#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৬
১২.
ঘরে আসতেই প্রচ্ছদ দুষ্টুর দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। কলাপাতা রঙের কামিজ পড়নে ক্রস করে কোমড়ে বাধা উড়না। পাতলা শরীরের চিকন কোমড়ের ছাপ স্পষ্ট। লাল পায়জামা গুটিয়ে কিছুটা উপরে তোলা। তবুও ভিজে গাঢ় খয়েরি রং ধারণ করেছে। জামার হাতার কনুই পর্যন্ত ভেজা। জামার নিচের অংশের বাম সাইড সম্পূর্ণ ভেজা। প্রচ্ছদ দুষ্টুকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে বলল,
‘সামান্য দুই একটা কাপড় ধুতে তোমার এই নাজেহাল অবস্থা? যেনো কাপড়ের সাথে পানি যুদ্ধ করেছো!’
দুষ্টু তর্জনী আঙ্গুল উচিঁয়ে বলল, ‘আপনি একদম আমাকে ঠেস করে কথা বলবেন না।’
প্রচ্ছদ কাধ উঁচিয়ে বলল, ‘ওকে।’
কিছুক্ষণ বড় বড় শ্বাস ফেলে দুষ্টু তেড়ে প্রচ্ছদের দিকে গেলো। প্রচ্ছদ ঘাবড়ে যেতেই দুষ্টু তড়িৎ বেগে উল্টোদিক ঘুরে আলমারি থেকে প্রচ্ছদের একটা টি-শার্ট নিয়ে কেচি দিয়ে খচ করে কেটে ফেলল। ঘটনা এতো তাড়াতাড়ি ঘটলো যে প্রচ্ছদ মুখের বুলি হারিয়ে ফেলল। মুখটা হা করে চোয়াল ঝুলিয়ে রোবটের ন্যায় ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দুষ্টুর হাত থেকে টি-শার্ট টা হালকা হাতে টেনে নিলো। দুষ্টুর ঠোঁটে তখন বিশ্বজয়ের সন্তুষ্টির হাসি। রাগ কমেছে! প্রচ্ছদ অসহায় গলায় বলল,
‘আমার ফেবারিট টি-শার্ট।’
দুষ্টু কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রচ্ছদ বিদ্যুতের গতিতে দুষ্টুর হাত থেকে কেচি নিয়ে চট করে তার চুল কেটে দিলো। কিছু চুল কোমড় থেকে নেমে এলো ঘাড় অবধি। দুষ্টুর ঠোঁট দুটোর মাঝে তখন চার ইঞ্চির ফাঁক। প্রচ্ছদের দিকে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক পরছে না। প্রচ্ছদ এটা কি করলো? এরপর যখন চুলের দিকে তাকালো তার কান্না পেলো। সামনের কয়েকটা চুল কেটে ঘাড় সমান করে দিয়েছে। সেই চুলগুলো বারবার চোখের সামনে এসে পরছে। দুষ্টু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে হাত বোলাতে বোলাতে করুণ কিন্নর কণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠলো,
‘আমার চুল!’
প্রচ্ছদ নিজেও অবাক হয়ে পরেছে। প্রিয় টি-শার্ট কাটায় বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলো যেনো। ও জানে দুষ্টু ওর চুল নিয়ে ভীষণ কন্সার্ন। প্রচ্ছদ থেমে থেমে বলল,
‘ওতোটাও খারাপ লাগছে না কিন্তু। কাটা দিয়ে বেঁধে রাখলে বোঝা যাবে না।’
দুষ্টু ধমকে উঠলো, ‘চুপ থাকুন আপনি। সামান্য একটা গেঞ্জির জন্য এভাবে আমার চুল কাটবেন অসভ্য লোক!’
দুষ্টুর ধমকে প্রচ্ছদ চুপ থাকলো। নীল রঙের টি-শার্ট টা উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলো কোনোভাবে ঠিক করা যায় কিনা। কিন্তু নাহ ঠিক করার উপায় নেই। প্রচ্ছদ টি-শার্টের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। এই টি-শার্ট’টায় যে কত স্মৃতি জর্জরিত! ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দুষ্টু চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলে,
‘আপনার ভাবী হচ্ছে এক খারাপ আর আপনি হচ্ছেন মহা খারাপ।’
প্রচ্ছদ ভ্রু কুচকে তাকালো, ‘কোন ভাবি?’
‘নীরা ভাবি।’
‘কি বলেছে?’
‘কি আর বলবো, ছাদে কাপড় নাড়তে দেখে জিজ্ঞেস করলো চাদর ধুয়েছি কেনো? আপনার প্যান্ট, শার্ট ধুয়েছি কেনো? হেনতেন।’
‘তুমি কি উত্তর দিলে?’
‘বললাম আপনি বিছানায় হাগু মুতু করেছেন।’
প্রচ্ছদ নাক ফুলিয়ে চোখ পাকিয়ে তাকালো। ভ্রু কুটি করে ভাবলো কিছুক্ষণ এরপর বলল,
‘ওর সাথে ওতো কথা বলতে যেয়ো না। ওর কৌতুহল একটু বেশি। সব বিষয়ে খোঁচানো স্বভাব। আমার পছন্দ না। তোমার সাথে ওর দিনে রাতে উঠতে বসতে দশ বার করে মারামারি হবে।’
‘আপনি বেশি জানেন?’
‘নাহ! আমি কীভাবে বেশি জানবো? তুমি তো সবজান্তা শমসের তাই না?’
‘হ্যাঁ। মারামারি হলে আপনি রেফারি থাকবেন।’
‘এই দুনিয়ায় আমার আর কাজ নেই তো!’
দুষ্টু মুখ বাকাঁলো। কিছু মনে পরেছে এমন ধারায় বলল,
‘ওহ, শুনুন আপনার সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।’
‘বলো।’
‘কথাটা হলো আজকে আমার বাইরে বের হতে হবে।’
প্রচ্ছদ একচোটে নাকচ করলো, ‘অসম্ভব। বিয়ের মাত্র দু’দিন। মা কক্ষনো আজ তোমাকে বাইরে বের হতে দিবে না।’
‘এরজন্যই তো আপনাকে বলা। আপনি ম্যানেজ করবেন।’
প্রচ্ছদ বাম ভ্রু উঁচু করে বলল, ‘কেনো? কি এতো প্রয়োজন?’
‘অনেক প্রয়োজন। আমার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাবো।’
প্রচ্ছদ এক ঝলক নরম চোখে দুষ্টুর দিকে তাকিয়ে হালকা আওয়াজে বলল, ‘শুধু বন্ধুদের সাথেই?’
দুষ্টু মাথা নিচু করলো, ‘শ্রেয়সী কাল ফোন দিয়ে মিট করতে বলল আর..’
‘আর?’
‘আর ও আসবে।’
পলকবিহীন মিনিট কতক প্রচ্ছদ তাকিয়ে থাকলো। জানালার সাদা পর্দা গুলো সরানো। রোদের অনেক তেজ। দৃষ্টি জোড়ায় বিশাল হতাশার পাহাড়। হাজারো কষ্ট মেঘের ভিড়। কেমন যেনো ব্যথা! ঠিক..কেমন যেনো! বুঝতে পারে না। ব্যথাটা ক্রমশ বাড়ছে যখন মাথায় বারবার বলের মতো ঢপ খেয়ে যাচ্ছে ‘ও’ শব্দটা। দুষ্টুর কণ্ঠে এই ‘ও, উনি’ শব্দগুলোর অধিকার কি শুধুই প্রচ্ছদের নয়? সে অনেকক্ষণ পরে আস্তে করে বলল শুধু,
‘রেডি হয়ে থেকো।’
১৩.
সকাল আট’টার দিকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি এলো। ভীষণ গরমে নেতিয়ে যাওয়া বৃক্ষ সতেজ হলো। ধুলোময় মাঠঘাট, পথরাস্তা বৃষ্টির ছটায় সিক্ত হলো। টিয়া ভার্সিটি চত্বরে পৌঁছালো। বহু আকাঙ্ক্ষিত মানুষ’টার জন্য অপেক্ষা করলো পুরো সাত মিনিট। মাথার উপর নরম রোদ। ঠান্ডা পবনে উড়ছে নীল উড়নার সাদা পার। ক্লান্ত চোখে পুরো ভার্সিটিতে একবার চোখ বুলাতেই যখন একপাশে মানুষ’টাকে পিয়নের সাথে কথা বলতে দেখা গেলো টিয়ার মন পাখি তখন ফুরুৎ করে উড়ে গেলো, হৃদপ্রদীপ নিভে গেলো, প্রেম মন শয্যাশায়ী হলো। টিয়া বুকে হাত রাখলো। এরপর অনেক্ক্ষণ বাদে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো। মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
‘আসসালামু আলাইকুম, স্যার।’
প্রযুক্ত ঘুরে তাকালো। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, গালের দাড়ি কামানো, তামাটে বর্ণের মুখ, ভীষণ কঠিন মানুষ’টাকে দেখলে ভেতর থেকে শ্রদ্ধা আসে, ভয় কাজ করে, কথা বলতে সংকোচ বোধ হয়। প্রযুক্ত রসকস বিহীন গলায় সালামের জবাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘তোমার নাকি কোন চ্যাপ্টার সমস্যা?’
টিয়া আস্তে করে জবাব দিলো, ‘জি স্যার।’
‘অফিস রুমে যাও। আমি আসছি।’
টিয়া মাথা নাড়িয়ে অফিস রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই প্রযুক্ত ডেকে উঠলো। টিয়া অতি উৎসাহ নিয়ে তাকালো। প্রযুক্ত বলল,
‘তোমার ভাইয়া আসবে না?’
টিয়ার মন খারাপ হলো। ডানে বামে হালকা করে মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো, ‘জানি না স্যার।’
কিছু মনে পরার মতো ভঙ্গি করে টিয়া বলল, ‘ওহ স্যার, আপনাকে জেঠি আম্মু সন্ধ্যায় বাসায় যেতে বলেছে। হয়তো ফোনও করবে।’
‘পারসোনাল কথা ভার্সিটির বাইরে বলবে। অফিস রুমে যাও।’
টিয়া ঠোঁট টিপে মাটির দিকে চেয়ে পা বাড়ালো। চ্যাপ্টার’টা বুঝে ও। গর্দভ টিয়া বইয়ের সবথেকে ভালো এই অধ্যায়’ টাই পারে।
প্রচ্ছদ, প্রযুক্ত সেই ছোটোবেলার বন্ধু। কলেজ ভার্সিটি একসাথে পড়ার সুযোগ না হলেও, কালে ভাগ্যক্রমে একই ভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে জয়েন করার সুযোগ পেয়েছে। টিয়া বলেছিলো বাসায় গিয়ে চ্যাপ্টার’টা বুঝিয়ে দিয়ে আসতে। কিন্তু ইগোওয়ালা লোকটা তো যায়নি বরংচ এক ঘন্টা আগে টিয়াকে ভার্সিটি আসতে বলেছে। ব্যস, টিয়াও এখন ট্রিক খাটালো। এবার, জেঠি আম্মুকে ফোন করে কনভেন্স করতে হবে এই বলে যে, ‘প্রযুক্ত ভাইয়াকে আজ সন্ধ্যায় বাসায় আসার জন্য বলো। উনি বলছিলেন, তোমার নতুন ভাবীকে বিয়ে ছাড়া দেখার সুযোগ ই হলো না!’ ভাবতে ভাবতেই টিয়া শব্দ করে হেসে দিলো। মাথার উপর দিয়ে টিউ টিউ শব্দ করতে করতে উড়ে চলে গেলো নাম না জানা এক সুন্দরী পাখি।
১৪.
বেক্কলের মতোন দুষ্টু প্রচ্ছদের কথা মতোন রেডি হয়েছে আট’টায়। দু’ঘন্টা থেকে রেডি হয়ে বসে আছে। ঘড়ির কাটা এখন দশ’টার ঘরে। এক্ষুনি হয়তো খেতে ডাকবে। এরপর’ই বাড়ি থেকে বের হওয়া হবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রচ্ছদ শার্টের হাতা ফোল্ড করছে। মেরুন কালার শার্টের বুকে দুটো বোতাম খোলা। হাতে মেটে রঙে ফিতার ঘড়ি। দুষ্টু গালে হাত দিয়ে প্রচ্ছদের রেডি হওয়া দেখে ভ্রু কুচকে তাকালো,
‘হিরোর মতোন সেজে যাচ্ছেন কেনো? আপনার ক্লাস নেই আজ?’
পারফিউম লাগিয়ে উত্তর দিলো প্রচ্ছদ, ‘যাবো না আজ।’
‘কেনো?’
‘বিয়ের ছুটি চলছে।’
দুষ্টু বিস্ময় নিয়ে তাকালো, ‘তবে কাল কোথায় গিয়েছিলেন?’
‘ভার্সিটিতেই। কিছুদিন আগে মিডটার্ম এক্সাম হয়েছে। খাতা নিয়ে ঝামেলা হয়েছিলো তাই গিয়েছিলাম।’
দুষ্টু ঠোঁট গোল করে ‘ও’ বলল। এক মিনিট পরেই খাবার খেতে ডাইনিং রুমে যেতে বলল কাজের মেয়েটা। দুষ্টু দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রচ্ছদের পেছন পেছন চলল। খাবার টেবিলে বসে কয়েক লোকমা খাওয়ার পর’ই সিড়িন হক মোটা স্বরে প্রশ্ন করলেন,
‘রেডি হয়েছো যে? সাত সকালে কোথায় যাচ্ছো?’
ব্যস, ওতেই দুষ্টুর গলায় ভাত আটকে গেলো। সিড়িন হক কাজের মেয়েটাকে বললেন দুষ্টুকে হালকা গরম পানি দিতে। মেয়েটার এমনিতেই ঠান্ডা লেগেছিলো কাল। দুষ্টুর পানি খাওয়ার সময় প্রচ্ছদ উত্তর দিলো,
‘মা, আমি একটু বের হচ্ছি ওকে নিয়ে। শপিং করতে যাবো।’
সিড়িন হক খাওয়ার মনোযোগী হয়ে বললেন,
‘তা ভালো। ওর কম্ফোর্ট মতো জামা কিনে দিয়ো।’
‘আচ্ছা।’
‘হুম। শুনো, আজ সন্ধ্যায় প্রযুক্তকে আসতে বললাম।’
‘ভালো করেছো, মা। অনেকদিন ওর সাথে আড্ডা হয় না।’
খানিক বাদে সবাই খাওয়া শেষ করে চলে গেলো। টেবিলে তখন শুধু সিড়িন হক এবং দুষ্টু। তিনি দুষ্টুর উদ্দেশ্যে বললেন,
‘বড় বউয়ের জন্য পাতলা সুতি শাড়ি আর কয়েকটা ঢিলা-ঢালা কামিজ, মেক্সি নিয়ে এসো। এই সময় আরাম’টাই আসল। এমনিতেও সারাক্ষণ শাড়ি ছাড়া কিছু পরতে চায় না। শাড়ি না পরলে নাকি ওর কাছে নিজেকে বউ বউ মনে হয় না। রাতে যদি একটু শাড়ি ছেড়ে আরাম মতো ঘুমোতে পারে। দেখে-শুনে, বেছে সুন্দর কাপড় আনবে।’
দুষ্টু বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে গরম পানিটুকু শেষ করলো। সিড়িন হক কয়েক সেকেন্ড থেমে বললেন, ‘মনে রেখো, বড় বউ আমার বাড়ির আদর্শ।’
চলবে❤️
#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৭
১৫.
গাড়ি বাকঁ ধরেছে ধানমন্ডির দিকে। লাল জামার উপর খয়েরী হিজাবে দুষ্টুকে ঠিক কলের পুতুলের মতোন চোখে লাগছে। প্রচ্ছদ আড়চোখে এ নিয়ে ষোল বার তাকিয়েছে। জানালায় হাত রেখে তাতে মাথা ঠেকিয়ে দুষ্টু প্রশ্ন করলো,
‘আমাকে রেস্টুরেন্টের একটু আগেই নামিয়ে দিবেন।’
প্রচ্ছদ মাথা নাড়ালো। জিজ্ঞেস করলো,
‘ওরা দেখে ফেলার ভয় পাচ্ছেন?’
দুষ্টু ভ্রু বাকিয়ে তাকালো। কিয়ৎক্ষণ বক্র ভ্রু নিয়ে তাকিয়ে থেকে হতাশ নিঃশ্বাসে বলল,
‘আপনার গলায় আপনি মানায় না। প্লিজ আর উল্টাপাল্টা করবেন না। তুমি বলেই ডাকুন। আমি ওতেই কম্ফোর্টেবল।’
‘নেক্সট টাইম থেকে খেয়ালে রাখবো।’
‘হুম।’
‘তোমাকে আবার আনতে যেতে হবে?’
দুষ্টু বাইরে তাকিয়ে ছাড়া ছাড়া গলায় উত্তর দিলো,
‘বুঝতে পারছি না। পরিস্থিতি বুঝে। তবে আপনাকে আর আমাকে তো একসাথেই বাড়িতে ঢুকতে হবে। আচ্ছা, আমি ফোন দিবোনি। নাম্বার’টা দিন।’
প্রচ্ছদ নাম্বার দিলো। দুষ্টু ফোনে সেভ করে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি এতোক্ষণ কোথায় থাকবেন?’
‘আমার একটা পরিচিত উকিলের সাথে দেখা করতে যাবো।’
দুষ্টুর চোখ মুখ চকচকে হয়ে উঠলো। ভীষণ উৎফুল্লতা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ডিভোর্সের ব্যপারে?’
‘হুম। ফোনে কথা হয়েছে।’
‘কতদিন লাগবে?’
বিরক্তিতে কপালে ভাঁজ পরলো প্রচ্ছদের, ‘বলেছিলাম তো তিনমাস।’
‘ওটা সত্যি ছিলো? এতোদিন কেনো?’
প্রচ্ছদের ভেতর’টা অনিচ্ছুক রাগে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। তারউপর দুষ্টুর এহেন বাক্যে সে রক্তলাল চোখ পাকিয়ে তাকালো। দুষ্টু ভয়ে মিইয়ে গেলো। প্রচ্ছদ দাঁতে দাঁত চেপে কিড়িমিড়ি করে বলল,
‘কি করবো বলো, ডিভোর্স তো আর আমার বাপ-দাদার সম্পত্তি না। আমি যদি পারতাম তবে এই মুহুর্তে তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে গাড়ি থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতাম। বিরক্তিকর মেয়ে একটা!’
দুষ্টুর চোখগুলো রসগোল্লার মতোন হয়ে গেলো। বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘আমি বিরক্তিকর? আমি? আপনি একটা বাজে অসহ্য!’
প্রচ্ছদ আবারো চোখ পাকিয়ে তাকাতেই দুষ্টু উলটোদিক ঘুরে বিরবির করলো,
‘হুহ! গরুর মতোন খালি চোখ পাকায়।’
খানিক বাদে গাড়ি যখন প্রায় গন্তব্যের কাছাকাছি দুষ্টু তখন হালকা আওয়াজে বলল,
‘উকিলের সাথে কথা বলতে কতক্ষণ লাগবে?’
‘Half an hour. তাই লাগবে কিনা সন্দেহ।’
‘কিন্তু আমার তো মাত্র আধ ঘন্টায় হবে না। বাকি সময়টুকু আপনি কি করবেন? আমাকে ছাড়া তো বাড়িতেও চলে আসতে পারবেন না।’
‘হুম।’
‘এক কাজ করুন তবে, উকিলের সাথে কথা বলে শপিংমলে চলে যাবেন। আমার জন্য দু’একটা লেডিস টি-শার্ট আর তিন-চার টা সেলোয়ার-কামিজ কিনবেন বাসায় পরার জন্য। এরপর আমি আপনাকে ফোন দিয়ে শপিংমলে চলে আসবো।’
‘আমি মেয়েদের জামা টামা কিনতে পারি না। তুমি যেহেতু আসবেই তবে আমার কেনার কি দরকার? আমি পারবো না।’
‘আরে আমি তো যাবো বড় ভাবির জন্য কিনতে। আন্টি আসার সময় আমাকে বলল বড় ভাবির জন্য কিছু ঢিলা-ঢালা পোশাক নিয়ে যেতে। আপনি আমার’টা কিনে রাখবেন নয়তো কেনাকাটা করতে করতে অনেক দেরি হয়ে যাবে।’
‘আমি পারবো না।’
দুষ্টু ভ্রু কুটি করে তাকালো, ‘পারবেন না?’
‘না।’
‘পারতে হবে। কেনো পারবেন না? তবে বিয়ে করেছেন কেনো? জানেন না বিয়ে করলে একটু আকটু বউয়ের জন্য শপিং করে দিতে হয়? এখন থেকে শিখুন।’
‘আহারে নামের বউ আমার!’
প্রচ্ছদ টেনে টেনে বলল। দুষ্টু তেজ নিয়ে বলে, ‘কথায় কথায় ইনসাল্ট করবেন না। আমি যদি মলে গিয়ে দেখি আপনি কিছুই কিনেন’নি তবে শপিংমল আজ আপনার মাথায় ভাঙবো।’
‘এতো অধিকার দেখানো তো ভালো নয়, মেয়ে।’
১৬.
শেষ শরৎ এর আকাশ পেজা তুলোর ন্যায় সুন্দর মেঘের উড়োউড়িতে ব্যস্ত। হেমন্তকালের আগমন বার্তা। বাতাসে কাশফুলের টুকরো টুকরো সাদা পালকের নরম অংশ ভেসে যায় এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। দুষ্টু বড় করে শ্বাস টেনে নিলো নিজের মাঝে। ঠোঁটের ফাঁকে না চাইতেও ফুটে উঠলো অমায়িক হাসি। সে এক বিরাট অনুভূতি! কত্তদিন পর দেখা হবে। ঠিক প্রথমদিনের মতো দুষ্টুর শরীর কাঁপছে। কেনো কাঁপছে কে জানে? হয়তো ভয়ে! তাকে না জানানো ঘটনা গুলো জেনে ফেলার ভয়।
শ্রেয়সী আর নীড় বসে আছে মুখোমুখি। জড় বস্তুর মতোন মাথা নিচু করে গল্প করতে দেখা যাচ্ছে নীড়কে। তার ফোলা চোখ, গায়ের শ্যামলা রং, পাংশুটে মুখ। গায়ে কালো রঙের টি-শার্ট। খানিক বাদে যখন নীড় মাথা উঠালো, রেস্টুরেন্টের কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখলো বহু অপেক্ষার মানুষটিকে। অসীম ভালো লাগার একটা স্রোত তার বুকের ভেতর আছড়ে পরলো। শরীরের সমস্ত অসুস্থ বোধ ফেলে সে চাঙ্গা হয়ে উঠলো যেন মুহুর্তেই। পাংশুটে মুখটায় খেলে গেলো এক ঝাঁক রঙের সন্তুষ্টি। উজ্জ্বল হলো তার চোখের তাঁরা। ঠোঁট আলগা হলো। দুষ্টু এগিয়ে এসেই নীড়ের কপালে হাত রাখলো। চিন্তিত কন্ঠে বলল,
‘হায় আল্লাহ! এতো জ্বর।’
‘তুমি জানলে কীভাবে?’
দুষ্টু চোখ ছোট ছোট করে বলে, ‘আমি জানবো না কেনো?’
নীড় হাসে। হেসে মাথা দুলিয়ে বলে, ‘ফোন বন্ধ ছিলো কেনো তোমার?’
‘নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।’
নীড়ের পাশে বসলো দুষ্টু। শ্রেয়সীর হাতে থাপ্পড় মেরে বলল, ‘কি খবর, শালী?’
‘আজ দুপুর দুইটায় এটিএন বাংলায় দেখিস। দেখাবে।’
‘যাহ, হারামি।’
খাবার অর্ডার করে শ্রেয়সী ফোনে চোখ ডুবালো। দুষ্টু এদিক ওদিক তাকিয়ে রেস্টুরেন্টে’টা দেখতেই ডান হাতের উপর অনাকাঙ্ক্ষিত বশত এসে পরলো আরেকটি হাত। দুষ্টু চমকে তাকালো। নীড়ের ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। সেই কোমল হাসির দিকেই তাকিয়েই কাটলো কিছুক্ষণ। এরপর হঠাৎই খেয়াল করলো তার ভীষণ অস্বস্থি হচ্ছে। ভীষণ! মনের ভেতর নিদারুণ একটা অপরাধ বোধ তরঙ্গের ন্যায় ভাসছে। নীড় হেসেই বলল,
‘তুমি জানো, তুমি যখন ফোন ধরছিলে না আমার কি অবস্থা হয়েছিলো? অসুস্থ না থাকলে তো কাল’ই একছুটে তোমার বাসার সামনে গিয়ে তোমাকে দেখে আসতাম।’
দুষ্টু আতংকিত দৃষ্টিতে তাকালো। এরপর ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি টেনে বলল,
‘আমি ভেবেছিলাম তুমি এখনো চট্টগ্রামে তাই ওভাবে বিষয়টা খেয়াল করিনি। চট্টগ্রামে থাকাকালীন তো তুমি এতো ব্যস্ত ছিলে যে, ঠিক মতো কথা বলার’ই সময় হয়নি।’
‘সরি, জান। এবার থেকে হবে। অনেক অনেক সময় দিবো আর অনেক ভালোবাসবো।’
দুষ্টু ঠোঁট টেনে হাসলো। নীড় দুষ্টুর দিকে কেমন গভীর প্রণয় চোখে তাকালো। বলল, ‘তোমাকে কেমন জানি দেখাচ্ছে!’
‘কেমন?’
‘লাল কাপড়ে একদম বউ বউ লাগছে।’
দুষ্টু পিলে চমকে উঠলো। নীড়ের হাতের নিচ থেকে সজোরে হাত টেনে নিয়ে আমতা আমতা করে বলল,
‘কেনো? হঠাৎ বউ বউ লাগতে যাবে কেনো?’
‘জানি না তো। তবে সুন্দর লাগছে। চেহারায় লাবণ্যতা ফুটে উঠেছে। তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে হবে আমার। এতো সুন্দরী প্রেমিকা ফেলে রাখা যাবে না। কখন কে কোথা থেকে এসে নিয়ে যায়!’
নীড় হাসলো। খাবার এলো। জুস খেতে খেতে আবারো সুন্দর করে হাসলো। নীড়ের মুচকি হাসিটা খুব সুন্দর। শ্রেয়সী নীড়ের মিটিমিটি হাসি নিয়ে কিছুক্ষণ মজা উড়ালো। কিন্তু তখন পর্যন্তও দুষ্টু আতংকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। অবাধ্য মন নিজ কন্ঠে বুকের ভেতর বলে উঠলো ভীষণ করুন সুরে,
‘আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি, নীড়। তোমার এই সুন্দর হাসিটা সবসময় আমার জন্য বরাদ্দ থাকুক। কখনো মিথ্যে না হোক।’
অপরাধবোধ, ভয়, জড়তা সব মিলিয়ে দৈবাৎ দুষ্টুর নিজেকে পাগল পাগল লাগলো। এর মাঝেই হঠাৎ মনে পরে গেলো প্রচ্ছদের কথা! খুব দ্রুত বাসায় ফিরে যেতে হবে।
চলবে❤️