এমন একদিন সেদিন পর্ব-৪৮+৪৯+৫০

0
2

#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৪৮
১০১.
রাত তিন’টে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। টিনের চালে বৃষ্টির টুপুরটাপুর শব্দ! কাঠের জানালায় বৃষ্টির ছাট বারি খাচ্ছে। এই ভর বৃষ্টিতে মধ্যরাতে একটি লজ্জার অঘটন ঘটে গিয়েছে! দুষ্টুর হিশু পেয়েছে। এদিকে কলপাড় বাইরে। ঘরের সাথে এডজাস্ট বাথরুম নেই। দুষ্টু জানালা হালকা ফাঁক করে বাইরে তাকালো। ঘুটঘুটে অন্ধকার! পেট চেপে দশ মিনিট অপেক্ষা করলো সে।

বৃষ্টির গতি একটু কমলো। দুষ্টু ওর পাশেই প্রচ্ছদের দিকে তাকায়! তখনের পরে প্রচ্ছদ আর ওর সাথে কথা বলেনি। দুষ্টু প্রচ্ছদকে ডাকলো বার কয়েক। এরপর হালকা হাতে গুতা দিলো৷ প্রচ্ছদ একটু নড়েচড়ে উঠে। দুষ্টু মৃদু স্বরে ডাকলো,

‘একটু উঠুন না!’

প্রচ্ছদ উঠে বসে ঘুম ঘুম চোখে তাকালো। চোখ কচলালো। এরপর গম্ভীর মুখে দুষ্টুর দিকে প্রশ্নবোধক চোখ দুটো নিবদ্ধ করলো। মুখে কথা বললো না। দুষ্টু অসহায় গলায় ঠোঁট উল্টে বললো,

‘আমি ওয়াশরুমে যাবো।’

প্রচ্ছদ এক ভ্রু উঁচু করে তাকায়। যার অর্থ ‘তো? তাতে সে কি করতে পারে? কোলে করে নিয়ে যাবে?’ দুষ্টু আরো খানিকটা ঠোঁট উল্টে জানালা খুলে বাইরে দেখিয়ে বললো,

‘দেখুন কত অন্ধকার! আমার সাথে চলুন।’

প্রচ্ছদ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে যেই আবার শুতে যাবে দুষ্টু প্রচ্ছদের মাথার পেছনে হাত দিয়ে আটকে দিয়ে বললো,

‘আমি এতো খারাপ। উঠুন না প্লিজ!’

প্রচ্ছদ অতি ঠান্ডা গলায় বলে,

‘ছে, সরি ফার্স্ট!’

দুষ্টু চোখ ছোট ছোট করে চাইলো, ‘রিভেঞ্জ?’

‘ইয়াহ!’

‘খারাপ লোক! বলবো না।’

প্রচ্ছদ এবার সটান শুয়ে এক টানে কম্বল মুড়ি দিয়ে শিরা মস্তক ঢেকে আরাম করে নাক ডাকলো। দুষ্টু রাগে নাক ফুলিয়ে বললো,

‘ফাইন! সরি।’

প্রচ্ছদ কম্বলের নিচে থেকেই বলে, ‘ওয়ান মোর টাইম!’

দুষ্টু কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো। কিন্তু লাভ হলো না এই মুহূর্তে এই বেয়াদব লোকের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। পেট ফেটে যাচ্ছে।

‘সরি।’

‘ছে ইট এগেইন।’

দুষ্টু চিল্লিয়ে উঠলো এবার, ‘আর কয়বার বলবো, ফালতু লোক? উঠবেন নাকি?’

প্রচ্ছদের বিস্তর হাসি পেলো। উঠে বসে ফোনের টর্চ জ্বালালো। কারেন্ট নেই। ঘরের এককোণের দোয়াত মৃদু আলো ছড়াচ্ছে। সেই আলোতে প্রচ্ছদের ঘুম ভাঙা হাস্যোজ্জ্বল মুখটা ভারি সুন্দর দেখাচ্ছিলো। দুষ্টু খানিকক্ষণ নিঃশব্দে তাকিয়ে দেখলো। প্রচ্ছদ নেমে দাঁড়িয়ে চপল পায়ে দিয়ে বললো,

‘নজর লাগবে আমার।’

দুষ্টু নেমে দাঁড়িয়ে বিরবির করলো, ‘বেহায়া লোক কোথাকার!’

বাড়ির বাইরে এসে পিচ্ছিল কর্দমাক্ত মাটি, শীতের ঠান্ডা পবন সাথে জটলা পাকা ঘন অন্ধকার দেখে দুষ্টুর শরীর কেঁপে কেঁপে উঠলো। আকাশে মৃদু মৃদু গর্জন হচ্ছে। দুষ্টু অসতর্কতা বশত-ই প্রচ্ছদের বাহু দু হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরলো। প্রচ্ছদ সেদিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে কদম ফেললো। দুষ্টু একবার পিছলে যেতে নিলো। প্রচ্ছদ দুষ্টুর হাতের উপর হাত রেখে শক্ত করে ধরে সতর্কে পা ফেললো। তার ভীষণ ভালো লাগছে…. ভীষণ! সারাদিনের এতো এতো দুঃখ কষ্টগুলো কর্পূরের মতো মিলিয়ে যেতে থাকলো বৃষ্টি ছটা হীম শীতল হাওয়ায়।

দুষ্টু দোয়া পড়তে পড়তে যাচ্ছিলো। ফিসফিস করে প্রচ্ছদকে বলে উঠলো,

‘চলুন, আমরা কালকে চলে যাই এখান থেকে?’

প্রচ্ছদ মৃদু হেসে বলে, ‘না।’

‘হ্যাঁ।’

‘না।

দুষ্টু শুনলো না। প্রচ্ছদের হাত ধরে এগিয়ে গেলো। প্রচ্ছদ দুষ্টুর দিকে একপলক তাকিয়ে আকাশের দিকে চোখ নিবদ্ধ করলো। আকাশকে মনের বুলি ব্যক্ত করলো গোপনে,

‘এই একটুখানি স্পর্শ পাওয়ার জন্যে হলেও আমি সারাজীবন ওর সাথে এই অজপাড়া গাঁয়ে থেকে যেতে চাই, আল্লাহ্।’

তখনি দুষ্টু বললো, ‘ভালোমতো আলোটা দরুন না! পিছলে পরে যাবো তো।’

প্রচ্ছদের পাত্তাহীন স্বর, ‘তো যাও। আমার তো ইচ্ছে করে তোমাকে ধাক্কা মেরে কাদায় গড়াগড়ি খাওয়াই। তবে যদি একটু মানুষ হও, দুষ্টু মেয়ে।

দুষ্টু ঝাড়ি দিয়ে বলে, ‘অসভ্য ছেলে।’

১০২.
পরেরদিন দুষ্টুকে দেখতে গ্রামের কিছু মহিলারা এলো। প্রচ্ছদের বাবার চাচাতো ভাইয়ের বউরা’ই ওদের দেখভাল সহ সব সামাল দিচ্ছিলো। এক বৃদ্ধা মহিলা এসে দুষ্টুর থুতনি ধরে বললো,

‘নাকে নাকফুল কই? বউয়ের গায়ে দেহান যায় থিরি পিস! শাড়ি পরে নাই কেন গো?’

দুষ্টু, টিয়া, শ্রেয়সী বারান্দায় বসেছিলো চেয়ার পেতে। আর উঠানে’ই দাঁড়িয়ে টুকটাক আলাপ সারছিলো প্রচ্ছদ, নীড়, প্রযুক্ত। দুষ্টু একবার চোখ তুলে প্রচ্ছদের দিকে তাকালো। প্রচ্ছদ ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে ইশারায় চুপ থাকতে বললো। দুষ্টু মিষ্টি হেসে বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘তা দাদী, আমার গায়ে তো তাও থিরি পিস আছে, তোমার গায়ের বুলাউজ (ব্লাউজ) কই?’

টিয়া, শ্রেয়সী হেসে উঠলো। বৃদ্ধাও মশকারি করে বললো,

‘বুলাউজ ছাড়া শাড়ি পড়ছি যাতে আমার বুইড়ার কষ্ট কম হয় রে ছেরি। তুইও একবার এই পথ নহল কইরে দেহিস জামাই খুশি হইয়া যাইবো।’

দুষ্টু লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। মাথা নিচু করে জিহবায় কামড় দিলো। একবার মাথা তুলে আড়চোখে চেয়ে দেখলো, প্রচ্ছদরা নিজেদের মতোন গল্প করছে। ভাগ্যিস শুনেনি! দুষ্টু হাফ ছাড়লো। আরেকজন মহিলা পান চিবিয়ে চিবিয়ে শ্রেয়সীকে তাক করে প্রশ্ন করলো,

‘মাইয়াডা কেডা?’

চোখের পলক নড়ার আগেই দুষ্টু শ্রেয়সী এবং নীড়কে চমকে দিয়ে বলে উঠলো,

‘আমার বোন!’

কী ভীষণ ভালো লাগায় যে শ্রেয়সীর অন্তরটা ছেয়ে গেলো তা যদি একবার দেখাতে পারতো দুষ্টুকে। বুকের ভেতর কান্না উথলে উঠলো। বহুদিন পর….এভাবে বললো দুষ্টু! শ্রেয়সী বুঝে উঠছিলো না কীভাবে দুষ্টুর সাথে একটু সরাসরি কথা বলবে। টলমলে চোখে সামনে তাকাতেই প্রযুক্ত মৃদু হাসলো। মহিলা আবার জিজ্ঞেস করলেন,

‘ওই পোলাডা তাইলে তোমার দুলাভাই?’

দুষ্টু মাথা নাড়ায়। প্রযুক্ত আরেকটু বিস্তর হাসলো। ওরা তিনজন এমন ভান ধরে দাঁড়িয়ে আছে যেনো কিচ্ছু শুনছে না নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল। অথচ ওরা এখানে দাড়িয়েই আছে ওদের বউদের কে কি বলে তা শোনার জন্য। প্রযুক্ত প্রচ্ছদের হাতে ঘুষি মেরে বললো,

‘তোর বউয়ের দুলাভাই হয়ে গেলাম রে! আজ থেকে তুই আমাকে দুলাভাই ডাকবি।’

প্রযুক্তর গর্বে বুক ফুলে উঠছে। প্রচ্ছদ পাত্তা দিলো না। উলটে বললো,

‘তুই দু’দিন ধরে নীড়ের সাথে কেনো থাকছিস? তোর নাহয় বউয়ের সান্নিধ্য দরকার নেই। মানলাম তোর সিস্টেমে সমস্যা আছে। তাই বলে তো নীড়ও বউ ছাড়া থাকতে পারে না।’

প্রযুক্ত খেঁকিয়ে উঠলো, ‘হাফ বেটা! মুখে লাগাম দে! সিস্টেম দেখতে চাস?’

প্রচ্ছদ নাক মুখ কুচকে দাড়ালো। নীড় ভ্রু কুচকে বলে উঠলো,

‘ছি! বিয়ের পর তোমার এই অধঃপতন? ছেলে দেখলেও তোমার ইমোশন জেগে উঠে? বউ কাছে আসতে দেয় না নাকি?’

প্রযুক্ত নীড়ের পেটে ঘুষি মেরে বললো,

‘তোর জন্যই তো দেয় না। প্রতিদিন রাতে তো তুই-ই আমার কাছে আসার জন্য উতলা হয়ে যাস!’

নীড় পেট ধরে মৃদু আর্তনাদ করার ভান ধরলো। কথা বাড়ালো না। এখন যদি কথা বাড়াতে গিয়ে কথায় কথায় ওকে জিজ্ঞেস করে তুই কেনো টিয়ার সাথে থাকছিস না তখন ও কি জবাব দিবে? যদি ওকে টিয়ার সাথে থাকার জন্য জোরাজুরি করে। তখন? নীড় ওদের বলল,

‘চলো পুকুর পাড়ের পাশের টং এ গিয়ে বসি।’

চলবে❤️

#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৪৯
টং এ বসে যে যার মতো চুপচাপ কিছুক্ষণ নিজেদের কথা ভাবলো। বাস্তবিক অর্থে, এই ঝিরিঝিরি শুষ্ক বাতাস….অল্পস্বল্প মিষ্টি রোদ.. সামনে বিশাল বড় পরিষ্কার পানির সুন্দর পুকুর.. উঁচু উঁচু তাল গাছগুলোর হেলানো দোলানো.. এতো মনোরম পরিবেশ যে নিজেদের ভবিষ্যত সম্পর্কে চিন্তা করতে-ই ভীষণ ভালো লাগছিলো। সেই ভালো লাগার নিস্তব্ধতা ভেঙে নীড় আচানক বললো,

‘তোদের বিয়ের কাহিনি শুনা তো। তোর বউয়ের খোঁজ পেলি কোথা থেকে?’

প্রচ্ছদ মৃদু হেসে বলে, ‘বিশাল বড় কাহিনী। শুনবি?’

নীড় ঠোঁটের কোণে মেকি হাসি নিয়ে বললো, ‘শুনবো বলেই তো জিজ্ঞেস করলাম।’

মুখে বললো ঠিকই কিন্তু নীড়ের বুক’টা জ্বলে যাচ্ছিলো অকারণেই। চট্টগ্রাম থেকে এসে প্রচ্ছদের গায়ে হলুদে এটেন্ড করার কথা ছিলো তার। সকল ঝক্কি ঝামেলা পুহিয়ে অবশেষে হলুদের দিন এসে পরলেও দুষ্টু ফোন ধরছিলো না দেখে চিন্তায় বিয়েতে উপস্থিত থাকার মতো মন-মানসিকতা ছিলো না নীড়ের। সেবার কতদিন কথা হলো না তাদের। সেই সামান্য দূরত্ব থেকেই আজন্মকালের দূরত্ব এসে পরলো।

প্রযুক্ত হেসে বলল,

‘তোর থেকে লুকিয়েছে বলে মারিস না কিন্তু আবার।’

নীড়ের হৃদপিণ্ডে কি জানি একটা খামচে ধরলো। তবুও প্রচ্ছদের দিকে চোখ নাচিয়ে চেয়ে রইলো। প্রচ্ছদ সলজ্জে হেসে মাথা চুলকায়। তার হৃদয়ের সংকোচন-প্রসারণ বেড়ে গেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে স্মৃতি হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে বের করে আনলো তার গোপনীকে। যাকে সে বহুবছর ধরে ভীষণ ভালোবাসে।

প্রচ্ছদ যখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার। দুষ্টু তখন ক্লাস নাইনে। ছোটোবেলায় দুষ্টুদের বাড়িতে বেশ কয়েকবার ওদের যাওয়া হয়েছে মায়ের সুবাধে। দুষ্টুর সাথে প্রচ্ছদের কখনো তেমন কথা হতো না। হলেও প্রচ্ছদ আপনি তুমি গুলিয়ে ফেলতো বলে দুষ্টু নাক মুখ ফুলিয়ে বলতো, ‘আপনি তো ভীষণ এলোমেলো ছেলে।’ প্রচ্ছদের সাথে দুষ্টুর টুকটাক গোছালো, সুন্দর কথাবার্তা হতো হঠাৎ! বস্তুত প্রচ্ছদের ওই গম্ভীর মুখখানা কে দুষ্টু কোনোকালেই পছন্দ করতো না। কিন্তু দুষ্টুর এই পছন্দ না করা’টাকেই প্রচ্ছদ পছন্দ করে ফেলল। ধীরে ধীরে পছন্দ’টুকু গাঢ় হলো। কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পেলো না। দিন, মাস যায় তার পছন্দের পারদ তড়তড় করে বাড়তে থাকে তবে সর্বোচ্চ গোপনে। ওই নীল গেঞ্জি’টা ওর এতো প্রিয় হওয়ার কারণ ছিলো- দুষ্টু একদিন বলেছিলো, ‘আপনাকে এই নীল গেঞ্জি দিয়ে তো খুব স্মার্ট লাগছে। কী সুন্দর!’ প্রচ্ছদ গম্ভীর মুখে উত্তর দিতো, ‘আমাকে সব গেঞ্জি’তেই স্মার্ট লাগে এবং আমি ছেলেটাই ভীষণ সুদর্শন।’ ব্যস! ওই কথাটুকু মনে রেখেই এতো বছর গেঞ্জি’টাকে আগলিয়ে রাখা। খুবই বাচ্চামো না ব্যাপারটা? প্রেমে পরলে সবাই একটু আধটু বাচ্চামো করে এটা তেমন বড় কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু বিয়ের পর দুষ্টু যখন গেঞ্জি’টা বাচ্চামি বশে কেটে ফেললো প্রচ্ছদের মনে হয়েছিলো কেউ ওর প্রেমের স্মৃতি’টাকে কেটে ফেলছে। ওর দশ বছরের একপাক্ষিক প্রেমের স্মৃতি।’

নীড়ের শরীর অসাড় হয়ে যাচ্ছে। মুখে কোনো রা নেই। তবুও শুনে চললো।

দু’বছরের জন্য স্কলারশিপ নিয়ে প্রচ্ছদ বাইরে গেলো পড়তে। ফিরে এসে শুনে দুষ্টু রিলেশনশিপে আছে। ওর পুরো দুনিয়াটা ভেঙে চুরমার হয়ে যেনো গড়িয়ে পরলো। মানতে পারছিলো না। দুষ্টু প্রচ্ছদকে ছাড়া কেনো অন্যকাউকে ভালোবাসলো? প্রচ্ছদের মা কীভাবে যেন বুঝে ফেললেন। মাথায় হাত রেখে একদিন জিজ্ঞেস করতেই প্রচ্ছদ হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পরলো। বুঝ হওয়ার পর এই প্রথম…. মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ওকে এনে দাও। আমি মরে যাবো। প্লিজ! আম্মু এনে দাও। আমার দম’টা বন্ধ হয়ে আসছে।’ মাকে সব বলার পর তিনি রাজি হলেন না। বললেন, ‘অসম্ভব। ওই ঘরের এক মেয়ে দিয়ে আমি এতো অপমানিত হলাম। বিয়ের আসরে আমার ছেলেকে প্রত্যাখ্যান করে পালিয়ে গেলো। আবার ছোট মেয়েকে যেচে গিয়ে নিয়ে আসবো? তাও এতোকিছু শোনার পর?

নীড়ের বুকের দহন বাড়ছে। এত্তোকিছু? অথচ ও কিচ্ছু জানে না! অবাকতায় চোখ কঠোর থেকে বের হওয়ার যোগাড়। প্রচ্ছদ যদি কখনো তাকে একবার বলতো! ইশশ….! সাত বছর আগে দৃষ্টির সাথে অর্জনের বিয়ের সময় নীড় উপস্থিত ছিলো ঠিকই কিন্তু সেখানে দুষ্টু ছিলো না। ও দৃষ্টিকে দেখেছে কিন্তু দুষ্টুকে দেখেনি কারণ তখন দৃষ্টির পালিয়ে যাওয়ার তোড়জোড়ে মূখ্য ভূমিকা পালন করছিলো বিধায় বিয়ে বাড়ির কোথাও ওকে দেখা যায়নি তেমন। ও দৃষ্টির পালিয়ে যাওয়ার সব বন্দোবস্তে ব্যস্ত ছিলো। ইভেন দুষ্টুর সাথে সম্পর্ক থাকাকালীনও দুষ্টু ওর ফ্যামিলি সম্পর্কে তেমন কিছু বলতো না। আদতে বলবে কি? তিন সদস্যের পরিবার! বোনের সাথে বাবা-মার যোগাযোগ নেই কারন পছন্দের মানুষকে বিয়ে করেছে। ব্যস এটুকুই! নাম জিজ্ঞেস করার চিন্তা যেমন কখনো মাথায় আসেনি তেমন কোনোরকম প্রয়োজনও বোধ করেনি। ও তো দুষ্টুতেই সীমাবদ্ধ ছিলো। একটা মিষ্টি দুষ্টু মেয়ে হলেই ওর চলতো। ওই মেয়েটি আশেপাশে থাকলে তো দিন দুনিয়ার হুশ ওর কোনোকালেই রইতো না। নীড় জড়ীভূত কন্ঠে বলে উঠলো,

‘আমাকে কখনো কেনো কিছু বলিসনি?’

প্রচ্ছদ হেসে বলে,

‘আরে পাগল, কেউ কিচ্ছু জানতো না তো এক্সেপ্ট মি। প্রযুক্তও জানে আরো বহু পরে যখন আমি বিদেশ থেকে আসি। যখন আমার অবস্থা খুবই খারাপ। আসলে এসব বলার মতো কথা নয়। বাট আই উইশ যদি তোকে বলতাম কিন্তু আমি তো জানতাম না তুই এক ইয়ার ড্রপ দিয়েছিস।’

বস্তুত নীড় দুষ্টু আর শ্রেয়সীর থেকে এক ইয়ার সিনিয়র। প্রথম থেকেই নীড় দুষ্টুকে পছন্দ করলেও দুষ্টু ওকে তোয়াক্কা করতো না। ওর পাত্তা পেতে কতকিছু’ই না করেছে! শেষমেষ বিভাগে আবেদন টাবেদন লিখে হুলুস্থুল কান্ড করে এক ইয়ার ড্রপ দিয়ে দুষ্টুকে নোট টোট দিয়ে হেল্প করে ওর নজরে আসতে পেরেছিলো। সে কত করসত করতে হয়েছিলো নীড়কে! সত্যি যদি প্রচ্ছদ ওকে বলে রাখতো তবে এতো বড় ভুল’টা….এতো বড় বড় কষ্টগুলো ওদের কখনো আষ্টেপৃষ্টে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে নিতো না। নীড় নিজের ভাবনা থেকে ফিরলো। তাকিয়ে খেয়াল করলো শুকনো উদাস প্রচ্ছদের চোখের কোণা দুটো পানিতে ভিজে উঠেছে। নীড় সেদিকে এক নয়নে চেয়ে রইল আর প্রচ্ছদ বলে গেলো,

‘তারপর জানিস আম্মু রাজি না হওয়াতে টোটালি খাওয়া দাওয়া অফ হলো আমার। ঘরের জিনিসপত্র ভেঙে একাকার। আব্বু, কাকা, ভাইয়া, ভাবি সবাই জানলো। ভাইয়া বুঝালো সবাইকে। আম্মু একসময় রাজি হলো। এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ের আয়োজন। বিয়ের রাতে আম্মুকে ওদের বাড়ির পেছনে পাহারায় রাখলাম। কারন আমি প্রিটি মাচ সিউর ছিলাম ও পালাবে। হাজার হোক রক্ত বলে কথা! এবং তাই-ই হলো। স্টেশন থেকে ধরে নিয়ে আসলো আম্মু। এরপর ফোন করে আমাকে কত কথা যে শোনালো তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তারপর বিয়ে হলো। বিয়ের রাতেই ও ডিভোর্স চাইলো। কূল-কিনারা না পেয়ে আমিও হ্যাঁ বললাম। এরমধ্যেই একদিন শুনলাম ওর সেই বয়ফ্রেন্ডের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে। আমার মনের ঘুটঘুটে অন্ধকার গুহার ভেতর একটা মস্ত বড় চাঁদ যেনো এক ফালি সরু কিরণ ফেললো । আশার রশ্মি খুঁজে পেলাম। এই তো, তারপর থেকে ক্রমেই ওর প্রতি দিনকে দিন আরো বেশি দূর্বল হয়ে পরলাম।’

প্রচ্ছদ থামলো। নীড়ের শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। কত্তো বছর ধরে ভালোবাসে প্রচ্ছদ! নীড় যদি জানতে পারতো একটাবার! শুধু একটাবার! কোনো মন্ত্রোবলে ও যদি প্রচ্ছদের গোপনীর খোঁজ পেতো! তার এতো প্রিয় ভাই’টার সবচেয়ে অপ্রিয় মানুষ’টা সে! নীড়ের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। প্রচ্ছদের কাধে হাত রেখে মৃদুস্বরে মনের অনিচ্ছায় প্রশ্নটা করে বসলো,

‘প্রচণ্ড ভালোবাসিস না?’

‘প্রচন্ড ….! ওকে আমি কক্ষনো ছেড়ে দিতে পারবো না রে। ও আমার পৃথিবী! আমার আকাশের সূর্য! আমার হৃদস্পন্দন! আমি কেমন করে বাচঁবো ওকে ছাড়া? ওর জন্য আমি গোটা বিশ্বের সাথে যুদ্ধ করতে পারি কিন্তু ওকে পাওয়ার জন্য ওর সাথে কীভাবে যুদ্ধ করবো? এতো অবুঝ কেনো ওই মেয়ে? থেকে গেলে কি হয়? আমি ওকে অনেক ভালোবাসবো। একটা পিঁপড়াকেও কখনো কামড়াতে দেবো না। কেনো আমায় একটু ভালোবাসে না? একটুখানি পছন্দ করুক না!’

প্রচ্ছদের চোখ লাল হয়ে উঠলো। নীড়ের চোখ ছলছল করলো প্রচ্ছদের আর্তনাদে। এতোটা যন্ত্রণা পেয়ে যাচ্ছে প্রচ্ছদ? নীড়ের বুকে মোচড় দিয়ে উঠে। না জেনেশুনে এতো বড় কষ্ট’টা দিতে পারলো প্রাণপ্রিয় ভাই’কে? আচ্ছা কখনো যদি ঘূনাক্ষরেও প্রচ্ছদ জানতে পারতো নীড়ের সাথে দুষ্টুর সম্পর্কের কথা। তবে কি হতো? প্রচ্ছদ কি নিজের দাবী ছেড়ে দিতো? তখন ও বাঁচতো কেমন করে? নীড়ের বুক দ্রুত উঠানামা করছে। ও মনপ্রাণ দিয়ে চাইলো ওর ভাই’টার কষ্ট কমে যাক! ও আর কোনোদিন কষ্ট না পাক! প্রচ্ছদের জীবনে সব ভালো হোক। ওর ভাগের ভালোগুলোও তার ভাগে ঠায় পাক! সে বুঝে গেছে প্রচ্ছদের বেপরোয়া ভালোবাসার কাছে তার হাল ছেড়ে দেওয়া ভালোবাসা ঠুনকো, মলিন।

চলবে❤️

#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৫০
১০৩.
পথের ধুলো উড়িয়ে রাস্তার সাথে চার চাকার ঘর্ষনে বড় গাড়ি’টা এসে থামলো হক বাড়ির সামনে। দুষ্টু একটা লম্বা নিঃশ্বাস টেনে সবার আগে নেমে চটপট পায়ে ভেতরে গেলো। কি দমবন্ধকর পরিবেশের মধ্যে ছিলো এ দুই-তিন দিন! ঘরে এসে বারংবার বিরবির করে বলে গেলো,

‘ওর সাথে যেনো আর কক্ষনো আমার দেখা না হয়!’

প্রচ্ছদ লাগেজ নিয়ে রুমে পা রাখতেই দুষ্টু বলে উঠলো,

‘চলুন প্রেগন্যান্সির টেস্ট করাতে যাবো। রিপোর্ট নিয়ে আজকেই কোর্টে যাবেন আপনি।’

ঘড়িতে তখন দুপুর বারো’টা বাজে। প্রচ্ছদের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। লাগেজ ঘরে ঢুকিয়ে নিজের জামা-কাপড় নিয়ে গোসলে গেলো। মিনিট দশেক পরে গোসল থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে দুষ্টু কপাল কুচকে বললো,

‘শুনেছেন আপনি?’

‘তোমার এই এক ঘ্যানরঘ্যানর আর ভালো লাগছে না আমার। এতো বিরক্তিকর মেয়ে কেনো তুমি? কবে থেকে টেস্ট করানোর কথা বলছি করলে না। এখন আবার শুরু করেছো। তোমার মর্জি মতো সব হতে হবে? নিজেরটা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারো না? এতোটুকু পথ ড্রাইভিং করে এসে আমি এখনি তোমাকে নিয়ে টেস্ট করাতে ছুটবো? তারপর আবার ছুটবো কোর্টে? বিবেকজ্ঞানহীন মেয়েমানুষ!’

প্রচ্ছদ ধমকিয়ে ধমকিয়ে উচ্চস্বরে বলে চললো। দুষ্টুর চোখ ছাপিয়ে অম্বুর এলো। এভাবে আর কক্ষনো কোনোদিন কথা বলেনি প্রচ্ছদ। দুষ্টুর বুক ভেঙে কান্না পেলো। প্রচ্ছদ সেদিকে খেয়াল পর্যন্ত করলো না বরং আরো বললো কঠোর বাক্যে হিমশীতল কণ্ঠে,

‘তোমার যদি থাকতে ইচ্ছে করে থাকো নাহয় চলে যাও। এক মাস পর আপনাআপনি ডিভোর্স পেয়ে যাবে!’

কথাগুলো বলেই প্রচ্ছদ হনহন করে ছাদে চলে এলো। রাগে শরীরে আগুন ধরে যাচ্ছে। ডিভোর্স! ডিভোর্স! ডিভোর্স! যখন তখন এই এক বুলি আওড়াচ্ছে। নিজমর্জি মতো সব করবে। বেপরোয়া মেয়ে! সবকিছুর একটা লিমিট থাকা উচিত।

ঘরে স্তম্ভিত দাঁড়িয়ে থাকা দুষ্টু অপমানে ছিন্নভিন্ন হয়ে লাগেজ থেকে প্রচ্ছদের সব কাপড় বের করে ছুড়ে মারলো এদিক-সেদিক। নিজের আরো কিছু কাপড় এনে উল্টেপাল্টে ভরলো লাগেজে। এরপর নিচে নেমে এলো। সিড়িন হক ডাইনিং টেবিলে খাতা কলম নিয়ে বসে মনোযোগ সহকারে বাজারের ফর্দ লিখছিলেন। দুষ্টু গিয়ে ডাকলো,

‘আন্টি।’

সিড়িন হক মাথা না উঠিয়ে বললেন, ‘জি।’

‘আমি একটু আমার বাসায় যেতে চাই।’

খাতায় মরিচের গুড়া দুই কেজি লিখতে লিখতে দুষ্টুর কথার জবাব দিলেন তিনি, ‘মাত্র এক জায়গা থেকে এলে। ফ্রেশও হলে না…

সিড়িন হকের কথা শেষ হওয়ার আগেই দুষ্টু বলে,

‘বাবা অসুস্থ। আমাকে দেখতে চাইছে। প্রায় দুই মাস হয়ে গেলো বাবা-মাকে দেখিনা।’

বস্তুত দুষ্টু মিথ্যে বলেনি। কাল-ই ওর বাবা ফোন দিয়ে বলছিলো ওকে যেতে। শরীর ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। ফোন’টা মূলত করেছিলো প্রচ্ছদকে। জামাইকে দাওয়াত দিয়ে মেয়ের সাথেও কথা বলা হয়েছে। সিড়িন হক বড় করে শ্বাস ফেললেন,

‘তোমার মা’কে কত করে বলি আসতে। সে আসতেই চায় না। তারউপর তোমার বাবা অসুস্থ। আচ্ছা যাও। কিন্তু প্রচ্ছদ কোথায়?’

‘উনার কাজ আছে। আমাকে একাই যেতে বলেছে।’

দুষ্টুর চটপটে উত্তর। সিড়িন হক ভ্রু কুচকে গালে জিব ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে কিছু আন্দাজ করে বললেন,

‘আচ্ছা যাও, এখনি যাবে?’

‘হ্যাঁ!’

‘দাড়াও দু’মিনিট। টাকা নিয়ে আসি। যাওয়ার সময় তোমার বাবা-মার জন্য কেনাকাটা করে যেয়ো।’

‘লাগবে না, আন্টি।’

‘লাগবে। দাঁড়াও দু’মিনিট।’

সিড়িন হক নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। কম কসরতে সিড়িন হককে রাজি করাতে পেরে দুষ্টু হাফ ছেড়ে বাঁচলো। এ বাড়িতে আর কক্ষনো আসবে না ও। এ-ই ওর শেষক্ষণ। নিজঘরে যাওয়ার সময় রান্নাঘরে চোখ পড়তেই দেখলো ইরা আর নীরা হাতে হাত লাগিয়ে একসাথে কাজ করছে। এই মূহুর্ত’তে এসেও ওর চক্ষু চড়ুকগাছ! রান্নাঘরে ঢুকে ইরাকে দেখে ওর কান্না পেলো। ওর সুন্দরী ভাবী’টাকে আর দেখা হবে না। ইরাকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকলো। নীরা দুষ্টুর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। দুষ্টুর হজম হলো না। অবাকতার সহিত নীরাকে বললো,

‘স্বপ্ন?’

নীরা শব্দ করে হেসে বলে, ‘যাও। এরকম করো না।’

দুষ্টু হাসলো। রান্নাঘরের কেবিনেটের উপর আকাশ বসে আছে। নাক দিয়ে সর্দি পরছে। নীরা নিজের আচল দিয়ে সর্দি মুছে দিলো যা এই প্রথম ঘটলো বলে বোধ হলো দুষ্টুর। ও মুগ্ধ চোখে চেয়ে রয়। ইশশ….. তারও তো একটা নিজস্ব আকাশ থাকার বয়স হয়েছে। আফসোস! তার নিজস্ব আকাশ’টা হয়তো কোনোদিন তার কোলে আসবে না!

,

এই শীতের মাঝেও ঠান্ডা বাতাসে হাফ হাতা গেঞ্জি গায়ে ছাদে বসেছিলো প্রচ্ছদ। আজ সূর্যের দেখা নেই। ঠান্ডায় বুকে একটু পর পর চাপ দিচ্ছে। ঘন্টাখানেক পর নিজঘরে ফিরে এসে দেখা গেলো, এদিক-সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ওর কাপড় ফেলে রাখা। ওমনি নাকের পাটাতন ফুলে উঠলো। আজ এই মেয়ের কপালে শনি আছে! প্রচ্ছদ চেঁচিয়ে দুষ্টুকে ডাকে। এদিক সেদিক খুঁজে। নিচে এসে ডাইনিং টেবিলের উপর আকাশকে নিয়ে খেলায় ব্যস্ত থাকা সিড়িন হকের দিকে তাকিয়ে কপাল কুচকে বলে,

‘আম্মু, তোমার বান্ধুবীর বেয়াদব মেয়ে’টা কোথায়?’

সিড়িন হক প্রচ্ছদের দিকে না তাকিয়ে জবাব দিলেন,

‘আমার বান্ধুবীর বেয়াদব মেয়েটি মিনিট বিশেক হলো বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে রৌনা দিয়েছে।’

কথাটা কানে যাওয়া মাত্র প্রচ্ছদ যেনো সেখানেই জমে গেলো। মাটির সাথে পা আটকে গেলো। দুষ্টু চলে গেছে? এমনটা তো ভাবে নি। ওর হৃদয়ে কে যেনো সূচ ফুটালো। কি আশ্চর্য! এতো বাজে রকমের খারাপ লাগছে কেনো? বুক’টা ধরফর করছে। গলা’টা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। কি যেনো নেই নেই লাগছে! হৃদপিণ্ড হাহাকারে ছেয়ে যাচ্ছে।

‘কেনো তুমি ওকে যেতে বলোনি?’

সিড়িন হকের কথার উত্তর না দিয়ে রোবটের মতো ঘরে চলে এলো প্রচ্ছদ। এতো পাষাণ দুষ্টু? প্রচ্ছদকে তো কত অপমান করে কই প্রচ্ছদ তো কখনো চলে যায় না। ও তো ঘুরেফিরে সেই নির্দয় দুষ্টুর কাছেই ফিরে আসে। আচ্ছা, দুষ্টু যদি আর না আসে? এটুকুই ওদের একসাথে থাকার সময় ছিলো? এতো কম! চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে-ই তো চলে গেলো। প্রচ্ছদ মাথার চুল টেনে বসলো বিছানায়৷ কেনো তখন ওভাবে দুষ্টু’কে ধমকালো? কেনো চলে যেতে বললো? নিজের গালে সপাটে দু’টো চর মারলো। প্রচন্ড লাল চোখ দুটো থেকে নির্লজ্জ, বেহায়া পানি এক নির্দয়, পাষাণ ব্যক্তির জন্য গড়িয়ে আসতে চাইলো। অথচ পুরুষদের যখন তখন কাঁদার নিয়ম নেই। প্রচ্ছদ চোখ-মুখ কয়েকবার হাত দিয়ে ঘষে বড় বড় করে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো।

১০৪.
দুপুরে গোসল শেষে টিয়া নামাজ পড়তে বসলো। কোথাও একফোঁটা শব্দ নেই। নিস্তব্ধ, গুমোট পরিবেশ! নীড় ঘরে এলো। টিয়া’কে দেখেও যেনো দেখলো না। ফোন’টা একবার চেক করে জামাকাপড় নিয়ে ঘুরে দাড়াতেই দেখলো সিজদাহ্ রত টিয়ার পিঠ থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। টিয়া বহু সময় নিয়ে সিজদাহ্ দিলো। নীড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে যেমন নিশ্চুপে এসেছিলো তেমনভাবেই প্রস্থান করলো।

শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে নীড় অনেকক্ষণ টিয়া’কে ভাবলো। জীবন’টা কি থেকে কি হয়ে গেলো? কত জটিল! কত বিষন্ন সব মানুষ! টিয়ার বিমর্ষ মুখ’খানা দেখলে নীড়ের দিন’টা আরো খারাপ যায়। শাওয়ার শেষে নীড় রুম থেকে বেরিয়েই দেখলো ডাইনিং রুমে টেবিলের সাথে লেগে দাঁড়িয়ে টিয়া খাবার গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। এরপর নীড়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ধীর গলায় সে প্রশ্ন করলো,

‘তুমি এতো কিছু পারো?’
‘পারতে হয়!’
‘আমি তো পারি না।’
‘শিখবে। ‘
‘কষ্ট হয় না রান্না করতে?’
‘অভ্যস্ত হয়ে গেছি!’

সেই বেলার মতো এতোটুকুই কথা হয়েছিলো তাদের। রাত আনুমানিক দশ’টার দিকে টিয়া বারান্দার বেতের চেয়ারে পা তুলে গুটিসুটি হয়ে বসেছিলো। চারিদিকে রুপালি গাঢ় জ্যোৎস্না। টিয়ার গুটানো ছোট্ট শরীর’টা জ্যোৎস্নার আলোতে ঝিলিক দিয়ে চোখে লাগছিলো। ভারি সুন্দর দেখাচ্ছিলো ওকে তখন! কিন্তু সেসময় আকস্মিক হাওয়ায় ভেসে আসা চিৎকারে টিয়া চমকে উঠলো। চেয়ার থেকে এইতো উল্টে যেতে নিচ্ছিলো৷ নীড় অগ্নিশর্মা রুপে বারান্দার দরজায় দাড়িয়ে গলার স্বর তুঙ্গে উঠিয়ে প্রশ্ন করলো,

‘তোমার রেসাল্ট বেরিয়েছে জানো না তুমি?’

টিয়া জিব বের করে আড়ালে কামড় দিলো! ওর তো মনেই নেই! অবশ্য মনে থাকার মতো পরিস্থিতিতেও নেই! তাছাড়া এসব রেসাল্ট ফেসাল্টের ধার ধেরেছে কোনকালে? কিন্তু নীড় তো ধারে। টিয়ার ভাবনা-চিন্তার মাঝেই নীড় গর্জে উঠলো,

‘রেসাল্টে কি পেয়েছো জানো?’
‘কি?’ টিয়ার মিনমিনে গলার স্বর।
‘এত্তো বড় বড় কয়েকটা ডিম।’
‘ভেজে খেয়ে নিলেই তো হয়।’

এমতাবস্থায় এহেন কথায় নীড়ের নাক’টা ফুলে উঠলো। পুনরায় গর্জে উঠলো সে,

‘মাত্র ২.৭১ পেয়েছো।’

টিয়া অবাক চোখে তাকায়। এরপর খুশিতে ঝুমঝুম করে বলে,

‘ফেল করিনি? উফফ..আল্লাহ থ্যাঙ্কিউ! পাস করে গেছি।’

টিয়ার মৃদু উল্লাসে নীড় ধমকে উঠলো। আগ বাড়িয়ে কান টেনে ধরলো। টিয়ার কানে স্বর্ণের বড় ঝুমকা। এমনিতেই সন্ধ্যা থেকে কান ব্যাথা করছিলো। দুল’দুটো খুলবে খুলবে করেও খোলা হচ্ছিলো না। এখন এতো জোরে কান টানায় টিয়া উচ্চস্বরে কঁকিয়ে উঠলো,

‘ব্যাথা লাগছে নীড় ভাইয়া! ছাড়ো ছাড়ো!’

‘ব্যথা লাগার জন্যই তো ধরেছি।’

ব্যথায় টিয়ার গলা ধরে এলো। নীড়’কে দুলের কথা বলতেই নীড় ছেড়ে দাড়িয়ে কান দেখে বলল,

‘কেয়ারলেস মেয়ে একটা! ইশশ…কান কি লাল হয়ে আছে! এতো বড় বড় ঝুমকা কেনো পড়েছো? না পড়াশোনা পারে… না রান্না পারে… না নিজের যত্ন নিতে পারে! পারে’টা কি? শুধু সারাদিন ফ্যাচফ্যাচ করে কাদঁতে আর উদাস নয়নে সন্নাসী’দের মতোন ভাবতে। এই! সন্নাসী হয়েছো তুমি? ঘর-সংসার নেই? এতো কিসের উদাসীনতা এই বয়সে, হ্যাঁ? থাপড়ে দাঁত ফেলে দেবো একদম।’

টিয়া ফুঁপালো। নীড় হাত ধরে টেনে ওকে ভেতরে নিয়ে এসে মলম এনে কানে লাগাতে লাগাতে ধমকে উঠলো আবার,

‘একদম ফুঁপাবে না। থাপ্পড় একটাও মাটিতে পরবে না, ডিরেক্ট কানের তিন আঙ্গুল নিচে।’

‘পাস করেছি এই তো বেশি। এতো পয়েন্ট দিয়ে কি করবো?’

‘ভেজে খাবে! ফাজিল! আলমারিতে সার্টিফিকেট তুলে রাখবে তাও ভালো রেসাল্ট করতে হবে। সমস্যা আছে?’

টিয়া দ্রুত গতিতে ডানে-বামে মাথা নাড়ে। নীড় আবার বললো,

‘কালকে থেকে রুটিন করে সকাল সাত’টায় আর রাত দশ’টায় আমার কাছে পড়তে বসবে তুমি।’

টিয়ার চোখ দুটো মার্বেলের মতো বড় বড় হয়েগেলো,

‘কিহ! ওতো সকালে উঠতে পারবো না। দশটায় পড়বো।’

নীড় বিদ্রুপ করে বলে,

‘এ্যাহ! আমার তো কোনো কাজ নেই। তোমার মতো শুয়ে বসে থাকাই তো আমার কাজ। সাত’টা মিনস সাত’টাই!’

টিয়া গাল ফুলালো। নীড় আরো বলে গেলো,

‘আমার কাছে রান্না শিখবে। প্রতিদিন নতুন নতুন রান্না এক্সপেরিমেন্ট করবে। খারাপ হলে হোক তবুও খাবো!’

‘আমার রান্না করতে ভালো লাগে না।’ টিয়া মুখ’টা গোমড়া করে বলল।

‘আমি শিখালে ঠিকই ভালো লাগবে।’

‘কেনো?’

‘আমি আদর যত্ন দিয়ে শেখাবো তাই।’

নীড় অন্যমনস্ক গলায় বলেছিলো। টিয়া একমুহূর্তের জন্য নিষ্প্রাণ চোখে তাকালো। কানের ভেতর বলের ন্যায় কথা’টি বারংবার ডপ খেলে গেলো। আচম্বিতে বুকের উপর থেকে একটা উটকো বড় রকমের বিশ্রী পাথর নেমে গেলো পাহাড়ের ঢালু বেয়ে। এর বদলে ভীষণ সুন্দর ছোট্ট পানির ফুয়ারা শৈলের সবুজ গাছগাছালির ভেতর থেকে লুকিয়ে নেমে এলো। টিয়ার মরা মন সতেজ করলো। নীড় আরো বলল,

‘আমি দু’টো টিউশনি খুঁজে এনে দিবো। নতুন মাস পড়লে টিউশন করাতে যাবে।’

টিয়া কপাল কুচকে তাকালো। বুকে আড়া-আড়ি ভাবে হাত ভাঁজ করে বললো,

‘আমি কাউকে পড়াতে পারি না। আর আমার পড়াতে হবে কেনো?’

‘আমাকে হেল্প করার জন্য। সংসারে তুমিও কন্ট্রিবিউট করবে। আমার একার’টা দিয়ে হবে না।’

টিয়া অসহায় হয়ে পরে,

‘নিজের বউকে সকাল সাত’টায় উঠিয়ে পড়িয়ে, রান্না বান্না শিখিয়ে আবার টিউশনিও করাবে! এতো কষ্ট দিতে মায়া লাগবে না একটুও?’

নীড় হাসলো৷ মৃদু, চমৎকার ঠোঁট বন্ধ হাসি। কী ভীষণ সুদর্শন যে তাকে দেখালো! আদতে সে চাইছে তাদের সম্পর্ক’টা স্বাভাবিক করতে। স্বামী-স্ত্রী না হোক, বন্ধু না হোক, আগের মতো সম্পর্ক আবার হোক। নীড় আলতো স্বরে বললো,

‘সারাদিন ব্যস্ত থাকলে কষ্টগুলো আর ছুঁবে না তোমায়! ভালো হবে না?’

টিয়া চোখ মেলে চাইলো। বলহীন গলায় বললো,

‘হবে হয়তো!’

চলবে