এমন দিনে তারে বলা যায়
পর্বঃ ১৫
সানজিদা মাহি
____________________________________
সন্ধ্যায় ডাইনিংএ নাস্তা করতে বসেছে শান্তা আর আনোয়ার সাহেব। শান্তা এক মনে পাউরুটিতে জ্যাম মাখাচ্ছে চামচ দিয়ে। আনোয়ার সাহেব চা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মেয়ের গতিবিধি লক্ষ্য করছেন নিশ্চুপ হয়ে বসে।
” কেমন আছো শান্তা? ”
বাবার এমনতরো প্রশ্নে শান্তার হাত থেকে চামচ পড়ে গেল অকস্মাৎ। পড়ন্ত চামচের আঘাত টেবিলে টুংটাং আওয়াজ তুলে অল্প কয়েক মুহূর্তের জন্য শব্দহীন, নিরব ঘরে অনুরণন তুলল। শান্তা নিজের ভাবনার জগতে আকন্ঠ ডুবে গিয়ে ব্যস্ততা অবগাহন করছিল। তারমধ্যে এমন একটা প্রশ্ন যেন ঠিক বেখাপ্পা লাগলো ওর মনে। চামচটা টেবিল থেকে হাতে তুলে নিয়ে সে বাবার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইলো। আনোয়ার সাহেব স্বাভাবিক গলায় বললেন,
” সারাক্ষণ চোখের সামনে থাকলেই যে ” কেমন আছে ” ধরনের প্রশ্ন করা যাবে না তা কিন্তু নয়। চোখের সামনে তো আমরা কেবল শরীরের অবস্থা দেখতে পাই৷ মন ভালো আছে কি খারাপ আছে তা তো দেখতে পাই না ”
শান্তা ঢোক গিলল। বাবা হঠাৎ এমন জ্ঞানগর্ভ কথা বলছে কেন? ওর মনের গুপ্ত অভিপ্রায় তো বাবার জানার কথা নয়। তবে কি বাবা চিঠির ব্যাপারে সমস্ত জেনে গেছেন?
” কি হলো শান্তা? এভাবে তাকিয়ে আছো যে? আমি তো সাধারণ একটা প্রশ্ন করেছি ”
শান্তা মুখ থেকে বিস্ময়ের ছাপটা মুছে ফেলতো চাইলো জোর করে। স্মিত হেসে বলল,
” ভালো আছি বাবা ”
” বলো আলহামদুলিল্লাহ ”
” আলহামদুলিল্লাহ ”
” পড়াশোনা ভালো হচ্ছে? ”
” হচ্ছে ”
শান্তা পুনরায় মাথা নুইয়ে পাউরুটিতে জ্যাম মাখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। হঠাৎ প্রচন্ড অস্বস্তি ঝেঁকে ধরলো ওকে। যে বাবার ওপর সারাক্ষণ নিজে হম্বিতম্বি করে কৃত্রিম শাসন জারি রাখে আচমকা তাকে কেমন ভয় ভয় লাগতে শুরু করেছে। মেয়ের সংকুচিত ভাব দেখে আনোয়ার সাহেব আর কিছু বললেন না। ভাবলেন, হয়তো কোনো কারণে মন খারাপ আর মন খারাপের কারণটা হয়তো তাকে বলা যায় না। এটা স্বাভাবিক। সব কথা তো আর সকলকে বলে বেড়ানো যায় না। ব্যক্তিগত বলে একটা কথা আছে। শান্তা তাড়াতাড়ি নাস্তা সেরে বাবার কাছ থেকে সরে এলো। মনের মধ্যে এলোমেলো ভাবনার ঝড় বইছে। দরজা আঁটকে দিয়ে সে বিছানায় বসলো। কিন্তু বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারলো না৷ একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়ের মাঝে আচ্ছন্ন হয়ে রইলো বহুক্ষণ। চিঠিগুলো লুকিয়ে ফেলা দরকার। যদি বাবা জিজ্ঞেস করে তখন তো সে মিথ্যা বললে ধরা খেয়ে যাবে। শান্তা তড়িৎগতিতে চিঠিগুলো টেবিলের ড্রয়ার থেকে বের করে বিছানার তোশকের নিচে ঢুকিয়ে রাখলো। ঠিক তখুনি দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। ভয়ের চোটে শান্তার গলা শুকিয়ে কাঠ প্রায়৷ যেখানে দাঁড়িয়েছে সেখান থেকে নড়তেও পারছে না কিছুতেই। দরজা খুলছে না বলে আনোয়ার সাহেব আওয়াজ তুললেন,
” শান্তা দরজাটা খুলো ”
শান্তা যেন এবার কেঁদেই ফেলবে৷ ইশ এমনটা হতে হলো শেষ পর্যন্ত? কি করবে এবার সে? কি করে নিজেকে বাঁচাবে এই দুর্যোগ থেকে? কোনোরকমে সাহস সঞ্চার করে পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। আশঙ্কা করছিলো, এই বুঝি বাবা ক্রোধে রঞ্জিত, কঠোর, রূঢ় দৃষ্টিতে ওরপানে চেয়ে থাকবে৷ দরজা খুলে দেখলো বাবা শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখমুখে তখনও ওর ভয়ের ছাপ। জিজ্ঞেস করলো,
” কি হয়েছে বাবা? ”
শত চেষ্টা করেও কন্ঠের মৃদু কাঁপুনিটা আড়াল করা গেল না। আনোয়ার সাহেব সেটা খেয়াল না করে বললেন,
” তোমার খালামনি টেলিফোন করেছে ”
বাবা চলে যাবার পরও এক মিনিটের মতো লাগলো ওর স্বাভাবিক হতে। এ সময় প্রায়ই খালামনি ফোন করে। কিন্তু আজ কি যে ওর হলো! কেবলই মনে হয় সবাই সবটা জেনে গেছে বুঝি। এক্ষুনি তাকে পাকড়াও করে কঠিন কন্ঠে জেরা করা হবে। আর তারপর? তারপর কি হবে সেটা সে ভাবতে পারছে না। নিশ্চয়ই চিঠি আদান-প্রদান করা বন্ধ করে দেওয়া হবে। হয়তো মাহমুদকেও শাসানো হবে এরজন্য। অথচ ও বেচারার তো কোনো দোষ নেই। পরিস্থিতির চাপে শান্তা ভুলে গেল তার বাবা অতিব ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষ। এ অবধি কাউকে শাসানো বা ঝাড়ি দিয়ে কথা বলার সাক্ষ্য প্রমাণ খুঁজলে একটাও পাওয়া যাবে না৷ নিজেকে আত্মস্থ করে সে ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়ালো খালামনির সঙ্গে কথা বলতে।
.
শান্তার চিঠিগুলোর মাঝে আজকাল কেমন একটা প্রচ্ছন্ন মনোভাব লুকানো থাকে। মাহমুদের কাছে মনে হয় চিঠির কাঁটাছেড়া হীন, গোল গোল অক্ষরগুলোর ভেতর অন্য কোনো ছবি ভেসে আসব আসব করে নিজেকে আড়াল করে রাখছে। শান্তা আগের মতো দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাবলি দিয়ে চিঠি পুরিয়ে ফেলে না। কোনো একটা ঘটনা লিখতে গিয়ে সবিস্তরে নিজের মনোভাব লিখতে থাকে। কখনো দু-একটা পঙক্তি থাকে তার প্রতি অভিমান মেশানো। যেন বলতে চায় আপনি ঠিক এমন কেন? ওরকম হতে পারেন না? মাহমুদ আসলে কেমন? সে নিজেও বুঝতে পারে না নিজেকে। তবে মেয়েটার অভিমান, অভিযোগে সে আনমনে হাসে৷ এতদিনে ওদের মধ্যে একটা মানসিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা বেশ বোঝা যায়। তবে মাহমুদ সেটাকে কোনো নামকরণ করতে পারে না। মেয়েটা মায়াবী। তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা তার কিছু গোপন কষ্ট আছে যা সে সবাইকে বলে বেড়াতে পারে না। সেসব শুধু সে মাহমুদকেই জানিয়েছে। এর অর্থ সে মাহমুদকে সম্পূর্ণ ভরসা করে। তাকে নিজের অঘোষিত নিরাপদ আশ্রয় মনে করে। মাহমুদের কি উচিত নয় তাকে নিশ্চয়তা দেয়া? কিন্তু সে নিশ্চয়তা ঠিক কেমন হবে? শান্তা আসলে কি বলতে চায় তাকে? সে বুঝি বুঝি করেও ঠিক বুঝতে পারে না৷ কিছু অনুভূতির ব্যাখ্যা হয় না৷ কোনো নামকরণে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। এসব অনুভূতি এমন হয় যে ব্যক্তি নিজেও বুঝতে পারে না। মাহমুদের তেমনি হচ্ছে ইদানীং।
এরইমধ্যে একদিন বাড়ি থেকে চিঠি এলো। মাহমুদ ছুটি নিয়ে স্বল্প কিছু জামাকাপড় সঙ্গে নিয়ে শহরে চলল। বাড়ি এসে তড়িঘড়ি করে ডাকার হেতু যখন জানতে পারলো তখন রাজ্যের থমথমে ভাব এসে ভর করলো ওর মুখে। মায়ের কথা একটাই। একলা একা এরকম অজপাড়াগাঁয়ে থাকা যায়? খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো হচ্ছে না বলেই তো শরীর দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছে। আর চোখগুলো কেমন কোটরগত হয়েছে এখান থেকে যাবার মাসখানেকের মধ্যেই। মাহমুদ আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে নিজেকে বিচার করার কাজে লেগে গেল। মাসখানেক আগে যখন বাড়ি এসেছিলো তখন সে যেমন ছিল এখনো তো তেমনি আছে। বুঝলো, মায়ের আসলে অন্যকিছু বলবার আছে। আর আসল কথা বলবার আগে এসব ছুতো মাত্র। টুল টেনে সে মায়ের সোজাসুজি বসলো।
” ঠিক করে বলো তো আম্মা। হঠাৎ ডেকে পাঠিয়েছো কেন? নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে। তোমাকে আমি ভালোই চিনি হু হু ”
রান্নাঘর থেকে মাহমুদের বড়বোন মহিমা তেড়ে এলো।
” মতলব কিরে হ্যা? তোকে তোর ভালোর জন্যই আম্মা ডেকেছে ”
মাহমুদ কৃত্রিম ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বলল,
” ওরে বাবা! অনেক ভয় পেয়েছি। এবার তোমার খুন্তি নামাও ”
কথার তালে হাতের খুন্তিটা ওরদিকে তাক করেছিলো মহিমা। ভাইয়ের ঢং দেখে খুন্তি নামিয়ে তৎক্ষনাৎ মায়ের দিকে চাইলো সপক্ষে সঙ্গ পাওয়ার অভিপ্রায়ে।
” তুই তোর কাজ কর। আমি বুঝাচ্ছি ওকে ”
মহিমা আর দাঁড়ালো না। থেকে কি হবে? তাকে তো কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না।
নাজমা ছেলের দিকে মনোনিবেশ করলেন। হাসি হাসি মুখ করে বললেন,
” ঢং করে লাভ নেই। জানিসই তো কেন ডেকে পাঠিয়েছি। শুন মেয়ে মা শা আল্লাহ যথেষ্ট ভালো। তোর বড় মামা মেয়ের খোঁজ পেয়েছে। ওর বাবা তোর মামার সাথে একই অফিসে চাকরি করে ”
” মা আমি এখন বিয়ে করব না “, ককিয়ে উঠলো মাহমুদ।
” কি বললি তুই? আবার বল। একদম ঠ্যাং ভেঙে দেব ”
মায়ের রাগ দেখে মাহমুদ ফুঁস করে দমে গেল৷ জানে মা সবসময় ভালো শুধু রেগে গেলেই আর রক্ষে নেই। নাজমা আগের কথার খেঁই ধরলেন।
” ওখানে একলা একা না খেয়ে অযত্নে রোগা হবি, সেসব আর হচ্ছে না। তোর মামা বলেছে মেয়ে পর্দানশীন। নামাজ কালাম মা শা আল্লাহ… ”
নাজমা সবিস্তারে মেয়ে ও তার পরিবারের বর্ণনা দিয়ে গেলেন। তার কিছু কথা মাহমুদের কানে ঢুকলো আর কিছু অন্যমনস্কতায় এক কান দিয়ে প্রবেশ করে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে গেল। সেদিন রাতে মামা এসে আরেক দফায় বুঝিয়ে গেলেন। মা আর মামা মিলে ঠিক করলেন আগামী শুক্রবার মেয়ে দেখতে যাবেন। মাহমুদ কখনো মামার কথার ওপর কথা বলার সাহস করেনি। এবারও সে মৌনতা অবলম্বন করে গেল।
মেয়ে দেখার পর কানের কাছে মা আর বোন দুইজনের উপচে পড়া প্রশংসা ক্রমেই বিরক্ত বোধ বাড়িয়ে দিচ্ছিলো ওর। মেয়েকে সে ভালো করে দেখেনি। তার বারবার মনে হচ্ছে শান্তাকে এ সম্পর্কে জানানো জরুরি। মাহমুদের নিরাসক্ত ভাবভঙ্গি নাজমার কাছে ভালো ঠেকছিল না। তিনি বারবার ছেলের কাছে মেয়েটির গুণগান গাইতে থাকলেন। শেষে আর না পেরে বলে বসলেন,
” আচ্ছা এ মেয়ে ভালো না লাগলে অন্য মেয়ে দেখি? ”
” আমাকে কিছুদিন ভাবার সময় দেও ”
নাজমা নিশ্চিন্তমনে দিবানিদ্রার আয়োজন করতে করতে বললেন,
” আচ্ছা ভাব আজকে। কাল জানিয়ে দিস ”
মাহমুদ বিরক্তবোধ করলো।
” একদিনে হবে না। আমি মাত্র তিনদিনের ছুটি নিয়ে এসেছি। আজই যেতে হবে ”
নাজমা বিছানায় বসে ছেলের দিকে সরু চোখে চাইলেন।
” তুই ওখানে যাবি তারপর কয়েকদিন ভেবে জানাবি মেয়ে পছন্দ হয়েছে কিনা? ওরা বসে থাকবে এতদিন উত্তরের অপেক্ষায়? ”
” তাহলে এখন কি করব? তুমি বলো আম্মা। আমার ছুটি শেষ। কালকেই কাজে যোগ দিতে হবে ”
ছেলের হেয়ালি পর্যবেক্ষণ করে ক্রোধে রঞ্জিত হলো নাজমার চোখ। ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন,
” তোর যা ইচ্ছে তাই কর! ”
মাহমুদ মায়ের রাগের তোয়াক্কা না করে উঠে এলো সামনে থেকে। তার মা বরাবরই একগুঁয়ে মানুষ। নিজে যা বলবে তাই হবে। সেদিন বিকেলেই গৌরিপুর চলে এলো সে। দু’দিন পর আবারও মায়ের চিঠি। এদিকে এই চার-পাঁচদিনে শান্তার কাছ থেকে একটাও চিঠি আসেনি। মাহমুদ তবু প্রতিদিনই চিঠি পাঠাতে লাগলো জবাবের আশায়। ওইদিকে মা মাথা পাগল করে দিচ্ছে মেয়ের বাড়িতে উত্তর পাঠাতে হবে বলে। এক সপ্তাহ অপেক্ষার পরও শান্তার কাছ থেকে কোনো প্রতিত্তোর না পেয়ে অবশেষে মাকে সে বলে দিল, এই বিয়েতে তার অমত নেই।
***
নিজের ঘরে পড়ছিলো শান্তা৷ কাজের মেয়েটা আচম্বিতে উত্তেজিত ভঙ্গিতে দৌড়ে এসে জানাল আনোয়ার সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কেমন যেন করছেন। শান্তা ছুটে গেল বাবার কাছে। আনোয়ার সাহেব বুকে হাত চেপে বসে আছেন বিছানার একপাশে। শ্বাসকষ্টের কারণে কথা বলতে পারছিলেন না। দিশা না পেয়ে শান্তা খালামনিকে ফোন করলো। খালুজান আর খালামনি এসে আনোয়ার সাহেবকে হাসপাতালে নেবার ব্যবস্থা করলেন অতিসত্বর। আর কখনো বাবার প্যানিক অ্যাটাক হতে দেখেনি শান্তা। চোখের সামনে বাবাকে এতটা অসুস্থ হতে দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলো সে। বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করবার পর আতঙ্কে বিমূঢ় হয়ে সে বাইরের চেয়ারে বসে রইলো মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে। বারবার মনে হচ্ছিলো, বাবা ছাড়া খুব কাছের আর কেউ তো নেই তার। বাবার কিছু হয়ে গেলে এত পৃথিবীটায় ভীষণ একা হয়ে পড়বে সে। বাবা থাকবে না একদিন এ কথাটাই ভাবতে পারছিলো না একবারের জন্যও।
আনোয়ার সাহেবকে বেশ কয়দিন থাকতে হলো হাসপাতালে। শান্তা রইলো তার সঙ্গেই। বাবার বিছানার ওপর পাশেই ওর বিছানা। অসুস্থ শরীর নিয়ে বাবা ঘুমিয়ে থাকেন বেশিরভাগ সময়ে। হাসপাতালের এই চার দেয়ালের মাঝে ঘুম আসতে চায় না তার। নিদ্রা যেন ছুটি নিয়েছে। রাত হলেই কাঁচের জানালা খুলে বিছানার এককোনায় বসে বসে কত কি ভাবে সে। মন পড়ে থাকে বাড়ির ডাকবাক্সটায়। নিয়ম করে নিশ্চয়ই চিঠি এসেছিলো কয়েকদিন। প্রতিত্তোর না পেয়ে হয়তো আসা বন্ধ হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। বাবার কথা চিন্তা করে সারাটাক্ষন মন খারাপ থাকে ওর। দিনের বেলায় খালামনি আসে। ওকে সঙ্গ দেয়। আর বোঝাবার চেষ্টা করে বাবার এই প্যানিক অ্যাটাক তার প্রতি দুশ্চিন্তা থেকেই হয়েছে৷ তাই তার উচিত বাবার দুশ্চিন্তা অপনয়নের প্রচেষ্টা করা। শান্তা ভেবে পায় না কি করবে। বাবাকে কি মাহমুদের কথা বলে দেয়া উচিত? বাবা কি মানবে তার আদরের কন্যাকে এক সামান্য স্টেশন মাস্টারের হাতে তুলে দিতে? আর মাহমুদ? সে কি শান্তাকে পছন্দ করে নাকি শুধুমাত্র একজন চিঠি-বন্ধু মনে করে তা সে বুঝে উঠতে পারেনি এতদিনেও। মাহমুদের কাছ থেকে কখনো এমনতর ইঙ্গিত পায়নি সে।
হাসপাতালের পুরোটা সময় দুশ্চিন্তা নিয়ে কেটেছে তার। ছাড়পত্র পাওয়া মাত্রই বাবাকে বাড়ি নিয়ে এলো। দিনটা একরকম ব্যস্ততায় কাটার পর রাতের বেলা হঠাৎ চিঠির কথা মনে পড়লো৷ উৎকন্ঠা নিয়ে শান্তা যখন ডাকবাক্সের দরজা খুলল, দেখলো ভেতরে সব ফাঁকা। একটা চিঠিও নেই। মনে হলো মাথার মধ্যে ভারী কোনো বস্তু দ্বারা আঘাত করেছে পেছন থেকে কেউ। চিঠিগুলো গেল কোথায়? কাজের লোক তো কখনো ডাকবাক্স খুলে চিঠি নেবার সাহস করবে না। সুযোগ বুঝে সে যখন কাজের মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলো। জানতে পারলো, খালামনি আগের দিন এসে ঘর পরিষ্কার করিয়েছে। তখনই পুরনো, অপ্রয়োজনীয় চিঠি বলে সেগুলো ফেলে দিয়েছে। শান্তার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো। দুশ্চিন্তায় মুখ এটুকুন হয়ে গেল এই ভেবে যে হয়তো খালামনি চিঠিগুলো পড়েছে। শান্তা কয়েকদিন নিশ্চুপ থেকে খালামনির প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার অপেক্ষা করছিল। কিন্তু অপরপক্ষের কোনো রা নেই দেখে নিশ্চিত হলো চিঠিগুলো না পড়েই ফেলা হয়েছে। বাবা পুরোপুরি সুস্থ হতেই সে অনেক কষ্টেসৃষ্টে তাকো দাদুর বাড়ি যাবার জন্য রাজি করিয়েছে। দাদাজানের বাড়ি থেকে পরদিন মাহমুদকে চমকে দেবে বলে একাই রওয়ানা হলো সে। কে জানতো সবচেয়ে বড় আঘতটি সেখানে অপেক্ষা করছে।
এতদিন পর শান্তা ফিরে আসবে বলে আশা করেনি মাহমুদ। হঠাৎ ওকে দেখে অবাক হলো। দু-একটা সৌজন্যমূলক কথা বলবার পর মাহমুদের বিয়ের কথা জানার পর শান্তার মুখ থেকে হাসি সরে গেল। আকস্মিক ঘটনার বিপুলতায় বিমুঢ় হয়ে রইলো সে কিয়ৎক্ষন। ভেবে এসেছিলো মাহমুদকে বলবে বাবার সঙ্গে কথা বলতে। ভীষণ অস্থিরমতি মেয়েটার ছোট্ট সজীব হৃদয়টাকে কে যেন দুমড়ে মুচড়ে দিল অদৃশ্য শক্তিতে। হাহাকারের নিনাদ সুর তুলল হাওয়ার বেগে। আচম্বিতে ওর ভিন্ন প্রতিক্রিয়ায় মাহমুদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বিবর্ন, ফ্যাকাসে মুখে চেয়ে রইলো সে। বুঝতে পারছিল না কি করে উঠবে। হঠাৎ কান্নার হেতু কি এই ছোট মেয়েটার তা বোধগম্য হতে বেশ দেরি হলো ওর। শান্তা তখন কাঁদতে লাগলো স্বপ্নভঙ্গের জ্বালায় ছারখার হয়ে যাওয়া মন নিয়ে। বাবার আদর আর মায়ের প্রতি ঘৃণা নিয়ে বড় হওয়া মেয়েটা দ্বিতীয়বারের মতো প্রচন্ড ধাক্কা খেল। ছোটবেলায় কেউ যখন ওকে জিজ্ঞেস করতো, ” শান্তা, তোমার মা শুনেছি পালিয়ে গেছে। তা কি সত্যি? ” তখন মায়ের প্রতি অবাধ আক্রোশে ওর ইচ্ছে করতো ছুটে পালিয়ে যায় দূরে কোথাও। যেখানে এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না তাকে। যে মা নিজের ছোট মেয়েটার কথা ভাবলো না৷ একটা অন্য লোকের জন্য নিজের সন্তানকে ফেলে চলে গেছে অবহেলায় করে তাকে শান্তা আর কখনো ভালোবাসেনি। বাবাই হয়ে ওঠে তার একমাত্র আশ্রয়। আর আজ সে আবারও একটা অসহনীয় আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হলো। তার জীবনটা কেন এমন? যাদেরকে তার খুব দরকার ছিল সে মানুষগুলোই কেন তার সঙ্গে এমন করে? দুর্দমনীয় আক্রোশে চনমনিয়ে উঠলো ওর মাথার ভেতর৷ বারবার পাগলের প্রলাপের মতো জিজ্ঞেস করতে লাগলো,
” কেন এমন করলে তুমি? কেন করলে? ”
মাহমুদ হতবাক হয়ে গিয়েছিল। শান্তার সঙ্গে সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল না। তবু মেয়েটার কান্না দেখে মায়া হলো খুব। তার প্রতি এতটা আবেগ শান্তা পুষে রেখেছিলো সে তা ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। মাহমুদ আকুল হয়ে ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলো।
” তুমি আমার প্রতি কি ধরনের অনুভূতি পোষণ করেছিলে তা আমি বুঝতে পারিনি।বিশ্বাস করো আমার কোনো দোষ ছিল না। আমি তো তোমাকে নিয়ে তেমন কিছু কখনো ভাবিনি… তোমাকে আঘাত দিতে আমি চাইনি…”
শান্তা কেঁদে চললো অবিরাম। মাহমুদ অপ্রতিভ বোধ করছিলো। মেয়েটা যে সত্যি তাকে নিয়ে এতো গভীরভাবে ভেবেছে এটা উপলব্ধি হয়নি কখনো। তবুও প্রবোধ দেবার জন্য বলল,
” আমি কি করব বলো? আমি তো তোমাকে চিঠির পর চিঠি দিয়েছি। তুমি চিঠির উত্তর দেওনি ”
শান্তা কান্নারহিত গলায় জানালো চিঠির উত্তর না দেবার কারণ। অভিযোগ করতে লাগলো ছেলে হয়ে মাহমুদ বিয়ে আটকাতে পারলো না কেন। মাহমুদ সত্য কথাই বলল। সে বিয়ে করতে চায়নি সত্যি। তবে শান্তাকে বিয়ে করবে এমনটাও চিন্তা করেনি কখনো। শান্তা তার জীবনে একজন বন্ধুর মতো ছিল বলে সে শুধু এ সম্পর্কে জানাতে চেয়েছিল তাকে। যদি শান্তা সব শুনে রাজি থাকতো হয়তো বা সে বাবা-মাকে তার কথা জানাতো। তাই বললো,
” তোমার কথা যে বলব কিসের ভরসায় বলতো? ”
শান্তা ধপ করে টুলের ওপর বসে পড়লো। গালবেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে তখনও৷ মাহমুদ হাঁটু গেড়ে বসে ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলো।
ভেতরের এই খন্ডচিত্র গুলোই কেউ একজনের হৃদয়কে অজস্র আঘাতে জর্জরিত করে দিচ্ছিলো তখন। সে জানে না ভেতরকার কথা। সে শুধুই তাই দেখেছে যা চোখের সামনে হচ্ছিলো। প্রবল অভিমানে সে চলে এসেছিল সে জায়গা ছেড়ে। কিছুক্ষণ পর শান্তা বেরিয়ে গেল ঝড়ের বেগে। মাহমুদ বসে রইলো স্থবিরের মতো বিমূঢ় হয়ে। যখন জানলো তনুর কথা তখন আকাশ সমান পীড়া ওকে ডুবিয়ে দিচ্ছিলো অকাতরে, বিষাদ বদনে। সে ছুটে গিয়েছিল বাইরে। বাইরের প্রচন্ড বারিপাতের মধ্যে দৃষ্টিগোচর হলো না তনু। মাহমুদ নিজেকে ধীক্কার দিতে লাগলো বারংবার। শান্তা এখন তাকে ঘৃণা করবে আর তনুও চলে গেল ভুল বুঝে। কি করবে এখন সে? তার কষ্টগুলো নিয়ে সে কার কাছে ভীড়বে?
চলবে ইন শা আল্লাহ….