এরই মাঝে পর্ব-৪৩+৪৪

0
107

#এরই_মাঝে
#পর্ব-৪৩

ভোরে রিদওয়ানের ঘুম ভেঙেছে শায়লার ডাকে। মৃদুস্বরে শায়লা অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে তাকে। রিদওয়ান ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো, হাত বাড়িয়ে বাতি জ্বেলে উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইলো-“কি হয়েছে? ব্যাথা করছে? কোথায় ব্যাথা করছে?”
শায়লা মাথা নাড়লো মৃদুস্বরে বললো-“মাকে একটু ডেকে দিতে হবে।”
রিদওয়ানের ভ্রু কুঁচকে গেলো-“কেন? কি দরকার? এতো সকালে মাকে ডাকতে হবে কেন? আমাকে বলো।”
শায়লা ভারী বিপদে পড়লো। একে তো রিদওয়ানের সাথে তার সখ্যতা নেই তারউপর এতোদিনের দূরত্ব। সাহায্য চাইতেও কেমন যেন আনইজি লাগে। সারারাত বাথরুমের চাপ আঁটকে রেখে এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু রিদওয়ানের উপর চেচাতেও মন সায় দিলো না। শায়লার নিরবতায় রিদওয়ান বিরক্ত হলো-“চুপ করে গেলে কেন? কি হয়েছে বলবে তো?”
শায়লা মুখ গোজ করে বললো-“কথা না বাড়িয়ে মাকে ডেকে দিন প্লিজ।”
বাধ্য হয়ে রিদওয়ান রুবিনাকে ডেকে আনলো। শায়লা মাকে সাথে নিয়ে রুমের সাথে লাগোয়া বাথরুমে গেলো। শায়লাকে বিছানায় দিয়ে রুবিনা চলে যেতেই রিদওয়ান চাপা রাগ ঝাড়লো-“এইটুকু কাজের জন্য মাকে ডাকার কি প্রয়োজন ছিল শায়লা? আমাকে বললেই হতো।”
শায়লা এবার মুখ ঝামটা দিলো-“না হতো না। শুধু শুধু আপনার কোন ফেবার আমি চাই না। যথেষ্ট ফেবার করেছেন।”
শায়লার ধমক খেয়ে রিদওয়ান চুুপসে গেলো। ম্রিয়মান গলায় বললো-“আমি সরি বলেছি তো শায়লা। কেন সবকিছু এমন জিইয়ে রাখো বলো তো?”
শায়লা জবাব দিলো না। রিদওয়ান এগিয়ে এসে শায়লার পাশে বসতেই শায়লা পিছিয়ে গেলো। রিদওয়ানের চোখে লাগলো ব্যাপারটা। সে হিসহিসিয়ে বলে ফেললো-“এভাবে পেছাচ্ছ কেন? আমি বাঘ না ভালুক? আর তুমি কি সামহাউ আমাকে বিশ্বাস করতে পারছো না?”
শায়লা তেরছাভাবে জবাব দিলো-“বিশ্বাস না করাটাই স্বাভাবিক না?”
অপমানে লাল হলো রিদওয়ান। মাথার চুল টেনে ধরে ল জলদগম্ভীর কন্ঠে বললো-“গত দুবছরের বেশি সময় তোমাকে একবারও বিরক্ত করিনি। এমন ইন্সিডেন্ট না ঘটলে হয়তো আরও দু’বছর আমাকে দেখতে না তবুও এমন অভিযোগ তুললে কি করে? সামান্য একবারের ঘটনা নিয়ে আমাকে এভাবে জাজ করছো?”
শায়লা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো-“সামান্য একবার! ব্যাপারটা আপনার কাছে সামান্য লাগছে? আমার সাথে করা সব আপনার সব আচরণ সামান্য? প্রথমে যাচ্ছে তাই আচরণ করে কাছে টানবেন তারপর না বলে কয়ে বিদেশে প্রাক্তনের কাছে যাবেন। এইসবই সামান্য?”
রাগের মাথায় নিজের মনের পুষে রাখা রাগের পুরোটাউ ঢেলে দিলো রিদওয়ানের উপর। রিদওয়ান হাত মুঠো করে আছে। ভ্রু দু’টো কুঁচকে তাকিয়ে দেখছে শায়লাকে। যেন বোঝার চেষ্টা করছে ওর মনের অভিসন্ধি। শায়লার কথা শেষ হতেই শ্বাস ফেলে রিদওয়ান-“তোমার রাগটা আসলে কিসে? আমি এতোদিন যোগাযোগ করিনি এজন্য? নাকি তোমায় না বলে চলে যাচ্ছিলাম এজন্য? কিন্তু এসব কেন তোমার কাছে ম্যাটার করবে? তুমি তো কখনো এই বিয়েটা ঠিকঠাক মানতে চাওনি। বলো চেয়েছ?”
শায়লা চুপ করে গেলো। রিদওয়ান নিজেকে শান্ত করতে বারবার ঘনঘন শ্বাস টানলো-“তুমি বিয়ে মানছো না আমাকে মানছো না অথচ ঠিকই আমার উপর অভিমান করে নিজের জান বকসে দিতে যাচ্ছিলে। কি আজব বলো তো?”
শায়লা প্রতিবাদ করলো-“মোটেও আপনার জন্য জান বকসে দেইনি। আমার ঠেকা পড়েনি আপনার জন্য এতোকিছু করতে।”
রিদওয়ান এবার হাসলো ঠোঁট টিপে-“আচ্ছা! তাহলে হাত দু’টো কাটলে কি দুঃখে? আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলে। সেঁজুতির কথা শুনে কেন থাকলে না? কষ্ট লেগেছিল? কেন কষ্ট লেগেছিল? তুমি তো আমাকে ভালোবাসো না তাহলে সেঁজুতি এলো না গেলো তাতে কি আসে যায়?”
শায়লার চেহারায় কাঠিন্যতা ছেয়ে গেলো-“আমার মধ্যে ভালোবাসা থাকুক চাই না থাকুক তাই বলে আপনি আমার সাথে বিট্রে করবেন? এই অধিকার কে দিলো আপনাকে? আপনার দাদাজান?”
রিদওয়ান রেগে গেলো-“খবরদার দাদাজানকে এসবে টানবে না। মানুষটা এখন এই দুনিয়াতে নেই।”
“কেন টানবো না? দাদাজান নিশ্চয়ই আপনাকে বলেনি বউয়ের অনুমতি ছাড়া তাকে ছুঁতে কিংবা বউ ফেলে আগের প্রেমিকার কাছে যেতে। কিন্তু আপনি তো এসব করছেন। বিয়েটা এতোটা ছেলেখেলা আপনার কাছে তাহলে সম্পর্ক কন্টিনিউ করলেন কেন?”
রিদওয়ান মাথা চেপে ধরে বসলো। শায়লার উল্টো পাল্টা কথায় মাথাটা বনবন করছে। সে কি করে এই মেয়েকে বোঝাবে ভেবে পাচ্ছে না। রিদওয়ানকে চুপ থাকতে দেখে শায়লা সাহস পেলো যেন-“এখন কথা নেই কেন মুখে?”
রিদওয়ান লাল চোখে তাকাতেই শায়লা ভরকে গেলো৷ বার কয়েক ঢোক গিললো। রিদওয়ানের এমন লুক দেখে অভ্যস্ত নয় সে। রিদওয়ান হয়তো শায়লার ভয় পাওয়াটা বুঝলো। তাই ওর দিকে একদৃষ্টিতে থেকে কৌতুকপূর্ব কন্ঠে বললো-“নিজেই বলছো প্রাক্তন আবার নিজের অজান্তেই সেই প্রাক্তনকে হিংসে করছো। আসলে তুমি কি করছো কি করতে চাইছো না নিজেই বুঝছে পারছো না। আইথিংক তোমার একটা সাইকোলজিস্ট এর সাহায্য লাগবে।”
“মোটেও কারো সাহায্য লাগবে না আমার। আমি পাগল নই।”
রিদওয়ান হাসলো-“আমি তো তোমাকে পাগল বলিনি শায়লা। তুমি শিক্ষিত মেয়ে, পড়ালেখা করছো কিন্তু করনীয় আর বর্জনীয় বুঝতে পারো না। অবশ্যই তোমার অন্য কারো সাহায্য দরকার।”
আচমকা শায়লা শান্ত হয়ে গেলো। রিদওয়ান যা বললো মাথায় ঘুরছে। ভাবনার জগতে থেকে টের পেলো না রিদওয়ান ওর খানিকটা কাছে এসে বসেছে। ক’দিনের অসুস্থতার ওর এলোমেলো রুক্ষ চুলগুলোর কিছু অংশ কপালের উপর এসে পড়েছে। রিদওয়ান যত্ন নিয়ে সেগুলো কানের পাশে গুঁজে দিতেই শায়লার সম্বিৎ ফিরলো। সে হচকে বালিশের উপর পড়তেই যাবে রিদওয়ান ওকে ধরলো শক্ত হাতে। দু’হাতে কোমড় পেচিয়ে ধরে ওকে কাছে টানলো আচমকা। নিজের আচরণে নিজেই চমকে গেলো রিদওয়ান। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে শায়লার চোখে চোখ রাখলো-“আমি তোমার কে শায়লা?”
শায়লা আমতাআমতা করে। রিদওয়ান বললো-“আমি তোমার স্বামী হই শায়লা। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ককে একই সাথে পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের বা দূরের সম্পর্ক বলা যায়। স্বামী স্ত্রী দু’জন দু’জনকে বুঝলে সবচেয়ে কাছের আর যদি না বোঝে তাহলে দূরের। তুমি কি চাও? আমরা কেমন স্বামী স্ত্রী হবো?”
শায়লা জবাব দিলো না। ওর গা ঘামছে। বহুদিন পরে রিদওয়ানের স্পর্শ পেয়ে শরীর কাঁপছে না চাইতেও। শায়লার কপালে আর নাকে ঘামের চিন্হ দেখে রিদওয়ান হাসলো। এক হাত দিয়ে নাকটা ঘষে দিয়ে ফিসফিস করলো-“কথা দিয়েছিলাম তুমি না চাইলে তোমার কাছে আসবো না কিন্তু কথা রাখতে পারলামনা বলে সরি। তবে এর বেশি কিছু করবো না। তুমি না বললে একটা চুমুও দেব না। প্রমিস।”
বলেই সরে গেলো শায়লার কাছ থেকে।

*****

রুবিনার বড্ড অসস্তি লাগে শায়লার শশুর বাড়িতে। তিনদিনেই হাপিয়ে উঠেছে। কোন কাজ করার নেই। বাড়ির বাকি দুই বউ চাকরি করে। তারা সকালে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়ে। রান্নার লোক আছে তারাই রান্না করে জাকিয়া শুধু বলেটলে দেয়। বাড়িতে সকাল থেকে রাত অবধি কাজ করে যাওয়া রুবিনার সারাদিন সময় কাটাতে কষ্ট হয়। তাছাড়া জাকিয়া কথাটথা তেমন বলে না তার সাথে। পল্লবীটা থাকলে তাও সময় ভালো কাটে। রুবিনা ভাবছে রিদওয়ানকে বললে টিকেট কেটে দিতে। শায়লার কাজ রিদওয়ানই সামলে নিচ্ছে। তাহলে এখানে শুধু শুধু পড়ে থাকা কেন? ভাবনার মাঝেই জাকিয়া এসে বসলো তার সামনে। দুইকাপ চা রেখে বললো-“আমি জানি আপনার চা খাওয়ার অভ্যােস নেই তবুও নিয়ে এলাম। দুইজন চা খেতে খেতে একটু গল্প করি। কি বলেন?”
রুবিনা সতর্ক হলো। যতই ঘরের কোনে থাকুক না কেন মানুষ চেনার ক্ষমতা আছে তার। জাকিয়া শুধু শুধু গল্প করার মানুষ না এটা ভালোই বুঝেছে কয়দিনে। সে জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো-“করেন আপা, কি গল্প করতে চান?”
জাকিয়া চায়ে চুমুক দিয়ে জানতে চাইলো-“শায়লার বাবার সাথে আপনার…”
জাকিয়াকে কথা শেষ করতে দেয় না রুবিনা-“তালাক হইছে। আমিই নিবেদন করছিলাম। যে মানুষ বিশ্বাস ভঙ্গ করে তার সাথে সম্পর্ক রাখতে চাই না।”
জাকিয়া হাসলো-“তাহলে সেই মানুষের বাবা মায়ের সাথে থাকছেন যে? ব্যাপারটা কেমন হয়ে যায় না?”
রুবিনা ঘাবড়ে না গিয়ে পাল্টা হাসলো-“আমি তো থাকতে চাই নাই আপা। বাবা জোর করে রাখছে। সে তার ছেলের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে আমাকে মেয়ে বানায়ে রাখছে। জমিজমাও লিখে দিছে আমার নামে। যদিও সেসব কিছুই আমার চাই না। আমার মেয়েরা আমার সম্পদ।”
এরপর দু’জনের মধ্যেই নিরবতা। জাকিয়া হুট করে বলে উঠলো-“রিদওয়ানটা কি পাগলামি করছে বলুন তো? ও ইউকে তে এমডি করার সুযোগ পেয়েছে এখন বাসায় বসে বউ সেবা করে সেই সু্যোগ হেলায় নষ্ট করছে। এরকম সুযোগ কি বারবার আসবে বলেন আপা? ছেলেটা আমার দুনিয়াদারী কিছুই বোঝে না। একটা ডিগ্রি না থাকলে কি ডাক্তারের কোন ভ্যালু আছে? আপা একটু বোঝান না ওকে।”
রুবিনা বুঝলো আলোচনা কোন দিকে গড়াচ্ছে। সে বললো-“এখানে না হলে অন্য কোথাও যাবে। আপাতত বউয়ের কাছে থাকাও গুরুত্বপূর্ণ আপা। আর ওসব ডিগ্রি দিয়ে কি হয় আপা? ভালো মানুষ না হলে ডিগ্রির কোন দাম নাই।”
রুবিনার কথা তিতা করলার মতো লাগলো জাকিয়ার কাছে। গিলতে না পেরে উগলে দিলো অন্য ভাবে-“আপা, আপনার মেয়েটার মাথায় মনেহয় সমস্যা আছে, তাই না? সবকিছুতে কেমন ওভাররিয়্যাক্ট করে। বাবা ছাড়া বড় হয়েছে তো। তাছাড়া যারা আত্মহত্যা করতে চায় তাদের তো মানসিক সমস্যা থাকেই না হলে কে সজ্ঞানে নিজের জান নিতে চাইবে। আহারে আমার আদরের রিদওয়ান, কেবল বউ যে পেলো।”
জাকিয়ার হাহাকারে রুবিনার মেজাজ উর্দ্ধমুখি। সে দাঁড়িয়ে গেলো-“আপা, আমার শায়লা একদম সুস্থ মানুষ। তবে বুঝতে পারতেছি ওকে কে পাগল বানানোর চেষ্টা করতেছে।”
জাকিয়া চোখ উল্টে বললো-“এসব কি বলেন আপা? কে ওকে পাগল বানাবে?”
রুবিনা হাসলো-“আপা, আপনি যা চান তা কোনদিন হবে না। দুইজন মুরব্বি মানুষের ইচ্ছা কখনো ব্যর্থ হবে না।”
বলেই ছুটে গেলো তৈয়ব মাওলানার রুমের দিকে। এ বাড়িতে আর থাকা যাবে কিছুতেই না।

চলবে—

#এরই_মাঝে
#পর্ব-৪৪

“মা আসবো?”
রিদওয়ানকে দরজায় দেখে রুবিনা জায়নামাজ গুছিয়ে বিছানায় উঠে বসলো-“আসো। কি হইছে? শায়লা ডাকে আমাকে?”
“না মা, আমিই এলাম। একটু কথা বলার ছিলো।”
রিদওয়ান সামনে চেয়ার টেনে বসলো। রুবিনা নিরবে রিদওয়ানকে দেখলো।
“মা, এখন পর্যন্ত কোন কাজ আপনাদের না জানিয়ে করিনি। হোক সেটা ভালো কি মন্দ। আজও একটা বিষয়ে অনুমতি চাইতে এলাম।”
রুবিনা এবার লজ্জা পেলো। শায়লার হাসপাতালে থাকার সময় রিদওয়ানকে খুব কথা শুনিয়েছিলেন। ছেলেটা তাতে দুঃখ পেয়েছিল সন্দেহ নেই। সে কিছুটা লাজুক হয়ে বললো-“তোমাকে অনেক কড়া কথা শুনাইছি রিদওয়ান তুমি কিছু মনে কইরো না। আমার তখন মাথা ঠিক ছিলো না।”
রিদওয়ান মাথা নাড়ে-“আপনি ভুল কিছু বলেননি মা। আমার ভুল ছিলো না হলে এমন কিছু ঘটতো না। তবে শায়লার ব্যাপারে আমি এখন দ্বিধায় ভুগি মা। কোনটা ওর পছন্দ হবে কোনটা হবে না আমি বুঝতে পারি না। ওকে জোর করলে ওর ভালো লাগে না, জোর না করলে ভালো লাগে না। ওর মনে কি চলে তা বুঝতে আমি অপারগ। ওর জন্য দূরে রইলাম তাতে ওর কতটুকু ভালো হলো তা তো দেখতেই পাচ্ছি। আবার কাছে থাকতে চাইলেও ওর পছন্দ হচ্ছে না। এভাবে তো সংসার হবে না মা। আমি আর কতদিন ধৈর্য্য ধরবো?”
রুবিনার চেহারা মলিন হলো। বুকটা দুরুদুরু করছে। কি বলতে চাইছে রিদওয়ান? প্রশ্নবোধক চাহনি দিতেই রিদওয়ান বললো-“ও আমাদের কাউকেই মনের কথা খুলে বলে না। ও কি চায় মনে কি চলছে। তাই আমি ভাবছিলাম ওকে একজন সাইকোলজিস্ট দেখাব। ওর মনের রোগটা কি সেটা জানা জরুরি মা। আমি চাই শায়লা স্বাভাবিক মেয়েদের মতো জীবন যাপন করুক।”
রুবিনা সায় জানিয়ে মাথা নাড়ে-“তুমি ডাক্তার মানুষ, ওর জন্য যেটা ভালো সেটাই করো। কিন্তু বাবা, একটা অনুরোধ আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও। শায়লার জন্য তো তুমিই আছো আমার থেকে কি কাজ বলো। সত্যি বলতে এভাবে কাজ ছাড়া বসে থেকে আমাদের অভ্যাস নেই। আর ওদিকে মাও একা আছে বাড়িতে।”
রিদওয়ান মানা করলো না-“আজ রাতের টিকেট করে দিচ্ছি তাহলে। শায়লা ক’দিন থাকুক আমার সাথে। যেহেতু বাইরে যাওয়া হলো না। আমার চাকরিতে জয়েন করতে হবে। ভাবছি শায়লাকে আমার সাথে নিয়ে যাব এবার। কিছুদিন কাছে রেখে দেখি ওর কি মনোভাব।”
রিদওয়ানের কথা শুনে সত্যিই খুশি হলো রুবিনা। দূরে থেকে যখন এমন হাল তখন কাছে থাকাই ভালো।
“এটাই ভালো হবে। আমার মনেহয় এ বাড়িতে না থেকে তোমার চাকরির জায়গায় গেলে ভালো হবে। দু’জন একসাথে থাকলে শায়লার অবিশ্বাস আর দ্বিধাটাও কেটে যাবে। মেয়েটা মুখে কিছু না বললেও এটুকু বুঝি ও তোমাকে অপছন্দ করে না।”
রিদওয়ান ক্ষনকাল থমকায়। সত্যি কি শায়লা তাকে পছন্দ করে? কখনো স্বাভাবিক মেয়েদের মতো ভালোবাসার কথা বলবে কি? রুবিনা ডাকলো-“তোমার অতীতে কেউ থেকে থাকলে তার কথাও বলে দিয়। তোমার প্রতি বিশ্বাস জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব তোমারই রিদওয়ান। আর একটা কথা কি জানো, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে আড়াল রাখতে নেই তাতে তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নেয়। সেই সুযোগ আর কাউকে দিয় না।”
রিদওয়ান একটু অবাক হলেও চুপচাপ শুনলো তারপর মাথা দুলিয়ে বেরিয়ে এলো।

*****

ডাঃ মাহিমা মনোয়ার দেখতে অনেকটা স্পেনের রানী সোফিয়ার মতো। ফর্সা নিটোল ত্বক, মুক্তার মতো ঝকঝকে দাঁত, নিঁখুত খাঁড়া নাক, সিল্কি ঢেউ খেলানো চুলগুলো ঘাড়ের খানিকটা নিচ পর্যন্ত দুলছে। শায়লা মুগ্ধ হয়ে দেখছে সামনে বসে থাকা নারীটিকে। মানুষটা নিবৃস্ট মনে ফোনে কথা বলছে। কথা বলা শেষ করে ফোন কেটে শায়লার দিকে তাকিয়ে হাসলো মাহিমা-“হ্যালো শায়লা, কেমন আছো?”
শায়লা মাথা নাড়ে। মাহিমা হাসলো-“কথা কম বলো?”
শায়লা আবারও মাথা নাড়ে।
“চা না কফি?”
“কফি।” ছোট্ট করে উত্তর দেয় শায়লা। নিজের এসিস্ট্যান্টকে ডেকে দু’কাপ কফির কথা বলে চেয়ার হেলান দিয়ে শায়লার দিকে তাকালো-“চা কফির মধ্যে একটা মিল আছে। সেটা কি বলো তো?”
শায়লা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ভাবছে চা আর কফির মধ্যে অমিল কি আছে? দুটোই তো একই জিনিস। শায়লা বিরবির করলো-“দুটোতেই ক্যাফেইন আছে আর দু’টোই নিদ্রাহীনদের সঙ্গী। ক্যাফেইনের পরিমাণের হেরফের ছাড়া খুব একটা পার্থক্য নেই।”
মাহিমা হেসে দিলো-“চমৎকার। তোমার বুদ্ধিমত্তার লেভেল দারুণ। এখন বলো তো এই সিলি প্রশ্নটা আমি কেন করলাম?”
“আমার বুদ্ধি যাচাই করার জন্য না এটা নিশ্চিত।””
মাহিমা উচ্চস্বরে হাসলো-“সৌন্দর্যের সাথে বুদ্ধিমত্তা খুব চমৎকার কম্বিনেশন এবং রেয়ার, এটা জানো? তোমাকে দেখে মনেহচ্ছে আমি আমার নিজেকে আয়নায় দেখছি। তোমার বয়সে তোমার মতোই ছিলাম আমি।”
শায়লা কিছুটা চমকালো। নিজের কাটা হাতের দিকে তাকিয়ে থাকলো। মাহিমা মৃদুস্বরে বললো-“একটা ঘটনা বলি শোন৷ আমি একজনকে খুব পছন্দ করতাম। খুব মানে খুব, পাগলামি পর্যায়ের। কিন্তু আমি ইন্ট্রোভাট আর জেদি স্বভাবের ছিলাম বলে স্বীকার করতাম না। এটাই আমার স্বভাব ছিলো। আমার মন চাইতো একটা অথচ কাজ করতাম তার উল্টা। ভাবতাম মনের কথা বলে ফেললেই কারো কাছে পাত্তা পাবো না। আসলে নানীর বাড়ি থাকতাম, মা স্কুলে চাকরি করে আমাদের দেখভাল করেছে। বুঝতেই পারছো কেমন ভাসমান জীবন ছিলো। তাই সহজে মনের কথা প্রকাশ করতাম না। তো সে একদিন জানালো আমাকে পছন্দ করে। আমি আমার স্বভাবমতো তার পছন্দের কথা জেনে তাকে অবজ্ঞা করে দূরে ঠেলে দিলাম। মানুষটা কষ্ট পেলো। অপমানের বদলা নিতে পরে আমারই সমবয়সী খালাতো বোনকে বিয়ে করলে আমি বুঝলাম ভুল করে ফেলেছি। তার প্রতি ভালোবাসাটা টের পেলাম তখন। ভীষণ কষ্ট পেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করি। মা ভয় পেয়ে আমাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিলেন পড়াশোনা করতে।”
শায়লা মৃদুস্বরে বললো-“আপনার বাবা কি…”
শায়লা কথা শেষ করে না। মাহিমার চেহারা কিছুটা ম্রিয়মান হলো-“বাবা মারা গেছিলেন ছোট বেলায়।”
“ওহহহ। তারপর কি হলো? আপনি আর বিয়ে করেননি?”
“করিনি আবার? এক পাগলের পাল্লায় পড়লাম যে আমার ঠিক বিপরীত ছিলো। এই যে আমি আজ মনোবিজ্ঞানী হয়ে মানুষের প্রবলেম শুনছি সলভ করছি এইসব তার কৃতিত্ব। সে আমাকে বকবক করা শিখিয়েছে। শিখিয়েছে ভালোবাসার মানুষকে সন্মান দিতে হয় সে বাবা মা ভাইবোন যেই হোক না কেন। মনের কথা বলতে জানতে হয় না হলে জীবন থেকে একসময় পছন্দের মানুষগুলো হারিয়ে যাবে একে একে। তাদের সাথে আমাদের কোন মধুর স্মৃতি জমবে না যেটা আমাদের অবসরের সঙ্গী হবে। যে স্মৃতি মনে করে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটবে। আমাদের এই ছোট জীবনে মানুষকে মাফ করতে জানতে হয়। মাফ করলে মনে শান্তি মিলবে।”
শায়লা আর মাহিমা দু’জনই নিরব রইলো। মাহিমা শায়লার দিকে তাকিয়ে থেকে অবাক হয়ে ভাবছে কেন এই অল্পবয়সী মেয়েটাকে পেয়ে নিজের অতীত স্মৃতি রোমন্থন করলো? হয়তো মেয়েটার মাঝে নিজেকে দেখে পেয়েছে বলে। উত্তরটা পেয়ে তার মন কিছুটা শান্ত হলো।

*****

রিকশায় বসে বারবার আড়চোখে শায়লাকে দেখছে রিদওয়ান। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওকে মনোবিজ্ঞানীর চেম্বার অবধি আনতে পেরেছে। এখন এতোটা চুপচাপ দেখে ভয় লাগছে। মেয়েটা রাগ করলো নাকি? রিদওয়ান বারবার খুকখুক করে দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করলো। শায়লা মুগ্ধ নয়নে আশেপাশে তাকিয়ে দেখছিলো। বিরক্ত হয়ে বললো-“সমস্যা কি আপনার? যা বলতে চাইছেন বলে ফেলুন এমন খুকখুক করছেন কেন?”
“না মানে কিছু খাবে? অনেকক্ষণ হলো বাড়ির বাইরে কিছু খাবে?”
“ফুচকা খাবো। ওই যে ওখানে দেখা যাচ্ছে ফুচকাওয়ালা।”
রিদওয়ান মাথা চুলকায়-“এখন এই অবস্থায় এসব বাইরের খাবার খাওয়া ঠিক হবে? একটু সুস্থ হয়ে নিয়ে না হয় খেলে?”
“আজই খাবো। কাল বাঁচি কিনা তার ঠিক আছে?”
রিদওয়ান রেগে গেলো-“বাঁচবে না মানে? আবারও উল্টো পাল্টা কিছু করার প্ল্যান আছে? এবার যদি এমন কিছু করো তবে তোমার হাত দু’টোই কেটে দেব। না থাকবে হাত না থাকবে হাত কাঁটার ইচ্ছে।”
শায়লা ফিক করে হেঁসে দিলো-“তাই করবেন। এটাই ভালো হবে।”

চলবে—
©Farhana_Yesmin