এমন দিনে তারে বলা যায়
পর্বঃ ১৭
সানজিদা মাহি
_____________________________________
যদি আজ বিকেলের ডাকে
তার কোনো চিঠি পাই ?
যদি সে নিজেই এসে থাকে ?
যদি তার এত কাল পরে মনে হয়
দেরি হোক, যায়নি সময় ?*
আজ মনটা বেশ ফুরফুরে তনুর। প্রজাপতিরা পেলুব রোদ্দুর গায়ে মেখে ডানা ঝাপটে ঝাপটে যেভাবে ফুলের সৌন্দর্যকে কবুল করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে ঠিক তেমনি তনুর মনের প্রজাপতিরা দলবদ্ধ হয়ে ডানা ঝাপটে উড়ছে অতি দাপটের সঙ্গে। এই তো সে কান পেতে প্রজাপতির ডানা ঝাপটানি শুনতে পাচ্ছে। শব্দটা কেমন শুনতে? ঝিরঝির ঝিরঝির? নাকি রিমঝিম ঝিমরিম? তনু বুঝতে পারছে না। তবে তা নিয়ে সে চিন্তিতও নয়। সে যদি বিনুর মতো হতো তবে নিশ্চয়ই খুশিতে কয়েকটা লাফ দিয়ে ফেলতো!
ঘটনা হচ্ছে আজ সকালেই পিয়ন তনুর নামে একটা চিঠি দিয়ে গেছে। খামের ওপরে প্রেরকের নামটা দেখে তনু আর ফরিদার মুখটা ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করলো তৎক্ষনাৎ। চিঠিটা পিয়নের হাত থেকে বাবাই এনে দিয়েছিলেন তাকে। চিঠি দেবার সময় বাবা কেমন একটা সলজ্জ হাসি দিয়েছিলো সেটা দেখে বাবার প্রতি খানিকটা করুণার হলো ওর। চকিতে মুখ তুলে দেখলো ঘরের আরও দুটি প্রাণ সোৎসাহে চেয়ে আছে চিঠিটার দিকে। তনয়ের চোখে শিশুসুলভ আগ্রহ আর বিনয়ের ঠোঁটে রহস্যময় হাসি৷ ওইদিকে তনুর বুকের ঢিপঢিপানি তখন ঝড়ের গতিতে বেড়ে চলেছে। নিজের মনের তোলপাড় করা ঝড়ের ভাবগতি পাছে প্রকাশ হয়ে পড়ে তাই তড়িঘড়ি করে সেখান থেকে একপ্রকার পালিয়ে এলো। চিঠি নিয়ে বসে রইলো আধঘন্টার মতো৷ মস্তিষ্কে আকাশ পাতাল ভাবনার উদ্রেক। ভয়ে খাম ছিঁড়ে চিঠিটা পড়তেও পারছে না। যদি ভয়ঙ্কর কিছু লেখা থাকে ওতে? টের পেল ভয়ের চোটে ওর পা শিরশির করছে। কি মুশকিল কি করবে এখন? সিদ্ধান্ত নিল চিঠিটা এখনই পড়বে না৷ বালিশ উঠিয়ে তার তলায় চিঠিটা রেখে বালিশ চাপা দিল। কিন্তু শান্তি লাগছে না মনে৷ চোখজোড়া ও বদের হাড্ডি। ঘুরেঘুরে তার ওইদিকেই ফিরা চাই৷ অবশেষে মনকে খুব করে শাসিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে ছিঁড়ে ফেলল খাম। মনের একপাশ বলছে, তনু পড়িস না কিছুতেই ওই চিঠি। পড়লেই তোর পৃথিবীতে ভূমিকম্প নেমে আসবে ঠায়। অন্যপাশ বলছে, ভয় পেলে চলবে না তনু৷ চিঠি না পড়লে তো আর চিঠির কথাগুলো বদলে যাবে না৷ এখন হোক পরে হোক জানতে তো তোমাকে হবেই। চিঠি খুলে মন ও মস্তিষ্কে প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ের শো শো শব্দকে উপেক্ষা করে তনু চিঠি পড়তে লাগলো।
প্রিয়তমেষু,
এমন সুন্দর সম্বোধনে ডাকার আমার কি কোনো অধিকার আছে? কখনো তো অধিকার খাটাইনি। আজ না হয় সম্বোধন দিয়েই করলাম নিজের প্রথম অধিকার ফলানো পথচেষ্টার অভ্যর্থনা।
চোখ যা দেখে তার বাইরে অনেককিছু দেখে না। আর অদেখা জিনিসে লুকিয়ে থাকে সত্যিকার বিষয়বস্তু। হয়তো সবসময় নয় তবে কখনো কখনো অবশ্যই। যদি আমাকে কাপুরুষের উপাধি দিয়ে থাকেন ইতোমধ্যে, তবে ভুল করেননি৷ আপনার স্বামী একজন বিরাট কাপুরুষ। হয়তো আপনি বাড়ি গিয়ে সমস্ত জানিয়েছেন নিজের পরিবারকে। আমি জানি না পরিস্থিতি কতটা বিগড়েছে। তবে এখন পর্যন্ত আপনার পরিবার থেকে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করার জন্য আমার পরিবার কিংবা আমার সাথে এখন পর্যন্ত কেন যোগাযোগ করা হয়নি কেন জানি না৷ শীঘ্রই ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটাতে আমি আসব। আমাকে হয়তো আপনার দরকার নেই। কিন্তু আপনাকে আমার ভীষণভাবে প্রয়োজন।
তনু, আমার প্রতি সামান্য একটু বিশ্বাস কি রাখা যায়? বেশি না সামান্য একটু?
ইতি
মাহমুদ
***
তনু আজ নিজ হাতে রান্না করবে বলে মাকে রান্নাঘরে আসতে দেয়নি। বাবা অফিস যাবার আগে রাস্তার ভ্যানগাড়ি থেকে থেকে চিংড়ি মাছ কিনে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছেন । সেগুলো সজনের ডাটা দিয়ে রান্না করবে। আর থাকবে মসুরের ডাল, বুটের ডালের বড়া, গোল করে বেগুন ভাজা। তনু দেখেছে কিভাবে তৃপ্তির সঙ্গে কর্তামশাই এসব সাধারণ খাবারগুলো খেতেন। মানুষটা অন্যরকম। খেতে পছন্দ করেন ঠিক, তবে অতি সাধারণ জিনিস সব। এরকম মানুষকে খাইয়ে কার পক্ষে তৃপ্তি না পাওয়া সম্ভব? তনু সজনের ডাটা কাটতে কাটতে গল্প করে কাল্পনিক কর্তা মশাইয়ের সঙ্গে। এই যে এতদিন তনু ওখানে নেই। কর্তা মশাই কি নিজ হাতে ঠিকমতো রান্না করে খেতে পারছে? আচ্ছা আলসেমি করে রাতে রান্নার ভয়ে না খেয়ে শুয়ে পড়ছে না তো? বৃষ্টিতে ভিজে সর্দি হলো না তো? তনু একেকবার প্রশ্ন করে। একেকবার অভিমানে মুখ বাঁকায়। একেকবার সলজ্জ ভঙিতে মাথা নিচু করে। গল্প করতে করতেই তনুর রান্না শেষ হয়ে যায়। কিন্তু গল্প শেষ হয় না। এতদিন কত কথা সে জমিয়ে রেখেছে। সেসব কি আর পেটে থাকতে চায়? মা এসে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, ” কার সঙ্গে কথা বলছো তনু? ”
তনু থমকায়। মুহূর্তে কল্পনার গৌরীপুর বাস্তবের নিজের বাড়িতে পরিণত হয়। একটু আগের হাসি হাসি মুখটা থমথম করতে থাকে মন খারাপের সুর তুলে।
” না মা এমনি ”
তনু চলে আসে নিজের ঘরে। বিছানায় উপুড় হয়ে বালিশ চেপে ধরে কাঁদে। কেউ কি জানে তার কারণ? তনু নিজেও কি জানে?
দিনের মধ্যে অন্তত পনের-বিশবার এক চিঠি পড়া হয়েছে। এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে কোথায় দাঁড়ি, কোথায় কমা আছে সব তার মুখস্থ হয়ে গেছে। তবু হাতে লেখা চিঠিটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে কি যে ভালো লাগে! কাগজের প্রতিটা জায়গাজুড়ে ওই মানুষটার হাতের ছোঁয়া যেন এখনো লেগে আছে৷ চিঠি হাতে তনু দেখতে পায় কর্তামশাই জানালার ধারের টেবিলটায় বসে অতি মনোযোগের সহিত চিঠি লিখছে। কপালের ওপর বিন্দু বিন্দু রুপোলি রাঙা ঘাম যেন আকাশ হতে বর্ষনের আরেকরকম রূপ ছায়া। বড় বড় কয়েক টা সরু গোছার চুল এসে ছুঁয়ে আছে কপাল। চোখ দুটোতে উদ্রেক, বিস্ময়, উত্তেজনা আর একটুখানি প্রেম স্নিক্ত চাহনি। গাঢ় কৃষ্ণ নয়ন মনিতে প্রতীক্ষার অধীরতা। ভাবতে ভাবতে আরেক দফায় চিঠিটা পড়া হয়ে যায়। তবু প্রতিবার নতুন লাগে। মনে হয়, একই কথা বারবার নতুনত্ব ধারণ করতে জানে।
গভীর রাতে তনুর ঘুম হালকা হয়ে যায়। তন্দ্রার মধ্যে সে স্বপ্ন দেখে। উথলে পড়া জোছনা বৃষ্টি গায়ে মেখে সুরিয়া নদীতে একটি ছোট্ট ডিঙিতে বসে আছে সে আর তার কর্তা মশাই। কর্তা মশাইয়ের হাতে বৈঠা। জলের মাঝে ছলাৎছলাৎ শব্দ তুলে ছোট ডিঙিটি একটু একটু করে দুলতে দুলতে সামনে এগোচ্ছে। মিষ্টি বাতাস এসে সন্তোর্পনে গা ছুঁয়ে দেয়৷ জোছনায় জলেরা মেতেছে আলোর স্নানে। কর্তামশাই হঠাৎ পাটাতন থেকে একগুচ্ছ কদম ফুল তুলে নেয়। বাড়িয়ে দেয় তনুর দিকে। তনু ফুলগুলো নিয়ে নাকের কাছে এনে শুঁকতে থাকে। টের পায় একটা নেশা ধরানো মাতাল ঘ্রাণ৷ এ রাত্রিরে তাজা কদমফুল একটা অস্বাভাবিক বিষয়। তনু গৌরীপুর থাকাকালে বাড়ির আশেপাশে কদম ফুলের গাছ দেখেনি। কিন্তু স্বপ্নে সবই স্বাভাবিক। এই যে কর্তামশাই মনেমুগ্ধের মতো তার দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছে তাও স্বাভাবিক। হঠাৎ খেয়াল হয় কর্তামশাই ওর ঠিক গা ঘেঁষে বসা। তার বাড়িয়ে দেওয়া হাতে নিজের হাত রাখতে যায় তনু। মনে হয় সে খুব দূরে সরে যাচ্ছে। কর্তামশাইয়ের সঙ্গে ওর দূরত্ব ক্রমেই বাড়তে থাকে…..
_________________________
মাহমুদ চুলায় ভাত বসিয়েছে। স্টোভের চুলার উপর মাঝারি আঁচে ভাত ফুটছে। প্রায়ান্ধকার ঘরে অদূরে হারিকেনের টিমটিমে আলো আর পাশেই চুলার মৃদু তেজ ঠান্ডা পরিবেশকে বেশ উষ্ণতা দিয়েছে। মাহমুদ বসেছে একটা কাঠের পিঁড়ির ওপর। চুলার কমলা আলোয় মুখের একপাশটা অত্যুজ্জ্বল। আজ জ্বর কমেছে অনেকটা। প্রতিদিন দুপুরে নজুর বাড়ি থেকে দুপুর আর রাতের জন্য খাবার আসে। আজও এসেছে। মাহমুদ বলে রেখেছিলো ভাত যেন শুধু দুপুরের জন্য দেয়। ভাতটা গরম গরম খেতেই মজা। আজ নজুর মা তেলাপিয়া মাছ ভুনা আর মসুরের ডাল পাঠিয়েছে। কিন্তু মাহমুদের ইচ্ছে করছে কচুর ছড়ার ভর্তা দিয়ে মাড়সহ গরম ভাত মাখিয়ে খেতে। কিন্তু এই মৌসুমে কচুর ছড়া পাওয়া যায় না৷ এই অদ্ভুত খাবারটা সে খেয়েছিল আপার বাসায়৷ দুলাভাই একদিন বলল,
” মাহমুদ সারাদিন তো খালি মাছ- মাংস খাও। একটা ইন্টারেস্টিং খাবার খাও আমার সাথে আজ ”
আপা হেসে বলেছিল, ” ইশ কি এক ইন্টারেস্টিং খাবার। আমি ভয় পাচ্ছি মাহমুদ না আবার খেতে বসে নাক সিঁটকায় ”
মাহমুদ নাক সিঁটাকয়নি। বরং সেদিন এই ভর্তা দিয়েই দুই প্লেট ভাত খেয়েছে। তনুকে একদিন নিজের হাতে বানিয়ে খাওয়াতে হবে। সেও মাছ-মাংস তেমন পছন্দ করে না। তনুর কথা মনে পড়তেই মনের আকাশে আষাঢ়ের ঘন কৃষ্ণ মেঘ জমতে লাগলো। এতমাস সে একা এখানে থেকেছে অথচ কখনো নিজেকে নিঃস্ব মনে হয়নি। কিন্তু তনু চলে যাওয়ার পর যেদিন বাড়ি ফিরে এলো। মনে হলো, এই দুই কামড়ার ঘরের মধ্যে বিশাল কিছু একটা নেই। যার দরুন বিরাট ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছে৷ গৃহকর্ত্রী চলে যেতেই গোছালো ঘরটা দেখতে দেখতে অগোছালো, অপরিষ্কার হতে সময় নেয়নি বেশি। রাণী ছাড়া রাজা আর রাজ্য থেকেও ঠিক না থাকার মতো।
তনু নামটা মনে পড়লেই চোখে ভাসে হাসি হাসি লাজুক মুখের, শান্ত চোখের অধিকারীনী এক পবিত্র মানবী। একপাশে বেণুনি করা চুল। কপাল বেয়ে নেমে আসা খুচরো কিছু চুলের অবাধ্যতা, মৃদু প্রভঞ্জনে কম্পনরত নেত্রপল্লব। প্রতিরাতে ঘুমাবার আগে কিছু একটা দারুণভাবে মিস করতো মাহমুদ। মনে পড়লো সেটা ছিল তনুর চুড়ির টুংটাং শব্দ। তনু যখন আশেপাশে ঘুরে বেড়াতো মনে হতো তার একান্ত কিছু একটা অন্তত আছে। কেউ একজন আছে খুব আপন৷ মনে পড়লো ফুফুজানের বাড়িতে বৃষ্টিভেজা সে দুপুরটার কথা। ঘুমাচ্ছিলো সে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় উঠে বসেছিলো। জানালার বাইরে দেখতে পেল পুকুরের সিঁড়িতে বসে পানিতে পা ভিজিয়ে রেখেছে তনু৷ বৃষ্টিতে ভেজা চুলগুলো লেপ্টে ছিল পিঠের সাথে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে একটা স্নিগ্ধময়ী নারী অবয়ব সামনে তাকিয়ে কি দেখছিলো? আরেকটু ভালো করে দেখার জন্য মাহমুদ জানালার কাছে উঠে এসেছিলো। দেখতে পেল পুকুরের মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজে বাচ্চাদের হুটোপুটি। আর খুব সুক্ষ একটা রিমিঝিম শব্দ। কিসের সেটা? তনুর হাসির? তনু এতো সুন্দর করে হাসতে জানে? সেই মুহূর্তে মাহমুদের মনে হয়েছিলো এই হাসির শব্দটাকে সে বয়ামে বন্দি করে রাখতে চায়। কানে এসে বিরামহীন বাজতে লাগলো বৃষ্টির রিমঝিম ছন্দতালের সঙ্গে রিমঝিম হাসির নিক্কণ। তনু আর সে যখন প্রথমদিন ট্রেনে চড়ে এই গৌরিপুর আসছিলো সেদিনও ছিল ভীষণ বৃষ্টি। মাহমুদ কখনো সিগারেট খায় না। কিন্তু সেদিন এক প্যাকেট সিগারেট সঙ্গে নিয়েছিল। স্নায়ুর উষ্ণতা আর ইতস্তত ভাব লুকোতে বারবার গিয়ে সিগারেটে টান দিচ্ছিলো। যতবার সে কেবিনে ঢুকেছে তনু নাকমুখ কুঁচকে কেমন করে ওরদিকে তাকিয়ে রইলো৷ প্রথমে বুঝতে পারেনি কারণ। পরে বুঝতে পেরে মনে মনে লজ্জিত হলো। ট্রেনের দরজা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল সিগারেটের বাক্সটা।
আজকাল এসব ভেবেই দিবসরজনী কাটছে মাহমুদের। কি ভীষণ এক ভুলে পেয়েও হারাতে হলো আপন মানুষ৷ শুধু কি মায়ের একগুঁয়েমি আর শান্তার প্রতি প্রচ্ছন্ন মায়াই কি এর জন্য দায়ী? শান্তা যে একটা মায়া ছাড়া কিছুই না সে কথাটা বুঝতেও দেরি হলো ঢের। সেও তনু চলে যাওয়াতেই। মাহমুদের ধারণা ছিল সে বোধহয় মনে মনে তনুর স্থলে শান্তাকেই চেয়েছিলো। তাই তো প্রথম থেকেই তনুকে সরিয়ে রেখেছিলো ধরাছোঁয়ার বাইরে অনেকটা দূরে। তবুও মেয়েটা কিছু না করেই ওকে নিজের অপাপবিব্ধ মন দিয়ে মায়ায় জড়িয়ে নিল অন্তর্হিত বাঁধনে।
শান্তার ছোট জীবনে একটা বড় কষ্ট ছিল মাকে নিয়ে। যে কষ্টটা সে সবার থেকে আড়াল করে রাখতো আলগোছে। শুধু মাহমুদকে কাছের একজন মনে করে গচ্ছিত রেখেছিল সমস্ত বেদনা৷ শেষের চিঠিগুলোতে মাহমুদের প্রতি তার অনুভূতি থাকতো প্রচ্ছন্নভাবে। সে কথাগুলোই হয়তো ওকে বিশ্বাস করিয়েছে সেও কিছুটা শান্তাকে চায়। মেয়েটাকে শুরু থেকে প্রশ্রয় না দিলে আজ এ পর্যন্ত পানি গড়াতো না। তনু একদিন কথায় কথায় বলেছিলো, ” মানুষ মনে করে সে আল্লাহর নিষেধ অমান্য করে তাঁকে ধোঁকা দিচ্ছে। অথচ মানুষ নিজের কর্ম দ্বারা নিজেকেই ধোঁকা দেয়। আর সৃষ্টিকর্তা তো তার নিজের মঙ্গলের জন্য নিয়ম তৈরি করে দিয়েছেন। যে প্রভুর দাসত্ব স্বীকার করে না সে স্পষ্টত নিজের প্রবৃত্তির দাস “। মাহমুদ যদি নিজের জীবনে এসব সংকোচযুক্ত ঘটনাবলী ঘটার সুযোগ না দিত তবে শুরু থেকেই তনুর সাথে তার পথচলাটা অমায়িক হতো। নিজের এই ভুল তাকে এখন নিজেকেই শুধরে নিতে হবে। যদিও জানে না আদৌও পারবে কিনা।
ভাতের মাড় উপচে পড়ার শব্দে মাহমুদের ধ্যানগ্রস্থ মনের সম্বিত ফিরলো। ভাতের মেড়ে গেলে তরকারি গরম করে নিল। বাইরে বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। বৃষ্টি ছিটকে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে জানালার সম্মুখে রাখা টেবিলকে। মাহমুদ তড়িৎ গতিতে টেবিলটাকে জানালার কাছ হতে দেয়াল বরাবর সরিয়ে রাখলো। জানালাটা বন্ধ করলো না। তনুর অভ্যাস ছিল জানালা সবসময় খোলা রাখা। সেই অভ্যাসটা এখন তার নিজের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে অজ্ঞাতসারে। মাহমুদ ঘড়ি দেখলো। সাড়ে আটটা বাজে। তারমানে এশার সালাতের সময় হয়ে গেছে। অজু করে সালাত শেষ করে রান্নাঘরের মেঝেতে ছোট শীতলপাটি বিছিয়ে খেতে বসলো। আজ যদি তনু থাকতো তবে তনু নিশ্চয়ই বরাবরের মতো সামনে বসে ওর খাওয়া দেখতো। মাহমুদ যখন খেতে বসে তখন ওর চোরা চোখের চাহনীটা নজর এড়ায় না তার। যদিও একদমই বুঝতে দেয় না। খাওয়ার সময় কেউ চেয়ে আছে বুঝতে পারলে প্রচন্ড অস্বস্তি হতো ওর। অথচ তনু যখন আড়চোখে চেয়ে থাকে তখন কেমন যেন একটা শিহরণ কাজ করে। মেয়েটা এমন কেন? কিছু না করেও মন জিতে নেয়!
বাইরে একসুরে ছন্দতুলে বৃষ্টির পতনের শব্দ ভেসে আসছে। জানালা দিয়ে বৃষ্টি এসে মেঝে অনেকখানি ভিজিয়ে দিয়েছে৷ মাহমুদ সেখানে একটা কাপড় বিছিয়ে দিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো।
গতকাল খুব সাহস করে চিঠি পাঠিয়েছিলো সে তনুকে। চিঠি পড়ে মেয়েটার প্রতিক্রিয়া কেমন হয়েছে তা জানতে ইচ্ছে করছে খুব। তনু কি ওকে সত্যিই প্রচন্ড ঘৃণা করে? পিঙ্গল তনুখানি চোখের সামনে এসে পড়লে মনে হয় ওইরকম একজন মানুষ কখনো কাউকে ঘৃণা করতে পারে না। কিন্তু যে কষ্ট সে তাকে দিয়েছে সে কষ্ট হতে সৃষ্ট ক্ষতকে কি দিয়ে প্রলেপ দেবে? তনু যদি ওকে ফিরিয়ে দেয়? এরকম কাপুরুষ বরকে গ্রহণ করতে যদি অপারগ হয়? নেতিবাচক কিছু ভাবলেই ওর বুক ধড়ফড় করে। হারানোর শঙ্কা যদি আগে হতো তবে এ ধরনের ভুল সে ইহজীবনেও করতো না। মাহমুদ দুইহাতে নিজের কানের লতি ধরে শাঁসালো নিজেকে৷ মনে মনে বললো, শিক্ষা হয়েছে এবার তোর? মাহমুদ পাশ ফিরলো। তনুর বালিশটাকে পাশ বালিশ বানিয়ে জড়িয়ে রাখলো। আশ্চর্যজনক ভাবে খেয়াল করলো বালিশটা থেকে তনুর চুলের ঘ্রাণ আসছে। বালিশটার উপরিভাগকে মনে হচ্ছে তনুর কৃষ্ণকায় কেশ ৷ আর গোটা বালিশটাই যেন তনু৷ মাহমুদ আনমনে হেসে ফেলল। ইশ আজ মনে হচ্ছে ঘুম আসবে না!
একা বিছানায় ঘুম চোখে নেই –
শুয়ে শুনি হাওয়া ডেকে ডেকে যায়
যেন মনে হয়, আজ রাত্রিতে এখানে আসার
কত কাল থেকে রক্তে আমার কথা ছিল কার!*
চলবে ইন শা আল্লাহ…