#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৫১
১০৫.
ক্ষীণালোক কক্ষের দক্ষিণামুখী জানালা গলিয়ে বিশাল রাত্রি-আকাশ অবলোকন করতে করতেই দুষ্টুর বুক’টা শূন্য ঠেকলো৷ জীবন থেকে কি পেলো ও? ওর জীবনের এচিভমেন্ট’টা কি? বুক চিরে চাপা উদ্বেগ বেরিয়ে এলো। ঘড়ির কাটা দশটার ঘরে। মিনিট পাঁচেক হলো ও নিজ বাসায় ফিরেছে। জানালা গলিয়ে শূন্যে তাকালো। রৌপ্য চন্দ-শোভা চতুর্দিক রুপকথার মতো রুপালি করে তুলেছে। এরমাঝে আকস্মিক জানালার গ্রিলে রাখা ওর দুটো হাতের পাশে এসে ঠেকলো আরো দু’টো পুরুষালী হাত । দুষ্টু তড়িৎ বেগে পেছন ফিরলো। প্রচ্ছদ যৎসামান্য চমৎকার করে হেসে দুষ্টুর মুখে ফু দিলো। দুষ্টু চোখ ছোট ছোট করে কপাল কুচকে নাক ফুলিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,
‘আপনি?’
প্রচ্ছদ কাধ ঝাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি!’
দুষ্টু ভয়ংকর চাহনি ফেলে শুধায়, ‘আপনি এখানে এসেছেন কেনো?’
‘কারণ আপনি এসেছেন তাই।’
প্রচ্ছদ দুষ্টুর মতো করেই বললো। দুষ্টু বিরক্ত হলো। দুপুরের অপমানের রাগ’টা মাথায় চিরবিড়িয়ে উঠলো। প্রচ্ছদ অপরাধী সুরে মাথা নিচু করে কুর্নিশ ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
‘আই এম এক্সট্রিমলি সরি, মহারানী। আপনার সাথে তেমন ব্যবহার করা আমার মোটেও উচিত হয়নি। আমার ভুল হয়ে গেছে। এই অধমকে দয়া করে মাফ করুন। আপনার পদধূলিতে একটু স্থান দিন।’
প্রচ্ছদ ভীষণ ভান করলো। দুষ্টু তার ভারী স্বর’টা বজায় রেখে বললো,
‘নট এলাউ! স্থান দেওয়া যাবে না।’
প্রচ্ছদ মেকি কান্নার ভং করে,
‘না না মহারানী এমন’টা বলবেন না। আমি বড় পাপ করে ফেলেছি আপনাকে বকা দিয়ে। আমার গর্দান নেওয়া উচিত। কিন্তু আপনার মতো হতদরিদ্র মহারানীর কোনো জল্লাদও নেই। সুতরাং বিনা সাজা’তে দয়া করে মার্জনা করুন এই পাপীষ্ঠকে।’
দুষ্টু চোখ পাকিয়ে চেয়ে ধমকে বলল, ‘সরুন! সরুন আমার সামনে থেকে!’
‘না, সরা যাবে না।’
‘আপনি আমার বাসা থেকে বের হবেন নাকি আমি বের হবো?’
‘আপাতত আমরা কেউ বের হচ্ছি না।’
প্রচ্ছদ গলার স্বর নিচু করে দুষ্টুর কানে ফিসফিস করে বললো৷ মুখ বাড়িয়ে দ্বিতীয় দফায় ফু দিয়ে দুষ্টুর সুন্দর আনন থেকে চুল গুলো সরিয়ে দিলো। ঠোঁট মেলে কিছু বলতে যাবে ওমনি হাতের কাগজ’টা প্রচ্ছদের মুখের সামনে ধরলো দুষ্টু। প্রচ্ছদ ভ্রু বাঁকালো। মুখ’টাকে বিকৃত করে প্রশ্ন করলো,
‘হুয়াট ইজ দিজ?’
‘রিপোর্ট।’
প্রচ্ছদ দশ সেকেন্ড রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে থেকে দুষ্টুর দিকে কড়া চোখে তাকায়,
‘তোমার এতো বড় সাহস তুমি আমাকে না জানিয়ে একা একা গিয়ে প্রেগন্যান্সিও টেস্ট করিয়েছো?’
দুষ্টু ঈষৎ হেসে বলে, ‘বাকি’টা জীবন আমাকে একাই কাটাতে হবে।’
প্রচ্ছদের কানে কেমন অন্যরকম শুনালো কথা’টা। যেনো কত পীড়ন মিশে রয়েছে এই ভয়ংকর বিশ্রী বাক্যে। প্রচ্ছদ রাশভারী স্বরে বললো,
‘কখন গিয়েছিলে?’
দুষ্টু প্রচ্ছদের বাহু বন্ধন থেকে সরে এলো। চুল আচড়াতে আচড়াতে উত্তর দেয়, ‘চার’টায়।’
‘এখন দশ’টা বাজে।’
প্রচ্ছদের মনের প্রশ্ন’টা যেনো দুষ্টু বুঝতে পারলো।
‘টেস্ট করিয়ে শ্রেয়সীর বাসায় গিয়েছিলাম। ওখান থেকে আসতেই দেরি হলো।’
কথা’টা বলেই দুষ্টু ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,
‘আপনাকে এতো জবাবদিহি করছি কেনো? আমার যেখানে ইচ্ছে সেখানে ছিলাম। যত রাত ইচ্ছে তত রাতে বাড়ি ফিরবো? সমস্যা আছে?’
প্রচ্ছদ চটপট পায়ে এগিয়ে গেলো,
‘অফকোর্স! বিকজ ইউ আর স্টিল মাই ওয়াইফ!’
‘আই ডোন্ট এগ্রি উইথ দ্যাট। আই এম নট ইউর ওয়াইফ। আজকের পর থেকে আপনার আমার মাঝে আর কোনো সম্পর্ক নেই।’
প্রচ্ছদ বিরক্ত হয়ে তাকালো,
‘দুষ্টু আমি তো সরি বললাম। চলো বাসায় যাবো। বিছানা চেঞ্জ হলে আমার ঘুম আসেনা।’
দুষ্টু অবাকতার ভান ধরে বললো,
‘কিসের বাসা? কোন বাসা? আমি কোনো বাসায় টাসায় ফিরছি না। আর আপনাকে এখানে ঘুমাতে বলেছে কে? আশ্চর্য!’
দুষ্টুর অনড় জবাবে প্রচ্ছদ জোরে শ্বাস ফেলল। অনেক কষ্টে ধৈর্য্য ধরে হাত মুঠো করে বিছানায় বসে বলল,
‘দেখো আমার প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছিলো। প্রথমত এই কয়দিন রাতে ঘুম হয়নি বিছানা বদলানোর জন্য। দ্বিতীয়ত এতোটুকু পথ গাড়ি চালিয়ে এলাম শরীরও ভালো লাগছিলো না। তুমি তো পুরো পথ আমার কাধে মাথা রেখে ভসভস করে ঘুমালে। আমার তো এদিকে নিজেকে মাতাল মাতাল লাগছিলো। তারউপর রুমে ঢুকেই প্রথমে তোমার মুখের ওই এক প্যানপ্যানানি শুনে দিয়েছি হালকা একটা ধমক! তাতেই তুমি আমার জীবন ওষ্ঠাগত করে ছাড়ছো!’
সব কথা ডিঙিয়ে দুষ্টু ভ্রু কুচকে প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে বলে,
‘হালকা ধমক? আর আমি আপনার কাধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছি?’
‘হ্যাঁ! কাধ’টা এখনো ব্যথা করছে। তোমার মাথার ওজনও বাপরে বাপ! একশো কেজি ওজন। পুরো দুই ঘন্টা ছিলে। পরে টিয়া সরিয়ে দিয়েছে।’
দুষ্টু চোখ রাঙিয়ে তাকালো। অস্ফুটে বলল,
‘আপনার সাথে আর কোথাও কখনো যাবো না।’
প্রচ্ছদ ঠোঁট ফাঁকা করে হাসলো,
‘এটুকুতেই…? গ্রামে প্রতিরাত আমাকে জড়িয়ে আমার উপর হাত-পা তুলে ঘুমিয়েছো।’
দুষ্টুর চোখ দুটো রসগোল্লার মতো হয়ে গেলো। লজ্জায় কান দুটো লাল হয়ে উঠলো। ছি ছি ছি! এই ছাব্বিশ বছরে এসেও বাচ্চাদের মতো হাত পা তুলে দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে? দুষ্টু মিনমিনে স্বরে বলল,
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ! নেহাত আমি ভদ্র ছেলে! তাই কিছু করিনি। অন্য কোনো ছেলে হলে তো তোমার সাথে…….
দুষ্টু তড়িৎ বেগে প্রচ্ছদের মুখে হাত রাখলো। প্রচ্ছদ থেমে গেলো। দুষ্টু সামনের ছোট চুল গুলো বারংবার উড়ে ওই সুন্দর বদনের উপর পরলো৷ অন্ধকার ঘর তখন মৃদু আলোয় সজ্জিত ছিলো। প্রচ্ছদ অনেকক্ষণ ক্ষীণ দীপ্তি’তে দৃশ্যমান সামনের মনোহর রমণীর দিকে চেয়ে রইল। দুষ্টু আস্তে করে প্রচ্ছদের ঠোঁটের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিলো। তৎক্ষণাৎ প্রচ্ছদ দুষ্টুর হাত তৃষ্ণার্তের ন্যায় থাবা দিয়ে ধরলো। অবশ কন্ঠে বলে উঠলো,
‘আপনি কেনো আমার হয়ে থাকতে চান না?’
আকস্মিক বাক্যের কোনো উত্তর খুঁজে পেলো না দুষ্টু। ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ঠোঁট চেপে ধরলো। কান্না পাচ্ছে ভীষণ! এই শেষ মূহুর্ত গুলোয় এসে প্রচ্ছদ এমন পাগলামি কেনো করছে?
‘বাড়ি যান।’
‘যাবো না। শেষ’বারের মতোন শশুড় বাড়ির আদর যত্ন খেয়ে যাই।’
বলতে বলতে প্রচ্ছদ বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। দুষ্টু ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করে, ‘কখন এসেছেন আপনি?’
‘রাত আট’টায় ।’
‘ওহ! কালকে কিন্তু রিপোর্ট নিয়ে কোর্টে যাবেন।’
‘আর তুমি আমার সাথে হক মঞ্জিলে যাচ্ছো।’
‘আমি অবশ্যই যাচ্ছি না।’
‘তুমি অবশ্যই যাচ্ছো।’
মায়ের ডাক পড়ায় দুষ্টু আর কথা বাড়ালো না। মায়ের সাথে কথা বলে ফিরে এসে দুষ্টু বলল,
‘চলুন। খেতে ডাকছে।’
‘খাবার নিয়ে আসো।’ ফোন চাপতে চাপতে উত্তর প্রচ্ছদের।
দুষ্টু চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
‘আসবেন নাকি? আমি ঘরে খাবার নিয়ে আসতে পারবো না এখন।’
‘গো ফার্স্ট!’
‘প্রচ্ছদ, আই এম টায়ার্ড!’ দুষ্টুর অসহায় গলা।
‘তুমি নিয়ে আসবে নাকি আমি আন্টিকে গিয়ে বলবো?’
দুষ্টু দাঁত কিড়মিড় করে গেলো। এই লোক একটা বেত্তমিজ। দুষ্টু ঘরে একটা প্লেটে খাবার নিয়ে আসলো। প্রচ্ছদের সামনে ধরতেই প্রচ্ছদ ফোনে গেমস খেলতে খেলতে বলল,
‘খাইয়ে দেও প্লিজ।’
দুষ্টু মৃদু চিৎকার দেয়, ‘কিহ?’ এরপর দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘আপনি ফোনে গেমস খেলবেন আর আমি খাইয়ে দেবো? ‘
প্রচ্ছদ ডান হাত বাড়ালো। কপালে ভাঁজ ফেলে পাত্তাহীন বিরক্তির চোখে হাতের দিকে তাকাতেই দুষ্টুর আত্মা ধক করে উঠলো। চাপা মৃদুস্বরে বলে উঠলো,
‘হায় আল্লাহ! হাতে ব্যথা পেয়েছেন কীভাবে?’
‘ঘুষিয়ে।’
দুষ্টু সরু চোখে তাকায়। বস্তুত দুষ্টু চলে আসার পর প্রচ্ছদের এতো খারাপ লাগছিলো.. নিজের উপর এতো রাগ জেদ হচ্ছিলো যে কি করবে বুঝতে পারছিলো না। পরে আর কি? ভেতরের জ্বালা মেটাতে দেয়ালে অনেকবার ঘুষিয়েছে। যারফলে, হাত ফুলে লাল হয়ে ঢোল। রক্তাভ হয়ে আছে। জায়গা’টায় ব্যথা প্রচন্ড! দুষ্টু শুনে বললো,
‘শরীরে শক্তি বেশি হয়েছে? মুখের শক্তিও বেশি আর শরীরের তো মাশাল্লাহ্! ইশশ… জখম হয়ে গেছে একদম।’
‘দুপুরেও খাইনি। দিবে নাকি?’
বড় করে শ্বাস বুকে টেনে নিয়ে দুষ্টু ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিতে দিতেই প্রচ্ছদ প্রশ্ন করলো,
‘সারাদিন খাও নি কেনো?’
‘জানলেন কীভাবে?’
‘ম্যাজিক।’
‘আম্মু বলেছে নিশ্চয়ই।’
‘খাও নি কেনো?
‘শ্রেয়সীর বাসায় খেয়েছি।’
‘বিশ্বাস করলাম না।’
‘তাতে আমার কি?’
‘কি লাভ বলো তো এতো অভিমান করে? সেই তো আমাকে ছাড়া নাওয়া, খাওয়া পর্যন্ত ভুলে যাও।’
দুষ্টু ভেংচি কাটে, ‘ভুলে যাই না। ইচ্ছে করেনি।’
‘সেটাই তো। আমার সাথে ঝগড়া হয়েছে বলেই তো ইচ্ছে করেনি। তুমি আমাকে ছাড়া থাকবে কীভাবে?’
দুষ্টু প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না। চুপচাপ লোকমা তুলে দিলো। প্রচ্ছদের ঠোঁটের সাথে বারংবার ওর আঙ্গুলের স্পর্শ লাগছে আর বারবারই দুষ্টুর শরীর বেয়ে হীম স্রোত বয়ে যাচ্ছে। পেটের ভেতর কেমনতর যেনো অস্বস্থি! ও কোনোদিন নীড়কেও খাইয়ে দেয়নি। আসলে, খাইয়ে দেওয়ার মতো কখনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। প্রচ্ছদ খেতে খেতে বলে,
‘ডিভোর্সের পর আমাকে ভুলে যাবে?’
দুষ্টু এবারও উত্তর দিলো না। প্রচ্ছদ আবার প্রশ্ন করে,
‘তোমার বয়ফ্রেন্ড কে ভুলে যাবে?’
দুষ্টু অযত্নে বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। ভাত মাথা থামিয়ে নিবিড় দৃষ্টিতে প্রচ্ছদের চোখের দিকে তাকালো। চার’টি চোখ এক হলো। দু’টো হৃদয়ের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো।
‘ওর নাম রঙ পেন্সিল দিয়ে লিখেছিলাম। মুছতে গিয়ে বরং লেপ্টে যাচ্ছে। আর আপনার’টা লাল কালি। ঘষতে ঘষতে খাতা ছিড়ে যায় তবুও এক বিন্দু পরিমাণ মোছে না।’
প্রচ্ছদ একদৃষ্টিতে চেয়ে বলল, ‘তাহলে ছেড়ে যাচ্ছো কেনো?’
‘ওকে ছেড়ে দিলাম কেনো?’ প্রচ্ছদের মুখে লোকমা তুলে দিয়ে দুষ্টু পাল্টা প্রশ্ন করে।
‘আমার জন্য। কিন্তু আমাকে ছাড়বে কার জন্য?’
‘নিজের জন্য।’
প্রচ্ছদ থমকে গেলো। দুষ্টুর দিকে স্থির নজর তাক করলো। দুষ্টুর চোখের কোণায় পানি! কি আশ্চর্য! প্রচ্ছদের কথায় আজ বারবার তার চোখে পানি আসছে। দুষ্টু ওর চোখের কোণা’টা আলতো করে কনুই দিয়ে মুছে মুখে মেকি হাসি ঝুলিয়ে প্রসঙ্গ এড়াতে বলল,
‘আমি চলে গেলে আমার সাথে যোগাযোগ রাখবেন না?’
প্রচ্ছদ সময় নিলো না উত্তর দিতে, ‘কক্ষনো না।’
দুষ্টুর বুক’টা ভেঙে এলো। ঠোঁট কামড়িয়ে অনেক কষ্টে জিজ্ঞেস করতে পারলো,
‘কেনো? আমাকে ভুলে যাবেন?’
‘প্রাণ থাকতে না। তোমাকে ভুলতে আমার অনেক কষ্ট হবে। অপার্থিব।’
চলবে
#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৫২
১০৬.
ভোর সাড়ে ছ’টায় বাসার কলিং বেলের উপর যুদ্ধ শুরু হলো! প্রযুক্ত ঘুম ঘুম চোখে আলসে পায়ে হেটে এলো। বিরক্তিতে কপাল কুচকে উঠেছে। ঘড়িতে একবার চোখ বুলাতেই মেজাজ সপ্ত আসমানে চড়লো। মারকুটে ভঙ্গিতে সে দরজা খুললো। যেই হোক তার একটা দফারফা করেই ছাড়বে৷ এমনিতেই কাল রাতে সে ঘুমিয়েছে তিন’টায়। দরজা খুলেই প্রযুক্ত বেখেয়ালে একবার চেয়ে পরক্ষণেই বিদ্যুৎ এর ন্যায় ঝলকানো দৃষ্টি ফেললো। আতঙ্কে মুখ হয়ে উঠলো সাদা। একটানে শ্রেয়সী’কে ভেতরে এনে সজোরে বন্ধ করলো দুয়ার। প্রযুক্ত ভীতিগ্রস্ত হয়ে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইল এই নিঃশঙ্ক মেয়ের দিকে। শ্রেয়সী তখন খিলখিল করে হাসছে। ভাগ্যিস বাসায় প্রযুক্ত’র বাবা-মা নেই। ত্রস্ত কন্ঠে শুধালো,
‘এতো সকালে আমার বাসায় কি করছেন? সাহস তো কম না আপনার!’
শ্রেয়সী পায়ে পায়ে হেটে প্রযুক্তর ঘর খুঁজে নিলো। ওর বিছানা গুছিয়ে দিলো। এদিক সেদিক পরে থাকা কাগজগুলো জড়ো করে ভাঁজ করে রাখলো। জানালা-দরজার পর্দা এটে দিলো সুন্দর করে যেনো এক ফোঁটা সূর্যের কিরণ না ঢোকে। প্রযুক্ত ওর পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলো। শ্রেয়সী হাতের কাজ শেষ করে মাথা এলিয়ে দিলো প্রযুক্তর বুকে। প্রযুক্ত পেছন থেকে শ্রেয়সীর থুতনি উঁচু করে ওর কপালে চুমু খেলো। ভরাট স্বরে শুধালো,
‘ঠোঁটেও দেই?’
‘দিন।’
বলেই শ্রেয়সী হাসতে হাসতে সরে যায়। প্রযুক্ত ভ্রু কুচকে বুকে হাত আড়াআড়ি ভাঁজ করে বলে,
‘দেখুন তো, আজ সূর্য কোন দিকে উঠলো?’
শ্রেয়সী আবার হাসলো। প্রযুক্ত বলল,
‘যদি বাবা-মা বাসায় থাকতো?’
‘নেই বলেই তো এলাম।’
‘কেনো?’
শ্রেয়সী ঠোঁট উল্টে আহ্লাদী গলায় বলে,
‘মিস করছিলাম তো। দেখুন মাত্র তিন ঘন্টা ঘুমিয়েছি এক্সাইটমেন্টে। চোখ-মুখ ফুলে আছে না আমার? আমাকে ঘুম পাড়ান না!’
প্রযুক্ত বদ্ধ ঠোঁটে সামান্য হাসলো,
‘আগে থেকেই প্ল্যান করা হয়েছে তবে!’
শ্রেয়সী লাজ মিশ্রিত হাসি দিলো। কথায় কথায় প্রযুক্ত কাল রাতে বলেছিলো যে ওর বাবা মা বাসায় নেই।
শ্রেয়সী প্রযুক্তর গলা দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে। প্রযুক্তও ওর কোমড়ে নিজের ঠান্ডা হাত দুটো রেখে জিগায়,
‘এতো খুশি কেনো, আপনি?’
শ্রেয়সী প্রযুক্তর গেঞ্জির বাটনে খোঁচাখোঁচি করতে করতে প্রমোদিত কণ্ঠে বলতে লাগলো,
‘কাল দুষ্টু আমার বাসায় এসেছিলো।’
‘ওওও.. এরজন্যই আমার বেগম এত্তো খুশি?’
শ্রেয়সী আবার হেসে মাথা ঝাঁকালো। ওর এত্তো আনন্দ লাগছে…..! এমন আমোদ বহুদিন লাগেনি। দুষ্টু যখন এলো শ্রেয়সী তো অবাক। বিস্ময় নিয়ে আহাম্মকের মতোন দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলো। দুষ্টু বিরক্তিকর চোখে তাকিয়ে ওকে ঠেলেঠুলে ঘরে ঢুকে পরলো। চেঁচিয়ে শ্রেয়সীর মা’কে ডেকে বলে উঠলো,
‘আন্টি? কোথায় তুমি? তাড়াতাড়ি আমার জন্য স্পেশাল এক কাপ কফি আর নুডলস বানিয়ে নিয়ে এসো আর দেখে যাও আমি তোমার জন্য ছোট ফুচকা আর চটপটি নিয়ে এসেছি।’
শ্রেয়া ভেতর থেকে দুষ্টুর গলা শুনে দৌড়ে বেরিয়ে এসে উচ্ছ্বাসে জড়িয়ে ধরলো। সেই প্রায় তিন মাস আগে দুষ্টু এ বাসায় এসেছিলো। দুষ্টু বেশ আদর-টাদর করে শ্রেয়ার হাতে ফুচকা, চটপটি ধরিয়ে দিলো। শ্রেয়া চলে যেতেই শ্রেয়সী শান্ত, ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এলো। সজল চোখে হঠাৎ দুষ্টুর দু’গালে হাত রাখলো। ভাঙা ভাঙা গলায় উচ্চারণ করলো,
‘আমি…. তোকে একটু জড়িয়ে ধরি?’
শ্রেয়সীর বাচ্চামো আবদারে আকস্মিক দুষ্টু ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলো। শ্রেয়সী’কে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো। সেই ছোটোবেলার বন্ধু তারা। কলেজ’টা শুধু ভিন্ন ছিলো তাদের বাকি পুরোটা সময় একসাথে। কিছু ক্ষুদ্র, খুচরো ভুল বোঝাবুঝি’তে এতো দূরে তারা কখন কীভাবে চলে গেলো? শ্রেয়সী দুষ্টুর গালে চুমু খেলো। দুষ্টু আলতো করে গোপনে শ্রেয়সীর চুলের ভাজে চুমু খেয়ে বলল,
‘ছিহ! তোর এই স্বভাব যাবে না? আমাকে চুমু দিবি না।’
শ্রেয়সী ক্রন্দনরত চোখে হাসে,
‘কেনো? চুমু দেওয়ার অধিকার কি শুধু ভাইয়ার? আমার অধিকার শেষ?’
দুষ্টুর হাসি মিলিয়ে গেলো তবুও অনেক কষ্টে ফিরিয়ে আনলো। শ্রেয়সীর ঘরে গিয়ে বসে দু’জন নিজেদের জমানো অনেক কথা বললো। উচ্চস্বরে হাসলো। তর্কাতর্কি করলো। দু চারটে চর থাপ্পড় মারলো একজন আরেকজনের গায়ে। প্রথম থেকে আবারো সব শুনলো শ্রেয়সী। এবার মনোযোগ দিয়ে শুনে মস্তিষ্ক দিয়ে যা বুঝলো তাতে আদতে কারোর-ই কোনো দোষ নেই। এরমধ্যে শ্রেয়সীর মা এসে কফি আর নুডলস দিয়ে গেলেন। কফি’তে চুমুক দিয়ে শ্রেয়সী প্রশ্ন করলো,
‘ফাইনাল ডিসিশন এটাই তুই ভাইয়াকে ডিভোর্স দিবি’ই?’
দুষ্টু কথা না বাড়িয়ে প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট বের করে দেখালো৷ শ্রেয়সী ভ্রু কুচকে তাকিয়ে ক্ষীণ হাসলো,
‘আটঘাট বেঁধে নেমেছিস একদম।’
‘আমি চাই যাতে আর কোনোদিন নীড়ের মুখোমুখি হতে না হয়।’
‘খুব চাইল্ডিশ হয়ে গেলো না কথাটা? তোর সব দিক ভাবা উচিত। একটা সম্পর্কে হুট করে জড়িয়ে পরলি আবার হুট করে এক নিমিষে ভেঙে দিবি?’
‘হুট করে ভাঙছি না তো। এটা তো প্রথম থেকেই বলা। বিয়ের রাত থেকে।’
দুষ্টু নুডলসের বাটি’টা হাতে নিলো। শ্রেয়সী কফিতে চুমুক দিয়ে ভাবপ্রবনতা বজায় রেখে বলল,
‘আমি যতটুকু প্রযুক্তর মুখে শুনেছি উনি তোকে ভীষণ ভালোবাসেন।’
শ্রেয়সী ভেবেছিলো এই কথায় দুষ্টু প্রতিক্রিয়া দেখাবে। বড় বড় চোখ মেলে চাইবে। বজ্রাহত হবে। কিন্তু তার কিছুই হলো না। উল্টে দুষ্টু বলল,
‘জানি এবং অনেক আগে থেকে।’
উল্টে শ্রেয়সী বজ্রাহতের ন্যায় তাকালো। বস্তুত শ্রেয়সী’কে সবকথাই প্রযুক্ত বলে দিয়েছে দুষ্টুকে একটু বোঝানোর জন্য। এদিকে দুষ্টু কিছুই হয়নি এমনভাবে বলল,
‘কি হলো? অবাক হচ্ছিস কেনো? উনার ডায়েরি পড়ে জেনেছি।’
শ্রেয়সী আস্তে করে বলল, ‘ভেরি বেড।’
দুষ্টু মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘আই নো দ্যাট।’
‘একটু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা কর না! ভাইয়াকে একটু ভালোবাসলে কি হয়?’
দুষ্টু খেতে খেতে বিজ্ঞ গলায় বলল,
‘একা মানুষ ক’জনকে ভালোবাসবো, আমি? জীবনে তো কত মানুষ আমাদের ভালোবাসে! কতজনে প্রপোজাল দেয় সবার’টা কি এক্সেপ্ট করি? সবাইকে কি ভালোবাসি? এইতো কিছুদিন আগে নীড়ের হয়ে তো কত ইমোশনাল ডায়লগ ছাড়লি, আমার সাথে যা-তা করলি এখন আবার প্রচ্ছদের হয়ে। তোরা তো ভন্ড রে! ভালোবাসা কি এতো সস্তা? এতো তাড়াতাড়ি হয়ে যায়?’
শ্রেয়সী কিছু বললো না। দুষ্টু খানিকটা রেগেই বলে,
‘উনি অপরাধ করেছেন আমাকে জোর করে বিয়ে করে। ভালোবাসে বলেই জোর করতে হবে?’
‘তার শাস্তি কি সে পাচ্ছে না? ভালোবাসার মানুষ’টা থেকে ভালোবাসা না পাওয়ার চেয়ে বড়, নির্দয়, নির্মম শাস্তি কি এই দুনিয়ায় আছে?’
‘নেই। কিন্তু উনার উচিত ছিলো প্রথমেই এপ্রোচ করা। যে লোক নিজের ভালোবাসার কথা বলতে পারে না অথচ জোর করে ছিনিয়ে নেয় তার অবশ্যই এই দহন প্রাপ্য।’
দুষ্টু আবার বললো আনমনা কন্ঠে,
‘কিন্তু জানিস ইদানীং উনাকে খুব ডেস্পারেট লাগে। ভীষণ অসহায় লাগে। উনি উনার ভালোবাসা প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। আমার টেককেয়ার করেন। আমাকে ভালোবাসেন….!’
কথা বলতে বলতে দুষ্টুর গলার আওয়াজ ক্রমেই নিচু হয়ে এলো। কেমন অপ্রকৃতস্থ স্বপ্নময় গলা শুনালো। শ্রেয়সী বলল,
‘সম্পর্ক’টাকে শুধু শুধু নষ্ট করিস না। দেখবি আস্তে আস্তে সবাই সবার পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে যাচ্ছে অথচ মাঝখান থেকে তুই ছিটকে যাবি। আমি বলছি, আরেকটু টাইম নে। ডিভোর্স এর সময় আরেকটু পিছিয়ে দে।’
খাওয়ায় মনোযোগ দিয়ে দুষ্টু পাত্তাহীন গলায় বলে,
‘যা হবার তা এই তিন মাসের মাঝেই হয়েছে, হবে। আর যা হবার নয় তা অনন্তকালেও সম্ভব নয়। যা নয়ে হয় না তা নব্বইয়েও হবে না।’
,
কেটে-বেছে, নীড়ের কথা এড়িয়ে যতটুকু বলা যায় ততটুকু শ্রেয়সী বলল। প্রযুক্ত সব শুনলো। ঠোঁট চেপে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘আল্লাহ জানে প্রচ্ছদের কপালে কি রয়েছে! দুষ্টু যদি ওকে ছেড়ে চলে যায়, ও নির্ঘাত মরে যাবে।’
‘হুম। টিয়া আর নীড়ের খবর নিয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ। টিয়ার রেসাল্ট বেরিয়েছে। আমিই নীড়কে ফোন দিয়ে জানিয়েছি। নীড় আজকে থেকে টিয়াকে সকাল সন্ধ্যা পড়তে বসাবে, রান্না শেখাবে। সেই সাথে ইচ্ছেমতো বকা দিয়েছে। টিয়া একটু কানে ব্যাথা পেয়েছে বুঝেছো নীড় সেটাও ফোনে আমাকে কয়েক হাজার বার বললো, ‘কেয়ারলেস মেয়ে একটা! নিজের খেয়াল রাখতে পারে না। শুধু সারাক্ষণ ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কান্নাকাটি করে।’ নীড়ের উৎকন্ঠা দেখে আমার মনে হলো খুব শীঘ্রই ওদের সম্পর্ক’টা স্বাভাবিক হবে। আসলে অল্প বয়সে দুজনের অমতে বিয়েটা হলো তো তাই দুইজনের নরমাল হতে একটু সময় লাগছে।’
শ্রেয়সীর হিসেবের চাকা উল্টোদিকে ঘুরছে। ও ভেবেছিলো নীড় তার লাইফ’টা আর কন্টিনিউ করতে পারবে না কিন্তু দুষ্টু দিব্যি হেসে খেলে চলে যাবে। অথচ এদিকে দেখছে দুষ্টুর লাইফ’টা থমকে দাঁড়িয়েছে বিবেক নামক দংশনের যাতাকলে। ওদিকে নীড় চলছে নতুন দিগন্তের সূচনা লগ্নের প্রচেষ্টায়। প্রযুক্ত ফ্রেশ হয়ে এলো। শ্রেয়সীর উন্মুক্ত কাধে হালকা হাত ছুইয়ে দিতেই শ্রেয়সী চমকে লাফিয়ে সরে দাড়ালো।
‘মানুষের হাত নাকি সাপের? এতো ঠান্ডা কেনো?’
প্রযুক্ত হেসে দুষ্টুমি করে শ্রেয়সীর গালে, গলায় হাত চেপে ধরে। শ্রেয়সী এক দৌড়ে বিছানার অপরপাশে গিয়ে দাড়ায়। এরপর কম্বল মুড়িয়ে বিছানায় বসলো। প্রযুক্ত জিজ্ঞেস করলো,
‘খাবেন কিছু?’
শ্রেয়সী মাথা নেড়ে না করলো। হাতের ইশারায় প্রযুক্তকে ডেকে খাটে হেলান দিয়ে বসিয়ে আধশোয়া হয়ে প্রযুক্তর চওড়া বুকে মাথা ঠেকালো।
‘ঘুমাবো আমি।’
প্রযুক্ত ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কানে ফিসফিস করে বলে,
‘তখন তো ব্রাশ করিনি তাই ছেড়ে দিয়েছিলাম এখন ঠোঁটে চুমু দেই?’
চলবে❤️
#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৫৩
‘তখন তো ব্রাশ করিনি তাই ছেড়ে দিয়েছিলাম এখন ঠোঁটে চুমু দেই?’
প্রযুক্তর ফিসফিস শ্রেয়সীর কানে ফসফস ধ্বনি তুললো। লজ্জায় কান লাল হয়ে উঠলো। প্রযুক্ত অনুরক্ত কন্ঠে মাদক ঢেলে অনুরোধ করলো,
‘প্লিজ….!’
‘না! চুপ করুন!’
‘একটা। শুধু একটা! আর কক্ষনো চাইবো না।’
প্রযুক্তর এমন আকুতি ভরা নয়ন আর কন্ঠে শ্রেয়সী নিজেকে নকল কঠোরতার চাদরে মুড়িয়ে রাখতে পারলো না। কোমল হলো! এরপর কেউ কারোর কথা শুনলো না। শুনলো শুধু অবাধ্য দুই জোড়া ঠোঁট! একে অপরের সাথে কীভাবে যেনো চুম্বকের মতো জোড়া লেগে গেলো। সেই চুম্বকের চুম্বনের জলের ছটা গড়ালো অনেক দূর অবধি। যত দূর অবধি গড়ালে সম্পূর্ণ কায়া একে অপর’কে ছুয়ে দেয়। শ্রেয়সীর গতরের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে গেলো প্রযুক্তর সুগন্ধ! বন্ধনহীন উন্মত্ততায় প্রযুক্তর বিচরণ ঘটলো এই রজনীকান্ত সদৃশ অঙ্গনার গাত্রে!
১০৭.
ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছে টিয়া। শীতের দাপটে প্রায় জমে যাওয়ার যোগাড়। বাইরের কুয়াশার ঘন ধূম্রজালে এক মিটার দূরের কিছুও আবছা। চোখ কচলিয়ে ফ্লোরে একবার পা দিয়ে একটু ছুঁইয়ে ওমনি আবার এক ছুটে ভারী কম্বলের নিচে ঢুকে পরলো। হাত দুটো ঘষতে ঘষতে নীড়ের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
‘অসম্ভব। এই ঠান্ডায় সকাল সাত’টায় আমি কম্বল ছেড়ে উঠে মরে যেতে পারবো না।’
নীড়ের হাতে স্কেল। গম্ভীর মুখে টিয়ার বইয়ে চোখ বুলিয়ে বলল,
‘এখন সাড়ে সাত’টা বাজে। মরবে না। উঠো।’
‘তুমি জানো পানি কত ঠান্ডা?’
‘জানি। তোমার জন্য গরম পানি করে রেখেছি। যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। হারি আপ!’
‘নীড় ভাইয়া, প্লিজ!’
‘কোনো প্লিজ টিজ নেই। গো ফার্স্ট! নাহলে কিন্তু টিয়া স্কেলের মাইর একটাও মাটিতে পরবে না।’
টিয়া চোখ মুখ কুচকে তাকালো। আষ্ঠেপৃষ্ঠে শরীরে শাল’টা জড়িয়ে নিয়ে ফ্লোরে আবারো আগের ন্যায় হালকা একটু পা ছুঁয়ে ওমনি কম্বলের নিচে ঢুকলো। তৎক্ষণাৎ নীড় ওর মাথায় জোরেসোরে টোকা দিলো। টিয়া মাথায় হাত ঘষে দু’মিনিটে ফ্রেশ হয়ে এলো। অসহায় গলায় বলল,
‘বিছানায় বসি? টেবিলে বসবো না। চেয়ার ঠান্ডা।’
নীড় মেনে গেলো, ‘আচ্ছা। বসো।’
টিয়া ভ্রু কুচকে বললো, ‘তুমি ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের হয়ে ম্যাথ ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট পড়াবে?’
নীড় কড়া চোখে তাকালো,
‘না পারলে তোমার জন্য টিচার নিয়ে আসবো। এখন এই ম্যাথগুলো করো জলদি।’
টিয়ার ম্যাথগুলো করতে করতে নয়’টা বাজলো। একটানা বসে থেকে নীড়ের কোমর লেগে গেছে সেই কখন তবুও সে একফোঁটা নড়লো না। তার কাজ হচ্ছে টিয়াকে কোনোমতে পড়তে বসানো। সে নিশ্চয়ই অন্য ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট পড়াতে পারবে না। কিন্তু মেয়েটা পড়তেই বসতে চায় না। একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নীড় বলে উঠলো,
‘শেষ?’
টিয়া উপর-নিচ মাথা ঝাঁকায়। নীড় ওর বই খাতা গুছিয়ে দিয়ে বলে,
‘বইগুলো যথাস্থানে রেখে কিচেনে এসো। ব্রেকফাস্ট রেডি করবো।’
টিয়ার একচোটে উত্তর, ‘আমি পারবো না।’
নীড় যেতে যেতে বলে গেলো,
‘আমাকে যদি দ্বিতীয়বার ডাকতে হয় তবে বারান্দায় আটকে রাখবো তোমায়৷ উইদাউট এনি সোয়েটার অর শাল।’
টিয়া চোখ বড় বড় করে নীড়’কে ভয়ংকর একটা গালি দিলো। নীড় রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল,
‘আমি শুনতে পারছি। আসবে নাকি আমি গিয়ে নিয়ে আসবো? আমি এলে কিন্তু খুব খারাপ হবে।’
টিয়া ঠোঁট উলটে বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। কপাল চাপড়ে বলে উঠলো,
‘এ কার পাল্লায় পরলাম আমি?’
রান্নাঘরে প্রবেশ করতেই দেখলো নীড় আটা’র প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে। টিয়া আলসে পায়ে হেটে গেলো। নীড় একটা স্টিলের বোল ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
‘আমি যেভাবে বলছি সেভাবে রুটি বানাবে।’
কিন্তু টিয়া এই পানি বেশি দিলো তো এই আটা কম দিলো! আটা মাখতে মাখতে আবার হাত লেগে এলো! ঠান্ডায় দাঁতে দাঁত লেগে নীড়ের সাথে কতক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করলো। অনেক চড়াই-উতরাই পার করে রান্নাঘর আটা দিয়ে সাজিয়ে সাদা বানিয়ে নিজের বারোটা বাজিয়ে টিয়া আটা মেখে একটা আধা পার্ফেক্ট ডো তৈরি করলো। রুটি বেলতে গিয়ে দেখা গেলো বেলা তো দূরে থাক টিয়া একটুখানি আটার দলা নিয়ে ঠিকমতো গোল-ই করতে পারছে না। নীড় ভ্রু কুচকে দাঁড়িয়ে ছিলো। অতি ধৈর্য্যে এই মেয়ের কাজকর্ম দেখে গেলো সে। অবশেষে না পেরে বলল,
‘গোঁয়ার দেখেছি। গাধা দেখেছি। তোমার মতো এতো গোঁয়ার-গবিন্দ, ব্রেইনলেস মেয়ে আর একটাও দেখিনি। এগুলা কোনো কাজ? চোখের দেখায় পারা যায় আর সেই কাজের পঁচিশ মিনিট ধরে শুধু আটা-ই মাখলে। এতোক্ষণে ২৫ জন মানুষের রুটি বেলে ভেজে খেয়ে ফেলা যেতো।’
টিয়া গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নীড় ছো মেরে ওর হাত থেকে আটার দলা নিয়ে হাতের তালুতে সুন্দর করে গোল সেইপ করলো।
‘এবার বেলো।’
টিয়া ভ্রু নিচু করে অসহায়যোগে বলল,
‘আমি পারবো না।’
নীড় নরম হলো,
‘পারবে। চেষ্টা করো। না পারলে আমি আছি!’
টিয়া চেষ্টা করলো। একবার দু’বার কয়েকবার! কিচ্ছু হলো না। সব হযবরল হয়ে গেলো। টিয়া মনঃক্ষুণ্ন হলো। হতাশ গলায় বলে উঠলো,
‘আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। আ’ম গুড ফর নাথিং। আ বিগ জিরো।’
নীড় বড় একটা নিশ্বাস নিজের বুকের মাঝে টেনে নিলো। এরপর টিয়ার পেছনে দাঁড়িয়ে ওর দু’হাতের উপর নিজের দু’হাত রাখলো। টিয়া পিলে চমকে উঠলো। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার নীড়ের দিকে তাকালো। নীড় ওর খুব কাছে। নিশ্বাসে নিশ্বাসে বাড়ি খেলো। টিয়া লজ্জায় আড়ষ্ট হলো। ইতিমধ্যে সে আটায় মাখামাখি। যেনো যুদ্ধ করেছে। চুলের উপর এমনভাবে আটা লেগেছে যেনো চুলে পাক ধরেছে। নীড় শব্দ করে হেসে চুলে ফু দিলো। আটা গুলো বাতাসে উড়ে মিলিয়ে গেলো। টিয়া হাতের বেলনটাকে আরো শক্ত করে চেপে ধরে। শ্বাস-প্রশ্বাসে তার ভারী শব্দ! বড় বড় দম নেওয়া! বুকের ক্রমশ উঠা-নামা! নীড় আস্তে আস্তে টিয়ার হাত চালালো। বেলন চললো। ছয় মিনিটের মাথায় সুন্দর গোল রুটি হয়ে গেলো। টিয়া সেদিকে তাকিয়ে উৎফুল্লে বলল,
‘ওয়াও…… জীবনের প্রথমবার’ই আমি এতো সুন্দর রুটি বেলে ফেলেছি?’
নীড় ভ্রু উঁচু করে এমনভাবে তাকালো…টিয়া দাঁত বের করে হেসে দিয়ে বলল,
‘তোমার সাপোর্টে!’
‘চলো বাকিগুলো তাড়াতাড়ি শেষ করো।’
টিয়া আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি কি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবে?’
নীড় চোখ ছোট ছোট করে তাকায়, ‘কোনভাবে?’
টিয়া বিরবির করে,
‘এইযে আমার সাথে লেগে।’
নীড় যেন শুনলো। গম্ভীর মুখে বলল,
‘ইচ্ছে করে লেগে দাড়াইনি! পারছিলে না, দেখিয়ে দিচ্ছিলাম।’
বলেই নীড় সরে দাড়ালো। টিয়া ঠোঁট উল্টালো। নীড় রাগে মুখ ঘুরিয়ে রান্নাঘরের ছোট্ট জানালার বাইরে চোখ ফেললো। টিয়া হালকা হাতে এক দু’বার চেষ্টা করলো। অতঃপর নীড়ের দিকে তাকালো অথচ নীড় চোখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলো না। হাল ছেড়ে দিয়ে টিয়া অস্ফুটে বলে উঠলো,
‘আর দুই একবার দেখিয়ে দিলেই কিন্তু আমি পেরে যাই। বাচ্চা মানুষ দু’চারটে কথা ভুলে বলে ফেলতেই পারে। তাই বলে এতো রাগ দেখাতে আছে?’
নীড় ঠোঁট চেপে হাসলো। কিন্তু এগিয়ে এলো না। টিয়া পেছনে ঘুরে কোমল সুরে বলল,
‘সরি তো রে বাবা! প্লিজ হেল্প মি নাও!’
নীড় এগিয়ে এলো। বিদ্রুপ করে বলল,
‘তোমার শরীরের সাথে লেগেই দাড়াবো?’
টিয়ার কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো। চোখ খিচে বন্ধ করলো। নীড় আগের ন্যায় পেছনে দাঁড়িয়ে টিয়ার হাতের উপর হাত রাখতেই শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে গেলো৷ এইমুহূর্তে এই রান্নাঘরে টিকে থাকা দায়! নীড় ধীরে ধীরে চার’টে হাত চালিয়ে বলে উঠলো,
‘আজ বোধহয় সকালের খাবার দুপুরে খেতে হবে।’
চলবে❤️