এরই মাঝে পর্ব-১৪

0
121

#এরই_মাঝে
#পর্ব-১৪

রিদওয়ান চরম মাত্রায় বিরক্ত। দাদাজান নাটকের চুড়ান্ত করেছে। আর ওই মেয়েটা দাদাজান যা বলছে চুপচাপ সব করে যাচ্ছে। এই তো কিছুক্ষণ আগে খাবার এর টেবিলে মেয়েটা তাকে আর দাদাজানকে খাবার পরিবেশন করছিল চুপচাপ যেন সে কতকাল ধরে এ বাড়ির বউ। রিদওয়ান অবাক হয়ে দেখছে মুখে চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলা মেয়েটা বাধ্য মেয়ে হয়ে মুখে কলুপ এটেছে। এটা দেখে আরও বেশি মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার। তাকে ডেকে আনার কারণ যে মেয়েটা সেটা বুঝতে বাকি নেই। নিশ্চয়ই মেয়েটা তার নামে উল্টোপাল্টা বকে দাদাজানের মাথা খেয়েছে। যদি সত্যি এমন করে থাকে তাহলে মেয়েটাকে একটা উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে সে। অন্যমনস্ক হয়ে রিদওয়ান বিছানায় নজর বুলালো। নতুন চাদর বিছানো হয়েছে খাটে। টেবিলের উপর ফুলদানিতে কিছু ফুল রাখা হয়েছে। নিঃসন্দেহে দাদাজানের বুদ্ধি।
“আপনার কফি।”
কোমল মেয়েলি স্বরে চমকে উঠলো রিদওয়ান। ক্যাটক্যাটে সবুজ কাতান পরিহিত মেয়েটা নিঃশব্দ দাঁড়িয়ে আছে চায়ের কাপ নিয়ে। সবুজ রং রিদওয়ানের বিশেষ অপছন্দ অথচ এই অপছন্দের রং এ মেয়েটাকে দেখতে খারাপ লাগছে না। মেয়েটার চেহারায় একটা স্নিগ্ধ কোমল মায়াময় ভাব ছড়িয়ে আছে যেটা দেখতে ভালো লাগছে। সে অবাক হয়ে দেখছে আর ভাবছে সবুজ রং এ কাউকে ভালো লাগতে পারে! রিদওয়ানের মন চাইলো কিছুক্ষণ ওই মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে। কিন্তু নিজেকে হ্যাংলা প্রমান করবে না বলেই কফির কাপটা নিয়ে মোবাইল দেখতে লাগলো। শায়লা আড়ষ্ট হয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে দরজা লাগাতেই রিদওয়ানের চোখ কপালে। সে অবাক হয়ে জানতে চাইলো-“দরজা আটকালেন কেন?”
শায়লার গম্ভীর মুখ আরও গম্ভীর হলো-“কেন মানে? রাত হয়েছে ঘুমাবো তাই।”
শায়লা যতটা সহজে জবাব দিলো রিদওয়ান ততটাই বিস্মিত হলো-“আপনি এই ঘরে ঘুমাবেন?”
“আপনার কোন সন্দেহ আছে? আর কোন প্রশ্ন থাকলে দয়া করে দাদুকে যেয়ে করুন প্লিজ।”
রিদওয়ান চুপ করে গেলো। শায়লা বিছানায় বসলো পা তুলে। রিদওয়ান জানতে চাইলো-“আপনি কি বিয়েটা মেনে নিচ্ছেন?”
শায়লা হাসলো-“না মেনে উপায় আছে কোন? থাকলে বলুন।”
রিদওয়ান কি উত্তর দেবে ভেবে পেলো না। আসলেই তো কোন উপায় নেই। শায়লা রিদওয়ানকে দেখলো একনজর। রিদওয়ান শান্ত হয়ে বসে আছে। শায়লা বললো-“তাই বলে আবার ভাববেন না আপনার সাথে এক কামরায় থাকতে চাইছি। আসলে মুরব্বি মানুষ বললে মুখের উপর মানা করা যায় না।”
রিদওয়ান বিরক্ত হলো-“আপনি কি দাদাজানকে কিছু বলেছেন?”
“কোন বিষয়ে?”
“আমাদের বিষয়ে। স্পেসিফিকলি বলতে গেলে বলতে হয়, আমাকে নিয়ে।”
শায়লা অবাকের চুড়ান্ত হলো-“আপনাকে নিয়ে কি বলবো?”
“নিশ্চয়ই কিছু বলেছেন তা না হলে দাদাজান আমাকে জরুরি তলব করলো কেন? আপনি জানেন কত ঝামেলা করে আসতে হয়েছে আমাকে? টিচারের কত বকুনি সইতে হয়েছে?”
শায়লা রেগে গেলেন শান্ত হয়ে জবাব দিলো-“আপনাকে কতটা ঝামেলা করে আসতে হয়েছে সেটা আমার জানার কথা না। আমি ছিলাম না আপনার সাথে। আর রইলো দাদাজানের কথা, আমি এখানে এসেছি আপনি আসার দশ পনেরো মিনিট আগে। অতএব বুঝতেই পারছেন এ বিষয়েও আমি কিছু জানি না।”
রিদওয়ান তার কথায় অটল রইলো-“উহু, এ কথা বললে তো হবে না। আপনি অবশ্যই কিছু না কিছু বলেছেন। তা না হলে আপনি আসার পরই কেন দাদাজান আমাকে ডাকলো?”
“ঠিক এইসব কারনেই আমি ডাক্তার ছেলে দুই চোখে দেখতে পারি না। নিজে বাদে অন্য কাউকে দেখতে পায় না তারা। তারা শুধু সেল্ফ প্যামপারিং এ বিশ্বাস করে। নিজেকে প্রায়োরিটি দেয়। ভীষণ স্বার্থপর তারা।”
রিদওয়ান ভীষণ রেগে গেলো-“এখানে সেল্ফ প্যামপারিং এর কি দেখলেন আপনি? স্বার্থপরের মতো কিবা করলাম? তাছাড়া একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো, আপনি কয়টা ডাক্তার ছেলেকে চেনেন? তারা কি এমন করেছে যে আপনার এতো গাত্রদাহ হচ্ছে? বারবার একই অভিযোগ শুনতে শুনতে ত্যক্ত হয়ে গেলাম।”
শায়লা কিছু দমে গেলো রিদওয়ান এর আক্রমণে। তবুও হার মানবে না। সে বললো-“আমি কতজনকে তা জেনে কি করবেন? আপনার নিজের কথাই ধরুন। বারবার নিজের কথাই তো বলছেন ঘুরেফিরে। আপনার এখানে আসতে কতো কষ্ট হয়েছে, আপনাকে নিয়ে কি বলেছি। আরে বাবা, আমার কিসের ঠেকা পড়েছে আপনাকে নিয়ে আলোচনা করার। বারবার আমাকে না বলে দাদাজানকে জিজ্ঞেস করলেই তো পারেন।”
রিদওয়ান হাত ঝাড়লো, মুখ বিকৃত করে বললো-“সেটাই তো পারি না। বুড়ো ইমোশনাল ব্লাকমেল করে সিনক্রিয়েট করে ফেলে।”
“আচ্ছা, আমাকে একটা উত্তর দিন তো। আপনি বিয়েটা কেন করেছিলেন?”
শায়লার প্রশ্নে হতবাক রিদওয়ান বললো-“এখনো বুঝতে পারছেন না কেন বিয়ে করেছি? কে শখ করে পড়া অবস্থায় বিয়ে করে? খেয়েদেয়ে কাজ নেই নাকি?”
“তারমানে আমার সাথে বিয়েতে আপনার মত ছিলো না। অন্য কারো সাথে সম্পর্ক ছিলো আপনার?”
“আশ্চর্য কথা বলছেন তো? আপনাকে হুট করে ডেকে এনে বললো আজ তোর বিয়ে আর আপনি নাচতে নাচতে বিয়ের পিড়িতে বসবেন? কি আজব প্রশ্ন। তা আপনি কেন বিয়ে করেছিলেন? শখে?”
ব্যঙ্গাত্বকভাবে বললো রিদওয়ান। প্রশ্ন শুনে শায়লার রেগে যাওয়ার কথা কিন্তু সে রেগে গেলো না। উল্টো হেসে দিলো। রিদওয়ান ভ্যাবাচ্যাকা খায়। ও কি হাসির কথা বলেছে? অসন্তুষ্ট হয়ে তাকালেও শায়লার প্রানবন্ত হাসি দেখে চেহারায় অসন্তোষ গায়ের হয়ে গেলো নিজের অজান্তেই। শায়লা হাসি থামিয়ে চেহারায় গম্ভীরতার মুখোশ টেনে নিলো-“বিয়ের চিন্তা ভাবনা দূর নুন্যতম প্রেম ভালোবাসা নিয়েও ভাবিনি। আপনি হয়তো জানেন না আমি ভীষণ ভালো ছাত্রী। এই জেলার শ্রেষ্ঠ ছাত্রী আমি। প্রাইমারি থেকে ইন্টার পর্যন্ত স্কলারশিপ পেয়ে পড়েছি। এ পর্যন্ত এসেছি নিজের চেষ্টায়। খুব ইচ্ছে ছিল নিজে স্বাবলম্বী হবো কিন্তু দাদাজানের সেই ইচ্ছে পছন্দ হলো না আর আমারও স্বাবলম্বী হওয়া হলো না।”
রিদওয়ান এর মন খানিকটা খারাপ হলো। শায়লাও যে চাপে পড়ে রাজি হয়েছে সেটা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে। কেন যে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা ছোটদের মন বুঝতে চায় না। রিদওয়ান মৃদুস্বরে বললো-“আপনি এখনো স্বাবলম্বী হতে পারেন। কেউ আপনাকে মানা করবে না। আমার বড় দুই ভাবিকে তো দেখেছেন। দু’জনেই কিন্তু চাকরি করে আবার সুন্দর মতো সংসারও করছে।”
কথাগুলো বলেই চমকে গেলো রিদওয়ান। কেন বললো ওর কথাগুলো? এরকম কথা শায়লাকে বলার মানে কি? তার মানে কি সে বিয়েটা মেনে নিচ্ছে? রিদওয়ান ভীষণ অসস্তি বোধ করলো। শায়লাও কিছুটা বিস্মিত। সে বিস্ময় নিয়েই রিদওয়ানের দিকে তাকালে রিদওয়ান কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো-“প্লিজ কথাগুলো অন্যভাবে নেবেন না। আপনার কথার প্রেক্ষিতে কথাগুলো বলেছি। তাছাড়া একটা কথা তো মানতে হবে যে আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে। জানি বিয়েটা মনের বিরুদ্ধে হয়েছে কিন্তু দাদাজানকে আমি দুঃখ দিতে পারবো না কিছুতেই।”
শায়লা ক্লান্ত গলায় বললো-“এখানে দাদাজানকে দুঃখ দেওয়ার কথা আসছে কেন?”
“না মানে আমাদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং না হলে দাদাজান কষ্ট পাবে। সেটাই বলছি আর কি।”
“শোনেন, এই মুহূর্তে বিয়ে সংসার এসব নিয়ে ভাবতে চাই না আমি। পড়ালেখা হ্যাম্পার হোক সেটা কিছুতেই চাই না। দাদাজান আমাকে এটাই বলেছিল যে বিয়েটা হচ্ছে হোক, কোন কিছু বদলাবে না। আমি আমার মতোই পড়ালেখা করবো বা বাকী যা করা দরকার করবো।”
শায়লার কথা অপমান বোধ করে রিদওয়ান রেগে গেলো-“তো আমি বুঝি ভাবতে চাইছি? শ্বাস ফেলার সময় পাই না হাসপাতালে ডিউটি দিতে দিতে আর আপনি বলছেন সংসার নিয়ে ভাবতে। কি মনেহয় ডাক্তারি পড়া খুব ইজি?”
শায়লা চুপ হয়ে গেলো। পরমুহূর্তেই রিদওয়ান বুঝতে পারলো কাজটা একদমই ঠিক করেনি। এতো রুড হওয়া উচিত হয়নি। সে কন্ঠস্বর কিছুটা নরম করে বললো-“সরি, আমি আপনাকে হার্ট করতে চাইনি।”
আবারও নিরবতা। দু’জনেই চুপ করে বসে আছে। অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর রিদওয়ানই মুখ খুললো-“শুনুন, ঝগড়াঝাটি না করে আমরা বরং নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে একটা সলুশনে আসতে পারি। যেহেতু আমরা দু’জনই পড়ছি, এখনো ছাত্র ছাত্রী তাই বিয়েটা নিয়ে মনে চাপ নিয়ে নিজেদের ক্ষতি করা উচিত হবে না। দাদুরাও তো বলেছে এখনই সংসার না। কিন্তু তারা চায় আমাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক হোক। বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক দেখলে তারা হয়তো শান্তি পাবে। এভাবে কারণে অকারণে আমাদের ডেকে এনে অসস্তিতে ফেলবে না।”
শায়লা কিছু না বলে মাথা দুলায়। মনে মনে বললো, এখন এটাই বাকি আছে করতে। আমার এতো খারাপ দিন এলো যে আপনার সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে আপনি আমার হৃদয় ভাঙতে পারেন। রিদওয়ান কিছু ভেবে নিয়ে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ে-“আমাদের দুজনকেই দাদুদের সামনে একটু অভিনয় করতে হবে। এমন দেখাতে হবে যে আমাদের মধ্যে সব ঠিক আছে। তাহলেই আর তারা আমাদের বিরক্ত করবে না। আমরাও শান্তিতে থাকতে পারবো।”

চলবে—-
©Farhana_Yesmin