের ছোট। অথচ তার দুই বছরের একটা বাচ্চা আছে। আমার কোলে একটা বাচ্চা থাকলে সুন্দর দেখাতো না? বাচ্চাগুলো যখন মা মা বলে ডাকে তখন খুব আনন্দ হয়? নীরা ভাবীর পরাণ’টা বুঝি জুড়িয়ে যায়? বড়ভাবী অনুভব করে তার পেটে তার অংশ। পেটে হাত রাখলেই টের পাওয়া যাচ্ছে যার অস্তিত্ব। আমার না খু..ব মা হতে ইচ্ছে করছে! কি করবো বলুন না?’

প্রচ্ছদও যেনো দুষ্টুর মতো পাগল হয়ে গেলো এমন ধারায় দৈবাৎ উত্তর দিলো,

‘কিন্তু এখন গর্ভবতী হলে তো তুমি ডিভোর্স নিতে পারবে না, দুষ্টু।’

বলে প্রচ্ছদ নিজেই হতভম্ব হয়ে গেলো। এ কি বলল! কোনদিক বিবেচনা করে এ কথা বলল? দুষ্টুর পেটে তার বাচ্চা এ কথা কল্পনাতে আনা’টা যেমন দুষ্কর তেমনি একটা বাচ্চা হওয়ার পর পর-ই তার বাবা-মায়ের ডিভোর্স ব্যাপার’টি বাচ্চার গোটা জীবনকে তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

দুষ্টু আচ্ছন্ন ভরপুর কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘সব ইচ্ছে পুষতে নেই বুঝলেন?’

প্রচ্ছদ দুষ্টুর কাধ ধরে মৃদু ঝাঁকালো। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

‘হঠাৎ এসব বলছো কেনো?’

দুষ্টু চমকে উঠলো। উদ্ভ্রান্তের ন্যায় দু’পাশে বারংবার মাথা নাড়ালো। এরপর চকিতেই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে যেই দৌড়ে চলে যেতে ধরবে ওমনি প্রচ্ছদ ওর হাত’টা ঝাপটে ধরলো। দুষ্টুর আত্মা থমকে গেলো। হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি আওয়াজ’টা পর্যন্ত রুদ্ধ হয়ে এলো। সারা শরীরে একটা ঠান্ডা রক্ত স্রোতের শিহরণ বয়ে গেলো। কী আশ্চর্য এসব তো আগে কোনোদিন হয় নি। আজ-কাল প্রচ্ছদের স্পর্শ পেলেই কেনো দুষ্টু আটকে যায়? কেনো আটকে যায় ওই দুই চোখের পাতায়…স্বামী নামক শব্দটায়..বিয়ের বন্ধন’টায়? সারা দেহ জুড়ে টুনটুনির মিষ্টি আওয়াজের মতো সুন্দর কম্পন টের পায় ও। দুষ্টুর নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগে! মনে মনে বলে এ কোন মায়ার মন্ত্রজ্বালের দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছে সে? সে যে আবদ্ধ হয়ে যাবে। একবার আবদ্ধ হয়ে গেলে যে নিস্তার পাওয়া ভীষণ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে নিজ প্রবৃত্তির কাছে।

প্রচ্ছদ তার অন্তরিন্দ্রিয়ের একদম গহীন থেকে ঠেলে শব্দ গুলো বের করলো নিবিড়, শান্ত, গা শিরশিরে কণ্ঠে,

‘আপনি কেনো আমার থেকে আলাদা হতে চাইলেন? আমরা কি পারতাম না আমাদের বাচ্চার বাবা-মা হতে?’

দুষ্টু অবাক চোখে তাকালো। গলা থেকে ছিটকে ক্ষীণ আওয়াজে বেরুলো একটি শব্দ,

‘প্রচ্ছদ…..’

প্রচ্ছদ হাত ছেড়ে দিলো। দুষ্টু তখনও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে।

৭৬.
ইরা বসেছিলো বিছানার এক কোণায়। অর্জন পাশে বসে ওর মাথায় হাত রাখলো। নরম সুরে বলল,

‘কি হলো? ভাইয়ের সাথে গোপন বৈঠক করার পর থেকেই মনমরা হয়ে বসে আছো যে? কিছু বলেছে নাকি?’

বলতে বলতেই অর্জনের ভ্রু দুটো কুচকে উঠলো৷ ইরা দু’ হাটুর উপর মাথা গুঁজে বলল,

‘কিছু না। তুমি ঘুমাও।’

‘হ্যাঁ আর তুমি জেগে বসে থাকবে? কি হয়েছে ইরা? আমাদের মধ্যে তো কখনো কেউ কিছু লুকোয় না।’

ইরা মাথা তুলল। চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। অর্জনের বুকে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বলল,

‘প্রযুক্ত বিয়ে করেছে, জানো?’

অর্জনের দু ঠোঁটের মাঝে বিশাল বড় ফাঁক হয়ে গেলো।

‘ওরে.. একদম ছক্কা মেরে দিয়েছে। তোমার ভাই একটা চিজ.. বাংলাদেশে আর এক পিস খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।’

‘মজা করো না প্লিজ। ও এটা কীভাবে করতে পারে? লুকিয়ে বিয়ে করেছে ভাবতে পারছো তুমি? আমার ভাই হয়ে কীভাবে সম্ভব?’

অর্জন ইরার মাথায় হাত বুলায়,

‘শান্ত হও, ইরাবতী। দেখো, ও তো আর বাচ্চা নয়। কবে করেছে?’

ইরা নাক টেনে বলল,

‘পরশু। আমি ওকে একটা থাপ্পড় মেরেছি জানো? থাপ্পড় মারার পর আমার ভাই’টার চোখ টলটল করছিলো। করুণ সুরে বলছিলো, ‘আপু, আরো মারো কিন্তু রাগ করো না। আমি তোমাকে কিছু না বলে থাকতে পারি না তুমি তো জানো। আমার খুব খারাপ লাগছিলো এ কয়দিন।’

ইরা কেঁদে দিলো। কান্নার দমকে পিঠ কেঁপে উঠলো।

‘আমি ওকে মারলাম কেনো? আমি কবে ওর গায়ে হাত তুলেছি আমার মনে পরে না। আমার ভাইটা খুব ভালো। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।’

অর্জন ইরার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে নরম স্বরে বলে,

‘কাঁদে না ইরাবতী। কাদঁলে শরীর খারাপ করবে যে। এমনিতেই তোমার শরীর’টা আজ-কাল ভালো যায় না।’

ইরা আরো কেঁপে কেঁপে উঠলো। অর্জন ওর মুখ তুলে ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলল,

‘তুমি এক কাজ করো, কাল প্রযুক্তর সাথে দেখা করো। আর বলো ওর বউকে দেখাতে। আগে দেখো মেয়েটা কেমন? ওর কাছ থেকে আগে শুনো বিয়েটা কাউকে না জানিয়ে কেনো করলো।’

ইরা বলল, ‘বলছো?’

‘হুম, জিজ্ঞেস করো। আর এটাও শুনে নিও বাসর হয়েছে কিনা। যদি না হয় তাহলে আর করার দরকার নেই। সামনের মাসের মধ্যেই বড় করে বিয়ে দেওয়া যাবে।’

অর্জন চোখ টিপলো। ইরা ওর বাহুতে সজোরে কিল বসিয়ে দিয়ে বলল,

‘ছিহ! তুমি খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছো। খুব! আমি এসব জিজ্ঞেস করবো?’

‘শুনো, আরেকটা কথা।’

‘বলো।’

‘আমি তোমার সাথে থাকবো। মানে আড়ালে থাকবো আর কি! প্রযুক্ত যখন ওর বউ দেখাবে তখন ভূতের মতো সামনে এসে তোমার ভাইকে ভড়কে দিবো। দেখো শুধু তোমার ভাইয়ের কি অবস্থা করি। অস্ত্র পেয়েছি এবার! আমার সাথে বেশি উল্টাপাল্টা করলেই থ্রেট, ‘সবাইকে জানিয়ে দেবো কিন্তু তুই বিয়ে করছিস লুকিয়ে।’

ইরা জোরে জোরে হাসলো। ঘরের সামনে দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যাওয়া টিয়া থমকে দাঁড়ালো। কথাগুলো যেন কানের ভেতর প্রতিধ্বনি তুললো। মনে হচ্ছে কেউ গরম সীসা কানে ঢেলে দিলো। সে কিচ্ছু বুঝছে না, শুনছে না। অঙ্গ জুড়ে অস্বাভাবিক কাপুঁনি। কানের মাঝে পু পু এক ধরনের শব্দ। সে আর দাঁড়াতে পারলো না। দিগবিদিক না তাকিয়ে দৌড়ে চলল। যেনো ক্ষেপা, পাগলা, বুনো ঘোড়া সে।

চলবে❤️

#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৩৭
দিগবিদিক না তাকিয়ে পাগলা ষাড়ের মতো ছুটতে ছুটতে টিয়া আটকে পরলো কারোর নরম বাহুডোরে। আকস্মিক কেউ বুকের উপর এসে পড়ায় দুষ্টু বেশ খানিকটা পিছিয়ে গেলো। অবাকতার সাথে টিয়ার মুখের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো, চোখ ফেটে যেনো রক্ত পরবে ওর। সে হালকা হাতে টিয়াকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসালো। টিয়া হেচকি তুলে কাদঁতে কাঁদতে অস্পষ্ট স্বরে বলে গেলো,

‘নতুন ভাবি… নতুন ভাবি?’

দুষ্টু ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মৃদু আওয়াজে জিজ্ঞেস করে,

‘বলো। কি হয়েছে?’

‘প্রযুক্ত… প্রযুক্ত ভাইয়া বিয়ে করেছে, নতুন ভাবি।’

বলতে বলতেই শ্বাস রোধ হয়ে এলো তার। দুষ্টু বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করে,

‘কি বলছো?’

টিয়া উত্তর দেয় না। দুষ্টুর ভ্রু দুটো বেঁকে যায়। ফিচেল গলায় শুধায়, ‘লুকিয়ে?’

টিয়া মাথা নাড়ায়। দুষ্টু সতর্ক কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,

‘তাতে তুমি কেনো কাঁদছো, টিয়া?’

প্রশ্ন’টা কানে যাওয়া মাত্র টিয়ার কান্নার বেগ বাড়লো। অপরিস্ফুট স্বরে বলল,

‘আমি ভালোবাসি তাকে ভাবি। ভীষণ ভালোবাসি।’

দুষ্টুর হাতের বাধন আলগা হয়ে এলো। মাথাটা সটান সোজা হয়ে স্থির তাকিয়ে রইল টিয়ার মুখের দিক। খানিক বাদে একটা জোরালো চিৎকার গলা থেকে ছিটকে বেরুলো,

‘কি বলছো এসব, টিয়া? তুমি বুঝতে পারছো কি বলছো?’

দুষ্টু টিয়াকে ধাক্কিয়ে আবারো বলে,

‘টিয়া? প্রযুক্ত ভাইয়া তোমার বড়ভাবীর ভাই। তোমার ভাইয়ার বন্ধু। তাছাড়া তোমার চেয়ে কত বড় তিনি!তুমি কীভাবে উনাকে ভালোবাসতে পারো?’

টিয়া মাথা উঁচু করে নরম গলায় প্রশ্ন করে,

‘বয়সে একটু বেশি বড় হলে, ভাবীর ভাই হলে, ভাইয়ের বন্ধু হলে কি তাকে ভালোবাসতে নেই, নতুন ভাবী?’

দুষ্টু থমকালো। সত্যি তো! ভালোবাসা কি ওতো মেপে ঝুঁকে হয়? দুষ্টু টিয়ার মাথায় হাত রাখলো। কোমল স্বরে বলল,

‘এরজন্যই নীড়কে বিয়ে করতে চাইছো না? দেখো টিয়া, এটা একতরফা ভালোবাসা! প্রযুক্ত ভাইয়া তো তোমায় ভালোবাসে না। তারচেয়েও বড় কথা সে এখন বিবাহিত। তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে মন থেকে মুছতে পারবে ততই ভালো। বাড়িতে কাউকে এ বিষয়ে বলো না। ব্যপার’টা খুব বাজে পর্যায়ে চলে যাবে। বিয়েটা করে নাও। আর যদি একান্ত তুমি বিয়ে’টা করতে নাই পারো তবে জোর করো না নিজেকে। মনের উপর জোর করা যায় না।’

শেষের কথাগুলো বলার সময় দুষ্টুর গলা অন্যরকম শোনা গেলো। টিয়া দুষ্টুকে জড়িয়ে ধরে ভাঙা স্বরে করুণ গলায় বলল,

‘না বাসুক! আমি তো তাকে ভালোবাসি। আমি তো মানতে পারছি না।’

‘কেনো মানতে পারছো না? আচ্ছা বলো তো, যেই ছেলেটা তোমার দিকে কখনো ফিরেও তাকায়নি। অন্যকাউকে বিয়ে করেছে। যাকে এতোটা দিন একতরফা ভালোবাসলে তার জন্য কেনো তুমি চোখের জল ফেলবে? কেনো তুমিও অন্যকাউকে বিয়ে করতে পারবে না? তোমার নীড় ভাইয়াও তো করছে, দেখতে পারছো না?’

শেষের কথা’টা বলে দুষ্টু নিজেই আঁতকে উঠল। আড়চোখে টিয়ার দিকে তাকাতেই দেখা গেলো সে মনোযোগ দিয়ে শুনছে কিন্তু শেষের কথাটা তেমন আমলে নেয়নি। দুষ্টু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। টিয়া ভাবনার ঘোরে বলল,

‘আমার সাথে আজ থাকো না, নতুন ভাবী?’

দুষ্টু দরজা গলিয়ে একবার বাইরে দৃষ্টি রাখলো। অতঃপর ভীষণ হতাশ গলায় বলল, ‘আচ্ছা।’

৭৭.
অর্জন কাল রাতে যেমন বলেছিলো দৃশ্যপট গুলো ঠিক তেমনভাবেই সাজানো হলো। প্রযুক্তর মাথা নিচু। ভীতি গলায় বলল,

‘ওর সাথে দেখা করে কি করবে আপু? বকবে?’

ইরা চোখ পাকিঁয়ে তাকায়,

‘সেটা তোমাকে বলতে হবে? মেয়ের নাম কি?’

‘শ্রেয়সী।’

নিচুস্বরে জবাব দেওয়া মাত্র ইরা ধমকে উঠে,

‘মেয়েদের মতো মিনমিন করছো কেনো? বিয়ে করে কি বোধশক্তি সব লোপ পেলো?’

প্রযুক্ত নিচু করে বাচ্চাদের মতো মাথা নাড়িয়ে বলে,

‘না। চলো।’
____________________

পরিষ্কার টলটলে পানি। মিষ্টি রোদের সাথে সুমধুর বাতাস। পার্কের পুকুর মুখী সাদা বেঞ্চেতে বসে থাকার মিনিট কতক পরেই কে যেনো প্রযুক্তর চোখ দুটো দু’হাত দিয়ে ঢেকে নিলো। প্রযুক্ত ছাড়াতেই শ্রেয়সী পেছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরলো। সে অপ্রস্তুত অবস্থায় কেশে উঠলো। আড়চোখে ইরার দিকে তাকাতেই দেখা গেলো, ইরা অপ্রতিভ চোখে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। প্রযুক্ত ফিসফিস করে বলল,

‘শ্রেয়সী, আমার আপু। আপনার সাথে দেখা করতে নিয়ে এসেছি।’

শ্রেয়সী চোখ বড় বড় করে তড়িঘড়ি করে মাথায় ঘোমটা টেনে প্রযুক্ত থেকে দু’হাত দূরে সরে দাড়ালো। এরপর ইরার সামনে হাটু ভাঁজ করে বসে সালাম দিলো। ইরা ব্যস্ত স্বরে বলল,

‘তুমি এভাবে বসলে কেনো? এই প্রযুক্ত, উঠ। ওকে বসতে দে।’

শ্রেয়সী মাথা নাড়িয়ে হেসে বলে,

‘নাহ, আপু। ঠিকাছি। আপনি কেমন আছেন? শরীর কেমন? আপনি তো বাস্তবে দেখতে আরো সুন্দর! মাশাল্লাহ্!’

ইরা হাসলো। শ্রেয়সীর মাথায় হাত বুলিয়ে থুতনি টিপে বলল,

‘তুমি তো খুব মিষ্টি। আমি আরো ভাবলাম আমার মাথামোটা ভাইটা কাকে না কাকে বিয়ে করলো।’

শ্রেয়সী নত মুখে প্রযুক্তর দিকে তাকায়। তখনই গাছের আড়াল থেকে ঝপাং করে অর্জন এসে সামনে দাড়ালো। প্রযুক্ত ভড়কে গিয়ে ইরার দিকে আতংকিত চোখে তাকালো। অর্জন প্রযুক্তর কোলে বসে পরলে প্রযুক্ত চট করে দাঁড়িয়ে পরে। অল্পতে পরতে পরতে বেঁচে যায় অর্জন।

‘আমার কোলে এসে বসছো কেনো? কলিজায় উঠো না! সেখানে তোমার জন্য বিনামূল্যে সিট রেখেছি।’

অর্জন বেঞ্চে বসে ভাব নিয়ে বলে,

‘শোন, এখন থেকে আমাকে সম্মান দিয়ে গলা নামিয়ে কথা বলবি। লুকায় বিয়ে করোস। চুপিচুপি ছক্কা মারোস। আবার দুলাভাই এর সাথে উঁচু গলায় কথা বলোস? বেত্তমিজ শালা কোথাকার!’

প্রযুক্ত বিরবির করলো। ইরা উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল,

‘আমি আম্মুর সাথে কথা বলবো। যাতে তাড়াতাড়ি তোদের বিয়েটা দেওয়া যায়। চলো।’

অর্জন মুখ ভার করে বলে,

‘আরেকটু বসি না? তোমার ভাইয়ের বউয়ের সাথে তো আমার কথাই হলো না। এই শ্রেয়সী, বসো আমার পাশে।’

প্রযুক্ত তড়িঘড়ি করে শ্রেয়সীর হাত চেপে ধরে,

‘নাহ, আমার বউ তোমার পাশে বসবে কেনো?’

বলতেই প্রযুক্ত একবার ইরার দিকে তাকালো। অপরাধবোধ থেকে ইতস্তত করে মাথা নিচু করে বলল,

‘আচ্ছা থাক, কিন্তু বসা লাগবে না দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলো না!’

অর্জন শব্দ করে হাসে। উঠে দাঁড়িয়ে ইরার দু’কাধে হাত রেখে জড়িয়ে ধরে বলে,

‘আমার বউয়ের পাশে আর কোনোদিন বসে দেখিস কি করি তোকে।’

‘আপু….।’

ইরা শ্রেয়সীর দিকে এগিয়ে গেলো। শ্রেয়সী মিষ্টি করে হাসলো। ব্যাগ থেকে দুটো চিকন স্বর্ণের চুড়ি বের করে শ্রেয়সীর হাতে পড়াতে পড়াতে ইরা বলল,

‘ভাইয়ের বউয়ের প্রথমবার মুখ দেখার জন্য বানিয়ে রেখেছিলাম।’

শ্রেয়সী ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে,

‘কিন্তু আপু আমার এসব লাগবে না। এখনি কেনো দিচ্ছেন? বাসায় নিতে পারবো না তো।’

ইরা হালকা হেসে শ্রেয়সীর গালে হাত রাখলো।

‘বাসায় ঢুকার আগে খুলে ফেলবে। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আবার পড়বে। ভালো থেকো।’

ইরারা চলে যেতেই প্রযুক্ত এক হাত দিয়ে শ্রেয়সীকে জড়িয়ে ধরলো। শ্রেয়সী আস্তে করে প্রযুক্তর বুকে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল,

‘এতো ভালো কেনো আপনারা?’
‘কারণ আপনি অনেক ভালো।’
‘তাই?’
‘হুম।’
‘ভালোবাসেন আমাকে?’
‘অবশ্যই।’
‘কতটা?’
‘যতটা ভালোবাসলে, জীবনের বাকি ষাট বছর আপনাকে আরো ষাট বার বিয়ে করা যায়!’

প্রযুক্ত বলল ফিসফিস করে। মুগ্ধতার এক ঝাঁক ছটা শ্রেয়সীর চোখে মুখে এসে লাগলো। নয়নের কপাট দুটো বন্ধ হয়ে এলো আবেশে। মিশে গেলো প্রযুক্তর বুকের সাথে আরো খানিকটা।

৭৮.
দুপুর গড়িয়েছে। শেষ দুপুরের হালকা তেজি রশ্মি গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে খেলছে! হেলছে! দুলছে! কাঁচের থাই ভেদ করে একটা মিষ্টি নরম স্বর্ণ বর্ণের রোদ্দুর মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলো। ঘরের দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। উল্টো হয়ে শুয়ে থাকা দুষ্টু উঠে বসলো। টিয়া মলিন মুখে ভেতরে ঢুকলো। আস্তে করে বিছানার কোণায় বসতেই দুষ্টু মৃদু হেসে বলল,

‘সূর্য কোনদিকে উঠলো?’

টিয়া কথা বলে না। দুষ্টু নিঃশব্দে ওর হাত ধরলো। স্নেহময় স্বরে বলল, ‘কিছু বলবে?’

টিয়া মলিন মুখেই হাসে। দুষ্টুর হাতের উপর আরেকটা হাত রেখে বলে,

‘তুমি ঠিকই বলেছো। যে মানুষ’টা কখনো আমাকে বুঝতেই পারেনি। এতোভাবে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করেছি অথচ কখনো ফিরে তাকায়নি। খুব সহজে অন্যকাউকে বিয়ে করে ফেলেছে তার জন্য কষ্ট পাওয়া নিছকই অহেতুক।’

দুষ্টু কেমন করে জানি গোপনে হাসলো। টিয়া হঠাৎ বলে উঠলো,

‘জানো, বড় ভাবীর একটা ছায়া তোমার মধ্যে বিদ্যমান এবং তা দৃশ্যমান। তুমি যেও না। থাকো না আমাদের বাড়িতে? আমাদের বাড়ির মানুষগুলো গম্ভীর হলেও না ভীষণ ভালো! শুধু নীরা ভাবী ছাড়া।’

কথাগুলো বলেই টিয়া চলে গেলো। দুষ্টু ভাবনার অতল সাগরে নিমজ্জিত হয়ে পরলো। চিন্তার, মায়ার, স্নেহের কয়েকটা ভাঁজ পরলো কপাল জুড়ে। সাথে এও ভাবলো, টিয়া আসলে প্রযুক্তকে ভালোবাসেনি কিংবা হয়তো.. কিছু মূহুর্তের জন্য অজান্তে কখনো ভেসে ফেলেছিলো যা সে নিজে ধরতেও পারেনি। কিন্তু ভালোবাসলে এতো অকপটে.. এতোটা সহজে মনকে বুঝ মানানো যেতো না। বাহ্যিক সুন্দরের কবলে পরে নিছক কিছুক্ষণের ভালো লাগায় আটকে গিয়েছিলো। ওটা এমন ভালোবাসা… যে ভালোবাসা চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল হয়ে যায়। ভেবে কষ্ট হলো যে, নীড় ছেলেটা হয়তো জীবনে কখনো সুখের দেখা পাবে না। দুঃখ ওর চিরসঙ্গী হয়েই রয়ে গেলো!

দুষ্টুর চোখের কিনার ঘেঁষে বিন্দু বিন্দু পানির ভিড় জমলো। তখনি দরজা খুলে প্রচ্ছদের প্রবেশ। দুষ্টুর দিকে কিয়ৎক্ষণ এক ধ্যানে তাকিয়ে থেকে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। কাল রাতের ওই সময়টার পর থেকে প্রচ্ছদের সাথে দুষ্টুর দেখা হয়নি। রাতে টিয়ার ঘরে কাটানোর পর সকালে ঘরে এসে দেখে প্রচ্ছদ নেই। সারাদিন পর এই এলো।

দুষ্টু নিচে খাবার আনতে গেলো। খাবার নিয়ে ঘরে আসতেই দেখা গেলো প্রচ্ছদ বিছানায় শুয়ে আছে শুকনো মুখে। সে খাবার রেখে হালকা গলায় ডেকে বলল,

‘সকালে না খেয়ে চলে গিয়েছেন কেনো?’
‘তুমি কাল রাতে টিয়ার ঘরে ছিলে কেনো?’
‘তো?’
‘তো অনেক কিছু।’
‘আপনি জানতেন?’
‘জানার কথা না?’
‘কই খোঁজ করেননি তো। জানলেন কীভাবে?’
‘ম্যাজিক করে। তোমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে খোঁজ করবো নাকি?’

দুষ্টু জোরে শ্বাস ফেলল,

‘খেয়ে নিন। চোখ মুখ শুকনো লাগছে। সারাদিন তো মনে হয় না পেটে কিছু পরেছে।’

প্রচ্ছদ দুষ্টুকে খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করে খেতে বসলো। দুষ্টু জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়ায়। প্রচ্ছদ খেতে খেতে বলে,

‘ডক্টরের কাছে কবে যাবে?’
‘ওমা! ডক্টরের কাছে যাবো কেনো?’
‘রিপোর্ট নিতে হবে না?’

দুষ্টু নিশ্চুপ হয়ে গেলো। উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকালো। এক ঝাঁক কাক কা’কা করতে করতে উড়ে চলে গেলো বামদিকে। ওর আত্মা ধক করে উঠে। প্রচ্ছদ বলে,

‘সারাদিন এতো উদাস উদাস ভাব নিয়ে থাকো কেনো? নতুন প্রেমে পরেছো নাকি আবার?’

দুষ্টু বাঁকা চোখে তাকায়। খানিকক্ষণ মৌন থেকে উত্তর দেয়,

‘প্রেমে পরা কি এতো সহজ? ভালোবাসতে চাইলেই কি ভালোবাসা যায়? ভালোবাসা দাবী করা মানেই কিন্তু ভালোবাসা নয়। ভালোবাসা মানে কি কেউ জানে না অথচ মানুষ ভালোলাগাকে বারংবার ভালোবাসা বলে চালিয়ে দেয়।’

প্রচ্ছদ চোখ কপালে তুলে বলল,

‘জিজ্ঞেস করলাম কি আর উত্তর দিচ্ছো কি? আমি কি তোমার কাছে ভালোবাসার ডেফিনিশন চেয়েছি?’

‘না, এমনি বললাম আর কি!’

দুষ্টু যেনো একটা আচ্ছন্নের চারিপাশে দেয়াল তোলা ছোট ঘরের মাঝে আটকে ছিলো। মাথায় টিয়ার ব্যাপারটাই কিলবিল করছে।

প্রচ্ছদ খেতে খেতে ত্যাছড়া গলায় বলল,

‘হুম, বলবেই তো। তোমরাই তো বলবে। অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ তোমরা। আমরা ওত প্রেম ট্রেম করিওনি। কাউকে এতো ভালোবাসিওনি তাই এতো ভালোবাসার ব্যাখ্যা ট্যাখ্যাও জানি না।’

দুষ্টু কড়া গলায় বলে উঠলো,

‘প্রেম প্রেম করছেন কেনো বারবার? কিছু প্রেম জীবনে একবার আসে। সেক্ষেত্রে ভালোবাসা আরো কয়েকবার মনে জাগ্রত হতেই পারে! যেমন, আমি একজনকে ভালোবেসেছিলাম। প্রেম করেছি। এবার আমি আপনাকেও যেকোনো সময় ভালোবাসতে পারি। কিন্তু তার সাথে যেভাবে প্রেম করেছি সেভাবে কি আপনার সাথে সম্ভব? যত্তসব!’

প্রচ্ছদের গলায় খাবার আটকে গেলো। দুষ্টু গ্লাসে পানি ঢেলে দিয়ে শব্দ করে জগ’টা টেবিলে রেখে হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। প্রচ্ছদ পানি খেয়ে গলা উচিঁয়ে বলল,

‘তোমাকে আগে মাথার ডাক্তার দেখাতে হবে, দুষ্টু।’

চলবে❤️

#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৩৮
৭৯.
পৌষ মাসের আজ দু’দিন। ঊষালগ্নে সূর্যোদয়ের লালাভ রাঙা সময়টা থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ছন্দপ্রকরণ। শেষ সকালের হালকা বৃষ্টিতে ভেজা, কাপুঁনি ঠান্ডার মাঝে নীড় চলল দু’তলার দিকে। দরজা খুলল নুসরাত। নীড়’কে দেখেই কেমনতর অবাক হয়ে গেলো। হালকা হেসে নীড় বলল,

‘আন্টিকে ডেকে দাও।’

দরজা থেকে সরে দাঁড়ায় নুসরাত,

‘ডাকছি। ভেতরে আসুন।’

‘নাহ, ভেতরে যাব না। তুমি জলদি আন্টিকে কিংবা আংকেল কে ডেকে দাও।’

এক পলক অপ্রতিভ চোখে নীড়কে দেখে ভেতরের ঘরে গেলো সে। নীড় এক মূহুর্ত চেয়ে দেখলো ওই দুলে দুলে হেটে যাওয়ার শব্দ। মেয়েটা খুব চুপচাপ হয়ে গেছে আজ-কাল। খানিকবাদে নুসরাতের বাবা এলেন। চশমা’টা চোখে দিয়ে ভীষণ লজ্জার সাথে নত মুখে বললেন,

‘বাবা, এই মাসের ভাড়া’টা এক সপ্তাহ বাদে দেই? আমি নিজে গিয়েই দিয়ে আসবো।’

নীড় ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,

‘আপনি এসব কি বলছেন আংকেল? আমি কি কখনো ভাড়া চাইতে আপনার কাছে এসেছি? আপনার যখন সুবিধা হবে তখনি দিবেন। দরকার পড়লে দিবেন-ই না। আমি তো আপনার ছেলের মতোই।’

ভদ্রলোক করুন চোখে এই সুন্দর, লম্বা গড়নের, বাচ্চাদের মতো পবিত্র মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এই ছেলে যে খুব কষ্ট করে চলে তা দেখে না বুঝা গেলেও কাছে গেলে খানিকটা টের পাওয়া যায়৷ ভাড়ার টাকা দিয়ে তার অর্ধেক মাস চলে। তবুও কি সহজ ভাবে বলল ভাড়া দিবেন না। এতোটা বড় মনের মানুষ হয়? ভদ্রলোক স্নেহের সুরে বললেন,

‘বলো বাবা, কোনো দরকার?’

নীড় মাথা নাড়ায়, ‘জি আংকেল।’

ভেতর থেকে নুসরাতের মায়ের গলা শোনা গেলো। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন,

‘নীড়? তুমি এসেছো? আমি তো অবাক হয়ে গেলাম। ভেতরে এসো বাবা। সকালের নাস্তাও তো বোধ হয় করা হয়নি। কি খাবে বলো? রুটি আর আলু ভাজি করেছি। দেই?’

‘না আন্টি আমি কিছু খাবো না। আমি আসলে এই কার্ড’টা দিতে এসেছিলাম।’

কালোর উপর সোনালি বর্ণের জরির কারুকাজ করা মোটা কার্ড’টা এগিয়ে দিলো সে। নুসরাতের বাবা সহাস্যে কার্ড’টা হাতে নিলেন। নুসরাতের মা বললেন,

‘ওমা! কার্ড’টা কি সুন্দর! তোমার বিয়ে বুঝি?’

নীড় মাথা ঝাঁকালো,

‘আগামী শুক্রবার। আপনাদের অবশ্যই আসা চাই।’

‘নিশ্চয়ই বাবা।’

‘আসি তবে আন্টি। ভালো থাকবেন আংকেল। আসসালামু আলাইকুম।’

নীড় পা ফেলল। সিড়ির কোটায় গিয়ে একবার পেছন ফিরে তাকালো। নুসরাতের মা মিষ্টি করে হাসলেন। নীড় জোরপূর্বক হেসে সিড়ি ভাঙলো। নুসরাতের চোখ দুটো ঝাপসা। কাজল রাঙা চোখ’দুটোয় ফোঁটা ফোঁটা জল। নীড় স্পষ্ট দেখতে পেলো ওই চোখে তার জন্য কেমন অসহায়ত্বের ঘৃণা। এই ঘৃণা মানে আপনি বিয়ে করছেন? সব জেনেও আপনি আমার সামনে কার্ড’টা দিতে পারলেন? ভালো না বাসুন সৌজন্যবোধ না থাকুক করুণা করে হলেও আমার সামনে আপনার বিয়ের কথা’টা না বললেই হতো না?

নীড়ের বুক চিরে কয়েকটা এলোমেলো দীর্ঘশ্বাস পড়লো। তার কাজল রাঙা চোখ পছন্দ। ওর সাথে দেখা হলে দুটো মানুষের চোখ সবসময় কাজল রাঙা থাকতো। একজনকে সে ভালোবাসতো, আরেকজন তাকে ভালোবাসে। নুসরাত যখন দরজা খুলল তার চোখ ছিলো সাদা। কিন্তু যখন ভেতরে ডাকতে গেলো তার বাবা-মা’কে ফিরে আসার পর তখন তার চোখে কালো প্রলেপ দেখা গেলো। নীড় মনোযোগ দিয়ে দেখেছে! তীক্ষ্ণ চোখে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে! দেখতে দেখতেই ভেবেছে মানুষ কেনো মানুষকে এতোটা ভালোবাসে?যে ভালোবাসা অতিরিক্ত তাতেই বড়ো কষ্ট। তাতে অপূর্ণতার সম্ভাবনা। অতিরিক্ত মানে-ই যে বিশাল সমুদ্র পরিমাণ হাহাকার, পাহাড় সমান দীর্ঘশ্বাস, সারাজীবনের নির্ঘুমতায় নিজেকে দেওয়া এক মিথ্যে গভীর আশ্বাস! কেনো এরকম হয়!

আজ খুব প্রগাঢ় ভাবে নীড় অনুধাবণ করতে পারলো,

“যেকোনো কঠিন সত্য সম্পর্কে তৃতীয় ব্যক্তি কষ্ট পায়। সেইসাথে যার একজন দাবিদার থাকে তার আনাচে কানাচে আরো বহু দাবিদার থাকে। আর যার একজন দাবিদারও থাকে না তার দাবি কক্ষনো কেউ করে না। তাকে নিয়ে হল্লা হয় না। তাকে নিয়ে কেউ কষ্ট পেয়ে চোখের পানি ফেলে না। এ যেনো প্রকৃতির একপাক্ষিক একধরনের ভয়ানক ঘৃণ্য নিয়ম!”

৮০.

ঘিয়া রঙের একটা সুয়েটার পরে দু’হাত দিয়ে দু’বাহু ধরে কাঁপতে কাঁপতে কনকনে শীতের ঝাপসা পথ অতিক্রম করে শ্রেয়া যাচ্ছিলো প্রাইভেটের উদ্দেশ্যে। ধীর পায়ে। তার পেছনে আজও গাড়ি’টা আসছে। শীতের ভয়ানক কাঁপুনিতে শ্রেয়ার গাড়ির মালিক’টাকে আর কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না। বেহায়াদের কোনো কিছু বলেই কিছু বুঝানো যায় না। সে একবার ঘুরে দাঁড়িয়ে ভ্রু ভাঁজ করে খুব বিরক্তিকর দৃষ্টিতে গাড়ি’টার দিকে তাকালো।

ভেতরে বসা সাজিদ বেরিয়ে এলো। শ্রেয়ার সামনে মাথা নিচু করে বলল,

‘তুমি চাইলে গাড়িতে উঠতে পারো। এই শীতে জুবুথুবু হয়ে যাচ্ছো, তোমার প্রাইভেটের স্যারের বাসা তো আরো খানিকটা দূরে…’

মুখের কথা মুখে রয়ে গেলো শ্রেয়া অগ্নি লাল চোখে তাকালো। এরপর গমগমে গলায় বলল,

‘আপনি যদি আমার থেকে তিন চার বছরের বড় হতেন ট্রাস্ট মি তবুও আপনার গালে আজ আমার হাত পরতো। আনফরচুনেটলি, আপনি আমার দাদার বয়সী। যার কারনে এতো বড় মুরুব্বির গালে হাত তুলতে পারলাম না। জীবনে আর কত পাপ কামাবো বলুন? ধরুন, আমি থাপ্পড়’টা মারার সাথে সাথেই যদি সার্কেল মার্কে ঘুরতে ঘুরতে এই রাস্তায় ডাস করে পরে যান তখন তো পাবলিক এসে আমাকে ধরবে। আমি কেনো মুরুব্বির গায়ে হাত তুললাম, বেয়াদব মেয়ে, ফ্যামিলি থেকে সভ্যতা শেখায়নি ব্লা ব্লা ব্লা…। আর তাছাড়াও আমি চাই না আমার জন্য একজন মুরুব্বি ব্যাথা পেয়ে আমার নামে বদদোয়া করুক। এমনিতেই আমার জীবনে দোয়ার অভাব। সাথে আরো বদদোয়া এড হলে…খোদা!’

শ্রেয়া হাত তুলে বড় করে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে পা বাড়ালো। সাজিদ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। মাথা’টা ক্রমশ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। সাজিদের বয়স এতো বেশি যে সে এই মেয়ের দাদার বয়সী? ওহ মাই গড! এই মেয়ের কাছ থেকে আর কত অপমানিত হবার বাকি আছে তার? এত্তো বড় সাহস মেয়েটার?

সাজিদ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। শ্রেয়া একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে ভেংচি কাটলো। উল্টোদিকে ফিরে মুচকি হেসে হেলেদুলে, হালকা-পাতলা শরীর’টা নিয়ে ক্যাঙ্গারুর মতোন লাফিয়ে চলল। এতোক্ষণের শীতে কাঁপুনি ভাবটা কমে এসেছে। শরীর ক্রমেই গরম পানির মতো টগবগ করে ফুটছিলো। তবে ভালোও লাগছিলো, বুড়ো লোক তার পেছনে আঠার মতো ঘুরছে ভেবে শ্রেয়া ফিক করে হেসে দিলো। হাসতে হাসতেই একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো, সব ঝাপসা!

৮১.
সারাদিন ব্যস্ততার পর দুষ্টু রাত এগারোটার দিকে ঘরে এলো। চোখে-মুখে পানি দিয়ে এসে এলোমেলো শরীরে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বসতেই প্রচ্ছদ আড়চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,

‘রাতের খাবার সেই কখন খাওয়া শেষ তুমি এতোক্ষণে এলে যে?’

সে দূর্বল গলায় উত্তর দেয়,

‘হাতের কাজগুলো শেষ করে এলাম। খাবার-দাবার ফ্রিজে রেখে প্লেট-বাটি ধুয়ে তারপর ফুরসৎ পেলাম। আর বড় ভাবী অসুস্থ না? মাঝেমাঝেই পেটে ব্যথা করছে আজ-কাল। আল্লাহ না করুক, এবার যেনো কোনো অঘটন না ঘটে।’

প্রচ্ছদ ফাজলামো গলায় বলল,

‘বাব্বাহ! দুষ্টু! তুমি তো সংসারী হয়ে গেছো। মায়া কাটাতে পারবে?’

দুষ্টু তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। এরপর আবার বিছানায় হেলান দেয়। তার চোখ মুখের আড়ালে ক্লান্তির স্পষ্ট ছাপ দেখে প্রচ্ছদ মাথা নিচু করে ল্যাপটপে চোখ রাখলো। এরপর নরম গলায় বলল,

‘এতো কাজ একা হাতে না করে নীরাকে একটু হেল্প করতে বলতে পারো না?’

দুষ্টু তাচ্ছিল্য গলায় বলল,

‘নীরা ভাবি আমার কাজ করে দেবে? ও পারলে আমার কাজ বাড়িয়ে দেয়। আমার কাজে প্রচুর খুঁত ধরে। আমি নাকি কিচ্ছু করতে পারি না। এতো বয়স হলো এতোদিনে বিয়ে করলাম তাও সংসার টিকছে না। রান্না-বান্না পারি না। শুধু পড়াশোনায় ভালো হলেই হয় না সবদিকেই থাকতে হয়। আমি নাকি গুড ফর নাথিং। সেই মূহুর্তে আমার প্রচুর কান্না পায়।’

বলতে বলতেই দুষ্টুর চোখের কোণায় পানি জমলো।প্রচ্ছদ বিরবির করলো,

‘বসে বসে লেজ নাড়ানো শুধু। কালকেই আম্মুকে বলছি। এতোদিন বড় ভাবীর সাথে ঝামেলা করতো এখন আবার আমার বউয়ের সাথে। ওর একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে।’

‘আচ্ছা, আপনি নীরা ভাবীকে কখনো ভাবী ডাকেন না কেনো?’

‘ওকে ভাবী ডাকবো কেনো? ও আমার চেয়ে কত ছোট জানো? আর তবুও ডাকতাম! কিন্তু ওর যে বিহেভিয়ার! ঘেন্না লাগে আমার!’

‘এভাবে বলা উচিত নয়। তার শুনলে খারাপ লাগবে।’

‘লাগুক। ও সারাদিন মানুষকে কষ্ট দিয়ে বেড়াবে তো ওর পেতে হবে না? আমার বউয়ের সাথে…’

প্রচ্ছদ আটকে গেলো। চোরা চোখে একবার দুষ্টুর দিকে তাকিয়ে মুখ লুকানোর মতো ল্যাপটপে চোখ গুজলো।

বাব্বাহ! বউকে তো দিন দিন চোখে হারাচ্ছেন দেখি।’

প্রচ্ছদ ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। দুষ্টু আমতা আমতা করে বলে,

‘না মানে… এতোদিন কিছু বলেননি, যেই শুনলেন আমাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলছে ওমনি চটে গেলেন।’

দুষ্টু ঠোঁট টিপে হাসলো। প্রচ্ছদ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

‘চটবো না? চটার কথা না?’

‘একদম না।’

প্রচ্ছদ তাকালো একবার। এরপর বলল, ‘আচ্ছা।’

‘হুম। আর শুনুন, আন্টিকে কিচ্ছু বলবেন না। আমি আছি না? আমার সাথে নীরা ভাবী পারবে নাকি? ও ডাইনি হলে আমি শাকচুন্নি।’

প্রচ্ছদ ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে বলল,

‘খুব একটা ভুল কথা কিন্তু বলোনি। মুখ ফসকে সত্যি কথা গুলোই বের হয়।’

দুষ্টু চোখ রাঙানি দিয়ে তাকালো। কিছু মনে পরেছে এমন ভঙ্গিতে বলল,

‘সন্ধ্যায় বারান্দা থেকে কাপড় গুলো এনেছেন?’

প্রচ্ছদ চোখ কপালে তুলে বলে,

‘আমি এসব কবে করি? আর আমি সন্ধ্যাবেলায় বাড়িতে ছিলাম নাকি? ন’টায় এলাম।’

দুষ্টু দৌড়ে গেলো বারান্দার দিকে। যেতে যেতে ধমকালো,

‘একটা কাজ আমাকে ছাড়া হবে না। যখনি আসুন কাপড়গুলো তুললে কি হাতে ফোসকা পড়তো? ইশশ…শিশির পরে বোধহয় আবার ভিজে গেলো। কি করবো আমি! আমার আর ভালো লাগে না এতো কাজ করতে! মানুষ কেনো বিয়ে করে? সুখে থাকতে ভূতে কিলালেই মানুষ বিয়ে করে। আর জীবনেও বিয়ে করবো না আমি।’

প্রথম দিকে ঠোঁট কামড়ে দুষ্টুর কথা গুলো শুনে মজা পেলেও শেষের কথাটা শুনে প্রচ্ছদ চমকে উঠল। সত্যি বিয়ে করবে না আর? সত্যি…? প্রচ্ছদ ভেবে পায় না, যেহেতু বিয়ে করবেই না তবে কেনো প্রচ্ছদকে ছেড়ে যেতে চাওয়া? প্রচ্ছদের কি উচিত এই মেয়েটাকে ধরে বেধে নিজের করে রেখে দেওয়া? প্রচ্ছদ ভাবলো কতক্ষণ! অতঃপর বারান্দার দিকে পা বাড়ালো। যত যাই হোক, দুষ্টু মেয়ের তার সংসারের সংসারী হয়ে উঠার গল্পগুলো সচক্ষে দেখার মাঝে অন্যরকম সন্তুষ্টি বিরাজ করছে! প্রচ্ছদ মন্ত্রমুগ্ধের মতো মাঝে মাঝে দুষ্টুর ওই হঠাৎ গড়ে উঠা গিন্নির ন্যায় চেহারার দিকে চেয়ে থাকে একচিত্তে।

‘প্রকৃতির আলোড়ন দেখবে?’

বিরক্তর সাথে বিরবির করে কাপড় তুলতে ব্যস্ত থাকা দুষ্টু চমকে ঘাড় ঘুরালো। কৌতুহল নিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘আলোড়নে কি কি থাকছে?’

‘বৃক্ষের আন্দোলন। পাতাদের সংঘর্ষ। মেঘ-বৃষ্টির যুদ্ধ। ক্ষণপ্রভার অংশীদারিত্ব।’

দুষ্টু মিষ্টি করে হেসে বললো,

‘কিন্তু এখন শীতকাল, বোকা।’

প্রচ্ছদ হাসে। হেসেই দুষ্টুর চোখের উপর নিজের ডান হাত’টা রাখে। দুষ্টুর সারা গা কেঁপে উঠলো। এক কদম পিছিয়ে পরলো। প্রচ্ছদ বলল,

‘নড়ো না! অনুভব করো, যতক্ষণ না কালো পর্দায় বর্ষাকাল আবিষ্কার করো!’

দুষ্টু স্থির হয়ে দাড়ালো। মিনিট দুয়েক পর কালো পর্দায় আবছা আবছা ভাসলো বৃক্ষের আন্দোলন। পাতাদের সংঘর্ষ। মেঘ-বৃষ্টির যুদ্ধ। ক্ষণপ্রভার অংশীদারিত্ব। সেই সাথে সে দেখতে পেলো দৈবাৎ দুজন মানব-মানবী। প্রকৃতির ওই সুন্দর রূপে তাদের গড়ন’টা ছিলো ঠিক দুষ্টু-প্রচ্ছদের মতো। সে পিলে চমকে উঠলো। এক ঝটকায় প্রচ্ছদের হাত সরিয়ে দিয়ে দু’কদম পিছিয়ে পড়লো। অতঃপর মাথা নেড়ে বারংবার বিরবির করতে করতে দৌড়ে চলে গেলো ভেতরে।

‘সম্ভব না.. কক্ষনো সম্ভব না। এতোটা আশা রাখবেন না আমার প্রতি। রাখবেন না….! একটুখানি দয়া করুন আমায়।’

চলবে

#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৩৯
৮২.
শেষ সকালের মৃদু সমীরের ঝাপটা! মধ্যাহ্নের মিষ্টি আদর রোদের আবর্তন, সমবর্তন। প্রচ্ছদ সেই সময়’টায় গায়ে শার্ট জড়াতে জড়াতে বলল,

‘দুষ্টু, রেডি হও।’

দুষ্টু ফিরে তাকালো। ভ্রু কুচকালো। বিরবির করে বলল,

‘এমন ভাবে অর্ডার করলো যেন আমার আদর্শ স্বামী এসেছেন গো!’

‘কি বিরবির করছো? সারাদিন কল্পনার জগতেই থাকো?’ প্রচ্ছদ ধমকে উঠে।

দুষ্টু তেঁজের ছাটে নিজেও ধমকে উঠলো,

‘রেডি হবো কেনো? এই ঠান্ডায় আমি কোথাও যেতে টেতে পারবো না।’

‘কি আশ্চর্য! ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না? রিপোর্ট নিতে হবে। উকিলকে দেখাতে হবে। চলো, উঠো উঠো।’

দুষ্টু উঠলো না। বসে থাকলো সটান। প্রচ্ছদ আবার বলল,

‘কি ব্যাপার উঠছো না কেনো?’

বেশ কিছুক্ষণ পর দুষ্টু উত্তর দিলো, ‘আমি যাবো না।’

নিরব নিস্তব্ধ ঘরটাতে কথাটা যেন ছিটকে দেয়ালে দেয়ালে বারি খেলো। প্রচ্ছদের বুঝে আসলো না। কপাল কুচকে জিজ্ঞেস করলো,

‘কি? আবার বলো?’

দুষ্টু থেমে থেমে বলে,

‘টিয়ার বিয়ে’টা মিটুক। তারপর যাই। এখন ঝামেলা না করাই ভালো।’

প্রচ্ছদ ভ্রু কুটি করে দুষ্টুর মুখের কাছাকাছি এসে সন্দেহের সুরে বলল,

‘সত্যি?’

দুষ্টু নিঃশব্দে উঠে গেলো। যাওয়ার আগে এক পলক তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,

‘মিথ্যে বলবো কেনো? আপনার কি খুব সমস্যা? জলদি আমাকে তাড়াতে হবে? আমি চলে যাওয়ার পর পর তো আবার বিয়ে করতে হবে। তারজন্যই তো এতো তড়িঘড়ি। আর আমি কি আপনার কাছে থাকার জন্য মরে যাচ্ছি? ডিভোর্স কিন্তু আমি চেয়েছি। আপনি চাননি। বিয়ে করে আমি আসিনি। আপনি আমাকে নিয়ে.. এসেছেন। আবার তাড়িয়ে দেওয়ার জন্যও উঠে পড়ে লেগেছেন? পুরুষ মানুষ’রা এমনি হয়! চরিত্রের ঠিক নেই।’

শেষের কথাগুলো বলার সময় দুষ্টুর গলা দিয়ে আগুনের ফুলকি বেরুচ্ছিলো। প্রচ্ছদ তাজ্জব বনে গিয়ে কথাগুলো হজম করলো। এরপর দুষ্টু হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই হালকা আওয়াজে বলল,

‘বললাম কি আর উত্তর দিলো কি? এই মেয়ে মানুষের জাতের হয়েছে টা কি!’

৮৩.
অপরিস্ফুট রূর্যকরণের অনুরাগে উদাস শীতল পবনে জাড়িত মন। আকাশের আঁচল তখন গাঢ় নীল। নীড় ঘরে তালা দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলো তড়িঘড়ি করে। ব্যস্ত পা ফেলতেই পেছন থেকে ভেসে এলো করুণ সুমধুর ডাকের ঝংকার,

‘শুনুন।’

নীড় অস্থির দৃষ্টিতে পেছন ফিরে তাকালো, ‘বলো।’

নুসরাত হাত বাড়িয়ে টাকাটা এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘ভাড়া।’

নীড় ভ্রু কুচকালো। অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল,

‘কাল তো আংকেল বলল টাকা দিতে দেরি…

নুসরাত মাঝ পথে থামিয়ে দিলো,

‘হুম বলেছিলো কিন্তু আমি টাকা ম্যানেজ করেছি।’

নীড় আবার সামনের দিকে পা বাড়ায়। গমগমে আওয়াজে বলে,

‘রেখে দাও। পরে দিও।’

‘নাহ, আপনি নিন।’

হাটা থামিয়ে পেছন ফিরে নীড় শক্ত চোখে তাকালো। নুসরাত সেই দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে কঠিন গলায় বলল,

‘আর আমরা বাসা ছেড়ে দিচ্ছি।’

নীড় অবাক হয়ে গেলো। বিস্ময় ভরা চোখে চেয়ে বলল,

‘ছেড়ে দিচ্ছো মানে?’

নুসরাতের প্রাণহীন গলা, ‘হুম।’

নীড় অপ্রতিভ গলায় বলে, ‘কোথায় থাকবে?’

‘বাবা-মা বাড়িতে চলে যাবে। ক্লাসের ডেট পরলে আমি হলে উঠবো।’

নীড় শান্ত চোখে তাকালো। একবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো নুসরাতের প্রাণহীন, নিবিড়, শুকনো মুখটার দিকে। মেয়েটা যেন হঠাৎ করেই বড় হয়ে গেলো। ধারালো, কাঠিন্যতা, দায়িত্ববোধের একটা পরল পরেছে। সে ধীর কণ্ঠে বলল,

‘আর তোমার ভাই?’

নুসরাত হাসলো। শুকনো মড়মড়ে ঠোঁট দুটো জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে বলল, ‘

‘মেসে রেখে দেবো ভাবছি। দু’একটা টিউশনি করিয়ে ওর খরচ টা নিজেই চালানোর চেষ্টা করবো।’

‘অনেক বড় হয়ে গেছো দেখছি।’ নীড়ের গলায় ঝাঁঝ।

‘বড় তো হতেই হতো। আর কত ছোট থেকে পাগলামি করবো জীবনে?’

নুসরাতের গলায় বিদ্রুপ। নীড় দৃঢ় গলায় বলল,

‘শুনো, তোমরা এই বাড়িতেই থাকো। আমি জানি, তুমি কেনো এসব করছো? যাই হোক, তোমরা এই বাড়িতেই নির্বিকার ভাবে থাকতে পারো। আমি অন্য কোথাও চলে যাবো।’

‘কোথায় যাবেন?’ নুসরাতের গলার স্বর এলোমেলো হলো।

‘ফ্ল্যাটে থাকবো।’

‘ওহ, যৌতুক নিয়ে বিয়ে করছেন বুঝি?’ নুসরাত হাসলো।

নীড় আড়চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আমার মামাতো বোন। আর ফ্ল্যাট’টা আমার মায়ের।’

‘তো এতোদিন যে এই ভাঙাচোরা বাড়িতে থাকলেন?’

‘বাবা-মায়ের স্মৃতি ছিলো বলে।’

‘আর এখন? স্মৃতি হারিয়ে গেলো?’

‘নাহ, টিয়া এখানে থাকতে পারবে না। আমি তো সারাদিন এখানেই পরে থাকবো। কোথায় আর যাবো এ বাড়ি ছেড়ে?’

‘ওহ, আপনার হবু বউয়ের নাম বুঝি টিয়া?’

মিষ্টি হেসে কথাটা বলতেই নুসরাতের গলা কেঁপে উঠলো। নীড় মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেলো। নুসরাত স্তম্ভিত দাঁড়িয়ে দেখলো তার বড় বড় পা ফেলে পকেটে হাত গুঁজে চলে যাওয়া। নীড়’টা খুব বুঝমান। কার মন কখন কি বলে সে বুঝে! সে আরও বুঝে, তাকে আর তার বউকে একসাথে নুসরাত কখনোই সহ্য করতে পারবে না। তবে নীড় কেনো আর ইচ্ছে করে মেয়েটাকে কষ্ট দিবে? নাহয় কারোর একটু স্বস্তির জন্য একটুখানি ত্যাগ করলো। তাতে তো বিশেষ ক্ষতি নেই!

৮৪.
যেকোনো পরিবেশ, পরিস্থিতি, প্রকৃতির একটা নিজস্ব আমেজ, গন্ধ, আমোদ থাকে। হক বাড়িতে এখন চলছে আমোদিত সময়। বিয়ে উপলক্ষে হৈ-হল্লা, হাসিঠাট্টা, গল্প-গুজবে মেতে উঠেছে। হাতে হাতে এগুচ্ছে কাজ। এক একজনের দৌলতে পরছে একেক দায়িত্ব। সেই সুবাদে প্রযুক্ত আজ হক বাড়ির চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্জন, সাজিদ, প্রচ্ছদের সাথে বিয়ের প্যান্ডেল, লাইটিং, ফুল, খাবারের মেন্যু এসব নিয়ে আলোচনা করতেই ইরার ঘর থেকে ডাক পরলো। উপরের বা’দিকের ঘরে যেতেই ইরা বলল,

‘মেয়েটাকে বিয়েতে নিয়ে আসিস।’

প্রযুক্ত চোখ কপালে তুলল,

‘নিয়ে আসবো মানে? বিয়েতে বাবা-মা থাকবে। ওকে নিয়ে এনে কোথায় রাখবো? ও কার সাথে থাকবে একা একা? কাউকে চেনে নাকি?’

‘তুই নিয়ে আসিস। আমি ম্যানেজ করে নেবো। আমি ওকে ফোন করে দাওয়াত দিয়েছি। ও বলেছে, তুই বললে আসবে।’

‘আপু, ও কিন্তু ভীষণ বাঁচাল, চতুর সাথে চঞ্চল। এই শরীরে ওকে তুমি একদম সামলাতে পারবে না। খামোখা এসব ঝামেলার কোনো মানেই হয় না।’

ইরা ধমকে উঠলো,

‘তোর মতামত শুনতে চেয়েছি? আমার মতামত’টা জানিয়ে দিলাম। সন্ধ্যায় যাতে মেয়েটাকে আমি এই বাড়িতে দেখি।’

প্রযুক্ত চুপচাপ ঘাড় নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে আসতেই মুখোমুখি হলো টিয়ার। প্রযুক্তর মুখ’টা চোখের পেলব পর্দায় ধারণ করার সাথে সাথে টিয়ার চোখ দুটো টলমল করে উঠলো। আড়ালে চোখের কোণা মুছে জোরপূর্বক হেসে বলল,

‘কেমন আছেন স্যার?’

প্রযুক্ত অবাক হলো। বাড়িতে টিয়া কখনো স্যার বলে ডাকে না। সে নিচু স্বরে জবাব দিলো,

‘ভালো। তুমি?’

‘আপনিই বলুন আমার কেমন থাকার কথা?’

টিয়ার কথাগুলো অন্যরকম। কি যেনো একটা রয়েছে যাতে প্রযুক্তর মনে হচ্ছে সে অনেক বড় একজন অপরাধী। টিয়ার সাথে ভয়ংকর কিছু ঘটিয়ে ফেলেছে। তার গলার স্বর’টা এতো ঠান্ডা যে গা শিরশির করে উঠছে। প্রযুক্ত অবাক কণ্ঠেই শুধালো,

‘কি আশ্চর্য! আমি কিভাবে জানবো?’

‘ওমা! ক’দিন পর আমার বিয়ে। সো, বিয়ে উপলক্ষে নিজের ভেতরে এক্সাইটমেন্ট’টা কেমন কাজ করে তা তো আপনি ভালো জানবেন।’

প্রযুক্ত চমকে তাকালো। টিয়ার কথা বলার ধরণে বিদ্রুপাত্মক ভাব। সে বলল,

‘ভয় পাবেন না, স্যার। আমি কাউকে কিছু বলবো না। আফটার অল আপনার ছাত্রী বলে কথা!’

প্রযুক্ত বোকা বনে গেলো। কি আজব ব্যাপার! এই মেয়ে এভাবে কেনো কথা বলছে? আর প্রযুক্তর-ই বা বুক’টা এতো কাঁপছে কেনো? সে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। গম্ভীর মুখে বলল,

‘বিয়ে হচ্ছে বলেই ভেবো না তোমাকে আমি আর শাসন করতে পারবো না। আমি তোমার স্যার। এসব কি কথা হচ্ছে?’

‘কিন্তু বাড়িতে তো ভাইয়া।’

‘একমুহূর্তে তুমি আমাকে স্যার বলেই সম্বোধন করছো।’

টিয়া হাসলো। নির্বিকার গলায় বলল, ‘ম্যাডাম কে নিয়ে বিয়েতে আসবেন।’

প্রযুক্ত পিলে চমকে উঠে। আত্মা কেঁপে উঠলো। ভ্রু কুচকে বলল,

‘ম্যাডাম মানে?’

‘বুঝতে পারছেন না? আসলে ভাবী বলে ডাকতে পারছি না তো তাই বোধ হয় বুঝতে পারছেন না। আরে, আপনার বউ। তাকে নিয়ে বিয়ে দেখতে, খেতে চলে আসবেন।’

প্রযুক্ত বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। টিয়া মাথা’টা একটু এগিয়ে ফিসফিস করে বলল,

‘আমি সব জানি। ভয় নেই কাউকে কিছু বলবো না। তবে বিয়েতে নিয়ে আসবেন। দেখতে হবে না আমার স্যার কেমন বিয়ে করলো? আমার ম্যাডাম’টা দেখতে কেমন?’

টিয়া মিষ্টি করে হাসলো। প্রযুক্ত তখনও তাজ্জব বনে তাকিয়ে আছে। টিয়া পা বাড়ালো। কদম ফেলেও আবার ফিরে এলো। প্রযুক্তর স্থিরচিত্রের, আশ্চর্য সুন্দর, অবাকতায় ঘেরা চোখদুটোর উপর নিজের বিষন্ন, উদাস দৃষ্টি স্থাপন করে হঠাৎ বলল,

‘আপনার বউ’কে আমি কখনো ভাবী সম্বোধন করতে পারবো না যার কারনে আপনাকে আর কখনো ভাইয়া বলেও ডাকতে পারছি না। আপসোস!’

টিয়া চোখ বন্ধ করলো। ঠোঁটের ফাঁকে হাসি ঝুলিয়ে বলল,

‘আসি? নিয়ে আসবেন কিন্তু ম্যাডামকে। না নিয়ে আসলে খুব খারাপ হবে। আমি ডিরেক্ট আপনার বাবা-মাকে বলে দেবো। আর আপনি তো জানেন, আমি আপনার বিচ্ছু ছাত্রী!’

দাঁত বের করে হেসে বিনা যুদ্ধে জেতার মতো থ্রেট দিয়ে টিয়া চোখের আড়াল হলো। আড়াল হতেই নির্লজ্জ, বেহায়া চোখ দুটো থেকে টপ করে অজান্তেই পানি পড়লো বুকের উপর।

দূর থেকে সবটা অবলোকন করে বুক চিরে বেরিয়ে এলো বড় দীর্ঘশ্বাস। দুষ্টু দুয়ার ছেড়ে হতাশ মুখে নিজের ঘরের ভেতর ঢুকে গেলো। ভাবলো,

‘মানুষ বড়ই বিচিত্র প্রাণী! বিচিত্র তাদের মন! বিচিত্র তাদের স্বভাব! সবশেষে বিচিত্র তাদের জীবনধারার গতিপথের স্বাদ!’

চলবে