এলো প্রেমের মৌসুম পর্ব-১০

0
5

#এলো_প্রেমের_মৌসুম
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ১০

আজকে অয়নের জন্যে নিজেই সিঙ্গারা বানিয়েছে আনিশা, যদিও প্রথমবার একা বানাতে গিয়ে কিছু ঝামেলা পোহাতে হয়েছে তবে শেষমেশ বানাতে পেরেছে। অন্যান্য দিনের মতো আজও আনিশাই নাস্তা এনে দিলো অয়নকে, এর আগে যখন মেয়েটাকে পড়িয়েছে তখন অনেক অলস ছিলো কিন্তু এখন ওকে এত কাজ করতে দেখে অয়ন নিজেই অবাক হয়েছে।

‘ তুমি দেখছি এখন বেশ কাজের হয়ে গেছো, আগে তো আন্টি হাজার বললেও এক জায়গা থেকে উঠতেই চাইতে না ‘

‘ তখন ছোটো ছিলাম, এখন তো একটু বড় হয়েছি। ভাবী কাজ করা শেখাচ্ছে তাই অলসতা অনেকটা কেটে গেছে ‘

‘ ওয়াও! মেঘনার সাথে তোমার সম্পর্ক বেশ ভালো মনে হচ্ছে ‘

‘ ভীষণ! উই আর ফ্রেন্ডস। ভাবী আমাকে অনেক সাহায্য করে ‘

‘ গুড, ননদ ভাবী মিলেমিশে থাকাটাই উচিত ‘

অয়ন একটা সিঙ্গারা তুলে মুখে দিলো, আনিশা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে কেমন হয়েছে তা শোনার জন্যে…

‘ কেমন হয়েছে ভাইয়া?’

‘ উম্ম, গুড! অনেক মজা হয়েছে ‘

‘ সত্যিই? থ্যাংক ইউ! আচ্ছা আপনার কি কি খেতে ভালো লাগে?’

‘ তুমি কি আমার পছন্দ অপছন্দ জানার চেষ্টা করছো?’

‘ ত.. তেমন কিছুনা ‘

‘ তাহলে? এসব আলোচনা করে সময় নষ্ট করার দরকার নেই। পড়ায় মন দাও, তোমার কিন্তু সামনেই টেস্ট এক্সাম শুরু হবে ‘

অয়নের কথা শুনে আনিশা আর কথা বাড়ালো না তবে অয়নের কাছে খাবারের প্রশংসা শুনে বেশ খুশী হয়েছে মেয়েটা। অয়ন পড়িয়ে যাওয়ার পর আনিশা দুটো সিঙ্গারা নিয়ে মেঘের ঘরে আসে, মেঘ একটু আগেই কোচিং সেন্টার থেকে ফিরেছে।

‘ ভাবী, দেখো আমি আজ একাই সিঙ্গারা বানিয়েছি। কেমন হয়েছে খেয়ে দেখো’

মেঘ হাসিমুখে একটা সিঙ্গারা হাতে তুললো, কিন্তু এক কামড় খেতেই বুঝলো কিছু জিনিস গরমিল হয়ে গেছে..

‘ লবণ আর মরিচের গুঁড়া অনেকটা বেশি হয়ে গেছে!’

মেঘের কথা শুনে আনিশা হতবিহ্বল হয়ে গেলো, কারণ ও বানানোর পর জিনিসটা খেয়ে দেখেনি। এবার একটা একটু খেয়ে দেখলো সত্যিই কিছু জিনিস বেশি হয়ে গেছে..

‘ এমন হলো কেনো! আমি তো তোমার রেসিপি ফলো করেছিলাম ‘

‘ সেদিন তো আমি একটু বেশি করে বানিয়েছিলাম কিন্তু তুমি অল্প বানিয়েছো, অল্প বানালে জিনিসের পরিমাণও তো অল্প দিতে হবে তাইনা?’

‘আল্লাহ! আমার তো এ কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিলো। আমি টেস্ট না করে দেখেই অয়ন ভাইয়াকে খাইয়েছি, কিন্তু উনি তো কিছু বললেন না ‘

‘ অয়নের জন্যে বানিয়েছিলে?’

‘ হুমম! ইশ, ভাইয়া আমার মন রাখার জন্যে অভিযোগ না করেই খেয়ে নিয়েছেন। ধুর, ভালো করতে গিয়ে আমি উল্টো ঝামেলা করে ফেললাম। এবার উনি কি ভাববেন আমার সম্পর্কে? সামান্য একটা সিঙ্গারা ঠিকমতো বানাতে পারিনা ‘

অয়ন যে শুধু ওর মন রাখার জন্যেই এগুলো খেয়েছে তা উপলব্ধি করে মন খারাপ হয়ে গেলো আনিশার, মেঘ আনিশার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো…

‘ ইটস ওকে! প্রথম প্রথম একটু ভুল হবেই, কয়েকবার বানালেই অভ্যাস হয়ে যাবে। মন খারাপ করার কিছু নেই ‘

‘ আচ্ছা ভাবী, এটা তো ভালো হয়নি। তারপরও অয়ন ভাইয়া কিছু বললো না কেনো?’

‘ উম্ম! তোমার মন খারাপ হবে ভেবে হয়তো কিছু বলেনি ‘

‘ ওহ! ধুর! কি ভাবলাম আর কি হলো, আমি আর কিছু বানাতেই যাবো না ‘

আনিশার এতো ফ্রাস্ট্রেশন দেখে মেঘের আর বুঝতে বাকি নেই যে তার ননদের পছন্দের মানুষটা আসলে অয়ন! তবুও কৌতুহল বশত মেঘ প্রশ্ন করলো…

‘আনিশা, মনে হচ্ছে অয়নের প্রতি তুমি ইদানিং একটু বেশিই সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছো। ব্যাপারটা কি?’

‘ কিছুই না ভাবী, উনি ভাইয়ার পুরোনো বন্ধু আবার আমার অনুরোধে পড়াতে এসেছেন। তার একটু বিশেষ খাতির করা তো দরকার তাইনা?’

‘ অয়নকে নাস্তা দেওয়ার জন্যে তোমাকে এতো ভাবতে হবেনা আনিশা, ও আমিই দিয়ে দেবো ‘

‘ না ভাবী! ওনার জন্যে নাস্তা আমি বানাবো ‘

‘ ওহহও! এত্তো পজেসিভ? যার জন্যে এসব করছো সে জানে এসব?’

মেঘের কথা শুনে আনিশার ফর্সা গাল দুটো লজ্জায় লাল হয়ে গেলো, ভাবী যে বিষয়টা বুঝে গেছে তা আর আনিশার বুঝতে বাকি নেই। তবুও লুকানোর বৃথা চেষ্টা করলো…

‘ নাহ ভাবী! তুমি ভুল বুঝছো ‘

‘ থাক, আর লজ্জা পেতে হবেনা। আমার যা বোঝার বুঝে গেছি ‘

আনিশা বুঝেছে যে ও ধরা খেয়ে গেছে, বুঝলো এখন আর লুকিয়ে লাভ নেই! সন্ধ্যার একটু পর আরিশ এসে মেঘকে তৈরি হতে বলে…

‘কোথায় যাবো এখন?’

‘ বাবা তোমাকে বাইরে থেকে ঘুরে আসতে বলেছে! চলো, তুমিও এই সুযোগে শপিং করে নেবে ‘

‘কিন্তু আমার তো কিছু লাগবে না ‘

‘ বাবা যেহেতু বলেছে, তাই আমাদের যেতে হবে। ইচ্ছে না হলেও টুকটাক কিছু কিনে নিও। মেয়েরা তো আবার শপিংয়ের সুযোগ পেলে হাতছাড়া করতে চায়না ‘

‘ বাব্বাহ! মেয়েদের সম্পর্কে ভালোই জানো দেখছি। এতোদিনে নিশ্চয়ই ৪-৫ টা প্রেম করে ছ্যাঁ’কা খাওয়া হয়ে গেছে তোমার তাইনা?’

‘ কিসের ছ্যাঁ’কা? লিসেন, আমি পিওর সিঙ্গেল। মেয়েদের নিয়ে পাস করার মতো অযথা সময় আমার নেই’

‘ হ্যা, সেই! তোমার বন্ধুবান্ধব আর কম্পিউটার গেমের পেছনে যে সময় দাও তাতে প্রেম করার সময় আর পাবে কই? মেয়েদের সময় না দিলে তারা এমনিতেই ছেড়ে চলে যাবে ‘

‘ ওহ রিয়েলি? আমি যদি তোমায় সময় না দেই তাহলে তুমিও কি চলে যাবে?’

‘ আমার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতিতে কি আদৌ তোমার কিছু যায় আসবে?’

আরিশ ভেবেছিলো কায়দা করে মেঘের পেট থেকে কথা বের করবে, মেঘের মনে ওর জন্যে অনুভূতি আছে কিনা সেটা জানার চেষ্টা করবে। কিন্তু মেঘের প্রশ্ন শুনে উল্টে নিজেই চুপ করে গেলো আরিশ, কারণ মেঘের প্রশ্নের উত্তর ওর কাছে এই মুহূর্তে নেই।

‘ জানতাম, তুমি উত্তর দিতে পারবে না ‘

‘ ফাইন! আমি পারলাম না, কিন্তু তুমি তো আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারো ‘

‘ তুমি যেদিন আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে সেদিন আমিও তোমার প্রশ্নের উত্তর দেবো ‘

মেঘ রেডি হওয়ার উদ্দেশ্যে কোন ড্রেস পড়বে সেটা খুঁজছিলো, কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আরিশ ওকে দেখতে দেখতে গভীর ভাবনায় মশগুল হয়ে পড়লো। নিজের প্রশ্নের উত্তর পেতে চাইলে মেঘের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে? কিন্তু মেঘের করা প্রশ্নের কি উত্তর দেওয়া উচিত? ওর উপস্থিতিতে কি পরিবর্তন হয়েছে আর ওর অনুপস্থিতিতে কি হবে তা আরিশের জানা নেই। হয়তো কখনো এই বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখেনি। আরিশ ভাবলো আদৌ কি মেয়েটার উপস্থিতি আমার জীবনে বিশেষ কোনো প্রভাব ফেলেছে? সেদিন ওরা দুজনে বাইরে ডিনার করলো, মোটামুটি ভালো একটা সময়ই কাটিয়েছে বলা যায় কিন্তু যে আরিশ সুযোগ পেলেই মেঘকে টিজ করতে শুরু করে সেই ছেলেটা সেদিন চুপচাপ ছিলো। যেনো কিছু নিয়ে গভীর ভাবনায় মত্ত ছিলো। মেঘ জানতেই পারলো না যে আরিশের মস্তিষ্কে ওকে ঘিরেই নানান প্রশ্ন উত্তরের খেলা চলছে!
_______________________________________

সকল পরিস্থিতি বিবেচনা করে সুহানা আর জয়কে পালিয়ে বিয়ে করার পরামর্শ দিয়েছে আরিশ, ওরা সাহায্য ও প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করবে বলে আশ্বাসও দিয়েছে। বন্ধুদের ওপর সম্পূর্ন ভরসা আছে সুহানার, আর পরিবারের চাপে পড়ে ভালোবাসার মানুষকে হারাতে চায়না ও তাই আরিশের প্ল্যানে রাজি হয়েছে। আরিশ অয়নকে আলাদা করে ডেকেছে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করার জন্যে…

‘ সুহানার সাথ সব প্ল্যান করা হয়ে গেছে, ও জয়ের সাথে শেয়ার করে নেবে। বাকিটা আমাদের সব অ্যারেঞ্জ করতে হবে। তুই রেডি আছিস তো? হাতে বেশি সময় নেই ‘

আরিশ নিজের প্ল্যান শেয়ার করতে শুরু করলো, কিন্তু এক পর্যায়ে লক্ষ্য করলো অয়ন অন্যমনস্ক হয়ে আছে…

‘ কি ভাবছিস তুই অয়ন?’

‘ হ্যা? না কিছুনা। তুই বল যা বলছিলি ‘

‘ কিছুনা? তুই এমন অন্যমনস্ক হয়ে আছিস মানে কিছু তো একটা ব্যাপার আছে। জলদি বল কি হয়েছে ‘

‘ আসলে আমি একটা বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম ‘

‘ কেমন বিষয়?’

অয়ন উত্তর দিলো না, কিন্তু আরিশ বুঝে গেছে!

‘ আহ! নট অ্যাগেইন অয়ন প্লিজ! তোকে কতোবার বলেছি বিষয়টা নিয়ে ভাবা বন্ধ কর, যা হবার হয়ে গেছে। এখন এসব নিয়ে ভেবে কি লাভ?’

‘ আই ডোন্ট নো, আজ হঠাৎ মনে পড়লো ‘

‘ মনে করিস না, যে তোকে কষ্ট দিয়েছে শুধু শুধু তার কথা ভেবে কোনো লাভ নেই। জাস্ট ফরগেট অ্যাবাউট হার ‘

দীর্ঘশ্বাস ফেললো অয়ন, স্কুল জীবনে একটি মেয়েকে ভালোবেসেছিলো। কলেজ অব্দি খুব সুন্দর সম্পর্ক ছিলো ওদের কিন্তু হুট করেই মেয়েটার বিয়ে হওয়ার পর অয়ন মানসিকভাবে অনেকটা ভেঙে পড়েছিলো। বন্ধুদের সাপোর্টে তখনকার খারাপ সময় পেরিয়ে এলেও জীবনের প্রথম প্রেমের কথা এখনও ভুলতে পারেনি! কিছুদিন পর থার্ড সেমিস্টার এক্সামের সকল কার্যক্রম আগে শেষ হলো, এখন আবারো ক্লাস শুরু হয়েছে। এর মাঝে মেঘের কোচিং সেন্টারে ভালোই সময় কাটছে, কিন্তু দিনদিন বিভিন্ন কারণে মেঘ যেনো নিহানের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এ বিষয়টা নিয়ে অস্বস্তি বেড়েছে আরিশের! আজ সকালে খেয়ে আসার পরও একটা ক্লাস শেষেই খিদে পেয়ে গেছে মেঘের, তাই ও ক্যান্টিনে খেতে এসেছে। মেঘ খাবার কিনে নিয়ে বসলো। জরুরি ক্লাস চলছে, তাই তিশাকে ক্লাসে রেখে এসেছে। ওর থেকে পরে পড়া নিয়ে নেবে। ক্লাসে মেঘ নিহান দুজনের কাউকেই না দেখে আরিশ কিছুটা চিন্তিত হলো…

‘ অয়ন, তুই ক্লাস অ্যাটেন্ড কর। আমি আসছি’

‘ কোথায় যাচ্ছিস?’

‘ কাজ আছে!’

আরিশ ক্লাস থেকে বেরিয়ে মেঘকে খুঁজতে শুরু করে। খাওয়া শেষে মেঘ লাইব্রেরীর দিকে যাচ্ছিলো তখনই আরিশের সঙ্গে মুখোমুখি পড়ে…

‘ তুমি এখানে কি করছো? ক্লাস না শুরু হয়েছে?’

‘ একই প্রশ্ন আমারও, তুমি এখানে কি করছো?’

‘ খিদে পেয়েছিলো তাই খেতে এসেছিলাম ‘

‘ এখন কোথায় যাচ্ছো?’

‘ আমার লাইব্রেরীতে একটু কাজ আছে ‘

‘ ক্লাস চলছে, এখন তোমার লাইব্রেরীতে কিসের কাজ? তোমার বসের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছ নাকি?’

‘ আমার বস?’

মেঘ প্রথমে বুঝতে পারেনি কিন্তু কিছুটা ভাবার পর বুঝলো আরিশ কার কথা বলছে। মেঘ কিছুটা বিরক্ত হলো…

‘ আরিশ, আমি বুঝতে পারছি না এখানে নিহানের কথা কেনো আসছে? আমি আমার দরকারে যাচ্ছি ‘

‘ দুজন মিলে একসঙ্গে ক্লাস থেকে উধাও হয়ে গেলে, ভাবলাম তোমাদের বস এম্প্লয়ের জরুরি কোনো মিটিং আছে ‘

আরিশের কথার শুনে অবাক হয়ে গেলো মেঘ!

‘ আরিশ! তুমি আমাকে সন্দেহ করছো?’

উত্তর দিলো না আরিশ, কিন্তু ওর চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট। মেঘ বুঝলো আরিশ হয়তো ওদের দুজনকে নিয়ে সন্দেহ করছে, কষ্ট হলো মেয়েটার!

‘ একটা সম্পর্কে বিশ্বাস অনেক বড় একটা ফ্যাক্ট। আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো আমার পছন্দ করো না কিন্তু তুমি তো দেখছি আমাকে বিশ্বাসও করো না।তোমার থেকে অন্তত এইটা আমি আশা করিনি আরিশ’

আরিশ কিচ্ছু বললো না, মেঘের দিকে তাকিয়ে শুধু শুনলো। কথাগুলো বলার পরেও মেঘ অনেক আশা নিয়ে ওর দিকে তাকিয়েছিলো, ভেবেছিলো আরিশ বুঝি সরি বলবে কিন্তু নাহ! আরিশ চুপ রইলো। মন খারাপ করে মেঘ চলে এলো ওখান থেকে। এতোদিন আরিশের অনেক কথা শুনেই খারাপ লেগেছে তবে সেটা ছিলো সাময়িক কিন্তু আজ যেনো একটু বেশিই কষ্ট হলো। একটু বেশীই রেগে গেছিলো আরিশ, ভালোমন্দ বিচার না করেই হুট করে মেঘকে এমন কথা বলে বসলো। এমনকি মেঘ যাওয়ার সময় একবারও ওকে আটকানোর বা কিছু বলার চেষ্টা করলো না!

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]