এরই মাঝে পর্ব-০৮

0
104

#এরই_মাঝে
#পর্ব-৮

“মা!”
মুনিয়ার ডাক শুনে জাকিয়ার অন্তর কেঁপে উঠলো। মেয়ের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকালো সে। মুনিয়া অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে-“রিদু যা বললো সত্যি?”
জাকিয়া ঢোক গিললো। মুনিয়া সর্পচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে বললো-“কবে হয়েছে এতোসব? আমাকে না জানিয়ে এতোকিছু করার কারণ জানতে পারি কি?”
জাকিয়া সাহায্যের আশায় পল্লবীর দিকে তাকায়। পল্লবী মুনিয়াকে ডাকে-“আপু, আসলে হয়েছে কি তুমি তো তখন দেশে ছিলে না। দাদু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলেন। তারপর আমাদের ইমার্জেন্সি যেতে হলো। তোমাকে বলার কোন সুযোগ ছিলো না আসলে। মা অবশ্য…”
মুনিয়া হতবাক হয়ে বললো-“সত্যিই রিদুর বিয়ে হয়েছে তাহলে!”
“আপু, তুমি বসো আমি বুঝিয়ে বলছি কি ঘটনা।”
মুনিয়া হাত দেখালো-“তুমি থামো ভাবি। আমি মার মুখ থেকে শুনতে চাই। মানলাম আমি দেশে ছিলাম না, একটা ফোন করা যেত। আমি চলে আসতাম না হয়। তাই বলে আমাকে না জানিয়ে এতোবড় কাজ হয়ে যাবে? একটামাত্র মেয়ে হয়ে তোমাদের কাছে এই গুরুত্ব আমার?”
জাকিয়া রেগে গেলো-“অযথা সেন্টিমেন্টাল হয়ো না মুনিয়া। কারণ না থাকলে এমন কাজ হতো নাকি?”
“আমি সেন্টিমেন্টাল হচ্ছি!”
মুনিয়া যেন রাগ করতেও ভুলে গেলো। জাকিয়া বললো-“তা নয়তো কি? তোমার দাদু একটা সিনক্রিয়েট করে রিদুকে বিয়ে করতে বাধ্য করেছে। না আমরা তৈরি হওয়ার সুযোগ পেয়েছি না রিদু। আর তুমি আছো নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। এদিকে আমার ছেলেটা রাগ করে বাড়ি ছেড়েছে।”
মুনিয়া মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুসময়। জানতে চাইলো-“তা বিয়েটা হয়েছে কবে?”
“তুমি তখন মালয়েশিয়া ছিলে আপু।”
পল্লবী ঝটপট উত্তর দিতেই মুনিয়ার চোখ ছানাবড়া-“সে তো তিনচার মাস আগের কথা। এরমধ্যে কতবার এসেছি বাসায় তোমরা আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করোনি। আজ দাদুর দোষ দিচ্ছ?”
জাকিয়া লজ্জিত হলো না, বরং তেজের সাথে উত্তর দিলো-“তোমার এই ব্যবহারের কারণে কিছু বলার সাহস হয় না। কোন কথায় কিভাবে রিয়্যাক্ট করো তার ঠিক আছে?”
“আজ বুঝে গেলাম বিয়ের পর মেয়েরা আসলেই পর হয়ে যায়। আসলে মেয়েরা পর হয় না মায়েরা পর করে দেয়। ঠিক আছে মা, তুমি সুখে থাকো তোমার বউমাদের নিয়ে। আমার যখন কোন গুরুত্ব নেই তোমাদের কাছে তখন আর এখানে থেকে কাজ নেই। আমি আসছি। আজ থেকে ভুলে যেয় তোমার একটা মেয়ে ছিলো।”
মুনিয়া হাতের ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তৃষাকে ডাকলো গলা ছেড়ে। তৃষা একটু অবাক হয়ে বেরিয়ে এলো-“ভাবি, ডাকলে?”
“হ্যা চলো বাসায় যাই। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।”
“তুমি না বললে আরও কিছুক্ষন থাকবে।”
“এখন আর থাকতে ইচ্ছে করছে না। চলো তাড়াতাড়ি।”
পেছনে থেকে জাকিয়া বললো-“বেশি বাড়াবাড়ি করছো মুনিয়া। এতো রিয়্যাক্ট করার মতো কিছু হয়নি কিন্তু।”
মুনিয়া মায়ের কথার জবাব দিলো না। তৃষা না বুঝে জানতে চাইলো-“কি হয়েছে ভাবি?”
“কিছু না।”
মুনিয়ার থমথমে মুখ দেখে তৃষা আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পায় না। তবে বুঝলো বেশ সিরিয়াস কিছু হয়েছে তা না হলে ভাবি এভাবে চলে আসতো না।

*****

রিদওয়ান মেজাজ খারাপ করে বসে আছে রুমে। আজ সকালের ওয়ার্ডে ডিউটির সময় ম্যাডাম ভাইভা নিলে কেন যেন রিদওয়ান কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি ঠিকঠাক। বন্ধুদের সামনে ম্যাডাম খুব তিরস্কার করেছে তাকে। এরকম ঘটনা রিদওয়ান এর ক্ষেত্রে খুব রেয়ার। সেই থেকে মন খারাপ করে বসে ছিলো, দুপুরে খাওয়া হয়নি তার। খেতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু পেটে খিদে। বিরক্ত হয়ে পাশ ফেরে রিদওয়ান।
“এই রিদওয়ান, মুক্ত মঞ্চে অনুষ্ঠান হচ্ছে। যাবি?”
সজীব এসেছে রুমে। কাপড় পরিবর্তন করছে দ্রুত হাতে।
“মন ভালো নেই। আমি যাব না।”
সজীব হাসলো-“তুই শালা সবসময় সেন্টি খোর। মুখটা ওরকম বাংলার পাঁচ বানিয়ে রেখেছিস কেন? ম্যাডাম বকেছে তাই?”
রিদওয়ান জবাব দিলো না। সজীব এগিয়ে এসে ওর কাঁধে হাত রাখলো-“মেডিকেল স্টুডেন্ট এর জন্য খুব নরমাল ঘটনা। দয়া করে এতো সেন্টি খাস না। চল মুক্ত মঞ্চের দিকে যাই। পারুল, জিমি, সবাই যাচ্ছে। চলরে ভাই। মন ভালো হবে।”
রিদওয়ান পটলো না। সে শুয়ে থেকে উত্তর দিলো-“নারে তোরা যা। আমি একটু ঘুমাই।”
সজীব ক্ষেপে গেলো-“তুই উঠবি নাকি গায়ে পানি ঢালবো?”
রিদওয়ান মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে সজীবকে দেখলো। ও দুই হাত কোমড়ে চেপে রেগে বোম হয়ে দাঁড়িয়ে। রিদওয়ান বিরক্তি দেখিয়ে উঠলো-“তোদের জ্বালায় দেখছি হলে থাকা যাবে না। বাসায়ও শান্তি নেই এখানেও শান্তি নেই। যাব কোথায়?”
সজীব দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“তোর দেখছি জাহান্নামে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। কারণ সুখ তো তোর সহ্য হয় না। পাঁচ মিনিটে তৈরি হয়ে আয়।”
গায়ে শার্ট চাপাতে চাপাতে বলে সজীব। রিদওয়ান ত্যক্ত হয়ে উঠে বাথরুমে ঢুকলো।

জেমস এসেছে, শিরোনামহীনের তুহিন এসেছে। প্রচুর ভীড়ে প্রান ওষ্ঠাগত। সজীব চঞ্চলরা হইচই করতে করতে ঢুকে গেলো। ওদের পিছু পিছু রিদওয়ান। কোনরকমে বসার জায়গা পেয়েছে কিন্তু রিদওয়ান এর বিরক্ত লাগছে। আশেপাশের সব ছেলেমেয়েরা গায়কের সাথে গলা মিলিয়ে গান গাইছে। কিছুক্ষণ থেকে রিদওয়ান উঠে পড়লো। সজীব অবাক হয়ে জানতে চাইলো-“কোথায় যাচ্ছিস?”
“আসছি একটু।”
“আরে এতো কষ্ট করে জায়গা ম্যানেজ হয়েছে আর তুই কিনা চলে যাচ্ছিস?”
“আসছিরে বাবা। জায়গা না পেলে দাঁড়িয়ে থাকবো। থাক তোরা।”
রিদওয়ান বেড়িয়ে এলো ভীড় কেটে। একটু এগিয়ে এসে একটা চায়ের দোকানে ঢুকলো। আয়েশ করে চা খাচ্ছে এমন সময় মেয়েটাকে দেখলো। ওপাশের উঁচু বেদির উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। চারপাশে তাকিয়ে দেখছে আর পা দুলচ্ছে যেন সবকিছু দেখে খুব মজা পাচ্ছে। রিদওয়ান কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে মেয়েটার কান্ড দেখলো। ওর ভীষণ মজা লাগছে মেয়েটাকে দেখতে। এগিয়ে যাবে না ভেবেও শেষ পর্যন্ত রিদওয়ান নিজেকে আটকাতে পারলোনা। নিজের অজান্তেই মেয়েটার সামনে গিয়ে বসলো-“মিস শায়লা, কি ব্যাপার বলুন তো? আপনি কি আমাকে স্টক করছেন? সব জায়গায় আমাদের দেখা হচ্ছে কি করে?”
শায়লা প্রথমে চমকে উঠলেও রিদওয়ানকে দেখে তার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটলো-“আরে আপনি? এ কথা কিন্তু আমিও বলতে পারি। আমাকে স্টক করছেন নাতো? বারবার দেখা হওয়ার কারণ কি, হুমম?”
শায়লা কথাটা বলতে দু’জনেই হেসে দিলো। রিদওয়ান বললো-“আপনিও কনসার্ট দেখতে এসেছেন?”
শায়লা আঁতকে ওঠার ভান করলো-“পাগল! এরকম শোরগোলে আমার মাথা ব্যাথা হয়। টুম্পার পাল্লায় পড়ে আসতে হয়েছে। ও একা আসবে না বাধ্য হয়ে আমার আসতে হলো। আপনি?”
রিদওয়ান কাঁধ ঝাঁকালো-“সেম কেস। বন্ধুরা জোর করে ধরে এনেছে। আমি মোটেও এসব কনসার্ট এনজয় করি না।”
শায়লা অবাক হওয়ার ভান করে-“আমাদের দু’জনার কতো মিল, তাই না?”
রিদওয়ান হাসলো-“চা খাবেন?”
“খাওয়া যায়।”
“চলুন ও পাশে যেয়ে বসি।”
“কিন্তু টুম্পাকে এখানে থাকবো বলেছি।”
“এখন ম্যাসেজ করে ওপাশে থাকার কথা বলে দিন তাহলেই তো হয়।”
“ভালো বুদ্ধি। দাঁড়ান ওকে ম্যাসেজ পাঠাই।”
শায়লা মোবাইল বের করে টুম্পাকে ম্যাসেজ দিয়ে বললো-“চলুন।”
দু’জন একটা ভীড় সামলে সামনে এসে বসলো। রিদওয়ান আবার চায়ের অর্ডার দিলো। তখনকার চা ঠান্ডা হয়ে গেছিল খেতে পারেনি। চা এলে চুপচাপ কয়েক চুমুক দিয়ে রিদওয়ান বললো-“নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন শায়লা। বারবার দেখ হচ্ছে অথচ কেউ কারো সম্পর্কে জানি না। আসুন আজ আনুষ্ঠানিক পরিচয়টা সেরে ফেলি।”
শায়লা হেসে দিলো। রিদওয়ান খেয়াল করে দেখলো হাসলে মেয়েটাকে চমৎকার লাগে। বাম গালে খুব আবছাভাবে টোল পড়ে।
“আমি ফাস্ট ইয়ার, জেনেটিক ইন্জিনিয়ারিং।”
“আরে হ্যা, মনে পড়েছে। হাসিবও তো জেনেটিকে পড়ে। আপনারা তো সব জিনিয়াস পাবলিক।”
শায়লা লাজুক হাসলো-“বেশি বেশি বলছেন। এমন কোন ব্রেন লাগে না এতে। আচ্ছা আমার কথা বাদ দিন আপনার কথা বলুন। কোন ডিপার্টমেন্ট আপনি?”
রিদওয়ান প্রথমে না বুঝে তাকিয়ে ছিলো। পরে বুঝতে পেরে ওর হাসি থামে না। শায়লার নিজেকে বোকা লাগে। সে জানতে চাইলো-“আমি কি হাসার মতো কিছু বলেছি?”
রিদওয়ান হাসি থামিয়ে বললো-“না তা বলেননি তবুও হাসি পেলো। আমি আসলে আপনার ইউনিতে পড়ি না।”
“তাহলে?” প্রশ্নবোধক চাহনি দেয় শায়লা।
“আমি মেডিকেলে পড়ছি। ফাইনাল ইয়ার শুরু হয়েছে। আর কিছুদিন পর পুরোপুরি ডাক্তার হয়ে বেরুব।”
রিদওয়ানের কথা শোনার সাথে সাথে শায়লার চেহারায় আঁধার নামলো। ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেলো সে। আচমকা একটা কথাও না বলে সে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে উঠে হনহনিয়ে চলে গেলো। পেছনে বসে রইলো শায়লার এমন আচরন না বোঝা বোকা বোকা চেহারার রিদওয়ান। সে তখনো আশ্চর্য হয়ে ভাবছে, কিছু কি ভুল বলেছে সে? খারাপ কিছু কি বললো? মেয়েটা কোন কথা না বলে এভাবে চলে গেলো কেন? নাকি তার ডাক্তারি পড়া পছন্দ না মেয়েটার?

চলবে—-
©Farhana_Yesmin