এরই মাঝে পর্ব-৪৯+৫০

0
114

#এরই_মাঝে
#পর্ব-৪৯

টাঙ্গাইলে আসার মাস পার হচ্ছে। দু’জনার সম্পর্ক সহজ হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে। রিদওয়ানকে এখন বেশ ব্যস্ত থাকতে হয়। হাসপাতালের ডিউটি বাদে বাকি সময় পড়ালেখায় ব্যস্ত থাকে। এখন দেশেই কোন একটা ডিগ্রি নেবে ঠিক করেছে। অন্যদিকে শায়লাও ধীরে ধীরে সেরে উঠছে। ওর হাতের ক্ষত মোটামুটি সেরে গেছে। কাটা জায়গাটা এখন সাদা হয়ে থাকে। খুব বেশি কাজ করলে হাতে চিনচিনে ব্যাথা ছাড়া আর কোন সমস্যা নেই আপাতত। ওর শরীরের ক্ষত সারলেও মনের ক্ষত কতদূর সেরেছে সেটা বোঝা যায় না। কিছুটা পরিবর্তন এসেছে শায়লার আচরণে। সে ইদানীং মন দিয়ে সংসার সাজায়। সারাদিন অনলাইনে বসে এটা সেটা দেখে আর অর্ডার করে। সেদিন ডাইনিং টেবিল আর একটা ডিভান অর্ডার দিয়েছিল। সন্ধ্যায় রিদওয়ান ফিরে দেখলো শায়লা ব্যস্ত হয়ে মিস্ত্রিদের ডিরেকশন দিচ্ছে। জিনিস গুছিয়ে দিয়ে মিস্ত্রি বিদায় হতেই রিদওয়ান অবাক হয়ে জানতে চাইলো-“এসব কি শায়লা?”
শায়লা তুমুল খুশি হয়ে জবাব দিলো-“ডাইনিং টেবিল আর ডিভান। কেমন হয়েছে দেখুন তো? অনলাইনে অর্ডার দিলাম ভাবলাম কেমন না কেমন হবে। এখন দেখছি ভালোই।”
রিদওয়ান কিঞ্চিত উষ্মা প্রকাশ করলো-“আমাকে জানালে না কেন? টাকা তুলে আনিনি তো।”
“টাকা দেওয়া হয়ে গেছে। আপনার চিন্তা করতে হবে না।”
“কে দিয়েছে টাকা?” রিদওয়ান বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইলো। শায়লা ততোধিক বিরক্তি নিয়ে জবাব দিলো-“কেন আমি দিয়েছি। আমাকে কি বেকার নিস্কর্মা মনেহয়? এখনো আমার কাছে পুরো বাড়ি সাজানোর মতো টাকা আছে এটা জানেন?”
শায়লার কথা শুনে রিদওয়ান মজা পেলো-“রিয়েলি? আমাকে কিছু ধার দেবে? পকেট গড়ের মাঠ হয়ে আছে।”
শায়লা ভ্রু কুঁচকে রিদওয়ানের দিকে তাকালো। বুঝতে চাইছে রিদওয়ান ওর সাথে ফান করছে কিনা। রিদওয়ান হাসি হাসি মুখ করে ওকে দেখছে। শায়লা মুখ গম্ভীর করে বললো-“লাগলে অবশ্যই দেব। কত লাগবে বলুন।”
“তুমি কতো দিতে পারবে?”
“আপনার কতো চাই?”
রিদওয়ানের চাহুনি বদলে গেলো। ডিভানে মাথা এলিয়ে দিয়ে মৃদুস্বরে বললো-“যা চাই তাই দেবে?”
শায়লা মাথা দুলিয়ে সায় দিলো। রিদওয়ান ওকে হাতের ইশারায় ডাকলো-“এদিকে এসো।”
নিজে সরে বসার জায়গা ফাঁকা করে বললো-“এখানে বসো।”
শায়লা ইতস্তত করে। দ্বিধায় তার পা জড়িয়ে আসতে চায়। চোখ দুটো অস্থির হয়ে এদিক সেদিক চায়৷ জড়সড় হয়ে রিদওয়ানের পাশে বসতেই রিদওয়ান ওর হাত ধরে বুকের উপর নিয়ে রাখলো-“বুক পকেট রিক্ত নিঃস্ব হয়ে আছে শায়লা। কিছু ভালোবাসা খরচ করে ভরে দেবে বুকটা? অনেকদিন ধরে একা একা থেকে আর পারছিনা বউ। এবার কি রাগটা কমানো যায়?”
হুট করে রিদওয়ানের মুখে এমন আবেগী কথা শুনে শায়লার বুক কাঁপে, হাত পা অসার হয়ে যায়। বারবার ঢোক গিলছে সে। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। রিদওয়ানের আঁকুতি ওর ভেতরটা নাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু নিজের খোলস ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার সাহসও পাচ্ছে না। জড়তা কমলেও কেন যেন আজ অব্দি সহজ হতে পারছে না। তবুও নিজের খোলস ভেঙে রিদওয়ানের কপালে হাত রাখে-“আজ কি হাসপাতালে অনেক চাপ ছিলো? শরীর খারাপ করলো নাকি আপনার?”
শায়লা কথা ঘুরিয়ে নিলো বলে রিদওয়ানের মনে অভিমান জমে। মেয়েটা এখনো রাগ করে আছে? আর কতো? মনটা খারাপ হলো ভীষণ। সে নিজের কপালে থাকা শায়লার হাতের উপর হাত রেখে ক্লান্ত গলায় বললো-“শরীর ঠিক আছে কিন্তু ক্লান্ত হয়ে গেছি। আজ অনেক চাপ ছিলো।”
“আচ্ছা আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন আমি খাবার বাড়ছি ততক্ষণে।”
রিদওয়ান কথা না বাড়িয়ে উঠে গেলো। শায়লা এই সুযোগ খাবার বেড়ে নিলো। অপেক্ষা করছিল রিদওয়ানের কিন্তু অনেক সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন এলো না শায়লা ওকে ডাকতে এসে দেখলো রিদওয়ান শুয়ে আছে। কি মনে করে ডাকতে যেয়েও ডাকে না রিদওয়ানকে। মন খারাপ হলো ওর। আজ প্রথমবারের মতো নিজের হাতে খাবার রেঁধেছিল ও রিদওয়ানকে সারপ্রাইজ দেবে বলে। অথচ রিদওয়ান সারপ্রাইজ দেখলোই না। শায়লা খাবার ঢাকা দিয়ে পাশের রুমে এসে বসলো। কাল একটা ভিডিও করেছিল ওটা এডিটিং করে আপলোড দিলো। আগের ভিডিওর ম্যাসেজ সেকশন চেক করলো। কাজ শেষ করে সব গুছিয়ে ঘড়ি দেখলো। দু’ঘন্টা পার হয়েছে, এখনো কি রিদওয়ান ঘুমাচ্ছে? ভ্রু কুঁচকে শোবার ঘরে উঁকি দিলো ও। আলো জ্বালিয়ে দেখলো রিদওয়ান গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। এই ভ্যাপসা গরমে এভাবে গুটিয়ে শুয়ে থাকার মানে কি? শায়লা ভাবলো রিদওয়ানকে ডাকবে৷ রাত হয়ে গেছে কিছু খেতে হবে তো। শায়লা কয়েকবার ডাকার পর রিদওয়ান বললো-“খাবো না। ভীষণ ঠান্ডা লাগছে আমার। কাঁথা দাও তো গায়ে। আর ফ্যানটা বন্ধ করো তাড়াতাড়ি।”
শায়লা বিস্মিত হলো। তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এসে রিদওয়ানের কপালে হাত রাখলো। ভীষণ জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তার। উত্তাপ সইতে না পেরে হাত সরিয়ে নিলো দ্রুত। কাঁথা বের করে গায়ে দিয়ে জলপটি এনে কপালে দিলো। রিদওয়ান শিউরে উঠলো ঠান্ডা পানির উত্তাপে। কিছুক্ষণ জলপটি দেওয়ার পর কপালের উত্তাপ কমে এলে রিদওয়ানকে ডাকলো শায়লা-“শুনছেন, কিছু খাবেন ওষুধ খেতে হবে তো।”
রিদওয়ান সারা দিলো-“খাবো। আনো কিছু। সাথে জ্বরের ওষুধ।”
শায়লা খুশি হয়ে গেলো। তাড়াহুড়ো করে অল্প খিচুড়ি বেড়ে আনলো প্লেটে। দুই চামচ মুখে দিলো রিদওয়ান তারপর বললো-“ভালো লাগছে না খেতে খাবো না আর। ওষুধটা দাও খাই। শরীর ভীষণ ব্যাথা করছে।”
শায়লা কথা না বাড়িয়ে ওষুধ দিলো। ওষুধ খেয়ে রিদওয়ান আবার কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে গেলো। শায়লা প্লেটের খিচুড়িটা জোর করে খেলো। বাকি খাবার ফ্রিজে তুলে রাখলো। কেন যেন ভালো লাগছে না কিছু। ফাঁকা ফাঁকা লাগছে সব। অন্যদিন এইসময়টুকু টুকটাক গল্প হয় রিদওয়ানের সাথে। মাঝে মাঝে ঝগড়া খুনসুটি সময় কিভাবে যায় টের পায় না। আজ রিদওয়ান অসুস্থ বলে সব যেন থমকে গেছে। শায়লা কাজ শেষ করে রুমে এলো। রিদওয়ানের পাশে বসলো। অস্ফুটে বিরবির করছে রিদওয়ান। শায়লা মুখের কাছে কান এগিয়ে দিয়ে তা শোনার চেষ্টা করলো। রিদওয়ান কাকে যেন বলছে-“আর পারছি না শায়লা। এতো কাছে থাকার পরও তোমাকে ধরা যায় না ছোঁয়া যায় না। নিজেকে সামলে নিতে অনেক কষ্ট হয় শায়লা। কবে তুমি ঠিক হবে বলো তো? ম্যাডাম সময় দিতে বলেছে তোমাকে, তুমি যাতে নিজ থেকে কাছে আসো সেই পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরতে বলেছে। কিন্তু এখন আমার সত্যি কষ্ট হয় শায়লা। তোমার সাথে বিয়ের চার বছর চলছে। না আমরা কোন বিবাহবার্ষিকী পালন করলাম না আমার জন্মদিন না তোমার। আমাদের কোন বিশেষ দিন হয়নি, কোন বিশেষ স্মৃতি জমাইনি। এভাবে কি চলে বলো তো? কবে ভালোবাসবে তুমি আমাকে? আর কতো অপেক্ষা করবো?”
শুনতে শুনতে শায়লার বুক ধরফর করে। হাতের তালু ঘামে, গাল লাল হয় অকারণে। রিদওয়ানের জ্বরাগ্রস্থ মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মায়া লাগে শায়লার। আজ পর্যন্ত রিদওয়ানকে অসুস্থ দেখেনি কখনো। সবসময় শক্ত হয়ে ওকে আগলে রেখেছে। আজ একদমই অসহায় দেখাচ্ছে ওকে। শায়লা মায়াভরা মন নিয়ে রিদওয়ানের কপালে হাত ঠেকায়। জ্বরের তাপ কমেনি বিন্দুমাত্র। মনেহচ্ছে ওষুধে কাজ হয়নি। মায়ের কথা মনে পড়ে তার। মা বলতো জ্বর মাথায় উঠতে দেওয়া যাবে না। বেশিক্ষণ জ্বর নিয়ে বসে থাকতে নেই। ওষুধে না কমলে জলপটি আর গা স্পঞ্জ করতে হবে লাগাতার। কি মনে করে শায়লা বালতিতে করে পানি নিয়ে এলো দ্রুত। রিদওয়ানের গা থেকে গেঞ্জি খুলতে যেয়ে থমকে গেলো কিছু সময়ের জন্য। পরক্ষণেই দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে অনেক কষ্টে রিদওয়ানকে উঠিয়ে বসিয়ে গেঞ্জি খুলে ফেলে আবার শুইয়ে দিলো। রিদওয়ান গুঙিয়ে উঠলো-“কি করছো শায়লা? আমার শীত করছে তো?”
“শুনছেন জ্বর কপাতে হবে আপনার এইজন্য গা মুছিয়ে দেব। একটু শীত লাগলেও সহ্য করে নেবেন।”
বলেই শায়লা জলে ভেজানো তোয়ালে রিদওয়ানের বুক মুছতে লাগলো। চেচিয়ে উঠলো রিদওয়ান-“শায়লা, মেরে ফেলবে আমাকে? আমার প্রতি এতো রাগ? এতো কষ্ট দিয়েছি তোমাকে?”
রিদওয়ান আবোলতাবোল বলছেই। সামনের দিকটা মুছিয়ে ওকে কাত করে দিয়ে পিঠ মুছলো। রিদওয়ান বকবক করেই যাচ্ছে-“এভাবে কষ্ট না দিয়ে মেরে ফেলো আমাকে। সহ্য হচ্ছে না আর। শায়লা এই শায়লা, কথা বলছো না কেন?”
“চুপ করুন।”
“না চুপ করবো না। কি করবে তুমি? আবার মরতে যাবে? যাও। পারো তো শুধু আমাকে কষ্ট দিতে। না না শুধু আমাকে না গোটা পরিবারটাকেই কষ্ট দাও। তুমি খুব খারাপ একটা মেয়ে। মনে মায়াদয়ার লেশমাত্র নেই। না হলে জামাইতে এতো কষ্ট কেউ দেয়?”
রিদওয়ান চিত হয়ে শুয়ে বকবক করছে তো করছেই। শায়লা ওর মাথায় পট্টি দিতে চাইছে কিন্তু ও কিছুতেই নেবে না। শায়লা শাসাল-“এরকম করলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।”
রিদওয়ান ঠোঁট ওল্টায়-“কি আর এমন খারাপ হবে? তুমি যা করছো তার চাইতে খারাপ আর কিছু হয়? কষ্ট দিতে দিতে মেরে ফেলতেই বাকি আছে। ওইটুকু আজ পরিপূর্ণ করে আসো।”
শায়লার আর সহ্য হলো না। রিদওয়ানের মুখ বন্ধ করতে তাই নিজে উদ্যেগ নিয়ে ওর দিকে ঝুঁকে এসে আচমকা ঠোঁট আঁকড়ে ধরলো শায়লা। একের পর এক রীতিমতো আগ্রাসী চুম্বনে রিদওয়ানের নাজেহাল অবস্থা। তার চোখ দুটো দেখে মনেহচ্ছে কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে যে কোন সময়। এতোটা আশ্চর্য মনেহয় ও ওর জীবনে হয়নি।

চলবে—

#এরই_মাঝে
#পর্ব-৫০

রিদওয়ান ছটফটিয়ে জড়িয়ে ধরতে যাবে তখনই শায়লা আচমকা ওকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে গেলো। জ্বরে তপ্ত রিদওয়ান ঘোলাটে নয়নে অস্থির চাহুনি দিয়ে তাকায়-“কি হলো?”
“চুপচাপ মাথা ঝুলিয়ে শুয়ে পড়ুন। জ্বরে গা পুড়ছে আপনার মাথায় পানি দেব।”
শায়লা হাঁপাতে হাঁপাতে জবাব দিলো। এখনো বুকটা ধড়ফড় করছে তার। ঠোঁট দুটো টকটকে লাল। হাত পা কাঁপা কাপি করলেও নিজেকে সামলে নিতে বদ্ধ পরিকর। রিদওয়ান ওর দিকে তাকিয়ে অবুঝের মতো মাথা নাড়ে-“উহু, আগে কাছে এসো। তোমাকে চাই আমার। এভাবে উস্কে দিয়ে সরে পড়লে মেনে নেব না।”
শায়লা ওষ্ঠ কামড়ে ধরলো। নাছোরবান্দা রিদওয়ানকে দেখলো মন দিয়ে। ছেলেটা জ্বরে টালমাটাল। কালো লোম আবৃত ফর্সা বুকের ওঠানামা বলে দিচ্ছে ওর উচাটন হৃদয়ের হাল। শায়লা ঢোক গিললো। রিদওয়ান তুমুল ভাবে আকর্ষন করছে ওকে কিন্তু অসুস্থ মানুষটার কাছাকাছি যাওয়া অনুচিত হবে। শায়লা মৃদুস্বরে ধমক দিলো-“কথা না শুনলে কিন্তু আর কখনোই কাছে যাব না। অসুস্থ আপনি। আগে সুস্থ হয়ে নিন তারপর সব হবে।”
রিদওয়ানের চেহারার মরিয়া ভাব কিছুটা কমে আসলো। সে ঘোর লাগা স্বরে বললো-“সত্যি তো? আমি সুস্থ হয়ে গেলে তুমি নিজ থেকে আমার কাছে আসবে?”
শায়লাকে কিছু সময়ের জন্য দ্বিধান্বিত দেখায়। মনের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে। তবুও মাথা নেড়ে বললো-“সত্যি। এবার শুয়ে পড়ুন প্লিজ।”
রিদওয়ান বাধ্য ছেলের মতো শুয়ে পড়লো। শায়লা এগিয়ে এসে ওর মাথার নিচে পলিথিন দিয়ে জলের বালতি এগিয়ে আনলো। মগ ভরে পানি নিয়ে ধীরে ধীরে মাথায় পানি ঢালতে শুরু করলো। মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে মোলায়েম ভাবে। শুরুতে শীত লাগলেও আরামে চোখ বুজে এলো রিদওয়ানের। সে মাথায় থাকা শায়লার হাতের উপর হাত রেখে বিরবির করলো-“আরাম লাগছে শায়লা।”
“এভাবেই থাকুন। কিছুক্ষণ পানি ঢাললে জ্বর কমে যাবে।”
“গায়ের উত্তাপ না হয় কমবে কিন্তু মনের উত্তাপ কমাই কি দিয়ে শায়লা? আমার ভালোবাসা বোঝার ক্ষমতা কবে হবে তোমার?”
ক্ষনিকের জন্য শায়লার হাত থামে। মৃদুস্বরে বললো-“ঘুমিয়ে পড়ুন। কথা বলবেন না আর।”
রিদওয়ান চুপ করে গেলো। চোখ বুঁজে পড়ে থাকতে থাকতে কিছুক্ষণ পরই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো সে। টানা পনের বিশ মিনিট রিদওয়ানের মাথায় পানি ঢালে শায়লা। জ্বরের প্রকোপ কমে আসতেই তোয়ালে দিয়ে চুলগুলো মুছে দিলো আলতো হাতে। রিদওয়ান গভীর ঘুমে আছে বলে ডাকলো না আর। অনেক কসরত করে বালিশ দিলো মাথার নিচে। ওর মাথার কাছেই চেয়ার টেনে বসে রইলো। বসে থেকেই একসময় ঘুমিয়ে গেলো।

খুব ভোরে কলিংবেলের আওয়াজে ঘুম ভাঙলো শায়লার। এতো সকালে কে এলো এই চিন্তায় লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। রিদওয়ান তখনও ঘুমে বিভোর। চট করে ওর কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখলো। তাপমাত্রা কমেনি দেখা যাচ্ছে। ডাক্তার মানুষের জ্বর হলে কি ডাক্তার ডাকতে হয়? শায়লা ভেবে পেলো না কি করবে। ওদিকে কলিংবেল বেজে যাচ্ছে সমানতালে। শায়লা গায়ের কাপড় ঠিক করে ছুটে এসে দরজা খুলে চমকে গেলো। সামনে ওয়াহেদ আর জাকিয়া দাঁড়িয়ে আছে। শায়লা থতমত খেয়ে বললো-“আপনারা?”
ওয়াহেদ বিচলিত হয়ে জবাব দিলো-“রাতে তুমি বললে রিদুর জ্বর এসেছে তাই চলে এলাম৷ তুমি একা মানুষ ওকে নিয়ে কি করবে ভেবে চিন্তা হচ্ছিল। আর তোমার শাশুড়ী মা তো ছেলের অসুস্থতার কথা শুনে মাথা নষ্ট করে দিয়েছে আমার। এখন কেমন আছে রিদু?”
জাকিয়া এতো ভদ্রতার ধার ধারলো না। সোজা ঘরে ঢুকে গেলো। এঘর ওঘর উঁকি দিয়ে রিদওয়ানকে পেতেই হামলে পড়লো-“রিদু, কেমন আছিস বাবা? মা চলে এসেছে দেখ। রিদু শুনছিস? চোখ মেলে তাকা আব্বু।”
শায়লা আর ওয়াহেদ দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। জাকিয়া রিদওয়ানের কপালে গালে গলায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ওয়াহেদকে দেখা মাত্র অভিযোগ করলো-“ওর গা পুড়ছে জ্বরে। কি করবো?”
ওয়াহেদ শায়লাকে দেখলো একনজর তারপর শান্ত গলায় জবাব দিলো-“জ্বরের ওষুধ দেওয়া ছাড়া আপাতত কিছু করার নেই। ভাইরাল ফিভার হলে তিনদিন থাকবে। তিনদিনের বেশি হলে তখন দেখা যাবে। শায়লা মামনি, খাবার আছে কোন? ওকে ডেকে তুলে কিছু খাইয়ে ওষুধ দিয়ে দাও।”
শায়লা মাথা নেড়ে রান্নাঘরে গেলো। ফ্রিজে ফ্রোজেন পড়োটা আছে সেটা বের করে ভেজে নিলো। ডিম পোজ করলো কয়েকটা। একটা পড়োটা আর ডিমপোজ নিয়ে রিদওয়ানের ঘরে গেলো। তাকিয়ে দেখলো রিদওয়ান উঠে বসেছে ততক্ষণে। বাবা মায়ের সাথে হালকা পাতলা আলাপ করছে। জাকিয়া শায়লার হাত থেকে প্লেট নিয়ে নিলো-“দাও আমাকে। ওকে খাইয়ে দিচ্ছি। তুমি ওষুধটা নিয়ে এসো।”
শায়লা ঘাড় কাত করে মেনে নিলো। ওষুধের বক্স থেকে দুটো জ্বরের ওষুধ বের করে সামনে এসে দাঁড়ায়। রিদওয়ানের সাথে চোখাচোখি হলো। রিদওয়ান হাত বাড়িয়ে ওষুধ নিলো। পানি দিয়ে ওষুধ গিলে নিয়ে আবার শুয়ে পড়লো। জাকিয়া হইহই করে উঠলো-“আরে না খেয়ে শুয়ে পড়লি যে? রিদু অল্প করে খেয়ে নে বাবা।”
“ভালো লাগছে না মা। ডিম খেয়েছি ওতেই হবে।”
জাকিয়া ফোঁস করে উঠে শায়লাকে ডাকলো-“এই মেয়ে ওর জন্য একটু স্যুপ অথবা জাও ভাত বানাও। জ্বরের মধ্যে এসব পরোটা খেয়ে আরও শরীর খারাপ হবে।”
ধমক খেয়ে শায়লার মুখটা ছোট হয়ে গেলো। সে কথা না বাড়িয়ে মাথা দুলিয়ে চলে এলো রান্নাঘরে। ওয়াহেদ জাকিয়াকে ধমক দিলো-“এই মেয়ে মানে কি জাকিয়া? ওর একটা নাম আছে। তাছাড়া ওকে এভাবে হুকুম দিচ্ছ কেন? ও নিজেও অসুস্থ সেটা ভুলে গেছ?”
জাকিয়া ঠোঁট ওল্টায়-“অসুস্থ না ছাই। ওর জন্য করতে করতে রিদুর আজ এই অবস্থা। আমার আদরের ছেলেটা যেদিন থেকে এই বিয়ে করেছে সেদিন থেকে ওর জীবন থেকে সুখশান্তি গেছে।”
রিদওয়ান চুপচাপ মায়ের কথা শুনছিল। থাকতে না পেরে ধমকে উঠলো-“মা চুপ করবে তুমি? কি শুরু করেছ?”
ওয়াহেদ বললো-“রিদু ঘুমাচ্ছে ওকে ঘুমাতে দাও। এসো আমরা হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা করি।”
জাকিয়া মানা করতে যেয়ে করলো না। ওয়াহেদের দৃষ্টি কঠোর তাই ঝামেলা না করে উঠে এলো। ওয়াহেদ ডাকলো-“শায়লা মামনী, আমরা একটু ফ্রেশ হবো।”
শায়লা এগিয়ে এলো-“এই ঘরে যান আঙ্কেল। রুমের সাথে লাগোয়া ওয়াশরুম আছে। আপনাদের ব্যাগপত্তর ওখানেই রেখেছি। হাতমুখ ধুয়ে আসুন নাস্তা রেডি আছে।”
ওয়াহেদ হেসে সায় দিলো। রুমে ঢুকে বেশ চমকিত হলো দু’জনেই। একটা মাঝারি সাইজের কাঠের খাট, টেবিল আর আলমারি আছে এই রুমে। বড় কামরাটা সল্প আসবাবে বেশ খোলামেলা দেখাচ্ছে। জাকিয়া নিজের কাপড় নিয়ে ওয়াশরুম ঢুকলে ওয়াহেদ ঘুরে ঘুরে দেখলো রুমটা। বারান্দায় গেলো। অনেকদিন ঢাকার মধ্যে থেকে এই পরিবেশ যেন স্বর্গ লাগছে। ওয়াহেদের মন ভালো হয়ে গেলো। জাকিয়া বেরুতেই বললো-“বাসাটা বেশ সুন্দর কি বলো?”
“হুমম। কিন্তু ওরা এতোসব কবে করলো? তুমি টাকা দিয়েছ?”
ওয়াহেদ জাকিয়াকে দেখে হেসে দিলো-“পাগল! ওদের দু’জনকে এখনো চেননি তুমি? নিজেদের টাকায় করেছে নির্ঘাত।”
“কিন্তু এসব করার কি দরকার ছিলো? ক’দিন পরে চেষ্টা করে ঢাকায় ট্রান্সফার নিলেই হতো। শুধু শুধু টাকার অপচয়।”
জাকিয়া কে কিছু বলা অর্থহীন ভেবে ওয়াহেদ কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পরে নাস্তা পর্ব শেষ করে চায়ে চুমুক দিতে দিতে শায়লাকে ডাকলো-“রান্নাঘরে কি করছো তুমি? নাস্তা করেছ? কাজের জন্য কোন হেপ্পিং হ্যান্ড রাখোনি?”
“হেল্পিং হ্যান্ড আছে আঙ্কেল। আর কিছুক্ষণ পরেই আসবে। ওনার জন্য খানিকটা জাও ভাত করছি। ওটা হয়ে গেলে নাস্তা করবো।”
“তোমার শরীর সুস্থ এখন?”
“হ্যা।”
“তোমাদের বাসাটা বেশ সুন্দর খোলামেলা আছে।”
“জ্বি আঙ্কেল।”
ওয়াহেদ কিছুটা গম্ভীর মুখভঙ্গিতে বললো-“এখনো আঙ্কেল? কবে বাবা ডাকবে শায়লা?”
শায়লার মুখ শুকিয়ে গেলো। শুকনো গলায় বললো-“এই ডাকটাতে আমার এলার্জি আছে আঙ্কেল। চাইলেও ডাকতে পারবো না। তাছাড়া ডাকে কি আসে যায়। আপনাকে আমি মন থেকে শ্রদ্ধা করি। দাদাজানের পরে কাউকে আপন ভাবলে সে আপনি। আমার ডাক নিয়ে কষ্ট পাবেন না প্লিজ।”
ওয়াহেদ দীর্ঘ শ্বাস ফেললো-“ঠিক আছে তোমার যা ভালো লাগে তাই ডেকো।”
“আপনি একটু রেস্ট নিন আঙ্কেল। ভোর সকালে জার্নি করে এসেছেন।”
ওয়াহেদের হঠাৎ মনে পড়লো ড্রাইভারের কথা। নিজেদের গাড়ি নিয়ে এসেছেন ড্রাইভারকে ভুলে গেলেন কি করে?
“শায়লা হারুনকে সাথে নিয়ে এসেছি। ওর কথা তো ভুলেই গেছিলাম।”
“ওনাকে নাস্তা দিয়েছি আঙ্কেল। আমাদের বাসার দারোয়ান ভাইয়ের ওখানে আছে আপাতত।”
ওয়াহেদ খুশি হলো। মেয়েটাকে যতটা বোকা দেখায় ততটা না। জ্ঞান বুদ্ধি আছে যথেষ্ট। ওয়াহেদ তৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে গেলো। শায়লা একবার ও ঘরে উঁকি দিলো। জাকিয়া শুয়ে আছে রিদওয়ানের পাশে। রিদওয়ান পাশ ফিরে ঘুমিয়ে আছে। শায়লার একবার ইচ্ছে হলো রিদওয়ান কপাল ছুঁয়ে দিতে কিন্তু জাকিয়া থাকায় সেটা সম্ভব না। শায়লা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ডাইনিং এ এসে বসলো। খেতে ইচ্ছে করছে না তবুও জোর করে একটা পরোটা আর ডিম খেলো। চা গরম করে নিয়ে বসলো ডিভানে। আনমনা হয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই দরজায় আওয়াজ। কাজের মেয়ে কমলা এসেছে। তাকে রান্নার কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আবারও ডিভানে বসলো। জাকিয়াকে নিয়ে ভাবছে। সে কি ওই ঘরেই থাকবে? ভাবনাটা মাথায় আসতেই অসস্তিতে মন ছেয়ে গেলো।

“এই মেয়ে তুমি এখানে শুয়ে আছো কেন?”
আচমকা শরীরে ধাক্কা পেয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো শায়লা। সামনে রিদওয়ানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হতবিহ্বল হলো-“আপনি উঠে এলেন কেন? কি হয়েছে? জ্বর এসেছে আবার?”
রিদওয়ান মাথা নাড়ে-“উহু, জ্বর ছেড়েছে। খিদে লেগেছে, কিছু আছে খাওয়ার মতো?”
শায়লা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে জবাব দিলো-“বসুন এখানে। আপনার জন্য জাও ভাত রান্না করেছি খাবেন।”
শায়লা এক বাটি জাও ভাত এনে রাখলো-“এই নিন। একটু মরিচ কেটে দিয়েছি। ঝাল ঝাল লাগবে খেতে।”
রিদওয়ান বাটি হাতে নিতে নিতে আবারও জানতে চাইলো-“এখানে শুয়ে ছিলে কেন?”
“এমনিতেই।” শায়লা কথা বাড়াতে চাইলো না।
রিদওয়ান জাও মুখে দিয়ে মুখ কোঁচকায়। শায়লা তাকিয়ে দেখলো কিন্তু কিছু বললো না। রিদওয়ান আরও দুই তিন চামচ জাও জোর করে খেয়ে বাটি রেখে দিলো-“ভালো লাগছে না আর। দেখো তো আবার জ্বর আসছে কিনা?”
শায়লা রিদওয়ানের কপালে হাত দিলো। কপাল বেশ গরম হয়ে আছে। হাত সরিয়ে আনবে এমন সময় রিদওয়ান ওর হাতের উপর হাত রাখলো। ম্লান গলায় বললো-“তোমার হাত ঠান্ডা বলে আরাম লাগছে।”
বলেই ওর হাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে উল্টো পিঠে ঠোঁট ছোঁয়াল রিদওয়ান। শায়লার গাল লাল হলো, বুঝলো জ্বর দেখাটা অজুহাত মাত্র। সে লজ্জা পেয়ে হাত টেনে নিয়ে বললো-“গোসল করে নিন৷”
রিদওয়ান শায়লার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো-“তুমি কি জানো তোমার লাজুক রুপ রাগী শায়লার চাইতে সুন্দর? এতোদিন লজ্জা পাওনি কেন মেয়ে? তাহলে তোমার এই লাজুক রুপটা মিস করতাম না।”
“এতোদিন তো আপনি ছিলেন না কাছে।”
বলে নিজেই চমকে গেলো শায়লা। কি বলে ফেললো এটা?

চলবে—
©Farhana_Yesmin