এলো প্রেমের মৌসুম পর্ব-১৪+১৫

0
2

#এলো_প্রেমের_মৌসুম
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ১৪

মেঘ প্রথমে ভেবেছিলো আরিশকে হয়তো ওর শ্বশুর পাঠিয়েছে, সে হিসেবেই ও জিজ্ঞাসা করলো…

‘তোমাকে কি বাবা পাঠিয়েছে?’

মেঘের প্রশ্ন শুনে কপালে ভাঁজ পড়লো আরিশের, মেঘের কাছে যে ওর এই আচরণ অস্বাভাবিক লাগছে তা মেঘের কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে। আরিশ স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলো…

‘ আমি নিজে থেকে আসতে পারিনা?’

‘ সেটা না, কিন্তু তোমার তো আমাকে নিজে থেকে নিতে আসার ইচ্ছে হওয়ার কথা না। তাই ভাবলাম হয়তো তোমার বাবা কিছু…’

‘ আমি স্বেচ্ছায় তোমায় নিতে এসেছি, কারণ তোমার যা অবস্থা দেখছি মনে হয় তুমি এখানেই পার্মানেন্টলি থেকে যাওয়ার প্ল্যান করছো’

‘ আমি কালই ফিরে যেতাম ‘

‘ আগামীকাল আসতে আর মাত্র কয়েক ঘন্টাই বাকি ‘

‘ হুমম! আচ্ছা, চলো আব্বু আম্মুর সঙ্গে দেখা করবে ‘

‘ তোমার আব্বু আম্মুর সঙ্গে দেখা করেই তোমার রুমে এসেছি’

আরিশ টিভির চ্যানেল চেঞ্জ করে দেখার মতো প্রোগ্রাম খুঁজছে, মেঘ স্থির দাড়িয়ে ওকে দেখে যাচ্ছে। দুপুরে লাইব্রেরীর ঘটনার পর রাতের বেলা আরিশের আকস্মিক আগমনে মেয়েটা একটু শক পেয়েছে বটে।

‘ দাঁড়িয়ে আছো কেনো? কিছু খেতে দাও! তোমার আম্মু অবশ্য ডিনারের কথা বলেছিল কিন্তু আমি বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি। হালকা কিছু দাও ‘

মেঘের রুমে ছোটো একটা বিস্কুটের কৌটা সবসময়ই থাকে, সেটাই এনে আরিশকে দিয়ে বললো…

‘ হালকা কিছু বলতে আমার রুমে এটাই আছে, চলবে নাকি অন্যকিছু এনে দেবো?’

‘ এখন এতকিছু খাওয়ার সময় নেই, এতেই চলবে। তুমি গিয়ে রেডি হয়ে এসো ‘

‘ এতো তাড়াহুড়োর কি আছে? রাত হয়েছে, দরকার পড়লে আজকের রাতটা থেকে…’

‘ এতদিন থাকলে তারপরও ইচ্ছে মেটেনি তোমার? এক এক ঘণ্টাও সময় দেবো না তোমায়। দ্রুত রেডি হয়ে এসো, আই অ্যাম ওয়েটিং ‘

ভীষণ তাড়া দিচ্ছে আরিশ, মেঘও ভেবে দেখলো আরিশ নিজে থেকে নিতে এসেছে। ওর সঙ্গে ফেরত না গেলে বিষয়টা মন্দ দেখায়, তার ওপর হুট করে এসে এতদিন বাবার বাড়ি থাকাটা ভালো দেখায় না। পরে আর আপত্তি করলো না মেঘ, তৈরি হয়ে নিলো। আসার সময় কোনো কাপড়ের ব্যাগ আনেনি মেঘ, যেহেতু এই বাড়িতে ওর জামাকাপড় আছে। তাই আলাদা করে ব্যাগ প্যাক করার ঝামেলা নেই। কিছুক্ষণ পর মেঘের মা বাবার থেকে বিদায় নিয়ে আরিশ মেঘকে নিয়ে বের হয়। ড্রাইভ করছে আরিশ, পাশে বসে আছে মেঘ। এক পর্যায়ে মেঘ বললো…

‘ বাবা কি তোমাকে কিছু বলেছে?’

‘ না তো, কি বলবে?’

‘ নাহ, এমনিই। আরিশ, আজকে লাইব্রেরীতে…’

‘ ইয়াহ, আই কিসড ইউ। সো?’

চমকে উঠলো মেঘ, যে বিষয়টা নিয়ে ও সারাদিন ভেবে পা’গ’ল হয়ে গেছে সেই বিষয়টা আরিশের কাছে যেনো স্বাভাবিক কোনো ব্যাপার! মেঘ প্রশ্ন করলো…

‘ কেনো করলে?’

‘ তোমাকে শান্ত করার জন্যে ‘

‘ আমাকে শান্ত করানোর আরো অনেক উপায় ছিলো, তাই বলে…ভাগ্য ভালো তখন লাইব্রেরীতে কেউ ছিলো না নাহলে…’

‘ নাহলে কি হতো? আমরা ম্যারেড, কে কি বলতে আসতো আমাদের? তাছাড়া ওই মুহূর্তে ওটাই আমার কাছে বেস্ট অপশন মনে হয়েছে, নাহলে তুমি আমার কথা না শুনেই চলে যেতে’

আরো একদফা চমকালো মেঘ, পরে কিছুক্ষণ ভেবে দেখলো ও। অনেক ভাবার পর ধরে নিলো আরিশ হয়তো ওই মুহূর্তে ইমোশনাল হয়ে কাজটা করেছে, মন থেকে বা ভালোবেসে নয়! কথাটা ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেঘ!
_______________________________________

পঁচিশতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ইউনিভার্সিটিতে আজ প্রোগ্রাম হবে, ভার্সিটি কতৃপক্ষ ও সিনিয়ররা মিলে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করছে। আয়োজনে যারা কাজ করছে আরিশও তাদের মধ্যে একজন। দুপুরে প্রোগ্রাম হবে, তো সকালেই ওদের যেতে হবে। আরিশ ক্যাজুয়াল একটা ড্রেস পরে রেডি হয়ে নিলো, আর প্রোগ্রামে পড়ার জন্যে একটা পাঞ্জাবি আলাদা ব্যাগে নিয়ে নিলো। বেরোতে যাবে তখনই মেঘ এসে জিজ্ঞাসা করলো..

‘ আচ্ছা, আজ আমার কি পড়া উচিত?’

‘ তোমার যা ভালো লাগে পড়ে নাও, আমাকে জিজ্ঞাসা করছো কেনো?’

‘ তবুও, আচ্ছা প্রোগ্রামে তো মেয়েরা সবাই শাড়ি পড়বে তাইনা?’

‘ কে কি পড়লো সেটা তোমার দেখার দরকার নেই, তোমার যা ভালো লাগে সেটাই পড়ো ‘

আরিশের থেকে কোনো পরামর্শ না পেয়ে কিছুটা হতাশ হলো মেঘ, আরিশ ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে। পরে মেঘ ওর বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলে ঠিক করলো কি পড়ে যাবে! প্রোগ্রামের কাজ শেষে আরিশ রেডি হয়ে এসে ক্যাম্পাসের একপাশে বসতেই সুহানা বলে ওঠে…

‘ ওয়াও! আরিশ, তোকে তো এই পাঞ্জাবিতে দারুন লাগছে। ইউ আর লুকিং ভেরি হ্যান্ডসাম ‘

‘ থ্যাংক ইউ!’

চুলগুলো সামনে এনে একটু স্টাইল করে বসে আরিশ ও অয়নকে উদ্দেশ্য করে সুহানা বললো…

‘এবার বল আমাকে কেমন লাগছে বলতো? তোরা একে একে আমার প্রশংসা করতে শুরু কর ‘

‘একদম শাকচুন্নি লাগছে রে তোকে! কি রং চুজ করেছিস এটা? জয় তোকে কি রং পছন্দ করে দিয়েছে?’

‘ তুই জানলি কিভাবে এটা জয়ের চয়েজ?’

‘ কারণ তোর চয়েজ সম্পর্কে আমরা জানি! জয়ের কালার চয়েজ তো দেখা যাচ্ছে খুব একটা ভালো না ‘

‘ আরিশ, আমার জয়কে নিয়ে একদম উল্টোপাল্টা কথা বলবি। ওর চয়েজ ভীষণ ভালো, তোর চোখ নেই তাই বুঝতে পারছিস না’

অয়ন হেসে বলে উঠলো…

‘ আহহা! দেখেছিস আরিশ, এখনই কত্তো মোহাব্বত? বিয়ের পর যে কি করবে, কোনো মেয়েকেও বোধহয় জয়ের দিকে তাকাতে দেবে না’

ওরা দুজনকে সুহানাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিলো, এদিকে সুহানা তো রেগে মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। তখনই অয়ন বললো..

‘ আরিশ, ওদিকে দেখ কে এসেছে!’

সামনে তাকাতেই চোখ যেনো আটকে গেলো আরিশের, তিশার সাথে দাড়িয়ে ক্লাসের অন্য মেয়েদের সঙ্গে কথা বলছে মেঘ। অন্যদিনের তুলনায় আজ অন্যরকম লাগছে মেয়েটাকে, কারন আজকে ও শাড়ি পড়ে এসেছে! মেঘ নীল শাড়ি পড়েছে, আরিশ নীল পাঞ্জাবি। সুহানা হেসে প্রশ্ন করলো…

‘ কীরে, আজ তোরা কাপল শ্যুট করার প্ল্যান করে এসেছিস নাকি? দুজনেই ম্যাচিং কালার পড়েছিস?’

‘ নো, ইটস অ্যা কো ইন্সিডেন্স!’

মেঘ তখনও আরিশকে লক্ষ্য করেনি। কিন্তু মুগ্ধ নয়নে তার প্রিয় রমণীকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত। মেঘের খোলা অবাধ্য কেশ, নীল শাড়ি, হাত ভর্তি চুড়ির সঙ্গে কপালের টিপটা যেনো মেয়েটার সৌন্দর্য দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। একটু পরেই মেঘের নজর যায় আরিশের দিকে। পাশ থেকে তখন অয়ন বললো…

‘মেঘনার পাশেরটা কে দেখেছিস? এমনিতে কেমন লাগে দেখতে, আজকে কিন্তু কিউট লাগছে তাইনা?’

ভ্রু কুঁচকে বন্ধুর দিকে তাকালো আরিশ…

‘ তুই আবার মেঘনার বান্ধবীকে দেখা শুরু করলি কবে থেকে?’

‘ কেনো? ওকে দেখা মানা আছে নাকি আমার? তাছাড়া আজ ওকে দেখতে সুন্দর লাগছে তাই বললাম’

‘ হ্যা, সবই বুঝতে পারছি। আচ্ছা শোন তোরা থাক আমি একটু আসছি’

সুহানা জিজ্ঞাসা করলো…

‘কোথায় যাবি এখন? একটু পরেই তো প্রোগ্রাম শুরু হবে ‘

‘ প্রোগ্রাম শুরু হলে তোরা ভেতরে চলে যাস, আমার অপেক্ষায় বসে থাকতে হবেনা ‘

‘ ওহও! আরিশ, আমার তোকে দেখে কি মনে জানিস? তুই এখন পাক্কা প্রেম করার মুডে আছিস’

চোখ গরম করে বন্ধুর দিকে তাকালো আরিশ..

‘এভাবে তাকাচ্ছিস কেনো? তোর মুখটা দেখে ওইরকম লাগছে আবার বউকে দেখে আমাদের ফেলে চলে যাচ্ছিস’

‘ মেঘনার সঙ্গে আমার এখন বেশি টাইম স্পেন্ড করা উচিত, নাহলে ঝামেলা হয়ে যাবে। বিয়ে করিসনি তো, বললে বুঝবি না ‘

আরিশ উঠে চলে গেলো, অয়ন বুঝলো না ও কি বোঝানোর চেষ্টা করলো। তবে আরিশ যে মেঘকে নিয়ে সিরিয়াস হতে শুরু করেছে তা অয়ন সুহানা উভয়ই ভালোই বুঝতে পারছে! আরিশ মেঘের কাছে আসছিলো, উল্টে দেখলো মেঘই ওর কাছে আসছে…

‘ কিছু বলবে?’

‘ তোমাকে একটা জিনিস দেওয়ার আছে ‘

মেঘ ওর ব্যাগ থেকে একটা রুমাল বের করে আরিশের হাতে দিয়ে বলে..

‘ এটা তোমার জন্যে ‘

আরিশ রুমালটা হাতে নিয়ে দেখে বললো..

‘ এটা তো আমার রুমাল না’

‘ হুমম! আসলে সেদিন তুমি আমার হাতে রুমাল বেঁধে দিয়েছিলে। তোমার রুমালটা আর ব্যবহারের উপযোগী নেই তাই ভাবলাম তোমাকে নতুন রুমাল গিফট করে দেই ‘

আরিশ লক্ষ্য করলো রুমালের এক কোণায় ইংরেজিতে ওর নামসহ ছোটো একটা ফুলের ডিজাইন করা..

‘ ওহ, থ্যাংকস! এখানে তো দেখছি আমার নামও লিখা আছে, তুমি এমব্রয়ডারি করতে পারো?’

‘ হুম, একটু একটু পারি। গত বিকেলে এমনি বসেছিলাম তাই ভাবলাম রুমালটায় একটু এমব্রয়ডারি করে দেই ‘

‘ বাড়িতেই দিতে পারতে ‘

‘ আমার আসলে খেয়াল ছিলো না, আর সকালেও তুমি জলদি চলে এলে। দেওয়ার সময় পাইনি ‘

‘মেঘনা এটা সামান্য একটা রুমাল, এর জন্যে তোমার এতো কষ্ট করার দরকার ছিলো না। তোমার হাতের চোট এখনও ঠিক হয়নি’

‘ দরকার ছিলো! আমি বুঝি জানিনা যে ছেলেদের সবথেকে দরকারের জিনিস এটা? তারা সবকিছু ভুলে যেতে পারে কিন্তু বাইরে যাওয়ার আগে নিজেদের রুমাল আর ওয়ালেট নিতে কখনো ভুল করবেনা ‘

মেঘের কথায় হাসলো আরিশ, এই হাত নিয়েও মেঘ কতোটা যত্ন করে রুমালে ডিজাইন করেছে ভেবেই ভালো লাগলো ওর!

‘ ভালোই জানো দেখছি, থ্যাংক ইউ। হিসেবে এটা তোমার আমাকে দেওয়া প্রথম গিফট, এটা অনেক যত্ন করে রাখবো আমি ‘

আরিশের থেকে ধন্যবাদ পাওয়ার আশা ছিলো না মেঘের, কিন্তু আরিশ ধন্যবাদসহ যে এতো সুন্দর একটা কথা বলবে ভাবেনি মেঘ। ইদানিং আরিশের ছোটো ছোটো কেয়ার, ওর কথা সবকিছুই মেঘের কাছে ভীষণ স্পেশাল লাগছে। যদিও পূর্বেও আরিশকে পছন্দ করতো মেঘ, আরিশের রুক্ষ আচরণও আপন করে নিতে প্রস্তুত ছিলো ও কিন্তু প্রকাশ করতে পারেনি! আরিশ রুমালটা পকেটে রেখে মেঘকে বললো…

‘ চলো, যাওয়া যাক?’

‘ হুমম!’

হাঁটতে গিয়ে অসাবধানতা বশত কুচিতে পা লেগে পড়ে যেতে যাচ্ছিলো মেঘ, দ্রুত আরিশ ওকে ধরে ফেলে। মেঘের শাড়ির কুচি কিছুটা খুলেও গেছে পা লাগার ফলে। অবশ্য তাতে সমস্যা হয়নি কারণ ক্যাম্পাসের এদিকে কেউ ছিলো না, তখন সবাই অডিটোরিয়াম রুমে।

‘দেখে হাঁটবে তো, এখনি পড়ে যেতে ‘

‘হ্যাঁ, আসলে শাড়ি পড়ার অভ্যাস নেই তো তাই একটু..’

রেগে উঠলো আরিশ…

‘ যখন অভ্যাস নেই তাহলে তোমাকে পড়তে কে বলেছিলো? নরমালি যে ড্রেস পড়ো সেগুলো পড়লেই পারতে। এখন আমি না ধরলে তো মুখ থুবড়ে পড়তে এখানে’

‘এরকম একটা প্রোগ্রাম আর শাড়ি না পড়লে হয়? দেখলে না সব মেয়েরা শাড়ি পরেছে? তাদের মাঝে আমি অন্য ড্রেস পরে আসলে কেমন লাগতো?’

‘আচ্ছা, তুমি যাও আমি শাড়িটা ঠিক করে আসছি। কুচিগুলো খুলে ঠিকমতো দিতে হবে’

‘ এক মিনিট, তুমি তো শাড়ি পড়তে পারো না। তাহলে কূচিগুলো কি নিজেই দিয়েছিলে নাকি আমার আম্মু দিয়ে দিয়েছিলো?’

আরিশের কথা শুনে মেঘের মনে পড়লো আজকে ওর শাশুড়িই শাড়ির কুচি ধরে দিয়েছিলো, মেঘ নিজে কুচি দিতে পারে না। আগেও যে কয়েকবার শাড়ি পরেছে ওর মা পরিয়ে দিয়েছে। অসহায় দৃষ্টিতে আরিশের দিকে তাকালো মেঘ! এখানে কে সাহায্য করবে এখন?

চলবে…

#এলো_প্রেমের_মৌসুম
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ১৫

পবিত্র ধর্মগ্রন্থের কিছু অংশ পাঠের মধ্য দিয়ে আজকের প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে, শুরুতেই ভার্সিটির অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ বক্তব্য রাখবেন। এরপর প্রধান অতিথিরা বক্তব্য রাখবেন। অয়ন তিশা আর সুহানা পাশাপাশি চেয়ারে বসেছে। তিশার সঙ্গে অয়নের আজ অনেকক্ষণ কথা হয়েছে, মেয়েটাকে ভালোই লেগেছে অয়নের। এতক্ষণ পার হওয়ার পরও মেঘ আসেনি দেখে তিশা ওকে কল করলো, কিন্তু ফোন বন্ধ আসছে। অয়ন প্রশ্ন করলো…

‘ মেঘনাকে কল করছো নাকি?’

‘ হ্যা, আমাকে ফোন দিয়েছিল আমি দেখিনি। এখন ওর ফোনে কল ঢুকছেনা, নেটওয়ার্ক ইস্যু হয়তো ‘

‘ ওকে ফোন দিতে হবেনা, আরিশের সঙ্গেই আছে। চলে আসবে ‘

‘ মেঘনা ওর সঙ্গে কেনো থাকতে যাবে?’

‘ হাসবেন্ড ওয়াইফের ব্যক্তিগত কথা থাকতেই পারে, তেমনি কিছু হবে হয়তো ‘

অয়নের কথা শুনে হাসলো তিশা..

‘ হাসবেন্ড ওয়াইফ? মেঘনা আর আরিশ? এই দিনদুপুরে মজা করো না তো ‘

অয়ন উত্তর দিলো না, ক্ষণিক নীরবতার পর তিশা অবাক চোখে তাকালো অয়নের দিকে কারণ ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছে না মজা করছে…

‘ আর ইউ সিরিয়াস?’

‘ তোমার কি মনে হয় এরকম সিরিয়াস একটা বিষয় নিয়ে আমি মজা করবো? আমি তো ভেবেছিলাম মেঘনা তোমাকে বলেছে ‘

মাথায় হাত পড়লো তিশার, কারণ মেঘের সঙ্গে আরিশের কোনো সম্পর্ক আছে সেটা মেঘের হাবভাবে বিন্দুমাত্র বোঝার উপায় ছিলো না।

‘ হোয়াট! আরিশ মেঘনার হাসবেন্ড! আই কান্ট বিলিভ দিস। ওদের দেখে তো কোনোভাবেই মনে হয় না ওরা বিবাহিত! আমি মেঘনার সঙ্গে থেকেও কিছু বুঝলাম না?’

‘ হেই রিল্যাক্স! তুমি আবার আশ্চর্যের ঠ্যালায় হার্ট অ্যাটাক করে বসো না। তাহলে আবার আমাদের প্রোগ্রাম ছেড়ে তোমায় নিতে হাসপাতালে ছুটতে হবে ‘

‘ মজা করো না তো অয়ন! আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না এখনও ‘

তিশা আর প্রোগ্রাম কি ইনজয় করবে, উল্টে আরিশ মেঘের সম্পর্কের কথা শুনে শক পেয়ে বসে আছে। সুহানা অয়নকে বললো…

‘ তুই ওকে কেনো বললি? জানিস তো আরিশ যদি জানে বিষয়টা তুই পাঁচকান করেছিস তাহলে উল্টে তোকে বকবে ‘

‘ প্যারা নিস না তো, আগের ব্যাপার আলাদা। এখন ওকে দেখে বুঝতে পারছিস না? এখন দেখবি নিজেই সবাইকে জানাবে যে মেঘনার সঙ্গে ওর কি সম্পর্ক ‘

‘ হ্যা, তাও ঠিক। ইদানিং তো মেঘনার প্রতি ভীষণ কনসার্ন ও। আচ্ছা ওরা দুজনে গেছে কোথায় বলতো? ফোন করে দেখবো?’

‘ কি দরকার ওদের বিরক্ত করার? আমরা চুপচাপ প্রোগ্রাম ইনজয় করি ‘

অয়নের কথা শুনে সুহানা আর ফোন করলো না।ওদিকে আরিশ মেঘকে দো তলার একটা ফাঁকা ক্লাসে নিয়ে গেছে…

‘ঠিক করে ফেলো, এখানে এখন কেউ নেই আর আসবেও না। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি’

আরিশ রুমের বাইরে দাঁড়ায়। মেঘ কয়েকবার কুচি তোলার চেষ্টা করে কিন্তু জর্জেট শাড়ি হওয়ায় বারবার হাত ফস্কে যাচ্ছে। তিশাকে কয়েকবার ফোন করেছিলো সাহায্যের জন্যে কিন্তু ও ফোন ধরছে না। পরে মেঘ বাধ্য হয়ে আরিশকে ডাকে…

‘ কি হয়েছে?’

‘আমি পারছিনা, তুমি একটু তিশাকে ডেকে দেবে?’

‘ আমি কাউকে ডাকতে পারবো না, নিজে চেষ্টা করো ‘

‘ আরিশ প্লিজ, আমি দ্বারা হবেনা। তিশাকে ফোন করছি কিন্তু ধরছে না ‘

‘ সরি মেঘনা, আমি কাউকে ডাকতে যেতে পারবো না। কতো গরম পড়েছে দেখেছো? এখন অডিটোরিয়াম রুমে যেতে গেলে এই রোদ পাড় হয়ে যেতে হবে ‘

‘ তাতে কি? তুমি তো সানস্ক্রিম মেখেই এসেছো ‘

‘ তুমি কিভাবে জানলে আমি সানস্ক্রিম মেখেছি?’

‘ উফফ! এখন এসব কথা বলার সময় না আরিশ, ডু সামথিং ‘

‘ আমি ডাকতে যেতে পারবো না ‘

‘তাহলে কি করবো আমি এখন? এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবো এখানে?’

‘এক কাজ করো, ইউটিউব থেকে শাড়ি পরার ভিডিও খুঁজে চালু করে নাও। ওটা দেখে ট্রাই করলেই হয়তো পারবো ‘

মেঘ ইউটিউবের কথা ভুলেই গেছিলো, আরিশের পরামর্শ অনুযায়ী ও ইউটিউবে শাড়ি পরার টিউটোরিয়াল চালু করে কয়েকবার চেষ্টা করলো কিন্তু ব্যথ হলো।

‘ হচ্ছেনা ‘

মেঘ একা পারবে বুঝে আরিশ ভেতরে এলো..

‘ ত..তুমি ভেতরে এলে কেনো?’

‘ তোমার শাড়ির কুচির জন্যে আমরা প্রোগ্রাম মিস করে ফেলবো, চুপচাপ দাড়াও। আমি হেল্প করছি’

আরিশ প্রথমে দরজা বন্ধ করলো, এরপর ইউটিউবে দেখে সেভাবেই মেঘের শাড়ির কুচি দিতে শুরু করলো। প্রথমে পারছিলো না কিন্তু কয়েকবার চেষ্টা করতে করতেই একসময় হয়ে গেলো। মেঘ স্থির নজরে চেয়ে দেখছে আরিশকে, মাস দুই আগে যে ছেলেটা সারাক্ষণ ওর সঙ্গে খিটখিট করতো সে হুট করেই যেনো কেমন বদলে গেছে। প্রয়োজনের সময় নিজেই সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে, পাশে থাকার চেষ্টা করছে।

‘ ওকে! দেখো তো হয়েছে কিনা? যতোটা পেরেছি পারফেক্টলি করার চেষ্টা করেছি, এর থেকে ভালো…’

আরিশ মাথা তুলে তাকাতেই লক্ষ্য করলো মেঘ পলকহীন ভাবে তাকিয়ে ওকে দেখছে, উঠে দাড়ালো ও। হেসে প্রশ্ন করলো…

‘ আর ইউ ইমপ্রেসড?’

‘ হুমম, সুন্দর হয়েছে কুচি দেওয়া ‘

মেঘের কথায় হতাশ হলো আরিশ…

‘ ওহ! তুমি কুচির জন্যে ইমপ্রেসড? আমি ভাবলাম যে দিয়ে দিলো তাকে দেখে ইমপ্রেস হয়েছো ‘

‘ সাহায্যের জন্যে ধন্যবাদ। চলো, যাওয়া যাক ‘

মেঘ যেতে যাচ্ছিলো, আরিশ ওকে আটকায়। এক হাতে মেঘের কোমড় জড়িয়ে নিজের অনেকটা কাছে টেনে আনে। অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো মেঘ…

‘ এতো তাড়ার কিসের? এতো কষ্ট করে সাহায্য করলাম, সে তুলনায় ধন্যবাদটা একটু বেশিই ক্যাজুয়াল হয়ে গেলো না?’

‘ তাহলে কিভাবে ধন্যবাদ নিতে চাইছো?’

‘উম্ম! সেটা আমিই ঠিক করি?’

‘ ওকে! আগে আমাকে ছাড়ো, ভার্সিটি ভর্তি আজ অনেক মানুষ। কেউ দেখে ফেললে..’

এবার আরো দু হাতে কোমড় জড়িয়ে ধরলো আরিশ, আরিশের নাতিশীতোষ্ণ হাতটা পেটের ওপর পড়তেই কেঁপে উঠলো মেঘ..

‘ দেখলে দেখুক, আই ডোন্ট কেয়ার ‘

আরিশের এহেন অস্বাভাবিক হাবভাব বোধগম্য হচ্ছেনা মেঘের, ও আর প্রশ্ন না করে পারলো না…

‘ হোয়াট আর ইউ ট্রাইং টু ডু? তুমি নিজেই বলেছিলে যে আমাদের সম্পর্কটা গোপন থাকবে, আমি তোমার কথা রাখার চেষ্টা করছি সেখানে তুমি…’

‘ আই নো তুমি আমার কথা রাখার খুব চেষ্টা করছো, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমি নিজেই নিজের কথা রাখতে পারছি না। আই ডোন্ট নো হুয়াই!’

আরিশের কথা শুনে মেঘ কনফিউজড হয়ে গেলো..

‘ আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না আরিশ, কি বলতে চাইছো তুমি?’

আলতো করে নিজের ডান হাতের পিঠটা মেঘের বাম গালে ছুঁইয়ে আরিশ বললো…

‘ ইউ আর লুকিং গর্জিয়াস ‘

আরিশের আকস্মিক প্রশংসা শুনে যেনো হতবিহ্বল হয়ে পড়লো মেঘ, নিজের কনফিউসন দুর করার জন্যে আরিশকে বোঝার চেষ্টা করছিলো মেঘ কিন্তু হুট করেই আরিশ এমন আদর জড়ানো কণ্ঠে প্রশংসা করে বসলো..

‘ শাড়িতে তোমাকে এতো সুন্দর লাগে আগে খেয়াল করিনি। বিয়ের দিন হয়তো আরো সুন্দর লাগছিলো! আমার দূর্ভাগ্য যে সেদিন তোমাকে ভালোমতো তাকিয়েই দেখিনি ‘

আরিশের দিক থেকে যেনো চোখ সরাতে পারছে না মেঘ, নিজের কান কেই হয়তো এখনো বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না। আরিশের ঠোঁটের কোণে ফুঁটে ওঠা ওই এক চিলতে হাসি যেনো মেঘের বুকের ভেতর যেনো উথাল পাথাল স্রোতের সৃষ্টি করে দিয়েছে। মেঘের মস্তিষ্কে হুট করেই বেজে উঠলো একটা প্রশ্ন, সে কি আমার প্রেমে পড়েছে? আরিশ লক্ষ্য করলো মেয়েটা কেমন ঘোর লাগানো চোখে চেয়ে আছে…

‘ মেঘনা? আর ইউ ওকে?’

উত্তর দিলো না মেঘ, আরিশ হাসলো। একটু ভাব নিয়ে বললো…

‘ আই নো আমাকে হ্যান্ডসাম লাগছে, তাই বলে…’

পুরো কথা শেষ করতে পারেনি আরিশ, তার আগেই দু হাতে ওর গলা জড়িয়ে নিজের ওষ্ঠোজোড়া মিলিয়ে দিলো মেঘ। প্রথম পর্যায়ে চমকে উঠলো আরিশ, মেঘের তরফ থেকে এই প্রতিক্রিয়া অপ্রত্যাশিত ছিলো তবে খুশি হয়েছে বটে কারণ মেঘ নিজে থেকেই কাছে এসেছে। দু হাতে আরো শক্ত করে মেঘকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিলো আরিশ। মেঘের প্রথম স্পর্শ হালকা হলেও আরিশ তাকে গভীরতায় রূপ দিলো…
_____________________________________

প্রোগ্রাম শেষে দুপুরে লাঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে, সবাই লাঞ্চের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরই মাঝে তিশা তো মেঘের ওপর রেগে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। মেঘ ওর রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছে…

‘ মেঘনা, আমি আজকে অনেক কষ্ট পেয়েছি! তুই যে আমাকে বন্ধু ভাবিস না সেটাও আমার বোঝা হয়ে গেছে। তোকে আমি তোর বরের ছবি দেখাতে বললে সবসময় এড়িয়ে গেছিস, কখনো বললি না কেনো যে আরিশের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে তোর?’

‘ সরি রে, আসলে বিষয়টা প্রকাশ না করার কিছু কারণ ছিলো তাই…’

‘ যাই থাকুক, অন্তত আমাকে বলতে পারতি। অয়নের কথা আমি তো প্রথমে বিশ্বাসই করিনি, এখন দেখি এটাই সত্যি। তুই কিভাবে পারলি আমার সঙ্গে এমন করতে বলতো?’

‘ সরি! আচ্ছা, এখন তো জানিস। আর রাগ করিস না ‘

‘ কেনো রাগবো না? অয়ন না বললে আমি হয়তো কোনোদিন জানতেই পারতাম না। আচ্ছা, তুই কি তোর বিয়ের বিষয়টা গোপন রাখার চেষ্টায় ছিলি? কেনো এতোদিনে একবারও বললি না?’

বান্ধবীকে মানানোর চেষ্টায় মেঘ, ওদিকে আরিশরা ঠিক করেছে ক্যাম্পাসের বড় গাছের নিচে ঘাসের ওপর বসে বন্ধুদের সঙ্গে একসাথে খাবে। যেহেতু প্যাকেটজাত খাবার তাই সমস্যা নেই! ওরা খাবারের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখন অয়ন প্রশ্ন করলো…

‘ কীরে, তুই আজ কোথায় গায়েব হয়ে গেছিলি?’

‘ মেঘনাকে হেল্প করছিলাম ‘

‘ ওর কি হয়েছিলো?’

‘ সাহায্যের প্রয়োজন ছিলো ‘

আরিশের কথা শুনে মাথা চুলকালো অয়ন, দুবার করা প্রশ্নে আরিশ উত্তর দিয়েও যেনো দিলো না। একটু পরে মেঘ ও তিশা এলো, তিশাকে অয়ন নিজের পাশে বসার জায়গা দিলো। মেঘ দেখলো সবার হাতে খাবারের প্যাকেট কিন্তু ওর খাবার নেই। মেঘের মনে পড়লো ও খাবার আনেনি…

‘ আমার খাবারের প্যাকেট আনতে ভুলে গেছি, তোমরা খাওয়া শুরু করো আমি নিয়ে আসছি ‘

আরিশ বসা অবস্থাতেই মেঘের হাত ধরলো..

‘কোথায় যাচ্ছো?’

‘ বললাম তো ‘

‘আমি যেতে বলেছি তোমাকে?’

‘ না!’

‘তাহলে? চুপ করে বসো’

‘ বসে থাকলে কিভাবে চলবে? খাবো না আমি? তুমি তো আমার খাবার আনোনি ‘

‘সেই চিন্তা তোমাকে করতে হবেনা, চুপচাপ বসো’

মেঘ আরিশের পাশে বসলো, বাকিরা আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে যে আরিশ কি করতে চাইছে?

‘ আমি এতো অয়েলি খাবার খাবো না, তুমি খেয়ে নাও। এমনিতেও তোমার হাতের চোট এখনও পুরোপুরি ঠিক হয়নি। আই থিঙ্ক, আমার তোমাকে খাইয়ে দেওয়া উচিত ‘

তিশা সবে তখন খাবার মুখে দিয়েছে, আরিশের কথা শুনে খাবার ওর গলায় আটকে কাশি উঠে যায়। মেঘ দ্রুত তিশার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলো। বাকি দুজন হা হয়ে গেছে আরিশের কথা শুনে, যে মেয়েটাকে দুদিন আগে একবিন্দু সহ্য করতে পারতো না তার জন্যে আরিশের এতো দরদ দেখে অবাক না হয়ে পারছে না!

চলবে…