এরই মাঝে পর্ব-০৫

0
111

#এরই_মাঝে
#পর্ব-৫

শায়লা একটা টিউশনের খবর পেয়েছে। ক্লাস শেষ করে তাড়াহুড়ো করে সেখানেই যাচ্ছিল। টিএসসির মোড় পাড় হয়ে ওর ডিপার্ট্মেন্টের সিনিয়রদের আড্ডা বসে প্রতিদিন। আজও বসেছে। সাত আট জনের একটা দল। দু’জন মেয়ে আর বাকী ছেলেরা মিলে গান ধরেছে। এমন সময় শায়লাকে ওদের নজরে এলো। ওকে দেখে ওদের মনে এলো আজ শায়লা আসেনি ওদের সালাম দিতে। ওদের চেহারায় দুষ্ট হাসি ফুটে উঠলো। দলে থাকা দিনা হাসিবকে ইশারা করতেই সে শিষ বাজালো। শায়লা ওদের খেয়াল করেনি। হুট করে তার সামনে নিপাকে দাঁড়ানো দেখে থমকে গেলো। নিপা অমায়িক হাসি দিয়ে বললো-“কোথায় যাচ্ছেন ম্যাডাম? আজ আপনার দেখা পেলাম না যে?”
শায়লা ভ্যবাচ্যকা খায়। কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইলো। অদূরের জটলার দিকে ইশারা করে নিপা মুচকি হাসে-“এদিকে আসুন ম্যাডাম। আপনার অপেক্ষায় বসে আছি আমরা।”
শায়লা অসহায় চোখে সেদিকে তাকিয়ে দেখে ঢোক গিললো। নিপাকে মিনতি করে-“আপু, আমি খুব জরুরি কাজে যাচ্ছি। কাল দেখা করি আপনাদের সাথে? প্লিজ আপু?”
নিপার ভ্রু কুঁচকে গেলো-“পাগল হয়েছ মেয়ে? কোন অজুহাত না দিয়ে এখনই এসো। সিনিয়রদের কথা অমান্য করলে ভয়াবহ শাস্তি হয় এটা জানা নেই তোমার? তাড়াতাড়ি এসো।”
শায়লাকে দ্বিধান্বিত দেখায়। সে পায়ে পায়ে জটলার দিকে এগুলো। হাসিবদের দিকে তাকিয়ে হাত জোর করলো-“আমাকে আজ যেতে দিন না ভাইয়া। খুব জরুরি কাজ, কাল যে শাস্তি দেবেন মেনে নেব।”
“তার আগে বলো আজ আসোনি কেন? আজকে শাস্তিই তো বাকি রয়ে গেছে।”
“আজ আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম ভাইয়া। তবুুও সরি বলছি। ভাইয়া, প্লিজ যেতে দিন আমায়।”
শায়লার ফটাফট জবাব শুনে ওরা বিস্মিত। মেয়েটা একটু বেশি সাহস দেখাচ্ছে। গা জ্বালা করে হাসিবের। সে কঠিন গলায় বললো-“যেতে দেব তার আগে দশবার কান ধরে উঠবস করো।”
শায়লা বুঝতে না পেরে হতবাক হয়ে পুনরায় জানতে চাইলো-“জ্বি! কি করবো?”
“কানে ধরে উঠবস করবে। ছোটবেলার পড়া না পারলে স্কুলের টিচার যে সাজা দিত সেটা। বুঝছো? সেটা করো।”
“কিন্তু আমি কখনো কানে ধরে উঠবস করিনি তো।”
বোকার মতো চেয়ে থাকে শায়লা। আর শায়লার কথা শুনে ওদের কাশি উঠে গেলো। বলে কি মেয়ে। দিনা নাকি গলায় ঢং করলো-“কেন? তুমি বুঝি খুব ভালো ছাত্রী? সবসময় পড়া করতে?”
শায়লা মাথা দুলায়। নিরব হাসলো-“তাহলে বরং নেচে দেখাও। ভালো ছাত্রীরা আবার নাচ ভালো পারে জানি।”
শায়লা ঘড়ি দেখলো। অসহায় চোখে মাথা নাড়ে-“ওসব পারি না ভাইয়া।”
“তাহলে যেটা করতে বলছি তাই করো ভনিতা না করে।”
নেমানের কন্ঠ কঠিন হলো। শায়লা আশেপাশে তাকায়। জায়গায় জায়গায় ছেলেমেয়েরা জটলা পাকিয়ে বসে আছে। ভীষণ লজ্জা লাগছে তার। এখানে কান ধরে উঠবস করা মানে নিজের মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া। কাঁদতে মন চাইছে তার। এ কেমন বিপদে পড়লো সে? হাসিব ধমক দিলো-“এখনো দাঁড়িয়ে আছো? এখনি শুরু না করলে বিশবার করতে হবে। যত দেরি হবে তার ডাবল হতে শুরু করবে শাস্তি। নাও শুরু করো।”
শায়লা সাহায্যের আশায় ওদের সবাইকে দেখলো একবার। কেউ না কেউ তো ওকে বুঝবে। মেয়ে দুটো যেন বেশি মজা পাচ্ছে ওর অসহায়তায়। শায়লা শেষবার অনুরোধ করে-“আপু, প্লিজ এমন করবেন না। কাল থেকে নিয়ম করে যাব আপনাদের কাছে৷ আজ সত্যিই আমার জরুরি কাজ আছে।”
নিপা ধমক দিলো-“স্টপ গিভিং এক্সকিউজ।”
ধমকে কেঁপে উঠলো শায়লা। এতে উচু গলায় কেউ কখনো কথা বলেনি তার সাথে। অপমানে তার চোখ দুটো লাল হয়ে উঠলো। ভয় পেয়ে কানে হাত উঠে গেছে আপনাতেই। উঠবস শুরুই করবে এমন সময় একটা ছেলেকে এগিয়ে আসতে দেখলো শায়লা-“এই হাসিব, কেমন আছিস?”
হাসিব দ্রুত বেগে উঠে দাঁড়ালো-“রিদওয়ান ভাইয়া! তুমি এখানে?”
ছেলেটা হাত মিলিয়ে বললো-“পরীক্ষা শেষে বন্ধুরা জোর করে ধরে নিয়ে এলো। তুই বাসায় আসিস না কেন? খালা কেমন আছে?”
“ভালো। সামনে ফাইনাল তো সময় পাই না একদম। সেদিন মুনিয়াপুর সাথে দেখা হয়েছিল। আপু বলেনি?”
হাসিব উচ্ছ্বসিত হয়ে বলতেই ছেলেটা আড়ষ্ট হলো-“আপুর সাথে দেখা হয়নি আমার। আমি কয়েকদিন ধরে হলে থাকছি। পরীক্ষা শেষ হলে বাসায় যাব।”
“ওহহহ, তাই বলো।”
ছেলেটা প্রস্তাব দিলো-“চল কোথাও যেয়ে বসি। অনেকদিন পরে তোর সাথে দেখা হলো।”
“হুম চলো। এই তুমি যাও। কাল সকালে অবশ্যই ডিপার্টমেন্টের সামনে আসবে মনে করে।”
শায়লা যেন জ্বর ছেড়ে উঠলো এমন অনুভূতি হলো। কৃতজ্ঞ চিত্তে ছেলেটাকে দেখলো। ছেলেটা অবশ্য তাকায়নি। সুযোগ পেয়ে শায়লা ব্যাগ কাঁধে তুলে ছুটে পালায়। পথে বারবার কেবল ছেলেটার কথা মনেহচ্ছিল। কি যে নাম বললো ছেলেটার? রিদওয়ান! শায়লা বিরবির করলো-“অনেক ধন্যবাদ রিদওয়ান সাহেব। আজ আপনি বড় বাঁচা বাঁচিয়ে দিয়েছেন আমাকে।”

****

রাতে খাওয়ার টেবিলে জাকিয়া জানালো কাল মুনিয়া আসবে। ওয়াহেদ বললো-“মুনিয়াকে বুঝিয়ে বলো রিদওয়ান এর বিয়ের ব্যাপারে।”
জাকিয়া মাথা ঝাকায়-“উহু, বুঝিয়ে বললেও ও বুঝবে না। অযথাই তুলকালাম করবে। শোন, তোমরা কেউই ওকে রিদওয়ান এর বিয়ের কথা বলবে না। এমনিতেও রিদওয়ান এর বিয়েটা ছেলেখেলার মতো হয়েছে। কেউ জানে না, আমরাও এভাবেই থাকবো। ওদের পড়ালেখা শেষ হোক তখন দেখা যাবে।”
ওয়াহেদুল হক বিরক্ত হলেন-“কি সব বলছো জাকিয়া? মানলাম হুট করে হয়েছে বলে ওদের মেনে নিতে সমস্যা তাই বলে তবুও বাচ্চাদের সায় দেবে?”
“তো কি করবো? এলাকায় মিষ্টি বিলি করবো? ওই মেয়েটা কি আমাদের পরিবারের সাথে যায় বলো তো? ওর পরিবারের হাল দেখেছ? বাবা মা আলাদা, বিয়ের অনুষ্ঠান করলে বেয়াই পাবে কোথায়? বেয়ান আবার দু’জন। মানে লোক হাসানো আর কি। তোমার বাবার না হয় আমাদের সমাজে থাকতে হয় না তাই নিজের মর্জি আমাদের উপর থুপে দিয়েছে। তাই বলে তুমিও বাবার দলে ভিরবে? তুমিই বলো তোমার বিজনেসম্যান বন্ধুদের সাথে কার পরিচয় করাবে? ছেলের শশুর অমুক, দুটো বিয়ে করেছে?”
ওয়াহেদ চুল করে থাকলেও কল্লোল মাকে তাল দিলো-“মা ঠিক বলেছে বাবা। যদি এমন হতো যে এক বউ মারা গেছে তাই আবার বিয়ে করেছে তবুও মানা যেত। এখানে ব্যাপারটা শুনতেও কেমন যেন লাগে।”
আসাদ অবশ্য চুপ করে রইলো। জাকিয়া বললো-“তোর কি মত আসাদ। কিছু বলছিস না যে?”
“দেখো মা, এইসব সমাজ টমাজ নিয়ে অতো মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। বিপদে সমাজ কিছু করে না। মেয়েটার বাবা যাই করুক তাতে মেয়েটার দোষ কোথায়? বাবার কারনে ও কেন সাফার করবে? তাছাড়া বিয়ে যখন হয়েছে ওদের সুযোগ দেওয়া উচিত। দু’জনের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং হলে আমাদের সমস্যা কি?”
আসাদ বরাবরই ঠোঁট কাটা স্বভাবের। সত্যি মিথ্যে ঠিক বেঠিক নিয়ে কড়কড়ে জ্ঞান ঝাড়ে। জাকিয়া কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হলো। ওয়াহেদ সুযোগ পেয়ে মুখ খুললো-“শোন আমি বলি কি, এই বিয়ে নিয়ে মাতামাতি বাদ দাও। যা হওয়ার হয়েছে। ওরা যেমন চলছে চলুক। সময় সুযোগ হলে যদি নিজেদের নিয়ে ভাবতে চায় ভাববে আমরা আপত্তি করবো না। আর মুনিয়াকেও বুঝিয়ে বলো। পরে জানলে আরও বেশি কষ্ট পাবে তারচেয়ে কাল বলে দিয়।”
পল্লবী মাথা দুলায়-“মা, আমিও এটাই বলতে চাই। সত্য লুকিয়ে না রেখে বলে দেওয়া ভালো। মুনিয়াপু কেমন তা আপনি আমি সবাই জানি। আপু দেশে থাকলে তো সমস্যা ছিলো না। যেহেতু সে ছিলো না তাই জানানো হয়নি।”
তবুও জাকিয়ার মনের দ্বিধা গেলো না। মুনিয়া ওর ননদের জন্য রিদওয়ানকে চেয়েছিল। ওর শশুরবাড়ির লোকেরা নাকি রিদওয়ানকে খুব পছন্দ করে। এখন এই খবর পেলে কি তুলকালাম করবে কে জানে? মেয়ের জীবনে অশান্তি হলে কাকে বলবে? মেয়েটা না সংসার ফেলে চলে আসে। চিন্তা দূর করতেই জাকিয়া আসাদকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো-“তোদের খবর কি? ডাক্তারের কাছে কবে যাবি? সাত বছর হতে যাচ্ছে আসাদ আর কতদিন অপেক্ষা করবি? সমস্যাটা কার? নাকি এমনিতেই হচ্ছে না?”
আসাদ তার দিকে তাকাতেই মালিহার চেহারা ফ্যাকাশে হলো। ভারি লজ্জা লাগলো তার। এভাবে সকলের সামনে কেন বললো মা? আড়ালে কেবল তাদের দু’জনকে বললে পারতো? এখন আসাদ নিশ্চিত তাকে ভুল বুঝবে। বলবে সেই কানপড়া দিয়েছে মাকে। নয়তো মা কখনো এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। মালিহার শরীর কাঁপছে। আসাদ কি কবরে এবার? গতবারের হাতের ব্যাথাটা এখনো যায়নি তার। মালিহার গলা ছেড়ে কাঁদতে মন চাইছে।

চলবে—-
©Farhana_Yesmin