#এরই_মাঝে
#পর্ব-৪৭
“হাতমুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে নাও। আমরা বাইরে যাব।”
বলে চলে যাচ্ছিল রিদওয়ান। শায়লা ডাকলো-“কোথায় যাব?”
“টুকটাক কেনাকাটা করতে হবে কাল বলছিলে। সেটাই করে আসি চলো।”
শায়লা মাথা দুলিয়ে সায় দিলো। শায়লা আলমারি থেকে কাপড় বের করছিল রিদওয়ান হুট করে এসে তার হাত ধরে টানতেই শায়লা চেচিয়ে উঠলো-“আরে আরে কি হলো? কোথায় নিচ্ছেন আমাকে?”
রিদওয়ান ওকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে মুখে আঙুল চাপে-“শসসস, চুপচাপ বসে থাকো।”
স্যভলনে তুলো ভিজিয়ে দুই হাতের কব্জি ভালোমতো পরিস্কার করে ওষুধ লাগিয়ে চিকন করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলো। কব্জির কাটা অংশ দেখলে বিরক্ত লাগে। এখন আর সেটা ক্ষতর জায়গা বলে মনে হচ্ছে না। রিদওয়ান নিজের কাজ দেখে সন্তুষ্ট হয়ে বললো-“এখন ঠিক আছে। নয়তো রাস্তাঘাটে লোকজন অকারণ কৌতুহল দেখাতো।”
শায়লা এতোক্ষণ রিদওয়ানকে দেখছিল লুকিয়ে। কি মন দিয়ে ড্রেসিং করছে। চেহারা এখনো ঘামে ভেজা, গা থেকে ঘামের গন্ধের সাথে পারফিউমের মিলেশে খুব লাইট একটা ঘ্রান আসছে। শায়লার মাথা ঝিমঝিম করে সে গন্ধে। রিদওয়ান ওর দিকে তাকাতেই নিজের দৃষ্টি সরিয়ে হাতের দিকে তাকিয়ে শায়লা বললো-“মুখে বললেই হতো।” “তোমার সাথে কথা বললে আবার বলবে আলাপ জমাচ্ছি তাই কথা না বলে কাজ করলাম। এখন তৈরি হও তাড়াতাড়ি আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি।”
“হুমমম।”
রিদওয়ান ওয়াশরুমে ঢুকলে শায়লা এই সুযোগে কাপড় পাল্টে নিলো। চোখে সামান্য কাজল আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক লাগিয়ে আয়নায় দেখলো নিজেকে। সন্তুষ্ট হয়ে চুলগুলো পরিপাটি করতে যেয়ে বিপত্তি বাঁধলো। তার লম্বা চুলগুলো আঁচড়ে একটা বেনী করতে যেয়েও পারলোনা। হাতের কব্জিতে ভীষণ টান পড়ছে। কয়েকবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলো শায়লা। ঘেমে একাকার হয়ে মন খারাপ করে বিছানায় বসলো। রিদওয়ান বাথরুম থেকে বেরিয়ে শায়লাকে বসে থাকতে দেখে অবাক হলো-“কি হয়েছে তোমার? এভাবে বসে আছো কেন?”
শায়লা অসহায় গলায় বললো-“চুল বাঁধতে পারছি না হাতে টান লাগছে।”
রিদওয়ান কিছু না বলে পাশের ঘরে গেলো। পাঁচ মিনিট পরেই ফিরে এলো। একটা কালো গোল গলা গেঞ্জি আর জিন্স প্যান্ট পড়ে ফিরে এলো। ওর ভেজা চুলগুলো এখনে এলোমেলো হয়ে আছে। ও শায়লাকে ডাকলো-“এসো এখানে।”
শায়লা লক্ষী মেয়ের মতো ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসলো। রিদওয়ান চিরুনি হাতে নিয়ে ওর চুল আঁচড়াতে শুরু করলো। আধাঘন্টা চেষ্টা করে বেশ সুন্দর করে একটা বেনী করে চুলের শেষাংস শায়লার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো-“নাও এবার রাবার দিয়ে বেঁধে নাও।”
শায়লার মুখ জুড়ে প্রশান্তির ছাপ। সে কৃতজ্ঞ চিত্তে চুলে ব্যন্ড পেচিয়ে উঠে দাঁড়ালো। নিজেকে আয়নায় দেখলো ঘুরে ফিরে রিদওয়ানের দিকে তাকালো-“থ্যাংক ইউ।”
রিদওয়ান জবাব না দিয়ে ওয়ালেট পকেটে ঢুকিয়ে ডাকলো ওকে-“চলো যাই। সন্ধ্যা হয়ে গেলো।”
শায়লা মাথা নেড়ে রিদওয়ানের পিছু নিলো। গেট খুলে বেরুতেই একজন মহিলাকে দেখে রিদওয়ান সালাম দিলো। মহিলা জানতে চাইলো-“ও কে? তোমার ওয়াইফ?”
রিদওয়ান মাথা দুলিয়ে বললো-“জ্বি আন্টি। আমার ওয়াইফ শায়লা। শায়লা উনি আমাদের বাড়িওয়ালি পলি আন্টি।”
শায়লা সালাম দিলো। সালামের উত্তর নিয়ে পলি বললো-“আমি তো তোমাদের কাছেই আসছিলাম। কাল তোমরা এলে আমি খোঁজ নিতে পারিনি। আসলে কাল তোমার আঙ্কেলের শরীর একটু খারাপ ছিলো। ওকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।”
“আমাকে ডাকলেন না কেন আন্টি? কি হয়েছে আঙ্কেলের?”
রিদওয়ানের কথায় পলি উৎফুল্ল গলায় জবাব দিলো-“আরে আমি তো ভুলেই গেছি তোমার কথা। প্রতিবেশি একজন ডাক্তার হলে আর কি লাগে। রিদওয়ান তোমাকে কিন্তু অনেক জ্বালাবো আমরা।”
“কোন সমস্যা নেই আন্টি। যখন খুশি ডাকবেন আমাকে, আমি দেখে দেব। আঙ্কেল এখন কেমন আছে?”
“তেমন সিরিয়াস কোন সমস্যা না। তোমার আঙ্কেলের গ্যাসের প্রবলেম হয় মাঝে মাঝে। বদ লোকটা অফিসে সারাদিন কয়েক কাপ চা খায়। তারপর সারারাত গ্যাসের যন্ত্রণায় ছটফট করে। তা তোমরা কি কোথাও যাচ্ছ?”
শায়লা ফিক করে হাসলো দেখে রিদওয়ান কড়া চোখে তাকায়। শায়লা দমে গেলো। মনে মনে কয়েকটা গালি দিলো রিদওয়ানকে। হাসার সময় না হেসে রোবট হয়ে থাকা কি কাজের কথা? রিদওয়ান আড়চোখে শায়লাকে দেখে নিয়ে জবাব দিলো-“জ্বি আন্টি, একটু বাজারে যাচ্ছিলাম টুকটাক কেনাকাটা করতে।”
“আচ্ছা বেশ। কাল রাতে তোমরা আমাদের সাথে খাবে। তোমার আর এই মিষ্টি মেয়েটার দাওয়াত থাকলো রাতের ডিনারের জন্য। কি আসবে তো মিষ্টি মেয়ে?”
পলি শায়লার চিবুক ধরে নেড়ে দিতেই শায়লা হেসে মাথা দুলায়-“আসবো আন্টি।”
“তোমাদের মনেহয় দেরি হচ্ছে। যাও তোমরা বেলা থাকতেই ঘুরে এসো।”
দু’জনই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। বাসা থেকে বেরিয়ে অল্প কিছু দূর হেঁটে রিকশা নিলো রিদওয়ান। রিকশায় পাশাপাশি বসে ভীষণ অসস্তি বোধ করে শায়লা। চেপেচুপে কোনায়,সেটে থাকে। একটা স্পিডবেকার পার হতে গিয়ে ঝাঁকিতে পড়ে যেতে নিলে রিদওয়ান জাপ্টে ধরলো ওকে। মেজাজ তেতে উঠলো নিমিষেই। দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“সমস্যা কি তোমার শায়লা? আমি কি রাক্ষস নাকি অচ্ছুৎ যে কাছে বসলে হয় খেয়ে নপব নয়তো ছোঁয়া লাগলে তোমার গা পঁচে যাবে? রাতের আমার পাশেই তো শুয়ে থাকো তবুও এই ঢং কেন? একবার হাত কেটে শিক্ষা হয়নি? হাত পা ভাঙতে চাচ্ছ?”
রিদওয়ানের কড়া কথা শুনে শায়লার চোখে পানি চলে এলো। সে ঠোঁট দু’টো চেপে ধরে কান্না আঁটকায়, মৃদুস্বরে ভেজা গলায় বললো-“সরি।”
রিদওয়ান কিছু বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। শায়লার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে মেয়েটা কান্না আঁটকে আছে। নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত গলায় সুধায়-“এরকম করো কেন তুমি? একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করা যায় না? আমাকে স্বামী না ভাবলে বন্ধু তো ভাবতে পারো। বন্ধু ভেবেই না হয় সম্পর্কটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করো।”
শায়লা নির্জিব দৃষ্টিতে সামনের রাস্তায় তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওর মুখের অভিব্যক্তি দেখে রিদওয়ান উচ্চস্বরে হেসে দিলো। শায়লা চমকে তাকালো। রিদওয়ান তখনো হেসেই যাচ্ছে। তাকিয়ে দেখতে দেখতে শায়লার রাগ উঠলো-“আশ্চর্য তো! এরকম বেয়াদবের মতো হাসছেন কেন?”
রিদওয়ান হাসি চেপে জানতে চাইলো-“কথায় কথায় এমন গাল ফুলাও কেন? দেখলে মনেহয় খেলায় নেওয়া হয়নি বলে ছোট বাচ্চা রাগ করে আছে।”
“তাতে আপনার কি?”
শায়লা নাকের পাটা ফুলে উঠেছে। রিদওয়ান হুট করে শায়লার কোমড় চেপে ধরে নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বললো-“আমারই তো সব। তুমি এরকম রাগ করলে মন চায় তোমাকে আচ্ছা মত আদর করে দেই। কিন্তু তা তো করা যাবে না। তোমার কাছে গেলে তোমার আবার গায়ে এলার্জি হয়। তাহলে আমি কি করবো বলে দাও?”
শায়লা মুখ ঝামটা দিলো-“অসভ্য লোক। ছাড়ুন আমাকে। বকা দিয়ে আবার ঢং করা হচ্ছে।”
“তার মানে কি শায়লা? বকা না দিলে ঢং করতে পারবো?”
“আমি মোটেও সে কথা বলিনি। কথা ঘুরিয়ে আমাকে জব্দ করার চেষ্টা করবেন না।”
“তুমি জব্দ হও? কিভাবে? আল্লাহ! আর আমি এতোদিন ভেবেছি জব্দ হওয়া আমার একচেটিয়া দায়িত্ব।”
“রিদওয়ান ভালে হবে না বলছি? ছাড়ুন আমাকে, কোথাও যাব না আপনার সাথে। এই মামা রিকশা থামান তো আমি নামবো।”
“মামা, বাজারের আগে রিকশা থামাবেন না।”
রিকশাওয়ালা মামা দাঁত বের করে হাসে-“মামা, মামী কিন্তু একদমই রাগতে পারে না। আমার বউ হইলে ধাক্কা দিয়ে রিকশা থেকে ফালায় দিতো।”
রিদওয়ান চোখ গোল করে পালাক্রমে রিকশাওয়ালা আর শায়লাকে দেখে। শায়লার ঠোঁটের কোনে ক্রুর হাসি। রিদওয়ান ভীত গলায় বললো-“মামা, আপনি তো দেখি আমার সর্বনাশ করতে চাইতেছেন। এইরকম বিপ্লবী বুদ্ধি দিতেছেন আমার বউকে। আপনি তো মানুষ ভালো না। বউ যদি সত্যি সত্যি আমাকে রিকশা থেকে ফালায় দেয় আর আমার যদি কিছু হয় তাইলে কিন্তু আপনি দায়ী থাকবেন।”
রিকশা ওয়ালা হে হে করে হাসলো। রিকশা থামিয়ে বললো-“নামেন।”
রিদওয়ান শায়লাকে আকড়ে ধরে বললো-“নামেন মানে? আমাকে কেন নামাইতেছেন? না না আমি নামবো না।”
“আরে মামা বাজার চইলা আসছি তাই নামতে কইলাম।”
রিদওয়ান সামনে তাকিয়ে দেখলো সত্যি তাই। সে বোকার মতো মুখ করে হাসলো-“বুঝি নাই মামা। ভাবলাম আপনি মামীর পক্ষ নিলেন।”
শায়লা ঝাঁঝের সাথে বললো-“ছাড়েন আমাকে। নামতে দেন।”
“দাঁড়াও। একা নামার দরকার নাই। পরে পড়ে যাবা আর আমার দোষ হবে। এমনিতেই সেবা করতে করতে জান যায়।”
রিদওয়ান রিকশা থেকে নেমে শায়লার হাত ধরে নামালো। রিকশা ভাড়া দিয়ে এগিয়ে গেলো। রিকশাওয়ালা শায়লাকে ডাকলো-“মামী, মামা যতই ঝগড়া করুন খুব ভালোবাসে আপনাকে, তাই না?”
শায়লা মুখে কিছু না বলে হাসলো। মনে মনে বললো, কচু ভালোবাসে। এতো ভালোবাসলে আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতো না। এখন আদিখ্যেতা দেখাচ্ছে। ভেবেছে আমি গলে যাব এতো সহজে। মোটেই গলবো না, আমাকে কষ্ট দিয়েছে তো আমিও কষ্ট দিয়ে শোধ তুলবো। না হলে আমার নামও শায়লা না।
চলবে—
#এরই_মাঝে
#পর্ব-৪৮
পরের দিন খুব ভোরে হাসপাতাল থেকে কল আসাতে যেতে হয়েছিল রিদওয়ানকে। শায়লা তখন ঘুমে কাঁদা হয়ে আছে। রিদওয়ান ওকে ডাকলো না। ছোট্ট একটা চিরকুট লিখে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় লটকে দিয়ে গেট লক করে বেরিয়ে গেলো। শায়লার ঘুম ভাঙলো এগারোটা নাগাদ। রিদওয়ানকে না দেখে প্রথমে একটু ভয় পেলেও পরে বুঝলো হাসপাতালে গেছে। হাতমুখ ধুয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই কাগজটা চোখে পড়লো। তাতে লেখা আছে-“আমি হাসপাতালে যাচ্ছি। সকালে অবশ্যই নাস্তা করে ওষুধ নেবে। আর হ্যা, অলস বসে না থেকে আবার ভিডিও বানানো শুরু করো। সময় ভালো কাটবে। তোমার ল্যাপটপসহ প্রয়োজনীয় জিনিস পাশের ঘরে ব্রাউন কালারের লাগেজে আছে।”
চিরকুট পড়ে শায়লা মুখ বাঁকালো। ফ্রিজ খুলে দাঁড়িয়ে থাকলো কিছু সময়। কাল বাজার থেকে আসার সময় কিছু খাবার কিনে এনেছিল। রাতে বাইরে থেকে খেয়ে এসেছিল বলে খাবারগুলো ফ্রিজে দেখে দিয়েছিল। শায়লা একটা তেহারির প্যাকেট বের করে রান্না ঘরে এলো। চুলোয় গরম করে প্লেটেহন ঢেলে নিয়ে বেডরুমে ফিরে এলো। কয়েক লোকমা খেয়ে কি মনে করে পাশের ঘরে গেলো। লাগেজ খুলে দেখলো তার ভিডিও করার যাবতীয় জিনিস আছে ওর মধ্যে। শায়লার ভ্রু কুঁচকে গেলো। এসব পেলো কোথায় রিদওয়ান? ও কি ভার্সিটিতে গেছিল? কি মনে রুমে ফিরে মহুয়াকে ফোন দিলো। ওপাশ থেকে মহুয়ার উচ্ছ্বসিত কন্ঠ শোনা গেলো-“বড়পা, কেমন আছিস? বরকে পেয়ে বোনকে ভুলে গেছিস।”
শায়লা তেতে উঠলো-“হয়েছে তোর? শেষ কথা?”
মহুয়া থতমত খেলো-“আবার কি করলাম বড়পা?”
“কিছুই করিসনি। একটা কথা জানতে ফোন দিলাম।”
মহুয়ার অভিমানি গলা শোনা গেলো-“তুই কেমন স্বার্থপর হয়ে গেছিস বড়পা? কোথায় ভাবলাম ছোট বোনের খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য ফোন দিয়েছিস। আচ্ছা বল কেন ফোন দিলি। কি জানতে চাস?”
শায়লা খানিকটা লজ্জা পেলো। আসলেও তো মহুয়ার সাথে বেশ অনেকদিন হলো কথা হয় না তার। সে আমতা আমতা করে দোষ কাটানোর চেষ্টা করলো-“জানিসতো বেশিক্ষণ মোবাইল ধরে রাখতে পারি না হাত ব্যাথা করে। আচ্ছা বল, তুই কেমন আছিস?”
মহুয়ার অভিমান কমে না-“থাক থাক আর অভিনয় করতে হবে না। তুই তাড়াতাড়ি বল কেন ফোন দিলি।”
শায়লা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো-“আমার ল্যাপটপসহ এসব জিনিস কি তুই এনে দিয়েছিস?”
“তো আর কে আনবে? ভাইয়া তো গার্লস হোস্টেলে যেতে পারবে না। আমাকে সেদিন ফোন করে বললো তোর জিনিসগুলো এনে দিতে আমি এনে দিলাম। কেন কি হয়েছে?”
“কিছু না। এমনিতেই জানতে চাইলাম।”
“শোন বড়পা, এখন তো বসেই আছো। অনেকদিন তোমার চ্যানেলে ভিডিও যাচ্ছে না। তুমি বরং ছোট ছোট ভিডিও বানিয়ে হলেও পোস্ট কর না হলে তো মনিটাইজেশন হারিয়ে ফেলবি। আচ্ছা, শোন আমার ক্লাস আছে আমি ক্লাসে যাচ্ছি। পরে কথা বলবো তোর সাথে।”
শায়লাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রাখে মহুয়া। খাবার শেষ করে এককাপ চা বানিয়ে ল্যাপটপ খুলে বসলো। চায়ে চুমুক দিতে দিতে নিজের কাজে ডুবে গেলো পুরোদস্তুর। বিকেলে কলিংবেলের আওয়াজে হুঁশ এলো শায়লার। ও ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলো। ছয়টা বেজে গেছে তার মানে রিদওয়ান ফিরে এসেছে। কলিংবেলটা আবার বাজতেই দাঁতে জিভ কেটে দরজা খুলতে ছুটলো। রিদওয়ান ওকে দেখে বিরক্ত হলো-“পনেরো মিনিট ধরে বেল দিচ্ছি। করছিলে কি তুমি?”
রিদওয়ান রুমে ঢুকে দেখলো পুরো বিছানা জুড়ে ল্যাপটপ বই খাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শায়লা কিছু না বলে নিঃশব্দে পেছনে দাঁড়ালো। রিদওয়ান ওর দিকে ফিরে বললো-“কাজ করছিলে? এইজন্য ফোন ধরোনি?”
শায়লা মাথা দুলিয়ে সায় দিতেই রিদওয়ান বললো-“তাও ভালো। তোমার শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে দেখে ভালো লাগছে। সারাদিন নিশ্চয়ই খাওয়া দাওয়া গোসল কিছু করোনি। মনে আছে তো আজ আন্টির বাসায় দাওয়াত।”
শায়লা এবার লজ্জা পেলো। এই ছেলে কি করে সব বুঝে যায় তাই ভেপে পায় না। শায়লা বললো-“কিছু খাবেন এখন?”
“নাহ। সকালে বেরিয়েছি, এখন শাওয়ার নিয়ে একটু শোব। তুমি কি একটু বিছানাটা পরিস্কার করে দেবে?”
শায়লা মাথা দুলায়-“এখনই দিচ্ছি।”
শায়লা বিছানা পরিস্কার করতে করতে রিদওয়ান ফিরে এলো। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো-“আমাকে সাড়ে আটটায় ডেকে দিয়। ডাকার আগে অবশ্যই তুমি তৈরি হয়ে নেবে। আমরা সাড়ে আটটায় বেরুব।”
“ঠিক আছে।”
রিদওয়ান পাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেলো। শায়লা কাপড় বাছতে বসলো। কি পরবে ঠিক করতে পারছে না। অনেক বেছে অবশেষে কালো রঙা সালোয়ার কামিজ বের করে শাওয়ারে ঢুকলো। দীর্ঘ সময় নিয়ে যত্ন করে চুলগুলো শ্যাম্পু করলো। গোসল সেরে টের পেলো হাতদুটো টনটন করছে। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে বুঝতে পেরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো শায়লা। আটটার এলার্ম সেট করে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।
“শুনছেন, উঠতে হবে। দাওয়াতে যাবেন না?”
কয়েকবার করে ডেকেও রিদওয়ান এর সারা পাওয়া গেলো না। শায়লা বিরক্ত হয়ে মগে করে পানি এনে ওর ওর মুখে ঢেলে দিলো। রিদওয়ান ভয় পেয়ে চেচিয়ে উঠলো-“কে কে কি হয়েছে?”
শায়লা হাত বুকের উপর আড়াআড়ি ভাবে রেখে অদূরে দাঁড়িয়ে আছে। রিদওয়ান মুখের পানি মুছে দাঁতে দাঁত চেপে শায়লার দিকে তাকালো-“কি সমস্যা? গায়ে পানি ঢাললে কেন?”
শায়লা নির্বিকার চিত্তে বললো-“অনেকক্ষন ধরে ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে গেছিলাম।”
“আশ্চর্য! তাই বলে ঘুমন্ত মানুষটার গায়ে পানি দেবে?”
“সাড়ে আটটা বেজে গেছে। পলি আন্টি অলরেডি একবার ডেকে গেছেন। যেতে চাইলে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিন।”
রিদওয়ান এর মন চাইলে এক বালতি পানি এনে শায়লার গায়ে ঢেলে দিতে। কিন্তু আন্টি ডেকে গেছে শুনে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করলো। উঠে ঝটপট তৈরি হয়ে নিলো।
দরজা খুলে ওদের দেখে খুশি হয়ে গেলেন মানুষটা-“আরে তোমরা চলে আসছো? এতো দেরি করলা কেন?”
রিদওয়ান অপরাধী গলায় বললো-“হাসপাতাল থেকে ফিরে আমি ঘুমিয়ে গেছিলাম আন্টি তাই একটু দেরি হলো।”
পলি আন্টি শায়লার গাল ধরে আদর করে দিলেন-“মিষ্টি মেয়ে, কেমন আছো? তোমাকে তো খুবই সুন্দর লাগছে আজকে।”
শায়লা লাজুক হাসলো। রিদওয়ান ভ্রু কুঁচকে শায়লাকে দেখলো। কালো রঙা সালোয়ার কামিজ ওর পরনে। ফর্সা শায়লাকে তাতে আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে শরীরে চেনা অনুভূতির জন্ম নিতে পারে এই ভয়ে রিদওয়ান ফোঁস করে শ্বাস ফেলে নজর ফিরিয়ে নেয়।
“আঙ্কেল নেই?”
“আছে। তোমরা বসো আমি ডেকে আনছি।”
শায়লা আর রিদওয়ান বসলো। কিছুক্ষণ পরেই পলি ফিরে এলো। তার পেছন পেছন জামাল ভূঁইয়া আর তাদের কন্যা রত্না। রত্না মেয়েটা দেখতে সুশ্রী। শ্যামা গায়ের রং এ মায়া কাড়া চেহারা। চেহারায় বাচ্চা ভাব স্পষ্ট। ওদের দেখে রিদওয়ান উঠে দাঁড়ালো-“আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। রিদওয়ান কেমন আছো?”
“ভালো আছি আঙ্কেল। আপনি কেমন? শরীর খারাপ শুনলাম।”
“ভালোই আছি। মাঝে মাঝে গ্যাসটা জ্বালাতন করে এই যা। তোমার বউ তো ভারী মিষ্টি দেখতে। কি নাম মা তোমার?”
“শায়লা।”
“বাহ খুব সুন্দর নাম। শায়লা ও আমাদের মেয়ে রত্না। এ বছর কলেজে ভর্তি হলো। রত্না ভাবিকে সালাম দাও।”
রত্না সালাম দিয়ে শায়লার পাশে বসলো। ফিসফিস করে বললো-“ভাবি, আপনার ইউটিউব ভিডিও ফলো করি আমি। খুব সুন্দর করে পড়ান আপনি।”
শায়লার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো। এই মেয়ে ওকে চিনে ফেললো? শরম পেলো আবার ভালোও লাগলো। রত্না জানতে চাইলো-“কিন্তু অনেকদিন কোন ভিডিও নেই কেন ভাবি?”
শায়লা কি বলবে ভেবে পেলো না। জামাল ভূঁইয়া বললো-“রত্না মা, ভাবিকে ভেতর ঘরে নিয়ে যাও। গল্প করো ভাবির সাথে।”
রত্না খুশি হয়ে গেলো। শায়লার হাত ধরে টেনে নিলো নিজের রুমে। কিছুক্ষণের মধ্যে বকবক করে শায়লার মাথা ধরিয়ে ফেললো।
রাতে ঘরে ফিরে শায়লা চুপচাপ শুয়ে পড়লো বাতি নিভিয়ে। রিদওয়ানের সাথে একটা কথাও বললো না। রিদওয়ান ও ওকে বিরক্ত করলো না। আধাঘন্টা পরে বাতি জ্বালিয়ে শায়লাকে ডাকলো-“শায়লা, ওঠো। নুডুলস বানিয়েছি তোমার জন্য খেয়ে নাও।”
শায়লা উঠে বসলো, ওর চোখ দুটো টকটকে লাল। রাগত্ব স্বরে বললো-“এতো আদিখ্যেতা করছেন কেন? কি বুঝাতে চাইছেন?”
শায়লার অকারণ রাগের হেতু বুঝলো না রিদওয়ান। গরমে ঘেমে নুডলস বানিয়ে আনলো তাতেও সমস্যা মেয়েটার? বিরক্ত হয়ে জানতে চাইলো-“আবার কি করলাম শায়লা? এরকম ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা না বলে সরাসরি বলো বুঝতে সুবিধা হবে। আর এখানে আদিখ্যেতার কি দেখলে? ওখানে দেখলাম কিছু খাওনি তাই নুডলস বানিয়ে আনলাম৷”
শায়লার রাগ তবুও কমলো না। সে কঠিন গলায় বললো-“এতো খেয়াল রাখবে হবে না আমার। আপনার করুনা চাই না আমি।”
রিদওয়ান এবার রেগে গেলো-“কি হয়েছে বলবে? কেন রাগ দেখাচ্ছ?”
“চাকরি ছাড়ার আগে আপনি এই বাড়িতেই থাকতেন না?”
“হ্যা থাকতাম। তো কি হয়েছে?”
“আপনি রত্নাকে পড়াতেন?”
“ওর এসএসসি পরীক্ষার আগে কিছুদিন দেখিয়েছিলাম। তাতে কি হয়েছে?”
রিদওয়ান বুঝে পেলো না কাউকে টিউশন দিলে রাগার কি আছে। সে বোকার মতো শায়লার মুখপানে তাকিয়ে আছে। রাগে শায়লার নাকের পাটা ফুলে উঠছে ক্ষনে ক্ষনে।
“কচি মেয়ে পেয়েই তো মাথা নষ্ট হয়ে গেছিল। আমার কথা আর মনে ছিলো না, তাই না? তাই তো বলি দুই বছরে একদিনও কেন আমাকে মনে পড়ে না আপনার।”
শায়লার কথা শুনতে শুনতে রিদওয়ানের রাগের বদলে হাসি পেয়ে গেলো। এই মেয়ের মাথা নষ্ট হয়ে গেছে নির্ঘাত। ছোট্ট একটা মেয়েকে হিংসা করছে। রিদওয়ান হা হা করে হাসে। শায়লা থমকায়, চমকায়। ভ্রুকুটি করে রিদওয়ানের দিকে চেয়ে থাকে। রিদওয়ান হাসি নিবারন করে বললো-“হিংসে হচ্ছে কেউ আমাকে পছন্দ করছে দেখে? আচ্ছা, কেউ আমাকে ভালোবাসলেই বা তোমার কি? তোমার তো আমাকে পছন্দ না। হাজারো দোষ আমার। জোর করে বউ করে রেখেছি তোমায়, জোর করে আদর করেছি। তাহলে অন্য কেউ আমাকে…”
শায়লা আচমকা হাত দিয়ে রিদওয়ানের মুখ চেপে ধরলো-“খুব সাহস হয়ে গেছে আপনার, তাই না? একটা কথা পরিস্কার শুনে রাখুন। আমি নাতো তো কেউ না। অন্য কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলে দেখেছেন তো মরেছেন।”
রিদওয়ান দুটো গোল চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে। মুখটা শায়লার হাতের মধ্যে। কথা বলার কোন উপায় নাই। শায়লার রাগান্বিত চোখে চোখ পড়তেই দু’জনের দৃষ্টি স্থির হলো। রিদওয়ানের কৌতূহলি দৃষ্টির সামনে মিইয়ে গেলো শায়লা। হাত সরিয়ে নিয়ে সরে বসে নুডলসের বাটি টেনে নিয়ে খেতে শুরু করলো। রিদওয়ান মুচকি হাসলো। মেয়েটাকে আরেকটু রাগিয়ে দেবে নাকি?
“আঙ্কেল বলছিলো রত্নাকে পড়াতে৷ রত্না নাকি আমার…”
শায়লা নুডলসের বাটি আছাড় মারতে উদ্যত হতেই রিদওয়ান আঁতকে উঠলো-“খবরদার বাটি ভাংবে না। অনেক কষ্টে ঘেমে ঘুমে রান্না করেছি। না খেলে আমাকে দাও।”
রিদওয়ান হাত বাড়াতেই শায়লা বাটি পিছিয়ে নিলো। তা দেখে রিদওয়ান গুনগুন করতে করতে উঠে দাঁড়ালো-“কি কপাল আমার। বউয়ের রান্না খাবো কি বউকে রেঁধে খাওয়াতে হচ্ছে। সাথে রাগও হজম করতে হচ্ছে। কেউ ভালোবাসতে পারবে না আবার বউয়ের সাথে প্রেম ভালোবাসার আলাপও করা যাবে না। কোন জ্বালায় পড়লাম আমি? দাদাজান, দেখো তোমার আদরের নাতির কি অবস্থা। বিবাহিত হয়েও ব্যাচেলরের দিন কাটাচ্ছি। ”
রিদওয়ানের পেছনে শায়লা নুডলস খাচ্ছে আর মিটিমিটি হাসছে।
চলবে—
©Farhana_Yesmin