এরই মাঝে পর্ব-১৬

0
104

#এরই_মাঝে
#পর্ব-১৬

“তোমরা আমাকে দুলাভাই না ডেকে ভাইয়া ডাকতে পারো। দুলাভাই কেমন পরপর শোনায়। বরং ভাইয়া ডাকলে মনে হবে আপন বোন ডাকছে। তাছাড়া আমার একটা আক্ষেপ ছিলো জানো?”
রিদওয়ানের দৃষ্টি পুকুরের গভীর জলে নিবন্ধ। দুই বোন উৎসুক দৃষ্টি মেলে রিদওয়ান এর দিকে তাকিয়ে একসাথে জানতে চাইলো-“কি আক্ষেপ ভাইয়া?”
ওদের ডাক শুনে রিদওয়ানের মুখে হাসি ফিরে এলো-“আমার কোন ছোট বোন ছিলো না এই আক্ষেপ। কিন্তু এখন তো আমি দু’দুটো ছোট বোন পেয়ে গেলাম। তোমাদের ভাইয়া ডাক শুনে আমার ছোটবোন না থাকার দুঃখ ফুরররর হয়ে গেলো।”
রিদওয়ান হাতের ইশারায় অভিনয় করে দেখাতেই মহুয়া আর বিনা খিলখিল হাসিতে লুটোপুটি খায়। রিদওয়ান মুগ্ধ চোখে দুই সরল কিশোরীর হাসি দেখে। মহুয়া হাসি থামিয়ে বললো-“ভাইয়া, ছোটবোনদের জন্য কি এনেছেন? আমরা কিন্তু গিফট না নিয়ে ছাড়বো না। বিয়ের পর প্রথমবার এসেছেন বলে কথা।”
রিদওয়ানের মুখে কালো মেঘের ঘনঘটা-“সরি পিচ্চিরা, তোমাদের জন্য এবার কিছু আনতে পারিনি। দাদাজান হুট করে ডাকলো আমিও ডিউটি আর ক্লাস ফেলে ছুটে চলে এসেছি। কারো জন্য কিছু আনিনি। তবে আই প্রমিজ ঢাকায় যেয়েই তোমাদের জন্য গিফট পাঠাবো।”
এ কথা শুনে দুই বোনই খুশি হয়ে গেলো। মহুয়া হঠাৎ বললো-“ভাইয়া, আপুর জন্যও কোন গিফট আনেন নাই?”
মহুয়া অবাক জানতে চাইলে রিদওয়ান মাথা নাড়ে-“আরে তোমার রাগী বোন যে এখানে এসেছে তাই তো জানতাম না।”
বিনা ফিক করে হাসলো-“আপা আসলেও অনেক রাগী। ধমক ছাড়া কথা বলতে পারে না।”
“সত্যি! আমার তো রাগীর চাইতে বেশি ঝগড়াটে মনে হয়েছে।”
দুই বোন একে অপরকে দেখলো, তারপর দুইজন সমস্বরে বলে উঠলো-“ঝগড়া আর আপা?”
রিদওয়ান ঘাবড়ে গেলো-“হ্যা কেন? তোমার আপা ভীষন ঝগড়া করে।”
“আপা তো কথাই বলে না। সারাক্ষন মুখ গম্ভীর করে বইয়ে মুখ গুঁজে থাকে। ওকে দেখলে আমার বোন কম মাস্টারনি বেশি লাগে।”
বিনা বলতে বলতে হিহি করে হাসলো। রিদওয়ানও ওদের সাথে হাসলো-“আমারও তাই মনেহয়।”
মহুয়া ফিসফিস করলো-“এই ভাইয়া, আপা যেন গিফট এর কথা না জানে। জানলে রাগ করবে।”
রিদওয়ান আরেকপ্রস্ত অবাক-“ওমা! রাগ করবে কেন? ভাই বোনদের গিফট দেবে না?”
“আপা কারো কাছ থেকে কিছু নেওয়া পছন্দ করে না।”
“স্ট্রেন্জ! আচ্ছা তোমার আপা বলে ডাক্তারিতে চান্স পেয়েছিল? তা পড়লো না কেন?”
মুখ পাতলা বিনা ফট করে বলে দিলো-“কেন আবার বাবার উপর রাগ করে। বাবা ডাক্তার কিনা। আপু বাবাকে পছন্দ করে না আর ডাক্তারও ওর পছন্দ না। এই যে মহুয়াপু ডাক্তারি পড়তে চায় আপা মানা না করলেও খুশি না।”
রিদওয়ান মহুরার দিকে তাকিয়ে হাসলো, হাতে চিমটি কেটে বললো-“ভবিষ্যতে সেম প্রোফেশনে থাকবো বলে পিন্চ মহু।”
রিদওয়ান এর মুখে মহু ডাক শুনে মহুয়া আবেগতাড়িত হয়ে গেলো। কানতে মন চাইছে ওর। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো-” ভাইয়া, আমি ভেবেছি পরীক্ষা দিয়েই ঢাকায় যাব ডাক্তারির জন্য কোচিং করতে। কিন্তু ভাবনা হচ্ছে দাদাজান আবার আপুর মতো আমারও বিয়ে না দিয়ে দেয়।”
রিদওয়ান হাসতে যেয়েও হাসে না। সে মহুয়াকে অভয় দিলো-“তোমার পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্রই আমাকে জানাবে। আমি দাদুকে ফোন দিয়ে কথ বলবো। আর কোচিং এর সব ব্যবস্থা করে রাখবো।”
মহুয়া খুশিতে চেচিয়ে উঠলো-“সত্যি ভাইয়া?”
রিদওয়ান মাথা দুলিয়ে সায় জানাতেই মহুয়ার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো-“ভাইয়া, কি উপকার যে করলেন। আপুকে কোচিং এর কথা বলতে খুব খারাপ লাগে। এখন আর বলতে হবে না ওকে।”
রিদওয়ান গম্ভীর হয়ে চুপচাপ বসে রইলো। হুট করে ওর মুড পাল্টে যাওয়ার কারণ বুঝলোনা দুই বোন। ওদের ও মন খারাপ হলো। রিদওয়ান দু’জনকে চুপ করে যেতে দেখে ঠোঁট উল্টো বললো-“আমি মন খারাপ করেছি।”
দু’জন সমস্বরে জানতে চাইলো-“কেন ভাইয়া?”
“ভাইয়া ডাকছো আবার বলছো উপকার করেছি। তাই মন খারাপ হয়েছে। ভাইয়া কিছু করলে সেটা ভাইয়ার দায়িত্ব, সেটা উপকার নাম দিলে ভাইয়াকে অপমান করা হয়।”
মহুয়া কান ধরে-“সরি ভাইয়া, আর বলবো না। প্লিজ মাফ করে দেন।”
“মনে থাকবে তো?”
মহুয়া মাথা দুলায়। রিদওয়ান ওর মাথায় হাত রেখে বললো-“তোমাকে মাফ করলাম বৎস।”
বলেই হো হো করে হাসলো। মহুয়া আর বিনাও হাসছে হিহিহি করে।
“তোদেরকে মা ডাকছে।”
শায়লার কন্ঠ শুনে তিনজনই চমকে উঠলো। মহুয়া আর বিনার মুখ পাংশুটে দেখায়। অনিচ্ছায় উঠে দাঁড়ালো দু’জন। তিনবোনই চলে আসবে এমন সময় রিদওয়ান ডাকলো-“তোমাদের বাড়িতে বুঝি মেহমানকে একা বসিয়ে রাখার নিয়ম?”
“তোরা যা আমরা আসছি।”
দুই বোনকে চলে যাওয়ার ইশারা করে শায়লা রিদওয়ান এর পাশে বসলো। দু’জনই কিছুক্ষণ চুপচাপ পুকুরের জলে দৃষ্টিপাত করে রইলো।
“এই পুকুর পাড় তোমার অনেক প্রিয় তাই না?”
শায়লা নাক মুখ কুঁচকে তাকাতেই রিদওয়ান বললো-“হোয়াট? তুমি আমার চাইতে অনেক ছোট তাই তোমাকে তুমি করেই বলবো। এতে এতো নাক মুখ কুঁচকে থাকার কি আছে? আর সবসময় এমন রাগী টিচারের মতো মুখ বানিয়ে রাখো কেন? দেখলে মনেহয় পয়ত্রিশ এর বুড়ি।”
শায়লার মেজাজের দফারফা হলো। সে রাগে গরগর করে-“আমাকে পয়ত্রিশ বছরের বুড়ির মতো দেখায়? আমি রাগী টিচারের মতো?”
রিদওয়ান ভদ্র ছেলে হয়ে উত্তর দিলো-“তা নয়তো কি? আয়নার দেখেছ নিজেকে? দেখলেই বুঝতে পারবে আমি মিথ্যে বলছি না। আজ আমি তোমাকে শায়লা না রাগী টিচার নামে ডাকবো।”
রাগে শায়লার শরীর কাঁপে, নাক মুখ লাল হয়ে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“আর আপনি কি? নিজেকে কি সালমান খান মনেহয়?”
“উহু, আমি রিদওয়ানুল হক, সালমান খান কেন হবো।”
“জ্বি না, আপনি যেহেতু কয়দিন পরে ডাক্তার হয়ে রোগীদের পকেট কাটবেন তাই আপনি হচ্ছেন ক*সা*ই হক।”
“ডাক্তার কি শুধু রোগীর পকেট কাটে? জীবন বাঁচায় না?”
রিদওয়ান আহত কন্ঠে শুধায়। শায়লা একটুও না দমে বললো-“জীবন বাঁচাক বা না বাঁচাক পকেট কাটবেই। তা না হলে আপনাদের আবার পেটের ভাত হজম হয় না। আর মন নিয়ে খেলা তো আপনাদের স্বভাব।”
“কয়জন ডাক্তার দেখেছ এমন? আর যদি দেখেও থাকো আমাকে বলছো কেন? আমি কি এমন কিছু করেছি? নিজেকে দেওয়ার মতো সময়ই তো পাই না কারো মন নিয়ে খেলবো কখন? ভেরি ব্যাড শায়লা। রেগে হুঁশ হারিয়ে ফেলেছ দেখছি।”
রিদওয়ানের শান্ত ধীরস্থির মনোভাব দেখে শায়লা ঘাবড়ে গেলেও হার না মেনে অটল গলায় বললো-“হুঁশ হারাই বা না হারাই সত্য বদলে যাবে না।”
কথাটা বলে শায়লা উঠে চলে যাচ্ছিল রিদওয়ান বললো-“থামো শায়লা। বসে থাকো। কথা শেষ করি।”
শায়লা আবারও বসলো-“কি বলবেন বলুন?”
রিদওয়ান গভীর শ্বাস টানলো-“তোমার আমার সাথে সবসময় রেগে কথা বলার কারণটা আমি বুঝতে পারছি না আসলে। আমাকে নিয়ে তোমার সমস্যা কি? বিয়েটা তো তোমার কিংবা আমার কারো ইচ্ছাতেই হয়নি। তাহলে তুমি কেন এমন ব্যবহার করছো যাতে আমার নিজেকে দোষী মনেহচ্ছে। আমাকে বলো আমার দোষটা কি?”
শায়লার চেহারা মলিন হলো। দেবার মতো উত্তর সে খুঁজে পেলো না। আসলেই রিদওয়ান এর কোন দোষ নেই। বরং অপরিচিত রিদওয়ান তাকে নানাভাবে সাহায্য করেছে। কিন্তু ওর ডাক্তার হওয়াটা কেন যেন মেনে নিতে পারছে না শায়লা। বারবার মনেহচ্ছে ওর বাবা মায়ের সাথে যা করেছে রিদওয়ান ওর সাথে তাই না করে। মনে ভীষণ ভয় হয় শায়লার। নিজেকে মায়ের মতো পরিত্যক্ত অবস্থায় আবিস্কার করার ভয়। কিন্তু সেসব কথা রিদওয়ানকে বলা অর্থহীন। শায়লা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো-“আমার মনেহয় ডাক্তারদের নিজের প্রফেশনের মধ্যে বিয়ে করা উচিত। তাতে আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর সুবিধা হয়। যাহোক, আমাদের বিয়েটা নিয়ে আমি আরেকটু ভাবতে চাই। আপনিও ভাবুন। আমার সাথে এডজাস্ট করতে পারবেন কিনা। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।”
রিদওয়ানের চোখে বিরক্তি। শায়লা উঠে কাপড়ের ময়লা ঝাড়ে-“এখন আসুন প্লিজ। বেলা হয়েছে দুপুরের খাবার খেতে হবে।”
অবুঝ মেয়েটার সাথে কথা বাড়ানোর ধৈর্য্য হলো না রিদওয়ান এর। সে শায়লার পেছনে হাঁটা ধরলো।

খালি হাতে এসেছিল রিদওয়ান রাতে বিদায় নেওয়ার সময় তিনটে ব্যাগ বাড়তি হলো। শায়লা মা হরেকরকম পিঠেপুলি, হাস মুরগী রেধে ব্যাগ লোড করে দিয়েছে। সব খাবার রিদওয়ানের বাড়ির জন্য। শুনে মুখ শুকিয়ে গেলো রিদওয়ান এর। বাড়িতে কিছু জানিয়ে আসেনি। এখন এসব নিয়ে বাসায় গেলে মা নির্ঘাত সিনক্রিয়েট করবে। ভাববে ও লুকিয়ে চুরিয়ে শশুরবাড়ি যায়। মুরব্বিদের মুখের উপর কিছু বলাও যায় না। কি বলবে কি করবে ভাবতে ভাবতে অসহ্য হয় রিদওয়ান। গাড়িতে ওঠার পর থেকে ভেবেই যাচ্ছে। শায়লা মোবাইল ক্রল করতে করতে আড়চোখে রিদওয়ানকে দেখে। দুশ্চিন্তাগ্রস্থ রিদওয়ানের চিন্তার কারণ খুঁজে পায় না। অনেকক্ষণ দেখে থাকতে না পেরে শায়লা বলেই ফেললো-“কোন সমস্যা হয়েছে? তখন থেকে দেখছি ভেবেই যাচ্ছেন। কি ভাবছেন এতো?”
রিদওয়ান শায়লার দিকে তাকালো। মেয়েটার উৎসুক দৃষ্টি নজর এড়ায় না। রিদওয়ান দ্বিধা নিয়ে বললো-“ভাবছি তোমার মা যেসব দিয়েছে সেগুলো নিয়ে বাসায় গেলে খুব সমস্যা হবে। আম্মু খুব ঝামেলা করবে। ভাববে আমি মনেহয় প্রায়ই এখানে আসি।”
শায়লা অবাক হয়ে বললো-“এমন ভাববে কেন? আপনি তো যান না গ্রামে।”
রিদওয়ান মৃদু হাসলো-“যাই না কিন্তু আম্মু মনে করবে। আর কারো মনে করা তুমি কিভাবে ঠেকাবে?”
সত্যি বলতে শায়লাও ভেবেছে এ নিয়ে। জাকিয়া তাকে বিশেষ পছন্দ করে না সেটা সে টের পায়। তাই বলে মায়ের দেওয়া জিনিসগুলো দেবে না তা কি করে হয়?
শায়লা বললো-“কিন্তু না দিয়ে কি করবেন? তাছাড়া দাদু তো নিশ্চয়ই ফোন দিয়ে জানতে চাইবে জিনিসগুলো পেয়েছে কিনা। আমার মনেহয় না এতো লুকোচুরি প্রয়োজন আছে। আমরা তো পালিয়ে বিয়ে করিনি বা তেমন কোন অপরাধ করিনি কাজেই অমুলক ভয় পাওয়ার প্রয়োজন দেখছি না।”
“বলছো?”
শায়লা মাথা দুলায়। রিদওয়ান আর কিছু না বললেও ওর মায়ের ভাবনা মাথা থেকে গেলো না। ভয় হচ্ছে এসব দেখে মা শায়লাকে না উল্টো পাল্টা কথা শুনায়।

চলবে—-
©Farhana_Yesmin