এমন একদিন সেদিন পর্ব-৫৮

0
1

#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৫৮
১১৬.
দুষ্টু প্রচ্ছদের ডিভোর্সের বাকি আর মাত্র দু’দিন তন্মধ্যে প্রযুক্ত শ্রেয়সীর গোপন বিয়ের ব্যাপারে সবার জানাজানি হয়ে গেছে। বাবা-মাকে রয়েসয়ে বুঝিয়ে শ্রেয়সীকে ঘরে তোলার জন্য সবকিছু ঠিকঠাক করতে হয়েছে ইরাকে। এ মাসের ৩০ তারিখ শ্রেয়সী’কে উঠিয়ে আনা হবে। এতোসব ঝক্কি-ঝামেলার মাঝে ইরার আচমকা ব্লিডিং হতে শুরু করলো। ঘটনা’টি ভূমিকম্পের ন্যায় বাড়িসুদ্ধ সবাইকে নাড়িয়ে দিয়ে গেলো। ইরার প্রায় সাড়ে চারমাস ছুই ছুই। প্রযুক্তর বিয়ের জন্য দু-তিন দিন এ বাড়ি ও বাড়ি করতে হয়েছে। শ্রেয়সীর বাসায়ও যেতে হয়েছে। এতো ধকল সইতে না পেরে এই অনাকাঙ্ক্ষিত আকস্মিক দুর্ঘটনাটি ঘটে গেলো।

ব্লিডিং শুরু হয়েছে সকাল সাত’টায়। ব্লিডিং হালকা গাঢ় হতেই ইরা ত্রস্ত পায়ে অপরাধী ভঙ্গিতে সিড়িন হক’কে গিয়ে জানালো সকাল নয়’টায়। ঝড়ের বেগে কথা’টা অর্জনের কানে চলে গেলো। সকাল দশ’টার মধ্যেই ওরা ডাক্তারের কাছে রৌনা হলো। ইরা যেন মূখ বনে গেছে। ফ্যালফ্যাল করে শুধু চেয়ে-ই আছে। মন-মস্তিষ্কে ঘুরছে শুধু একটাই কথা,

‘আমার এই বাচ্চাটাও বাঁচবে না?’

পেটে হাত রেখে ইরা ঠোঁট ভেঙে নিস্তব্ধে কেঁদে উঠলো। অর্জন ওকে ঝাপটে ধরে দোয়া-দরুদ পরে পেটে ফু দিলো। প্রচ্ছদ নিরবিচ্ছিন্ন নিরবতায় গাড়ি চালিয়ে গেলো। পাশের সিটেই দুষ্টু বসে আছে। ইরার একস্তূপ হাহাকারে ওর মন’টা বিষিয়ে উঠছে। বিরবির করে আল্লাহ’কে ডেকে বলছে, ‘সুন্দর ভাবীর কষ্ট কমিয়ে দাও, আল্লাহ!’

ডাক্তার ইরা’কে চেকাপ করে চিন্তিত গলায় বললেন,

‘তেমন কোনো সমস্যা নেই তবে মিসক্যারেজের ঝুঁকি ছিলো। হসপিটালে ভর্তি থাকুক।’

ইরার চেহারায় আতংকের ভাব’টা খানিক প্রশমিত হলো। কিন্তু অর্জন এক বাক্যে ‘না’ করে দিলো। ডাক্তার বললেন,

‘আচ্ছা নিজ বাড়িতে যদি আমার দেওয়া নিয়ম গুলো মানতে পারেন তবে হসপিটালে ভর্তির দরকার নেই।’

ডাক্তার নিয়ম দিলেন, তিন মাস ফুল বেড রেস্ট। দুই সপ্তাহ সে বিছানা থেকে উঠতে পারবে না ওয়াশরুমে যাওয়া ছাড়া। পায়ের নিচে সারাক্ষণ বালিশ দিয়ে রাখতে হবে। হাটবে না। ওষুধ ঠিকমতো খাবে। সময় মতো ইঞ্জেকশন নিতে হবে।

অর্জন মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে এলো। বাড়ি’তে এসে দেখা গেলো রীতিমতো ইরাকে এক সেকেন্ড কাছ ছাড়া করছে না সে। কোলে করে ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে আবার কোলে করে নিয়ে আসছে। দুষ্টু তা দেখে হেসে কুটিকুটি হয়ে চলে এলো। প্রচ্ছদ এসে-ই কোথায় যেনো আবার লা-পাত্তা হয়েছে৷ ওইদিনের পর থেকে এই পাঁচদিন প্রচ্ছদের সাথে তার একটা টু শব্দও বিনিময় হয়নি। দুষ্টু শব্দ করে নিশ্বাস ছাড়লো। আলমারি খুলে কিছু গয়নার বাক্স বের করে চললো সিড়িন হকের ঘরের দিকে।

,
সিড়িন হক মিনিট চারেক হলো দুষ্টুর দিকে রক্তলাল চোখে তাকিয়ে আছেন। দুষ্টু সেই চক্ষু সপ্তম বারের মতোন দর্শন করে আরো খানিক’টা মিইয়ে গেলো।

‘এগুলা আর আমার প্রাপ্য নয়। রেখে দিন।’

সাথে সাথে সিড়িন হকের ভরাট গলার স্বর দেয়ালে দেয়ালে বারি খেলো,

‘আমি সার্থপর, পাষাণ, বেপরোয়া দেখেছি কিন্তু তোমার মতো মেয়েমানুষ দেখিনি!’

দুষ্টু যেন কথা’টা শুনেও শুনলো না। কি দরকার ওত পাত্তা দেওয়ার? আজ বাদে কাল যেখান থেকে চলে যেতেই হবে তাদের কথাকে এতো গুরুত্ব ভেবে গায়ে মাখানোর কোনো প্রয়োজন নেই। এরপর বছরে ওদের সাথে দেখা তো দূর সারাজীবনে একবার দেখা হয় কিনা সন্দেহ!

‘আমার বাড়ির এই অবস্থা! আর তুমি তোমার গোছগাছ শুরু করে দিয়েছো?’

দুষ্টু মুখে হাত দিয়ে দাড়িয়ে কিছুক্ষণ ভেবে আস্তে করে উত্তর দিলো,

‘আমি থাকলে কি বাড়ির অবস্থা ভালো হয়ে যাবে, আন্টি?’

সিড়িন হকের চোখ থেকে যেন এবার রক্ত ঝরবে। চোখ পাকিয়ে এমন তরে তাকালেন যেন চোখ দিয়েই ভস্ম করে ছাড়বেন এই বেয়াদব মেয়েকে। তিনি ছো মেরে দুষ্টুর হাত থেকে গয়নার বাক্সগুলো নিয়ে আলমারিতে রেখে বললেন,

‘এই মূহুর্তে আমার ঘর থেকে বেরুবে তুমি।’

দুষ্টু অপমান’টা মনে রাখলো না। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। ওকে যেনো কোনোকিছুতেই কেউ আটকাতে পারছে না। বরফের ন্যায় কঠিন মন কোনোমতেই গলছে না। তার উপর বিগত পাঁচদিন থেকে নীড়ের এ বাড়িতে উপস্থিতি ওকে আরো বেপরোয়া করে তুলেছে। নীড় এ বাড়িতে থাকলে দুষ্টু এবাড়ির কারোর চোখের সাথে চোখ মেলাতে পারে না। সর্বক্ষণ মনে হচ্ছে এ বাড়ির প্রত্যেকটা প্রাণ থেকে দেয়ালের ইটগুলোকে পর্যন্ত সে ক্রমাগত ঠকিয়ে যাচ্ছে। তবে কোনোকিছুই যে ও গায়ে মাখছে না এটা সত্যি কিন্তু…… কিন্তু প্রচ্ছদের ওই চুপচাপ হয়ে যাওয়া…. দুষ্টুকে প্রকাশ্যে সর্বদা এড়িয়ে চলা…. একটা বাক্যও আদান-প্রদান না করা এসব খুব পুড়াচ্ছে। দুষ্টুর অন্তর দহনের গন্ধ কি প্রচ্ছদের নাকে একবার গিয়ে বারি খায়নি? একবার ঘুরে তাকিয়ে দুষ্টুকে দেখে না কেনো? ওর ভালোবাসার বুলিগুলো আর আওড়ায় না কেনো?

করিডোর ধরে টিয়ার ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দুষ্টু বেখেয়ালে দেখে ফেলল, টিয়ার মাথায় বিনুনি গেঁথে দিচ্ছে নীড়। বিনুনি গাঁথা শেষ হতেই খুব সন্তর্পণে টিয়ার মাথায় আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ানো হলো। দুষ্টু অনুভূতিশূন্য চোখে তা তাকিয়ে দেখলো৷ ওর বিন্দু পরিমাণ খারাপ লাগলো না। ঠোঁট জুড়ে খেলে গেলো মৃদু-মন্দ এক চিলতে হাসি। শুধু মনে মনে আওড়ালো,

‘ভাগ্যের কী আশ্চর্য খেলা! কার ভাগ্যে কে লেপ্টে রয়!’

সে দৃশ্যটার দিকে আরেকবার তাকিয়ে বাতাসে দীর্ঘশ্বাস মেলে দিয়ে ফিসফিস করে আওড়ালো,

‘তবুও সবাই একসাথে ভালো থাকুক! প্রাণখুলে বাঁচুক। আমার জীবন ওদের সবার ভালোর জন্য পরিত্যাজ্য হোক।’

দুষ্টু আস্তে করে দরজার পর্দা টেনে দিয়ে চলে গেলো। নীড় বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে পরলো। দুষ্টুর উপস্থিতি ও টের পেয়েছে। টের পেয়েছে বলতে দুষ্টু যখন পর্দা টেনে দিয়ে গেলো তখন আয়নায় ওর প্রতিচ্ছবি দেখেছে। টিয়া নীড়ের মাথার পাশে বসলো। শুধালো,

‘মাথা ব্যথা করছে?’

চোখ বন্ধাবস্থায় নীড় না করলো। টিয়া ভাবুক স্বরে প্রশ্ন করে,

‘তোমার কি মনে হয় নীড় ভাইয়া? পরশু কি সত্যি সত্যি ওদের ডিভোর্স হয়ে যাবে?’

নীড় চোখ খুলল। টিয়া’কে ধরে ওর পাশে শুইয়ে দিলো। বিনুনি ধরে খেলতে খেলতে শুধালো,

‘আমাদের সম্পর্কও তো অপ্রাকৃত! তুমি কি আমাকে কখনো ডিভোর্স দেবে?’

বিয়ের প্রথম দিকে হলে টিয়া হ্যাঁ বলতো। কিন্তু এই মূহুর্ত’টায় এসে টিয়া ঠিক হ্যাঁ বলতে পারলো না। উল্টে প্রশ্ন করলো,

‘তুমি দেবে?’

টিয়ার প্রশ্নে নীড় মুচকি হাসলো। ওর পিচ্চি হাতের পাঁচ আঙ্গুলের ভেতর নিজের দীর্ঘ, স্থূল পাঁচ আঙ্গুল ঢুকিয়ে বলল,

‘কক্ষনো না।’

‘তুমি কখনো কাউকে ভালোবেসেছো, নীড় ভাইয়া?’
‘বেসেছি তো!’
‘কাকে?’
তোমাকে!’
‘সে তো অন্যরকম!’

নীড় টিয়ার কাছাকাছি এলো। নীড়ের তপ্ত শ্বাস টিয়ার ঠান্ডা মুখশ্রীতে আছড়ে পরতেই নিশ্বাসের গতি বেড়ে গেলো। নীড় ধীর গলায় শুধালো,

‘কীরকম?’

টিয়া খুব কষ্টে মুখ থেকে নিশ্রিত করতে পারলো, ‘বন্ধুর মতোন।’

‘তো, তুমি কেমন ভালোবাসা আশা করছো, টিয়া?’

নীড়ের ফিসফিসে কণ্ঠস্বর। টিয়া মাথা নিচু করে গুটিসুটি হয়ে উঠে বসলো। সেকেন্ড কতক পর টিয়াকে আবার ধরে শুইয়ে দিয়ে নীড় সেই সুরে আবারো শুধালো,

‘স্ত্রীর মতো?’

টিয়ার দম বন্ধ হয়ে এলো। নীড় ওর খুব কাছে! এতো কাছে যে দুজনের তপ্ত নিশ্বাস মিলেমিশে একাকার হয়ে এক্ষুণি বিস্ফোরণ ঘটবে। টিয়া নীড়ের বুকে আলতো ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। ওর হৃদয় কাঁপছে! নীড় বলল,

‘তুমি যেদিন থেকে আমাকে নীড় ভাইয়া বলা’টা বিয়োগ করতে পারবে ভাববে সেদিন থেকে-ই আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি গেঁথে গেছে ভূ-তলের অনেক…অনেক গহীন অবধি যা আর কখনোই উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়!’

টিয়া কি কথাটার মর্ম বুঝলো? বুঝলো বোধহয়! তা নাহলে ওমন দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কেনো?

‘তুমি আমার আগে কাউকে ভালোবেসেছো?’

‘না!’

নীড়ের এক চোটে উত্তর কিন্তু তার বোধ হলো এক্ষুণি তার হৃদয় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে! অন্তরিন্দ্রিয় লণ্ডভণ্ড হবে মিথ্যার অভিশাপে! এতো বড় মিথ্যে? নীড়ের বুক’টা ভারী হয়ে… এতো বেশি ওজন হলো যে তার ভার আর বহন করা যাচ্ছে না। সহসা সে টিয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো জড়িয়ে ধরার মতো করে। এই প্রথম! টিয়া আবেশে চোখ বুজে ফেলল! চিত্তে চাঞ্চল্যতা বয়ে গেলো! শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিরশিরানির ঢেউ উঠলো! কতক্ষণ পর অনুভব করলো তার উন্মুক্ত কাধে উষ্ণ নেত্র-নীর! সে চমকে উঠলো! উৎকন্ঠায় জিজ্ঞেস করলো,

‘নীড় ভাইয়া তুমি কি কাঁদ…

টিয়ার কথা সমাপ্ত করতে না দিয়ে বরং আরেকটু গাঢ় করে জড়িয়ে ধরে ওকে হতভম্বতার সাগরে বিহ্বল করে দিয়ে নীড় চাপা স্বরে বলে উঠে,

‘তুমি আমার সেই সবুজরঙা পাখি যার একমাত্র নীড় আমি।’

চলবে❤️