এরই মাঝে পর্ব-০৭

0
105

#এরই_মাঝে
#পর্ব-৭

“বউমা, শায়লার সাথে কথা হয়? সব ঠিক আছে? তিন মাস হয়ে গেলো ও আমার কাছে টাকা চায় নাই। নিজ থেকে ফোন করে না আমি ফোন দিলে ধরে না। দশবার দিলে একবার রিসিভ করে দায়সারা কথা বলে। সেদিন আমি টাকা পাঠাইতে চাইলাম বললো লাগবে না। তুমি কিছু জানো এই ব্যাপারে?”
রুবিনা মাথা নিচু করে ছিলো। মুখ তুলে তৈয়ব মাওলানাকে দেখলো। মানুষটার মন খারাপ বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু সত্য তো লুকিয়ে রাখা যাবে না। আজ হোক কাল হোক প্রকাশ পাবেই। এর চাইতে ভালো আগেই জানুক। রুবিনা মৃদুস্বরে বললো-“আব্বা, ও বললো দুইটা টিউশনি পাইছে তাতে ওর হাতখরচ হয়ে যায়।”
তৈয়ব মাওলানা ব্যাথীত নয়নে রুবিনার দিকে তাকালো-“ওকে বলছিলাম মন দিয়ে পড়ালেখা করতে। টিউশনি করলে পড়বে কখন? ওর কি ভালো রেজাল্ট করার ইচ্ছা নাই?”
রুবিনা মাথা নাড়ে-“সেটাও জিজ্ঞেস করছি আমি। বললো পড়ালেখায় কোন সমস্যা হয় না। সমস্যা হইলে ছেড়ে দিবে।”
তৈয়ব মাওলানা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো-“বুঝছি। ও আমার উপর রাগ হইছে। ওকে একন বিয়া দিছি দেইখা রাগ হইছে। আচ্ছা তুমি কওতো বউমা, আমি কি সত্যিই খারাপ কাজ করছি? ওর বিয়া দেওয়া উচিত হয় নাই আমার? তোমাদের সবার ভালো চিন্তা কইরা কি আমি ভুল করলাম? আমার সিদ্ধান্তে ভরসা করলো না শায়লা?”
রুবিনা উৎকন্ঠিত হলো। শশুরকে স্বান্তনা দিতে তড়িঘড়ি করে বললো-“না আব্বা, আপনে কেন ভুল করেন নাই। শায়লা বাচ্চা মানুষ, এখন রাগ হয়ে আছে। যখন বুঝবে আপনার সিদ্ধান্তই ঠিক তখন দেখবেন আপনার উপর রাগ থাকবে না। আপনে অস্থির হইয়েন না আব্বা। শায়লার রাগ পড়ে যাবে ধীরে ধীরে। আমি ওকে বোঝাবো।”
তৈয়ব মাওলানা মলিন মুখে জবাব দিলো-“বুঝলেই ভালো। আমার তো তোমাদের কাছ থেকে কিছু চাওয়ার নাই বউমা। তোমাদের সুখে শান্তিতে দেখে মরতে পারলেই আমার শান্তি।”
রুবিনা স্নেহময় ধমক দিলো-“আবোলতাবোল বইলেন না আব্বা। মরার কথা আসতেছে কেন? নাতনি আপনার, জেদও আপনার মতন। ওর বাচ্চামিতে কিছু মনে নিয়েন না আব্বা।”
নাজনীন এতোক্ষণ চুপচাপ স্বামী আর বউমার কথোপকথন শুনছিলেন। এবার তিনি মুখ খুললেন-“আর জামাই বাড়ির কথা কিছু কয়? একবারও গেছে ওই বাড়ি?”
রুবিনা মাথা নাড়ে-“যায় নাই। ওরাও ডাকে নাই।”
“তার মানে কি জামাই এর সাথে দেখা হয় নাই আর?”
নাজনীন ক্ষীণস্বরে প্রশ্ন করে।
“হয় নাই বললো। এই বিষয়ে বেশি কথা বলতে চায় না। জানতে চাইলে রাগারাগি করে।”
তৈয়ব মাওলানা নীরব রইলো। নাজনীন বললো-“ভালোই হয়েছে একদিক দিয়ে। কেবল পড়ালেখা শুরু হইছে এখন মন দিয়ে পড়ুক। জামাই সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকলে পড়া হবে না।
ধীরে ধীরে ওদের মধ্যে মিল মোহাব্বত হোক। কি বলেন আপনি?”
শেষ প্রশ্নটা তৈয়ব মাওলানাকে উদ্দেশ্য করে করলেন। তৈয়ব মাওলানা গুম হয়ে গেলেন। স্ত্রীর কথার জবাব দিলেন না।

★★★

শায়লা ক্লাস শেষ করে হলে ফিরছে পেছন থেকে হাসিব ডাকলো-“এই শায়লা, একটু শুনবে?”
শায়লা থমকে গেলো-“আসসালামু আলাইকুম হাসিব ভাই। কেমন আছেন?”
“ভালো আছি। একটা কথা জানতে চাই, বলবে?”
“হ্যা ভাইয়া বলার হলে অবশ্যই বলবো। কি জানতে চান বলুন।”
“ইকরার কথাটা তুমি কি করে জানলে? আমার খুব ক্লোজ কয়েকজন বন্ধু ছাড়া আর কেউ জানে না আসলে। ইকরা চায় না কেউ আমাদের ব্যাপারে জানুুক।”
শায়লা ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ ভাবলো। ওই রিদওয়ানের কথা হাসিবকে বলা উচিত হবে না। জানলে দু’জনার সম্পর্ক খারাপ হতে পারে ভেবেই বললো-“জেনেছি কোনভাবে। আর আপনার বন্ধুরা জানে না সেটাও জেনেছিলাম। তবে আপনি নিশ্চিত থাকুন আমি কাউকে কিছু বলবো না।”
হাসিব মাথা নাড়ে-“সেটা আমি জানি শায়লা। সেজন্য ধন্যবাদ তোমাকে।”
এরপর শায়লা কি বলবে ভেবে পেলনা। সে বললো-“আমি কি যাবো ভাইয়া?”
“হ্যা যাও। আর কোন সমস্যা হচ্ছে নাতো? কেউ কিছু বলেছে? বললে আমাকে জানাবে।”
শায়লা মাথা দুলিয়ে সায় দিলো। হেঁটে হাসিবের আড়ালে আসতেই ফিক করে হাসলো। আব আয়ে উট পাহাড়কে নিচে। ইকরার কথা বলতেই বান্দা বন্ধুদের ভুংভাং বুঝিয়ে সুরসুর করে তার সাজা মওকুফ করে দিলো। তারপর শায়লা ফ্রি বার্ড। নো রাগিং নো সাজা। রিদওয়ান নামের মানুষটাকে অনেকদিন ধরে মনে মনে খুঁজছে শায়লা ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য। কয়েকবার করে আজিজ সুপার মার্কেটেও গেছে কিন্তু দেখা হয়নি আর। মানুষ কি হারিয়ে গেলো নাকি? তার বড্ড উপকার করেছে। ভালো হোক ছেলেটার, মনে মনে দোয়া করে শায়লা।

পরের রবিবার টুম্পার সাথে নিলখেত এলো বই কিনবে বলে। কাজ শেষ করে টুম্পা বাসার দিকে আর শায়লা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে গল্পের বই দেখছিল মন দিয়ে।
“এক্সকিউজমি আপনার হাতের বইটা দেখতে পারি? আপনি কি বইটা নেবেন? না নিলে আমি নেব ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড।”
শায়লা চমকে উঠে সামনে তাকায়, ওর চেহারায় হাসি ফুটে উঠলো-“আরেহ আপনি! কতদিন ধরে খুঁজছি জানেন?”
রিদওয়ান চোখ নাচায়-“তাই নাকি? কেন বলুনতো? হঠাৎ আমায় খুঁজবেন?”
“ট্রিট দিতে। আপনি যে আমায় কতবড় ঝামেলা থেকে বাঁচিয়েছেন জানেন? হাসিব ভাই তো প্রশ্ন করে পাগল করে ফেললো। আমি ইকরার কথা কি করে জানলাম। আপনার নাম বলিনি কিন্তু।”
“বললেই বা কি?”
রিদওয়ান ঠোঁট ওল্টায়। শায়লা হাসলো-“আপনাকে ফাঁসিয়ে দিতে চাইনি। কাজ হয়েছে ঝামেলা শেষ। কিন্তু একটা কথা বলুন তো আমায়। হাসিব ভাই আপনার কে? বন্ধু?”
রিদওয়ান উঠে দাঁড়ালো। শায়লার হাত থেকে বইটা নিলো-“তা জেনে কি হবে? আমাকে ট্রিট দিতে চাইলেন না? চলুন পাশের তেহেরি ঘরে তেহারি খাই।”
“হ্যা নিশ্চয়ই। চলুন যাই।”
শায়লা খুশি হয়ে গেলো। রিদওয়ান হঠাৎ মন পাল্টে বললো-“শুনুন, খাওয়া দাওয়ার পার্ট আজ থাক। আপনি বরং আমাকে এই বইটা কিনে গিফট করুন। তাতেই হবে।”
শায়লা কিছুটা অবাক হলেও মানা করলো না। চুপচাপ বইয়ের দাম চুকিয়ে দিলো। রিদওয়ান হেসে বিদায় নিলো-“আসছি আজ। বন্ধুরা আছে ওইদিকে। পরে কথা হবে।”
শায়লাকে কিছু বলতে না দিয়ে যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই ফিরে গেলো রিদওয়ান। শায়লা একা একা বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলো। এমন আজব ক্যারেক্টার আগে চোখে পড়েনি তার।

★★★

পরিক্ষা হওয়া পর্যন্ত রিদওয়ান টানা হলে থাকলো। পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার পর কিছুদিন বাসায় থাকলো বন্ধুদের সাথে বেড়িয়ে এলো। ফাইনাল ইয়ারের ক্লাস শুরু হতেই আবার হলে চলে গেলো। এখন নাকি কোনভাবেই বাসায় থাকা সম্ভব না। বিভিন্ন ওয়ার্ডে ডিউটি করার বিরতিতে লেকচার ক্লাস এটেন্ড করা মানে দম ফেলার ফুরসত নেই। কাজেই বাসায় থাকার প্রশ্নই আসে না। এই বিষয় নিয়ে জাকিয়ার সাথে কয়েকবার বচসা হয়ে গেছে রিদওয়ানের। জাকিয়া কিছু বুঝতে চায় না বলে রিদওয়ান হাল ছেড়ে দিয়ে নিজের মতো থাকে। আজ গ্যালারি লেকচার বাতিল হওয়ায় সুযোগ পেয়ে বাসায় ফেরার পর দেখলো বাসা বেশ জমজমাট। তাদের একমাত্র বোন মুনিয়া এসেছে দুই বাচ্চা নিয়ে। সাথে আছে তার আদরের ননদ তৃষা। দেখেই গা জ্বলে গেলো রিদওয়ানে। আপুর এই ননদটা ভীষণ গায়ে পড়া। অসহ্য লাগে রিদওয়ান এর। ওদের এড়িয়ে সন্তোর্পনে নিজের ঘরে যেতে চাইলো কিন্তু পারলোনা। তার আগেই মুনিয়ার চোখে পড়ে গেলো-“এই রিদু, তুই ওভাবে চোরের মতো কোথায় যাচ্ছিস? এদিকে আয়। কতদিন দেখি না তোকে। এরমধ্যে দু’দিন এলাম দুদিনই শুনলাম তুই হোস্টেলে। ঘটনা কি বলতো? তুই না আগে হলে থাকতে পারতি না। হুট করে কি হলো?”
রিদওয়ান বিরক্তি চেপে এগিয়ে এলো-“তেমন কিছু না আপা। ফাইনাল ইয়ার বলে পড়ালেখার চাপ বেশি। হলে থাকলে সুবিধা হয় আর কি।”
মুনিয়া ঠোঁট ওল্টায়-“এদিকে পলাশ আর শিমুল তোর কথা বলতে বলতে আমার মাথা খেয়ে ফেলছে।”
রিদওয়ান ভাগনে ভাগ্নিকে খুঁজলো-“ওরা কোথায়? আজ আনোনি?”
মুনিয়া মাথা নাড়ে-“না। আজ তৃষার সাথে বেড়িয়েছিলাম শপিং এর জন্য। ওরা বাসায় আছে। তুই এককাজ করিস, একদিন আমার বাসায় এসে ওদের দেখে যাস।”
“আচ্ছা।”
“এই তৃষা, আজ তুমি এরকম বোবা হয়ে আছো যে? খুব তো রিদু ভাই রিদু ভাই বলে চেচাচ্ছিলে এখন কি হলো?”
রিদওয়ান কেশে উঠলে আর তৃষা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলো-“যাহ ভাবি, কি সব বলছো? আমি মোটেও রিদু ভাইয়া বলে চেচাই না।”
“আচ্ছা! এখন বলবো কি করো তুমি?”
তৃষার লাজে মরমর অবস্থা-“ভাবি, ভালো হচ্ছে না।”
রিদওয়ান এই অপ্রিতিকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে উঠে দাঁড়ালো-“আপা আমি একটু রুমে যাচ্ছি। ফ্রেশ হতে হবে।”
জাকিয়া সায় দিলো-“হ্যা যা তুই। ফ্রেশ হয়ে নে টেবিলে খাবার দিচ্ছি একটু পরে।”
মুনিয়া আরও কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু মায়ের ইশারা পেয়ে থেমে গেলো। তবে ঘটনা এখানেই থামলো না। কিছুক্ষণ পর মুনিয়া তৃষাকে নিয়ে রিদওয়ান এর ঘরে গেলো-“এই রিদওয়ান, তৃষার কিছু প্রশ্ন আছে পড়ালেখা নিয়ে। তুই তো ওর সিনিয়র, দেখতো কি জানতে চাইছে তৃষা। এই তৃষা তোর কি জানার আছে রিদওয়ানের কাছে জানতে চা। কথা বল রিদওয়ান এর সাথে আমি আসছি মায়ের সাথে কথা বলে।”
রিদওয়ান ভারি বিপাকে পড়লো। দাদুর বিয়ে বিয়ে খেলার পর সে এই ভয়ে বাড়ি আসে পাছে তার নববধূর সাথে দেখা না হয়ে যায়। মেয়েদের হ্যান্ডেল করা তার কম্ম না। মেয়েমহল থেকে সর্বদা দশহাত দূরত্ব বজায় রাখে সে। বিশেষ করে সেঁজুতির ঘটনার পর থেকে। এই মুহূর্তে মুনিয়ার উপর ভীষণ রাগ হলো তার। সে তৃষাকে ‘একটু আসছি’ বলে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। মুনিয়া মায়ের ঘরে বসে কথা বলছিল। সে সেখানে গেলো-“আপা, এই যে তোমার ননদকে আমার সাথে ভিড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছো তুমি কি জানো আমি বিবাহিত? দাদাজান আমায় বিয়ে করিয়েছে। মা কি বলেছে কিছু তোমাকে?”
মুনিয়ার চোখ দুটো আলুর মতো হয়ে গেলো। সে পালা করে একবার মাকে আরেকবার রিদওয়ানকে দেখছে। রিদওয়ান একবার ক্রুর হাসি দিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে চোখ নাচালো। অবশ্য কথা বলে আর দাঁড়ালো না সে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। জাকিয়া মেয়ের চেহারা দেখে ঢোক গিললো। আজ একটা সাইক্লোন না হয়ে যাবেই না।

চলবে—-
©Farhana_Yesmin