এরই মাঝে পর্ব-২৫+২৬

0
117

#এরই_মাঝে
#পর্ব-২৫

রিদওয়ান চলে যাওয়ার পরে ওয়াহেদ ক্রুদ্ধ হয়ে মুনিয়াকে দেখলো, শীতল গলায় জানতে চাইলো-“তুই শায়লাকে কি বলেছিস মুনিয়া? সত্যি করে বল?”
মুনিয়া ঢোক গিললো, মায়ের দিকে তাকালো। জাকিয়া এগিয়ে এলো-“তুমি ওকে এতো জেরা করছো কেন? যেটাই বলুক মেয়েটার এতো রিয়্যাক্ট করার দরকার কি?”
ওয়াদের তীব্র বিতৃষ্ণা নিয়ে জাকিয়াকে বললো-“বাবা শখ করে রিদওয়ানকে বিয়ে দিয়েছে নিজের পছন্দের মেয়ের সাথে। মেয়েটা ভালো, ভদ্র। অথচ তোমরা সেই মেয়েটাকে নানাভাবে হেনস্তা করছো। কি চাইছো তোমরা সেটা পরিস্কার বুঝতে পারছি।”
জাকিয়া বিস্মিত হওয়ার ভান করলো-“কি চাইছি?”
“অভিনয় করো না জাকিয়া, অন্তত আমার সাথে অভিনয় করো না।”
ওয়াহেদের ঝাঁঝালো দৃষ্টি জাকিয়াকে দমাতে পারলো না। সে মুখটা দুঃখী দুঃখী করে বললো-“এখানে অভিনয়ের কি দেখলে? তাছাড়া সেদিনের আশা একটা মেয়ের জন্য তুমি তোমার বউ আর মেয়েকে কথা শোনাচ্ছ? মেয়েটা তোমার এতো আপন আমরা কেউ না?”
ওয়াহেদ বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে উত্তর করলো-“মেয়েতা তোমার ছোট ছেলের বউ। মেয়েটার কথা না ভাবলে অন্তত রিদওয়ানের কথাটা ভাবো। স্পষ্ট বুঝতে পারছি রিদওয়ান মেয়েটাকে পছন্দ করতে শুরু করেছে।”
জাকিয়া ফুঁসে ওঠে-“সব তোমার বাবার চাল। ইচ্ছে করে ওকে ডেকে নিয়ে মেয়েটার সাথে জোর করে ভাব জমানোর চেষ্টা করছে।”
“আর কত জাকিয়া? বাবার প্রতি আর কতো অভিযোগ দিলো তোমার অন্তর শান্ত হবে? আমি বুঝে পাই না বাবার প্রতি কেন এতো রাগ তোমার? বুড়ো একজন মানুষ, শেষ বয়সে এসে একটা ইচ্ছে পূরণ করেছে তাতে কেন তোমার গা জ্বলছে?”
ওয়াহেদ ধৈর্য্য হারা হয়ে গেলো। জাকিয়া ওয়াহেদের দিকে তাকিয়ে বললো-“কারণ ইচ্ছে পূরনে আমার ছেলে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়েছে।”
এবার যেন ওয়াহেদের ধৈর্য্যর বাঁধ ভেঙে গেল-“তুমি মা না আর কিছু? দেখতে পাচ্ছ না
যে রিদওয়ান মেয়ে সহ্য করতে পারতো না সে শায়লার প্রতি কতটা দায়িত্ববান? ধীরে ধীরে ছেলেটা স্বাভাবিক হচ্ছে তবুও তোমার শায়লাকে ভালো লাগছে না শুধুমাত্র বাবার পছন্দ বলে? তোমার ঈর্ষার লেভেল দেখে খারাপ লাগছে জাকিয়া। এতো ঈর্ষা ভালো নয়৷ তোমার এই ব্যবহারে আমার ছেলেটা না কষ্ট পায়।”
ওয়াহেদ এবার মুনিয়ার দিকে তাকালো-“তুমি নিশ্চয়ই মেয়েটার আত্ম সন্মানে আঘাত করেছ। তা না হলে ও চলে যেত না। খুব খারাপ কাজ করেছ মুনিয়া। ও এমনিতে এ বাড়িতে আসতে চায় না। অনেক রিকোয়েস্ট করে এনেছিলাম অথচ তুমি আমার মান রাখলে না। তুমি হয়তো জানো না, মেয়েটা কতটা ভালো ছাত্রী। নিজের পড়ার খরচ নিজে ম্যানেজ করছে। রিদওয়ান বা অন্য কারো টাকা ও ছুঁয়েও দেখবে না।”
মুনিয়া আমতাআমতা করে-“আমি তো কেবল জানতে চেয়েছি এতো গিফট করার টাকা সে পেলো কোথায়?”
ওয়াহেদ হতাশ চোখে মুনিয়ার দিকে তাকালো-“অনেকগুলো টিউশনি করার ও। শপিং এর জন্য অন্যের টাকা কেন লাগবে ওর? নেওয়ার হলে তো ওর বাবার টাকাই নিত। ওর বাবা ওদের প্রচুর টাকার অফার দেয় কিন্তু ওরা সবিনয়ে ওদের বাবাকে প্রত্যাখ্যান করে।”
ওয়াহেদ থেমে লম্বা শ্বাস নিয়ে বললো-“একটা কথা পরিস্কার করে বলে দেই তোমরাও কান খুলে শুনে নাও। তোমাদের সবার কাছে অনুরোধ দয়া করে শায়লার পেছনে লাগবে না। শায়লা এ বাড়ির বউ এটা মেনে নাও তোমরা। বাবার বন্ধুর মেয়ে এ বাড়িতে স্ব সন্মানে থাকবে। এটুকু যদি তোমাদের ভালো না লাগে আমিই চলে যাব এ বাড়ি থেকে। সারাজীবন বাবার জন্য কিছু করিনি এখনও মানুষটাকে এতটুকু শান্তি যদি দিতে না পারি তাহলে ছেলে হিসেবে ব্যর্থতা আমার। আমি সে ব্যর্থতা মেনে নিয়ে সরে যাব তোমাদের জীবন থেকে।”
কল্লেল এবার কথা বলে-“এসব কি কথা বাবা? মুনিয়ার সাথে সাথে তুমিও বাচ্চা হয়ে গেলে নাকি? শায়লাকে নিয়ে আমাদের কারো কোন সমস্যা নেই। মেয়েটা ভালো, রিদওয়ান ভালো থাকবে ওর সাথে।”
ওয়াহেদ মাথা নাড়ে-“তোমরা মেনে নিলেও তোমাদের মায়ের আপত্তি আছে। সে নানাভাবে শায়লাকে হেউ করার চেষ্টা করে এটা দেখনি?”
পল্লবী আর মালিহা দৃষ্টি বিনিময় করলো। দু’জনই চুপ করে থাকলো। বউ তো তারাও তাই এই আলোচনায় যেতে চায় না। জাকিয়া ঠোঁট কামড়ে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে। মুনিয়া উঠে দাঁড়ালো-“আমি তাহলে যাই।”
“যাও। অনুষ্ঠান তো পন্ড। তবে খাবার আছে খেয়ে যাও আর ও বাড়ির সবার জন্য নিয়ে যাও।”
মুনিয়া ঠোঁট বাঁকালো-“লাগবে না।”
ওয়াহেদ ভ্রু কুঁচকে বললো-“লাগবে না কেন? বড় বউমা মুনিয়ার খাবার দিয়ে দাও।”
“জ্বি বাবা।” পল্লবী উত্তর দিলো। ওয়াহেদ পুনরায় মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো-“আর মুনিয়া শোন, কথাবার্তায় সংযমের পরিচয় দাও।অকারণে কাউকে কষ্ট দেওয়া ভালো কথা নয় মা। তুমি কাউকে কষ্ট দিলে সেই কষ্ট কাল তোমার জীবনেও ফেরত আসবে ধরে নিয়। তাই আগে থেকে সাবধান হও।”
জাকিয়া তেতে উঠলো-“কেমন বাপ তুমি? মেয়ের কষ্ট কামনা করছো?”
ওয়াহেদ হতাশ চোখে জাকিয়াকে দেখলো তারপর ধীর পদক্ষেপে নিজের কামরায় চলে গেল। যারা নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে তাদের বোঝানো বড্ড কঠিন কাজ। ওয়াহেদ বেশ চিন্তিত হলো। শায়লা আর রিদওয়ানের সম্পর্কটা শুরু হতেই শেষ না হয়ে যায়।

*****

এলোমেলো হাঁটছিল শায়লা। জলে ভেজা ঝাঁপসা চোখে সামনে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। আজকের আগে নিজেকে এতো ভাঙাচোরা আর লাগেনি আগে। যে সম্পর্কে জড়াতে চায়নি সেই সম্পর্ক থেকে এমন অপমান কে মেনে নেবে? দাদার উপর শায়লার পুরনো রাগটা ফেরত এলো। আরও জোরে জোরে হাঁটতে থাকে সে। নয়ন দুটো থেকে অবিরাম জলের ফোয়ারা বয়ে চলেছে। খুব ইচ্ছে করছে দাদাজানকে ফোন করে বলতে, বিয়েটা কেন দিলো? অপমান করার জন্য? মানুষের কটু কথা কি কম শুনেছে জীবনে? নতুন করে কেন আরও কিছু মানুষকে জুটিয়ে দিলো? ভাবতে ভাবতে হঠাৎই ইটের টুকরোতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো শায়লা। ভীষণ ব্যাথা পেলো হাঁটুতে। দাঁতে দাঁত চেপে অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়াতেই টের পেলো পায়ের পাতায় কয়েক ফোঁটা রক্ত পড়লো। ভয় পেয়ে শাড়ীটা হাঁটু বরাবর চেপে ধরতেই কাপড় ভিজে গেলো রক্তে। ভীষন জ্বলছে হাঁটুর জায়গাটা। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথ্যা সহ্য করে নিলো শায়লা। এই শারীরিক ব্যাথা তুচ্ছ কিছুক্ষণ আগে পাওয়া মানসিক আঘাতের কাছে। শায়লা কাপড়ে লেগে থাকা ময়লা ঝেড়ে পুনরায় হাঁটতে শুরু করে। পায়ের ব্যাথায় কিছুটা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে। চোখ দুটো মুছছে বারবার।
“শায়লা, থামো প্লিজ। কোথায় যাচ্ছ?”
চমকে পিছু ফেরে শায়লা। পেছনে ফিরে রিদওয়ানকে দেখতে পেলো। শায়লার পেছনে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে ছেলেটা। কিছুক্ষন আগের ঘটনার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো রিদওয়ান এর উপর। সে চেচিয়ে উঠলো-“জাহান্নামে যাচ্ছি। যাবেন? চলুন একসাথে যাই।”
রিদওয়ান হতচকিত হলো, শায়লার মেজাজ হালকা করার চেষ্টায় উত্তর দিলো-“স্ত্রী যেখানে যাবে স্বামীর তো বাধ্য হয়ে সেখানেই যেতে হবে। কি আর করা চল যাই জাহান্নামে।”
শায়লার রাগ পড়লো না তাতে। সে চোখ দিয়ে রিদওয়ানকে ঝলসে দিতে চাইলো-“ফান করছেন?আমাকে হেনস্থা হতে দেখে খুব মজা লাগছে আপনার, তাই না?”
রিদওয়ান ব্যাথীত নয়নে তাকালো-“এই বুঝলে আমাকে? এতোক্ষণ কি আমি কিছু করেছি কিছু বলেছি তোমাকে? আমার উপর রাগ দেখাচ্ছ কেন?”
শায়লা একটুও না দমে উত্তর দিলো-“এতো ভালো সাজতে যাবেন না। আপনারা বড়লোকগুলো সবাই এক। নিজেদের বাদে বাকী সবাইকে ধুলিকণা মনে করে উড়িয়ে দিতে চান। আমার সামনে আর ভং ধরে থাকবেন না৷ আপনাদের চেনা শেষ আমার।”
রিদওয়ান কোমল কন্ঠে বললো-“একজনের রাগ আরেকজনকে দেখানো কি ভালো? শায়লা, প্লিজ ওদের জন্য নিজেকে কষ্ট দিয় না, আমাকে কষ্ট দিয় না।”
শায়লা গা ঝাড়া দিলো-“এসব মন ভোলানো কথা বলবেন না প্লিজ। কোন কথাতেই আর আমি পটছি না। আমি তো আসতে চাই না আপনাদের বাড়িতে। বারবার নিজেরা ডেকে এনে অপমান কেন করেন? কি দোষ আমার? আমি কি আপনাকে জোর করে বিয়ে করেছি? নাকি আপনার পরিবারকে বাধ্য করেছি? কেন তারা এমন করে?”
রিদওয়ান চুপ করে রইলো। শায়লার অভিযোগ সত্য তাই অভিযোগ খন্ডনের কোন চেষ্টা করে না সে। রিদওয়ান একটা রিকশা দাঁড় করিয়ে উঠে পড়ে। শায়লাকে ডাকলো-“চলো ক্যাম্পাসে ফিরি।”
শায়লা মাথা নাড়লো-“আপনি যান। আমি যাব না আপনার সাথে।”
“অকারণ জেদ কেন করছো শায়লা? এতোক্ষণ যা বলেছ শুনেছি তাই বলে যা খুশি তা করবে?”
শায়লা গোঁয়ারের মতো উত্তর দিলো-“হ্যা করবো। কি করবেন আপনি?”
রিদওয়ান শান্ত নজরে শায়লাকে দেখলো-“মাকে ফোন করে বলবো তার মেয়েকে ঠিক মতো মানুষ করতে পারেনি। সে স্বামীর কথা শোনে না। বেয়াদব।”
মায়ের কথা শুনে শায়লা চুপ করে গেলো। মেজাজ ভীষণ খারাপ হলেও জবাব দিলো না কোন। চুপচাপ এসে রিদওয়ান এর পাশে বসলো। রিকশা চলতে শুরু করলো। শায়লা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে। রিদওয়ান ওকে দেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে নিজেকে দেখে। কেন সে এই মেয়েটাকে নিয়ে এতো ভাবে? এমন কি আছে মেয়েটার মধ্যে? কেন মেয়েটার জন্য কিছু করতে ভালো লাগে তার? মেয়েটার মন খারাপ দেখলে কেন বুকের মাঝে হাহাকার হয়, পৃথিবী ওলট পালট করে দিতে মন চায়? অনেক ভেবেও উত্তর পায় না রিদওয়ান। এই যেমন এই মুহূর্তে মেয়েটার বাচ্চাদের মতো ফুলিয়ে রাখা অভিমানী মুখটা দেখে আদর করে দিতে মন চাইছে। বলতে ইচ্ছে করছে, ‘পৃথিবীর যে যাই বলুক আমি তো জানি তুমি কেমন? তাই কারো কথায় কিছু মনে করো না মেয়ে। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি ভীষণ ভাবে।’ নিজের মনের ভাবনার নিজেই চমকে উঠলো রিদওয়ান। এসব কি ভাবছে সে? শায়লা জানলে কি ভাববে? বেচারী তাকে বিশ্বাস করে। করুক, আমি তো বিশ্বাস ভাবছি না। আমি কেবল ওর ভাঙা মনটা জোড়া দিয়ে ওকে ভালো ভাবে বাঁচতে শেখাচ্ছি। রিদওয়ান নিজেকে প্রবোধ দিলো। সে আলতো ভাবে শায়লার হাতে হাত রাখলো-“রাগ করে না বউ। আমি আছি তো পাশে।”

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#এরই_মাঝে
#পর্ব-২৬

রিদওয়ানের কাতর গলায় বলা বাক্যে এমন কিছু ছিলো যে শায়লা চমকে উঠে তার দিকে তাকালো। রিদওয়ানের চোখ দুটোতে রাজ্যের অনুভূতি জমা হয়েছে। ঠিক কি বলতে চাইছে ওর গভীর দুই নয়ন অবোধ শায়লা বুঝলোনা। তবে ওর অভিমান খানিকটা হালকা হলো, বুকের মধ্যে কষ্টের অনুভূতিতে কিছুটা প্রলেপ পড়লো বুঝি। অনেকটা সময় দুঁজন দু’জনার দিকে তাকিয়ে রইলো। বিব্রত হয়ে শায়লাই নজর ফিরিয়ে নিলো। তার দৃষ্টি সোজা সামনের রাস্তায়। সেদিকে তাকিয়ে থেকেই সে মৃদুস্বরে বললো-“কি বললেন? বউ? এতো সহজে মেনে নিলেন? আপনি আমাকে দয়া করছেন নাতো রিদওয়ান? আপনার দাদাজানের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করতে আমাদের সম্পর্ককে নাম দিচ্ছেন নাতো? কয়েকবছর পরে আবার দেখা যাবে লাইপ পার্টনার হিসেবে আমাকে অযোগ্য লাগবে আপনার। এরচেয়ে আগেভাগে বলে দেওয়া ভালো। আমি মেনে নেব রিদওয়ান কিন্তু এখন এসব বলে পরে আমাকে মাঝরাস্তায় একা ফেলে যাবেন তা সহ্য করতে পারবোনা।”
বলে পুনরায় রিদওয়ানের দিকে তাকালো শায়লা। একসাথে এতগুলো কথা রিদওয়ানের হজম হলো না ঠিক। সে সহসাই দেওয়ার মতো কোন জবাব খুঁজে পেলো না। কিছুক্ষণ ভাবলো, ভেবে খানিক বাদে বললো-“জীবনকে সহজভাবে দেখা যায় না শায়লা? আমার কোন ব্যবহারটা তোমার কাছে করুনা মনে হলো বলো তো?”
“সবই। এই যে আমার চাইতে বেশি আমার পরিবারের চিন্তা করা, তাদের জন্য দায়িত্ব পালন করা সবই করুনা মনেহয়। মনেহয় আপনি দাদাজানের আদেশ পালন করছেন কেবল। তাকে খুশি করতে এতো কিছু করছেন।”
রিদওয়ান শায়লার কোমল মুখাবরণ দেখলো কিয়ৎকাল। অনেকটা ভাবুক মানুষের মতো বললো-“আমরা মানুষরা বড্ড আজব বুঝলে। মন একরকম চায় মস্তিষ্ক চায় আরেকরকম। মন আর মস্তিষ্কের চাওয়া পাওয়া বেশিরভাগ সময় সাংঘর্ষিক। আমাদের মন চায় স্বাধীনভাবে বাঁচতে অথচ মস্তিষ্ক নিয়মে আবদ্ধ। ছোট বেলা থেকে যা আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় আমরা জ্ঞানে অজ্ঞানে সেসবই মেনে চলি। সমাজিক রীতিনীতি, পারিবারিক শিক্ষা সবমিলিয়ে আমাদের মন আর মগজ সবসময় একটা যুদ্ধের ময়দান। এন্ড গেস হোয়াট, বিজয়ী কে হয় জানো? আমাদের মগজ। মগজের কথা অনুযায়ী চলতে চলতে আমরা একসময় বিশ্বাস করতে শুরু করি আমরা যা করছি তা আমাদের মন চাইছে বলে করছি। আমরা আসলে নিয়মে চলে অভ্যস্ত। মুখে যত যাই বলি না কেন মন চায় কারো নিয়মের বেড়াজালে জীবনটা নির্ঝন্ঝাট কাটুক। যতই দাদাজানের চাওয়া হোক না কেন এই চাওয়া অনুযায়ী চলতে ভালো লাগছে আমার।”
শায়লা ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে-“আপনার এতো কঠিন কথা আমি বুঝি না রিদওয়ান। সত্যি বলতে এতো সহজে আপনাকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার বারবার মনেহচ্ছে আমাদের সম্পর্কটাকে আরও সময় দেওয়া উচিত। শুধু দাদুদের কথায় ভরসা করা উচিত হবে না। আমি নিজেকে কোন একটা পর্যায়ে না নিয়ে অন্য কিছু ভাবতে পারছি না আসলে। জীবনের এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে কেউ আমাকে সামান্য খোঁচা দিলেও আমার মান সন্মানের ঘরে টান পড়ে। আমি মেনে নিতে পারি না।”
রিদওয়ান নরম করে হাসলো-“আপুর কথা শুনে এটা মনেহলো?”
শায়লা মাথা নাড়ে-“উহু, নতুন করে বুঝতে পারলাম। লক্ষ্য থেকে সরে যাওয়া যাবে না। আমার মনেহয় কি জানেন, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক হবে ফিফটি ফিফটি। অবস্থান যোগ্যতা সব মিলিয়ে দু’জন দু’জনার পরিপূরক হবে। একজন বিশ আরেকজন আশি এমন সম্পর্ক নিয়ে সন্দিহান আমি। আমাদের সম্পর্কটা হচ্ছে ওই আশি আর বিশ। মাঝে ষাটের গ্যাপ পূরণ করতে না পারলে ভবিষ্যতে ভীষণ সমস্যা হবে। যেহেতু আমি বিশ, আরও তিরিশ নাম্বার আমাকে যোগ করতে হবে।”
রিদওয়ান এবার হেসে দিলো-“আমাকে তাহলে তিরিশ নাম্বার কমাতে হবে কিন্তু কিভাবে কমাব?”
শায়লা ঠোঁট কামড়ে ধরলো। বোঝার চেষ্টা করলো রিদওয়ান ওর কথাগুলোকে মজা করে উড়িয়ে দিচ্ছে কিনা। ও মৃদুস্বরে প্রতিবাদ করলো-“ঠিক তা বলিনি তবে যদি প্রয়োজন পড়ে তাহলে কমাবেন। কিভাবে কমাবেন আমি জানি না। আমার জন্য আপনার আশি হওয়ার দরকার নেই পঞ্চাশ হলেই চলবে।”
রিদওয়ানকে এবার কিছুটা উদাস দেখায়-“এতো পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে কি জীবন চলে? জীবন তো কোন অংক না শায়লা যে হিসেব মিলতেই হবে। দুয়ে দুয়ে চার হলে ভালো তবে না হলে ক্ষতি নেই এটা মেনে নিলে চলার পথ সহজ হবে।”
শায়লা জবাব দিলো না কোন। ওর আসলে ভালো লাগছে না। খুব ভালো মতোই জানে রিদওয়ানের কথাগুলো ওর মতো বাবা হীন পরিবারের মেয়ের জন্য কেবল তত্বকথা। অন্তত এই মুহূর্তে তেমনই মনে হলো ওর কাছে। রিদওয়ান ওর মনের হাল বুঝেই ওর আচমকা ওর হাতটা ধরলো। চমকে উঠলো শায়লা। হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চাইলো কিন্তু রিদওয়ান ছাড়লো না। জলদগম্ভীর কন্ঠে সুধালো-“তোমার হাত ধরার অধিকারও নেই আমার? এমন করছো কেন? আমার সাথে একরুমে থাকতে পারো অথচ হাত ধরলে দোষ?”
শায়লা শান্ত হয়ে গেলো। একরুমে থাকলেও রিদওয়ান এর আগে কখনো কাছাকাছি আসা দূর হাত ধরারও চেষ্টা করেনি। সেকথা পেড়ে কথা বাড়ায় না শায়লা। মন ভালো থাকলে হয়তো এই স্পর্শে শিহরিত হতো কিন্তু এখন কোন অনুভূতিই এলো না। রিদওয়ান কোমল কন্ঠে শায়লাকে প্রবোধ দিলো-“শোন শায়লা, যে যাই বলুক, মার্কিং এ তুমি তিরিশ পাও কি পঞ্চাশ তুমি আমার স্ত্রী। আর এটা কখনো মিথ্যে হয়ে যাবে না। আমি জানি তোমার স্বপ্ন ছিল জীবনে কিছু করা, নিজের একটা পরিচয় তৈরি করা। কোনটাতেই আমার আপত্তি নেই। কিন্তু বারবার আমাদের সম্পর্কটা প্রশ্নবিদ্ধ করবে না। যে সম্পর্ক ঠিকঠাক শুরু হয়নি তা শেষ হওয়ার কথা বারবার বলাটা অনুচিত। আমরা নিজেদের একবার সুযোগ তো দেব, তাই না?”
শায়লা তবুও জবাব দিলো না। রিদওয়ান ফট করে ওর হাত ছেড়ে দিলো-“এরপরে আর এ বিষয়ে কোন কথা বলবো না আমি। আজই শেষবারের মতো বললাম।”
নিরবতা ভঙ্গ করলো শায়লা-“আমার খিদে পেয়ে গেছে। বাইরে খাবেন না আমি হলে চলে যাব।”
রিদওয়ানের মুখে হাসি ফুটলো-“চলো বাইরে কোথাও খাই।”
“ঠিক আছে।”
শায়লা মেনে নিলো। খাওয়া দাওয়া শেষে শায়লাকে ওর হলের সামনে নামিয়ে দিয়ে হাতে একটা প্যাকেট দিলো রিদওয়ান-“এখানে স্যাভলন, ব্যান্ডেজ আর ওষুধ আছে শায়লা। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছো দেখলাম। নিশ্চয়ই পা ছিলে গেছে। পায়ে মলমটা লাগিয়ে নিয় আর ওষুধটা মনে করে খেয়। কোন সমস্যা বোধ করলে আমাকে ফোন দেবে।”
শায়লা কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকালো-“থ্যাংক ইউ। খুব পেইন হচ্ছে আসলে।”
রিদওয়ান হুট করে গম্ভীর হলো-“যাও। তাড়াতাড়ি জায়গাটা ক্লিন করে মলম দাও। আসছি আমি।”

*****

ভার্সিটিতে সরকারি ও বিরোধী দলের দুই পক্ষের মধ্যে গন্ডগোল হয়ে শায়লার ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা পিছিয়েছে। হল ছাড়ার নির্দেশও এসেছে। শায়লা ভীষণ চিন্তিত হলো। বাড়ি চলে যেত কিন্তু টিউশনগুলোর জন্য তাও পারছেনা। থাকবে কোথায় এই ভাবনা তিষ্টাতে দিচ্ছে না ওকে। রিদওয়ানের বাসায় যাওয়া সম্ভব না। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না শায়লা। না পেরে টুম্পাকে ফোন দিলো শায়লা-“টুম্পা, কেমন আছিস?”
টুম্পা বেশ খুশি হলো শায়লার ফোন পেয়ে-“তুই কেমন আছিস? পরীক্ষা তো পিছিয়ে গেলো। কি করবি তুই? বাড়ি চলে যাবি?”
শায়লা ইতস্তত করে জবাব দিলো-“যেতে তো চেয়েছিলাম কিন্তু আমার টিউশনগুলোর কি হবে? ওদের কি এতোদিন না পড়িয়ে থাকা যাবে?”
“ওহহ তাইতো। তাহলে কি করবি তুই? হল তো ছাড়তে বলে দিয়েছে।”
“হুমমম। সেটাই ভাবছি আসলে।”
হঠাৎ টুম্পা উৎসুক গলায় প্রস্তাব দিলো-“তুই না হয় ক’দিন আমাদের বাসায় থেকে যা শায়লা। পরে বাড়ি গেলে যাবি। দুই বান্ধবী বেশ মজা করবো ক’দিন।”
শায়লা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে টুম্পার প্রস্তাব পেয়ে। তবুও ওকে বুঝতে না দিয়ে বললো-“তোর বাসায়? তোর বাবা মা আপত্তি করবে নাতো?”
“তাদের আপত্তি করার এতো সময় কোথায় শায়লা। বাবা মা দু’জনই অফিস করে বিজি থাকে। বাসায় কেবল আমি আর ভাইয়া। তুই চলে আয় তো।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আসছি আমি।”
খুশি হয়ে ফোন কাটে শায়লা। দ্রুত হাতে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ব্যাগে নিয়ে নেয়। টুম্পার বাসা ওয়ারিতে। এখান থেকে খুব একটা দূরে নয়। বের হবে এমন সময় রিদওয়ানের ফোন-“শায়লা, কোথায় তুমি?”
“এইতো। টুম্পার বাসায় যাব। জিনিস গোছাচ্ছি।”
“টুম্পার বাসায় কেন যাবে? আমাদের কুয়াকাটা যাওয়ার কথা ছিলো ভুলে গেছ?”
শায়লার ভ্রু কুঁচকে গেলো-“হ্যা, সেটা কি আজ? কয়েকদিন পরে না?”
রিদওয়ান স্পষ্টত বিরক্ত হয়ে জবাব দেয়-“আজ রাতেই তো শায়লা। টিকেট কাটা হয়ে গেছে। আগে বলে রাখার পরও ভুলে গেলে কি করে? যাইহোক, প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো গুছিয়ে নাও। আমি তোমাকে রাত আটটায় পিক করবো। রাতে বাইরে খেয়ে তারপর বাসে উঠবো। ঠিক আছে?”
শায়লার রিদওয়ানের সাথে যেতে ইচ্ছে করছে না তবুও মেনে নিলো-“ঠিক আছে। আমি রেডি হচ্ছি আপনি আসুন।”

রিদওয়ান এলো আটটায়। ততক্ষণে হল খালি হয়ে গেছে। রুমে একা একা ভয় লাগছিল বলে শায়লা নিচে রিসিপশনে বসে ছিলো। রিদওয়ান ফোন দেওয়া মাত্রই ব্যাগ নিয়ে বেরুল সে। শায়লার হাতে দু’টো ব্যাগ দেখে রিদওয়ানের মুখে ভাজ পড়লো-“দুটো ব্যাগ কেন?”
“আপনি কিছু জানেন না?”
“কি জানবো?”
“ভার্সিটিতে গন্ডগোল হয়েছে, এ মাস বন্ধ দিয়ে আমাদের হল ছাড়তে বলেছে। এসব জানেন না আপনি?”
রিদওয়ান মাথা দুলায়-“জানি। তুমি আমাকে ফোন দাওনি কেন?”
শায়লার ভ্রু কুঁচকে গেলো-“কোন ব্যাপারে ফোন দেব?”
“এই যে হল ছাড়তে হবে। এটা জানাবে না? আমাকে না জানিয়ে তুমি টুম্পার বাসায় যাচ্ছিলে কেন?”
শায়লা মুখ নিচু করলো-“তো কি করবো? আপনাদের বাসায় আমি যাব না তাই আর আপনাকে জানাইনি। এদিকে টিউশন ফেলে বাড়ি যেতেও পারছিনা। আবার হলেও থাকার উপায় নেই। তাই ভাবলাম টুম্পার বাসায় থেকে আসি কিছুদিন।”
রিদওয়ানের দু’চোখে বিরক্তি। সে জলদগম্ভীর কন্ঠে বললো-“তোমার উচিত ছিলো আমাকে জানানো। যাইহোক, আমি হয়তো জানানোর যোগ্য হইনি তাই জানাওনি।”
রিদওয়ানের কন্ঠের উষ্মাটুকু টের পেলো শায়লা। সে অপরাধী গলায় জবাব দেয়-“সরি। তখন আসলে খুব হোপলেস লাগছিল। আপনার কথা মনেই আসেনি।”
“উহু, আমার কথা মনে এসেছিল কিন্তু তুমি ভেবেছ আমি তোমাকে বাসায় নিয়ে যাব তাই ইচ্ছে করেই বলনি আমাকে। তাই না?”
শায়লা মাথা নিচু করে রইলো। রিদওয়ান ওকে দেখে হতাশ গলায় বললো-“এখনো তোমার ভরসায় জায়গা হতে পারলাম না শায়লা। খুব কষ্ট লাগছে।”
রিদওয়ানের কথাটা শায়লার হৃদয় তোলপাড় করলো। সে অস্ফুটে স্বরে বললো-“এসব কি বলছেন? আর এখন এসব কথা আসছেই বা কেন?”
“সেদিন তুমি বলেছিলে আমি যোগ্যতায় আশি আসলে তো আমি বিশ হওয়ারও যোগ্য না। না হলে সর্বপ্রথম ফোনটা টুম্পাকে নয় আমাকেই করতে।”
শায়লা কি বলবে ভেবে পেলো না। এ কথা ঠিক রিদওয়ানকে ফোন করার কথা মনে এলেও ফোন করেনি সে। অপরাধবোধে ছেয়ে গেলো ওর মন। রিদওয়ানকে কিছু বলা দরকার কিন্তু কি বললে রিদওয়ানের ভালো লাগবে বুঝলো না।
“আমি আসলে…”
শায়লা কথা গুছানোর চেষ্টা করে। রিদওয়ান হাত দেখালো-“হয়েছে বাদ দাও। আর কিছু বলতে হবে না। জোর করে সব হয় না আসলে। তাই আমাকে খুশি করতে মিছে কোন স্থুতি বাক্য বলতে হবে না তোমাকে।”
শায়লা চুপসে গেলো। রিদওয়ান আজ একটু বেশি রেগে আছে কেন? সে কি জানে না শায়লা কেমন?

চলবে—
©Farhana_Yesmin