এরই মাঝে পর্ব-০৪

0
110

#এরই_মাঝে
#পর্ব-৪

বিদায়বেলায় অভিমানে দাদুর থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিলো শায়লা। তৈয়ব মাওলানা সে অভিমান ভাঙার কোন চেষ্টা করলো না। কেবল নাতনির মাথায় হাত রেখে বললো-“মন দিয়ে পড়ালেখা কইরো বু জান। দাদাজানের মুখ উজ্জ্বল কইরো। তোমাকে ভরসা করি আমরা, সেই ভরসার মান রাইখো।”
শায়লা কিছু বলেনি। চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসেছিল। রুবি ডুকরে উঠে ঘরে ছুটেছে। মেয়েকে ভালোমতো চেনে সে। কাল থেকে কারো সাথে কথা বলেনি শায়লা। অভিমান বা ইগো যাই বলা হোক, শায়লার মধ্যে এটার অভাব নেই। শায়লার বাবা যখন তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো তারপর থেকে আজ পর্যন্ত শায়লা কোনদিন বাবার কথা জিজ্ঞেস করেনি, কোনদিন বাবার নাম বা বাবার সাথে সম্পর্কিত কোন কিছুর আশপাশ দিয়েও যায়নি। কি পরিমান ঘৃনা শায়লা ওর বাবাকে করে সেটা চান্স পাওয়ার পরও ওর ডাক্তারি না পড়া থেকে খানিকটা বুঝতে পারা যায়। রুবিনা যতদূর শায়লাকে বোঝে এ বাড়িতে হয়তো শায়লা আর ফিরবে না। সেই বুঝ থেকেই রুবিনার বুকে হাহাকার জাগে। মেয়েকে কি আর কোনদিন দেখতে পাবে না রুবিনা? মেয়েটা সারাজীবনের মতো কি দূরে সরে গেলো? শায়লার ঘরে বসে অঝোর ধারার কেঁদে যায় রুবিনা।

★★★

“মা, ওকে কি রিদওয়ান এর ঘরে দেব?”
পল্লবী এসে দাঁড়িয়েছে জাকিয়ার দরজায়। আড়চোখে একবার ওয়াহেদকে দেখে নিলো জাকিয়া। তাকে মোবাইলে ব্যস্ত দেখে গলা নামালো-“মেয়েটাকে গেস্ট রুমে বসাও। ওর জন্য গেস্টরুম তৈরি করে রেখেছি।”
পল্লবী অবাক হলো। কিছুটা দ্বিধা নিয়ে বললো-“কিন্তু মা ওতো রিদওয়ানের বউ। গেস্ট রুমে কিভাবে?”
জাকিয়া এগিয়ে এলো-“রিদওয়ান বাড়ি ফেরেনি কাল। সোজা গিয়ে হোস্টেলে উঠেছে। আর ওদের বিয়েটা এখনো ফরমাল নয়। আগেভাগে সবাইকে জানান দেওয়ার কি দরকার। নিজেদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং বাড়ুক তারপর দেখা যাবে। এখন
যা বলছি তাই করো।”
পল্লবী রুষ্ট মনে চলে এলো। শাশুড়ীর কথা বিশেষ ভালো লাগলো না তার। যেভাবেই হোক বিয়েটা হয়েছে এখন এতো ভনিতা করার কি হলো। বরং তারা আন্তরিকতা দেখালে রিদওয়ান আর শায়লার মধ্যে একটা সম্পর্ক হতে পারে। পল্লবীর খারাপ লাগলো শায়লার জন্য। মেয়েটার কপালে কি আছে কে জানে।

শায়লা বসে ছিল ড্রয়িং রুমে। পল্লবী ওকে ডাকলো-“শায়লা, এসো তোমার ঘর দেখিয়ে দেই।”
শায়লা পল্লবীর পিছনে পিছনে এলো। গেস্ট রুম দেখিয়ে দিয়ে বললো-“তুমি হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হও। কিছুক্ষণ পরে নাস্তার জন্য ডাকবো।”
শায়লা চুপচাপ ঘরে ঢুকলো। পল্লবী চলে যাচ্ছিল শায়লা প্রথমবারের মতো তাকে ডাকলো-“ভাবি!”
পল্লবী অবাক হয়ে পিছু ফিরলো-“আমি চলে যেতে চাইছি। পরশু থেকে ক্লাস। হোস্টেলে সিট আছে আমার। আজ গেলে দুদিনে কিছুটা গুছিয়ে নিতে পারতাম।”
পল্লবীর ভ্রু কুঁচকে গেলো-“তুমি হোস্টেলে উঠবে কেন? এখান থেকেই না ক্লাস করবে?”
শায়লা গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ে-“না ভাবি। সেরকম কোন কথা হয়নি দাদুর সাথে। আমি আমার মতো হোস্টেলে থাকবো। আপনি একটু আন্টিকে বলে দিন। নাস্তা খেয়ে আমি বেড়িয়ে যাব।”
পল্লবী কথা বাড়ালো না-“আচ্ছা, মাকে বলে দেব আমি।”

ওয়াহেদুল হক বারকয়েক থাকার কথা বললেও শায়লা রাজি হলো না কিছুতেই। জাকিয়া বললো-“আচ্ছা, ও যেতে চাচ্ছে যাক না। আমরা আছি, ওর কোন প্রয়োজন হলে ও চলে আসবে এখানে। কি, ঠিক আছে তো শায়লা?”
শায়লা মাথা দুলিয়ে সায় দিলো। ওয়াহেদুল হক নিজ থেকে জোর করে এলে শায়লাকে ভার্সিটিতে রাখতে। শায়লার ভীষণ অসস্তি হতে লাগলো। অকারণে কারো কাছ থেকে সাহায্য বা ফেভার নেওয়া পছন্দ করে না শায়লা কিন্তু এখন সেটাই করতে হচ্ছে। না চাইতেই অচেনা মানুষগুলো ওর কারনে ছোটাছুটি করছে। সে পুরোটা পথ ভীষণ মন ছোট করে চুপচাপ বসে রইলো। ওকে নামিয়ে দিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় ওয়াহেদ ডাকলো-“শায়লা মামনী, আমার ফোন নাম্বারটা রাখো। কোন প্রয়োজন হলে বিনাদ্বিধায় ফোন দেবে আমাকে।”
সম্পর্কে ওর শশুর লোকটার সম্বোধনে শায়লা কিছুটা কেঁপে উঠলো। এই বয়সী মানুষগুলোকে ঠিক সহ্য হয় না শায়লার। বাবার কথা মনে পড়ে। মনটা অসহ্য বেদনায় হুটোপুটি করে। বাবা থাকলে কি ওকে মামনী ডাকতো? শায়লার মন চঞ্চল হলো। সে নিজেকে সামলে নিয়ে মোবাইলে নাম্বার তুলে নিলো।

★★★

রিদওয়ান ঢাকায় ফিরে সোজা হোস্টেলে উঠেছে তাও আজ সাতদিন হয়ে গেলো। না বাড়ির কারো ফোন ধরছে না বাড়িতে যাচ্ছে। সে ঠিক করেছে পরীক্ষা হওয়া অবধি হোস্টেলেই থাকবে। বাড়িতে নিশ্চয়ই ওই মেয়েটা আছে। এই মুহুর্তে কিছুতেই ওই মেয়েটার মুখোমুখি হতে চায় না সে। কি আজব ব্যাপার, সে নাকি বিবাহিত হয়ে গেছে। রুমমেটগুলো শুনলে কি বলবে? নারী বিদ্বেষী রিদওয়ান কিনা সবার আগে বিয়ে করে নিলো? নিশ্চয়ই পঁচাবে তাকে? বলবে, কিরে ব্যাটা। খুব তো বলেছিলি এখন কি বলবি? রিদওয়ান মাথার চুল টেনে ধরলো। হুট করে পিঠের উপর থাবা বসলো-“কিরে ব্যাটা, তুই কবে থেকে টানা হোস্টেলে থাকতে শুরু করেছিস?”
রিদওয়ান চমকে উঠলো। রুমমেট সজীবকে দেখে হাসলো-“পরীক্ষার জন্য আছি। তোরা সবাই মিলে একই কথা বলছিস কেন? আমি থাকাতে কি খুব প্রবলেম হচ্ছে তোদের?”
সজীব ভ্যাবাচ্যাকা খেলো-“আরে না না তেমন কিছু না। তুই কখনো থাকিস না জোর করেও রাখতে পারি না তাই জানতে চাইছি।”
রিদওয়ান এর মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। সে চেচিয়ে উঠলো-“কখনো থাকিনি বলে কি এখনও থাকতে পারবোনা? আজব ব্যাপার! সবাই একই প্রশ্ন করে করে আমার মাথা খাচ্ছিস।”
সজীব হেসে দিলো-“চিল বন্ধু। কি হইছে তোর? পরীক্ষা ভালো হচ্ছে না? এতো রেগে আছিস কেন? নাকি অন্য কোন ব্যাপার? নতুন কেউ এসেছে জীবনে?”
সজীবের কথা শুনে মেজাজ ঠান্ডা হওয়ার বদলে আরও গরম হলো-“অন্য কেউ এলেইবা কি। আর এলে তোকে বলবো কেন? কথা খুঁজে পাস না?”
সজীব বোকার মতো তাকিয়ে থেকে হাফ ছাড়ে-“থাক ভাই। আর কোন কথা বলবো না তোকে। তুই একা একা থাক। আমি লাইব্রেরিতে যেয়ে বসছি।”
সজীব রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। রিদওয়ান নিশ্চুপ বসে থাকে। কাল মেডিসিনের এক্সাম আছে পড়া দরকার কিন্তু মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। সে কি ওভাররিয়্যক্ত করছে? মনেহলো সজীবের সাথে অকারণেই রাগ দেখিয়ে ফেললো।

★★★

কেউ যাতে কিছু টের না পায় তাই হাত থেকে আংটিটা খুলে রেখেছে প্রথমদিনই। কারো উপর ডিপেন্ডেবল হওয়ার কোন ইচ্ছে তার কোনকালেই ছিলোনা এখনও নেই। ক্লাস শুরু হয়েছে, কিছু বন্ধু জুটে গেছে এরইমধ্যে। শায়লা খুব বন্ধু বৎসল নয় তবুও ওর মধ্যে হয়তো কিছু আছে যা অন্যকে আকৃষ্ট করে। ঢাকায় প্রথমবার এসেছিল ভর্তি পরীক্ষা দিতে। তারপর ভর্তি হতে। দুইবারই ওর ফুপাতো ভাইকে সাথে পাঠিয়েছে তৈয়ব মাওলানা। সেবার ভীতি হতে এসে টুম্পার সাথে আলাপ হয়েছিল। এই কয়দিনে টুম্পার সাথে ভালো খাতির হয়ে গেছে। তিনজন রুমমেটের দুইজন সিনিয়র বলে বেশ চাপে থাকতে হয় শায়লার। এরমধ্যেই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে মুখোমুখি হলো র্যাগিং এর।

শায়লার মাথায় এখন সবসময় টিউশনের ভাবনা ঘুরে বেড়ায়। নিজের টুকটাক খরচ সামলাতে দুটো টিউশন করা জরুরি হয়ে গেছে। দাদুর টাকা সে আর হাত পেতে নিতে চায় না। যে মানুষটা তার মনের খবর জেনেও না জানার ভান করে তার কাছ থেকে কোনরকম সাহায্য সে নেবে না ঠিক করেছে। এই ভাবনাতে মশগুল থেকে তাদের ডিপার্টমেন্টের মোস্ট সিনিয়র একটা গ্রুপের সামনে পড়ে গিয়ে সালাম না দিয়ে বিপত্তি বাঁধায় শায়লা। প্রতিদিন নানাভাবে র্যাগিং করে শায়লাকে। ওরা নিয়ম করে দিলো প্রতিদিন তাদের ক্লাসে এসে সালাম জানিয়ে যাবে শায়লা। এর অন্যথা হলে কঠিন শাস্তি। রুমমেট সিনিয়র আপুদের ধরেও শাস্তি মওকুফ করতে পারে না শায়লা। তারপর একদিন অপ্রিতিকর এক পরিস্থিতিতে দেখা হয়ে গেলো শায়লা আর রিদওয়ান এর, একদম অপরিচিত হিসেবে।

চলবে—
©Farhana_Yesmin