#এরই_মাঝে
#পর্ব-৪১
রিদওয়ান বাড়ি ফিরে আসতেই জাকিয়া একের পর এক প্রশ্নবানে জর্জরিত করে ফেলছে তাকে। বারবার আহাজারি করছে-“কেমন মেয়ে বিয়ে করিয়েছে তোর দাদাজান বুঝতে পারছিস? এইজন্যই আমি বারবার মানা করেছিলাম, ওর থেকে দূরে থাকতে বলতাম। ভাগ্যিস এখনো ঘটা করে অনুষ্ঠান করিনি তা নয়তো আজ মানসম্মান নিয়ে টানাহেঁচড়া হতো। কি কপাল আমার, এতো টাকা খরচ করে দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হলি অথচ ওই মেয়ের জন্য সব পন্ড হলো। এইজন্যই ওই মেয়েটাকে সহ্য হয় না আমার। বাবা ছাড়া দাদার দয়ায় মানুষ হয়েছে তবুও কত ঢং, নেকামি দেখে বাঁচি না। জামাইকে পাত্তা দেয় না শশুরবাড়ির মানুষকে পাত্তা দেয় না। কি শিখিয়েছে ওর মা? কোন সভ্যতা ভদ্রতা জানে না। আমার ছেলেটার জীবন নষ্ট করে দিলো মেয়েটা। ওই মেয়েকে নিয়ে আদিখ্যেতা বাদ দে রিদু। ওকে ছেড়ে দে এছাড়া তোর শান্তি আসবে না। আমি তোর ভালো বিয়ে দেব। যে মেয়ে স্মার্ট, দেখতে শুনতে ভালো, আমাদের সাথে যার ম্যাচ হবে তেমন মেয়ে এনে দেব তোকে। ওকে ছেড়ে দে রিদু।”
মায়ের কথা শুনতে শুনতে রিদওয়ানের চোখ ছানাবড়া। সেই চোখে অবিশ্বাস আর ঘৃনা খেলে বেড়াচ্ছে। সে চেচিয়ে উঠলো-“ছেড়ে দেব মানে? মা! এসব কি বলে যাচ্ছ তুমি? যে ভাবেই হোক মেয়েটা তোমার ছেলের বউ এখন। তার অসুস্থতায় তুমি সুস্থতা না চেয়ে কিসব বলছো? আমার বউ মৃত্যুর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আর তুমি পড়ে আছো ইউকে যাওয়া নিয়ে।”
জাকিয়া থতমত খেলো। মিনমিন করে বললো-“তোর এতো কষ্টের এমডি ডিগ্রি। তোর তো ক্যারিয়ারই শেষ রিদু।”
রিদওয়ান বিরক্তি নিয়ে বললো-“ক্যারিয়ার শেষ হলে শেষ। বউয়ের চেয়ে ক্যারিয়ার বড় নাকি? একটা মানুষের জীবন চলে যাচ্ছে আর তুমি আছো ক্যারিয়ার নিয়ে। কিছু না হলে গ্রামে গিয়ে ডাক্তারি করবো তোমার সমস্যা কি?”
জাকিয়া এবার চেচিয়ে উঠলো-“কি আবোল তাবোল বকছিস রিদু? এইজন্যই ওকে আমার সহ্য হয় না। ডাকাত মেয়ে একটা, আমার ছেলেটাকে দখল করে নিয়েছে। যে ছেলে মায়ের সাথে উঁচু আওয়াজে কথা বলতো না সে এখন মায়ের সাথে তর্ক করে। ভালো তো ভালো না?”
রিদওয়ান ভ্রু কুঁচকে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। হুট করে প্রশ্ন করলো-“তুমি কি কাল শায়লাকে সেঁজুতির কথা বলেছ?”
জাকিয়া চমকে উঠলো। তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মৃদুস্বরে বললো-“আমি কেন ওই মেয়েকে এসব বলবো?”
মায়ের মুখের ভাব দেখে রিদওয়ান কিছুটা আন্দাজ করে নিলো। ঘৃনাভরে মাকে দেখলো-“গুটি কয়েকজন ছাড়া সেঁজুতির কথা কেউ জানে না। আর তুমি ছাড়া শায়লার কাছে বলার মতো কাউকে খুঁজেও পাচ্ছি না। তুমি কিভাবে পারলে মা? এমন কিছু কিভাবে করতে পারলে? যেখানে তুমি জানো তোমার ছেলে মেয়েটাকে পছন্দ করছে। সেঁজুতিকে ভুলে একটু ভালো থাকতে শিখছে সেখানে তুমি খুশি না হয়ে ছেলের জীবনটা বিষিয়ে তুলতে চাইছো? তোমার জন্য মেয়েটা আজ মৃদু দুয়ারে পৌঁছে গেছে। ছিহ মা ছিহ, আমি ভাবতেও পারছি না তুমি এমন কিছু করতে পারো।”
জাকিয়া নিজেকে বাঁচানোর জন্য প্রানপন চেষ্টা করলো-“তুই আমাকে ভুল বুঝছিস রিদু। আমি এমন কিছু বলিনি যাতে মেয়েটা নিজের জীবন দেবে। ওই মেয়ে একটা পাগল, কিছু বললেই এমন ভাব করে যেন কিছু বোঝে না জানে না। সামান্য কথায় অনেক বেশি রিয়্যাক্ট করে।”
রিদওয়ান অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। তীব্র বিতৃষ্ণা নিয়ে বললো-“তুমি কিসের ভয় পাও মা? এতোদিন দাদু ছিলো তোমার ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা বুঝতাম। কিন্তু এখন কিসের ভয়? দাদু তো নেই। আর থাকলেও দাদু কখনো তোমার ব্যাপারে কারো সাথে কোন কথা বলতো না।”
জাকিয়া অবাক হলো-“মানে কি রিদু? কি বলছিস বুঝতে পারছি না।”
রিদওয়ান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো-“তুমি দাদীমার সাথে কি করেছিলে সেটা দূর্ভাগ্যবশত আমি দেখে ফেলেছিলাম মা। দাদাজান সব জানতো তবুও কোনদিন কাউকে কিছু বলেনি বা বলার চেষ্টা করেনি। নয়তো বাবার সাথে তোমার বিচ্ছেদ চুড়ান্ত ছিলো। কিন্তু জানো তো দাদাজান এতোটা নিচ নয় তাই বাবার কান পর্যন্ত ঘটনা গড়ায়নি। তুমি দাদাজানকে ভয় পেতে একইসাথে অপছন্দ করতে তাইতো তার সব কথা মেনে নেওয়ার ভান করতে। আমি এতো বছর ধরে এটাই ভেবে এসেছি তোমার হয়তো অনুশোচনা হয়, তুমি হয়তো শুধরে গেছ কিন্তু তুমি তো তুমি। কখনোই শুধরাবে না। শোন মা, শায়লার ব্যাপারটা নিয়ে থানায় জিডি হয়েছে। ওরা কোন ভাবে যদি টের পায় আমাদের কারো কোন সম্পৃক্ততা আছে এই ঘটনায় তাহলে পুরো পরিবারের জেলের ঘানি টানতে হবে। এখন তুমি কি চাও বলো? শায়লার সাথে শত্রুতা বজায় রাখবে নাকি ছেলের বউ হিসেবে মেনে নেবে। না নিলেও সমস্যা নেই মা। ওকে নিয়ে আমি আলাদা থাকবো। দাদাজানকে বাবা কখনো সন্তান হিসেবে সন্তুষ্টি দিতে পারেনি। তবে বাবার কষ্ট হবে ভেবে দাদাজান সে নিয়ে কোন অভিযোগও করেনি। মানুষটার সামান্য চাওয়া আমার কাছে ছিলো। এটুকু পূরণ না করতে পারলে আমার পাপ লাগবে মা। তুমি কি চাও তোমার সন্তানের জীবন এলোমেলো হোক?”
জাকিয়াকে বিহ্বল দেখায়। রিদওয়ান সব জানতো? কবে থেকে? কোনদিন কিছু বুঝতে দেয়নি। সেজন্যই হয়তো দাদার প্রতি একনিষ্ঠ টান তার। মায়ের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা থেকে টান বেড়েছে। বুড়ো মরতে মরতে তাকে হারিয়ে দিয়ে গেছে। জাকিয়া অসহায় বোধ করলো। রিদওয়ান মায়ের মনের হাল যেন বুঝতে পারলো। এমনিতেই সারাদিন মনের উপর বড্ড চাপ গেছে তারউপর রুবিনার দোষারোপ। একদিকে দেখলে নিজেকে দোষীই লাগছে তার। মায়ের কুমতলবগুলো আগে কেন বোঝেনি সে? তাহলে হয়তো শায়লা এতোবড় ঘটনা ঘটাতো না। আফসোস হচ্ছে কাল কেন শায়লাকে একবার ফোন দিলো না। একটা ফোনকল অনেককিছু পাল্টে ফেলতে পারতো। রিদওয়ানের মাথা টনটন করে উঠলো। নিজের ক্লান্ত শরীরটা রুমে টেনে নিয়ে বিছানায় আছড়ে পড়লো। মন চাইছে লম্বা একটা ঘুম দিতে। ইশশ, এমন যদি হতো এটা একটা দুঃস্বপ্ন, ঘুম থেকে উঠে দেখবে সব ঠিক আছে। রিদওয়ান ক্লান্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। শাওয়ার নিয়ে আবার হাসপাতালে যাবে সে। একবার দূরে থেকে যথেষ্ট ভুগেছে আর না। অন্তত শায়লার সুস্থ হওয়া পর্যন্ত কোন অভিমান সে মনে রাখবে না, কারো কটু কথায় পিছু হটবে না। আগে শায়লা সুস্থ হোক তারপর ওর সাথে হিসেব নিকেশ করা যাবে। এবার আর কোন জোর করা না, কিছু চাপিয়ে দেওয়া না এমনকি ভালোবেসে অধিকারও দেখাবে না। শায়লা যা বলবে তাই মেনে নেবে সে। যদি শায়লা তাকে না চায় তাহলে দূরে সরে যাবে চিরদিনের মতো। ঝর্নার জলে ভিজতে ভিজতে কঠিন ভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো রিদওয়ান।
*****
আশ্চর্য মন আমাদের। আমরা যাকে ভালোবাসি তাকেই সর্বোচ্চ ঘৃণা করি। যাকে ঘৃনা করি তাকেই মনে মনে লালন করি পরম যত্নে। বিপদে তাকেই আঁকড়ে ধরতে চাই ভরসায়। শায়লার জ্ঞান ফিরলো পরদিন সকালে এবং খুব অবাক করা ব্যাপার হলো জ্ঞান ফেরার পর শায়লার চোখ দুটো হন্যে হয়ে খুঁজলো সেই মানুষটাকে যাকে সে অবহেলায় দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। মানুষটাকে দেখতে না পেয়ে তার হতাশ চোখ দুটো পুনরায় বন্ধ হলো। অভিমানেরা অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ে দু’চোখের কোল ঘেঁষে। মানুষটা তাকে ফেলে চলেই গেলো শেষ পর্যন্ত? শায়লা কি এতোটাই খারাপ যে তার মৃত্যুশয্যার খবর পেয়েও তাকে দেখতে আসা যায় না? অবোধ কান্নাগুলো বাঁধনহারার মতো বুকের পাঁজর ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চায়। আজ নিজের উপর বড্ড করুনা হচ্ছে তার। কেন সে এমন হলো? কেন কাউকে নিজের মনের ভাব খুলে বলতে পারে না? শায়লা মনে মনে গুমরে মরে হাজারবার।
কপালে শীর্ন হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ মেলে শায়লা। দাদাজানকে বসে থাকতে দেখে চমকে উঠলো সে। মলিন কন্ঠে বললো-“দাদাজান, আপনি! ঢাকায় কখন এলেন?”
তৈয়ব মাওলানার নয়ন দ্বয় ছলছল হলো, কম্পিত কন্ঠে সুধায়-“আমাকে মাফ করে দাও শায়লা বু। আমার জন্য তুমি কষ্ট পাইতেছ খালি।”
শায়লা হতচকিত হলো, ক্লান্ত গলায় বললো-“এসব কি বলছেন দাদাজান? আপনার কি দোষ? দোষ তো আমার কপালের।”
“কপালকে দোষ দিতে নাই বু আল্লাহ নারাজ হোন। সব আল্লাহর ফয়সালা বু আর আল্লাহ আমাদের ভালো চান। আমাদেরই বুঝতে দেরি হয়।”
শায়লা বিরক্ত হলো। এই মুহূর্তে নীতিকথা ভালো লাগছে না শুনতে। তৈয়ব মাওলানা আরও কিছু বলতে চাইলো পারলো না। ডাক্তারের বারন মনে করে চুপ করে গেলো। পরে সময় সুযোগ বুঝে শায়লার সাথে কথা বলা যাবে। তৈয়ব মাওলানা উঠে দাঁড়ালো-“তুমি বিশ্রাম নাও বু। শরীর ভালো হোক অনেক কথা বলবো তোমার সাথে।”
শায়লা মাথা দুলায়। তৈয়ব মাওলানা বেরিয়ে আসতেই রুবিনা ঢুকলো। মেয়ের মাথার কাছে বসে হাত বুলিয়ে দিতেই শায়লা চোখ খুললো-“মা।”
রুবিনা জবাব দিলো না। কেবল চুপ করে বসে রইলো। মায়ের মলিন মুখ দেখে শায়লা ম্রিয়মান কন্ঠে বললো-“তুমি আমার উপর রাগ করছো তাই না মা? সত্যি বলতেছি মা আমি জানি না কেন এমন করলাম।”
রুবিনা তবুও কথা বললো না মেয়ের সাথে। শায়লা স্যালাইন চলা হাত বাড়িয়ে মায়ের হাতে রাখলো-“মা, ভুল করে ফেলেছি মাফ করে দাও না।”
রুবিনা এবার নিজেকে সামলে নিতে না পেরে নিঃশব্দে চোখের জল ফেললো। দূর্বল গলায় বললো-“তুই কি ভেবেছিলি শায়লা? তুই মরে গিয়ে বেঁচে যাবি? মাকে তো একটুও ভালোবাসিসনি তাই না? মাকে ভালোবাসলে এমন কাজ করার সাহস হতো না। তোদের মতো অকৃতজ্ঞ সন্তানের জন্য আমি জীবন ত্যাগ করলাম বলে আজ আমার সত্যিই কষ্ট হচ্ছে নিজের জন্য।”
শায়লার দু চোখ জলে টইটম্বুর। ব্যাথিত নয়নে বললো-“এভাবে বলো না মা। আমি সত্যি বুঝতে পারিনি।”
রুবিনা চোখ মুছে ফেললো। নিজেকে শক্ত করে বললো-“তোর সাহস কি করে হলো নিজের জীবন নেওয়ার? কারো কথা ভাবলি না একবারের জন্যও। এতো স্বার্থপরতা?”
শায়লা লজ্জা পেলো ভারী। মায়ের চোখে চোখ রাখতে পারে না। অপরাধী মনে দংশন চলে বারবার। সত্যি বড্ড বোকার মতো কাজ করে ফেলেছে। সেই কতদূর থেকে দাদাজান আর মাকে ছুটে আসতে হয়েছে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে শায়লার মনের কোনে বারবার একজনার কথা মনে আসছে। মানুষটা কি তার খবর পেয়েছে? পেয়ে থাকলে একবার আসবে না? সত্যি সত্যি শায়লাকে সে ভুলে গেলো?
রুবিনা শায়লাকে দেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। শায়লার গোপনে চোখ মোছা দেখে আন্দাজ করে নিয়েছে। মেয়ের দু’চোখ কাকে খুঁজছে সেটাও খুব ভালো ভাবে বুঝতে পারছে। রুবিনা মৃদুস্বরে ডাকলো-“কাকে খুঁজছিস শায়লা?”
শায়লা বিব্রত হলো। উল্টো ঘুরতে যেয়ে হাতের ক্যানুলাতে টান পড়ে আর্তনাদ করে উঠলো। রুবিনা আবারও বললো-“আওয়াজটা কি শরীরের ব্যাথায় এলো না মনের ব্যাথায়? শায়লা, তুই কি রিদওয়ানকে খুঁজছিস?”
শায়লা জবাব দিলো না কেবল নজর লুকিয়ে নিলো। রুবিনা অসহায় চোখে মেয়েকে দেখে মৃদুস্বরে বললো-“যা নিজের সেটাকে এভাবে হেলায় দূরে রাখতে নেই শায়লা। তাহলে সেটা অন্য কারো হয়ে যায়। তুইও মায়ের মতো ভুল করে ফেলছিস শায়লা।”
শায়লা চমকে উঠলো, প্রশ্ন নিয়ে মায়ের চোখে চোখ রাখে, সে চোখে অনেক না বলা কথা।
চলবে—
#এরই_মাঝে
#পর্ব-৪২
“যে জিনিস পাহারা দিয়ে নিজের করে রাখতে হয় সে জিনিস আমার চাই না মা। মেয়েরা নাকি তাদের বাবার মতো কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে চায় অথচ আমি সবসময় চেয়েছি বাবার মতো কেউ না আসুক আমার জীবনে। যে পুরুষ স্ত্রীর বিশ্বাস আর ভরসা নষ্ট করে সে পুরুষ আর যাইহোক ভালো মানুষ নয়।”
শায়লার কথায় রুবিনা বাকহারা হলো। এরকমটা তো সেও ভাবতো একসময়। তারপর ভাবনারা গতি পাল্টে গেলো। কেন পাল্টে গেলো ভাবনার গতি? অনেক ভেবে ভেবে রুবিনা বুঝেছে। একটা স্থায়ী আবাসের বড্ড প্রয়োজন ছিলো রুবিনার।
ছোট বেলায় মা মারা গেলো, সৎমার সংসারে অনাদর না হলেও আদর ছিলো না। হেলায় বেড়ে ওঠা লতার মতোই বড় হয়েছে সে। ইন্টার অব্দি পড়ে তারপর বিয়ে। শশুর শাশুড়ী পেয়ে যেন বাবা মা পেলো রুবিনা। তারা তাকে যথেষ্ট ভালোবাসা দিয়েছে। পড়ালেখা খুব পছন্দের কিছু ছিল না রুবিনার। ঘরের কাজে সর্বগুনে গুণান্বিত ছিলো। তা দিয়েই শশুরবাড়ির সকলের মন জয় করেছে। স্বামী কি অসুখী ছিলো তার সাথে? সত্যি বলতে কোনদিন তা মনে হয়নি। একটা বোকামি করেছিল রুবিনা। শশুর বাড়ির সংসার আগলে বসে ছিলো। অথচ তার উচিত ছিলো স্বামীর সাথে তার কর্মস্থলে যাওয়া, একান্ত নিজের একটা সংসার গড়ে তোলা। বাবা মায়ের আদর ভালোবাসা শশুর শাশুড়ীর কাছ থেকে পেয়ে সেই উচিত কাজটা করতে ভুলে গেছিল। আবার মাঝে মাঝে ভাবে গিয়েই বা কি হতো? স্বামীকে তো সে আঁচলে বেঁধে রাখতে পারতোনা। যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা। যার মন থেকে উঠে যাওয়া কপালে লেখা থাকে তার জন্য জান দিলেও তাকে ধরে রাখা যাবে না। দ্বিমুখী ভাবনায় রুবিনার প্রায় রাত নির্ঘুম কাটে। রুবিনা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে শায়লার দিকে তাকালো-“তাহলে রিদওয়ানের জন্য কেন কষ্ট পাচ্ছিস?”
শায়লা অন্যমনস্ক হলো। কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর বড্ড জটিল। জটিলতা তৈরি করে বোকা মন। সে মনের তল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মন কখন কি ভাবে কেন ভাবে কেউ আজ অবধি কেউ জানেনি। মনের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকলে শায়লা কখনোই এমন বোকামি করতো না। সে বরং রিদওয়ানের নতজানু হওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনতো। দু’বছর আগে রিদওয়ান তার সাথে যে অন্যায়টা করেছিল সেটার জন্য রিদওয়ান কি গিল্টি ফিল করে? শায়লার বড্ড জানতে মনচায়। রিদওয়ান বলেছিল শায়লা না ডাকলে সামনে আসবে না অথচ নিজের কর্মের জন্য সে আজ অবধি একবারও অনুতপ্ত হয়নি। হলে নিশ্চয়ই শায়লার কাছে মাফ চাইতো। তাতে তাদের সম্পর্কে দুই বছরের দূরত্ব আসতো না কখনোই।
“তাহলে সেদিন কেন গেছিলি? সব ভুলে কেন গেছিলি ওর কাছে?”
শায়লা নিজেই নিজেকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো। সন্তোষজনক উত্তর পেলো না। শায়লার হাসফাস লাগে সবকিছু। এই হাসপাতালের বেড, ব্যাথাযুক্ত দুই হাত, এই শুয়ে থাকা সবকিছু অসহ্য লাগে। নিজের ঘরটাকে ভীষণ মিস করছে। পুকুর পাড়টাকে মনে পড়ছে, যেখানে অসংখ্য মনখারাপের বিকেল কেটেছে। ক্লান্ত শায়লা চোখ বুজে ফিরে গেলো তার গ্রামের বাড়িতে।
“মা। আমি আসবো?”
পুরুষালি কন্ঠ কানে যেতেই চমকে চোখ খুললো শায়লা। ঠিক তখনই চার চোখের মিলন হলো। কিছু মুহূর্তের জন্য পৃথিবীটা থমকে গেলো মনেহয়। দু’জনই দু’জনকে দেখছে নির্নিমেষ। শায়লা ফিসফিসিয়ে বললো-“আপনি যাননি?”
রিদওয়ান সে কথা শুনলো কিনা বোঝা গেলোনা। সে নিঃশব্দে ভেতরে এলো। শায়লার জ্ঞান ফেরার খবর পেলেও মুখোমুখি হওয়ার সাহস হচ্ছিল না। ওকে দেখে রুবিনা আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো। রিদওয়ানকে কিছুটা স্বস্তিও পেলো। অনেক কটু কথা বলে ফেলেছে ছেলেটাকে। ভেবেছিলেন আর বুঝি আসবে না। এখন দেখে কিছুটা খারাপ লাগলো। তখন ওভাবে না বললেও হয়তো চলতো। রুবিনা কোমল গলায় ডাকলো-“এসো রিদওয়ান, বসো ওর কাছে। আমি বাইরে যাচ্ছি।”
রুবিনা চলে গেলো। রিদওয়ানের অসস্তি হচ্ছে, বহুদিন পরে শায়লার মুখোমুখি হয়ে সহজ হতে পারে না। মন চাইছে শায়লাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে। হাজারটা চুমো একে দিতে ওর মুখে। কিন্তু মন চাইলেও তেমন কিছু করা যাবে না সে জানে। এই মেয়েটা হয়তো কোনদিন তার মনের আবেগগুলো ঠিকঠাক বুঝবে না। তার ইচ্ছে অনিচ্ছের মুল্য হয়তো কোনদিন পাবে না। তবুও কেন যে অবুঝ মেয়েটাকে এতো ভালোলাগে তার? নিজের মন খারাপ ভাবটা দূরে ঠেলে সে চেয়ার টেনে বসলো। স্যালাইনটা চেক করলো অযথাই। হাতটা দেখে বললো-“খুব ব্যাথা করছে কি?”
জমা অভিমান সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে বুকে। শায়লার গলায় সে অভিমানের রেশ-“ব্যাথা করলে কার কি? কেউ কবে আমার কথা ভেবেছে?”
রিদওয়ান বিব্রত হলো। কথাগুলো যে তাকে উদ্দেশ্য করে বলা এতে কোন সন্দেহ নেই। অপরাধবোধ মাথা চাড়া দিলো। মাথা নিচু করে মৃদুস্বরে নিজের অপরাধ মেনে নিলো-“তোমার কাছে এলে কি করবো আর কি করবো না সেটাই বুঝতে পারি না শায়লা। সব গুলিতে ফেলি। যা করা উচিত না তা করে ফেলি আর যা করা উচিত তা করতে দ্বিধা হয়। আম সরি শায়লা, আমার খুব ভুল হয়ে গেছে। প্লিজ মাফ করে দাও।”
শায়লা বিদ্রুপের হাসি হাসলো-“তা কোন ভুলের জন্য মাফ চাইলেন? আপনার তো ভুলের শেষ নেই।”
রিদওয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো শায়লার দিকে। কিছুটা সময় পার হলো এভাবেই তারপর বললো-“আমার উচিত ছিলো ইউকে যাওয়ার ব্যাপারটা তোমাকে নিজ মুখে জানানো। তুমি আমার স্ত্রী, অধিকার আছে জানার। আমারই ভুল ছিলো।”
শায়লা চুপ করে গেলো। অনেক অনেক কিছু বলতে মন চাইলেও ইচ্ছে করলো না। বরং চুপচাপ রিদওয়ানকে দেখতে ভালো লাগছে। মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকিয়ে দেখছে রিদওয়ানকে। হুট করে প্রশ্ন করলো-“আপনি যাবেন না? এখানে এসে বসে আছেন যে? আমার জন্য আপনার যাওয়া ক্যান্সেল হলো বুঝি নাকি পিছিয়েছেন?”
রিদওয়ান সে কথার জবাব না দিয়ে বললো-“আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি। চাইলে বাড়ি যেতে পারবো আমরা।”
“আমি নওগা যাব। মায়ের কাছে থাকলে ভালো লাগবে আমার। কিছুদিন গ্রামে থাকতে মন চাইছে।”
“উহু, এখন কিছুদিন ঢাকায় থাকতে হবে আমার সাথে আমার বাসায়। ডাক্তারের এ্যাপয়েনমেন্ট নিয়েছি। তোমার ঘা টাও একটু শুকাতে হবে। তারপর আমিই তোমাকে নিয়ে যাব গ্রামে।”
শায়লা কিছু না বলে তাকিয়ে রইলো। অবাক হচ্ছে ভেতরে ভেতরে রিদওয়ানের অধিকার নিয়ে কথা বলায়। এই ছেলেটা কখন কি করে কিছু বোঝেনা।
শায়লা দূর্বল গলায় বললো-“আমি আপনাদের বাড়িতে যাব না।”
“কেন? আমার মায়ের জন্য?”
শায়লা চমকে তাকায়। রিদওয়ান ওকে দেখছে একদৃষ্টিতে। শায়লাকে তাকাতে দেখে হাসলো-“ভয় নেই, তিন চারদিন থাকবো আমরা। তারপর নওগা ফিরে যাব। আর আমি সবসময় থাকবো তোমার সাথে, মা উল্টোপাল্টা কিছু বলতে পারবে না তোমাকে।”
“আপনার মা উল্টোপাল্টা বকে আপনি বুঝলেন কি করে?”
রিদওয়ান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বললো-“এসব নিয়ে পরে কথা বলবো শায়লা। একটু রেস্ট নাও এখন। বেশি কথা বলা ঠিক হবে না তোমার। আমি যাচ্ছি এখন। ডাক্তারের সাথে কথা বলে দেখি তোমাকে আজই বাসায় নেওয়া যায় কিনা।”
শায়লা কেন যেন রিদওয়ানের কথাটা মেনে নিয়ে চুপচাপ চোখ বুঝলো। অনেক কথা বলায় ক্লান্তি ভর করেছে শরীরে, চোখ বোজার সাথে সাথেই ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো।
*****
রিদওয়ান আর ওয়াহেদের জোরাজোরিতে শায়লা, ওর দাদা আর মাকে রিদওয়ানদের বাড়িতে আসতেই হলো। রিদওয়ানের কথা, এই মুহূর্তে শায়লাকে ছেড়ে কোথাও যাওয়া চলবে না। আবার শায়লাকে নিয়ে অতোদূর জার্নি করার উপায় নেই বলে বাধ্য হয়ে ওদের মেনে নিতে হলো। রুবিনার বড্ড অসস্তি হচ্ছে। বাড়ির বাইরে একদিনও কোথাও থাকেনি। কয়দিন হাসপাতালে ছিলো, মেয়ের টেনশনে এতোকিছু বোঝেনি। এখন মেয়ের শশুরবাড়ি এসে কেমন অদ্ভুত লাগছে। জাকিয়া ওদের পছন্দ না করলেও ওয়াহেদ আর রিদওয়ানের কারনে হাসি মুখে কথা বললো। তবে পল্লবী আর মালিহা বেশ আন্তরিক আচরণ করলো। শায়লার জায়গা হয়েছে রিদওয়ানের ঘরে। রুবিনা আর তৈয়ব মাওলানার জন্য আলাদা গেস্টরুম দেখিয়ে দিল ওরা। শায়লার দু’হাত দিয়ে কিছু করার উপায় নেই। হাসপাতালে নার্স ছিলো এখন ঘরে এসে বিপদে পড়লো। খাওয়া বাথরুম সব কাজে মাকে ডাকতে হচ্ছে। রাতে রুবিনা ওকে খাইয়ে দাইয়ে ওষুধ দিয়ে ঘুমাতে গেলো। রিদওয়ান সারাদিন ইচ্ছে করে রুমে আসেনি এখন রুমে ফিরে দেখলো শায়লা বসে আছে বিছানায়। রিদওয়ানকে দেখে অসস্তি বোধ হলো তার। একা একাই শোয়ার চেষ্টা করলো। ফলাফল দুই হাতের কব্জিতে ভীষণ টান পড়লো। ব্যাথায় মুখ চোখ কুঁচকে গেলো শায়লায়, আর্তনাদ বেরিয়ে এলো হঠাৎ। রিদওয়ান সবটা দেখলো দাঁড়িয়ে থেকে। চরম মেজাজ খারাপ হচ্ছে মেয়েটার উপর। এখনো এতো জেদ মেয়েটার। ওর কাছ থেকে কোন হেল্প নেবে না ভেবে এসব করছে। রিদওয়ান নিজেকে শান্ত করে এগিয়ে গেলো। শায়লাকে ধরে রেখে মাথার বালিশ ঠিক করে জায়গায় শুইয়ে দিয়ে ওর মুখের উপর উপুড় হলো-“নিজের উপর অত্যাচার কেন করছো শায়লা? আমাকে ডাকা যেত না? সবসময় এতো জেদ ভালো না শায়লা। জেদ ভালো কিছু বয়ে আনে না এটা কি এখনো বোঝনি? আর কত?”
শায়লা নিরব রইলো। রিদওয়ানের এতো কাছে আসাটা ঠিক হজম হচ্ছে না ওর। বুকটা ধুকপুক করছে অকারণ। সে চোখ বুঝে ঠোঁট চেপে ধরে রিদওয়ানের বকা হজম করলো। কাঠের পুতুলের মতো বিছানায় সেটে আছে। রিদওয়ান ওকে দেখে হতাশ হলো, এই মেয়ে কখনো ঠিক হওয়ার নয়। সবসময় নিজের মতো থাকবে এটাই পন করেছে। রিদওয়ান সরে এসে মোলায়েম গলায় বললো-“নিজের জেদটা একটু সাইডে রাখো শায়লা। অন্তত তোমার সুস্থ হওয়া পর্যন্ত। রাতে আমি ঘুমিয়ে থাকলেও আমাকে ডাকবে। খবরদার একা কিছু করার চেষ্টা করবে না।”
শায়লা তবুও নিরব রইলো। রিদওয়ান বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লো ওর পাশে। দুইদিনের দৌড় ঝাপে শরীর অসার হয়ে আছে। বিছানায় গা এলাতেই শরীর ভেঙে এলো, অল্প সময়ের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।
চলবে—
©Farhana_Yesmin