#এরই_মাঝে
#পর্ব-৩৩
শায়লার লজ্জা পাওয়া উচিত কিন্তু পাচ্ছে না। সে অনুভূতিহীন দৃষ্টিতে হাঁটুতে মুখ গুঁজে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ভেজা চুলগুলো এলেমেলো হয়ে ছড়িয়ে পিঠময়। কিছু অংশ বিছানায় পড়ে বিছানা ভিজে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে যন্ত্রণায় মুখ কুঁচকে উঠছে তার। হালকা গেলাপি রঙের জামা তার গায়ে। সত্যি বলতে শায়লা ভীষণ সুন্দর লাগছে দেখতে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে রিদওয়ান দেখলো শায়লাকে। দ্রুত হাতে গায়ে কাপড় চাপিয়ে শায়লার কাছে এলো। কোমল গলায় ডাকলো-“শায়লা, উঠবে না? সকালে খেয়েছ কিছু?”
রিদওয়ানের ডাকে শায়লা সাড়া না দিয়ে চুপ করে রইলো। রিদওয়ান আবারও ডাকলো-“শায়লা, আমি কিছু জানতে চেয়েছি।”
শায়লা তবুও চুপ করে রইলো। চোখ মুখ কুঁচকে উঠতেই রিদওয়ানের ভ্রু কুঁচকে গেলো-“পেট ব্যাথা করছে?”
কোন জবাব এলো দেখে রিদওয়ান রেগে গেলো এবার। এগিয়ে এসে শায়লার কাছে বসলো। ওর চিবুক ধরে মুখ উঁচু করে মৃদুস্বরে গর্জন করে উঠলো-“কি সমস্যা শায়লা? কথা বলছো না কেন? আমার অপরাধ কি? তোমাকে কাছে টানা? লাইক সিরিয়াসলি?”
শায়লা কথা না বললেও ওর চোখ দুটো ভিজে উঠলো আপনাতেই। চোখের কোল ঘেঁষে জলের ধারা নেমে আসছে। রিদওয়ান হতবাক হয়ে গেলো। এমন কি করেছে সে? স্ত্রীকে কাছে টেনেছে বিয়ের বছর খানেক বাদে তাতেও কি দোষ করেছে? রিদওয়ান বিরক্তির চুড়ান্ত হলেও নিজেকে শান্ত রেখে নরম কন্ঠে সুধায়-“কি হয়েছে বলবে তো? কাঁদছো কেন?”
শায়লা ফোঁপাতে ফোপাঁতে বললো-“কেন এমন করলেন আপনি? একটু ধৈর্য্য ধরা গেলোনা?”
“একটু ধৈর্য্য! কি বলছো শায়লা? বিয়ের একবছর পার হয়েছে। আমি কখনো তোমাকে জোর করেছি? বলো? সামান্য চুমু খেতে চাইলেও তোমার আপত্তি। তাহলে বলো কতদিন ধৈর্য্য ধরলে তোমাকে পেতাম? আমি মানুষ শায়লা অবশ্যই আমার ধৈর্য্যচুত্তি ঘটবে। রোবট হলে ভিন্ন কথা ছিলো। তবে তুমি কেন আমাকে দোষ দিচ্ছ? রাজি না হলে বাঁধা দিতে পারতে। বাঁধা দাওনি কিন্তু।”
শায়লা কথা বললো না তবে নয়নজল থামলো না। রিদওয়ান এবার ওকে বুকে টানলো-“বোকা মেয়ে, কাঁদছো কেন? যা হয়েছে এটা খুব নরমাল স্বামী স্ত্রীর মধ্যে।”
রিদওয়ানের বুকে গিয়ে হুহু করে কেঁদে দিলো শায়লা-“তাই বলে সময় দেখবেন না? বাইরে সবাই বসে আছে। দাদু মারা গেছে কদিন হলো। এখন এই মুহূর্তে এসব মাথায় এলো কি করে? আমি সকলকে মুখ দেখাব কি করে?”
রিদওয়ানের হাসি পেলো ভীষণ কিন্তু হাসলো না। জানে হাসলেই এই বোকা মেয়েটা আরও বেশি রেগে যাবে। সে যত্ন করে শায়লার চোখের জল মুছে দিয়ে কপালে চুমু দিলো-“কেউ কিছু ভাববে না বোকা মেয়ে। কেন এসব নিয়ে ভাবছো বলো তো? চলো নাস্তা করতে যাই।”
শায়লা গোয়ারের মতো মাথা নাড়লো-“আমি যাব এখন। খাব না খেয়ে এসেছি। ঘুমাব একটু।”
রিদওয়ান ওকে জোর করলো না। বরং চোখ মুখ কুঁচকে উঠতেই জানতে চাইলো-“কি হচ্ছে?”
শায়লা খেঁকিয়ে উঠলো-“কিছু না। নিজের কাজ করুন যান।”
বলেই গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো৷ রিদওয়ান কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। দরজা খুলে বেরিয়ে এলো বাইরে। খাওয়ার টেবিলে মোটামুটি সবাই আছে। রিদওয়ান বসলো সবার সাথে। ওয়াহেদ ওকে দেখে বললো-“তুমি ক’দিন থাকবে রিদু? আমরা বিকেলে মিলাদ শেষে ঢাকায় রওনা দেব।”
“তিনদিন থাকবো বাবা। তিনদিন পরে ফিরবো। এক্সাম শুরু হবে আর কিছুদিনের মধ্যে।”
ওয়াহেদ মাথা নাড়লো। জাকিয়া সন্দিহান নজরে ছেলেকে দেখছে। সদ্য গোসল নেওয়া রিদওয়ানকে দেখে তার অভিজ্ঞ চোখ অনেক কিছু বুঝে নিয়েছে। শায়লা ঘর থেকে বের হয়নি এখনো, রিদওয়ানও কিছু বলছে না। সে জানতে চাইলো-“তোর বউ কই? খাবে না?”
রিদওয়ান আড়ষ্ট হয়ে জবাব দিলো-“ওর নাকি মাথা ধরেছে তাই শুয়ে আছে।”
জাকিয়া আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল ওয়াহেদ সু্যোগ না দিয়ে জানতে চাইলো-“তোর প্ল্যান কি রিদু?এরপর কোথায় যাবি পড়তে? কোন ডিগ্রি নিবি ভেবেছিস কিছু?”
রিদওয়ান রুটি মুখে দিতে দিতে মাথা নাড়লো-“এখনো ভাবিনি বাবা। তবে আমি আগে বিসিএস দেব। সরকারি চাকরিতে জয়েন করে তারপর বাইরে কোথাও পড়তে যাব।”
জাকিয়া বিরক্ত হলো-“বিসিএস দিয়ে কি হবে? সেই তো পোস্টিং দেবে কোন অজপাড়াগাঁয়ে। তুই ওসব পারবি করতে?”
“পারবোনা কেন? সব পারতে হয়। ডাক্তার হয়েছি কি শুধু শহরে এসিতে বসে রোগী দেখার জন্য? তবে বাবা আমি একটা জিনিস ভেবেছি।”
ওয়াহেদ ছেলের দিকে তাকালো-“কি ভেবেছিস?”
“দাদুর অনেক সম্পত্তি। ভাবছি দাদুর জায়গার উপর একটা উন্নত মানের হাসপাতাল তৈরি করবো। তাতে এই গ্রামের মানুষের উপকার হবে। তুমি কি কিছু ইনভেস্ট করতে পারবে?”
ওয়াহেদ সত্যিকার অর্থেই অবাক হলো। রিদওয়ানের কথা বুঝতে চাইলো। সত্যি কি রিদওয়ান এমন কিছু বলছে? ওয়াহেদের অবাক দৃষ্টি দেখে রিদওয়ান হাসলো-“অবাক হচ্ছ নাকি বাবা?”
ওয়াহেদ মাথা নাড়লো-“অবশ্যই অবাক হচ্ছি। সেই সাথে দারুণ খুশি লাগছে। জানিস, বাবা চাইতেন আমি ডাক্তার হই, গ্রামের মানুষদের চিকিৎসা দেই। আজ তোর কথা শুনে মনেহচ্ছে আগে কেন এমন কিছু আমার মাথায় আসেনি? শুধু ডাক্তার হয়েই ট্রিটমেন্ট দিতে হবে ব্যাপারটা এমন তো না। খুব ভালো একটা বুদ্ধি বলেছিস। আমি ভেবে দেখি টাকা পয়সার কি ব্যবস্থা করা যায়। কবে নাগাদ শুরু করতে চাস?”
“তাও বছর তিনেক লাগবে বাবা। পাশ করে বেরিয়ে বিসিএস তারপর একটা ডিগ্রি। ফিরে এসে এই কাজটায় হাত লাগাবো।”
জাকিয়া রেগে গেলো-“সত্যি করে বলতো রিদু তোর প্ল্যান কি? এখানেই থিতু হতে চাচ্ছিস?”
“সেরকম কিছু এখনো ভাবিনি মা। হতেও পারি।”
“বাহ, তোর দাদাজান তাহলে জিতেই গেলো? বুড়ো মরতে মরতে নিজের কাজ হাসিল করেই নিলো। নিজের ছেলেমেয়েদের সাথে পারলোনা বলে আমার ছেলেটাকে নিয়ে পড়লো। ছেলেটাকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে নিলোই নিলো।”
রিদওয়ান চিৎকার করলো-“মা, মুখে লাগাম দাও। কি সব বলছো দাদুকে নিয়ে। মানুষটার কবরের মাটি এখনো শুকোয়নি।”
জাকিয়া দুপদাপ পা ফেলে চলে গেলো। ওয়াহেদ মাথা নিচু করে বসে আছে। রিদওয়ান বাবাকে দেখলো একপলক। হাতে হাত রেখে চাপ দিলো-“সরি বাবা। মায়ের কথা বাদ দাও।”
কল্লেল চুপ করে ছিলো এতোক্ষণ। সে মুখ খুললো-“কিন্তু দাদুর সব সম্পদ নিয়ে কিছু করার কথা চাচা ফুফু মানবে? তারা সম্পদের ভাগ দাবি করবে না?”
রিদওয়ান কি ভেবে বললো-“দাদু কোন উইল করে গেছে কিনা খোঁজ করতে হবে। তৈয়ব দাদু এ ব্যাপারে জানতে পারে।”
ওয়াহেদ মাথা নাড়ে-“ঠিক আছে। আমি তৈয়ব চাচার সাথে কথা বলবো তবে এবার না। মানুষটা খুব মুষড়ে আছে। আমি ক’দিন পরে আবার আসবো তখন এই বিষয়ে খোঁজ খবর করবো।”
রিদওয়ান খাবার শেষ করে চা হাতে নিয়ে উঠলো।
*****
দুপুরের খাবারের সময় হলে শায়লাকে ডাকলো রিদওয়ান-“শায়লা, এবার তো ওঠো। সবাই কি ভাববে বলো তো। সেই সকাল থেকে ঘরে বসে আছে।”
শায়লা উঠে বসলো, কাঠ কাঠ গলায় জবাব দিলো-“সে কথা আপনার ভাবা উচিত ছিলো আগে।”
রিদওয়ান হেসে দিলো, শায়লার কাছাকাছি এসে মৃদুস্বরে বললো-“কোথায় ভাবলাম প্রথমবার তোমার এতো কাছে গেলাম বলে তুমি লজ্জা পাবে। এখন দেখছি লজ্জা দূর তুমি আমাকে পাত্তাই দিচ্ছ না।”
শায়লা আড়ষ্ট হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলো। ওর গাল দুটোর লালচে রং নজর এড়ায়নি রিদওয়ানের। ভাবলো আরেকটু লজ্জা দেবে একটু কঠোর মেয়েটাকে কিন্তু তার আগেই পল্লবী ঘরে ঢুকলো। দু’জনেই অপ্রস্তুত হয়ে ছিটকে দূরে সরে গেলো। শায়লা লজ্জায় মাথা নিচু করে। পল্লবী তা দেখে হেসে কুটিকুটি-“এই তোরা দুটিতে সারা ঘরে কি করছিস বলতো? আর কতো রোমান্স চলবে তোদের?”
রিদওয়ান মাথা চুলকায়-“তেমন কিছু না ভাবি। তোমার তেড়া জাকে বোঝাচ্ছিলাম একটু।”
পল্লবী এসে শায়লার কাছে দাঁড়ায়। ওর চিবুক ধরে মুখ তুলে দেখে মুচকি হাসলো-“তা কি বোঝাচ্ছিলি শুনি? এই রে শায়লা, তোর এখানে কি হয়েছে? অমন লাল হয়ে আছে কেন?”
পল্লবী ওর ঠোঁটে হাত বুলিয়ে দেয়। শায়লা টকটকে মুখ নিয়ে রাগে কটমট দৃষ্টিতে রিদওয়ানকে দেখলো। রিদওয়ান দ্রুত ঘর ছেড়ে পালালো। পল্লবী মৃদু হাসলো-“তোদের ফাস্ট টাইম ছিলো শায়লা?”
শায়লা চুপ করে রইলো। পল্লবী অবাক কন্ঠে বললো-“রিদুটার এতো ধৈর্য্য জানতাম নাতো। এতোদিন অপেক্ষা করেছে? তুই কতো লাকি শায়লা।”
শায়লা তবুও চুপ দেখে পল্লবী ভ্রু কুঁচকে বললো-“তুই রাজি ছিলি না? রাগ করে আছিস রিদুর উপর? এইজন্য রুম থেকে বেরুচ্ছিস না?”
শায়লা মুক হয়ে আছে। পল্লবী ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো-“পাগলি একটা। শোন, আজ আমরা চলে যাব। পুরো বাড়ি ফাঁকা থাকবে। তোদের দুটিতে বেশ হানিমুন সারতে পারবি। বুঝলি? এবার চল বাইরে। এভাবে ঘরে বসে থাকলে সবাই কি ভাববে বলতো?”
শায়লা ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে। নিজেকে বোধহীন লাগছে তার। কান ঝা ঝা করছে। রোবটের মতো
মৃদুস্বরে বললো-“তুমি যাও ভাবি আমি আসছি একটু পরে।”
“তাড়াতাড়ি আয়। সবাই বসে আছে টেবিলে।”
পল্লবী চলে যেতেই শায়লা দাদুর পুরনো আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। নিজেকে দেখলো অনেকটা সময় নিয়ে। ঠোঁটে লিপস্টিক দেবে সেই উপায়ও নেই। এ বাড়িতে তার কোন জিনিস নেই। সে প্রতিদিন সকালে আসে সন্ধ্যায় চলে যায়। এখন এই অবস্থাতেই বাইরে যেতে হবে। ক্লান্ত হাতে চুলগুলো খোঁপা করে নিলো। মাথাটা ওড়নায় জড়িয়ে নিলো ভালো মতো। তারপর সন্তুষ্ট হয়ে বাইরে এলো।
চলবে—
#এরই_মাঝে
#পর্ব-৩৪
যাবার বেলায় হইচই এর সুযোগে শায়লাকে
আলগোছে পেছনে টেনে নিলো জাকিয়া। শায়লা ভয় পেয়ে চিৎকার করবে তখনই মুখে আঙুল দিলো জাকিয়া-“চিৎকার করো না। জরুরি কথা বলবো তাই টেনে আনলাম।”
শায়লা ফ্যাকাসে মুখে তাকিয়ে আছে জাকিয়ার দিকে। এই মহিলা কি বলতে পারে ভেবে শরীরের ঘাম ছাড়ে। জাকিয়া ফিসফিস করলো-“তুমি পড়ালেখা করছো, রিদুর পড়া শেষ হয়নি। ওর স্বপ্ন দেশের বাইরে থেকে ডিগ্রি আনবে। খবরদার এখনই ওকে বাচ্চা দিয়ে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করো না। ওর জীবন নষ্ট করার চেষ্টা করবে না। গাঁইয়া মেয়েদের মতো বাচ্চা দিয়ে স্বামীকে আঁটকে রাখবে তেমন ভাবনা যেন না থাকে। অবশ্য বাচ্চা হলেই যে স্বামী আঁটকে থাকে তাও না। প্রমান তো তোমার চোখের সামনে আছে। শোন মেয়ে, পেটে বাচ্চা আসার আগেই ব্যবস্থা নেবে। আমি যেন এ বিষয় কোন খবর না পাই।”
জাকিয়া চলে গেলো। শায়লার চোখে টলমল জল। লজ্জা আর গ্লানিতে হৃদয় পূর্ণ হয়ে গেছে। আর কতো অপদস্ত হবে ও? রিদওয়ান কেন বোঝে না তাকে? কেন বারবার অপমানের দূয়ারে ঠেলে দেয় তাকে? সে তো রিদওয়ানকে কাছে টানতে চায়নি। রিদওয়ানই বারবার আসে তার কাছে। তাহলে দায় কেন তার একার হবে? কথা কেন সে একা শুনবে?
শায়লা কাঁদতে কাঁদতে নিজের বাড়ির দিকে ছুটলো। আর আসবে না রিদওয়ান এর কাছে।
সবাইকে বিদায় দিয়ে রিদওয়ান ঘরে ফিরে শায়লাকে খুঁজলো। দাদুর ঘরে না পেয়ে অন্য ঘরগুলোতেও উঁকি দিলো। কোথাও না পেয়ে তার ভ্রু কুঁচকে গেলো। ও বাড়িতে ফোন দিলো। রুবিনা ফোন তুলতেই রিদওয়ান সালাম জানালো-“মা, শায়লা কি বাড়ি গেছে?”
রুবিনা অস্ফুটে উত্তর দিলো-“এসেছে।”
রুবিনার কন্ঠ খানিকটা রুক্ষ শোনালো। রিদওয়ান জানতে চাইলো-“কি হয়েছে মা? রেগে আছেন কোন কারনে?”
একটু থেমে রুবিনা বলে উঠলো-“রিদওয়ান, তোমার সাথে কি ওর ঝগড়া হয়েছে? ওকে কাঁদতে কাঁদতে এসে ঘরে দোর দিতে দেখলাম।”
রিদওয়ান বিস্মিত হয়ে জবাব দিলো-“নাতো মা। কোন কথা হয়নি ওর সাথে। আচ্ছা, আমি আসছি এখনই।”
রুবিনা তাড়াতাড়ি বলে উঠলো-“এসো না রিদওয়ান। এখন হয়তো কোন কারনে ও রেগে আছে। তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারে। তুমি বরং কাল এসো।”
রিদওয়ানের মনটা খারাপ হলো ভীষণ। কোথায় ভেবেছিল কয়েকটা দিন শায়লার সাথে অন্তরঙ্গ সময় কাটাবে। ঢাকায় যেয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে যাবে। আবার কবে এমন সময় পাবে তাও জানে না। মেয়েটার কি হলো হঠাৎ করে? কেউ কি কিছু বলেছে? মা, মা কিছু বলেনি তো? রিদওয়ানের কপাল কুঞ্চিত হলো।
*****
পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙতেই শায়লাকে ফোন দিলো রিদওয়ান। ওর ফোনটা বন্ধ পেয়ে এবার কেন যেন রিদওয়ানেরও অভিমান হলো। বারবার সেধে সেধে শায়লার কাছে ছোট হওয়া গায়ে লাগছে এবার। শায়লা কেন তাকে একটুও বোঝার চেষ্টা করছে না? সম্পর্ক ঠিক করতে বারবার তাকেই কেন এগুতে হবে? শায়লার কি কোন দায় নেই? যদি এমন হয় তাহলে সেও আর শায়লার দিকে এগুবে না। শায়লার যদি তাকে প্রয়োজন না হয় তবে তারও শায়লাকে প্রয়োজন নেই।
শায়লা থেকে নিজের মনোযোগ হঠাতে নাস্তা করে রিদওয়ান দাদাজানের সিন্দুক খুলে বসলো। একে একে সব বের করে সিন্দুক থেকে। গহনার বাক্সটা খুলে বেশ চমকে গেলো সে। কি নেই সেখানে? রুপার কোমরবন্দ থেকে শুরু করে গলার সীতা, মাথার জড়োয়া টিকলি সব আছে। রিদওয়ান পুরো গহনার সেটটা বিছানায় সাজালো। কল্পনা করলো শায়লাকে কেমন লাগবে এই সেটটা গায়ে জড়ালে। রিদওয়ানের ঠোঁটের কোনে মোহনীয় হাসি চলে এলো। খুব ইচ্ছে করছে শায়লাকে এই গহনা পরিয়ে দেখতে। তৎক্ষনাৎ শায়লার কাছে যেতে মন চাইলো। পরক্ষণেই মনে পড়লো শায়লা কাল না বলে চলে গেছে। একবারও ফোন দেওয়ার প্রয়োজন করেনি। রিদওয়ান অভিমানেরা ফেরত এলো। বারবার নিজেকে হুমকি দিলো, শায়লার কথা আর ভাববি না রিদওয়ান। ও তোকে মনে করছে না তোর কিসের দায়? রিদওয়ান মন খারাপ করে গহনাগুলো পুনরায় বাক্সে তুলে রাখলো। কাগজের ফাইলটা নিয়ে পড়লো। সব কাগজ দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে বিকেল হলো। রিদওয়ান ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেলো। অনেকক্ষণ রিদওয়ান এর সারা না পেয়ে আমের এসে ডাকলো-“রিদওয়ান ভাই, খাবে না নাকি? সন্ধ্যা নামলো যে?”
ঘুমন্ত রিদওয়ান ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো-“কি হয়েছে আমের ভাই?”
“রাত হইলো। তুমি দুপুরে খেলে না, গোসল দিলে না। তৈয়ব দাদা এসে অনেকক্ষণ বসে ছিলো।”
“আমাকে ডাকলে না কেন?”
“তুমি ঘুম গেছ শুনে মানা করলো। বললো ঘুম থেকে উঠলে যেন ও বাড়িতে যাও একবার।”
রিদওয়ান হামি আটকালো-“ঠিক আছে। আমি গোসল দিচ্ছি ভাবিকে বলো ভাত দিতে। খেয়ে ও বাড়িতে যাব।”
আমের চলে গেলো। রিদওয়ান একবার ভাবলো যাবে না ও বাড়িতে। পরক্ষনেই ভাবলো শুধু শায়লার জন্য বাকি সবার সাথে রাগ দেখানো অভদ্রতা। তাই সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেললো। দাদাজানের সিন্দুকের সব গুছিয়ে তালা দিয়ে গোসলে ঢুকলো রিদওয়ান।
রিদওয়ানকে দেখেই তৈয়ব মাওলানা হইহই করে উঠলো-“কাল থেকে তুমি একা একা রইছো ওই বাড়িতে তাই তোমাকে আসতে বলছিলাম।”
রিদওয়ান হাসলো-“একা কোথায় দাদু? আমের ভাই ভাবি তার বাচ্চারা।”
তৈয়ব মাওলানা ম্লান মুখে বললো-“তবুও। রব দেখে মন খারাপ করতেছে। আমি তোমার কোন যত্ন করতে পারতেছি না। তুমি এখন থেকে ঢাকা যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই বাড়িতেই থাকবা।”
“না দাদু। বরং শায়লাকে নিয়ে যাই। দাদুর কাছে থাকতে ভালো লাগছে আমার। আবার কবে না কবে আসা হবে।”
সে কথা শুনে তৈয়ব মাওলানা নিরব হলেন। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো-“ঠিক আছে। তোমার যেটা ভালো মনেহয়। দেখো শায়লা আছে নিজের ঘরেই।”
রিদওয়ান শায়লার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। ঘরের দরজা আঁটকে বসে আছে শায়লা। রিদওয়ান দরজায় নক করলে আওয়াজ এলো না কোন। আবারও দরজায় শব্দ করলো রিদওয়ান। অনেকটা সময় পার হওয়ায় পর দরজা খুলে গেলো। রিদওয়ান ঘরে ঢুকতেই শায়লা চমকে গেলো-“আপনি!”
রিদওয়ান স্বাভাবিক ভাবেই জানতে চাইলো-“তুমি কি অন্য কাউকে আশা করছিলে?”
“কেন এসেছেন?”
শায়লার রোবটিক কন্ঠ শুনে মেজাজ খারাপ হলো রিদওয়ানের-“বউয়ের কাছে এসেছি। মন চাইছে তাই এসেছি। এখন আসার জন্য কৈফিয়ত দিতে হবে? আমি ও বাড়িতে একা জানার পরও তুমি আমাকে রেখে চলে এলে কেন শায়লা? বলেও আসোনি এমনকি একটা ফোন পর্যন্ত দাওনি।”
“ভালো লাগছিল না তাই চলে এসেছি।”
“সবসময় নিজের ভালোলাগা মতো কাজ করতে হবে? আমি কি তোমার জীবনে কোন ইম্পর্টেন্স রাখি না? এতো কেন অবহেলা শায়লা?”
রিদওয়ানের কথায় শায়লার মনে যেন আগুন জ্বলে উঠলো-“ইম্পর্টেন্স পাওয়ার মতো কাজ করেছেন যে সেই আশা করছেন? আপনি আমার কাছে কেন আসেন? শরীরের লোভে? বিয়ে করেছেন বউয়ের শরীর না হলে চলছে না তাই একটু ভালোবাসার অভিনয় করছেন? বারবার বলার পরও কেন বুঝতে পারছেন না এসব এখন চাই না আমি। পড়াশোনা করে নিজের একটা পরিচয় বানাতে চাই। তারপর না হয় বিয়ে আর সংসার সংসার খেলা নিয়ে কিছু ভাববো।”
রিদওয়ান হতবাক হয়ে গেলো। সে হতভম্ব হয়ে শায়লার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো-“কি বললে তুমি? আমি তোমার শরীরের লোভী? ভালোবাসার অভিনয় করছি?”
শায়লা নির্বিকার হয়ে উত্তর দিলো-“তা নয়তো কি? দাদু মারা গেলো ঘরভর্তি মানুষ আর আপনার আমাকে চাই? এখন নিজেকে সাধু বলবেন না আবার।”
রিদওয়ান ছুটে এসে শায়লার গাল চেপে ধরলো-“এতো বড় অপবাদ দিলে আমাকে? একবছরে একবার কাছে টেনেছি তাই এতো বড় অপবাদ? নিজেকে বারবার সংযত করেছি তবুও আমাকে আঘাত করে কথা বলতে বাঁধলো না তোমার?”
শায়লা ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো। রিদওয়ান ওর সর্বশক্তি মনেহয় গালের উপর প্রয়োগ করছে। কিন্তু শায়লার ব্যাথা পাওয়াটা দেখেও দেখলো না সে। হিসহিসিয়ে বললো-“অপবাদ যখন দিলেই অপবাদ মাথা পেতে নেব, তোমার কথাও সত্যি প্রমান করবো। আমি যে সাধু না তা আজ প্রমান দেব।”
বলেই প্রচন্ড আক্রোশে শায়লার অধর আঁকড়ে ধরলো নিজের অধর দ্বারা। শায়লা ধাক্কা দিয়ে রিদওয়ানকে সরিয়ে দিতে চাইলো পারলোনা। যেন অসুরের আত্মা ভর করেছে ওর মধ্যে। শায়লাকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় এনে ফেললো। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করে শায়লা দূর্বল নিস্তেজ হয়ে গেছে। সে অসহায় হয়ে চুপচাপ শুয়ে আছে আর চোখের জল ফেলছে। একবার কেবল দূর্বল গলায় ফিসফিস করলো-“রিদওয়ান আপনি আমার সাথে জবরদস্তি করছেন!”
তীব্র আক্রোশ রিদওয়ানকে কালা বানিয়ে দিয়েছে। সে যেন শুনেও শুনলো না। সে তার সমস্ত অপমানের যন্ত্রণা ভুলছে শায়লাকে যন্ত্রণা দিয়ে। রিদওয়ান চরম অভদ্রের মতো শায়লার শরীর দংশন করে চলেছে। অনেকটা সময় পার হওয়ার পর ক্লান্ত গলায় রিদওয়ান শায়লার কানে ফিসফিস করলো-“শায়লা, এটা হলো অপমান। আমার মান দেওয়াটা যেহেতু বুঝলে না তাই তোমাকে অপমান করলাম আজ। আজকের পর থেকে আর আমাকে দেখতে হবে না তোমার। তোমার শরীর লোভী ছেলেটাকে তোমার আশেপাশে দেখবে না তুমি। তুমি না ডাকলে আর কোনদিন আসবো না তোমার সামনে। আজকের পর থেকে তুমি আমাকে ঘেন্না করো শায়লা তাতে তোমার বেঁচে থাকতে সুবিধা হবে।”
শায়লা দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠলো-“কেন এমন করলেন রিদওয়ান?”
চলবে—
© Farhana_Yesmin